১৬. হ্যারিকেনের ম্লান আলো

হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে যোগানন্দ যেন মুগ্ধ হয়ে যায়। যদিও নেশা।টা তখনও মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে চনচন করছে।

যোগানন্দ ঘরে ঢুকতেই সবিতা মদের গন্ধ পেয়ে একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু যোগানন্দর কথায় সেটা কেটে গেল।

দিদি! কেন যেন আপনাকে দিদি বলতেই ইচ্ছে করছে। আপনি নিশ্চয়ই মদের গন্ধ পেয়েছেন। মদ আমি খেয়েছি দিদি, অস্বীকার করব না। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন। আপনার সঙ্গে আজ রাত্রে দেখা হবে জানলে মদ নিশ্চয়ই আমি খেতাম না। তবে মদ খেলেও, জানবেন মাতলামি আমি করি না।

কি জানি কেন, সবিতারও প্রথম হতেই যোগানন্দকে ভাল লাগে। তার সমস্ত অনুভূতি যেন বলে, লোকটা আর যাই হোক শয়তান বা দুষ্ট প্রকৃতির নয়। তাই আলাপ জমতে দেরি হয় না। যোগানন্দ সহজেই দু’দণ্ডে সবিতার মনে একটি স্থায়ী আসন করে নয়।

সে রাত্রে আর যোগানন্দর বিদায় নেওয়া হয় না।

রাত্রি ভোর হলে চা খেয়ে সে বিদায় নেয়। এবং যাবার সময় সবিতার অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনিলের হাতে সত্যিই শ’খানেক টাকা গুঁজে দিয়ে যায়।

কিন্তু যে উচ্ছৃঙ্খলতার বীজ অনিলের রক্তের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল সেই উচ্ছৃঙ্খলতার পথেই সেই একশত টাকা উবে যেতে পাঁচ দিনও লাগল না।

তারপর যে অভাব সেই অভাব।

আবার নেয় টাকা অনিল যোগানন্দর কাছ থেকে এবং আবার তা ফুরিয়ে যায় একদিনে। ঐভাবে দুতিনবার চলে।

উপন্যাসের কল্পিত এক কাহিনীর মতই যেন যোগানন্দর আবির্ভাব সবিতা ও অনিলের জীবনে।

সেবারে কিছু দিন পরে আবার যখন এক রাত্রে ঘটল যোগানন্দর আবির্ভাব, অনিল বাসায় ছিল না।

সবিতাই যোগানন্দকে বসতে বললে বসুন, এসেছেন যখন যাবেন কেন?

তা বসছি। কিন্তু ঐ সম্বোধন, আপনি আজ্ঞেটা ছাড়তে হবে। দিদি বলে যখন ডেকেছি সে দাবিটা এই অধম জনের রাখতে হবে এবং শুধু রাখাই নয়, সেই সঙ্গে বড় বোন ছোট ভাইকে যেমন তুমি বলে ডাকে তেমনি বলবে তুমি এবার থেকে।

সবিতা হেসে বলে, তাই হবে।

তাই হবে না, বলুন তুমি!

বেশ বলব।

আঃ সত্যি কি যে আনন্দ পেলাম দিদি। আর বুঝতে পারলাম ভগবান এখনো এই হতভাগ্যটাকে একবারে ভোলেননি।

বোস, চা করে আনি।

চা নিশ্চয়ই হবে, আপনার হাতের চা না খেয়ে নড়ছিই না। কিন্তু অনিলবাবুকে দেখছি না কোথায়ও, বেরিয়েছেন বুঝি?

সবিতা চুপ করে থাকে।

দিদি!

সে নেই।

নেই?

দশ দিন বাড়িতে আসেন না।

সে কি!

ও আর এমন কি! সবিতা হাসে।

তাই তো—তাহলে—যোগানন্দ বলে।

কি ভাই?

একা একা আছেন–

অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।

তা যেন হল। কিন্তু আপনাদের চলছে কি করে? কিছু মনে করবেন না দিদি—

যেমন করে আগে চলছিল। দুটো টিউশনি করি। কিন্তু দুজন স্ত্রীলোক একা একা এই বাড়িতে ভয় করে না তো দিদি?

এমন সময় হঠাৎ অনিল ফিরে এল, হাতে একটা পোটলা।

এই যে যোগানন্দ! কতক্ষণ? অনিল প্রশ্ন করে।

এই কিছুক্ষণ। কিন্তু এ দশ দিন ডুব দিয়েছিলে কোথায়? যোগানন্দ বলে।

বর্ধমানে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। অনিল বললে।

হঠাৎ বর্ধমানে দেশের বাড়িতে? প্রশ্ন করে এবারে সবিতা।

হ্যাঁ, অনেক দিন যাইনি। তাই দেখতে গিয়েছিলাম একবার। যা দেখলাম, বাড়িঘর অবশ্য ভেঙে গিয়েছে, কঁচা টিনের বাড়ি—একটা পাক ঘর ছিল, সেইটা কোনমতে টিকে আছে।

তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে সেখানে গিয়ে থাকলেই তো হয়! কিন্তু ঐ বাড়ির কথা তো কোন দিনও তুমি আমাকে বলনি? সবিতা বলে।

বলবার মত নয় বলেই বলিনি। সে যে এ বাড়ির থেকেও এক ডিগ্ৰী–

তা হোক, তবু তো নিজের ভিটে-পরের ভাঙা বাড়িতে ভাড়া টানার চাইতে নিজের পড়ো ভাঙা ভিটেও ঢের সুখের, ঢের সম্মানের। চল আমরা কালই সেখানে যাব।—

তাই যাও না অনিল—যোগানন্দ বলে।

ক্ষেপেছ তুমি যোগানন্দ! সেখানে কোথায় যাবে? কথাটা শুরুতেই চাপা দিয়ে দেয় অনিল

কেন, একটা ঘর তো আছে বলছিলো! সবিতা বলে।

থাকাটাই তো কেবল সব নয়, সেখানকার ম্যালেরিয়া–

তা হোক–

না না, ওখানে যাওয়া হবে না। অনিল বলে ওঠে।

যোগানন্দ উঠে দাঁড়ায় ঐ সময়, অনিল তার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে যায় এবং যোগানন্দর কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে নেয়।

যোগানন্দ টাকা দিতে গিয়ে এবারে বলে, এমনি করে বার বার পরের জমি থেকে মাটি কেটে এনে নিজের ঘরের গর্ত তো ভরাট করতে পারবে না। অনিল। যা হোক একটা কিছু করো না।

ঘাবড়াও মাৎ ভায়া! তোমার দেনা এবার বোধ হয়। শিগগিরি শোধ করে দিতে পারব আর সব অভাবও ঘুচিবে।

কি রকম?

দেখ না। অভাব বাধ হয় এবার সত্যিই ঘুচল!

ভাল। যোগানন্দ মৃদুকণ্ঠে বলে।

ভাল নয় হে, সত্যিই দেখো কেমন বরাতের চাকাটা ঘুরে যায়।

অনিলের চোখেমুখে একটা আনন্দােজজুল দীপ্তি ঝলমল করে।

যোগানন্দ একটু বেশ বিস্ময়ই অনুভব করে। বলে, ব্যাপার কি বল তো সত্যি করে! লটারিতে টাকা পাচ্ছ, না কোন গুপ্তধনটন আবিষ্কার করে ফেলেছে?

সে যাই হোক, সময়ে সবই জানবে।

সবিতাকে লুকিয়ে অনিল সে রাত্রে যোগানন্দর কাছ হতে টাকা নিলেও সবিতার নজর এড়ায়নি। যোগানন্দ যাবার পর সবিতা স্বামীকে বলে, আবার টাকা নিলে যোগানন্দর কাছ হতে?

ভয় নেই, ভয় নেই-এবারে সব শোধ করে দেব এক কিস্তিতে।

সব এক কিস্তিতে শোধ করে দেবে?

হ্যাঁ

কেমন করে শুনি?

দেখই না! অনিল রহস্যপূর্ণ হাসি হাসতে থাকে।

এর পর কয়েকটা দিন অনিল আর কোথাও বের হয় না। এবং কোথাও বের হলেও ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আবার ফিরে আসে। দিবারাত্র ঘরেই থাকে। আর মধ্যে মধ্যে একটা লাল-মলাট-বঁধানো জীর্ণ খাতার পাতা উল্টে পাল্টে পড়ে গভীর মনোযোগ সহকারে।

সবিতার কৌতূহল হল ব্যাপারটা কি জনবার জন্য কিন্তু সুযোগ পায় না।

সর্বদা যেন যখের ধানের মতই অনিল লাল মলাটওয়ালা খাতাটা ও পোঁটলাটা আগলে রেখেছে।

শুধু সবিতাই নয়, এবারে বাণীও বাপের ওপরে সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখে।

সে এবারে ঠিক করেছে বাপকে কিছুতেই নজরছাড়া করবেনা, কারণ তারও মনে একটা সন্দেহ জেগেছে। নিশ্চয়ই আবার তার বাপের মাথায় কোন দুরভিসন্ধি বাসা বেঁধেছে!

হঠাৎ একদিন অনিলের অনুপস্থিতির সুযোগে সবিতা পোটলা খুলে দেখে তার মধ্যে নেকড়া জড়ানো আছে একটি সোনার কঙ্কন, কিন্তু ব্যাপারটা ভাল করে বুঝবার আগেই হঠাৎ আবার অনিল ফিরে আসায় পোটলাটা যথাস্থানে রেখে দিতে বাধ্য হয় সবিতা। এবং পরদিনই প্রাতে ঘুম থেকে উঠে সবিতা দেখল তার স্বামী ও বাণী দুজনের একজনও ঘরে নেই।

প্রথমটায় সবিতা ভেবেছিল তারা বােধ হয় দুজনে কোথাও বের হয়েছে, কিন্তু দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হল তখনও দুজনের একজনও ফিরল না দেখে সবিতা রীতিমত চিন্তিত হয়ে ওঠে। ঠিক ঐ সময় হঠাৎ তার রামায়ণটার ভিতরে বাণীর একটা চিঠি আবিষ্কার করে।

মা, বাবার সঙ্গে সঙ্গে চললাম—বাণী।

বুঝল সবিতা, দুজনেই একসঙ্গে গিয়েছে।

অন্যান্য বারের চাইতে এবারে সবিতার চিন্তা হল বেশী, কারণ সঙ্গে বয়স্থ মেয়ে বাণী।

এবং বাণী তার পিতার প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট নয়, জানে সবিতা।

দুর্ভাবনায় দুশ্চিন্তায় দু রাত্রি কেটে গেল। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় এল যোগানন্দ।

সবিতা একাকী ঘরের মধ্যে চুপটি করে আলো জ্বেলে বসে ছিল।

যোগানন্দ সবিতাকে ঐ অবস্থায় দেখে শুধাল কি ব্যাপার দিদি, চুপটি করে একা বসে যে! মেয়ে কোথায়? আনিলবাবু বুঝি আবার চলে গেছেন?

এস যোগেন। সবিতা যোগানন্দকে আহ্বান জানাল। এবং ধীরে ধীরে সব বৃত্তান্ত খুলে বলল।

তাই তো! মেয়েও তার বাপের সঙ্গে গেল? তা মেয়ে যখন তার বাপের সঙ্গেই গিয়েছে

নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম, কিন্তু আমার তা মনে হয় না ভাই। ওকে তো আমি চিনি— আর মেয়ে বাপের প্রতি কোনদিনই প্ৰসন্ন নয়।

ভাবছেন কেন, হয়তো একপ্রকার ভালই হল!

না যোগেন, সে যদি স্বেচ্ছায় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যেত ভাবতাম না। কিন্তু এ তো তা নয়, তাহলে তো–

কিন্তু আমারও মনে হয় আপনার এই চিন্তার কিছু নেই। চিন্তার নেই!

না।

সবিতা চুপ করে থাকে।

সে যাক, এভাবে এখন তো আর একা একা এখানে আপনার থাকা চলতে পারে না দিদি।

তা ছাড়া আর উপায় কি বল? যাব কোথায়?

যদি আপত্তি না থাকে তো আমার ওখানে চলুন না দিদি!

তা হয় না যোগানন্দ।

কেন?

সে তুমি বুঝবে না। তা ছাড়া এমনিতেই তো তোমার ঋণ এ জীবনে কোনদিন আমরা শোধ করতে পারব না। তার উপর আর ঋণ বাড়াতে চাই না।

ও কথা বলে আর লজা দেবেন না দিদি। আজকের দিনে সংসারে পরস্পরের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক বলে কোন বস্তুই নেই, এমনিভাবে আমরা সমাজের মধ্যে পরস্পর হতে পরস্পর পাশাপাশি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। জ্ঞান হওয়া অবধি সংসারে বা সমাজের মধ্যে একটি মাত্র সম্পর্কই সকলের মধ্যে দেখে আসছি—স্বার্থের সম্পর্ক। আমাদের সম্পর্কের মধ্যেও সেই সম্পর্কটা টেনে এনে সেটাকে ছোট করে দেবেন না, এই আমার অনুরোধ।

যোগানন্দর মুখে কথাগুলো শুনে সবিতা মুগ্ধ হয়ে যায়।

কদিনেরই বা পরিচয় ঐ যুবকটির সঙ্গে তাদের।

সম্পূর্ণ অপরিচিত, পথের লোক-নিজে যে সবিতা একটু বিব্রতও বোধ করে না তা নয়।

না না-দুঃখ করো না ভাই। তোমাকে আমি অন্তত সেরকম কখনো ভাবিনি। সবিতা বললে, তোমার সঙ্গে পরিচয়টা জীবনে অক্ষয়ই হয়ে থােক, ধূলোর ওপর টেনে এনে তাকে আমি তো ছোট করতে পারব না ভাই। আজকের দিনে তুমিই তো আমার একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেজন্য নয়, এখন হতে অন্য কোথায়ও যাবার আমার সত্যিই বাধা আছে–

বেশ, তবে আর কি বলব বলুন।

পরের দিনই সকালে যোগানন্দ তার দারোয়ান প্রৌঢ় মহাবীর ও একজন রাতদিনের ঝি সবিতাকে সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দিল। এবং নিজেও মধ্যে মধ্যে এসে সবিতার খোঁজ নিয়ে যেতে লাগল।