প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

১৬. মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা

পনেরোশো বত্রিশের পনেরোই নভেম্বর।

মাত্র দুবছর আগে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ভারতবিজেতা বাবর আটচল্লিশ বছর বয়সে আগ্রা শহরে মারা গেছেন। তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী হুমায়ুন আফগান সর্দার শের শাহকে শায়েস্তা করবার উদ্দেশ্যে চুণার দুর্গ অবরোধ করে তাঁকে সাময়িক বশ্যতা স্বীকার করিয়েছেন মাত্র এক বছর আগে।

ইউরোপে তিন বছর আগে তুর্কিরা ভিয়েনা দখল করেছে। ভয়ংকর আইভান বলে সে যুগে যিনি পরিচিত সেই চতুর্থ আইভানের রাশিয়ার জারের সিংহাসনে বসতে আর এক বছর মাত্র বাকি।

পোর্তুগিজরা ইউরোপের প্রতিনিধি হিসেবে মাত্র আঠারো বছর আগে চিনে পা দিয়েছে, কিন্তু নিজেদের জুলুম জবরদস্তির দোষে কোথাও স্থায়ীভাবে বাস করবার

সুযোগ পায়নি। কোথাও তাদের মেরে শেষ করা হয়েছে আর কোথাও থেকে হয়েছে। বিতাড়িত। কান্টনের দক্ষিণে ছোট্ট দ্বীপ সাংচুয়ান থেকে তারা কোনওরকমে তখন ব্যবসা চালাচ্ছে।

পৃথিবীর ইতিহাসের নানা দিক দিয়ে স্মরণীয় এই সময়ে ওই তারিখে সুদূর সাগরপারের এক দেশ থেকে মুষ্টিমেয় ক-টি সৈন্য নিয়ে পিজারো অজানা রহস্যময় পেরু সাম্রাজ্যের অধীশ্বর আতাহুয়ালপার সম্পূর্ণ নিজস্ব পাহাড়ঘেরা সুরক্ষিত দুর্গনগরে নামবার জন্যে পা বাড়ালেন।

কী আছে ভবিষ্যতের গর্ভে তার কোনও আভাস কি পিজারো পেয়েছিলেন?

নইলে তিনি সেদিন যা করেছিলেন তাকে তো উন্মত্ত আত্মঘাতী বাতুলতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। পাহাড়ের ঢালু পথে যখন পিজারো তাঁর দলবল নিয়ে নীচের শহরে নামছেন তখন বিকেল হয়ে এসেছে।

সারাদিন আকাশ পরিষ্কার ছিল। হঠাৎ সেই সময় যেন নিয়তির ইঙ্গিত নিয়ে ঝড় উঠল। ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি। শুধু জলের ফোঁটা নয়, শিলাবৃষ্টিও। সেই সঙ্গে আর হাড় কাঁপানো শীত যা ভয়ের কাঁপুনি লুকোবার সুযোগ দিয়েছে কাউকে কাউকে।

তিনটি দলে ভাগ হয়ে পিজারো নামছিলেন। শহরে নেমে তিনি নিজের দল নিয়ে তাঁর বিশ্রামের জন্যে নির্দিষ্ট পান্থনিবাসে গেলেও তৎক্ষণাৎ দে সটোকে পনেরোজন সওয়ার সমেত ইংকা আতাহুয়ালপার কাছে সেলাম দিতে পাঠিয়েছেন। শুধু দে সটোর দলকে পাঠিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। নিজের ভাই হার্নারেমন্ডোকেও তার পিছনে বিশজন সওয়ার নিয়ে সহায় স্বরূপ যেতে বলেছেন।

দে সটোর পনেরো আর হার্নারেমন্ডোর কুড়ি এই মোট পঁয়ত্রিশ জন তো সওয়ার। সত্যিই যদি বিপদ কিছু ঘটে, কে কাকে কী সাহায্য করবে।

বিপদ কিন্তু কিছু ঘটেনি। পিজারোর প্রতিনিধিরা নিরাপদে বহাল তবিয়তেই ফিরে এসেছে। ইংকা নরেশ তাঁর শিবির ফেলেছেন নগরের বাইরে পাহাড়ের কোলের মুক্ত প্রান্তরে গরম জলের স্বাভাবিক ফোয়ারাগুলির কাছে। সেখান থেকে ফিরে দে সটো আর হার্নারেমন্ডো ইংকা আতাহুয়ালপার চরিত্র চেহারা ও ব্যবহারের বিবরণ দিয়ে যে খবর জানিয়েছে তা শুনে পিজারো সেই রাত্রেই তাঁর বাহিনীর প্রধানদের এক গোপন মন্ত্রণাসভা ডেকেছেন।

সেই দিনই বিকেলে তো সবে পিজারো কামালকা শহরে পা দিয়েছেন ইংকা নরেশের অতিথি হয়ে। শহরে পৌঁছোবার পর কর্তব্য হিসেবে রাজদর্শনে যাদের পাঠিয়েছিলেন তারা ফিরে এসে কী এমন খবর দিলে যে পিজারো সেই রাত্রেই গোপনে মন্ত্রণাসভা ডাকবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

ইংকা আতাহুয়ালপা কি রাজদর্শনে যারা গিয়েছিল তাদের ওপর জুলুম জবরদস্তি কিছু করেছেন, কিংবা অপমান-টপমান?

না, মোটেই নয়।

তবে কি অগ্রাহ্য, অবজ্ঞা?

না, তা-ও নয়। পিজারো তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি দে সটোকে পাঠিয়েছিলেন ইংকা নরেশকে কুর্নিশ করে আসতে আর সেই সঙ্গে ভাই হার্নারেমন্ডোকেও ভরসা দেওয়ার জন্যে সঙ্গে থাকতে বলেছিলেন।

ফিরে এসে তাঁরা যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে বিচলিত হবার কারণ অন্য।

এই নতুন মহাদেশে এ পর্যন্ত এসপানিওলরা অনেক কিছু দেখেছে, বড় ছোট অনেক মানুষের সংস্রবে এসেছে। তুষার ঢাকা অভ্রভেদী পাহাড়ের বুকে সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ যত রহস্যময়ই হোক, সত্য-মিথ্যা নানা বর্ণনা শুনে তার রাজ্যেশ্বর ইংকা আতাহুয়ালপা সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা তাই পিজারো আর তাঁর দলবলের মনে গড়ে উঠেছিল।

আতাহুয়ালপার চাক্ষুষ যে রূপ দেখা গেছে তার সঙ্গে সে ধারণার একেবারে মিল নেই।

আতাহুয়ালপার মতো এরকম সত্যিকার সম্রাটোচিত চেহারাই এর আগে এদেশে কোথাও পিজারো বা তার সঙ্গীদের কারও চোখে পড়েনি।

দে সটো আর হার্নারেমন্ডো পিজারোর এই ইংকা নরেশের সামনে আপনা থেকেই নিজেদের কেমন ছোট মনে হয়েছে। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য দেখাবার চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের ব্যবহারে আর কথায় সন্ত্রম ফুটে উঠেছে আপনা থেকেই।

সত্যি কথা বলতে গেলে দে সটো বা হার্নারেমন্ডো পিজারোর মনে নিজেদের সাদা চামড়া থেকে শুরু করে লম্বা চওড়া চেহারা আর গুলিবারুদ বন্দুক আর ঘোড়া নিয়ে শক্তি সামর্থ্যের একটু গুমর ছিলই। তাঁরা ভেবেছিলেন আর কিছু না হোক এদেশের পক্ষে সম্পূর্ণ অজানা এসব জাঁকজমক দিয়ে ইংকা নরেশকে একটু হকচকিয়ে দিতে অন্তত পারবেন।

তার বদলে দে সটো আর হার্নারেমন্ডোকেই ভেতরে ভেতরে বেশ একটু বিচলিত হতে হয়েছে।

বিচলিত হবার কারণ ইংকা নরেশের রাজসমারোহ কিন্তু নয়। কাক্সামালকা নগরের বাইরে আতাহুয়ালপার সেই সময়ের শিবির এমন কিছু জমকালো নয়। বেশ বড় গোছের খোলা একটা চত্বর, তার চারিধারে ধাপে ধাপে বসবার আসনের ব্যবস্থা। চত্বরের মাঝখানে একটি জলের কুণ্ড। সুড়ঙ্গ নালি দিয়ে তাতে ঠাণ্ডা আর গরম জলের স্রোত আসে।

বিরাট এই চত্বরে বড় ঘরোয়ানা ইংকা নারী-পুরুষ সব জড়ো হয়েছে আতাহুয়ালপার অনুচর হিসাবে পরিচর্যার জন্যে।

আতাহুয়ালপা কুণ্ডের কাছে একটি নিচু আসনে বসে আছেন। তাঁর পোশাক-আশাক সভাসদদের তুলনায় বরং সাদাসিধে। শুধু তাঁর মাথায় কপাল পর্যন্ত ঢাকা ইংকা রাজশক্তির প্রতীকচিহ্ন রক্তের মতো লাল বোলা।

মাথায় এই বোলা না থাকলেও তাঁকে আলাদা করে চেনা যেত এমনই তাঁর বিরল বৈশিষ্ট্য। দে সটো আর হার্নারেমন্ডো পিজারো দু-একজন সঙ্গীকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়েই ইংকা আতাহুয়ালপার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য দেখাবার জন্যে ঘোড়া থেকে কেউই নামেননি।

ব্যবহারের এই ঔদ্ধত্যটুকু কিন্তু গলার স্বরের স্বতঃস্ফুর্ত সম্রমে কাটাকাটি হয়ে গেছে।

দে সটো একটু সবিস্তারেই এ রাজ্যে তাঁদের আসার উদ্দেশ্যে জানিয়েছেন। জানিয়েছেন যে সাগরপারের এক মহান রাজ্যের সম্রাটের প্রতিনিধি হিসাবে তাঁরা এখানে এসেছেন। ইংকা নরেশের নানা বীরত্বের কীর্তিকাহিনী শুনে তাঁরা মুগ্ধ। তাঁরা ইংকা নরেশের হয়ে লড়তে চান আর পৃথিবীতে একমাত্র যা সত্য ধর্ম তার বাণী তাঁকে শোনাতে চান।

আতাহুয়ালপা কী বলেছেন এ ভাষণের জবাবে? কিছুই নয়। বুঝতে পারেননি বলেই কি তিনি নীরব থেকেছেন?

তা কেন হবে। দে সটোর সব বক্তব্য দোভাষী ফেলিপিলিও তো ভালভাবে। অনুবাদ করে শুনিয়েছে। পিজারোর দলে যে ক-জন নামকরা দোভাষী ছিল ফেলিপিলিও তাঁদের মধ্যে এক রকম প্রধান। টমবেজ শহরে তাঁর বাড়ি। সেখান থেকে তাঁকে দু-দুটো সাগর পার করে কাস্তিল-এ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শুধু ওস্তাদ দোভাষী বানাবার জন্যেই। ফেলিপিলিও-র অনুবাদে কোনও ত্রুটি নিশ্চয়ই তা হলে ছিল না।

আতাহুয়ালপা সুতরাং সব শুনে-বুঝেও কোনও জবাব দেননি! শুধু যে তিনি নীরব। থেকেছেন তা নয়, মুখের চেহারা যা করে রেখেছেন তাতে মনে হয়েছে এ সব কথা তাঁর কাছে কানে দেবার উপযুক্তও নয়।

দে সটো আর হার্নারেমন্ডো বেশ ফাঁপরে যে পড়েছেন তা বলাই বাহুল্য।

ইংকা নরেশের কঠিন নির্বিকার মুখ দেখে কী তাঁরা বুঝবেন? আতাহুয়ালপা সন্তুষ্ট, অসন্তুষ্ট? তাঁদের ওপর বিরূপ, না সদয়?

আতাহুয়ালপার বদলে তাঁর এক সভাসদ সংক্ষেপে অবশ্য দুটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন, ঠিক আছে।

কিন্তু তাতে কী বোঝা যায়? ও দুটি কথার মানে তো দু-দিকেই লাগানো যেতে পারে।

বেশ একটু ব্যাকুল অস্বস্তির সঙ্গে পিজায়োর ভাই হার্নারেমন্ডো এবার আতাহুয়ালপাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছেন, নিজের মুখে তাঁদের কিছু বলবার জন্যে।

বেশ উদ্বিগ্ন ক-টা মুহূর্ত কেটেছে। আতাহুয়ালপা নিজ-মুখে কিছু কি বলবেন? সে অনুগ্রহ যদি করেন তা হলেও কী হবে তাঁর ভাষণ?

দে সটো আর হার্নারেমন্ডো শুধু নন ইংকা প্রধানরাও বেশ একটু শঙ্কা-সংশয় নিয়ে আতাহুয়ালপার মুখের দিকে চেয়ে থেকেছেন।

আতাহুয়ালপার নির্বিকার ভাবলেশহীন মুখে এই প্রথম ঈষৎ বাঁকা হাসির আভাস দেখা গেছে। তারপর এসপানিওলদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি ধীর গম্ভীর স্বরে বলেছেন, তোমাদের সেনাপতিকে বললা গিয়ে যাও যে আমি এক উপবাস ব্রত পালন করছি। এ ব্রত কাল সমাপ্ত হবে। তারপর আমার রাজ্যপ্রধানদের নিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব। নগরের সমস্ত রাজ-অতিথিশালা তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের জন্যে খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সেইখানেই তিনি যেন তাঁর অনুচরদের নিয়ে অপেক্ষা করেন।

প্রথমকার কঠিন নীরবতার পর ইংকা নরেশের এই ভাষণটুকুতেই কি পিজারো আর তাঁর সঙ্গীরা অতখানি উদ্বেগের কারণ খুঁজে পেয়েছেন?

না, তা ঠিক নয়! ইংকা নরেশ আতাহুয়ালপার চেহারা, আচরণ ও এই ভাষণ, সব কিছুর ভেতর একটা ভিন্ন অস্বস্তিকর ইঙ্গিত ফুটিয়ে তুলেছে পরের একটি ঘটনা আর তার প্রতিক্রিয়া।

ঘটনাটা ঘটেছে আতাহুয়ালপা তাঁর বক্তব্য শেষ করবার পরই।

এসপানিওলরা সবাই ঘোড়ায় চড়েই রাজদর্শনে এসেছিল। আতাহুয়ালপাকে সসম্ভ্রমে অভিবাদন জানালেও ঘোড়া থেকে কেউ মাটিতে নামেননি।

ঘোড়া জানোয়ারটিই সম্পূর্ণ অজানা বলে নতুন মহাদেশের লোকের মনে তখন গভীর বিস্ময়, কৌতূহল আর আতঙ্ক জাগায়। এসপানিওল সওয়ার সৈনিকদের মধ্যে দে সটোর ঘোড়াটাই আবার সবার সেরা। তাঁর ঘোড়াও যেমন বিরাট আর তেজি দে সটো নিজেও তেমনই ওস্তাদ সওয়ার। ঘোড়ার পিঠে ইংকা আতাহুয়ালপার সবচেয়ে কাছে তিনিই দাঁড়িয়েছিলেন।

হঠাৎ কী কারণে বলা যায় না, দে সটোর তেজি ঘোড়াটা হ্রেষাধ্বনি করে একটু অস্থির হয়ে ওঠে। তারপর যা ঘটে তা কতটা দৈবাৎ আর কতটা ইচ্ছাকৃত বলা শক্ত।

দেখা যায়, দুরন্ত ঘোড়াটা লাগাম চিবিয়ে, গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে পায়ের খুরে মাটি আঁচড়াতে আঁচড়াতে যেন অকস্মাৎ খেপে গিয়ে সামনের বিরাট চত্বরে ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করেছে।

এই বার বোঝা যায় দে সটোর কেরামতি। অদ্ভুত কৌশলে কখনও বিদ্যুৎবেগে ছুটিয়ে, কখনও চরকিবাজির মতো ঘুরপাকের পর ঘুরপাক খাইয়ে, দৌড়ের মধ্যেই বেপরোয়া বাঁক নিয়ে বা সামনের দু-পা শূন্যে তুলিয়ে দে সটো সওয়ারগিরিতে তাঁর আশ্চর্য নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন।

শুরুতে ঘোড়াটার অস্থির হয়ে ওঠাটা হয়তো আকস্মিক। কিন্তু ঘোড়া নিয়ে পরের বাহাদুরকা খেল দে সটো ইচ্ছে করেই দেখিয়েছেন বলে মনে হয়। ঘোড়াটা নিজে থেকে চঞ্চল হয়ে ওঠার পর তার দৌড়ঝাঁপ নাচন-কোঁদন দেখিয়ে ইংকা প্রধানদের আর বিশেষ করে স্বয়ং আতাহুয়ালপাকে একটু ভড়কে চমকে দেওয়ার মতলব বোধহয় দে সটোর মাথায় আসে। আতাহুয়ালপার নির্বিকার তাচ্ছিল্যের মুখোশটা সরে কিনা দেখবার দুষ্টুবুদ্ধিও তার সঙ্গে ছিল।

চমকে দেওয়ার চেষ্টাটা কিন্তু অমন মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে দে সটোও ভাবেননি বোধহয়। আতাহুয়ালপার একেবারে গায়ের কাছে তুফানের মতো ঘোড়াটাকে হঠাৎ রুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দে সটো তাঁর বাহাদুরকা খেল শেষ করেছেন।

তাঁর সওয়ারগিরির আশ্চর্য কেরামতিতে ঘোড়াটা আতাহুয়ালপার প্রায় মাথার ওপর দু পা তুলে দাঁড়িয়ে উঠে আবার সামলে নিয়ে মাটির ওপর পা নামিয়ে স্থির হয়েছে সত্যি, কিন্তু তেজি ছুটকরানো ঘোড়াটার মুখের কিছুটা ফেনা ইংকা নরেশের পোশাকের ওপর গিয়ে পড়েছে।

ভড়কৈ দিতে গিয়ে এসপানিওল সেনাদল সমেত হার্নারেমন্ডোর সঙ্গে দে সটো নিজেই ভড়কে গিয়ে প্রমাদ গুনেছেন। কী করবেন এবার আতাহুয়ালপা?

কিন্তু কিছুই তিনি করেননি। তাঁর পাথরে খোদাই মূর্তির মতো কঠিন মুখে সমস্ত বাহাদুরির খেলার সময়ে তো নয়ই, শেষ মুহূর্তের এই মাত্রাছাড়া উপদ্রবেও এতটুকু ভাবান্তর দেখা যায়নি। গায়ের ওপর ঘোড়া এসে পড়বার উপক্রম হওয়ায় ইংকা প্রধানদের কাউকে কাউকে নিজের অনিচ্ছাতেই একটু শিউরে সরে দাঁড়াতে দেখা গেছে, কিন্তু আতাহুয়ালপার চোখের পাতাও একটু কাঁপেনি।

হ্যাঁ, পোশাকে ঘোড়ার মুখের ফেনা ছিটিয়ে পড়ার পর আতাহুয়ালপা কিছুই করেননি বলাটা ঠিক নয়। কিছু তিনি সত্যিই করেছেন। যে বেয়াদবিতে তাঁর খেপে ওঠবার কথা তা যেন লক্ষই না করে তিনি অতিথিদের খাদ্যে পানীয়ে আপ্যায়িত করবার আদেশ দিয়েছেন।

এসপানিওলরা ঘোড়া থেকে নামবার অনিচ্ছার দরুন খাবার জিনিস প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু ইংকা রাজপরিবারের আয়তাক্ষী সুন্দরীরা বড় বড় সব সোনার পাত্রে চিচা নামের যে দেশোয়ালি সুরা পরিবেশন করেছে তার প্রতি বিমুখতা দেখায়নি।

আতাহুয়ালপাকে বিদায় অভিবাদন জানিয়ে ফিরে আসবার সময় সে সুরার নেশাও দে সটো আর তাঁর সঙ্গীদের চাঙ্গা করতে পারেনি। সবাই বেশ একটু গুম হয়েই ফিরেছেন।

পিজারোকে বিবরণ শোনাবার সময় তাঁদের শঙ্কিত উদ্বেগের কারণগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আতাহুয়ালপা দে সটোর বেয়াদবিতে খেপে উঠে কিছু করলে যা মনে হত তার চেয়ে তাঁর অবিচলিত নির্বিকার ভাবটা ভয়াবহ লেগেছে আরও বেশি।

আর একটি সাংঘাতিক খবর ইতিমধ্যে পিজারোর বর্তমান আস্তানায় পৌঁছে গেছে।

খবর পাওয়া গেছে যে দে সটোর ঘোড়ায় খেলায় যে দু-একজন ইংকা বীর আতঙ্ক গোপন করতে পারেনি, আতাহুয়ালপা সরাসরি তাদের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন।

এই খবরেই আতাহুয়ালপার সমস্ত ব্যবহার আর কথার ওপরকার মোলায়েম খোলসটা সরে গিয়ে ভেতরকার ভয়ংকর চেহারাটা যেন বেরিয়ে পড়েছে।

আতাহুয়ালপা পিজারোর বাহিনীর সঙ্গে ওপর থেকে দেখলে অত্যন্ত ভাল ব্যবহারই করেছেন এ পর্যন্ত। কাকসামালকা শহরে তাদের রাজসমাদরে থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাদের বেয়াড়া বেয়াদবিতে ভুক্ষেপ পর্যন্ত করেননি। নিজে থেকে ইংকা প্রধানদের নিয়ে দর্শন দিতে আসবেন বলেছেন।

শুনতে যেমন চমৎকার ব্যাপারগুলো তেমন সরল সোজা কি?

রাজ-সমাদরে পিজারোর লোকজনদের রাখবার ব্যবস্থা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে ব্যবস্থা তাদের জবাই করবারই ভূমিকা নয়, কে বলবে?

প্রতিদ্বন্দ্বী ভাই হুয়াসকার-এর হিতৈষী ইংকা প্রধানদেরও ডাকিয়ে এনে আতাহুয়ালপা এমনই করে সসম্মানে কুজকো শহরে রাখবার ব্যবস্থা করেছিলেন। তারপর শেষ করে দিয়েছিলেন সকলকে।

দে সটোর বেয়াদবিতে সুক্ষেপ না করে যেন তা মাপ করেছেন বলেই মনে হয়েছে।

কিন্তু ভয় যারা পেয়েছিল সে সব ইংকা সভাসদদের প্রাণদণ্ড দিয়েছেন কেন?

নিজে থেকে পিজারোর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন বলেছেন ইংকা প্রধানদের নিয়ে।

কিন্তু এ কি শুধু সম্রাটোচিত উদারতায় পিজারোকে অনুগ্রহ করতে আসা? ইংকা প্রধানদের নিয়ে সদলবলে আসার আশ্বাসের মধ্যে কোনও ভয়ংকর গূঢ় অভিসন্ধি। লুকিয়ে আছে কি?

না, এক মুহূর্তও আর নষ্ট করবার নয়। পিজারোকে শশব্যস্ত হয়ে মন্ত্রণাসভা ডাকতে হয়েছে।

মন্ত্রণাসভায় স্থির-ধীর আলোচনা সম্ভব হয়নি। সবাই কেমন দিশেহারা।

পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই এখন, বলেছেন কাউন্সিল অফ ইন্ডিজ-এর প্রতিনিধি খাজাঞ্চি।

অনেকেই তাতে সায় দিয়েছেন। কিন্তু তাতে হবে কী?

সবাই মিলে সায় দিলেও ও-পরামর্শ যে বেকার তা কারও জানতে বাকি নেই।

পালিয়ে বাঁচবার কোনও আশা তাদের নেই, সুতরাং অন্য কোনও উপায় ভাবতে হবে।

উপায় আর কী? যতক্ষণ প্রাণ থাকবে ততক্ষণ অকাতরে লড়ে যাওয়া, বীরের মতো বলেছেন দে সটো।

আহাম্মকের মতো মিছিমিছি প্রাণটা এখানে রেখে যেতে কি এতদূরে এসেছি? দে সটোকে একটু বিদ্রূপ করেই বলেছে পিজারোর আর-এক সেনাপতি জুয়ান দে হেরাদা, রাদা নামে যে পরিচিত।

বুদ্ধিমানের মতো প্রাণটা লাভের সঙ্গে রাখার উপায়টা তা হলে বাতলাও শুনি!

দে সটো পালটা খোঁচা না দিয়ে পারেননি।

উপায় হল, সিসিলির আগাগোক্লিস যা করেছিল তা-ই। উদ্ধতভাবে জবাব দিয়েছে হেরাদা। অদূর ভবিষ্যতের ইতিহাস গাঢ় রক্তের ছোপে সে যে কলঙ্কিত করে যাবে তার ইঙ্গিত তখনই যেন তার আলাপে আচরণে দেখা গেছে।

সিসিলির আগাগোক্লিস আবার কে? কী-ই বা করেছিল সে? পিজারোর মন্ত্রণাসভার সবাই হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবার।

সে প্রশ্নের উত্তরে হেরাদা যা বলেছে সবাই তাতে থ।

শেষ মীমাংসা কিছুই অবশ্য তখন হয়নি। কিন্তু মন্ত্রণাসভার আর সকলের মতো পিজারো নিজেও কেমন বিমূঢ় দুশ্চিন্তায় সে রাতটা কাটিয়েছেন।

পিজারোর এ গোপন মন্ত্রণাসভায় গানাদো নামে পরিচিত বেদিয়ার যে জায়গা হয়নি তা বলাই বাহুল্য।

সভার সব বিবরণ সেই রাত্রেই কিন্তু তিনি পেয়েছেন। পিজারোর সেনাপতিদের মধ্যে দুটি মানুষ, অন্যদের তুলনায় অনেক সরল সোজা ও সৎ। এ দুজন হলেন। দানবাকার গ্রীক পেড্রো দে কানডিয়া আর দুর্ধর্ষ বীর দে সটো।

কী কারণে সঠিক বলা শক্ত, দে সটো প্রথম পরিচয়ের পর থেকেই গানাদো নামে বেদিয়াকে একটু বেশি রকম সমীহ করেন। সময়ে-অসময়ে এই অদ্ভুত মানুষটার কাছে অত্যন্ত দামি শলাপরামর্শ কয়েকবার পেয়েই বোধহয় দে সটোর শ্রদ্ধাটা অত গভীর হয়েছে।

মন্ত্রণাসভা থেকে বেরিয়েই দে সটো প্রথমে গানাদোর খোঁজ করেছেন। তারপর একটু নিরিবিলিতে নিয়ে গিয়ে গানাদোর কাছে সভার বিবরণের সঙ্গে হেরাদা যা বলেছে তা সবই শুনিয়েছেন সবিস্তারে।

সব কিছু শোনবার পর গানাদোর মুখে একটু বিদ্রূপের হাসি দেখা গেছে। একটু বিরক্ত হয়েই দে সটো বলেছেন, এতে হাসবার কী পেলে? হাসবার পেলাম আপনাদের হেরাদার ঠগবাজি! হেসে বলেছেন গানাদো, যে বিদ্যে জাহির করে সে আপনাদের হতভম্ব করেছে তা তার বেমালুম চুরি করা।

চুরি করা বিদ্যে? দে সটো অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, তার মানে কী?

মানেটা সত্যি ভয়ানক!—এবার গম্ভীর হয়েছেন গানাদো—সেনাপতি হেরাদা। আপনাদের কাছে চুরি করা বিদ্যেরই ভড়ং করেছে। সেটা দোষের বটে, কিন্তু তার চেয়ে যা সে পরামর্শ দিয়েছে তা অনেক বেশি সাংঘাতিক। আশা করি তার কথায় কেউ কান দেবে না, কিন্তু চুরি করা বিদ্যের জোরেই এ শয়তানির প্যাঁচ যার মাথায় খেলে সে মানুষ সম্বন্ধে সাবধান থাকা দরকার বলে মনে করি।

হেরাদা সম্বন্ধে গানাদোর এত বিরাগের কারণটা ভাল করে না বুঝলেও দে সটো সে বিষয়ে প্রতিবাদ করবার কিছু পাননি। হেরাদা মানুষটাকে তাঁর নিজেরও কেন বলা যায় না অত্যন্ত খারাপ লাগে।

গানাদোর সঙ্গে একমত হয়ে হেরাদার বিদ্যের ভড়ং সম্বন্ধেই ঘৃণাভরে দে সটো এবার প্রশ্ন করেছেন, যে বিদ্যে জাহির করে তা হলে তা ওর চুরি করা?

হ্যাঁ, হেসে বলেছেন গানাদো, ওর চুরি ধরিয়ে দিয়ে ভড়ং ভাঙতে চান তো এক কাজ করুন। জোঁকের মুখে তা হলে নুন পড়বে।

কী কাজ? আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করেছেন দে সটো। আজ তো আবার আপনাদের মন্ত্রণাসভা বসবে? কৌতুকের স্বরে বলেছেন গানাদো, আজ ওর কাছে শুধু একটা নাম উচ্চারণ করবেন। শুধু বলবেন, মাকিয়াভেল্লী।

কী বললেন? মেকিয়াভেলি?

এবারের প্রশ্নটা দে সটোর নয়, মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবুর।

মেকিয়াভেলি নয়, অনুকম্পাভরে বলেই ফেললেন দাসমশাই, ওটা হল ইংরেজি উচ্চারণ। হেরাদা যখন পিজারোর দলের কাছে চুরি করা বিদ্যে জাহির করেছে তখন ফ্লোরেন্সের নবচাণক্য মাকিয়াভেল্লীর নাম ইংরেজরা শুনেছে কি না সন্দেহ।

ইংরেজদের কাছেও কূটনীতির যে নবকৌটিল্যের নাম পৌঁছোয়নি, তা তখনই শুনেছিলেন শুধু আপনার সেই গানাদো!

শিবপদবাবুর বিস্মিত মন্তব্যে বিদ্রূপের খোঁচা নিশ্চয় একটু ছিল, কিন্তু দাসমশাই-এর নির্বিকার প্রশান্তি তা ভেদ করতে পারল না।

বরং এরকম একটা উপযুক্ত প্রশ্নে যেন খুশি হয়ে তিনি ব্যাখ্যা করে বোঝালেন— হ্যাঁ, ঘনরাম তা শুনেছিলেন আর শোনা খুব একটা আশ্চর্য কিছুও নয়। নিককলো দি বেনাদো মাকিয়াভেল্লী মাত্র পাঁচ বৎসর আগে ইতালির ফ্লোরেন্সে মারা গেছেন। ইতালি আর স্পেনের দূরত্ব এমন কিছু নয়। আর ইংরেজরা না জানলেও লাতিন দেশগুলিতে সে-যুগে জ্ঞান বিদ্যা রাজনীতির চর্চা যাঁরা করতেন ইতালির এই অসামান্য মানুষটির খবর তাঁরা অনেকেই রাখতেন—বিশেষ করে গনজালো ফার্নান্ডেজ দে ওভিয়েডো ঈ ভালডেজ-এর মতো স্বনামধন্য মানুষ তো বটেই। তিনি রাজনীতিবিদ পণ্ডিত শুধু ছিলেন না, এক সময়ে ইতালি গিয়ে নেসের রাজা ফার্ডিন্যান্ডের অধীনে কাজও করেছেন। গানাদো বলে যাঁর পরিচয়, এককালে এই ওভিয়েডোর কাছেই তিনি ক্রীতদাস ছিলেন। লেখাপড়া শেখবার সুযোগও পেয়েছিলেন সেইখানেই। মাকিয়াভেল্লীর নাম সুতরাং তাঁর অজানা থাকাটাই অস্বাভাবিক।

সব তো বুঝলাম!—শিবপদবাবু আর বোধহয় নীরব থাকতে পারলেন না— কিন্তু আসলে ব্যাপারটা হল কী! পিজারোর গোপন মন্ত্রণাসভায় হেরাদা চুরি করা বিদ্যে জাহির করে কী বলেছিল, কী? যা বলেছিল তার সঙ্গে মাকিয়াভেল্লীর কী এমন সম্পর্ক যে সে-নামটা শোনালেই মুখে নুন-দেওয়া জোঁকের মতো সে জব্দ হবে ভেবেছিলেন আপনার গানাদো?

হেরাদার কাছে মাকিয়াভেল্লী নামটা কেন জোঁকের মুখে নুনের মতো জিজ্ঞাসা করছেন? পরম ধৈর্য আর অনুকম্পার সঙ্গে বললেন দাসমশাই, তা হলে হেরাদা মন্ত্রণাসভায় যা বলেছিল, সেইটে একটু বিশদভাবে আগে শোনা দরকার। হেরাদা সিসিলি দ্বীপের আগাগোক্লিস-এর নাম করে তার উপায় নিতে বলেছিল। উপায়টা কী আর আগাগোক্লিস-ই বা কে? আগাগোক্লিস বড় ঘরের ছেলে নয়, একেবারে অতি সাধারণ দীন দরিদ্র এক কুমোরের ছেলে। বেপরোয়া সাহস আর বদমায়েশি বুদ্ধির জোরে সে সিরাকুস নগরের পৃটার পর্যন্ত হয়। তারপর সিরাকুস-এর শাসনপরিষদের সমস্ত নগরপ্রধানদের সে একদিন সকালে ডেকে পাঠিয়ে জড়ো করে তার নিজের সেনাদের দিয়ে অতর্কিতে নির্মমভাবে হত্যা করায়। হোমরা-চোমরাদের একজনও এ-মরণফাঁদ থেকে রেহাই পায় না। এইভাবে পথের সব কাঁটা সরিয়ে সাগাথোক্লিস সিসিলির রাজদণ্ড অনায়াসে শুধু নীচ নৃশংসতার জোরেই অধিকার করে।

হুঁ, শিবপদবাবুর মুখে এবার একটু গর্বের হাসি ফুটল, এসব তো মাকিয়াভেল্লীর দ্য প্রিন্স মানে রাজপুত্র বই-এ আছে। তাই থেকে নেওয়া।

না।দাসমশাই গম্ভীর প্রতিবাদে শিবপদবাবুকে নীরব করে পাণ্ডিত্যের শিলাবৃষ্টি করলেন, মাকিয়াভেল্লী বিখ্যাত হয়ে আছেন, অবশ্য যাকে দ্য প্রিন্স বা রাজপুত্র বলছেন সেই ইল প্রিনসিপে বইটির জন্যে। এ-বইটি পেরকুসসিনা গ্রামের উপান্তে তাঁর বিশ্রামাবাসে থেকে ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে মাকিয়াভেল্লী শেষ করেন। ইল প্রিনসিপে বইটি আসলে কিন্তু আরও একটি বড় বই ডিসকোরসি সোপ্রা লা প্রাইমা দেকা দি টিটো লিভিওর একটি অংশ মাত্র। এই বড় বইটি লেখা শুরু হয় রাজপুত্র-এর আগে, শেষও হয় অনেক পরে। মাকিয়াভেল্লী ছিলেন প্রাচীন রোমক ঐতিহাসিক লিভিও অর্থাৎ টাইটস লিভিয়স-এর দারুণ ভক্ত। ওই বড় বইটির লম্বা নামটার বাংলা মানে হল লিভিওর দশকগুলি সম্বন্ধে আলোচনা। লিভিও-র বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে ইউরোপের মধ্যযুগের নবকৌটিল্য মাকিয়াভেল্লী তাঁর বিচক্ষণ কূটনীতির পুরো পরিচয় ওই বড় বইটিতে রেখে গেছেন। হেরাদার সেই বইটি কোনওরকমে পড়া ছিল। তাই বেমালুম গাপ করে সে পিজারোর মন্ত্রণাসভায় নিজের বলে চালিয়ে বাহাদুরি দেখিয়েছে—

আর গানাদো মানে ঘনরাম তা ধরে ফেলেছেন! এতক্ষণ আচ্ছন্ন অভিভূত থাকার পর শিবপদবাবুর স্বরে একটু ঝাঁজ ফুটে উঠল—কিন্তু তাতে হল কী?

যা হল তা বড় সাংঘাতিক!—দাসমশাই সকলকে যেন তৈরি হবার সুযোগ দিতে একটু থেমে হঠাৎ নাটকের যবনিকা তুললেন—চারশো বছরের প্রাচীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংক্রা রাজশক্তি কর্ডিলিয়েরার তুষার-ঢাকা পার্বত্য সাম্রাজ্য থেকে কুয়াশার মতো চিরকালের জন্যে মিলিয়ে গেল।

মিলিয়ে গেল! উদরদেশ যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত, ভোজনবিলাসী সেই রামশরণবাবুর কণ্ঠ থেকে বিমূঢ় আক্ষেপ শোনা গেল—কেমন করে?

যেমন করে মিলিয়ে গেল তা প্রায় অবিশ্বাস্য। দাসমশাই বলে চললেন, মাত্র বাষট্টি জন সওয়ার আর একশো-ছ-জন পদাতিক যাঁর সম্বল, ইংকা সম্রাটের নিজের দুর্গনগরে অগণন বিপক্ষবাহিনীর মধ্যে যিনি একরকম বন্দি, সেই পিজারো এক কল্পনাতীত স্পর্ধা দেখিয়ে এ অসম্ভব সম্ভব করে তুললেন।

একটি বিশেষ দুঃখের কথা এই যে, ঘনরাম সম্পূর্ণভাবে এই ব্যাপারটার প্রত্যক্ষদর্শী হবার সুযোগ পাননি।

যে-রাত্রে দে সটোর কাছে মন্ত্রণাসভার বিবরণ তিনি শোনেন তার পরের দিন সকালে কাক্‌সামালকার পাহাড়-ঘেরা উপত্যকাটির অন্ধিসন্ধি ভাল করে একটু জানবার জন্যে একা একাই তিনি বেরিয়েছিলেন।