১৭. বাণীর হাত ধরে

বাণীর হাত ধরে টানতে টানতে কক্ষের মধ্যে নিয়ে এল অনিল।

মাসখানেক একেবারে ক্ষৌরকর্ম না করায় একমুখ দাঁড়িগোফ গজিয়েছে আজ অনিলের মুখে। তাকে আজ আর চেনবার সত্যিই উপায় নেই।

ঘরের কোণে প্রদীপট জ্বলছে মিটমিট করে। প্রদীপের স্বল্প আলোছায়া অপরিসর ছোট ইট-বের করা ঘরের জীর্ণ দেওয়ালে যেন রহস্যের আলপনা বুনে চলেছে।

হতচ্ছাড়া মেয়ে, তোকে ইচ্ছে করছে গলা টিপে শেষ করে ফেলি! রাগতকণ্ঠে অনিল বলে।

বাণী বাপের কথায় কোন প্রতিবাদ জানায় না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

বাণীকে নীরব থাকতে দেখে কি জানি কেন আনিলের রাগটা বোধ হয় নরম হয়ে আসে। মৃদু চাপাকণ্ঠে এবারে বলে, কতবার না বলেছি ঝোপ-জঙ্গল সাপে ভর্তি, যখন তখন অমন করে ঘরের বাইরে যাস না!

তুমি তো সারাটা দিন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াও! তোমাকে বুঝি সাপে কাটতে পারে না?

আমার আর তোর কথা এক হল!

কেন এক নয়? তার চেয়ে চল না বাবা, কি হবে মিথ্যে আমন করে আর মাটি খুঁড়ে? আমরা ফিরে যাই।

ফিরে যাব? কখনোই না। জানিস তুই, কেন আমি এখানে এসেছি?

সবটা না বুঝলেও কিছু কিছু বুঝতে পেরেছি বৈকি। স্মিতকণ্ঠে জবাব দেয় বাণী।

তুই কিছু জানিস না। জানিস যেজন্য এসেছি তা যদি পাই তাহলে এ জীবনে আমাদের আর কোন অভাবই থাকবেনা! রাজার হালে পায়ের উপর পা দিয়ে বসে-বসেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব!

ঐসব কথায় তুমি বিশ্বাস কর বাবা? পুরানো রাজবাড়ি জমিদারবাড়ি সম্পর্কে ওরকম অনেক কথাই রটে! যক্ষের ধন সত্যি কখনও থাকে! ও গল্পই!

হ্যাঁ, তুই তো সব জেনে একেবারে বসে আছিস। খিঁচিয়ে উঠল অনিল।

এই এক মাস ধরে তো তুমি কম খুঁজলে না, পেলে কিছুর সন্ধান? বল?

পাইনি এখনো ঠিক, তবে পাবই। নিশ্চয়ই আমি খুঁজে বের করব। আর খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে এক পা আমি নড়ছি না। খুঁজে আমকে বের করতেই হবে।

সত্যি, বাপের জন্য দুঃখ হয় বাণীর।

মানুষের সমস্ত শিক্ষা ও রুচিকে কি ভাবে যে এক এক সময় তার দুর্ভাগ্য আচ্ছন্ন করে ভাবতেও বিস্ময় লাগে। নইলে তার শিক্ষিত বাপ দুর্ভাগ্যের টানে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আজ!

বাণী মুখে স্বীকার না করলেও তার মনের কোণার তার উচ্ছৃঙ্খল পথভ্রষ্ট বাপের জন্য যে একটা দর্বলতা ছিল, সেটাই সে বুঝতে পারত না।

দশ বৎসর বয়সের সময় সে তার ব্যাপকে প্রথম দেখে।

মায়ের সঙ্গে তার সর্বপ্রকার আলোচনাই হত, একমাত্ৰ বাপের সম্পর্কে কখনো কোন আলোচনা হত না।

মা যে কতকটা ইচ্ছা করেই একান্তভাবে তার বাপের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেত, ঐ অল্প বয়সেও বাণী সেটা বুঝতে পেরেছিল। কারণ সাধারণের চাইতে ঐ অল্প বয়সেই বাণীর বুদ্ধিটা ছিল একটু বেশ প্রখরই।

এবং মা তার বাপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেও মারা মনের কোণে যে তার স্বামী সম্পর্কে একটা বিশেষ দর্বলতা আছে, সেটাও কিন্তু বুঝতে বাণীর কষ্ট হয়নি।

কতদিন তার চোখে পড়েছে মা তার নিভৃতে স্বামীর ফটোখানির দিকে নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তারপর বাপের সঙ্গে যখন এসে সেই বৌবাজারের ভাঙা অন্ধকার বাড়িতে ওরা উঠল একদিন তার হাত ধরে, তখন থেকেই কেন না-জানি ঐ বিচিত্র চরিত্রের লোকটির ওপরে এক অজ্ঞাত আকর্ষণ অনুভব করেছে সে।

একে একে তার চোখের সামনেই দেখেছে মায়ের গায়ের গহনাগুলো বেচে বাপ তার নষ্ট করেছে, তা সত্ত্বেও মায়ের নির্বিকার ক্ষমা মধ্যে মধ্যে বাণীকে বাপের প্রতি বিদ্রোহী করে তুললেও সেই সঙ্গে লোকটার প্রতি জেগেছে মনের কোথায় যেন একটা সহানুভূতি, অনুকম্পা।

মধ্যে মধ্যে বাপ তাকে পড়িয়েছে, সেই সময় বাণী দেখেছে লোকটির জ্ঞান কত গভীর, কত জানাশোনা!

তৎসত্ত্বেও জগতের সব কিছুর ওপরে অসীম একটা উপেক্ষা। ছন্নছাড়া জীবন-স্বভাবের উচ্ছৃঙ্খলতা।

তার মায়ের মত স্ত্রী পেয়েও যে লোকটা সুখী হয়ে ঘর বাঁধতে পারল না, তার জন্য মনে মনে বাণী দুঃখ বোধ করেছে।

এবং সেটাই বুঝতে পারেনি যে, ঐ দুঃখবোধের ভিতর দিয়েই ধীরে ধীরে কখন মনের মধ্যে জেগেছে তার সহানুভূতি, পথভ্রষ্ট সৃষ্টিছাড়া বাপের ওপরে জন্মেছে একটা আকর্ষণ, যার টানে সে অনায়াসেই সেদিন মধ্যরাত্রে পলায়নপর পিতার পিছু পিছু ঘর থেকে বের হয়ে তাকে অনুসরণ করেছিল।

তারপর বাপ টের পেয়ে তাকে ফিরে যাবার জন্য তার অনুরোধ, ভয়প্রদর্শন, রাগ কিছুই তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি সেদিন। এবং এখানে এসেও বাপের গালাগালি রাগ সব কিছুকে উপেক্ষা করে এই বনজঙ্গলের মধ্যে পোড়ো বাড়িতে পড়ে আছে।

অনিলও প্রথমটায় তাকে না জানিয়ে অকস্মাৎ চোরের মত গোপনে গোপনে বাণী তার পিছু নেওয়ায় বিশেষ রকম ক্ষেপে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েকে সঙ্গে করে বহরমপুর না নিয়ে এসে পারেনি।

প্রথমে সে জানতে পারে বাণী তাকে অনুসরণ করে এসেছে স্টেশনে পৌঁছে।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য একটা চেঁচামেচি ও কেলেঙ্কারির ভয়েই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসতে অনিল একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল বললেও অত্যুক্তি হয় না।

কিন্তু রাগটা অনিলের দুদিনের বেশী থাকে না।

বাণী সঙ্গে আসতে তার কিছু সুবিধাও হয়েছিল। নিজ হাত পুড়িয়ে আর রান্না করে খেতে হয়নি।

প্রথম প্রথম জঙ্গলের মধ্যে পোড়ো বাড়িতে থাকতে বাণীর খুবই খারাপ লাগছিল, কিন্তু বাপের একান্ত ঘনিষ্ঠতার মধ্যে এসে বাপের মধ্যে একটা স্নেহ-কোমল অথচ দুৰ্দান্ত বেপরোয়া মন আবিষ্কার করে কেমন একটা মায়াও পড়ে গিয়েছিল এই এক মাসের মধ্যেই তার মনে।

অনিল সারাটা দিন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

একটা লোহার শাবল নিয়ে এখানে ওখানে মাটি খোঁড়ে বা জঙ্গল কেটে সাফ করে আর রাত্রে একটা লাল মলাট দেওয়া খাতার জীর্ণ মলিন পাতা খুলে প্রদীপের আলোয় উল্টে উল্টে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়ে।

কলকাতাতেও এবারে বাণী বাবাকে ঐ খাতাটা পড়তে ও সযত্নে আগলে বেড়াতে দেখেছে।

কৌতূহল হয়েছে খাতাটার মধ্যে কি আছে জানিবার জন্য, কিন্তু সুযোগ বা সুবিধা পায়নি কলকাতাতে।

এখানে আসবার পর একদিন দ্বিপ্রহরে বাপের অনুপস্থিতিতে চুরি করে গোপনে খাতাটার কিছু অংশ পড়েছে।

জীর্ণ লালচে পাতায় কার ফোন ডায়ারী লেখা আছে।

সাল তারিখ দিয়ে নিয়মিত ডায়ারী নয়। এলোমেলা অসংলগ্ন ভাবে লেখা ঠিক ডায়ারী নয়, যেন কতকটা আত্মজীবনী শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর।

মার কাছেই শুনেছিল বাণী একদিন, তার পিতামহের নাম ছিল শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী।

এবং প্রথম হতেই তিনি ছিলেন সন্ন্যাসী প্রকৃতির মানুষ। সংসারের প্রতি তীর কোন আকৰ্ণ ছিল না। এবং দৈবচক্রে আকস্মিক দুর্ঘটনায় সে রাত্রে তার পিতামহী মৃন্ময়ী দেবী নিহত হন। সেই রাত্রেই তার পিতামহ শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী সেই যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন, আর কোন সংবাদই পরবর্তীকালে পাওয়া যায়নি।

তিনি আজও জীবিত কি মৃত কেউ তা জানে না।

এবং পিতৃমাতৃহীন তার বাপ মানুষ হন তীর দিদিমার কাছে মামার বাড়িতেই।

অত্যন্ত আত্মভিমানী পুরুষ ছিলেন তাঁর বাপ। বছর কুড়ি বয়স যখন তাঁর, সেই সময় একদিন তার চেয়ে বয়সে ছোট মামার সঙ্গে কি কথায় রাগারাগি হওয়ায় সেই যে একবস্ত্ৰে মাতামহের গৃহ ছেড়ে চলে আসেন, আর ওমুখো এ জীবনে হননি।

একটা মফস্বল শহরে গিয়ে সেখানকার কলেজে পড়ে টিউশনি করে বি. এ. পাস করে কলকাতায় এসে এম. এ. পড়তে শুরু করেন। সেই সময়ই তার মাতামহের সঙ্গে ও তার মারি সঙ্গে আলাপ।