প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

১৮. আতাহুয়ালপা যখন পিজারোর ভোজসভায়

আতাহুয়ালপা যখন পিজারোর ভোজসভায় আপ্যায়িত হচ্ছেন ঘনরাম তখন কামালকা নগরের বাইরে উষ্ণ প্রস্রবণের কাছে ইংকা নরেশের নিজের বিশ্রাম-শিবিরের একটি বেদির ওপর একলা বসে আছেন।

এই জায়গাটিতে এসে বসবার আগে বহুক্ষণ নগরের বাইরের প্রান্তরে তিনি প্রায় অপ্রকৃতিস্থের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন। পিজারোর এই পৈশাচিক শঠতায় তাঁর সমস্ত শরীর মন তখন আগুনের মতো জ্বলছে। কাক্‌সামালকা শহরে কিছুক্ষণ আগে যে হত্যা-তাণ্ডব হয়ে গেল তাতে তাঁর বিন্দুমাত্র হাত নেই। কিন্তু প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও এই অবিশ্বাস্য পরিণামের নিমিত্তমাত্র হিসাবেও তাঁর কিছুটা দায়িত্বও অস্বীকার করবার নয়। সূর্য কাঁদলে সোনার দেশের অভিযান সফল করবার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি তো সত্যিই তাঁর ছিল না।

সে সাফল্যের এই চেহারা শুধু যদি তিনি কল্পনা করতে পারতেন! নির্মম পৈশাচিকতায় এই সোনার দেশে রক্তগঙ্গা বহাবার তিনি সহায় হবেন জানলে কাপিন সানসেদোর গণনা সফল করবার জন্য এমন ব্যাকুল তিনি নিশ্চয় হতেন না। কাপিন সানসেদোর গণনায় এত কিছু ধরা পড়া সত্ত্বেও এই ভয়ংকর নিয়তির কোনও আভাস কেন পাওয়া যায়নি?

এই নিয়তি ঘটনার স্রোতকে কোন অমোঘ সর্বনাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তা তিনি জানেন না। জানতেও তিনি চান না। ফল যাই হোক, তাঁর জীবনের একমাত্র কাজ এখন এই নিয়তির গতিতে বাধা দেওয়া।

এখনও হয়তো একেবারে হতাশ হবার কিছু হয়নি। সর্বনাশা ঘটনা-প্রবাহের মুখ ফিরিয়ে এখনও হয়তো জল্লাদ পিশাচদের অত্যাচারের উপযুক্ত জবাব দেওয়া যায়।

অভ্রভেদী পর্বতশৃঙ্গের দেশের সমগ্র সাম্রাজ্য-শক্তির দরকার নেই। এই কাক্‌সামালকা শহরের ইংকাবাহিনী আর নাগরিকদের একবার রুখে দাঁড় করাতে

পারলেই এসপানিওল পিশাচেরা ফুৎকারে উড়ে যাবে এ পর্বতশিখর থেকে।

ইংকা নরেশের সেনাবাহিনী আর কাক্‌সামালকার নাগরিকেরা তখন আতঙ্কে

উন্মত্ত হয়ে শহর ছাড়িয়ে দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালাতে ব্যস্ত।

ঘনরাম ইংকা বাহিনীর একজন সৈনিককেই ধরে থামিয়েছেন। কোথায় পালাচ্ছ? লজ্জা করে না তোমার! বলেছেন তীব্র কঠিন স্বরে।

ঘনরামের হাত ছাড়াবার চেষ্টায় আকুলি-বিকুলি ত্রতে করতে লোকটা পশুসুলভ একটা আর্তধ্বনি ছাড়া একটা স্পষ্ট শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি। আবছা অন্ধকারেও লোকটার মুখে কসাই-এর হাতে-পড়া মেষশিশুর কাতর ভয়-বিহ্বলতা শুধু দেখা গিয়েছে।

তাকে ছেড়ে দিয়ে আরও অনেককে ঘনরাম থামিয়েছেন। দু-একজন তাঁর কথার জবাবও দিতে পেরেছে।

সে জবাব শুনে হতাশায় স্তব্ধ হয়ে গেছেন ঘনরাম।

আকাশের বজ্র যাদের অস্ত্র, বিদ্যুৎগতি দানবীয় পশু যাদের বাহন, গায়ের বর্ণ যাদের তুষারের মতো শুভ্র সেই অতিমানবদের বিরুদ্ধে যোঝবার চেষ্টাই বাতুলতা!আতঙ্কবিহ্বল আর্তনাদ হিসাবে এই বিশ্বাসই নানাভাবে ধ্বনিত হয়েছে। নানাজনের মুখে।

বহুক্ষণ পর্যন্ত একজনকেও ফেরাবার চেষ্টায় বিফল হয়ে ঘনরাম অবশেষে এই বেদির ওপর এসে বসেছেন ক্লান্ত হতাশায়।

অবসন্ন হতাশায় সারারাতই হয়তো ঘনরাম সেই উষ্ণ প্রস্রবণের কাছে ইংকা নরেশের বিশ্রাম-শিবিরের পাষাণ বেদিকার ওপর বসে থাকতেন।

কিন্তু তা থাকা তাঁর হয়নি।

হঠাৎ রাত্রির অন্ধকারে অদূরে তিনি একটা তীব্র আর্তনাদ শুনে অস্থির চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। এই ভয়ংকর পিশাচ-তাণ্ডবের রাত্রে তীব্র কোনও আর্তনাদ সচকিত বিস্মিত করবার মতো কিছু নয় অবশ্য। এর আগে বহু আর্তনাদই তিনি শুনেছেন কাছে। দূরে, রাত্রির আকাশে যা আতঙ্কের শিহর তুলেছে।

সে সব আর্তনাদ শুনে উত্তেজিত হলেও বিশেষ কিছু করতে তিনি পারেননি। আর্তধ্বনির উৎসস্থান অনুমান করে কয়েক পা যেতে-না-যেতেই সে ধ্বনি মিলিয়ে গেছে। বেশির ভাগ আর্তনাদের উৎপত্তি স্থান খুঁজে বার করা সম্ভব হয়নি। দু-একবার তা পারলেও সেখানে উপস্থিত হয়ে কোনও হতভাগ্য ইংকা সৈনিক কি প্রজার মৃতদেহই শুধু পড়ে থাকতে দেখেছেন যার অসহায় নিরস্ত্র দেহের ওপর বীর এসপানিওল রিসালাদার ঘোড়ার ওপর থেকে তার ইস্পাতের তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করে গেছে।

এবারে শুধু তীব্র আর্তনাদ শুনেই সুতরাং তিনি বিচলিত হয়ে ওঠেননি। বিচলিত হয়েছেন এ আর্তনাদ নারীকণ্ঠের বলে।

শুধু নারীকণ্ঠের বললেও তার যথার্থ পরিচয় দেওয়া হয় না। সুধাময় অপার্থিব কোনও বিহঙ্গই যেন মানবীর কণ্ঠ অনুকরণ করে এ আতধ্বনি তুলেছে!

পুরুষের গলার কাতর চিৎকার এ পর্যন্ত যা শোনা গেছে তা দীর্ঘ হয়নি কোনওবারই। একবার কি বড়জোর দুবারের পরই তা স্তব্ধ হয়ে গেছে নিহত হতভাগ্যের রুদ্ধকণ্ঠে।

এ আর্তধ্বনি কিন্তু ক্ষীণ হয়ে এলেও একেবারে থামেনি। হত্যা নয়, হরণ করার উদ্দেশ্যেই কোনও নারীকে যে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা বোঝা গেছে করুণ আর্তনাদের এই ধরন থেকে।

আর্তনাদ কোন দিক থেকে আসছে তা অনুমান করতে দেরি হয়নি ঘনরামের। তৎক্ষণাৎ সেই দিকে তিনি ছুটে গেছেন, কিন্তু বিপন্নাকে সত্যিই উদ্ধার বা সাহায্য করার বিশেষ কোনও আশা মনের মধ্যে রাখেননি।

আশা না রাখবার কারণ এই যে, রিসালাদার সওয়ার সৈন্য ছাড়া রাতের অন্ধকারে এতদূর পর্যন্ত কেউ যে হত্যাবিলাসে মাততে আসেনি তা তিনি জানেন। তাদেরই কেউ নিশ্চয় কোনও অসহায় নারীকে জোর করে ধরে নিয়ে চলেছে। তিনি যত জোরেই ছুটে যান না কেন ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। নিষ্ফল জেনেও আর্তধ্বনি অনুসরণ করে ছোটা কিন্তু তিনি বন্ধ করতে পারেন না।

অন্ধকারে কিছুদূর ছুটে যাবার পরই একটা ব্যাপারে তিনি বিস্মিত হন। অসহায় আর্ত বিলাপটা তখন ক্ষীণ হতে হতে প্রায় থেমে এসেছে। কিন্তু সেটা এতক্ষণে যত দূরে মিলিয়ে যাবার কথা ছিল তা তো যায়নি! এই নিস্তব্ধ প্রান্তরে ঘোড়ার দ্রুত শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না।

হঠাৎ সামান্য একটু আশার আলো তাঁর মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ঘনরাম নিজের গতি বিশেষ না কমালেও পদশব্দ সম্বন্ধে একটু সাবধান হন।

আকাশে ক্ষীণ একটু জ্যোৎস্নাও নেই। তবু তারার আলোতেই অস্পষ্টভাবে কিছুদূর পর্যন্ত দেখা যায়।

ঘনরাম অনুমান যা করেছিলেন তা-ই ঠিক। এসপানিওল সওয়ার সৈনিক আর তার ঘোড়াটাকে এবার আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে আর সওয়ার সৈনিক নীচে নেমে ঘোড়াটার পিঠের ওপর যা বাঁধবার চেষ্টা করছে তা নিশ্চয়ই তার বন্দিনীর প্রায় অসাড় দেহ।

বন্দিনীর যোঝবার শক্তি আর নেই বললেই হয়, তবু দুর্বল অবশ শরীরে এখনও সে মাঝে মাঝে উন্মাদের মতো মুক্তি পাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠছে। বেঁধে ফেলাটা সওয়ার সৈনিকের পক্ষে তাই সহজ হচ্ছে না। বিনা বাধায় এই লুণ্ঠিত নারী শিকারটিকে ধরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি বলেই সওয়ার সৈনিককে এরকমভাবে বাঁধবার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে মনে হয়।

সওয়ার সৈনিক এ নারীরত্নকে অক্ষত অবস্থায় ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে লুব্ধ না হলে তার নাগাল পাওয়ার সুযোগ ঘনরাম নিশ্চয় পেতেন না।

অনেকটা কাছাকাছি গিয়েও ঘনরাম কিন্তু ইংকা নরেশের বিশ্রামাগারের প্রান্তে একটি স্তম্ভের আড়ালে নিঃশব্দে নিশ্চেষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

সওয়ার সৈনিক মেয়েটিকে বাঁধা শেষ করে নিজে এবার ঘোড়ার পিঠে উঠতে যায়।

কিন্তু রেকাবে পা দিতে গিয়ে তাকে চমকে নেমে দাঁড়াতে হয়।

অন্ধকার নির্জন প্রান্তরে একটা যেন অশরীরী ধ্বনি হঠাৎ শোনা গেছে কঠিন ধমকের সুরে-পারে।

পারে! অবাক হয়ে এসপানিওল বীর এবার একটু সন্ত্রস্তভাবেই চারিদিকে চায়। পারে মানে—থামো। এমন সময় এই জায়গায় কে তাকে এই ধমকের সুরে থামতে বলতে পারে! স্বয়ং ইংকা নরেশকে বন্দি করার পর আজ রক্তবন্যা বইয়ে এই অবাধ হুল্লোড়ের দিন এরকম হুকুম দেবার আহাম্মকি কোনও সেনাপতিও তো করবেন না।

সওয়ার সৈনিকের গায়ে একটু কাঁটা দিয়ে ওঠে সত্যিই। বিশেষ করে দূরের একটা স্তম্ভের আড়াল থেকে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিকে বেরিয়ে আসতে দেখে একবার বুকটা কেঁপে ওঠে।

কিন্তু ভেতরে যা-ই হোক, সাত সমুদ্র পেরিয়ে এই অজানা রহস্যের দেশে সমস্ত বিপদ তুচ্ছ করে আসবার মুরোদ যার হয়েছে এত সহজে সে বেসামাল হয় না। ধমক দেওয়া হুকুমের পালটা জবাব তাকে দিতেই হয়।

পারে! বলে হুকুমটার শব্দই একটু ঘুরিয়ে সে দাঁত খিঁচিয়ে বলে ওঠে, পেরো! কুইয়েন এস্তা তু?

কে তুই কুত্তা? এত বড় অপমান শুনেও ছায়ামূর্তির কোনও চাঞ্চল্য কিন্তু দেখা যায় না। ঠিক যেন একটা অসাড় কবন্ধের মতো নিঃশব্দে ধীরে ধীরে মূর্তিটা এগিয়ে আসে।

কবন্ধের মতো মনে হবার কারণটা বুঝতে সওয়ার সৈনিকের দেরি হয় না। কিছুটা কাছাকাছি আসার দরুন দেখা যায় যে মূর্তিটার মুখটা মুখোশের মতো কালো পর্দায় যেন ঢাকা।

এসপানিওল বীর নিজের অজান্তেই দু-পা পিছিয়ে যায় এবার। কোমরের খাপ থেকে তলোয়ারটা খুলে সে তখন হাতে নিয়েছে।

মূর্তিটা কিন্তু তখনও নির্বিকারভাবে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। তার কোমরবন্ধ থেকেও খাপে-ভরা তলোয়ারটা ঝুলতে দেখা যায়। কিন্তু সে তলোয়ার খোলবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে মূর্তিটা মাথার ওপর দু হাত তুলে কী যেন করে মনে হয়।

সওয়ার সৈনিক হাত ভোলার মানে বোঝবার জন্যে আর অবশ্য অপেক্ষা করে। মূর্তিটা আর-এক-পা বাড়াতে-না-বাড়াতে খোলা তলোয়ার নিয়ে হিংস্রভাবে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ওই ঝাঁপিয়ে পড়াই সার। হঠাৎ কী যেন কোথা দিয়ে হয়ে যায় এসপানিওল বীর বুঝতেই পারে না।

ঝাঁপিয়ে পড়ার পরমুহূর্তে দেখা যায় সওয়ার সৈনিক মাটির ওপর সচাপ্টে আছড়ে পড়ে আছে। তার শিথিল হাত থেকে তলোয়ারটা ছিটকে পড়েছে একটু দূরে। মুখোশ ঢাকা মূর্তিটা কাছে এসে সে তলোয়ারটা কুড়িয়ে নেয়। তারপর যা করে তা অদ্ভুত। অন্ধকারেই সেই তলোয়ারটা সৈনিকের মুখের ওপর একটু শুধু যেন সে কাঁপায়।

কপালে হাতটা তুলে সওয়ার সৈনিক অস্ফুষ্ট একটা চিৎকার করে ওঠে এবার। চিৎকার শুধু কপালের ওপর সূক্ষ্ম আঘাতের জন্যেই নয়। তার তলোয়ারটা সেই ভয়ংকর মূর্তি নিজের হাঁটুর ওপর নিয়ে এক চাপে তখন দু-টুকরো করে ফেলেছে। ভাঙা টুকরো দুটো সৈনিকের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মূর্তিটা তারই ঘোড়ার ওপর লাফিয়ে গিয়ে উঠে সবেগে সেটা খোলা প্রান্তরে ছুটিয়ে দেয়।