১৭. মোতির কথাটা শেষ হল না

মোতির কথাটা শেষ হল না—হঠাৎ যেন বাঘের মত গর্জন করে উঠলেন নবাব সাহেব, এই হারামজাদী—আবার মিথ্যা কথা বলছিস–

মিথ্যে ওকে শাসিয়ে কোন লাভ হবে না নবাব সাহেব সত্য তা ওর মুখ দিয়ে আগেই বের হয়ে গিয়েছে

না, না—ও বুট বলছে।

ঝুট ও বলেনি কারণ রাত দশটায় আপনি হলঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন সত্য—এবং আপনি ভেবেছিলেন সে সময়—ও আপনাকে হলঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখতে পেয়েছে আপনার গতরাত্রে হলঘর থেকে রাত দশটায় বের হয়ে যাবার সাক্ষী ও রইল। কিন্তু দুভার্গ্য আপনার, মোতি সেটা দেখতে পায়নি কারণ দেখবার মত অবস্থা তখন তার ছিল না। সিদ্ধির নেশায় জল-বৃষ্টির ঠাণ্ডায় তখন ও ঘুমিয়ে পড়েছিল—তারপর আবার আপনি ঐ হলঘরে গিয়ে যখন দ্বিতীয়বার ঢোকেন-রাত বারোটার কিছু আগে কোন এক সময় ফুপুর ঘর থেকে—এবং যে সময় আপনার গায়ে ছিল ঐ বোরখাটা—

কি—কি সব বলছেন—পাগলের মত

নবাব সাহেব প্রতিবাদ জানালেন বটে কিন্তু তাঁর গলার স্বর যেন কেমন নিস্তেজ কেমন। ঠাণ্ডা প্রতিবাদের তীব্রতা নেই সে কণ্ঠস্বরে তেমন যেন।

আমি যে মিথ্যা কিছু বা পাগলের মত কিছু এলোমেলো বকছি না আপনার চাইতে। বেশী কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয় নবাব সাহেব। শুনুন—হলঘরে ঢুকতে গিয়েই বোরখাটা আপনার পেরেকে বেঁধে ছিড়ে যায়—এবং তারপর যে কোন কারণেই হোক বোরখা খুলে। রেখে আপনি যখন পরে নিশ্চিন্তে ঘর থেকে বের হয়ে যান মোতি ঘুমিয়ে আছে ভেবে অত রাত্রে—দুভাগ্য আপনার সেই মুহূর্তে মোতির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল এবং সে আপনাকে দেখতে পায়–

কিরীটীর গলার স্বর তীক্ষ্ণ–ঋজু।

সে বলতে থাকে, ধর্মের কল এমনি করেই বাতাসে নড়ে নবাব সাহেব, এমনি করেই আমাদের গুণাহের মাশুল খোদাতালার কাছে তামাম শোধ করতে হয়, নচেৎ আপনিই বা বোরখাটা রেখে পরম নিশ্চিন্তে হলঘর থেকে বের হয়ে আসবেন কেন? আর ঠিক ঐ সময়টিতে অতিরিক্ত পরিমাণ সিদ্ধি খাওয়া সত্ত্বেও মোতির ঘুমটা ভেঙে যাবে কেন এবং আপনি ওর চোখে পড়ে যাবেনই বা কেন—আবার মেহেরউন্নিসাই বা আপনাকে বাঁচাতে কোন এক সময় আপনার ফেলে আসা বোরখাটা হলঘর থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসবেন কেন?

নবাব সাহেব হঠাৎ যেন স্থান কাল পাত্র ভুলে সম্বিৎ হারিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, বেরিয়ে যান বেরিয়ে যান আমার ঘর থেকেget out-বলতে বলতে নবাব সাহেব উঠে দাঁড়ান।

বেরিয়ে আমি যাচ্ছি, কিন্তু মানিকবাবু আপনাকে নিষ্কৃতি দেবেন না, জাহানারা বেগমের হত্যাপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করবেন।

ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।

নবাব সাহেব হঠাৎ ধপ করে আবার বসে পড়লেন সোফার উপরে।

মানিকবাবু-জাহানারার হত্যাকারী উনি। কিরীটী বলে ওঠে।

হঠাৎ পাগলের মত হা হা করে হেসে উঠলেন নবাব সাহেব।

হ্যাঁ হ্যাঁ—আমি–আমিই হত্যা করেছি জাহানকে।

 

 

১৮.

ফেরার পথে কিরীটী মানিক চাটুয্যেকে বলছিল।

দুটো—দুটো মারাত্মক ভুল করেছিলেন নবাব সাহেব—এক ঐ মোতির বোরখা ব্যবহার করে তার ঘাড়ে দোষটা চাপাবার চেষ্টা করে—দ্বিতীয় জাহানারার হাতের আঙুল থেকে হীরার আংটিটা খুলে নিয়ে এসে লোভের বশে।

কিন্তু কি করে আপনি বুঝলেন মিঃ রায় যে নবাব সাহেবই

হত্যাকারী—তাইনা? ছোরাটা যেভাবে আমূল বুকের মধ্যেবিঁধেছিল সেটাকোনস্ত্রীলোকের পক্ষেই সম্ভব নয়। কোন শক্তিমান পুরুষেরই কাজ। এ বাড়িতে পারবেন একনবাব সাহেব—দুই নাসির হোসেন, কিন্তু নাসির হোসেন স্বর্ণডিম্বপ্রসূ জাহানারাকে হত্যা করতে যাবে কেন, জাহানারা তাকে অর্থ যোগাত আর তার সঙ্গে নাসিরের পীরিতও ছিল।

কিন্তু কেন কেন হত্যা করলেন নবাব সাহেব তাঁর প্রিয় বেগমকে?

এখনও সেটা বুঝতে পারেননি–

না।

মেহেরের জন্য।

মেহের?

হ্যাঁ–ঐ মেহেরের জন্যই। অতিরিক্ত নারীলোভী নবাব সাহেবের যখনই মেহেরের উপর নজর পড়েছিল, জাহানারা সম্ভবত প্রতিবাদ জানিয়েছিল—সংঘর্ষ বেধেছিল সেই মুহূর্তে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে—যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁকে অমন করে প্রাণ দিতে হল….

কিন্তু কি ভাবে হত্যা সংঘটিত হয়েছিল বুঝলেন কি করে?

ঐ বাড়ির দোতলার একটা নকশা মনে মনে ছকে নিন, তাহলেই ব্যাপারটা আপনার কাছে সহজ হয়ে আসবে। অবশ্য আমি ব্যাপারটা নবাব সাহেবকে সন্দেহ করে মোটামুটি অনুমান করেছিলাম–কারণ ঐ ভাবে ছাড়া হত্যা করা সম্ভবপর ছিল না।

কিরীটী চুপ করল।