১৭. কিরীটীর যুক্তি

কিরীটীর যুক্তি

সমস্ত দ্বিপ্রহর একটা টানা দিবানিদ্রা দিয়ে সকলেই যেন শরীরটা বেশ সুস্থ বোধ করে।

কয়েক দিন ধরে জাহাজে অবিশ্রাম ঢেউয়ের দোলায়, মনে হয় এখনও যেন দেহটা দুলছে।

বৈকালিক চা-পানের পর রাজু শহর দেখতে বের হয়েছিল, কিরীটী আর সুব্রত দোতলার ব্যালকনিতে পাশাপাশি দুখানা চেয়ার পেতে বসে গল্প করছিল।

সুব্রত বলছিল, যদিও আমি মুহূর্তের জন্য স্ট্রেচারে শায়িত সনৎদাকে দেখেছি, তবু–

কিরীটী বাধা দেয়, যদিও বলছেন কেন এখনও? আপনার মনে কি কোন সন্দেহ আছে সুব্রতবাবু? আপনি আমার কথা যদি বিশ্বাস করেন তা হলে জানবেন, সকালবেলার সেই স্ট্রেচারে শায়িত ব্যক্তি আর কেউ নন, আমাদের সনৎবাবুই।

কিন্তু কেন যে আপনি ভাবছেন কালো ভ্রমর সনৎদাকে প্রাণে মারবে না, এটা আমি ঠিক যেন এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।

প্রাণে যে মারবেই না বা প্রাণে মারা একেবারেই অসম্ভব, সে কথা তো আমি বলিনি সুব্রতবাবু। আপনারা আমার কথার ঠিক অর্থ ধরতে পারেননি। আমি বলতে চেয়েছি, বর্তমানে তারা সনৎবাবুর প্রাণহানি করবে না, করতে পারে না।

কেন?

আচ্ছা আপনার প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই সুব্রতবাবু!

বলুন?

আচ্ছা আপনার অমরবাবুর মত্যু সম্পর্কে কি ধারণা? আপনি কি মনে করেন সত্যিই কোন আততায়ীর হাতেই অমরবাবুর মৃত্যু ঘটেছে?

না।

কেন? কারণ তাই যদি হবে, তা হলে অন্ততঃ কালো ভ্রমর নিশ্চয়ই মৃতদেহের মুখটা ওভাবে বিকৃত করে রেখে যেত না।

তা হলে আপনি ধরেই নিচ্ছেন যে, এই হত্যা-ব্যাপারের সঙ্গে কালো ভ্রমর সুনিশ্চিত ভাবেই জড়িত আছে?

হ্যাঁ।

ঠিক তাই সুব্রতবাবু। সেইজন্যই সনৎবাবুকে বর্তমানে কালো ভ্রমর প্রাণে মারতে পারে না। কালো ভ্রমরের বিদ্বেষ শুধু সনৎবাবুর ওপরেই নয়, আপনার ওপরে অমরবাবুর ওপরেও। তবে সেই সঙ্গে আরও একটা কথা আমার মনে হচ্ছে, সনৎবাবুর ওপরে কালো ভ্রমরের রাগ বা বিদ্বেষ থাকাটা স্বাভাবিক এবং তার কারণও আমাদের চোখের সামনে আছে। কিন্তু আপনার ওপরে তার বিদ্বেষের কারণ যে কেবলমাত্র গতবারের লজ্জাকর পরাজয়ের ব্যাপারটাই, এটা মানতে যেন কিছুতেই আমার মন চায় না সুব্রতবাবু!

কেন? এ কথা বলছেন কেন কিরীটীবাবু?

তাই যদি বুঝতে পারতাম, তা হলে কালো ভ্রমরের এবারের অভিযানের অর্থটাও আমার নিকট পরিষ্কার হয়ে যেত। এই ঘটনা ঘটবার কিছুদিন আগে থেকেই কালো ভ্রমর সম্পর্কে আমি যথাসাধ্য খোঁজ নিয়েছি। একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, কালো ভ্রমর আর যাই হোক ছিচকে চোর-ডাকাত নয়। কারণ বিশেষ করে তাহলে ধনিক সম্প্রদায়ের প্রতিই তার যত কিছু বিদ্বেষ, যত বিতৃষ্ণা থাকত না এবং বিশেষ বিশেষ কতকগুলি কুকীতি ছাড়া সাধারণ আরও পাঁচটা দুর্ধর্ষ ডাকাত বা চোরের মতই হাঙ্গামা, ডাকাতি ও খুনখারাপি করে করে বেড়াত।

কিরীটীর শেষের কথায় কান না দিয়েই সুব্রত বলে, কিন্তু একটা কথা এখনও আমি বুঝে উঠতে পারছি না কিরীটীবাবু, এই এত বড় রেঙ্গুন শহরে কোন পথে আপনি সনৎদার সন্ধান করবেন?

সুব্রতর কথায় কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তার জন্যও চিন্তা নেই সুব্রত বাবু। কালো ভ্রমরকে আমাদের গৃহেই আসতে হবে।

এ আপনি কি বলছেন?

ঠিকই বলছি, এমন একটি বহুমূল্য সম্পদ হতে সে বঞ্চিত হয়েছে এবং বর্তমানে যা সম্পূর্ণ আমার অধিকারে, তারই আকর্ষণে সে আসবে। হ্যাঁ, কালো ভ্রমর আসবে। আসতে তাকে হবেই।

কিরীটীর কথাগুলো সুব্রতর নিকট যেন কেমন রহস্যপূর্ণ বলে মনে হয়। যেন পূর্ণ হেয়ালি।

আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারলাম না কিরীটীবাবু।

ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই সুব্রতবাবু। সময় এলেই সব বুঝতে পারবেন।

এমন সময় সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। কিরীটী যেন হঠাৎ উদগ্রীব হয়ে ওঠে, ঐ রাজেনবাবু আসছেন, আর তাঁর সঙ্গে বোধ হয় সলিলবাবুও আসছেন—যদি আমার অনুমান মিথ্যা না হয়ে থাকে।

সত্যিই কিরীটীর কথা শেষ না হতে হতেই প্রথমে রাজু এবং তার পশ্চাতে সলিলবাবু এসে ব্যালকনিতে প্রবেশ করলেন।

আসুন মিঃ সেন। কিরীটী আহ্বান জানায়, আপনাকে ডাকতে রাজেনবাবুকে পাঠিয়েছিলাম বটে, তবে ভাবিনি এখনই আপনি আসবেন।

জানেন তো বিদেশে স্বজাতি– সলিলবাবু হাসতে হাসতে চেয়ারে উপবেশন করলেন। তারপর প্রাথমিক পরিচয়-পর্ব শেষ করে সলিলবাবু বললেন, রাজেনবাবুর মুখেই সব শুনলাম মিঃ রায়।

এখন আপনি আমাদের সম্পূর্ণ ভরসা মিঃ সেন, কিরীটী বলে, আচ্ছা অমরবাবুর মত্যু সম্পর্কে আপনার মতামত কি জানতে পারি কি?

নৃশংস হত্যা সন্দেহ নেই। বরং এ যে সেই আগের ঘটনারই জের, তাও আমাদের ধারণা।

তারপর আবার একসময় কিরীটী কথায় কথায় সলিল সেনকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিঃ সেন, অমরবাবু যে কক্ষে শয়ন করতেন, সেখান থেকে চিৎকার করলে বা কোন গোলমাল হলে, নীচের ভৃত্যদের ঘরে কি শোনা যায়?

না। আমি সেটা পরীক্ষা করে দেখেছি, শোনা যায় না।

ভৃত্য তাহলে কোন চিৎকার বা গোলমালই শুনতে পায়নি সে-রাত্রে?

না।

আচ্ছা লোকটা এদেশীয় কি?

হ্যাঁ।

লোকটা এখন কোথায়, নিশ্চয়ই হাজতে? ভাল কথা, করোনারের ভারডিকট কি?

কেউ বা কারও দ্বারা অমরবাবু নিঠুর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন।

আচ্ছা আপনাদের ডি, আই, জি, লোকটা ইউরোপীয়ান নিশ্চয়ই?

অ্যাংলো-বার্মিজ।

আপনাদের ডিপার্টমেন্টে কালো ভ্রমরের একটা full details নিশ্চয়ই আছে?

আছে। সে

টা আমি একবার দেখতে পারি কি?

নিশ্চয়ই, কাল আমার ডিপার্টমেন্টে আসবেন, দেখাব। তাছাড়া আমাদের সুপারও আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হতে ইচ্ছুক।

রাত্রি প্রায় নটার সময় ইন্সপেক্টার সলিল সেন ওদের নিকট হতে বিদায় নিলেন।

ভৃত্য ঐ সময় সংবাদ দিল আহার্য প্রস্তুত। আহারাদির পর সকলে এসে যে যার শয্যায় আশ্রয় নিল।

সুব্রত ভাবছিল কিরীটীর কথাগুলিই। কিরীটীর অদ্ভুত বিচার ও বিশ্লেষণ শক্তি সত্যই তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তবু কিছুতেই সে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না, কেন কিরীটীর ধারণা কালো ভ্রমর সনৎদাকে এখনই প্রাণে মারবে না!

কি জানি, সুব্রত আবার ঐ সঙ্গে ভাবে, সব কথা যে কিরীটীবাবু, খোলসা করে খুলে বলতে চান না!

উনি কি সুব্রতকে বিশ্বাস করেন না?

রাজুকে যে সলিলবাবুর সন্ধানে পাঠিয়েছেন, সে কথা পর্যন্ত উনি তার নিকট গোপন করে রেখেছিলেন, কিন্তু কেন?

আর কিরীটী ভাবছিল সম্পূর্ণ অন্য কথা। কালো ভ্রমর নিজে থেকে ধরা না দিলে কোনমতেই তাকে ধরা যাবে না।

সনৎ-এর উধাও হওয়ার দিন থেকে পর পর এই কদিনের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে যেন তাই মনে হচ্ছে।

অবিবেচকের মত কোন কাজই কালো ভ্রমর করতে পারে না। প্রতিটি পদবিক্ষেপ সে হিসাব করে ফেলে।

এত বড় দলের যে দলপতি, অথচ কেউ আজ পর্যন্ত তার আসল পরিচয়টা পর্যন্ত জানে না এবং জানাতেও কালো ভ্রমর শুধু ইচ্ছুকই নয় তাই নয়, যাতে অন্য কেউ তার সত্যকারের পরিচয়টা না জানতে পারে, তার জন্য সে অত্যন্ত সচেষ্ট ও যত্নবান। কিন্তু কেন?