১৭. রেখা ভগৎ (কাল : ১৮০০ খৃষ্টাব্দ)

রেখা ভগৎ (কাল : ১৮০০ খৃষ্টাব্দ)

কার্তিকের পূর্ণিমা। এই সময় গণ্ডক-স্নান (নারায়ণী) এবং হরিহর দর্শনের খুব ভিড়। দূর দূরান্ত থেকে গ্ৰাম্য নর-নারীরা বহু্যত্ন-সঞ্চিত অর্থ এবং ছাতু-চাল নিয়ে হরিহরক্ষেত্রে এসে পৌঁছায়। বাগানের মধ্যে কিছু বলদ, ঘোড়া আর হাতী বঁধু-এ সব দেখে তখন কে ভাবতে পেরেছিল যে, এটাই ভবিষ্যতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মেলায় পরিণত হবে!

একখানা মোটা গামছা বিছিয়ে কাঁচালঙ্কা আর মূলো সহযোগে নুন-মাখা ছাতু পরম তৃপ্তির সঙ্গে আহার করে রেখা ভগৎ আর তার চার সঙ্গী এক আমগাছের নিচে কম্বলের ওপর। বসেছিল। রেখার মহিষ বিক্রয় হয়ে গেছে, সে থেকে থেকে ট্যাকে হাত দিয়ে বিক্রির। কুড়িটা টাকা দেখে নিচ্ছে। এই মেলায় এমন সব চোর এসেছে যার যাদুমন্ত্রে টাকা মেরে নেয়। রেখা আর একবার ট্যাকের ওপর হাত বুলিয়ে পরম নিশ্চিন্তের সঙ্গে কথা আরম্ভ করল, ‘আমাদের মোষ তো বিক্রি হয়ে গেল, তিনমাস ধরে খুব খাইয়ে-দাইয়ে আমি ওকে তৈরি করেছিলুম মৌলুভাই। ওরকম মোষের জন্যে বিশ টাকা দাম বেশি নয়। কিন্তু টাকাও আজকাল দেখতে দেখতে উড়ে যায়।‘

মৌলা, ‘ঠিকই! উড়েই যায়! এ ছাড়া টাকা-পয়সার। আজকাল অভাবও পড়ে গেছে চারিদিকে। এই কোম্পানীর রাজত্বে কোনো কিছুরই সুরাহা নেই। আমরা মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে মরে যাই, অথচ আমাদের ছেলেপুলেদের পেট–ভরা খাওয়া জোটে না এক সন্ধ্যাও!’।

রেখা, ‘এতদিন পর্যন্ত আমরা হাকিমকে নজর, বেগার এবং আমলা-পাইককে ঘুষ দেওয়ার ভিতর দিয়েই দিন কাটিয়েছি, কিন্তু জমি আমাদেরই ছিল।‘

মৌলা, ‘জমি-পুরুষ থেকে জঙ্গল কেটে জমি আবাদ করছি আমরা!’

সোবরণ, ‘মৌলুভাই, বাঘাক্ষেতের কথা জানো তো? ওখানে ভয়ানক জঙ্গল ছিল! আমাদের মুরিসূ ঘিনাবন বাবাকে ওখান থেকেই বাঘে ধরে নিয়ে যায়। সেই থেকেই ঐ জায়গার নাম ‘বাঘক্ষেত হয়েছে। প্রাণ দিয়ে আমরা সেই জমি আবাদ করেছি।’

রেখা ভোলাপণ্ডিতের দিকে তাকাল। ভোলাপণ্ডিতের রঙ কালো, পাতলা সাদা কাপড়ের পাগড়ী ঠিক করছিল। রেখা বলল, ‘ভোলাপণ্ডিত, তুমি তো সত্যযুগের কথা। জানো, বলতে পার, প্রজারা এমন দুৰ্দশায় আর কোনোদিন কি পড়েছে?’

মৌলা, ‘জানি আমরা তৈরি করেছি। চাষ-করা, বীজ-বোনা সব কাজে আমরা খেটেছি। অথচ আমাদের গ্রামের মালিক আমরা নই, রামপুরের মুন্সীজী।’

ভোলাপণ্ডিত, ‘অধর্মী রেখা ভগৎ, সর্বত্র অধৰ্ম। রাবণ এবং কংসের অত্যাচারকেও। হার মানিয়েছে কোম্পানী। পুরাণ ধর্মশাস্ত্রে লেখা আছে, রাজা পাবে কৃষকের কাছ থেকে এক দশমাংশ ফসল।’

‘মৌলা, ‘আমি তো অবাক হয়ে যাই পণ্ডিত! কোথাকার কে রামপুরের মুলী! তাকে আমাদের মালিক আর জমিদার বানিয়ে দিয়েছে?’

ভোলাপণ্ডিত, ‘সবই উল্টে গেছে মৌলু, প্রথমে প্রজাদের ওপর একজন রাজা ছিল। কৃষকেরা শুধু একজন রাজাকেই জানত। রাজা বহুদূরে আপন রাজধানীতে থাকত। শুধু ফসলের এক দশমাংশ পেলেই সে খুশী, তাও যখন ফসল হত তখন। কিন্তু এখন ফসল। হোক আর না হোক, নিজের হাড়মাংস বেচে, মেয়ে-বোনকে বেচে জমিদারের খাজনা ঠিক মতো দিতেই হবে।’

রেখা, ‘আর এই খাজনার কোনো হদিস পাওয়া যায় না পণ্ডিত। বছর-বছর খাজনা বেড়েই চলেছে! জিজ্ঞেস করবারও কেউ নেই যে, এমন অন্যায় কেন হচ্ছে।’

মুন্সী সদাসুখলাল পাটোয়ারী এসেছিল হরিহরক্ষেত্রে স্নান করতে, আর সস্তায় পেলে একটা গরু কিনতে। কিন্তু এ বছরের দুর্মুল্যতা দেখে কাঁপুনি ধরে গেছে তার। তার গায়ে ময়লা ছেড়া এক ফতুয়া এবং মাথায় টুপি। কানে এখনও খাগের মলম-দেখে মনে হয়, এখানেও বুঝি হিসাব লিখতে হবে তাকে। মসরিখের জমিদারের পাটোয়ারী বলে সে। ভাবছিল, এই আলোচনায় তার অংশগ্রহণ করা উচিত। কিনা। কিন্তু আলোচনা যখন গ্ৰাম্য রাজনীতি নিয়ে, তখন মুখ-কানওয়ালা মানুষের পক্ষে চুপ করে থাকা মুস্কিল!

দ্বিতীয়ত, দয়ালপুর গ্রাম তার মালিকের জমিদারীতে নয়। কাজেই দয়ালপুরের–কৃষকদের কথাবার্তায় অংশগ্রহণ করায় কোনো ক্ষতি আছে বলে সে মনে করল না। কলমটাকে আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে মুন্সীজী বলল, ‘কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে কিনা বলছ পণ্ডিত? কে জিজ্ঞেস করবে? এখানে তো সবাই পরের ধন লুট করে খায়। যত পার। লুটে খাও। কোনো রাজা নেই। নাজিম সাহেবের দরবারে আমার মাসতুত বোনের এক জামাই থাকে, অনেক গোপন তথ্যই সে জানে। একশো-দুশো ফিরিঙ্গি ডাকাতের দল জেকে বসেছে। এই দলকেই তারা নাম দিয়েছে কোম্পানী।’

রেখা, ‘ঠিক বলেছ মুন্সীজী, ‘কোম্পানী বাহাদুর’ শুনে-শুনে আমরা ভেবেছিলাম,, কোম্পানী কোনো রাজা হবে বুঝি, কিন্তু আসল কথাটি আজ বুঝলাম।’

মৌলা, ‘সেই জন্যেই তো যেদিকে তাকাও সেই দিকেই দেখবে লুট চলছে। ন্যায় অন্যায়ের খোঁজ-খবর করবার কি কেউ আছে? এই রামপুরের মুন্সীজীর সাত পুরুষের কখনও দয়ালপুরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না।’

সোবরণ, ‘আমার তো মৌলুভাই মাথায় ঢোকেনা যে, এই রামপুরের মুন্সী আমাদের গাঁয়ের মালিক হয়ে গেল কি করে! শুনতে পাচ্ছি দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে কোম্পানীর না-কি

মুন্সী, ‘দিল্লী নয় সোবরণ রাউৎ, মকসুদাবাদের (মুর্শিদাবাদের) নবাবের কাছ থেকে এই অঞ্চল কোম্পানী লিখিয়ে নিয়েছে। দিল্লীর তখৎ থেকে আমাদের এই অঞ্চলকে মাকসুদাবাদ আগেই ছিনিয়ে নিয়েছিল, সোবরণ রাউৎ।’

সোবরণ, ‘আমাদের এত কথা মনে থাকে না মুন্সীজী, আমরা তো শুধু দিল্লীর কথাই জানতাম। আচ্ছা মকসুদাবাদের হাতেও যখন রাজ্য এল, তখনও তো একটাই রাজা ছিল? আমাদের যেমন জুটত তেমনই খাজনা দিতাম। কিন্তু এখন একে দুই রাজার রাজ্য বলবে, না কি বলবে?’

রেখা, ‘দুই রাজাই হয়েছে সোবরণ ভাই–এক কোম্পানী-রাজ আর দ্বিতীয় রামপুরের মুন্সীজীর রাজ। জীতার এক পাল্লায় পিষলে বীচার আশা কিছুটা থাকে, কিন্তু দুপাটে পড়লে বাঁচা একেবারেই অসম্ভব। আর এ ব্যাপার তো আমরা নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। মুন্সীজী তুমিই বল! আমরা তো গেয়ো মুৰ্থ, আনাড়ী, তুমি এবং ভোলাপণ্ডিতই আমাদের মধ্যে জ্ঞানী।’ e

‘মুন্সী, ‘রেখা ভগৎ কথাটা বলেছি তুমি ঠিকই। জমিদার হল জীতার একটা পাল্লা। আর রাজার চেয়ে সে কোন বিষয়েই বা কম?’

রেখা, ‘কম কোন বরং এক-কাঠি বেশি মুন্সীজী। গায়ের পঞ্চায়েতের পরামর্শ কেউ নেয় এখন? রেওয়াজ মতো আমরা এখনও পাঁচজন মোড়ল ঠিক করে দিই, কিন্তু কোনো কাজে হাত দিতে পারে তারা? সবই জমিদার আর তার আমলা-গোমস্তারা করে। গায়ের ভেতর ঝগড়া বাধলে বাদী-বিবাদী দু’জনের কাছ থেকেই তারা জরিমানা আদায় করে। পনের বছরও তো কাটেনি সোবরণ রাউৎ মেয়ে-মরদের ঝগড়ায় কখনও মোষ বিক্রি করতে দেখেছ?’

সোবরণ, ‘আরে ভাই তখন তো সব কিছুই পঞ্চায়েতের হাতে ছিল। গাঁয়ের পঞ্চায়েত কোনো পরিবারকে উচ্ছন্নে যেতে দিত না, খুনের মামলা পর্যন্ত আপোসে মিটমাট করে দিত তারা। বাঁধি আর খালগুলোর অবস্থা দেখনি। মনে হয়, ওগুলোকে দেখবার বা ওগুলোর ভার নেবার এখন আর কেউ নেই। পঞ্চায়েত যদি এখনও সক্রিয় থাকত। তাহলে কি কোনোমতেই এমনটা হতে পারত?’

রেখা, ‘কোনোমতেই হত না সোবরণ রাউৎ। বৃষ্টি বেশি হলে এমন পরিষ্কার নালা নেই, যা দিয়ে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যেতে পারে।’

মুন্সী, ‘পঞ্চায়েতকে ধ্বংস করে কোম্পানী এ-সব তুলে দিয়েছে জমিদারের হাতে।’

রেখা, ‘আর জমিদারেরা যে কি করছে সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।’

মুন্সী, ‘আমিও জমিদারের নিমক খাই রেখা ভগৎ। তুমি জানো, মসরিখের জমিদারের পাটোয়ারী আমি। কিন্তু এ অন্যায়ের সম্পত্তি, অন্যায়ের ধন যে খায় সে নির্বাংশ হয়ে যায়। আমাকেই দেখ, সাত ছেলে, ঘোড়ার মতো জোয়ান-সব মরে গেল!’

মুন্সীজীর চোখে জল দেখে সকলেরই হৃদয় সহানুভূতিতে ভরে উঠল।’সব মরে গোল রেখা ভগৎ ঘরে এখন জল দেবার জন্য একটা বাচ্চা মেয়েও নেই। আর আমার মালিক ছাপরার সেই রান্তীর পেছনে কিভাবে ঘুরছে। তার ইন্দ্ৰিয় শিথিল হয়ে পড়েছে।–এই যে দুটো বাচ্চাকে দেখছ, এদের লোকে তার সন্তান বলে জানে কিন্তু আসলে এরা নাপিতের ঔরসজাত।’

রেখা, ‘মালিকদের মধ্যে এ-রকম ঘটনা এখন অনেকেরই হচ্ছে।’

সোবরণ, ‘ক্ষেত গেল, গ্রাম গেল, সাত-সমুদ্র পারের দস্যুরা আমাদের ওপর দেশী ডাকাত লেলিয়ে দিল। পঞ্চায়েত গেল, যে সামান্য ফসল। আমরা ফলাই তাও কেড়ে নেওয়া হয়! আর যদি কখনও ঠিক মতো রোদ-বৃষ্টি হল, সামান্য ফসল ঘরে উঠল, তো মালিক, জমিদার, চৌকিদার, পাটোয়ারী গোমস্তার পেট ভরাতেই সব খতম।’

মুন্সী, ‘পাটোয়ারীদের লুটের কথা আমি জানি সোবরণ রাউৎ কিন্তু এও তোমরা ; জানো, জমিদার মাত্র আটআনা মাইনে দেয় পাটোয়ারীদের মাসে, আটআনা পয়সায় জিভও ভেজানো যায় না–এ কথা কি জমিদার নিজে জানে না?’

রেখা, ‘জানে মুন্সীজী, জমিদার অন্ধ নয়, সবই দেখতে পায়। কোম্পানী বাহাদুর ডাকাত-আমাদের ওপর এক নতুন ডাকাত জমিদারকে বসিয়ে দিয়ে গেছে। এতাতেও আমরা বেঁচে আছি কি করে?’

‘সোবরণ, ‘বেঁচে কোথায় আছি রেখা? পেট ভরে ভাত খেতে বা দেহে এক টুকরো কাপড় জড়াতে পারে-এমন লোক ক’টা দেখা যায় দয়ালপুরে?’

মুন্সী, ‘কোম্পানীর এতে কি এসে যায় সোবরণ রাউৎ? সে খাজনা বেঁধে দিয়েই খালাস, জমা দেওয়ার দিন ছাপরা গিয়ে জমিদারেরা টাকার তোড়া জমা দিয়ে আসে। দয়ালপুরে কৃষক মরুক আর বীচুক, কোম্পানীর পাওনা কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে দেওয়া

কাছ থেকে জমিদার পাঁচ টাকা নেবে-এক টাকা কোম্পানীকে দিয়ে বাকী চার টাকা নিজে গিলবে।’

রেখা, ‘হা ভগবান! তুমি কি ঘুমিয়ে আছ, না মরে গেছ? কেন তুমি সুবিচার করছ না? আমরা যে ধ্বংস হয়ে গেলাম!’

সোবরণ, ‘হ্যাঁ, শেষ হয়েই গেলাম রেখা, শোনোনি বারো-পরগণার লোকেরা একজোট হয়ে জমিদারকে তাদের মালিক বলে মানতে অস্বীকার করেছিল? তারা ছাপরা গিয়ে কোম্পানীকে বলেছিল, ‘আমাদের পঞ্চায়েত তোমাদের খাজনা মিটিয়ে দেবে, আমরা জমিদারকে মানব না।’ সাহেব কি জবাব দিয়েছে জানো? ‘অনাবৃষ্টি আর বন্যার সময়ও ঠিকমতো খাজনা দেবে? অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ বা প্লাবনের সময় নিজেদের কাচ্চা-বাচ্চার প্রাণ। বঁচানোই মুস্কিল–তা কি ওরা জানে না, ফিরিঙ্গীর ঐ কথাটা বলতে ভগবানের ভয়ও হল না রেখা! এরপর সে কি বলেছিল জানো? ‘তোমরা তো কঙাল, খাজনা যদি না দাও তো কোম্পানী বাহাদুর কি নেবে তোমাদের কাছ থেকে? আমরা টাকাওয়ালা সম্রােন্ত লোককে জমিদার করে দিই, যাতে আমাদের খাজনা বাকী রাখলে তাদের ঘরবাড়ি নিলাম হয়ে যাবার, মান-সম্ভ্রম নষ্ট হবার ভয় থাকে।’

রেখা, ‘এই জন্যই তো ফিরিঙ্গীগুলোর সারা গায়ে শ্বেতী। বড় নির্দয় ওরা।’

‘সোবরণ, ‘বারো-পরগণাবাসীদের কোনো কিছুই নেই, কাজেই ওরা জীবনের বিনিময়ে লড়াই করে। কোম্পানী যদি বাহাদুরই হত, তবে বাহাদুরের মতোই লোকের সঙ্গে লড়ত। বারো-পরগণাবাসীদের কাছে বন্দুক’ই আছে আর কোম্পানীর লোকদের আছে কামান। এখান থেকে সেখান থেকে কালা-গোরা বহু পল্টনও এসে গেছে তাদের গ্রামের। পর গ্রাম জ্বলিয়ে দিয়েছে, নারী শিশুদেরও ছাড়েনি। বারো-পরগণার লোকদের আর কি করবার আছে?’

মৌলা, ‘চাষবাস তো এইভাবেই নষ্ট হয়ে গেল, তাঁতীদের মুখের অন্নও ঘুচাতে আরম্ভ করেছে সোবরণ রাউৎ। কোম্পানী এখন বিলাত থেকে কাপড় এনে বেচছে।’

মুন্সী, ‘ হ্যাঁ, কলের তৈরি সূতো, কলের তৈরি কাপড়। আমার এই ফতুয়া ঐ কাপড়ের তৈরি। তাঁতের কাপড় এত সস্তায় পাওয়া যায় না। কাজেই মান বাঁচাবার জন্যে এই জিনিসই। কিনতে হয়। এটা মান বাঁচাবারই প্রশ্ন-কিন্তু তুমি অমন করে হাসছ কেন রেখা? সরকারি জাজিমের ওপর বসতে হলে তখন বুঝতে।’

রেখা, ‘তোমার কথায় হাসিনি মুন্সীজী, হাসছি। এই জন্যে যে, কোম্পানী বাহাদুর রাজত্বও করেছে, আবার ব্যবসাও চালাচ্ছে। এমনি মজার রাজত্ব!’

ভোলাপণ্ডিত, ‘সত্য, ত্রেতা, দ্বীপর-তিন যুগ পার হয়ে গেছে। কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর কেটে গেছে। কিন্তু এমন রাজত্ব কখনও ছিল বলে তো শুনিনি!’

মুন্সী, ‘নাজিমের দরবারে এক মুন্সী কোম্পানীকে ফিরিঙ্গী-ডাকাত আখ্যা দিয়েছে, আর একজন বলেছে, কোম্পানী হল ফিরিঙ্গী ব্যবসাদারদের আড্ডা। ওরা শুধু ব্যবসার জন্যেই নিজেদের দেশ থেকে এসেছে। প্রথমে এখানকার মাল ওখানে নিয়ে বেচত, কিন্তু এখন ওরা বিলাতে বড়-বড় কারখানা খুলেছে—সেখানে নিজেরাই মাল তৈরি করায় আবার নিজেরাই সেটা বিক্রি করে।’

মৌলা, ‘তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কারিগরদেরও আর উন্নতির আশা নেই।’

 

২.

শীতের গঙ্গা সবুজ আকার ধারণ করে এবং তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যময় গতি আরও গভীর রূপ নেয়। এই সময় নৌকাড়ুবির ভয় কম থাকে এই জন্য ব্যাপারীরা এই সময়টাকে ব্যবসায়ের মরসুম বলে মনে করে। এই সময় গঙ্গার পারে ঘণ্টা কয়েক বসে থাকলেই দেখা যাবে, শত শত বড় নৌকা সামনে দিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশতেই, কোম্পানীর মাল বোঝাই থাকে–তার মধ্যে বহু মালই আসে বিলাত থেকে এবং সেগুলো ওপরের দিকে যায়। আর পাটনা, গাজীপুর মির্জাপুরের মতো তেজারতী শহরের ঘাট থেকে দেখা যায়, গঙ্গার চারিধার বড় বড় নৌকায় ভর্তি।

পাটনা থেকে একটি বজরা নিচের দিকে যাচ্ছিল। এতে সোরা, জাজিম ইত্যাদি বহু জিনিস বিলাতে চালান যাবার জন্যে ছিল। এরই একটা নৌকায় যাচ্ছিল বঙ্গসন্তান তিনকড়ি দে আর বিলিতি সাহেব কোলম্যান। পাটনা থেকে কলকাতা যেতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে, সুতরাং তিনকড়ি দে আর কোলম্যানের ভিতর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। যদিও প্রথমে একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে সঙ্কুচিত হয়ে উঠত। তিনকড়ি দের কাছে জুলক্ষী, আঁটোসাটো প্যান্ট, ফিতায় ঝোলানো বোতাম এবং কালো কোট পরিহিত শ্বেতমুখ ভয় এবং ভক্তির বস্তু ছিল। কিন্তু কোলম্যানই প্রথম আলাপ শুরু করায় তিনকড়ির সাহস বেড়ে উঠছিল। আলাপ-আলোচনায় তিনকড়ি বুঝতে পারল যে, কোলম্যান কোম্পানীর সাহেবদের ঘোরতর বিরুদ্ধে এবং গর্ভনর থেকে আরম্ভ করে কোম্পানীর ছোট বড় কাউকেই গালাগাল দিতে দ্বিধা করে না। তিনকড়িও কোম্পানীর চাকরদের বরদাস্ত করতে পারত না। বিশ বছর কোম্পানীর বড় বড় দপ্তরে সে কেরানীর কাজ করেছে। গরীবের ঘরেই সে জন্মেছিল, কিন্তু সে ছিল তাদেরই একজন যাদের আশা সীমাবদ্ধ এবং লোভ যাদের আত্মসম্মানের সঙ্কীর্ণ গন্তীতে আবদ্ধ। অবশিষ্ট জীবনের মতো খাওয়া পরার মতো সংস্থান করে নিয়েছিল তিনকড়ি। কোনো পুরনো এজেন্টের দয়ায় সে চব্বিশ-পরগণা জেলায় চারখানা গ্রামের জমিদারী পেয়েছিল, যার আয়ের তুলনায় খাজনা ছিল অনেক কম। কিন্তু এই দয়াটুকু পাবার জন্য এমন কাজ তিনকড়ি করেছিল, যার পাপ জন্ম-জন্মান্তরে মোচন হবে না বলে তার বিশ্বাস। সাহেবকে খুশী করবার জন্যে গ্রামের এক সুন্দরী ব্ৰাহ্মণ তরুণীকে তুলে দিয়েছিল সাহেবের হাতে। সাহেবরা সে সময় খুব কমই বিলেত থেকে নিজেদের মেম সঙ্গে করে আনত। কারণ ছ’মাসের বিপদ ঘাড়ে করে সমুদ্ৰ-যাত্রা বড় সহজ ব্যাপার ছিল না।

তিনকড়ির বয়স পঁয়তাল্লিশ। তার সুঠাম কালো দেহের কাঠামো খুবই বলিষ্ঠ। রোজ সকালে উঠে সে আয়নায় নিজের মুখ দেখত। আর হাতের আঙ্গুলগুলো পরীক্ষা করত, • কোনদিন তার দেহে কুণ্ঠ রোগ ফুটে বেরুবে-সেই আশঙ্কায় সে থাকত, কারণ ব্ৰাহ্মণীর সতীত্বনাশের এই শাস্তি তার কপালে আছে বলে তার মনে হত। সাহেবদের খিটমিটি, ‘ গালাগালি আর পায়ের ঠোক্কর সয়ে সয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল! তাই চাকরির বয়স থাকলেও কাজে ইস্তফা দিয়ে সে গ্রামে ফিরে আসছিল। বিশ বছর নীরবে সহ্য করা অপমানের আগুনে তার অন্তর জ্বলে যাচ্ছিল। যখন সে কোলম্যানকে নিজের চাইতেও কোম্পানীর বড় শত্রু বলে বুঝতে পারল, তখন ধীরে ধীরে দু’জনের আলাপ চলতে লাগল। কোলম্যান একদিন বলছিল, ‘ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তৈরি করা হয়েছিল বাণিজ্যের জন্য, কিন্তু পরে এরা লোককে লুট করতে শুরু করে। দেখছি না, যত সাহেব এখানে আসে, সবাই দুদিনের ভেতর লাখপতি হয়ে দেশে ফিরে যায়। ছোট-বড় সবারই এই অবস্থা। ক্লাইভ এই কাজই করেছে, কিন্তু তাকে কেউই ধরেনি। চেৎসিংহের রাণীরা অনাহারে মরে যাওয়া সত্ত্বেও লোভের তাড়নায় ওয়ারেন হেষ্টিংস তাদের কথা ভাববার অবকাশই পায়নি। আর অযোধ্যার বেগমদের কাঙাল বানিয়ে ছেড়েছে সে। কিন্তু আমাদের দেশবাসীরা তাকে ছাড়েনি। শাস্তির হাত থেকে সে বেঁচে গেছে, কিন্তু যা কিছু সে রোজগার করেছিল, কয়েক বছরের মামলায় সবই সে খুইয়েছে।’

‘মোকদ্দমা কে চালাল সাহেব?’

‘পাৰ্লিয়ামেণ্ট। আমাদের দেশে রাজা নিজের খুশীমতো চলতে পারে না। খুশীমতো চলার অপরাধে এক রাজার গর্দন আমরা কুড়াল দিয়ে কেটে ফেলেছি, আর সে কুড়াল এখনও রয়েছে। পার্লিয়ামেণ্ট হল পঞ্চায়েত বুঝলে মিঃ দে! এদের অধিকাংশ সদস্যকেই দেশের ধনী-মানীরা নির্বাচিত করে, আর কিছু বড়-বড় জমিদার বংশগত অধিকারে এর সদস্য হয়।’

‘জমিদারী প্ৰথা কতদিন থেকে চলে আসছে?’

‘আমাদের দেশে এ প্রথা কয়েক শ’ বছর ধরে চলে আসছে। আমাদের দেশের দেখাদেখি ভারতবর্ষে জমিদারী প্রথা কায়েম হয়েছে। সেখানেও জমির ওপর থেকে কৃষকের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ দেশে জমিদারী প্ৰথা কায়েম করেছে যে গভর্নর, তার নাম জানো?’

‘হ্যাঁ, কর্নওয়ালিস।’

‘ঠিক বলেছ। বিলাতের পয়লা নম্বরের কসাই জমিদার। এখানে এসে সে দেখল, যতদিন কৃষকেরা জমির মালিক থাকবে ততদিন অনাবৃষ্টি ও প্লাবনের সময় ঠিক মতো খাজনা আদায় হবে না। সে এ কথাও ভাবল, সাতসমূদ্র তেরনদীর পারের দেশ থেকে আগত ইংরেজদের এ দেশের কিছু লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে-আর তা হবে এমন সব লোকের সঙ্গে, যাদের স্বাৰ্থ ইংরেজদের স্বার্থের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। জমিদার হল ইংরেজদের সৃষ্ট। কৃষক-বিদ্রোহে ইংরেজদের যেমন বিপদ, তেমনি জমিদারের বিপদ। জমিদারী, সম্পত্তি এবং সম্ভ্রম চলে যাওয়ারও সমূহ আশঙ্কা। এই জন্য ছোট-ছোট কৃষকদের মালিক বলে স্বীকার না করে যদি পঁচিশ-পঞ্চাশটা গ্রামের বড়-বড় মালিক জমিদার সৃষ্টি করা যায়, তবে তারা সুসময়-দুঃসময় সর্বদাই কাজে আসবে। এইভাবে বিলাতের এই কসাই ভারতবর্ষের কৃষকদের গলা কেটে রেখেছে।’

‘কেটে যে রেখেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই’-নিজের জমিদারীর কৃষকদের কথা মনে পড়ল তিনকড়ির।

‘জায়গীরদারদের জুলুমে সারা দুনিযার লোকই মরছে; তবে এদের দিনও ফুরিয়ে এসেছে। ফ্রান্সের রাজা-রাণীকে কয়েক বছর আগেই প্রজারা মেরে ফেলেছে। তাদের ক্ৰোধাগ্নিতে বহু জমিদার পুড়ে খাক হয়ে গেছে। জমিদারী প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার লোকেরা সকল মানুষের জন্য সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। সে সময় আমি ফ্রান্সে ছিলাম। ফ্রান্সের রাজপ্ৰসাদের ওপর ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্রের তেরঙা ঝান্ডা আমি নিজের চোখে উড়তে দেখেছি। ইংলণ্ডেও ফ্রান্সের মতোই অবস্থা হত, কিন্তু একটা ব্যাপার তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।’

‘কি ব্যাপার সাহেব?’

‘দেখছি না বিলিতি কারখানার তৈরি জিনিসে ভারতবর্ষের বাজার ছেয়ে গেছে? তোমাদের এখানে তাঁতীরা বেকার হয়ে পড়েছে আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কারখানা খুলে তাতে জমিদারের অত্যাচারে খেতে-না-পাওয়া লোকদের কাজ দিয়েছে! তাদের তৈরি মাল এখানে পৌঁছাচ্ছে। এতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশেও হাত দিয়েই কল চালানো হত, কিন্তু এখন স্টীম-ইঞ্জিন তৈরি হচ্ছে, আর ঐ কলের কাপড় অনেক সন্তায় পাওয়া যায়। ফলে তোমাদের দেশের কারিগররা তো একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেল। তবে এখন এই সব কারখানায় মজুর হয়ে পেট চালাবার মতো কাজ তারা পেতে পারে। যদি এই কারখানাগুলো খোলা না হত, তবে আমাদের দেশেও ফ্রান্সের দশাই হত। মানুষকে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে দিতে হবে, মিঃ দে। অপরকে যে পশু বলে মনে করে, নিজেকেই তার ছেলেপিলেসহ পশু হতে হয়।’

‘ঠিক বলেছ সাহেব। আমি নিজের কর্মচারী এবং চাকরীদের মানুষ বলেই মনে করতাম না। কিন্তু একই ব্যবহার যখন সাহেবরা করতে লাগল আমার সঙ্গে, তখন বুঝতে পারলাম যে, মানুষকে অপমান করা কত বড় পশুর কাজ।’

‘দাস-প্রথা তুলে দেবার জন্য বিলেতে প্রবল চেষ্টা হচ্ছে।’

‘বিলাতেও দাস-প্রথা চলতে দেওয়া হয়?’

করি, শীগগিরই এর বিরুদ্ধে আইন পাশ হয়ে যাবে।’

‘ধনীরা তো এ সব চায়ই না, আর আমাদের পার্লামেন্টে ধনীদেরই প্রভুত্ব, কিন্তু এখন। তাদের মধ্যেই কিছু লোক একে খারাপ বলে মনে করছে। যাই হোক না কেন, মানুষ কেনাবেচার যারা পক্ষপাতী নয়। তারাও পাপ-পূণ্যের বিচারেই যে একে উঠিয়ে দিতে চায় তা নয়। তারা সম্পূর্ণ অন্য কারণে চাইছে। আজকাল অনেক কারখানায় দাসেরা কাজ করছে,–তারা যে সব যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে তার দাম অনেক, অথচ মূল্যবান যন্ত্রগুলির ওপর কোনো মমতা নেই দাস-শ্রমিকদের, তাই সূক্ষ্ম কাজের ভার দাসদের দেওয়া যায় না। যার। জীবন-মরণ নিয়ে তুমি রাতদিন খেলা করছ, সে তো সুযোগ পেলেই তোমার ক্ষতি করে প্ৰতিশোধ নিতে চাইবে।’

‘মা আর তার শিশুকে আলাদা করে যখন আমি বেচিতে দেখি, তখন আমার কাছে সেটা নিতান্তই অসহ্য মনে হয়।’

‘অসহ্য যার মনে হয় না, সে মানুষই নয় মিঃ দে!’

‘আমি ভাবছি ফ্রান্সের রাজাহীন রাজ্যের কথা-তাকে কি বলে সাহেব?’

‘প্রজাতন্ত্র।‘

‘প্রজাতন্ত্র কি রাজতন্ত্রের চেয়ে ভালো?’

‘প্রজাতন্ত্র সব চেয়ে ভালো ব্যবস্থা! শাহ শাহজাদা, বেগম আর শাহজাদীদের জন্যেই দেশের সম্পদের অধিকাংশ নিঃশেষ হয়ে যায়! পঞ্চায়েতী রাজ্যের সরকারের কাছ থেকে অধিক ন্যায়, নিরপেক্ষতা এবং সহানুভূতি পাওয়া যায়।’

‘ হ্যাঁ, আমি আগে আমার নিজের গ্রামের পঞ্চায়েতের কাজ দেখতাম, ওতে সত্যিই! বেশি ন্যায়নিষ্ঠা দেখা যেত। আর ব্যয়ের বাহুল্যে কেউই ধ্বংস হয়ে যেত না। কিন্তু যখন থেকে কর্নওয়ালিসের জমিদারেরা এসে পঞ্চায়েতকে ড়ুবিয়ে দিল, তখন থেকে লোকে শেষ

‘এ কথা ঠিকই বলেছ মিঃ দে, কিন্তু ফ্রান্সের জনতার উদ্দেশ্য প্রজাতন্ত্রের চেয়েও মহৎ ছিল, তারা মানুষ মাত্রেরই সাম্য, স্বাধীনতা এবং মৈত্রী এই তিন মূল ভিত্তির ওপর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল।’

‘আমাদের দেশের জন্যেও?’

‘তোমরা কি মানুষ নও?’।

‘সাহেবদের চোখে তো আমরা সত্যিই মানুষ নই!’

‘যতদিন পর্যন্ত সমগ্র দুনিয়ার সাদা-কালো সমস্ত জাতির শাসনব্যবস্থা সাম্য-মৈত্রী স্বাধীনতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন মানুষ, মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। কসাই কর্নওয়ালিস তার নিজের জাতের গোরা কৃষকদের মানুষ বলে মনে করত না। ফ্রান্সের রাজা, জমিদাররা তো খতম হয়ে গেছে, কিন্তু বানিয়ার দল-ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর জাতভাইরা রাজ্য দখল করে নিয়েছে, যার জন্য সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আসল তেরঙা ঝাণ্ডা ফ্রান্সেও উড়তে পারেনি।’

‘তা’হলে ফ্রান্সে রাজপরিবারের জায়গায় ব্যবসায়ীদের রাজ্য স্থাপিত হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, এবং ইংলেণ্ডের ব্যবসাদারেরাও সোরগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, যখন আমরা সাতসমুদ্র তের নদী পারে ভারতবর্ষের রাজ্য চালাতে পারছি, তখন আর ইংলেণ্ডে। পারব না!’ এ জন্য রাজ-শক্তিকে তারা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চায়, যদিও রাজাকে সরিয়ে দিয়ে নয়।’

‘আপনি বলেছিলেন, ইংলেণ্ডের রাজার হাতে শাসন-ক্ষমতা নেই।’

‘হ্যাঁ! এটা গোর-ব্যবসায়ীদের চালাকি। আমার খুব দেশ-ভ্রমণের সখ ছিল। সুবি পেয়ে আমি কোম্পানীর চাকরি নিলাম। চাকরি যদি না করতাম তবে ব্যবসায়ীরা আমাকে সন্দেহ করত এবং দেশ পর্যটন আমার পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে পড়ত! তাই আমি দু’বছর কোম্পানীর দাসত্ব রূপ নরকে ছিলাম।’

‘ভালো মানুষের কাছে এটা সত্যিই নরক। এখানে সে-ই শুধু থাকতে পারে, যে সকল পাপেই সিদ্ধহস্ত, সমস্ত অপমান সহ্য করে শুধু টাকা রোজগারের জন্যেই যে সৃষ্টি হয়েছে। কর্নওয়ালিসের এক অনুচরের কৃপায় পাপের প্রতিদান হিসাবে চারটি গ্রামের এক জমিদারী। আমি পেয়েছিলাম, কিন্তু তার প্রতিফলও পেয়েছি আমি-আমার বউ, ছেলে মেয়ে সব মরে গেছে। ঐ জমিদারীর নামে আমার প্রাণ কাঁপে, আমিও আজ। আপনার সঙ্গে একমত। সাম্যমৈত্রী-স্বাধীনতার রাজ্যই পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করতে পারে।’

‘কিন্তু এই একমত হওয়াতে বা তার আশা করাতে কিছু হবে না। এর জন্য ফ্রান্সের মতো সহস্ৰ সহস্ৰ লোককে আত্মবলি দিতে হবে। এই আত্মবলি চুপি চুপি দিলে কাজ হবে না। ভারতবষীয় সিপাইরাও তো ইংরেজের জন্যে লাখে লাখে আত্মবলি দিচ্ছে। এই আত্মবলি দিতে হবে নিজেদের মঙ্গলের জন্য এবং সব জেনে বুঝে।’

‘জেনে, বুঝে আত্মবলি!’

‘জানা-বোঝার মানে হল, ভারববাসীর পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞান দরকার। বিজ্ঞান মানুষের হাতে জোরালো শক্তি যুগিয়ে চলেছে। এই বিজ্ঞানের বিশেষ জ্ঞান দিয়ে মানুষ বন্দুক বোমা বানিয়েছে, নিজেকে সবল করে তুলছে। এই বিজ্ঞানই তোমাদের দেশকে ধ্বংস করে ইংলণ্ডে নতুন কলকারখানা এবং নতুন শহর তৈরি করে চলেছে। বিজ্ঞানের শরণতোমাদেরও নিতে হবে।’

‘তারপর?’

‘তারপর ভারতবর্ষের ছোঁয়াছুঁয়ি, জাত-পাত, হিন্দু-মুসলমান-সব কিছুর ভেদাভেদ মেটাতে হবে। দেখছি না, আমরা জাত-বিচার করি না।’

‘হ্যাঁ সেটা ঠিক কথা।’

‘ইংরেজদের মধ্যে ধনী দরিদ্র ছাড়া আর কি কোনো জাত-বিচার আছে?’

‘না। কিন্তু তারপর?’

‘সহমরণ বন্ধ করতে হবে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোককে আগুনে পোড়ানো—তুমি কি মনে কর, একে ভগবান কোনোদিন ক্ষমা করবেন?’

কলকাতায় পৌঁছে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে-এই চিন্তায় কোলম্যান ও তিনকড়ি দে বিষণ্ণ বোধ করল। সবশেষে কোলম্যান বলেছিল, ‘বন্ধু আমরা উনবিংশ শতাব্দীতে এসে পড়েছি। পৃথিবীতে প্রচণ্ড ওলট-পালট চলেছে। এতে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। আর এ জন্য প্রথম প্রয়োজন হল, ছাপাখানা এবং সংবাদপত্র চালু করে দুনিয়ার হালচাল। সম্বন্ধে জনসাধারণকে ওয়াকিফহাল করা।’

এ বছর বর্ষা হয়নি। জ্যৈষ্ঠের মাটি শুকনো পড়ে রয়েছে। আউশ বা রবিশস্য এক ছটাকও হয় নি। পরিবারের পর পরিবার মরে গিয়েছে অথবা তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়েছে। শীর্ণ লম্বা বিলের জল শুকিয়ে গেলে দেখা গেল, পঁচিশ মাইল দূর-দূরান্তের লোককে তার : গহ্বরে মারে পড়ে থাকতে। এরা পদ্মমূল খুঁজতে এসেছিল। আর এর জন্য কতবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে তার ঠিক নেই। পরের বছর বর্ষা যখন এল, প্রথম ফসলে রেখা হাত লাগল। গমের বীজ বুনতে বুনতে মঙ্গরীকে দেখে বিস্মিত হচ্ছিল সে। একটা বছরে যেন পৃথিবীতে কত পরিবর্তন ঘটে গেছে বলে মনে হচ্ছে। অধিকাংশ লোকই মরে গিয়েছিল, বহু পরিবারের লোকজন দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। রেখা এই ভেবে আশ্চর্য হল, কি করে তারা দুটি প্রাণী দেহ,মনকে এক করে রেখে এক সঙ্গেই বেঁচে আছে! অতীতে। অনাবৃষ্টির ফলে দুর্ভিক্ষ হয়েছে কিন্তু এত কষ্ট সম্ভবত রেখার পূর্বর্তী কৃষকদের ভোগ করতে হয়নি। সে সময় একমাত্র গর্ভনমেন্টই ছিল, আর দুর্দিনে তাকে খাজনা কম দিলেও চলত। এখন কোম্পানীর সরকারের নিচে জমিদারের জবরদস্ত সরকার রয়েছে, যাদের লস্কর-পেয়াদার কবল থেকে একটা খড়-কুটোও রেহাই পায় না। কোনো ফসল দেড়মাস বাঁচিয়ে রাখা যায় না, ফলে ভবিষ্যৎ আকালের জন্যে কৃষকেরা কিছুই সঞ্চয় করে রাখতে পারে না।

অগ্রহায়ণ মাসে মঙ্গরী যখন একটি ছেলের জন্ম দিল, তখন আরও বিস্মিত হল রেখা। তার নিজের বয়েস পঞ্চাশ হয়েছে বলে নয়, কারণ মঙ্গরীর বয়েস ত্রিশ বছর এবং আরও কয়েকটি মৃত সন্তানের জননী হয়েছিল সে। তার বিস্মিত হবার কারণ হল, দুর্ভিক্ষের দিনে যখন নিজের অস্থিচর্মকে জীইয়ে রাখাই মুস্কিল তখন মঙ্গরী এক নতুন প্রাণীকে কেমন করেজীইয়ে রেখে জন্ম দিল!

মাঘ মাসে রামপুরের জমিদার হাতী-ঘোড়া, পাইক-পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে দয়ালপুরে এল। রেখা শুনেছিল, জমিদারের ঘরে একটি ছেলেমেয়েও শুকিয়ে যায়নি। দুর্ভিক্ষের সময়ে তার ঘরে সাত বছরের পুরনো চাল খাওয়া হয়েছে। জমিদারের কাছারি ছিল গ্রামের এক প্রান্তে, তার সামনে পঁচিশ একর জমি জুড়ে এক আমবাগান তৈরি করা হচ্ছিল। তাতে প্রয়োজনীয় জল-ঢালা ও মাটি খোঁড়ার কাজে দয়ালপুরবাসীদের বেগার দিতে হত। প্রতি ঘরের লোকের ওপর মালিক পঞ্চাশটি করে আমগাছের চারার ভার দিয়ে রেখেছিল। চারাগাছা শুকিয়ে গেলে একটির জন্য পাঁচ সিকি দণ্ড দিতে হত। রেখার পরবর্তীরা জমিদারের অত্যাচারকে সনাতন বলে মেনে নিতে আরম্ভ করেছিল। তাদের কাছে সোবরণ রাউৎ এবং রেখা ভগতের বাণত জমিদারের রূপ এবং গ্রামে পঞ্চায়েতের কাজ-এ সবই গল্প বলে মনে হত। আকালের পর মালিকের পেয়াদারা আরও উদ্ধৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল। তারা ভাবত, কৃষকের মনোবল ভেঙে দিতে এবং মালিকের দাপট বাড়িয়ে তুলতেই আকালের আগমন হয়। আগ্রহায়ণ মাসে যখন রেখার চালে লাউগাছের ফল ধরতে শুরু করল, তখন থেকেই জমিদারের পেয়াদারা ঘোরাঘুরি করতে আরম্ভ করে। লোকে বলত, আকালের পর রেখার মেজাজ চড়ে গেছে। রেখার কাছে ওটা ভুল বলে মনে হত–কিন্তু কথাটা সত্যিই। বস্তুত, আকালের পরে গ্রামের অন্যান্য মানুষদের আত্মসম্ভ্রমবোধ যতটা নিচে নেমে গিয়েছিল, তার তুলনায় রেখা ছিল অনেক ওপরে। এই জন্যই তার ব্যবহার অন্যের কাছে রুক্ষ বলে মনে হত। পাইক-চৌকিদারকে নিজের ঘরের কাছে ঘুরতে দেখলে রেখা ভয়ানক রেগে যেত, যদিও মুখে সেটা প্রকাশ করত না। একদিন চৌকিদার দেওয়ানজীর জন্য লাউ পোড়বার জন্যে রেখার ঘরের চালের ওপর উঠল। রেখা ঘরে বসে ছেলে সুখারীকে কোলে নিয়ে আদর করছিল। চালের ওপর মচুমচ শব্দ হতেই সুখারীকে মাদুরের ওপর রেখে বাইরে এল। দেখল চৌকিদার চালার ওপর উঠে। লাউ, ছিড়ছে। তিনটি ইতিমধ্যেই ছিঁড়েছে, চতুর্থটি ছিড়বার জন্যে হাত বাড়িয়েছে। রেখার দেহে যেন আগুন জ্বলে উঠল। অর্ধেক গ্রাম শুনতে পায়, এমনি জোরে চীৎকার করে সে বলল, ‘কে হে?’

‘দেওয়ানজীর জন্যে লাউ পাড়ছি, দেখতে পাচ্ছি না?’ —মাথা না তুলেই উত্তর দিল চৌকিদার।

কর্কশস্বরে রেখা বলল, ‘হাত-পা আস্ত রাখতে চাও তো ভালোয় ভালোয় নেমে এস। —বলি শুনতে পাচ্ছ কথাটা?’।

‘মালিকের চাপরাশী জানো তো?’

‘খুব জানি! ভালো মানুষের মতো লাউগুলো ওখানে রেখে নেমে এস।’

চৌকিদার নিঃশব্দে নেমে এল। সব শুনে দেওয়ানজী তখনকার মতো রাগ চেপে রাখল। মাঘ মাসে মালিকের আগমনের অপেক্ষায় থাকল সে।

মালিক আসবার পর সেই চৌকিদার একদিন সন্ধ্যাবেলা রেখা ভগতের বাড়ি এসে বলল, ‘কাল সকাল থেকে দু’সের করে দুধ মালিকের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে।’

‘আমার কাছে গরু মহিষ কিছুই নেই, দুধ কোথা থেকে দেব?’

‘যেখান থেকে হোক, মালিকের হুকুম।’

দেওয়ান অবশ্যই জানত, রেখার গরু-মহিষ কিছুই নেই। কিন্তু রেখাকে তার টিটু করতে হবে এখন। সন্ধ্যাবেলাতেই সে রেখার ঔদ্ধত্যের কথা মালিকের কাছে জানিয়ে দিয়েছে; আর এও বলেছে যে, সারা গ্রাম বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। মালিক সেই রাতের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তার করণীয় কর্তব্য সম্বন্ধে। সকালে রেখার কাছ থেকে দুধ এল না। পেয়াদা এলে রেখা তার নিজের গরু-মহিষ না থাকার কথা জানাল।

মালিক পাঁচজন গুপ্তপ্রকৃতির পেয়াদাকে হুকুম দিল, ‘যাও হারামজাদার মাগের দুধ দুইয়ে নিয়ে এস।’

গ্রামের কয়েকজন লোক সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা ভাবল, পেয়াদারী রেখাকে ধরে আনবে। রেখাকে কোনো কিছু বলার বা শোনার সুযোগ না দিয়ে পেয়াদারা তাকে বেঁধে ফেলল। তারপর দু’জনে ঘরে ঢুকে মঙ্গরীকে ধরে আনল। নিরুপায় রেখা অগ্নিবৰ্ণ চোখে দেখতে লাগল-মঙ্গরীর আর্ত চিৎকারের মধ্যেই তার স্তন টিপে ধরে গ্লাসের মধ্যে সত্যি সত্যিই কয়েক ফোঁটা দুধ বের করল তারা।

পেয়াদারা রেখাকে বেঁধে রেখেই চলে গেল।

লজ্জায় মরে গিয়ে মঙ্গরী সেইখানেই মুখখুঁজে বসে রইল। কিছুক্ষণ পরে রেখা যেন কথা বলার শক্তি খুঁজে পেল। বলল, ‘লজ্জা করিস না মঙ্গরী। আজ আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েত বেঁচে থাকলে বাদশাহও এমন বেইজ্জতি কাউকে করতে পারত না। কিন্তু এই বেইজ্জতির মজা আমি দেখাব। যদি আমার দেহে সাচ্চা আহীরের রক্ত থাকে তো এই দেওয়ান এবং রামপুরের মুন্সীর কুলে কাঁদবার কেউ থাকবে না। এই অপমানের প্রতিকার আমার এই হাতই করবে মঙ্গরী। আয়, আমার বাঁধন ছাড়িয়ে দে।’

মঙ্গরী জলভরা চোখেই রেখার বাঁধন খুলে দিল। ঘরের ভিতর গিয়ে রেখা সুখারীকে কোলে নিয়ে তার মুখে চুমা দিতে থাকল। তারপর মঙ্গরীকে বলল, ‘এখন থেকে যা নেবার আছে তা নিয়ে শীগগির পালা। আমি এই ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি।’

রেখার গলার স্বর মঙ্গরীর অজানা ছিল না ছেলেকে কোলে নিল, আর দু-তিনখান কাপড় সঙ্গে নিল–তারপর রেখার পায়ে লুটিয়ে পড়ল।

রেখা অত্যন্ত কোমল স্বরে বলল, ‘শুধু তোর ইজ্জত নয়, সারা গ্রামের ইজ্জতের বদলা নিতে হবে। চলে যা, আর বড় হলে সুখারীকে বলিস তার বাপ কেমন ছিল। দেরী করিস না, আমি চললাম চুল্লী থেকে আগুন আনতে।’

মঙ্গরী বহু দূর পর্যন্ত ঘরটাকে দেখতে লাগল-যতক্ষণ পর্যন্ত তার চাল থেকে লেলিহান শিখা উঠতে আরম্ভ না করল, ততক্ষণ। লোকেরা গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত রেখার ঘরের দিকে দৌড়াতে লাগল, আর রেখা খোলা তলোয়ার নিয়ে দৌড়াল জমিদারের কাছারীর দিকে। নিজেদের জীবন সংশয় দেখে চৌকিদার, পেয়াদারা পালাতে লাগল। মালিক এবং দেওয়ানকে মারবার সময় রেখা বলল, ‘তোমাদের জন্যে কাঁদবার লোকও রাখব না। শয়তানের দল!’

রেখা নিজের কথাকে সত্য প্রমাণিত করল। প্রতিজ্ঞা পূরণের চেয়েও বেশি করল সে। কসাই কর্নওয়ালিস না-জানি কতজন রেখাকে জন্ম দিয়েছিল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *