১৮. শেষ শাসক বংশ

শেষ শাসক বংশ

মধ্যযুগীয় আরব-জগতের সর্বশেষ বংশ মামলুকরা সবদিক থেকে অসাধারণ ছিল। মুসলিম-ইতিহাসে ছাড়া এমন একটি জাতির উত্থান ও প্রসার কল্পনার অতীত ছিল বলেই মনে হয়। মামলুক শব্দের মানে ‘অধিকৃত।’ মামলুকরা দাস বংশীয় লোক ছিল? বহু গোষ্ঠীর, বহু জাতির বহু গোলাম পরদেশে এসে এক সম্মিলিত সামরিক শাসক-শক্তি গড়ে তোলে। বহু শতাব্দী হতে আরব সমাজ জীবনে যে অনাচার অব্যাহত গতিতে চলে আসছিল, এদের সৃষ্টি তারই অনিবার্য ফল । কিন্তু এরা কীর্তিমান লোক ছিল এবং বিলীয়মান আরব সাম্রাজ্যের ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে স্থান পাওয়ার এরা যথার্থ অধিকারী।

মামলুকরা তাদের সিরীয়-মিসরীয় রাজ্য হতে বাকী ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করে। তারা হালাকু ও তৈমুরের দুর্দান্ত লুণ্ঠনপ্রবণ অনুচরদের অগ্রগমন চিরদিনের তরে রুদ্ধ করে দেয়; নইলে মঙ্গোলরা সমগ্র মিসর ও পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রবাহ-পথ সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দিতে পারত। সিরিয়া ও ইরাকের উপর যে ধ্বংসের প্লাবন নেমে আসে, এদেরই জন্য মিসর সে প্লাবনের হাত হতে বেঁচে যায় এবং আরবের বাইরে সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক স্থায়িত্বের ব্যাপারে যে নিরবচ্ছিন্নতা আর কোন রাজ্য ভোগ করে নাই, মিসর তা-ই ভোগ করে। প্রায় পৌণে তিন শতাব্দী (১২৫০–১৫১৭) পর্যন্ত মামলুকরা সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক অশান্ত একটা এলাকার উপর আধিপত্য করে এবং সব সময়েই নিজেদের গোষ্ঠিগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলে। সত্য বটে, তারা মোটামুটি রক্তপিপাসু ছিল, তথাপি চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পের প্রসারে তাদের অবদান যেকোন সভ্য বংশের পক্ষে গৌরবের কথা হতে পারত। তাদেরই জন্য আজো মুসলিম জগতের মধ্যে সৌন্দর্য নিকেতন হিসেবে কায়রো একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। অবশেষে ১৫১৭ সালে ওসমানীয় বংশের সলীম তাদের উৎখাত করলে আরব খিলাফতের ধ্বংস্তূপ হতে উখিত বংশাবলীর শেষ বংশের দীপ নিভে গেল–আর পথ খোলাসা হয়ে গেল এক অনারব খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য। এরা ওসমানীয় তুর্ক।

মামলুক সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং প্রকৃতপক্ষে সে বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বায়বার্স। মিসর-শাসক এই ক্ষুদ্র বংশ বাগদানের খলীফাদের অনুসরণে বিদেশী গোলাম এনে নিজেদের দেহরক্ষী নিযুক্ত করে এবং এর ফলও পরিণামে একই হয়। মনিবের তুলনায় অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন, অধিকতর কর্মঠ গোলামেরা সেনাপতি হয় এবং এরপর তারা দখল করে সুলতানের সিংহাসন। বায়বার্স আসলে এক তুর্ক গোলাম ছিলেন। পদোন্নতি হওয়ার পর সুলতানের দেহরক্ষীদের এক দলের নেতা হন। তারপর সেই পদে কাজ করে শেষ পর্যন্ত মিসরে সর্বোচ্চ পদ অধিকার করেন। অবশ্য ও পদে উন্নীত হতে তাকে অনেক শক্তি প্রয়োগ, অনেক খুন খারাবী করতে হয়; তবে পতনমান আরব সাম্রাজ্যে প্রতিভার সামনে যে পথ খোলা, তিনি তা-ই গ্রহণ করেন। এই মামলুক বংশে উত্তরাধিকারের কোন নীতি ছিল না; অমন নীতি আছে বলে কোন দাবীও ছিল না। সর্বাপেক্ষা যে শক্তিশালী, সে-ই টিকে যেত; কিন্তু প্রায় তিনশ’ বছর ধরেই এই শক্তিশালীরা হয় গোলাম, না হয় গোলামের বংশধর ছিল। বায়বার্স নিজে ছিলেন সম্বা, গায়ের রঙে কালো, গলার আওয়াজে শক্তিমান–সাহসী, কর্মঠ নেতৃত্বের প্রকৃত গুণের অধিকারী।

ফিলিস্তিনে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি প্রথম যশ অর্জন করেন; কিন্তু তাঁর আসল যশ প্রধানতঃ নির্ভর করে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইয়ের উপর। আমরা আগেই বলেছি, এই সব অভিযানই ফিরিঙ্গী দুশমনদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে নেয়। ইতিমধ্যে তার সেনাপতিরা তার আধিপত্য পশ্চিমে বারবার এলাকা পর্যন্ত এবং দক্ষিণে নুবীয়া’র উপর প্রতিষ্ঠিত করে। এইরূপে এ দুটি ভূখণ্ড স্থায়ীভাবে মিসরের সুলতানের অধীনে আসে।

সামরিক নেতা ছাড়া বায়বার্সের আরো অনেক কৃতিত্ব ছিল। তিনি কেবল যে সৈন্যদল সংগঠন করেন, নৌবাহিনী পুনর্গঠিত করেন এবং সিরিয়ার দুর্গমালা দৃঢ়তর করেন এমন নয়, উপরন্তু তিনি বহু খাল কাটেন, বন্দরসমূহেরও উন্নতি সাধন করেন এবং কায়রো ও দামেস্কের মধ্যে দ্রুতগামী ঘোড়ার ডাক বসান। ফলে মাত্র চারদিনের মধ্যেই ডাক চলাচল করতে পারত। প্রত্যেক মঞ্জিলে ডাক বদলানোনার জন্য ঘোড়া তৈরী থাকত। সুলতান একই সপ্তাহে উভয় রাজধানীতে পলো খেলতে পারতেন। সাধারণ ডাক ছাড়া মামলুকরা কবুতরের বংশ পরিচয় পাকা খাতায় লেখা থাকত। বায়বার্স জনহিতকর কাজে উৎসাহ দেন, মসজিদের সৌন্দর্য বিধান করেন এবং ধর্মীয় ও দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। স্থাপত্য শিল্পে তাঁর কীর্তিসমূহের মধ্যে তাঁর নামীয় বিরাট মসজিদ ও মাদ্রাসা উভয়ই বেঁচে আছে। নেপোলিয়ন মসজিদটিকে দুর্গে পরিণত করেন এবং পরবর্তীকালে ইংরেজ সৈন্যরা এতে রসদ-সরবরাহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। মিসরে সুলতানদের মধ্যে বায়বার্সই প্রথম চার মাজহাবের জন্য চারজন হাকিম নিযুক্ত করেন এবং মিসরীয় হজযাত্রীদের জন্য স্থায়ী এবং সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ধর্মে তাঁর অটল বিশ্বাস ও উৎসাহ এবং জেহাদে তিনি ইসলামের যে গৌরব ফিরিয়ে আনেন, উভয় মিলে তাকে হারুনর রশীদের সমতুল্য করে তোলে। উপকাহিনীতে সালাহ্উদ্দীনের চেয়েও উচ্চতর কীর্তির অধিকারী হিসেবে তাকে বর্ণিত করা হয়। তাঁর জীবনের রোমাঞ্চকর বিচিত্র কাহিনী এবং প্রাক-ইসলামী আনৃতার আখ্যান আর-প্রাচ্যে আজো আরব্য-উপন্যাসের চেয়ে অধিকতর লোকপ্রিয়।

মঙ্গোল ও ইউরোপীয় শক্তিসমূহের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন তাঁর শাসনের এক বৈশিষ্ট্য ছিল। সুলতান হওয়ার পরই তিনি ভষ্ম উপত্যাকার মঙ্গোলদের প্রধান খানের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। আনজু’র চার্লস, সিসিলীর রাজা, আরাগনের জেমস্ ও সেভিলের আলফসো’র সঙ্গে তিনি বাণিজ্যিক সন্ধি-সূত্রে আবদ্ধ হন।

বায়বার্সের রাজত্বের একটি অভিনব দিক ছিল, তার পক্ষ হতে কয়েকজন আব্বাসীয় খলীফা নির্বাচন। এঁরা নামে মাত্র খালীফা ছিলেন–কিন্তু খলীফা পদের ক্ষমতা তাদের কিছুই ছিল না। সুলতানের উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে সত্যিকার সুলতান বলে স্বীকার করে নেওয়া, লোক-চক্ষে তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে প্রতিভাত করা এবং শীয়াদের ষড়যন্ত্র পথে বাধা জন্মানো। কারণ, ফাতেমীয় খলীফাদের আমল হতে মিসরে এদের ষড়যন্ত্রের আর অন্ত ছিল না। শেষ আব্বাসীয় খলীফার এক পিতৃব্য বাগদাদের ধ্বংসানুষ্ঠান হতে রেহাই পেয়েছিলেন। ১২৬১ সালের জুন মাসে বায়বার্স এঁকে দামেস্ক হতে আসতে দাওয়াত করে পাঠান এবং মহাধুমধামে তাকে খলিফা পদে অভিষিক্ত করেন। পেনশনভোগী ভাবী খলীফাকে দামেস্ক হতে রাজকীয় সম্মানের সঙ্গে আনয়ন করা হয়; এমনকি খৃস্টান পুরোহিতগণ বাইবেল ও ইহুদী পুরোহিতগণ তৌরাত উঁচু করে ধরে সঙ্গে আসে এবং আইনজ্ঞ আলিমরা অনুসন্ধান করে ভাবী-খলীফার খান্দান সম্বন্ধে অনুকূল সনদ দেন। প্রতিদানে ক্রীড়ানক খলীফা যথারীতি সুলতানকে মিসর, সিরিয়া, হেজাজ, ইয়ামন ও ইউফ্ৰেতীয় অঞ্চলের উপর শাসন-কর্তৃত্ব দান করেন। এর তিন মাস পর বায়বার্স তাঁর খলীফাকে বাগদাদে গদীনশীন করার উদ্দেশ্যে কায়রো হতে বের হন; কিন্তু দামেস্কে উপস্থিত হয়ে তিনি তাঁর খলীফাকে বাগদাদ অভিযানের ব্যাপারে তার অদৃষ্টের উপর ছেড়ে দেন। বাগদাদের মঙ্গোল গভর্নর হতভাগ্য খলীফাকে মরুভূমিতে আক্রমণ করে। তারপর সে খলীফার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু একের পর এক এমনি নামকাওয়াস্তে খলীফা আড়াইশ’ বছর পর্যন্ত খলীফার গদীতে বসেন। দেশের মুদ্রায় তাদের নাম থাকত আর মিসর ও সিরিয়ার জুমার খোত্বায় তাঁদের নাম উল্লিখিত হত; এতেই তারা তুষ্ট থাকতেন। ১৫১৭ সালে ওসমানীয় বংশের সুলতান সলীম যখন মামলুকদের হাত হতে মিসর কেড়ে নেন, তখন তিনি এ বংশের শেষ খলীফা আল-মুতাওয়াক্কিলকে সঙ্গে নিয়ে যান।

যে গর্বিত বিজয়-দৃপ্ত শাসকেরা সিরিয়া হতে ফিরিঙ্গী আধিপত্যের নাম নিশানা মুছে ফেলেন এবং সাফল্যের সঙ্গে মঙ্গোল প্লাবনের সম্মুখে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ান, তাঁদেরই অধীনে মিসরের ইতিহাস শুরু হয়। যুগের শেষ ভাগে সামরিক চক্রের শাসন, প্রবল সম্প্রদায়সূহের মধ্যে কলহ, গুরু কর-ভার, ধন-প্রাণের নিরাপত্তার অভাব, ঘন ঘন প্লেগ, দুর্ভিক্ষ ও বিদ্রোহ–সমস্ত মিলে মিসর ও সিরিয়ার সর্বনাশ সাধনের বেশি কিছু বাকী ছিল না। নীলনদের উপত্যকায় কুসংস্কার ও ভোজবাজি বিশেষ রকমে প্রবল ছিল। সঙ্গে সঙ্গে গোঁড়া ধর্ম-মতও জয়লাভ করে। এই অবস্থায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন উচ্চ-শ্রেণীর সাধনাই সম্ভবপর ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, অষ্টম শতাব্দী হতে আরব জগতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে শীর্ষস্থান অধিকার করে আসছিল, এয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে তা হারিয়ে ফেলে। সর্বত্রই এ দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অনেক যুগব্যাপী কঠোর সাধনা এবং প্রভুত্ব সম্পদ জাত নৈতিক অধঃপতন মনে ক্লান্তির সঞ্চার করেছে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগের পর আরবরা বিজ্ঞানের মাত্র দুটি শাখায় তাদের পূর্ব নেতৃত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয় : গ্রহ-বিজ্ঞান, গণিত (ট্রিগনোমেট্রী বা ত্রিকোণমিতি সহ) এবং চিকিৎসাশাস্ত্র বিশেষ করে চক্ষু-চিকিৎসা বিজ্ঞান। চিকিৎসা জগতে এ যুগে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ইবনুল নাফিস। ইনি দামেস্কে অধ্যয়ন, করেন এবং কায়রোর একটি হাসপাতালে দীর্ঘকাল প্রধান চিকিৎসকের কাজ করে ১২৮৯ সালে দামেস্কেই ইন্তিকাল করেন। দেহে রক্ত চলাচল পদ্ধতি আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় পর্তুগীজ পণ্ডিত সার্ভেটাসকে; কিন্তু তাঁর তিনশ’ বছর আগে ইবনুল নাফিস এ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। আমরা এখন যাকে যৌন-সাহিত্য বলি, এ যুগে এই শ্রেণীর প্রচুর পুস্তক লিখিত হয়। আরবী সাহিত্য বরাবরই প্রধানতঃ পুরুষের সাহিত্য; এ সাহিত্যে এমন অজস্র উপাখ্যান, ব্যঙ্গ এবং মন্তব্য আছে, যা আজকে আমাদের কানে অশ্লীল শোনায়।

মামলুকরা প্রায়শঃ খুন-খারাবীতে লিপ্ত থাকত; অথচ সত্যি এ এক অপূর্ব বিস্ময়, তাদের আমলে যে উচ্চাঙ্গের চারুকলা ও স্থাপত্য শিল্প প্রভূত পরিমাণে বিকাশ লাভ করে, টলেমীয় ও ফেরাউনীয় যুগের পর মিসরের ইতিহাসে তার আর তুলনা নাই। এয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোল আক্রমণে বিতাড়িত হয়ে মসুল, বাগদাদ ও দামেস্ক হতে বহু মুসলমান শিল্পী ও কারিগর মিসরে আশ্রয় গ্রহণ করে। এদের সংস্পর্শে মামলুক স্থাপত্য রীতি সিরীয়-ইরাক আদর্শ নবভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ক্রুসেড শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার উত্তরে পাথর নির্মিত ইমারতের প্রাধান্য লাভের সুযোগ ঘটে এবং গম্বুজ তৈরীর কাজে ইটের বদলে পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। হাল্কা গম্বুজ অপূর্ব সাজে সজ্জিত হতে থাকে। সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন ও বিচিত্র বর্ণে পাথর সাজিয়ে দালান-কোঠার সৌন্দর্য বর্ধন এ যুগের এক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। স্থাপত্য শিল্পে জ্যামিতিক রেখা ও কুফী হরফের আলঙ্কারিক প্রয়োগ এ সময় বিশেষ বিকাশ লাভ করে। (মুসলমানদের সকল যুগেই স্পেন ও পারস্যের তুলনায় মিসর ও. সিরিয়ায় জীব-জন্তুর চিত্র কম ব্যবহৃত হয়েছে।) সুখের বিষয়, মামলুক স্থাপত্য রীতির প্রকৃষ্টতম নমুনা আজো টিকে আছে এবং পণ্ডিত ও ভ্রমণকারী উভয়ের জন্যই সে নমুনা এক পরম আকর্ষণের বস্তু।

চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে মামলুকদের কাহিনী সিরীয়-মিসরীয় ইতিহাসের শোচনীয়তম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। সুলতানদের কয়েকজন ছিলেন বিশ্বাসঘাতক ও রক্তপিপাসু; কয়েকজন ছিলেন অকর্মন্য–অধঃপতিত, আর বেশির ভাগই ছিলেন অমার্জিত। ১৪১২ হতে ১৪২১ সাল পর্যন্ত সুলতান ছিল মাতাল। তাকে এক সার্কেণীয়ার ব্যবসায়ীর নিকট হতে খরিদ করা হয়েছিল। ইনি কতকগুলি চরম দুর্নীতির কাজ করেন। অন্য এক সুলতান আরবী ভাষা জানতেন না। তিনি তার এক কঠিন ব্যারাম ভাল না করতে পারার জন্য তাঁর দুই জন চিকিৎসকের শিরচ্ছেদ করেন। ১৯৫৩ সালে যিনি রাজত্ব করেন, তিনি লিখতেও জানতেন না–পড়তেও জানতেন না। সরকারী দলীল-পত্রে তার সেক্রেটারী তার নাম লিখে দিত; তিনি তার উপর হাত ঘুরাতেন। তাঁর চরিত্রগত জঘন্য দোষের কথা বলাবলি হত। আব্বাসীয়দের কুখ্যাত গিমান প্রথা মামলুকদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। এক খলিফা কেবল নিরক্ষর ছিলেন না, পাগলও ছিলেন। আর এক খলীফা (যাকে পঞ্চাশ দিনার দামে খরিদ করা হয়েছিল) এক আলকিমিয়াবিদ বাজে ধাতুকে সোনা করে দিতে পারে নাই বলে তার চোখ তুলে এবং জিভ কেটে ফেলেন।

সুলতানদের স্বার্থ-প্রণোদিত নীতির ফলে দেশের আর্থিত অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে। যেমন এক সুলতান পাক-ভারত হতে মসলা আমদানী বন্ধ করে দেন; তারপর বাজারের সমস্ত মসলা নিজে সস্তা দরে কিনে তাঁর প্রজাদের মধ্যেই চড়া দরে বিক্রি করে প্রচুর লাভবান হন। তিনি চিনির একচেটিয়া ব্যবসায় শুরু কনে এবং অতিরিক্ত লাভের আশায় কিছুকাল আখের আবাদ পর্যন্ত বন্ধ করে দেন। তার আমলে মিসর ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে এক ভয়াবহ প্লেগ দেখা দেয়। এই ব্যারামের ঔষধের জন্য চিনির প্রচুর চাহিদা হয়। কালো মৃত্যুর মত সর্বগ্রাসী না হলেও এ প্লেগে তিন মাসের মধ্যেই নাকি এক রাজধানীতেই তিন লক্ষ লোক মারা যায়। মানুষের পাপের জন্য এ প্লেগের আবির্ভাব ঘটেছে এই মনে করে তিনি মেয়েদের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন এবং খৃস্টান ও ইহুদীদের উপর নতুন কর বসিয়ে কাফফারা আদায়ের চেষ্টা করেন।

রাজ-শোষণ কেবল অমুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কর ধার্যের কোন বিধিবদ্ধ নীতি না থাকায় সুলতানরা তাদের অভিযান, জমকালো দরবারের অতিরিক্ত খরচ এবং বড় বড় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রভৃতির জন্য প্রজাপুঞ্জের নিকট হতে জোর-জুলুম করে টাকা আদায় করতেন আর সেই সব সরকারী আমলাদের কাছ থেকেও অর্থ আদায় করা হত, যারা প্রজাদের শোষণ করে স্ফীত হয়েছে। মরুর লণ্ঠনপরায়ণ বেদুঈনরা মাঝে মাঝে নীল উপত্যাকার কৃষকদের উপর হানা দিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করত। প্লেগের মত মাঝে মাঝে পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাব হত। দুর্ভিক্ষের আবির্ভাব প্রায় স্বাভাভিক হয়ে দাঁড়ায় এবং নীলনদে বান কম হওয়ার দরুন প্লেগ ও জলাভাব দেখ দিলে দুর্ভিক্ষ রুদ্র মূর্তি ধারণ করত। হিসেবে দেখা যায়, মামলুকদের যুগে মিসর ও সিরিয়ায় তিন ভাগের দুই ভাগ লোক কমে যায়।

এ যুগের শেষভাগে কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্যাপার দেশের দারিদ্র্য ও দুঃখ বৃদ্ধির কারণ হয়ে ওঠে। ১৪৯৭ সালে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কোডি-গামা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে পাক-ভারতে যাওয়ার পথ আবিষ্কার করেন। সিরীয়-মিসর সাম্রাজ্যের পক্ষে এ ছিল এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এরপর হতে কেবল যে লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরে মুসলমানদের জাহাজ পর্তুগীজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় নৌবাহিনী কর্তৃক ঘন ঘন আক্রান্ত হতে থাকে এমন নয়, আস্তে আস্তে পাক-ভারত ও আরবে উৎপন্ন মসলা ও অন্যান্য দ্রব্যের ব্যবসায়ের বেশীর ভাগেরই সিরিয়া ও মিসরে বন্দরে চালান বন্ধ হয়ে যায়। এইরূপে জাতীয় সম্পদের একটা বড় উৎস চিরতরে শুষ্ক হয়ে পড়ে।

মামলুকরা অত্যাচারী ছিল। কিন্তু তাদের চেয়েও এক বড় বর্বর পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সিরিয়ার উপর নিপতিত হয়। ১৩৩৬ সালে ট্রান্স অকশিয়ানাতে তৈমূরলংয়ের জন্ম হয়। তাঁর একজন পূর্বপুরুষ চেঙ্গীজ খার পুত্রের উজীর ছিলেন; কিন্তু তৈমুরলংয়ের পরিবার স্বয়ং চেঙ্গীজের বংশধর বলে দাবী করত। একজন লেখক পি করে বলেন যে, তৈমুর এক রাখালের ছেলে ছিলেন এবং প্রথম বয়সে লুটপাট করে খেতেন। একবার একটি ভেড়া চুরির সময় তিনি পায় আঘাত পেয়ে ন্যাড়া (লং) হন; এই জন্য তার নাম হয় তৈমুর লং। ১৩৮০ সালে তৈমুর তার তাফ্‌তার বাহিনী নিয়ে দিগ্বিজয়ে বের হন এবং আফগানিস্তান, পারস্য, ফারিস ও কুর্দীস্তান দখল করেন। ১৩৯৩ সালে তিনি বাগদাদ অধিকার করেন এবং পর বছর মেসোপটেমিয়া তার পদদলিত হয়। সালাহউদ্দীনের জন্মস্থান তারিতে। তিনি নিহতদের মাথার খুলি দিয়ে এক পিরামিড নির্মাণ করেন। ১৩৯৫ সালে তিনি ভগা নদী অঞ্চল আক্রমণ করেন এবং মস্কো অধিকার করে এক বছর শাসন করেন। তিন বছর পর তিনি উত্তর ভারত লুণ্ঠন করেন এবং দিল্লীর ৮০ হাজার বাসিন্দাকে হত্যা করেন।

১৪০১ সালে তৈমুর দুরন্ত তুফানের মত সিরিয়ার উত্তর ভাগের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনদিন পর্যন্ত আলেপ্পোকে লুণ্ঠনের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ২০ সহস্রাধিক মুসলিম বাসিন্দার মাথা দিয়ে তৈমুর দশ হাত উঁচু ও বিশ হাত পরিধির একটি টিপি তৈরী করেন। টিপিতে মাথাগুলির মুখ বাইরের দিকে ছিল। শহরের স্কুল ও মসজিদের অমূল্য ইমারতসমূহ বিধ্বস্ত করা হয়; আর কখনো এগুলি পুনর্নির্মিত হয় নাই। ক্রমে হামা, হিমস ও বালাবেকের পতন হয়। মিসরীয় সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে দামেস্ক দখল করা হয়। দামেস্কোর কেল্লা মাসেক কাল শহর রক্ষা করে। তৈমুরের বাহিনী শহর লুটপাট করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তৈমুর নামে মুসলমান ছিলেন। শীয়া মতের দিকে তার সামান্য ঝোঁক ছিল। তিনি আলেমদের ডেকে এক ফতোয়া আদায় করেন যে, তাঁর কাজ শরীয়ত সঙ্গত। উমাইয়া মসজিদের দেয়াল ছাড়া তার আর কিছুই রক্ষা পায় নাই। ইতিমধ্যে তৈমুর বাগদাদে তার কয়েকজন আমলার নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দামেস্ক হতে বাগদাদ পানে ধাবিত হন এবং সে শহরের বুকে এ বর্বর বিজেতা মানুষের মাথা দিয়ে একশ’ পঁচিশটি স্তম্ভ তৈয়ার করেন।

পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তৈমুর এশিয়া মাইনর আক্রমণ করেন এবং ১৪০২ সালের ২১ জুলাই আঙ্কারার ময়দানে ওসমানীয় বাহিনীকে পরাজিত করে সুলতান প্রথম বায়াজীদকে বন্দী করেন। ব্রুসা ও স্মার্না তার অধিকার আসে। মামলুক রাজ্যের সৌভাগ্যক্রমে এর দুই বছর পর চীন বিজয়ের পথে তৈমুরের মৃত্যু হয়। তার বংশধরগণ আত্মকলহে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

ঘোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ওসমানীয় তুর্করা আরব-সাম্রাজ্যের উপর চরম আঘাত হানে। ওসমানীয় তুর্কদের আদি বাসভূমি ছিল মঙ্গোলিয়া; তারা মধ্য এশিয়ায় ইরানী কওমদের সঙ্গে বিয়ে-শাদী করে তাদের সঙ্গে মিশে পড়ে। তারপর এশিয়া মাইনরে এসে তাদের জাতি ভাই সালজুকদের ধীরে ধীরে স্থানচ্যুত করে চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে একটি রাজ্য স্থাপন করে। ১৯৮১ সালে মিসরীয় সুলতানদের পক্ষে ওসমানীয় সমস্যা জটিল হয়ে ওঠে। এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ার সীমান্তে উভয়েরই সামান্ত রাজা ছিল। এদের মধ্যে যে যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু হয়, তাতেই এ দুই শক্তির ভিতরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমে বেড়ে চলে এবং অবশেষে ১৫১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি আলেপ্পোর সন্নিকটে উভয় শক্তির মধ্যে রণ-দামামা বেজে ওঠে। মামলুকরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। তুর্কী সৈন্যরা কামান, বন্দুক ও অন্যান্য দূর-পাল্লার অস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল। মামলুক বাহিনীতে বেদুঈন ও সিরীয় যোদ্ধা ছিল; তারা এসব অস্ত্র ব্যবহারকে অবজ্ঞার চোখে দেখত। কিছুকাল আগ হতেই তুর্করা বারুদ ব্যবহার করে আসছিল; কিন্তু সিরীয় মিসরীয়রা বাবা আদমের আমলের বিশ্বাসই আকড়ে ধরে বসেছিল যে, যুদ্ধে ব্যক্তিগত সাহস ও শৌর্যই জয় পরাজয় নির্ধারণ করে। ওসমানীয় সুলতান সলীম বিজয়ী বেশে আলেপ্পোতে প্রবেশ করেন। তাকে মামলুক জুলুম হতে মুক্তিদাতা হিসেবে অধিবাসী অভ্যর্থনা জানায়। সিরিয়া তুর্কদের হাতে চলে যায়। সিরিয়া হতে তুর্কবাহিনী মিসরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক বছরের মধ্যে মামলুক রাজ্যের অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যায়। সুলতান সালাহ্উদ্দীনের সময় হতে কায়রো প্রাচ্য ইসলামের কেন্দ্র এবং আরব সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল; এখন সে কায়রো সামান্য প্রাদেশিক নগরে পরিণত হয়। মক্কা ও মদীনা স্বভাতঃই ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে পড়ে। মিসরের ইমামরা জুমার নামাজের খোতবায় নিম্ন ভাষায় সুলতান সলীমের জন্য দোয়া করেন?

“হে প্রভু! তুমি আমাদের সুলতানকে রক্ষা করো : ইনি সুলতানের পুত্র সুলতান, উভয় মহাদেশ ও উভয় সমুদ্রের শাসক, উভয় বাহিনী উৎখাতকারী, উভয় ইরাক বিজেতা, উভয় পবিত্র শহরের খাদেম বিজয়ী ম্রাট সলীম শাহ্। হে প্রভু! তাঁকে তোমার অমূল্য সাহায্য মঞ্জুর কর। হে দো-জাহানের মালিক! তুমি তাঁকে গৌরবময় বিজয় লাভে সাহায্য কর।”

শেষ ক্রীড়নক খলীফা সত্যিই তাঁর খিলাফত-পদ তুর্ক সুলতানের নিকট হস্তান্তর করেছিলেন কিনা, তার যথেষ্ট প্রমাণ নাই। তবে তিনি সে পদ দিয়ে থাকুন আর না-ই থাকুন, এ কথা নিঃসন্দেহ যে, কন্সটানটিনোপলের তুর্ক ম্রাট ধীরে ধীরে খলীফা-পদের সমস্ত সুযোগ এবং অবশেষে খলীফা উপাধি আত্মস্থ করেন। সলীমের পরবর্তী সুলতানদের কেউ কেউ নিজেদের খলীফা বলে পরিচয় দিলেও এবং অন্যরা তাদের এই নামে সম্বোধন করলেও, তাদের খলীফা শব্দের ব্যবহার কেবল সম্মানসূচক ছিল এবং তাদের রাজ্যের বাইরে তারা খলীফা বলে স্বীকৃত হতেন না। ১৭৭৪ সালে সম্পাদিত রুশ-তুর্ক সন্ধি-পত্ৰই প্রথম জ্ঞাত আন্তঃরাষ্ট্রীয় দলীল, যাতে ওসমানীয় সুলতানকে খলীফা ও মুসলিম-জগতের ধর্মীয় নেতা বলে স্বীকার করা হয়েছে।

কন্সটানটিনোপলের সুলতান-খলীফা ইসলামের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী শাসনকর্তা হয়ে ওঠেন; কেবল বাগদাদের নয়, বাইজেন্টিয়ামের সম্রাটদেরও তিনি উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করেন। মামলুক-শক্তির পতন এবং বসফরাসের উপর ওসমানীয়দের আধিপত্য স্থাপনের ফলে ইসলামী শক্তির কেন্দ্র পশ্চিমে স্থানান্তরিত হয়। ঠিক এই সময়ই আমেরিকা ও উত্তমাশা অন্তরীপ আবিষ্কার এক নবযুগের সূচনা করে। আরব খিলাফতের ইতিহাস এবং আরব সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ হতে মধ্যযুগে যে সব মুসলিম বংশের অভ্যুদয় হয়, তাদের কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে। আরব-জগতে ওসমানীয় আধিপত্য শুরু হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *