১৭. পরদিন গড়ানবেলায় ভরতের উঠোনে

পরদিন গড়ানবেলায় ভরতের উঠোনে মানুষের মেলা লেগে গেল। সকলেই মাঠের আর খালের মানুষ। সকলেই ঢুকে একবার করে হাঁক দিল, মহিমের নাম ধরে। এমন কী রাজপুরের মানুষরাও বাদ যায়নি। মহিম কাজ ছেড়ে সবাইকে আপ্যায়ন করল, বসাল।

কিন্তু কাজ তো মহিমের শেষ হয়নি। না হোক, নিজের মনের কাছে মহিমের গোপন রইল না, প্রাণ তার পেখম তুলে নাচতে চাইছে, বুকটা তার ভরে উঠেছে। নিজেকে সে জিজ্ঞাসা করল, একেই কি বলে সৌভাগ্য। তার মনে পড়ল. উমার আহ্বান, কলকাতায় চলো। কলকাতা! সত্য, কলকাতা চুম্বকের মতো সমস্ত কিছুকে টেনে নিয়ে থরে থরে নিজের বুকে সাজি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই মানুষ অখিল তারা তো কলকাতায় নেই। নেই কোনও পরিচয়, তার কোনও নাড়ীনক্ষত্রের সন্ধান! সে টান, সে আত্মীয়তা কোথায়? সবটাই যেন এক বিরাট চাঞ্চল্য, অথচ প্রাণহীন। যেন ফেললা কড়ি বোলের মতো সবটাই বিকানোর মর্যাদায় উজ্জ্বল। হৃদয়ের রক্তে সেই উচ্ছ্বাসের ধারা নয়নপুরে যত অনাবিল, কলকাতায় তার অন্তঃস্রোতের গতি খোঁজার চেয়ে ওতে প্রাণভরে ড়ুব দেওয়া অনেক শান্তির। এই কাদা মাখা, মা ধরিত্রীর গায়ের গন্ধমাখা মাথা মানুষের এই প্রাণখোলা অভিনন্দন।

মহিমের বিনয়বাক্য গ্রাহ্য না করে সবাই তার প্রায়-সমাপ্ত কাজ দেখার জন্য ঘরের মধ্যে ঢুকতে লাগল। দেখা তো সবে শুরু। কবে তার শেষ, মহিম তার কী জানে।

অহল্যা মানুষজন দেখে আর উঠোনে বেরোতে পারে না। এদের মধ্যে অনেকেই তার শ্বশুর ভাসুর সম্পর্কের জ্ঞাতি এবং পড়শি আছে। সে ঘোমটা টেনে রান্নাঘরের বেড় কাটা জানালা দিয়ে সব দেখছিল। হঠাৎ তার নজরে পড়ে গেল দখিন ভিটার ঘরের ধারে সকলের আড়ালে পিপুলতলায় ভরত হুঁকো টানা ভুলে ভিড় দেখছে। অমনি বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল তার। যেন এ উৎসবের আসরে তার আসতে নেই। যেন অনাহূত, তবু না এসে পারেনি। কেন? এখানে ভরতের অধিকারই তো সব চেয়ে বেশি। তবু সে কেন পরবাসীর মতো আড়ালে রয়েছে?

হ্যাঁ, ভরত খানিকটা তাজ্জব, খানিকটা অসন্তুষ্ট, খানিকটা সন্তুষ্টি নিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করছে আর আর ভাইয়ের এ কেরামতিটা তারিফ পাওয়ার যোগ্য কি না তাই বোধ হয় ভাবছে। তার হঠাৎই মনে পড়ে গেল, তার বিয়ের পর এত মানুষ এ ভিটের আর কোনও দিন পা দেয়নি। তার পর বাড়ির দোরগোড়ায় ওর শ্বশুর ও সম্বন্ধিকে দেখে সে চমকে উঠল এবং তার বিস্ময়কে পাহাড়সমান তুলে নিয়ে মহিম তাদের উভয়কে প্রণাম করে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল। ইস্! ছোঁড়া মানুষ ভোলাতে একেবারে ওস্তাদ হয়ে গেছে। তার মনের মধ্যে ছোট্ট একটা কাঁটা হঠাৎ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল এই মনে করে, কই, সে তো কোনওদিন পীতাম্বর বা ভজনের পায়ের ধুলো নেয়নি। যেন আসল সম্বন্ধটা তাদের তার ভাইয়ের সঙ্গেই।

তার পর হঠাৎ আমলা দীনেশ সান্যালের গলার স্বরে সকলেই সচকিত হয়ে উঠল। সান্যালের মুখে এক অদ্ভুত ব্যঙ্গহাসি। মহিম সামনে এসে দাঁড়াতেই বলল, কী রে, কী এমন জানোয়ার গড়লি যে, সব গ্রাম ভেঙে পড়েছে উঠোনে?

লোকটার আবির্ভাবে ও কথায় সকলেই রুষ্ট হয়েছে বোঝা গেল। মহিম বলল, কাজ তো শেষ হয় নাই, শেষ হইলে দেখতে আসবেন। নিমন্ত্রণ রইল।

সান্যাল হো হো করে হেসে উঠে উঠোনের মানুষগুলোকে দেখিয়ে বলল, এরা বুঝি অনিমন্ত্রিত? তুই ব্যাটা কথা শিখেছি বেশ। চল্ না দেখি, কী আর্ট ফলালি। বাবুরা তোকে আবার আর্টিস্ট বলে।

সান্যাল দু-পা এগুতেই মহিম স্পষ্ট গলায় বলল, এখন দেখানো যাবে না সান্যাল মশাই।

মহিমের পাশ থেকে ভজন বলে উঠল। জানোয়ার পুরো তৈয়ারী না হইলে আপনি বুঝতে পারবেন না সানেলমশাই, কেমন জানোয়ার ওটা।

বটে? সান্যালের মুখে মুহূর্তে কয়েকটি ক্রোধের রেখা ফুটে আবার মিলিয়ে গেল। হেসে বলল, ভজন বুঝি? তা ভগিনীপতির সঙ্গে সব গোলমাল কাটিয়ে নিয়েছিস? বেশ করেছি। শুনেছিলাম ভরতকে পেলে নাকি তুই ঠেঙিয়েই একশ’ করবি। আবার সেই ভিটেই চাটতে এলি যে বড়?

মহিম অত্যন্ত গভীর হয়ে বলল, সান্যালমশাই, ভজনদাদা আমার অতিথি।

দ্যাখো ব্যাটার মরণ। আমি কি বলছি অতিথি নয়? জিজ্ঞেস করছি বিবাদ মিটে গেল নাকি?

ভজনের চোখ ধক্ ধক্ করে জ্বলছে। বলল, কথা তোমারে শিখোতে পারি সানেলমশাই কেমন করে কথা বলতে হয়। তবে ভাবি, একেবারেই, না, তোমায় বা থ মেরে যায়।

বলে, সে এমন একটা ভঙ্গি করল যেন সান্যালের জিভটা সে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ভরত পিপুলতলা থেকে সামনে এসে হাজির হল। বলল, সানেলমশাই, কাজ যদি তোমার শেষ হইয়ে থাকে, আপন কাজে যাও গিয়া। বেথা সময় নষ্ট।

সান্যাল তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ, এই যে ভরত। তোমার কাছেই এসেছিলাম ঘুরতে ঘুরতে। কর্তা বলছিল, তুমি যদি আপসে একটা মিটমাট করতে চাও তা হলে একবার কাছারিতে যেয়ো। এমনিতেও তো তুই–

ভরত বাধা দিয়ে বলে উঠল, তোমার কতারে যেয়ে বলল, ভরত নিজের কাম করতে জানে, অপরের পোয়োজন নাই।

এই তোমার জবাব? কুটিল সান্যালের মুখ।

বুঝতে পারলা না?

তা পারব না কেন? আবার হাসল সান্যাল। মহিমকে বলল, কতা তোকে একবার কাল.সকালে যেতে বলেছে, বুঝলি? উনিই পাঠিয়েছিলেন তোর আর্টের নমুনা দেখতে, তাই এসেছিলাম। বলে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিজের মনেই সান্যাল বলল,  ব্যাটারা খুব বেড়েছে। তার পর লাঠি ঠুকে ঠুকে সে বেরিয়ে গেল।

কিন্তু সকলে চমকিত এবং কিছুটা মুগ্ধও হয়েছিল বটে ভরতের কথায়। মনে হয়েছিল, ভরত যেন সত্যই আর তেমন দূরে নয়।

ভরত তাকাল ভজনের দিকে। ভজনও তাকিয়েছিল। মনে হল তারা উভয়েই বুঝি কথাবার্তা শুরু করবে। এমনি স্তব্ধ অপেক্ষামান রইল।

কিন্তু না। ভরত হঠাৎ মহিমের দিকে ফিরে বলল, যত সব অনাছিষ্টি, আকাম। কিন্তু কোনও বিদ্বেষ নেই তার গলায়।

আর একটি কথাও না বলে সে সেখান থেকে সরে গেল।

সকলেই নির্বাক এবং কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল, ভরত কাছে এসে সরে গেল বলে। ভাবটা কতক্ষণ থাকত বলা যায় না। এই সময় অখিলের দশ বছরের ছেলে ছুটে এসে মহিমকে কোমর

জড়িয়ে ধরে বলল, মহিকাকা, কালাচাঁদটারে মোরে দিতে হইবে।

মহিম হাসল।–কেন রে?

মুই রোজ ঘাস কেটে এনে খাওয়াব। নাওয়াব খালে। মরে গেলেও আর দিব না কাউকে। সকলেই হেসে উঠল, কিন্তু আনন্দে নয়, দুঃখে।

 

এই দিনই সন্ধ্যাবেলা পরান এল মহিমকে ডাকতে। উমা ডেকেছে মহিমকে। অহল্যা তখন তাড়াতাড়ি কুড়োল দিয়ে খান কয়েক মোটা কাঠ ফেঁড়ে নিচ্ছিল। হঠাৎ উমার ডাক নিয়ে মহিমকে আসতে দেখে আজ সে শুধু চমকাল না, মনের মধ্যে কেন প্রশ্নটা আজ অন্যরকমভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সে উত্তীর্ণ হয়ে রইল মহিমের জবাবের জন্য।

মহিম আর কুঁজো কানাই তখন ঘরের মধ্যে। মহিম বেরিয়ে এসে বলল, আজ আমি যেতে পারব না পরানদা, কাল সকালে কতা ডাকছে, সেই সময় যাব।

পরান ফিরে গেল। কিন্তু সে বড় বিমর্ষ।

 

পরদিন সকালে এক ঝাঁক বিস্ময়ের মত উমা এসে হাজির হল মহিমদের বাড়িতে, সঙ্গে পরান। খালি উঠোন দেখে পরান ডাকল মহিমকে। বেরিয়ে এল অহল্যা।

দুটি নারীই পরস্পরকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ক্ষণিক চোখে চোখে তাকিয়ে রইল। যেন বহুদিনের দুটি চেনা মানুষের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়েছে। পরমুহূর্তেই পরান কিছু বলবার আগেই অহল্যা ঘোমটা তুলে দ্রুত এগিয়ে উমার পায়ের ধুলো নিল। বলল, বউঠাকুরানীরে মুই চিনি।

জীবনে কোনওদিন উমাকে চোখে না দেখলেও যেন তার অন্তরই এ নারীটির পরিচয় বলে দিল তাকে।

উমা বললে, থাক থাক। তোমার দেওর কোথায়?

অহল্যা জবাব দেওয়ার আগেই মহিম তরতর করে তার ঘরের থেকে বেরিয়ে উঠোনে নেমে এল। ভুলক্রমে পায়ে হাত দিতে গিয়েও সে সামলে নিয়ে কপালে হাত ঠেকাল। বলল, আপনি আসছেন! আমি যে যেতাম এখনি?

গাম্ভীর্য সরল উমার মুখের, চোখ হল ভক্তিমতীর। চোরা অভিমানে বলল সে, যেতে বলেই এসেছি। এসেছি তোমাকে শায়েস্তা করতে। কোথায় তোমার ঘর?

শুধু বিস্ময় নয়, সকলে কিছুটা বিভ্রান্তও বটে ভরত পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে হুঁকো হাতে।

মহিম হেসে তাড়াতাড়ি বলল ঘর দেখিয়ে, এইটে। আসেন।

কিন্তু উমা আর সবাইকে যেন ভুল ভাঙার জন্য বলল, কী নাকি এক কাণ্ড করেছ তুমি যে, জগতে ঢি ঢি পড়ে গেছে। তাই দেখতে এলাম।

বলে সে মহিমের সঙ্গে তার ঘরে এসে ঢুকল। ঢুকেই স্তব্ধ বিস্ময়ে সে সমাপ্ত অখিল ও তার মোষের মূর্তির কাছে গিয়ে যেন পাথর হয়ে গেল। একী গড়েছে তার শিল্পী! মৃত মোয, তার উপরে মুখ গুঁজে পড়া মানুষ। সমস্তটা যেন নিষ্ঠুর কান্নায় ভরা। এক দুর্বোধ্য যন্ত্রণায় বুকে নিশ্বাস আটকে দেয় যেন কালো মোষটার অসহায় ঘাড় এলিয়ে পড়া ভঙ্গি আর তারই মতো কালো মুখ থুবড়ে পড়া মানুষটার হাড়পাঁজরা। হাড়পাঁজরার অভিব্যক্তি যে অবুঝ কান্না বুকের মধ্যে টেনে নেওয়ার বেগ, তা সুস্পষ্ট।

সমস্ত পরিবেশটাকেই যেন যন্ত্রণায় ও কান্নার ভরে তুলেছে মূর্তিটা। দেখতে দেখতে মহিমও সম্বিত হারাল।

অনেকক্ষণ পর উমা চোখ ফিরিয়ে সমস্ত ঘরটা খুঁটে খুঁটে দেখল। এক মুহূর্ত বেশি চোখ আটকে রইল তার আবক্ষ গৌরাঙ্গসুন্দরের মূর্তি দিকে। তার পর ফিরল সে মহিমের দিকে। সে আত্মভোলা শিল্পীর দিক থেকে চোখ আর সরল না। সরল না নয়, উমা পারল না। বুঝি উমা নিজেকেই চেনে না।

মোষের মূর্তি আড়াল করে উমা এসে দাঁড়াল তার সামনে। মহিমের সম্বিত ফিরল, চোখের পাতা নড়ল, দৃষ্টি রইল স্থির। এত কাছে উমার সেই চোখ, আজ তাতে বিচিত্র আবেগ, ঠোঁটে মোহিনী হাসি। এত কাছে, স্পন্দিত বুকের আবরণের কম্পন দেখল আর শুধু নাসারন্ধ্র নয়, চিন্তার অনুভূতিটুকুকে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে ফেলল উমার সর্বাঙ্গের বিচিত্র মধুর গন্ধ। প্রাণে সাহস জুগিয়ে মহিম স্পষ্ট তাকাল উমার চোখের দিকে।

উমা বলল, আস্তে আস্তে, কী দেখছ, আমাকে গড়বে?

আপনাকে? কথার স্বর আবার যেন মাটিতে ফিরিয়ে নিয়ে এল মহিমকে। বলল, আপনার মুর্তি?

কেন, গড়ার মতো নয়? যেন উৎকণ্ঠা এসে পড়েছে উমার কণ্ঠে, বুঝি জীবন-মরণের প্রশ্ন! শিল্পীর সামনে তার মতোটি করে তুলে ধরবার জন্য উমা দু-হাত শাড়ি থেকে মুক্ত করে, ঘোমটা সরিয়ে আঁচল টেনে দিল একটি সরু নিঝরের মততা, দুই উন্নত স্তনের মাঝখান দিয়ে। নীল জামার প্রতিটি রেখায় সুস্পষ্ট সযত্ন রক্ষিত যৌবন। ঘাড় বাঁকিয়ে ঈষৎ পেছনে হেলিয়ে বঙ্কিম ঠোঁটে হাসল সে। বলল, বলল আমাকে গড়বে?

মহিম স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো বলল, গড়ব।

তবে এখানে নয়, কলকাতায়।

আবার স্বপ্ন ভাঙে মহিমের। কলকাতায়?

হ্যাঁ। উমা আরও সামনে এসে বলল, যাবে না? আমার শ্বশুর তোমাকে টাকা দিয়ে রেখে দিতে চান তাঁর হুকুম তামিলের জন্য, তুমি তাই থাকবে?

না।

তবে চলো কলকাতায়!

ঠিক সেই মুহূর্তেই অহল্যা এসে ঢুকল। মুখে সামান্য হাসি। কিন্তু সে নিজেই বোধ হয় জানে না তার চোখের দৃষ্টি কী তীক্ষ্ণ সন্ধানী হয়ে উঠেছে।

উমা নিজেকে সামলে বলল হেসে, তোমার দেওরকে কলকাতায় পাঠিয়ে দাও মণ্ডল বউ, নয়নপুর ওর জায়গা নয়।

অহল্যা হাসল। নিঃশব্দ, নিষ্ঠুর সে হাসি। উমা তার জীবনেও কি এমন তীব্র শ্লেষের হাসি দেখেছে! মহিমের সে হাসি দেখে মনে হল, এক দারুণ ঝড় পাকিয়ে ওঠার মতো আকাশের কোনও এক কোণ থেকে যেন হু হু করে কালো মেঘ অজান্তে কখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে সারা আকাশে।

অহল্যা বলল, পাগলাঠাকুর নিয়ে গেছিল ওরে কলকাতা, রাখতে পারে নাই বউঠাকুরানী।

আমি পারব।

অহল্যা তেমনি হেসে বলল, বউঠাকুরানী, মোরা হইলাম গরিব চাষী গেরস্থ, একটুকুন ঠাঁই নাই যে বসতে দেই আপনারে। আপনাদের কাছে ও দুদিন বই তিন দিন থাকতে পারবে না।

তার পর হঠাৎ সে বড় সরলভাবে হেসে উঠল। বলল, মোর হতভাগা দেওরের আপন-পর-চেতনও বড় বেশি ঠাকুরান। পাগলা ঠাকুর ওরে ধরে রাখতে পারল না বলে কী বেড়নটাই দিছিল, এই মোর চোখের সামনেই।

সেই স্মৃতিতে আবার অহল্যার চোখ দুটো অঙ্গারের মতো জ্বলে উঠল। উমার চোখেও বিস্মিত অনুসন্ধান। ঠিক যেন চিনে উঠতে পারছে না অহল্যাকে। এ যেন কিষাণী মণ্ডবউ নয়, আর কেউ। চিন্তায় বুদ্ধিতে শাণিত প্রখর। অহল্যা চকিতে একবার মহিমকে দেখে বলল, তবে দেওর তো মোর আর ছেলে-পান নাই, যায় তো ওরে আটকায় কে? তবে মোরা পারি না ছাড়তে পরান ধরে।

বলে সে উমার মুখের ছায়া ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কী সরল আর সাদা উক্তি। উমা ফিরল সে ছায়া নিয়ে মহিমের দিকে। বুঝল, শুধু তার শ্বশুর নয়, শিল্পীকে তার প্রশস্ত মর্যাদায়, আলোকিত আশ্রয়ে টেনে নিয়ে যেতে আর যে বাধা আছে তা বোব হয় দুর্লঙ্ঘ্য। তবু নিরাশ সে মোটেই হল না। বলল, পুজোর ক’দিন নয়, কোজাগরী পূর্ণিমার দিন পরানকে পাঠাব সন্ধ্যায়, ফিরিয়ো না যেন ওকে। অনেক কথা আছে তার মনস্থির করতেই হবে তোমাকে। যেয়ো কিন্তু সেদিন?

মহিম তাকাল উমার দিকে। না, এখনও ওই চোখের সামনে প্রতিবাদের ভাষা সে কিছুতেই জিভে জুগিয়ে তুলতে পারছে না। একি স্বপ্ন, না সম্মোহন! সে বলল, যাব।

উমা ফিরল। কিন্তু মুখের ছায়া মনেও চেপে বসতে চাইছে যেন। …

 

পুজোর ক-দিন মহিম অন্য কিছু ভাববার সময় পর্যন্ত পেল না, এমনিই একটা ভিড় লেগে রইল বাড়িতে। এমন কী নহাট মহকুমা থেকে কেউ কেউ এসেছিল তার কাজ দেখতে। কেবল দেখতে পেল না সে গোবিন্দকে, বনলতাকে তার দুটি প্রিয় বন্ধুকে। আর অখিলকেও সে আজ পর্যন্ত পায়নি তার উঠোনে। আর একজনসে বোধ হয় কোনও দিনই আসবে না। সে হল পাগলা গৌরাঙ্গ।

আর খানিকটা বিস্ময়ের ঘোর লেগে রয়েছে তার মনে, অহল্যার নিস্তেজভাব ও থেকে থেকে অপলক অনুসন্ধানী চোখে মহিমের দিকে চেয়ে থাকা। কেন?..

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *