১৬. পরমাণুর চেয়েও ছোট

পরমাণুর চেয়েও ছোট

আমাদের এবারের বুধবারের আড্ডায় এসে হাজির হয়েছে মিলন, পঙ্কজ, নবীন, সবুজ আর সৌমিত্র। মিলন হলো ঢাবি ক্যাম্পাসের মেসি। ফুটবল নিয়ে তার কারিকুরি দেখলে মনে হবে এই ছেলের ডিএনএ-জুড়ে কোডিং-এর বদলে খালি ফুটবলই আছে। পঙ্কজকে আমরা চিনি গায়ক হিশেবে। সারা দিন গুনগুন করে গান করে সে। রবি ঠাকুর বলতেই অজ্ঞান সে। নবীন আমাদের সবার জুনিয়র। হালকা-পাতলা গড়নের এই ছেলেটি তার ছোট্ট পেটের মধ্যে দুনিয়ার সব তথ্য। ভরে রাখে। তাকে ছোটখাটো একটি এনসাইক্লোপিডিয়া বললে খুব একটি বাড়াবাড়ি হবে না। সবুজ তার নামের মতোই সতেজ। সবসময় মুখে এক চিলতে হাসি জিইয়ে রাখে। চরম দুঃখের মুহূর্তগুলোতেও সে হো হো করে হাসতে পারে। সেকেন্ড ইয়ারে ড্রপ খাওয়ার পরেও সে হাসতে হাসতে বলেছিল, জানিস, আমি না এক বছর ড্রপ খেয়েছি। তার হাসিখুশি স্বভাবের সাথে পরিচয় না থাকলে সেদিন হয়তো তাকে আমি ম্যান্টালি ডিসঅর্ডারড ভেবে বসতাম। সবুজের একটি ডাকনাম আছে অবশ্য। তাকে আমরা সবাই এডিসন বলে ডাকি। একবার সে মেয়েদের হলে গিয়ে একটি লাইট ঠিক করে দিয়েছিল। সেই থেকেই ওর নাম হয়ে গেছে বিজ্ঞানী এডিসন। আমাদের আজকের আড্ডার সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি হলেন সৌমিত্র দা। ডিবেট ক্লাবে আমি আর সৌমিত্র দা সবসময় এক পক্ষে থাকতাম। আমাকে একেবারে শুরু থেকেই প্রস্তুত করে নিতেন তিনি। বিতর্কের ছলাকলা সব আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি।

আজকের আড্ডার টপিক ঠিক করা হলো বিজ্ঞান। বলবেন সৌমিত্র দা। আমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আরিফ, আড্ডা শুরুর আগে তুই আমাদের একটি। কবিতা আবৃত্তি করে শোনা। সবকিছুরই একটি উদ্ভোধনী থিম থাকে। আমাদের আজকের আড্ডার উদ্বোধন হোক তোর আবৃত্তির মাধ্যমে।

সৌমিত্র দার এই আবদারের সাথে তাল মিলালো পঙ্কজ আর মিলন। বলল, একদম ঠিক বলেছ সৌমিত্র দা। আজকাল আরিফ আর আমাদের কবিতা শোনায় না। কবিতার কথা উঠলেই সে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।

সৌমিত্র দা আমাকে বললেন, কীরে, অভিযোগ কি সত্য? কবিতার সাথে তোর এমন বিচ্ছেদের কারণ কী?

আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। সৌমিত্র দা আবার বললেন, কবিতার সাথে বিচ্ছেদ হোক আর যা-ই হোক, আজকে তোর কবিতা না শুনে আড্ডা শুরু হবে না, ব্যস।

সৌমিত্র দার সাথে আবার মাথা নেড়ে সায় জানাল মিলন আর পঙ্কজ। তাদের জোরাজুরি কবি হেলাল হাফিজের দুই লাইনের একটি কবিতা শুনিয়ে দিলাম সবাইকে।

নিউট্রন বোমা বোঝো
মানুষ বোঝে না।

এই দুই লাইনের কবিতা আবৃত্তি শেষ হলেই সৌমিত্র দা জানতে চাইলেন, কবিতা শেষ?

আমি বললাম, হুম।

কী বলিস! এত ছোট কবিতা দিয়ে কীভাবে উদ্বোধন হবে? উদ্বোধন হতে হয় বিশাল সাইজের কবিতা দিয়ে। জসীম উদ্দীনের কবর কবিতা, ফররুখের পাঞ্জেরি অথবা রবি ঠাকুরের সোনার তরীর মতো সাইজে বিশাল না হলে কবিতা শুনে মজা আছে, বল?

আমার বেশ রাগ লাগল। বললাম, দেখো সৌমিত্র দা, তুমি শুধু একটি কবিতা আবৃত্তিই শুনতে চেয়েছিলে। আমাকে কিন্তু কবিতার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কেমন হবে তা বলে দাওনি।

কবিতার দৈর্ঘ্য-প্রস্থের কথা শুনে খলখল করে হেসে উঠল সৌমিত্র দা। হাসি থামিয়ে বলল, রাগ করিস না ভাই। এমনিতেই মজা করলাম। তবে, হেলাল হাফিজের এই ছোট্ট কবিতাটি কিন্তু আমার অলটাইম ফেভারিট। আমি আমার সম্পাদিত লিটল ম্যাগ ফুর-এর স্লোগান হিশেবে এই দুই লাইন ব্যবহার করতাম।

আমাদের আড্ডাস্থল থেকে অল্প দূরেই একজন বাদামওয়ালা বাদাম বিক্রি করছেন। শুকনো মুখে আড্ডা জমবে না বিধায় নবীন গিয়ে ত্রিশ টাকার বাদাম নিয়ে এলো। বাদাম মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে সৌমিত্র দা বলল, আরিফ যখন নিউট্রন বোমা নিয়ে কবিতা শোনাল, তখন আমারও ইচ্ছে করছে নিউট্রন-প্রোট্রন আর পরমাণুর গল্প বলতে। কী বলিস তোরা?

সবাই হ্যাঁ বলে সম্মতি জানাল। সবার সম্মতি পেয়ে বলতে শুরু করল সৌমিত্র দা। সবুজকে উদ্দেশ্য করে বলল, অ্যাই এডিসন, তুই কি কখনো ডেমোক্রিটাসের নাম শুনেছিস?

সবুজ কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, তুমি কি গ্রিক ফিলোসফার ডেমোক্রিটাসের কথা বলছ, যিনি প্রথম পরমাণুর ধারণা দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, বলল সৌমিত্র দা, আমি তার কথাই বলছি।

এই লোক ছিলেন একজন বিখ্যাত ফিলোসফার। যিশু খ্রিষ্টেরও অনেক আগে জন্মেছিলেন তিনি। তার সমসাময়িক অন্যান্য দার্শনিকদের মধ্যে একটি প্রশ্ন নিয়েই কেবল হইচই হতো। প্রশ্নটি ছিল, এই মহাবিশ্ব আসলে কী দিয়ে তৈরি?

দার্শনিকদের কেউ বলত মহাবিশ্ব হলো পানির তৈরি, কেউ বলত এই নিখিল বিশ্ব হলো বাতাসের তৈরি। কারও কারও মত ছিল এই মহাবিশ্ব আসলে আগুনের একটি পিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এরকম নানান কথা-উপকথা প্রচলিত ছিল তৎকালীন দার্শনিকদের মধ্যে; কিন্তু ওই সময়টায় বসে একেবারে ভিন্ন চিন্তা করতে পেরেছিলেন ডেমোক্রিটাস। তিনি কী বলেছিলেন জানো?

কী?, বলল মিলন।

ডেমোক্রিটাস বলেছিলেন যে, এই মহাবিশ্ব বাতাস, আগুন, পানি কোনোকিছু দিয়েই তৈরি নয়। এই মহাবিশ্ব আসলে অসংখ্য অদৃশ্য ক্ষুদ্রতম কণার সমষ্টি।

ডেমোক্রিটাস সেই অদৃশ্য কণাগুলোর নাম রেখেছিলেন অ্যাটম।

আমি বললাম, গ্রিক ভাষাতেও অ্যাটমকে কি অ্যাটমই বলা হতো?

ভালো প্রশ্ন, বলল সৌমিত্র দা। এরপর তিনি পকেট থেকে কলম আর এক টুকরো কাগজ বের করলেন। তাতে খচখচিয়ে কিছু একটি লিখে সেটি উল্টো করে আমাদের দিকে ধরলেন। আমরা দেখলাম তাতে একটি অপরিচিত ভাষায় লেখা dropos

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটি কী?

সৌমিত্র দা বললেন, গ্রিক ভাষায় অ্যাটমকে এভাবেই লেখে। ৫ অর্থ হলো। Never আর ropos অর্থ হলো ICut। তার মানে dropos শব্দের অর্থ দাঁড়ায়- Uncuttable। মানে, যা কাটা যায় না।

অর্থাৎ ডেমোক্রিটাস বলেছেন, অ্যাটম হচ্ছে কণার সেই অবস্থা, যাকে আর ভাঙা যায় না, কাটা যায় না, বিভাজন করা যায় না। তিনি বলতে চেয়েছেন, এই মহাবিশ্ব এমন কণা দ্বারা তৈরি যেগুলো চাইলেই আর বিভাজন করা যায় না, আলাদা করা যায় না।

এবার প্রশ্ন করল নবীন। সে বলল, তো, ডেমোক্রিটাসের এই কথা তখনকার সময়ে অন্যরা কি মেনে নিয়েছিল?

একদমই না, বলল সৌমিত্র দা। ডেমোক্রিটাসের সমসাময়িক দার্শনিক ছিলেন অ্যারিস্টটল। তখন তো চারদিকে অ্যারিস্টটলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। অ্যারিস্টটল যা বলত, সবাই তা বিনা বাক্যব্যয়ে বিশ্বাস করে নিত। কেউ কোনো আপত্তি করত না। ডেমোক্রিটাস যখন সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বললেন, মহাবিশ্ব আসলে আগুন, পানি আর বাতাসের তৈরি নয়, মহাবিশ্ব অ্যাটম দিয়ে তৈরি, তখন অন্য সবার সাথে ডেমোক্রিটাসের বিরোধিতা করেছিলেন স্বয়ং অ্যারিস্টটলও।

অদ্ভুত! অ্যারিস্টটলের মতো এরকম জ্ঞানী লোক কীভাবে ডেমোক্রিটাসের মতের বিরুদ্ধে যেতে পারে?, প্রশ্ন করলাম আমি।

হাসলেন সৌমিত্র দা। বললেন, আর বোলো না সেসব কথা। অ্যারিস্টটল জ্ঞানী লোক ছিলেন বটে, তবে তিনি জীবদ্দশায় যে-ভুলগুলো করে গিয়েছেন, সেগুলো ছিল খুবই মারাত্মক লেভেলের। এমনকি, তার একটি ভুলের কারণে পদার্থবিজ্ঞান অন্ধকারে ছিল পুরো দেড় হাজার বছর।

কোন ভুল?, জানতে চাইল সবুজ।

পৃথিবী ও সূর্যের ঘূর্ণন সম্পর্কে। অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে, সূর্য পৃদ্বিীকে কেন্দ্র করে ঘোরে। তার কথা যেহেতু গ্রিকবাসীরা ঈশ্বরের বাণীর মতোই বিশ্বাস করত, তাই এই মতের বাইরে কেউ কিছু চিন্তা করলেও সেটাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া হতো।

সৌমিত্র দার কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। বললাম, আজব তো! অ্যারিস্টটল সত্যিই কি বিশ্বাস করত, সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে?

হ্যাঁ, বলল সৌমিত্র দা।

কথা বলতে বলতে ত্রিশ টাকায় কেনা বাদাম শেষ হয়ে গেল। সৌমিত্র দা আবার বলতে লাগলেন, যাহোক, প্রথমদিকে সবাই ডেমোক্রিটাসের বিরোধিতা করলেও পরে দেখা গেল ডেমোক্রিটাসই আসলে সঠিক ছিল। মহাবিশ্বের প্রতিটি বই ক্ষুদ্রতম সূক্ষ্ম কণার সমষ্টি। এটাকে বাংলাতে বলা হয় পরমাণু। পরম+অণু। পরমাণু হলো বস্তুর এমন একটি পর্যায়, যাকে আর ভাঙা বা বিভাজন করা যায় না। তবে মজার ব্যাপার হলো ডেমোক্রিটাস একটি জায়গায় সঠিক হলেও অন্য জায়গায় একদম ভুল ছিলেন।

সৌমিত্র দার এই ভুল-ঠিক এর মহড়া শুনতে শুনতে মনে হলো পৃথিবীর তাবৎ মহা ভুলগুলো সম্ভবত এই মোটা মাথার বিজ্ঞানীরাই করে গেছেন। নবীন বলল, ডেমোক্রিটাস কোন জায়গায় ভুল ছিলেন?

ডেমোক্রিটাস বলেছিলেন, পরমাণুই হলো বস্তুর সর্বশেষ অবস্থা। এরপর আর কোনো অবস্থা নেই। পরমাণুকে ভাঙা যায় না, বিভাজন করা যায় না ইত্যাদি; কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, পরমাণুই বস্তুর পরম অবস্থা নয়। অর্থাৎ পরমাণুই বস্তুর শেষ অবস্থা নয়।

পঙ্কজ বলল, আমি কিন্তু খুব মজা পাচ্ছি সৌমিত্র দা। আমার তো এখন মনে হচ্ছে এই বিজ্ঞানীদের আসলে বিশ্বাস করাই ঠিক না। হা-হা-হা।

পঙ্কজের কথা শুনে আমরা সকলে হেসে উঠলাম। সৌমিত্র দা বললেন, বিজ্ঞান তো এমনই। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। এ জন্যে এক নাম-না-জানা কবি বিচ্ছেদের পরে প্রেমিকাকে বিজ্ঞানের সাথে তুলনা করে বলেছিলেন, তোমরা উভয়েই ছলনাময়ী।

এরকম কালজয়ী কবিতাশুনে আমরা আরেক দফা হেসে নিলাম। সৌমিত্র দা আবার বলতে শুরু করলেন, ডেমোক্রিটাসের এই তত্ত্ব বিজ্ঞান মহলে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল। সতেরোশো সালেও বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, পরমাণুই হলো বস্তুর সর্বশেষ অবস্থা, যেটাকে আর কোনোভাবে ভাঙা বা বিভাজন করা যায় না। এরপর, ডেমোক্রিটাসের এই তত্ত্বকে আরও মজবুত ভিত্তি দেন ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডাল্টন। আঠারোশো সালের দিকে এসে তিনি পরমাণুর গঠন নিয়ে একটি মতবাদ দেন। তার সেই মতবাদ পাঁচটি স্বীকার্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তার দেওয়া সেই পাঁচটি স্বীকার্যের মধ্যে তিন নম্বর স্বীকার্যটি হলো, পরমাণুসমূহ কখনোই বিভাজিত, সৃষ্টি বা ধ্বংস হতে পারে না।

ডাল্টনের এই মতবাদ আসার পরে ডেমোক্রিটাসের তত্ত্ব আরও শক্ত ভিত্তি পেয়ে যায়। এভাবে চলেছিল আরও বেশ কয়েক বছর। এরপর, আঠারোশো সালের শেষের দিকে। এসে বিজ্ঞানী জে জে থমসন এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের ইতি ঘটিয়ে দিলেন।

কীভাবে?, প্রশ্ন করল সবুজ।

বিজ্ঞানী জে জে থমসন পরমাণু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে পরমাণুর ভেতরে আরেকটি নতুন অবস্থা আবিষ্কার করলেন। সেটি হলো ইলেক্ট্রন। অর্থাৎ এতদিন ধরে যে বিশ্বাস করা হতো, পরমাণুকে ভাঙা যায় না, বিভাজন করা যায় না, পরমাণুই বস্তুর সর্বশেষ অবস্থা, তার যবনিকাপতন হলো। বিজ্ঞানী জে জে থমসন প্রমাণ করে দেখালেন, পরমাণুকেও ভাঙা যায়, বিভাজন করা যায়। পরমাণুকে বিভাজন করলে ইলেক্ট্রন পাওয়া যায়। ব্যস, রাতারাতি ভেঙে পড়ল ডেমোক্রিটাস আর জন ডাল্টনের মতবাদ। প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন তত্ত্ব।

আমি বললাম, কিন্তু বিজ্ঞান তো আর ইলেক্ট্রনেই বসে নেই। পরমাণুকে ভাঙলে এর অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিউট্রন আর প্রোটনও পাওয়া যায়।

এক্সাক্টলি, বলল সৌমিত্র দা। আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হলো, কীভাবে একটি ভুল মতবাদ, ভুল তত্ত্ব দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে বিজ্ঞান মহলে টিকে ছিল চিন্তা করো।

পঙ্কজ বলল, তার মানে আঠারোশো সালের আগপর্যন্ত পৃথিবীর কেউই জানত না—পরমাণুর চেয়েও ছোট বস্তু থাকতে পারে?

হ্যাঁ, বলল সৌমিত্র দা। বিজ্ঞানী জে জে থমসনের আবিষ্কারের আগে পৃথিবীর কেউই জানত না—প্রমাণুর চেয়েও ছোট বস্তু থাকতে পারে। তখন সবাই এটাই বিশ্বাস করত যে, পরমাণুই হলো বস্তুর সর্বশেষ অবস্থা এবং একে আর ভাঙা যায় না।

এতক্ষণ ধরে সাজিদ একটি কথাও বলেনি। এবার মুখ খুলল সে। বলল, সৌমিত্র দা, আমি একটু কথা বলতে চাই।

সৌমিত্র দা বললেন, অবশ্যই অবশ্যই। আমি তো আরও ভাবছিলাম যে—আমার বলা শেষ হলেই আমি তোমার কাছ থেকে শুনব।

তোমার কি বলা শেষ?

হ্যাঁ।

আচ্ছা। তোমার গল্পটি কিন্তু বেশ উপভোগ্য ছিল। তুমি তো জানোই যে, তুমি আমার প্রিয় একজন বক্তা। সাজিদের কথা শুনে হাসল সৌমিত্র দা। বলল, মাই প্লেজার!

তুমি বলছিলে, আঠারোশো সালের আগে পৃথিবীর কেউই জানত না, পরমাণুর চেয়েও ছোট বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে, রাইট?

হ্যাঁ।

কিন্তু, আমি তোমাকে এমন একটি তথ্য শোনাতে পারি, যা শুনলে তুমি নিজেই অবাক হয়ে যাবে।

যেমন?

হাসল সাজিদ। আমরা সবাই হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সে বলল, পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতে পরমাণুর চেয়েও ছোট বস্তুর অস্তিত্ব থাকার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়া আছে।

সাজিদের কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেল সৌমিত্র দার। ভীষণ অবাক হলো মিলন, নবীন, সবুজ আর পঙ্কজও। আমিও অবাক হয়েছি, তবে সাজিদ যখনই কিছু একটি বলতে চেয়েছে, তখনই বুঝতে পেরেছি যে, সামথিং ইজ দেয়ার!

সৌমিত্র দা বলল, রিয়েলি?

হ্যাঁ, বলল সাজিদ। আমি কি ব্যাখ্যা করব?

অবশ্যই করবে, খুব উত্তেজনাপূর্ণ গলা সৌমিত্র দার।

সাজিদ বলতে লাগল, কুরআনে সূরা সাবার তিন নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, [Allah is) the knower of the unseen. Not absent from him is an atoms weight within the heavens or within the earth or (what is] smaller than that or greater, except that it is in a clear register.

অর্থাৎ, তিনি (আল্লাহ) অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত। নভোমণ্ডল আর ভূমণ্ডলের অণু-পরিমাণ জিনিসও তার অগোচরে নেই। এমনকি এরচেয়েও (অণুর চেয়েও) ছোট কিংবা বৃহৎ সবকিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা আছে।

এই আয়াতে অণু-পরিমাণ বোঝাতে আরবী যাররা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যেটি এসেছে যাররাতুন থেকে। সকল আরবী ডিকশনারিতে এই যাররাতুন শব্দের অর্থ হলো, Atom, Smallest Piece, ক্ষুদ্রতম কণা ইত্যাদি।[১]

অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই আয়াতে স্পষ্ট শব্দেই অ্যাটম তথা পরমাণুর কথা উল্লেখ করেছেন এবং এর ঠিক পর পরই তিনি বলেছেন, এটার চেয়ে, অর্থাৎ এই পরমাণুর চেয়েও ছোট কিংবা বড় যা কিছুই আছে, তার সবটাই তিনি লিখে রেখেছেন সুস্পষ্ট কিতাবে। পরমাণুর চেয়েও যে ছোট বস্তু থাকতে পারে, সেটি আঠারোশো সালের অনেক আগেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যে-ভাষাটি ব্যবহার করেছেন, সেটাই সবচেয়ে চমকপ্রদ। তিনি বলেছেন অণুর চেয়ে ছোট জিনিস। তিনি কিন্তু যাররা তথা অণুর নাম নেওয়ার পরে বলে দেননি যে অণুর চেয়েও ছোট বস্তু ইলেক্ট্রন সম্পর্কেও আল্লাহ জানেন। তিনি অণুর পরে আর কোনোকিছুর নাম নির্দিষ্ট করে বলেননি। তার মানে হলো, অণুর পরে ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রনসহ কেয়ামত পর্যন্ত যা-ই আসতে থাকবে, তার সবটাই ওই ছোট জিনিস এর আওতায় পড়ে যাবে। এমন চমকপ্রদ ভাষাজ্ঞান আর আধুনিক বিজ্ঞানের আবিস্কৃত বিষয়াদি কি কোনো নিরক্ষর মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব সৌমিত্র দা? আমরা যেটাকে আঠারোশো সালের জ্ঞান ভাবছি, সেই জ্ঞানের ঝলক তো আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপরে এসেছিল।

একটানা এতক্ষণ কথা বলার পরে থামল সাজিদ। আমাদের বিস্ময়ের রেশ যেন কাটছেই না কোনোভাবে। সৌমিত্র দা বললেন, ঘটনা সত্যি হলে এটি আসলেই ভাববার বিষয়।

হেসে ফেলল সাজিদ। বলল, হ্যাঁ। কুরআন কিন্তু ভাবতেও বলেছে। কুরআন বলেছে, তারা কি কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?

সাজিদের কথা শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আসরের আযান হচ্ছে মসজিদে। সেন্ট্রাল মসজিদ থেকে ভেসে আসা আযানটি আজ অন্যরকম ভালো লাগছে। এক অপূর্ব সুরের দ্যোতনা যেন মুয়াজ্জিনের গলায়।

———–
১ A word for word meaning of the Quran, by Mohammad Mohar Ali

2 Comments
Collapse Comments

Bro, can you give bangla translation of islamic book ” Road to mecca ” writer : mohammad asad

আরিফ আজাদ ভাইয়ার প্রতিটি লেখা আমার হ্রদয় ছুঁয়ে যাওয়া।তিনি এত এত বই পড়ে,যুক্তিখন্ডন করে,মিল অমিল খুজে বের করে,কত সুচারু রুপে বিশ্লেষণ করে কোরআনের সত্যতা উন্মোচন করেছেন,তা সত্যিই অভূতপূর্ব।বাংলা লাইব্রেরীকে অসংখ্য ধন্যবাদ তাঁর অনন্যসাধারণ লেখাটুকু পিডিএফ আকারে প্রকাশ করার জন্য।পরিশেষে আরিফ আজাদ ভাইয়ার উত্তরোত্তর সাফল্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি . . .

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *