১৭. আবু নওয়াস হাঁটছিল

আবু নওয়াস হাঁটছিল।

পাশে দজ্‌লা বয়ে চলেছে। মেঘে গোধূলির ঝিলিমিলি। এখানে শহর থেমে গেছে। বেবহা ময়দানের প্রারম্ভ। মরুভূমির অংশ বিশেষ। তবে এখানে আবাদ আছে। আর আছে খুর্মা গাছের সারি।

নদীর উপর গুফাদারেরা গুফা বেয়ে চলেছে। কোন কোন গুফা বোঝাই তরমুজ, তামাক কফি। সন্ধ্যার আগে ঝাপসা স্তিমিত এই জীবন-লীলার দিকে নওয়াসের কোন লক্ষ্য নেই। বালু-তীর। খালি পায়ে হাঁটার জন্য মনোরম। নওয়াস তাই হাঁটছে। তীরে দজ্‌লার ঢেউ এসে লাগে, কখনও কখনও নওয়াসের পায়ে আছড়ে পড়ে। কবি একটু চমকায় মাত্র। তারপর হাঁটতে থাকে। কোন কিছুর দিকে তার আকর্ষণ নেই। উটের কাফেলা চলেছে দূরে দূরে। গোধূলির অন্ধকারে খেজুর বীথির পাশে পাশে এই দৃশ্য অবসরভোগীর আশীর্বাদ। কিন্তু নওয়াসের চোখ আজ কোন বস্তুর উপর এককভাবে বিদ্ধ হয় না। দৃষ্টি স্পর্শ করে, গ্রহণ করে না কিছুই।

নওয়াস যেন আজ অনন্তের মুসাফির। তাড়াহুড়া নেই, ক্ষিপ্রতা নেই। আরো–আরো কিছু আছে চোখে দেখার। তাই হঠাৎ একাগ্রতার প্রয়োজন-বোধ লাগে না।

নওয়াস হাঁটছিল। দজ্‌লা ঈষৎ শান্ত, ঈষৎ নীরব! তবু মানুষের মেহনতের নানা পট তো সাজানো। নওয়াস তা দেখতে প্রস্তুত নয়।

মরুভূমির বুকে কি সে কোন পানশালার খোঁজ পেয়েছে? না, এই বালুর চাঁচর রাজ্যে পানি স্বপ্ন-মাত্র। পাশালা ত বেহেশত।

আর শহরের শ্রেষ্ঠ পান্‌শালা ত সে ছেড়ে এসেছিল গোধূলির পূর্বে।

আকাশে নক্ষত্র ফুটতে থাকে এক এক করে। নওয়াস সেদিকে একবার তাকিয়ে দিগন্তেই কি যেন খুঁজতে লাগল। পানশালার পর নারী নওয়াসের অন্বিষ্ট। কিন্তু মানবীর কোন প্রয়োজন নেই তার। চাঁদ-সড়কের রোক্কাসাদের উঁচু বুক আজ তাকে বাধা দিতে পারে নি।

হঠাৎ থামল নওয়াস। দজ্‌লার কুলুকুলু-র শুধু তার কানে আসে। আর কোন শব্দ সে কান দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না।

দিগন্তের দিকে নওয়াসের দুই চোখ অন্ধকারে যেন প্রশ্নের জবাব খুঁজছে। প্রশ্নকারী, উত্তরদাতা উভয়ই সে নিজে।

নওয়াসের দুই ঠোঁটে হঠাৎ মৃদু হাসির আঁচড় দেখা গেল। তারপর বেশ জোরেই হেসে উঠল সে।

আন্দোলিত মন তখন ঠোঁটের কিনারায় প্রতিধ্বনি তোলে : নওয়াস, নওয়াস। আরো হাসো, হাসো। দুনিয়ায় তোমাকে সকলে শরাবী মদ্যপ বলেই জানবে। আর জানবে কবিরূপে। বলবে, ব্যভিচারী নওয়াস। তোমার কলঙ্কই বেঁচে থাকবে, তোমার অস্তিত্ব থাকবে না। কেউ জানবে না, তুমি কেন কলঙ্কের কালি-বোঝা নিজের মুখে মাথায় তুলে নিয়েছিলে? হাসো, হাসো, নওয়াস।

নওয়াস সত্যি নিজের মনে হাসতে লাগল। তারপর চুপ করে গেল। গম্ভীর তার মুখাবয়ব।

খেজুরের বীথি এখানে ঝাপসা, আকাশের গায়ে এসে মিশেছে।

আবার নওয়াস সোচ্চার বলতে লাগল : আমিও মানুষের মনের অন্ধকারে এমনই আকাশ রচনা করে যাব। মৃত্তিকা-জাত, তবু আসমানের সঙ্গী। আমার কলঙ্ক কেউ বুঝবে না। জীবনের দিকে দিকে হে অমৃতের পুত্র, অগ্রসর হও। মৃত্তিকা থেকে আকাশে পাড়ি দাও–কিন্তু তোমার দুই পা সব সময় যেন মাটির উপর থাকে। এইভাবে আকাশও তোমার কাছে ধরা দিয়ে যাবে। কিন্তু তোমরা তা করো না। আকাশের খোঁজে এগোও, এদিকে পৃথিবীতে হারিয়ে যাও। তোমাদের মানুষ বলেই আর কেউ চেনে না। তুমি পৃথিবী-বিস্মৃত, তাই মনুষ্যত্ব-বিস্মৃত। নওয়াস তাই কলঙ্কের কালি মেখে নিলে। শিব-হাল নওয়াস। আবে-হায়াৎ বিলিয়ে দিয়ে জহর নিজে পান করলে। শূন্য আকাশ তোমাদের কাছে এত প্রিয় যে, বৈচিত্র্য-গর্ভা পৃথিবীর দিকে তাকালে না। তাই কবি নওয়াস তার কবি-ব্ৰত ধারণ করলে–। হোক পাক, সহজ আনন্দ–এই সহজ আনন্দের দিকে আগে মানুষকে টানো–জীবনকে ভালবাসতে শিখুক মানুষ। তাই ত শরাব-সাকী আমার কাব্য প্রাত্যহিকতার প্রতীক। কাকে বোঝাব এই কথা?–একটি মানুষ-যদি পৃথিবীতে মানুষের মত বাঁচবার অভিলাষী হয়, নওয়াসের কলঙ্ক সার্থক। সূর্যের মত আমার জন্য থাক্ কলঙ্ক জ্বালা আর জ্বালা–তোমাদের জন্যে থাক শুধু প্রাণদাত্রী আলো আর আলো। চতুর্দিকে কালিমা-ময় জাল বিছিয়ে অঙ্গার কী হীরককে জ্যোতিহীন, না নির্মূল করতে পারে? কিন্তু নওয়াস, তুব–তবু, তোমার হৃদয় আবেগ উদ্বেলিত কেন? শান্ত হও, মন। রাত্রি নামে গোধূলি শিখরে

নওয়াস হঠাৎ অল্প জায়গার মধ্যে পাগলের মত পায়চারী করতে লাগলো। অন্ধকার চারিদিক থেকে হেঁকে ধরেছে। নওয়াস তারই কয়েদখানায় হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে : না, না।

সে জানে এই কণ্ঠস্বর কারো কাছে পৌঁছাবে না। তবু থেকে গেল সে, বুকে অস্থিরতা সত্তেও। আবার শহরের দিকে মুখ ফেরায় আবু নওয়াস। রহস্যময়ী দীপান্বিতা বগ্‌দাদ আবার হেসে উঠেছে। সেখানেই ত সে ছুটে যাবে। জীবনধারা থেকে আঁজলা পান না করলে ত তার তৃষ্ণা মিটবে না। মানুষের জীবনই মদিরা বিশেষ, তাই ত সে মদিরায় জীবনকে খুঁজেছে।

বগ্‌দাদ-অভিমুখী নওয়াস। দজ্‌লা হয়ত জোয়ারে উত্তাল। তার পদধ্বনি বার বার শমে তেহাই মারছে। গজল গাইছে গুফাদারেরা দল বেঁধে। সুরের খেই পাকড়ে গুন গুন করতে লাগল আবু নওয়াস।

জীবনের সবক নিতে বাদেই ত তাকে ফিরে যেতে হবে। বিরাট মরুভূমি আর শূন্যতার উপাসনা তার ব্রত নয়।

আবু নওয়াস জোর পা ফেলতে লাগল।

শহরের দরওয়াজার কাছাকাছি দজ্‌লার বুকে বিপণী-সারির আলো পড়েছে।

নওয়াস ভাবলে, “দজ্‌লা ত নদী নয়–আমার বুক। সম্মুখে কোথাও অন্ধকার আছে বলে কী এই নদীর স্রোতদল শহরের আলোস্নাত এক জায়গায় থমকে দাঁড়ায়? অন্ধকারের রহস্য কী তাদের টানে না?… আমি নিজেই এক দজ্‌লা।”

হাল্কা বুকে হাসল আবু নওয়াস। অতঃপর নিকটস্থ এক পানশালায় ঢুকে পড়ল, সেখানে আবুল আতাহিয়া তার প্রতীক্ষার্থী বসে ছিল।

–এসো, এসো। কোথায় ছিলে তুমি?

–হারিয়ে গিয়েছিলাম, আতাহিয়া।

আতাহিয়া : তুমি দেখছি আর এক মেহেরজান।

নওয়াস : না, আবুল আলাহিয়া। সত্যি হারিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। এই খুঁজে পাওয়ার আনন্দটুকু আজ পান করব। আমার শরাবের প্রয়োজন হবে না।

আতাহিয়া : বেশ, তবে চলো, ওঠা যাক। বগ্‌দাদের নৈশ স্রোতে অবগাহনের পর আজ ঘরে ফিরব। এসব জায়গা আমার ভাল লাগে না। তোমার জন্যেই শুধু আসা।

নওয়াস : বেশ, তাই চলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *