১৭. অবিনাশ পায়চারি করছেন

অবিনাশ পায়চারি করছেন আর মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করে চলেছেন—

নির্মম নিয়তি। অন্তিম সময়ে
একি মহা বিস্মরণ! গুরুদেব!
গুরুদেব!–ক্ষমা কর। ক্ষমা
কর প্রভু। অস্ত্র আবাহন মন্ত্র
দাও প্রভু ফিরাইয়া মোরে।

নিঃশব্দে ঘরের দরজাটা খুলে গেল এবং ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন গান্ধারী দেবী।

কাকামণি!

কে? ফিরে তাকালেন সঙ্গে সঙ্গে অবিনাশ চৌধুরী।

আমি গান্ধারী।

আয় মা। দুর্যোধন—দুর্যোধনকে কি ওরা নিয়ে গেল?

হ্যাঁ। এই আধঘণ্টাটাক আগে পুলিসের লোক এসে মৃতদেহ নিয়ে গেছে।

অভিশাপ—বুঝলি মা, এ সুরমার অভিশাপ!

সতী নারী দেছে অভিশাপ।
তীব্র নিরাশায় কেটে যাবে দিন
সহস্র বান্ধব মাঝে রহিব একাকী–
আমার মনের ব্যথা কেহ বুঝিবে না,
কণ্টক হইবে শয্যা—

কাঁদতে পারছি না মা—আমি কাঁদতে পারছি না। সুরমাই আমার সমস্ত চোখের জল মুছে নিয়ে গিয়েছে।

একটু থেমে অবিনাশ চৌধুরী আবার বলতে থাকেন, চার বছর আগে এই বাড়ি থেকে যেদিন সুরমার মৃতদেহটা পালঙ্কের ওপর থেকে নিয়ে ওরা বের হয়ে গেল, সেই দিন—সেই দিনই এ-বাড়ির সমস্ত ঐশ্বর্য বিদায় নিয়েছিল চিরদিনের মতই। একটা দিনের জন্য তাকে শান্তি দেয়নি ওই দুযযাধন। টাকা—টাকাই কেবল চিনেছিল। কিন্তু পারলি নিয়ে যেতে সঙ্গে সেই টাকা? একটা পয়সা নিয়ে যেতে পারলি? এত চিকিৎসা, এত আয়োজন সবই মিথ্যে হয়ে গেল তো?

আপন মনেই এবং আপন খেয়ালেই যেন অবিনাশ কথাগুলো বলে যান। গান্ধারী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনতে থাকে।

মেজাজী ও অত্যন্ত খেয়ালী প্রকৃতির খুল্লতাতকে গান্ধারী দেবী বেশ ভাল করেই চেনেন। নিজের চলার পথে আজ পর্যন্ত এতটুকু বাধাও অবিনাশ কখনও সহ্য করেননি। কারও উপদেশ বা পরামর্শকে কোনদিন গ্রহণ করেননি। নিজের বিচারবুদ্ধিতে চিরদিন যা ভাল বুঝেছেন তাই করেছেন। তাঁর কথার মধ্যে কোনরূপ মন্তব্য প্রকাশ করলে বা কথা বললে মুহূর্তে যে তিনি বারুদের মত জ্বলে উঠবেন গান্ধারী দেবী তা ভাল করেই জানেন। তাই বোধ হয় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন গান্ধারী দেবী।

কথাগুলো বলে অবিনাশ আবার আপন মনেই ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন নিঃশব্দে। তারপর হঠাৎ একসময় যেন অদূরে নিঃশব্দে দণ্ডায়মান গান্ধারী দেবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলে ওঠেন, গান্ধারী, তুই আবার এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কি চাস?

একটা কথা বলতে এসেছিলাম কাকামণি!

কি বলবি বলে ফেল! হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কি?

আশ্চর্য, এ যেন সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ।

একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেছে কাকামণি—

কি–কি হয়েছে?

বলছিলাম, শকুনি পালিয়েছে–

শকুনি পালিয়েছে! সে কি? হঠাৎ সে হতভাগাটা আবার পালাতেগেল কেন? কিন্তু তুই-তুই সে কথা জানলি কি করে?

এই কিছুক্ষণ আগে কৈরালা এসে প্রসাদকে বলেছে কথাটা। প্রসাদ আমাকে বলে গেল। বৃহন্নলার টু-সিটার গাড়িটা নিয়ে সে পালিয়েছে।

ইডিয়েট! গর্দভ!

কিন্তু তার পালানো ছাড়া আর উপায়ই বা ছিল কি?

মাথামুণ্ডু কি বলছিস তুই?

উত্তরে গান্ধারী দেবী কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকেন।

অবিনাশ খিঁচিয়ে ওঠেন, জবাব দিচ্ছিস না কেন? বল না, হঠাৎ সে গর্দভটা পালাতেই বা গেল কেন?

কাল রাত্রে—গান্ধারী ইতস্ততঃ করতে থাকেন।

কি–কাল রাত্রে কি? উত্তেজিত ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করেন অবিনাশ।

কাল রাত্রে তখন বোধ করি রাত পৌনে চারটে হবে, ওর পাশের ঘরের লাগোয়াই তো আমার শোবার ঘর, একটা ছপছপ জলে কাপড় কাচার শব্দ শুনে সন্দেহ হওয়ায় আমার ঘরের লাগোয়া যে পেছনের বারান্দা আছে সেই বারান্দা দিয়ে ওর ঘরে বন্ধ জানলার কপাটের খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি—

কি—কি দেখেছিস তুই?

ঘরের কুঁজো থেকে জল ঢেলে ঢেলে তাড়াতাড়ি করে শেকো একটা কাপড় ধুচ্ছে। আর মাঝে মাঝে আলোর সামনে তুলে ধরে কাপড়টা দেখছে। সে সময় আমি দেখেছি

কি–কি দেখেছিস?

দেখলাম কাপড়ের সেই অংশে ছোপ ছোপ রঙের লাল দাগ। আজও সে কাপড়টা ঘরের কোণেতেই পড়ে ছিল। সকালে কিরীটীবাবু ওর সঙ্গে কথা বলে চলে আসবার পর কাপড়টা পরীক্ষা করে দেখেছি, ধুলেও তাতে অস্পষ্ট রক্তের দাগ লেগে রয়েছে এখনও।

রক্ত! কিসের রক্ত? রক্ত আবার কোথা থেকে এল তার কাপড়ে?

আমি ভেবেছিলাম প্রথমে ছোড়দাই বোধ হয়—

গান্ধারী! চাপা কণ্ঠে একটা যেন গর্জন করে ওঠেন অবিনাশ রোষকষায়িত লোচনে গান্ধারীর দিকে চেয়ে।

হ্যাঁ কাকামণি, আমি ভেবেছিলাম ছোড়দাই হয়ত—তুমি তো জান না, দিন কুড়ি-পঁচিশ আগে একদিন বেলা তখন দুটো কি আড়াইটে হবে, দাদা সেই সময়টা দু-চার দিন সুস্থই ছিলেন—নার্স সব সময় বড় একটা কাছে থাকত না, ডাক্তার সানিয়ালও ঐদিন দুপুরে ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি নিয়ে শহরে গিয়েছিলেন, ওদিকটা একরকম খালিই ছিল, দাদা একটু আগে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন বলে তাঁর ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে থমকে দাঁড়ালাম।

অবিনাশের চোখের তারা দুটো তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসায় ছুরির ধারাল ফলার ন্যায় চকচক করতে থাকে। মুখের শিরা-উপশিরাগুলি যেন সজাগ হয়ে ওঠে। চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন অবিনাশ, কেন? দাঁড়ালি কেন?

ছোড়দার গলা শুনে।

ছোড়দা—মানে দুঃশাসন?

হ্যাঁ। তাই মনে হয়েছিল।

ঠিক মনে আছে তোর দুঃশাসনের গলাই শুনেছিলি?

হ্যাঁ, তেমনি কর্কশ ভাঙা-ভাঙা। চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছিল। ছোড়দাই দাদার সঙ্গে কথা বলছিল।

কি-কি বলছিল সে? উত্তেজনায় অবিনাশের কণ্ঠের স্বর যেন বুজে আসে।

বলছিল, বিশ্বাস কর তুমি, ও চিঠি তোমাকে আমি দিইনি। দাদা জবাব দিলেন, হতভাগা, তুই ভাবিস তোর হাতের লেখা আমি চিনি না? কিন্তু আমি এতটুকুও কেয়ার করি না। কিরীটী রায়কে আনাব। যেই চিঠি লিখে থাকুক, সব জারিজুরি সে ভেঙে দেবে।

তারপর?

ছোড়দা তার জবাবে বললে, তুমি বিশ্বাস কর আর নাই কর, আমি বলছি আমি বিন্দু বিসর্গও জানি না। তবে এও তোমাকে বলছি, তুমি তোমার উইল যদি না বদলাও তোমার কপালে সত্যিসত্যিই অপঘাতে মৃত্যু আছে।

শয়তান! বলছিল শয়তানটা ও কথা?

হ্যাঁ। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে বোধ হয় সেটা ছোড়দার গলা নয়—

তবে?

বোধ হয়—এখন মনে হচ্ছে সেটা শেকোর গলা।

শকুনির গলা!

হ্যাঁ। আমি আর দাদার সঙ্গে দেখা করতে সাহস পেলাম না। কারণ পরমুহর্তেই দাদা যেন। মনে হল অত্যন্ত চটে উঠেছেন। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে এলাম। তারই আধঘণ্টাটাক পরে আবার যখন দাদার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি দেখি মুখ লাল করে শেকো দাদার ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। এবং আমার পাশ দিয়েই গজর গজর করতে করতে চলে গেল।

হুঁ। কিরীটীবাবু এসব কথা জানেন, না জানেন না?

না বলিনি। কিন্তু শেকো পালিয়েই তো সর্বনাশ করলে। পুলিসের লোকেরা বিশেষ করে মিঃ রায় ওকেই এখন দাদার হত্যার ব্যাপারে সন্দেহ করবেন হয়তো

ননসেন্স! সন্দেহ করলে হল? চুপচাপ থাক, কোন কথা কাউকে বলবি না খবরদার।

সহসা এমন সময় যেন ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হল।

ভেজানো দুয়ার ঠেলে কিরীটী ঘরের মধ্যে পা দিল, ক্ষমা করবেন চৌধুরী মশাই, ক্ষমা করবেন গান্ধারী দেবী। গান্ধারী দেবী, আপনাকে এ-ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই দূর থেকে বাধ্য হয়েই আমাকে interrupt করতে হল আপনাদের ব্যক্তিগত কথাবার্তার মধ্যে। আমি আপনাকে অনুসরণ না করে পারিনি। দরজায় কান পেতে আপনাদের সব কথাও আমি এতক্ষ। শুনেছি।

সহসা যেন কিরীটীর কথায় বারুদ-পে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পড়ে। চিৎকার করে উঠলেন অবিনাশ চৌধুরী, বেশ করেছেন শুনেছেন! বেরিয়ে যান এ ঘর থেকে এই মুহর্তে। হামবাগ

বৃথা আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন চৌধুরী মশাই। অবশ্যম্ভাবীকে কেউ রোধ করতে পারে না।

গান্ধারী দেবী যেন পাষাণে পরিণত হয়েছেন। নিশ্চল স্থাণুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকেন নিঃশব্দে।

কিরীটী বলতে থাকে, যে কাজে আমি হাত দিয়েছি সে কাজ আজ আমি শেষ করে যাবই–

রায় মশাই! কিরীটীর কথা শেষ হল না, তীক্ষ্ণ অনুচ্চ কণ্ঠে অবিনাশ চৌধুরী যেন একটা চিৎকার করে ওঠেন।

চৌধুরী মশাই, যাচ্ছি আমি চলে; তবে একটা কথা কেবল যাবার আগে বলে যাই, আড়ি পেতে লুকিয়ে আপনাদের ঘরোয়া কথা শোনবার মধ্যে আমার দিক থেকে অসৌজন্য হয়তো কিছুটা প্রকাশ পেয়ে থাকবে, কিন্তু ন্যায়ত ও ধর্মত যে স্বৰ্গত আত্মার কাছে আমি সত্যবদ্ধ—দায়ী, সেটুকু না পালন করে এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আমার উপায় নেই। তাই আশা করি সেইটুকু বিচার করে আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন।

অত্যন্ত ধীর ও শান্ত ভাবে কথাগুলি বলে অতঃপর কিরীটী সত্যি সত্যিই ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং যাবার মুখে হাত দিয়ে ঘরের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেল পেছন থেকে।

.

আর ঘরের মধ্যে নিশ্চল পাষাণের মত দাঁড়িয়ে রইলেন অবিনাশ চৌধুরী ও গান্ধারী দেবী। দুজনেই নির্বাক, কারও মুখে কথা নেই।

কিরীটী সোজা নিজের ঘরে এসে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে সোনার লকেটটা বের করল।

কার প্রতিকৃতি লকেটের অভ্যন্তরে সযত্নে রক্ষিত? কে ঐ নারী? এ বাড়ির কোন মুখের সঙ্গেই তো মিল নেই। আর রায়বাহাদুরের ঘরের খাটের তলায়ই বা এটা এল কি করে? লকেটটার সঙ্গে বাঁধা লাল সুতোটা পুরনো হয়ে গিয়েছিল, তাই বোধহয় ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছে লকেটটার মালিকের অজ্ঞাতে। কিন্তু কার হাতে বাঁধা ছিল লকেটটা?

রায়বাহাদুরের কি? সম্ভব নয়, কারণ তাঁর হাতে বাঁধা থাকলে তিনি লকেটটা পড়ে গেলে নিশ্চয়ই জানতে পারতেন।

তবে কে?

দুঃশাসন-বৃহন্নলা-ডাঃ সমর সেন-সুলতা কর-ডাঃ সানিয়াল-অবিনাশ চৌধুরী, কেকার হাতে ছিল?

.

১১ নং পয়েন্ট : মৃত রায়বাহাদুরের ঘরে লাল সুতো বাঁধা সোনার লকেটে সুন্দরী তরুণীর প্রতিকৃতি।

টীকা: কোন ব্যর্থ প্রেমিকের গোপন প্রেমের নিদর্শন নয় তো ঐ লকেট!