প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৭. গান-কাজ-নাচ

গান-কাজ-নাচ

কিন্তু শ্রমসঙ্গীদের তাৎপর্য—গানের সঙ্গে কাজের আদিম যোগাযোগটির রহস্য—স্পষ্টভাবে বুঝতে হলে আরো কয়েকটি দিকে নজর রাখা দরকার।

প্রথমত, অসভ্য মানুষদের মধ্যে—এবং পিছিয়ে-পড়ে-থাকা সভ্য মানুষদের মধ্যেও—কাজের সঙ্গে শুধুমাত্র গানেরই যোগাযোগ নয়। তাছাড়াও নাচের যোগাযোগ। বস্তুত, আদিতে নাচ ছাড়া গান সম্ভবই নয়। কিংবা, ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, আদিম মানুষদের মধ্যে নাচ-কাজ-গান—সবসুদ্ধু একসঙ্গে মিশে একাকার হয়ে রয়েছে(৯৭)। তার মধ্যে কতোটা ঠিক নাচ, কতোটুকু নিছক কাজ এবং কতোটুকু শুধুমাত্র সংগীত—এ-ধরনের তফাত করবার চেষ্টাই কৃত্রিম।

দ্বিতীয়ত, এই যে নাচ-কাজ-গান—এর তাৎপর্যটুকু বিচার করতে দেখতে পাওয়া যায় মানুষের পিছিয়ে-পড়া অবস্থায় উৎপাদন-কাজের পক্ষে নাচগান বাহুল্য তো নয়ই, বরং অনিবার্যভাবেই উদ্দেশ্যমূলক ও প্রয়োজনীয়(৯৮)।

এই দ্বিতীয় কথাটিকে মনে না রাখলে ছান্দোগ্য-বর্ণিত কুকুরদের সামগান কিছুতেই বোঝা যাবে না। তাই এ বিষয়টিকেই বিশ্লেষণ করে এগোবার চেষ্টা করা যাক।

উৎপাদন-কৌশনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে দশজন মিলে একসংগে একই কাজে হাত না লাগালে কাজটাই অসম্ভব। তার কারণ কাজের হাতিয়ার তখন এমনই স্থূল যে কারুর পক্ষেই একা একটি পুরো কাজ করবার উপায় নেই। তাই সে-অবস্থায় নিজে নিজে কোনো কাজ করবার কথা ওঠে না, কাজ যা তা ওই পুরো দলটিরই।

কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতেই মানুষের হাতিয়ার ধারালো হয়েছে, উন্নত হয়েছে তার উৎপাদন কৌশল।

উন্নতির একটি পর্যায়ে পৌঁছে দেখা গেলো একজন মানুষ নিজে একটা গোটা কাজ করতে শিখেছে। ওই একটি কাজের জন্যে দশজনে আর একসঙ্গে হাত লাগাতে বাধ্য নয়। প্রত্যেকেই যে-যার কাজ করতে পারে। কিন্তু তাই বলে যৌথ-প্রেরণার প্রয়োজন যে মিটলো তা নিশ্চয়ই নয়। প্রত্যেকেই নিজের নিজের কাজ করতে, কিন্তু সকলে মিলে দল হিসেবে কাজ করবে। বরং যে-যার নিজের কাজের দায়িত্ব নিতে পারবার দরুনই যৌথ-প্রেরণার প্রয়োজনটা বাড়বার কথা : এখন আর দশ-হাত প্রত্যক্ষভাবে এক জায়গায় মিলছে না, তাই মনের দিক থেকে প্রত্যেকের কাছেই সাহসের আর বিশ্বাসের চাহিদাটা বেশি হয়েছে।

কিসের সাহস? কোন ধরনের বিশ্বাস?

যদিও একজনের নিজের উপর গোটা কাজটার দায়িত্ব পড়েছে তবুও আসলে সে একা নয়—দলের সবাই তার সঙ্গেই রয়েছে। তারই সাহস।

কোন বিশ্বাস থেকে এ-ধরনের সাহস পাওয়া সম্ভব? যাদুবিশ্বাস।

কাজে বেরুবার আগে সবাই মিলে এক হয়ে একই কামনা করবে।

শুধু তাই নয়, সবাই মিলে এক হয়ে একসঙ্গে দেখবে ওই কামনাটি সফল হবার ছবি।

কাজ শুরু হবার আগেই কামনা সফল হবার এই ছবিটি কেমন করে দেখতে পাওয়া সম্ভব? বাস্তবে নয় নিশ্চয়ই। কল্পনায়। আর কল্পনার ছবিটি দেখবার জন্যেই আদিম মানুষের পক্ষে নাচ-গানের আয়োজন : পুরো দলকে ডাক দিয়ে তারা একসঙ্গে মিলা নাচবে আর গান করবে—নাচটার আগাগোড়াই হলো কামনা সফল হবার অনুকরণ, গানটার আগাগোড়াই হলো কামনা সফল হবার অনুকরণ। এইভাবে কামনা সফল হবার ছবিটি দেখতে দেখতে পুরো দল মেতে উঠবে, মেতে উঠে কাজে বেরুবে। দলের মাতন—সে তো আর যেমন-তেমন নয়। সেই সাহসে বুক বেঁধে বেরুতে পারলে কেউই আর নিরুপায় নয়, দুর্বল নয়। অর্থাৎ কিনা, ওই নিরুপায়-বোধ বা দুর্বলতা-বোধটি মন থেকে কেটে যায়।

আজো পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যে-সব মানুষের দল পিছিয়ে-পড়া অবস্থায় টিকে রয়েছে তাদের চেতনায় কাজের সঙ্গে নাচ-গানের সম্পর্কটা কী রকম তাই দেখা যাক।

শ্রীমতি জেন হ্যারিশন বলছেন :

When a savage wants sun or wind or rain, he does not go to church and prostrate himself before a false god; he summons his tribe and dances a sun dance or a wind dance or a rain dance. When he would hunt and catch a bear, he does not pray to his god for strength to outwit and outmatch the bear, he rehearses his hunt in a bear dance.(৯৯)
আদিম মানুষ যখন রোদ, হাওয়া বা বৃষ্টি চায় তখন সে দেবালয়ে গিয়ে কোনো অলীক দেবতার পায়ে লুটিয়ে পড়ে না। সে ডাক দেয় নিজের গোষ্ঠীকে এবং রোদের নাচ বা হাওয়ার নাচ বা বৃষ্টির নাচ নাচতে শুরু করে। ভালুক  শিকার করবার আগে ভালুকটিকে হারিয়ে দেবার জন্যে সে তার দেবতার কাছে শক্তি ভিক্ষে করে না; ভালুক নাচ নেচে শিকারের মহড়া দিয়ে নেয়।

শ্রীমতি জেন হ্যারিশন(১০০) দেখিয়ে চলেছেন, মেক্সিকোর তারাহুমারে নামের মানুষদের মধ্যে ‘নাচা’ আর ‘কাজ-করা’—দুটি বিষয় বোঝাবার জন্যে দুটি স্বতন্ত্র শব্দ নেই। একই শব্দের ওই রকম দুটো মানে। দলের নাচে যোগ না দিয়ে যদি কোনো ছোকরা বসে থাকা তাহলে বুড়োরা তাকে ধমক দিয়ে বলবে, কুঁড়ের মতো বসে না থেকে কাজে লাগছো না কেন? বয়েস বাড়া বোঝাবার জন্যে ওরা বলে, নাচের সংখ্যা বাড়া। দলের নাচে যোগ না দিতে পারলে মানুষ কপাল চাপড়ে বলে, এ-রকম অকর্মণ্য হয়ে বেঁচে থেকে লাভ কী?

নাচ-গানের সঙ্গে কাজের এই যে যোগাযোগ এর মূলে রয়েছে আদিম মানুষদের একটি অদ্ভুত বিশ্বাস। তার নামে যাদুবিশ্বাস—ইংরেজীতে বলে ম্যাজিক। কী রকমের বিশ্বাস? কল্পনায় প্রকৃতিকে জয় করতে পারলে বাস্তব ভাবে প্রকৃতিকে জয় করাও সত্যিই সম্ভবপর হবে। কল্পনায় জয় করা মানে কী? জয়ের একটা নকল তোলা,—কামনা সফল হয়েছে তারই যেন অভিনয় করা। আকাশে বৃষ্টি চাইলে ওরা দলের সবাইকে ডাক দিয়ে শুরু করবে বৃষ্টির নাচ : আকাশে জলের ছিটে ছুঁড়ে বৃষ্টির নকল তুলবে, বাজনা বাজিয়ে নকল করবে মেঘের ডাক, আর ওরা ভাববে এইভাবে কামনা সফল হওয়ার নকল করে সত্যিই বুঝি কামনাকে সফল করা সম্ভব হবে।

ওদের কাছে, আসল কাজের সঙ্গে যাদুবিশ্বাসের তফাতটা তেমন স্পষ্ট নয়। যাদুবিশ্বাস ছাড়া ওদের পক্ষে বাঁচাই কঠিন—কেননা, ওদের হাতিয়ারের অবস্থা এমনই করুণ যে, মন থেকে অন্তত দুর্বলতা-বোধটুকুকে দূর করবার চেষ্টা দরকার। দুর্বলতা-বোধকে দূর করবার কৌশল ওই যাদুবিশ্বাস। আর এই যাদুবিশ্বাসই হলো ওদের নাচ-গানের ষোলো আনা।

মাওরিদের(১০১) মধ্যে এক রকমের নাচ আছে। তাকে বলে আলুর নাচ। ফসলের জন্যে পুব-হাওয়ার দরকার। তাই ওদের দলের তরুণী মেয়েরা ক্ষেতে গিয়ে নাচতে শুরু করে। নাচের আগাগোড়াই হলো ঝড় আর বৃষ্টি আর ফুলফোটা আর ফসল-ফলার অনুকরণ। নাচতে নাচতে তারা গান গাইতে শুরু করে, গানের মধ্যে কামনার প্রকাশ : চারাগুলি যেন তাদেরই অনুকরণ করে। অর্থাৎ, ওই মেয়েরা বাস্তবে যা চায় তাই কল্পনায় ফুটিয়ে তোলে নাচের দোলায়, গানের কথায়। দৃষ্টান্তটি সম্বন্ধে অধ্যাপক জর্জ টমসনের মন্তব্যটুকু ভালো করে দেখা দরকার। তিনি বলছেন, আলুর উপর ওই নাচের কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব নিশ্চয়ই সম্ভব নয়, কিন্তু যে-মেয়েরা নাচছে তাদের নিজেদের উপর নাচটির যথেষ্ট প্রভাব পড়তে বাধ্য। নাচতে নাচতে তাদের মনে বিশ্বাস জন্মেছে যে এরই দরুন চারাগাছগুলি রক্ষা পাবে। তারপর ওই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে তারা যখন গাছগুলির পরিচর্যা করতে লাগলো তখন তাদের আত্মবিশ্বাস আর শক্তিসামর্থ ঢের বেড়ে গিয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত ফসলের উপরও নাচটার প্রভাব পড়ে বই কি। এই নাচেরই দরুন বহির্বাস্তবের প্রতি মেয়েদের মনের ভাবটা বদলায়, ফলে পরোক্ষভাবে এই নাচই বহির্বাস্তবকেও বদল করে(১০২)।

ঠিক একই বিষয় চোখে পড়ে বাংলা দেশের ব্রতগুলির মধ্যে—অবশ্যই, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেগুলিকে বলছেন খাঁটি মেয়েলি ব্রত, এবং যেগুলি কিনা, তাঁর ধারণায়, “পুরাণেরও পূর্বেকার বলে বোধ হয়”(১০৩)। অবনীন্দ্রনাথের একটি বর্ণনা দেখুন :

এমনি শস্‌পাতার ব্রত। সেখানে আমরা দেখি মানুষ শস্যের কামনা করছে; কিন্তু সেই কামনা সফল করবার জন্যে সে যে নিশ্চেষ্টভাবে কোনো দেবতার কাছে জোড়হাতে ‘দাও দাও’ করছে তা নয়; সে যে-ক্রিয়াটা করছে তাতে সত্যিই ফসল ফলিয়ে যাচ্ছে এবং ফলস ফলার যে আনন্দ সেটা নাচ গান এমনি নানা ক্রিয়ায় প্রকাশ করছে। বর্ধমান অঞ্চলের মেয়েদের মধ্যে এই শস্‌পাতার ব্রত বা ভাঁজো, ভাদ্রমাসের মন্থনষষ্ঠী থেকে আরম্ভ হয়ে পরবর্তী শুক্লাদ্বাদশীতে শেষ হয়। মন্থনষষ্ঠীর পূর্বদিন পঞ্চমী তিথিতে পাঁচ রকমের শষ্য—মটর, মুগ। অড়হর, কলাই, ছোলা—একটা পাত্রে ভিজিয়ে রাখা হয়; পরদিন ষষ্ঠীপূজায় এইগুলি নৈবেদ্য দিয়ে বাকি শস্য সরষে এবং ইঁদুরমাটির সঙ্গে মেখে একটি নতুন সরাতে রাখা হয়; দ্বাদশী পর্যন্ত মেয়েরা স্নান করে প্রতিদিন এই সরাতে অল্প অল্প জল দিয়ে চলে; চার-পাঁচদিন পরে যখন শস্য সব অঙ্কুরিত হতে থাকে তখন জানা যায় এ-বৎসর শস্য প্রচুর হবে এবং মেয়েরা তখন শস্য উৎসবের আয়োজন করে। ইন্দ্রদ্বাদশীতে এই উৎসব; চাঁদের আলোতে উঠানের মাঝখানে এই অনুষ্ঠান। নিকোনো বেদীর উপর ইন্দ্রের বজ্রচিহ্ন দেওয়া আলপনা; কোথাও মাটির ইন্দ্রমূর্তিও থাকে। এই বেদীর চারিদিকে, পাড়ার মেয়েরা সকলে আপন-আপন শস্‌পাতার সরাগুলি সাজিয়ে দেয়, তারপর সাত-আট থেকে কুঁড়ি-পঁচিশ বছরের মেয়েরা হাত ধরাধরি করে বেদীর চারদিক ঘিরে নাচগান শুরু করে। উঠানের এক অংশে পর্দার আড়ালে বাদ্যকর তাল দিতে থাকে :

ভাঁজো লো কনকলানী, মাটির লো সরা,
ভাঁজোর গলায় দেবো আমরা পঞ্চফুলের মালা।…

এরপর দুই দলে ভাগ হয়ে মুখেমুখে ছড়াকাটাকাটি করে।…সমস্ত রাত দুই দলের নাচগান ছড়াকাটাকাটির উপরে চাঁদের আলো, তারার ঝিকিমিকি।…

এরপর রাত্রিশেষ, মেয়েরা আপন-আপন শস্‌পাতার সরা মাথায় নিয়ে পুকুরে কিংবা নদীতে বিসর্জন দিয়ে ঘরে আসে। এখানে শস্যের উদ্গমের কামনা সরাতে শস্যবপন ক্রিয়া থেকে আরম্ভ হলো এবং অনুষ্ঠান শেষ হলো উৎসবের নৃত্যগীতে…(১০৪)

————–
৯৭. G. Thomson ch. xiv.
৯৮. Ibid.
৯৯. J. E. Harrison AAR 30.
১০০. Ibid 30f.
১০১. G. Thomson SAGS 440.
১০২. Ibid
১০৩. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বাংলার ব্রত ৩।
১০৪. ঐ ৫৩-৩।