১৬. ক্রুস হেলালকে উৎখাত করে

ক্রুস হেলালকে উৎখাত করে

যে অত্যদ্ভূত দ্রুতগতিতে আরবের মরু সন্তানেরা হিজরী প্রথম শতাব্দীর মধ্যে তৎকালীন সভ্য-জগতের অধিকাংশ জয় করে ফেলে, তার সঙ্গে সঙ্গে তুলনীয় যদি কিছু থাকে, তবে তা হযরত মুহম্মদের (সঃ) মৃত্যুর পর তৃতীয় শতকের মধ্য হতে চতুর্থ শতকের মধ্য পর্যন্ত কালের ভিতর আরব-আধিপত্যের দ্রুত অধঃতন। ৮২০ খৃস্টাব্দের কাছাকাছি সময় বাগদাদের খলীফার একক হাতে যে প্রভুত্ব-ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল, তা অন্য কোন জীবিত লোকের হাতে ছিল না। ৯২০ খৃস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে সেই ক্ষমতা তার পরবর্তীদের হাতে এত খর্ব হয়ে পড়ে যে, তার নিজ রাজধানীতেও সে ক্ষমতা বিশেষ অনুভূত হত না। ১২৫৮ সালে বাগদাদ শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ শহরের সঙ্গে আবার প্রভুত্বও চিরবিদায় গ্রহণ করে এবং সত্যিকার খিলাফতের ইতিহাস খতম হয়ে যায়।

বাইরের কারণের মধ্যে মঙ্গোল বা তাফ্‌তারদের মত বর্বর জাতিসমূহের আক্ৰমণ জাকজমকপূর্ণ হলেও আসলে তা ছিল আরবজাতির শেষ পতনের অন্যতম কারণ। খিলাফতের কেন্দ্রভূমি ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানে যে অসংখ্য বংশ ও উপবংশের উত্থান হয়, তাতে রোগের লক্ষণই প্রকাশ পায়; ও গুলিকে রোগের কারণ বলা চলে না। পাশ্চাত্যের রোমক সাম্রাজ্যের মত, রুগ্ন মানুষটি ইতিপূর্বেই তার শেষ শয্যায় শায়িত ছিল–এমন সময় চোর এসে দুয়ার ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে এবং তার রাজকীয় উত্তরাধিকারের ভাগ কেড়ে নিয়ে সরে পড়ে।

খিলাফত খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। প্রথম যুগের অনেকগুলি বিজয় কেবল নামে বিজয় ছিল। তাছাড়া, শাসন-পদ্ধতি স্থায়িত্বের অনুকূলে ছিল না। প্রায় সর্বত্রই শোষণ ও অতিরিক্ত কর-ভারে প্রজাপুঞ্জ পীড়িত ছিল। আরব অনারব, আরব-মুসলমান, অনারব-মুসলমান, মুসলমান-জিম্মী–এদের মধ্যে বিভেদ রেখা অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। স্বয়ং আরবদের মধ্যেই উত্তর-আরব আর দক্ষিণ-আরবের মধ্যকার প্রাচীন রেষারেষি তেমনি তীব্রভাবে বিদ্যমান ছিল। ইরানের পারসিকতরা, তুবাণের তুর্করা আর হেমিটিক বার্বাররা সেমিটিক আরবদের সঙ্গে কখনো এক অভিন্ন জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। কোনো আত্মবোধই এই বিভিন্ন জন-সংঘকে একত্রে বেঁধে রাখতে পারে নাই। ইরানের সন্তানেরা কখনো তাদের জাতির অতীত গৌরব-মহিমা ভুলতে পারে নাই এবং কখনো এ নতুন শাসন-ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ আপনভাবে গ্রহণ করে নাই। সিরিয়ার লোকেরা বহুকাল পর্যন্ত আশান্বিত চোখে চেয়ে ছিল যে, তাদের কোন নেতা আবির্ভূত হয়ে আব্বাসীয়দের অধীনতার বন্ধন হতে তাদের মুক্ত করবে। বার্বাররা সুযোগ মিললে যে কোন ষড়যন্ত্রে যোগ দিত এবং অস্পষ্টভাবে হলেও এর থেকে বুঝতে বাকী থাকত না যে, তারা তাদের কওমী দৃষ্টিভঙ্গী বা আরবদের সঙ্গে তাদের বিভিন্নতা কিছুতেই ভোলে নাই। রাজনীতি ও সমর ক্ষেত্রে যেমন–ধর্মেও তেমনি বিভেদ রেখা ফুটে ওঠে এবং তার ফলে অদ্ভূত হয় শীয়া, কারমাতী, ইসমাইলী, খারেজী ইত্যাদি মাযহাব। এইসব সম্প্রদায়ের কতকগুলি ধর্মীয় দল ছাড়া আরো কিছু ছিল। সাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্ত কতকগুলো ধর্মীয় দল ছাড়া আরো কিছু ছিল। সাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্ত কারমাতীদের আঘাতে টলে ওঠে; ফাতেমীরা অনতিকাল মধ্যে পশ্চিম ভাগ অধিকার করে নেয়। খিলাফত যেমন ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহের সঙ্গে মধ্য-এশিয়ার দেশসমূহকে মিলিয়ে এক স্থায়ী অখণ্ডরাজ্য গড়ে তুলতে পারে নাই, ইসলামও তেমনি তার বিভিন্ন অনুবর্তীদের এক অখণ্ডজাতির বন্ধনে বেঁধে রাখতে পারল না।

এরপর সামাজিক ও নৈতিক প্রভাবও সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের অনুকূল ছিল । কয়েক শতাব্দীর মধ্যে বিজেতা জাতিসমূহের রক্ত বিজিতদের রক্তের সঙ্গে মিশে পাতলা হয়ে পড়ে; ফলে বিজেতারা তাদের বিশিষ্ট গুণ ও আধিপত্যের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আরব জাতীয়-জীবনের পতনের সঙ্গে আরবদের সহন-শক্তি ও মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। ক্রমে ক্রমে সাম্রাজ্য বিজিতদের সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। শাহীমঞ্জিলে হেরেম ও তার সংশ্লিষ্ট অসংখ্য খোঁজা, বালক-বালিকা গোলাম বাঁদী, গিলমান (এসব নারী-পুরুষ উভয়কে পতনের শেষ পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছায়), অগণ্য উপপত্নী ও সতেলা ভাইবোন, তাদের হিংসা ও ষড়যন্ত্র, মদ ও সঙ্গীত প্রধান বিলাসময় জীবন–এই সমস্ত এবং অনুরূপ অন্যান্য শক্তি মিলে পারিবারিক জীবনের প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে ফেলে। সিংহাসনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত অন্তহীন কলহ দুর্বল উত্তরাধিকারীদের অবস্থা আরো অনিশ্চিত করে তোলে।

অর্থনৈতিক অবস্থাও সাম্রাজ্য-রক্ষার পক্ষে প্রতিকূল ছিল। কর বসানো ও আঞ্চলিক শাসন শাসক-শ্রেণীর স্বার্থে পরিচালিত হওয়ায় কৃষি ও শিল্প পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে না। শাসকরা যে পরিমাণে ধনী হয়ে ওঠে, জনসাধারণ সেই পরিমাণেই গরীব হয়ে পড়ে। জমিদারীর অধীনে উপ-জমিদারীর সৃষ্টি হয় এবং শেষোক্ত প্রথার মালিকরা প্রজা-সাধারণকে লুট করে খেত। ঘন ঘন রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের ফলে লোক-সংখ্যা কমে যায় এবং অনেক ক্ষেত-খামার অনাবাদী পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে মেসোপটেমিয়ার নিম্ন অঞ্চলে বন্যা ধ্বংসের তা শুরু করতঃ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ দুর্ভিক্ষ, বহু এলাকা প্লেগ, বসন্ত, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি ব্যারামের মড়কে উজাড়-প্রায় হয়ে যেত। আরব ইতিহাসে বিজয়ের প্রথম চার শতাব্দীতে চল্লিশটি ব্যাপক মড়কের বিবরণ পাওয়া যায়। যে সব কারণে প্রাচ্যে এবং সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে মুসলিম-শক্তি ভেঙ্গে পড়ে, মোটামুটি ড্রপ কারণেই স্পেন ও ইউরোপের অন্যান্য অংশে মুসলিম-শক্তির পতন ঘটে। তফাতের মধ্যে এই ছিল যে, এখানে মঙ্গোলদের বদলে খৃষ্টানরা মৃত্যুবাণ হানে।

১০৩১ সালে কর্ডোভার উমাইয়া খিলাফতের পতন হয়। এর ধ্বংসস্তূপ হতে ছোট ঘোট এক ঝাঁক রাজ্যের উদ্ভব হয়। এসব রাজ্য ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি কাটাকাটি করে নিজেদের শক্তি-ক্ষয় করে। বিশটি শহর ও অঞ্চলে এমন বিশটি রাজ্যের উত্থান হয়। গ্রানাডার পরই সেভিলের ছিল গৌরবময় স্থান। কিন্তু শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই সেভিল এক নতুন উদীয়মান শক্তির হাতে পড়ে। এ শক্তি ছিল, মরক্কো হতে আগত এক বার্বার বংশ। এমনিভাবে স্পেনে বাবার প্রভুত্বের সূচনা হয়।

এ বার্বার বংশের নাম ছিল আল-মোরাভাইড। উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা ও স্পেন উভয়ই এদের আয়ত্তে ছিল। বংশের নামটি ছিল এক আরবী শব্দের অপভ্রংশ–মানে যোদ্ধা-দরবেশ দল। এরা প্রথমে এক সামরিক ভ্রাতৃসংঘ ছিল এবং সে সব কওমের পুরুষেরা চোখের নীচে মুখমণ্ডলের বাকী অংশ পরদায় ঢেকে রাখতো, এরা তাদের মধ্য হতে লোক সংগ্রহ করত। তাদের বংশধর ‘তুয়ারেগ’ কওম এখনো অমন পরদা পরে। এই জন্য এদের অন্য নাম হয় ‘পরদা পরনেওয়ালা’। আল-মোরাভাইডদের পর আরো একটি বার্বার বংশের অভ্যুদয় হয়। আরব বংশসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, গ্রানাডার নাসরিদ বংশ। এই বংশেরই মুহম্মদ আল-গালিব বিশ্ববিখ্যাত আলহামরা নির্মাণ করেন।

মুসলিম-শক্তির পতনকালে প্রাচ্য বা পাশ্চত্য জগতে যে সব ছোট ছোট রাজ্যের উত্থান-পতন হয়, তাদের ইতিহাস নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই না। তবে সে কাহিনীর একটা মোটামুটি ধারণা আমাদের থাকা দরকার। বিশেষ করে ইউরোপে মুসলিম-শক্তির শেষ দিকের ঘটনাবলী অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, যখন তারা পরস্পরকে ধ্বংস করতে ভীষণভাবে লিপ্ত, তখন তারা তাদের সংস্কৃতির বিস্তার-সাধনের কথা ভোলে নাই। কোন মানুষের পক্ষে তার জ্ঞান ও শিল্পকে অপরের মধ্যে প্রসারিত করার যে শক্তি, তা-ই তার সভ্যতার গৌরব ও বেঁচে থাকার ক্ষমতার পরিচায়ক।

একাদশ শতাব্দীতে যখন উমাইয়া খেলাফতের পতন হয়, তখনই খৃস্টান শক্তি কর্তৃক স্পেনের পুনর্জয়ের যুগ শুরু হয়। ৭১৮ সালে কোভাডোঙ্গার লড়াইয়ে অসুরিয়ান নেতা পিলায়ে মুসলিম অগ্রগমন রোধ করেন। স্পেনীয় ঐতিহাসিকেরা এই যুদ্ধ-জয়কেই স্পেন পুনর্জয়ের আরম্ভ মনে করে থাকেন। যদি মুসলমানরা অষ্টম শতাব্দীতে পর্বতাকীর্ণ উত্তর অঞ্চলের খৃস্টান-শক্তির শেষ দীপ নিভিয়ে দিত, তবে স্পেনের পরবর্তী ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদাভাবে লিখিত হতে পারত। উত্তরের খৃস্টান দলপতিদের মধ্যে প্রথম ভয়ঙ্কর আত্মকলহ থাকায় পুনর্জয়ের কাজে বাধা সৃষ্টি হতে থাকে; কিন্তু ১২৩০ খৃস্টাব্দে কেস্টাইল ও লিয়ন সংযুক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে মুসলিম শক্তির পতন দ্রুত গতিতে চলে। এয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত গ্রানাডা ছাড়া পুনর্জয় কার্যতঃ শেষ হয়ে যায়। ১০৮৫ সালে টলেডোর, ১২৩৬ সালে কর্ডোভার এবং ১২৪৮ সালে সেভিলের পতন হয়।

এয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পর দুটি বড় কাজ শুরু হয় : স্পেনকে খৃস্টানীকরণ ও তার ঐক্য বিধান। এককালে, স্পেনের যে অংশে সেমিটিক ও কার্থেজেনীয় সভ্যতার বিকাশ লাভ ঘটেছিল, কেবল সেই অংশে ইসলাম শিকড় গাড়ে। সিসিলীতেও ঐ ব্যাপারই ঘটে। এ ব্যাপারটি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাচীনকালে পিউনিক ও পাশ্চাত্য-সভ্যতার মধ্যে যে পর্যায়ের বিভেদ ছিল, ইসলাম ও খৃষ্টান ধর্মের মধ্যের বিভেদ মোটামুটি সেই পর্যায়ে বরাবরই বিদ্যমান ছিল। ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত বহু মুসলমান বিজিত হয়ে বা সন্ধি-সূত্রে খৃষ্টান শাসনাধীনে চলে যায়; কিন্তু তারা অন্যান্য ব্যাপারে তাদের আইন ও ধর্ম রক্ষা করে চলতে থাকে। এইসব মুসলমানকে বলা হত মুদেজার।’ ‘পোষ মানা’ অর্থবোধক একটি আরবী শব্দ হতে এই শব্দটি উদ্ভূত। বহু মুদেজার এই সময় আরবী ভুলে গিয়ে কেবল রোমান্স ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে এবং খৃস্টানদের সঙ্গে অনেকটা এক হয়ে যায়।

স্পেনে অবশেষে ঐক্য-সাধনার কাজ ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে চলতে থাকে। এই সময় খৃস্টান আধিপত্য কেস্টাইল ও আরাগন রাজ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৪৬৯ খৃস্টাব্দে আরাগনের ফার্ডিন্যান্ড ও কেস্টাইলের ইসাবেলার মধ্যে বিয়ে হয় এবং উভয় রাজ্য চিরতরে এক হয়ে যায়। এই মিলন মুসলিম-স্পেনের ধ্বংসের পথ অবারিত করে দেয়। এই ক্রমবর্ধমান বিপদের সম্মুখীন হওয়া নাসরিদ বংশের সাধ্যাতীত ছিল। এ বংশের শেষ সুলতান এক রক্তক্ষয়ী আত্মকলহে লিপ্ত হন এবং তার অবস্থা আরো বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। ১২৩২ হতে ১৪৯২ পর্যন্ত যে একুশজন সুলতান রাজত্ব করেন, তাঁদের মধ্যে ছয়জন দুইবার এবং একজন তিনবার রাজত্ব করেন। যে সময় আমেরিকার ইতিহাসের সূচনা, ঠিক সেই ১৪৯২ সালে এক দীর্ঘ অবরোধের পর খৃস্টান সৈন্যদের হাতে গ্রানাডার পতন ঘটে–স হেলালকে উৎখাত করে। উদার ম্রাট ও ম্রাজ্ঞী ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা আত্মসমর্পণের শর্ত পালন করলেন না।

১৪৯৯ সালে রানী ইসাবেলার ধর্মগুরু কার্ডিনাল জিমেনেজ-ডি-সিসনারোর নেতৃত্বে জোর করে ধর্মান্তর কর গ্রহণের অভিযান শুরু হয়। কার্ডিনাল প্রথম চেষ্টা করেন ইসলাম বিষয়ক সমস্ত আরবী বই পুড়িয়ে ফেলতে। গ্রানাডার আরবী পাণ্ডুলিপি পোড়ানোর উৎসব শুরু হয়। এরপর প্রতিষ্ঠিত হয় বিধর্মী উচ্ছেদ আদালত (ইনকুইজিশন)! এর কাজ জোরেশোরে চলতে থাকে। গ্রানাডার পতনের পর যেসব মুসলমান স্পেনে রয়ে যায়, তাদের সবাইকে এখন থেকে বলা হয়, ‘মরিসকো’ (স্পেনীয় ভাষায় এর মানে হোট মুর)। রোমকরা পশ্চিম-আফ্রিকাকে বলত, মরেটানিয়া আর বাসিন্দাদের বলত ‘ম-রী’ (মনে হয়, আসলে ফিনিশীয় শব্দ–মানে পাশ্চাত্য)। এই মরী হতে স্পেনীয় মোয়রা এবং ইংরেজি মুর শব্দের উৎপত্তি। বার্বাররাই প্রকৃত মুর ছিল। কিন্তু স্পেন ও উত্তর পশ্চিম আফ্রিকার সমস্ত মুসলমানকেই মুর বলা হয়। ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে পাঁচ লাখ মুসলমান আছে; এদের বলা হয়, মোরো। মেগেলান কর্তৃক ১৫২১ সালে এই দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কৃত হওয়ার পর স্পেনীয়রা তথাকার মুসলমানদের এ নাম দেয়।

মুসলিম স্পেনীয়রা একটি রোমান্স উপভাষায় কথা বলত। কিন্তু ব্যবহার করত আরবী হরফ। বেশীর ভাগের না হলেও অনেক মরিসকোরই পূর্বপুরুষ স্পেনীয় ছিল। কিন্তু এখন সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, তাদের পূর্বপুরুষরা খৃষ্টান ছিল; কাজেই তাদের হয় আবার খৃস্টান হতে হবে, নইলে তার ফল ভোগ করত হবে। মুদেজারদের মরিসকোদের সঙ্গে এক শ্রেণীভুক্ত করা হয়। এদের অনেকে প্রকাশ্যে খৃস্টান ধর্ম স্বীকার করত; কিন্তু গোপনে ইসলামের আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। কেউ কেউ খৃস্টানী মতে বিয়ে করে বাড়ী এসে গোপনে ইসলামী মতে ফের বিয়ে করত। অনেকে বাইরে খৃস্টানী নাম রাখত–আর বাড়ীতে ব্যবহারের জন্য আরবী নাম রাখত। ১৫০১ সালে কেস্টাইলে এক রাজকীয় আদেশে ঘোষণা করা হয় যে, কেস্টাইল আর লিয়নের সব মুসলমানকে হয় খৃস্টান হতে হবে, না হয় স্পেন ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে মনে হয়, এ ঘোষণা অনুযায়ী যথাযথ কাজ হয় নাই। ১৫২৬ সালে আরাগনের মুসলমানদের উপর ঐ একই আদেশ জারী হয়। ১৫৫৬ সালে দ্বিতীয় ফিলিপ এক আইন জারী করেন যে, বাকী মুসলমানদের অনতিবিলম্বে তাদের ভাষা, নামাজ-রোজা, অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং জীবনযাত্রা প্রণালী ত্যাগ করতে হবে। তিনি এমন আদেশ দিয়ে বসেন যে, স্পেনীয় গোসলখানাগুলিও বিধর্মীদের চিহ্ন; কাজেই সেগুলি ভেঙ্গে ফেলতে হবে। গ্রানাডা-অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয় (এই দ্বিতীয় বার) এবং পার্শ্ববর্তী পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে। তবে সে বিদ্রোহ দমন করা হয়। ১৬০৯ সালে তৃতীয় ফিলিপ মুসলিম বিতাড়নের শেষ হুকুম-নামায় দস্তখত করেন। এর ফলে স্পেনের সমস্ত মুসলমানকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। কথিত আছে, প্রায় পাঁচ লক্ষ মুসলমান আফ্রিকা বা অন্য কোন মুসলিম দেশে যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠতে বাধ্য হয়। প্রধানতঃ এই মরিসকোদের মধ্য হতেই পরে পয়দা হয় মরক্কোর জল-দস্যুদল। হিসেবে দেখা যায় যে, গ্রানাডার পতন ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মুসলমান হয় নির্বাসিত, না হয় নিহত হয়। স্পেনের মুর-সমস্যার এইভাবে চিরসমাধান ঘটে। আরবী-সভ্যতা যেখানে একবার শিকড় গেড়েছে, সেখানেই চিরস্থায়ী হয়েছে–স্পেন এই সাধারণ নিয়মের স্পষ্ট ব্যতিক্রম। মুররা নির্বাসিত হল। খৃস্টান-স্পেনকে ধার-করা আলো নিয়ে কিছুকাল চাঁদের মত উজ্জ্বল প্রতীয়মান হল। তারপর নেমে এল অন্ধকার। সেই হতে স্পেন অন্ধকারে ঘুরে মরছে।’

স্পেনে ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপত্য-শিল্পের সমস্ত কীর্তি ধ্বংস পেয়েছে। একমাত্র টিকে আছে কর্ডোভার মহান মসজিদ। ৭৮৬ সালে একটি পুরোনো গীর্জার অবস্থান-ভূমিতে এ মসজিদের ভিত্তি স্থাপিত হয়। গীর্জায় আগে এখানে ছিল একটি রোমক মন্দির। চতুষ্কোণ মিনার সম্বলিত এর প্রধান অংশের কাজ ৭৯৩ সালে শেষ হয়। মিনারগুলি আফ্রিকার ভাস্কর্য-রীতি মোতাবেক নির্মিত হয়। আফ্রিকান রীতির মূল ছিল সিরীয়-রীতি। ১১৯টি স্তম্ভ এর ছাদ ধারণ করত। গীর্জার ঘন্টা দিয়ে নৈপতলের বাতি মসজিদের আলো দিত। একটি বাতি ঋড়ে এক হাজার আলো জ্বলত; সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র ঝড়েও জ্বলত বারোটি। সিরিয়ার উমাইয়া মসজিদ নির্মাণে যেমন বাইজেন্টাইন রাজমিস্ত্রী মোতায়েন করা হয়, এখানেও তেমনি তারা নিযুক্ত হয়। এর স্থাপয়িতা গথদের নিকট হতে লুষ্ঠিত ৮০ হাজার দিনার মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করেন। ১০০০ সাল পর্যন্ত মুসলমানেরা এর মেরামত ও সম্প্রসারণ করেন। আজ এ মসজিদ একটি গীর্জা।

ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য-নিরপেক্ষ স্থাপত্য-শিল্পের মধ্যে সেভিলের আলকাজার (আরবী শব্দ) এবং গ্রানাডার আলহামরার ধ্বংসাবশেষ অপূর্ব সুন্দর। এর কারু সজ্জা ছিল বহাল–কিন্তু বিচিত্র ও রমনীয়। সেভিলের আল-কাজারের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন অংশ টলেডোর একজন স্থপতি ১১৯৯-১২০০ সালে জনৈক আল মোয়াহেদী গভর্নরের জন্য তৈরী করেন।

মুসলিম স্পেনে আল-মোরাভাইডদের পর আল-মোয়াহেদীরা দ্বিতীয় বার্বার শাসক বংশ ছিল। আরবীতে একেশ্বরবাদী অর্থবোধক একটি শব্দ হতে এদের ঐ নাম হয় । নিষ্ঠুর রাজা পিটারের জন্য ১৩৫৩ সালে মুদেজার স্থপতিরা মুসলিম স্টাইলে আল-কাজার পুননির্মাণ করে। কিছুদিন আগেও এ ইমারত রাজপ্রাসাদরূপে ব্যবহৃত হত। কর্ডোভা, টলেডো ও অন্যান্য বহু স্পেনীয় শহরে আল-কাজার ছিল; তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ছিল সেভিলের আল-কাজার এবং একমাত্র এই প্রাসাদটিই এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে। টলেডোর আল কাজারটি শেষ গৃহযুদ্ধে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আল-হামরা প্রাসাদে হিস্পনো-মুসলিম রূপসজ্জার চরম উন্নতির পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রানাডার এই অ্যাপলিসটি বিরাট আকারে নির্মিত এবং মোজাইক ও উল্কীর্ণ বচনে ব্যাপকভাবে সজ্জিত হয়। জনৈক নাসরিদ সুলতান ১২৪৮ খৃস্টাব্দে এর পত্তন করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়।

পাশ্চাত্য মুসলিম স্থাপত্যে ঘোড়র নালের আকারের খিলান এই স্থাপত্যের স্বাভাবিক লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য নিকট প্রাচ্যে ইসলামের আগেও এ স্থাপত্য রীতির চল ছিল। ঘোড়ার গোলাকার নাল আকারে এ রীতি দামেস্কের উমাইয়া মসজিদে ব্যবহৃত হয়। এই শেষোক্ত রীতি স্পেনে মুরীশ খিলান’ নামে পরিচিত হয়। আরব বিজয়ের আগেও স্পেনে এ রীতি নিঃসন্দেহ রকমে বিদ্যমান ছিল; তবে স্পেনীয়–বিশেষ করে কর্ডোভার মুসলমানরা এর গঠন ও আলংকারিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করে জনসাধারণের মধ্যে এর প্রচলন করে। আরব অধ্যুষিত কর্ডোভার স্থপতিরা ইউরোপের ভাণ্ডারে আরো কতিপয় মৌলিক দান করে। স্থাপত্য বিদ্যার এইসব নব নব বৈশিষ্ট্য মোজারাবদের দ্বারা কর্ডোভা হতে টলেডো এবং উপদ্বীপের উত্তর অঞ্চলের কেন্দ্রে কেন্দ্রে নীত হয়। এখানে মুসলিম ও খৃস্টান রীতির মিলন হতে এক নবতি জন্মলাভ করে। ঘোড়ার নীল আকারে খিলান ও খিলান করা ছাদ এই রীতি র প্রায় অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ছিল। মুদেজার মিস্ত্রীদের হাতে এই রীতি যথেষ্ট উন্নত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে স্পেনের জাতীয় রীতি হিসেবে গণ্য হয়।

গ্রানাডার পতনের বহুকাল পর পর্যন্ত মুরীয় নর্তক ও গায়কগণ স্পেন ও পর্তুগালের জনসাধারণকে আনন্দ বিতরণ করে। রাইবেরার ইদানিং যে গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা যায় যে, কেবল স্পেনের নয়–সমস্ত দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপে ত্রয়োদশ শতাব্দী ও তার পরের সাধারণ সঙ্গীত, সে অঞ্চলের গীতি কবিতা ও ঐতিহাসিক উপন্যাসের মত আন্দালুসীয়া হতে উদ্ভুত এবং তার আগে তা আরবী মারফত পারসিক, বাইজেন্টাইন ও গ্রীক মূল হতে আসে। দর্শন, গণিত ও চিকিৎসাশাস্ত্র যেমন গ্রীস ও রোম হতে যায় বাইজেনটিয়াম, পারস্য এবং বাগদাদে–আবার বাগদাদ হতে যায় স্পেনে এবং স্পেন হতে যায় সমস্ত ইউরোপে, তেমনিভাবে সঙ্গীতের তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কিত কতিপয় বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে।

স্পেন বাদেও ইউরোপের মধ্যে একমাত্র সিসিলীতে মুসলমানরা শক্তভাবে আসন গেড়ে বসে। ৬৫২ সাল হতে সিসিলীতে মাঝে মাঝে আক্রমণ চলতে থাকে। ৮২৭ সালে এর বিজয় শেষ হয়। এরপর ১৮৯ বছর পর্যন্ত দুর্দান্ত আরব আমীরদের অধীনে সিসিলী আংশিক বা মোল আনা রকমে আরব জগতের একটি প্রদেশ হয়ে থাকে। এর রাজধানী ছিল পালারমা।

উত্তর অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা ও অস্থায়ী বিজয়ের যেমন স্পেন ঘাঁটি বিশেষ ছিল ইটালী সম্পর্কে সিসিলীয় তেমনি ঘাঁটি ছিল। আমীর দ্বিতীয় ইব্রাহীম তিউনিসিয়া হতে আগত আগলাৰী ছিলেন। তিনি সিসিলীও শাসন করতেন। ৯০২ সালে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি জেহাদ করতে করতে প্রণালী পার হয়ে ইটালীর পায়ের আঙ্গুল কেলাবরিয়া পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেন। ইনিই কিন্তু প্রথম আরব আক্রমণকারী ছিলেন না। পালারমো অধিকার করার অল্পকাল পরেই উত্তর আফ্রিকার অন্য আগলাৰী সেনাপতিরা দক্ষিণ ইটালীর প্রতিদ্বন্দ্বী লর্ডদের কলহে হস্তক্ষেপ করে। তখনো ইটালীর গোড়ালী ও পায়ের আঙ্গুল বাইজেন্টাইনদের অধীনে। ৮৩৮ সালে যখন নেপলস আরব সাহায্যের জন্য আবেদন করে, তখন আরবদের যুদ্ধধ্বনি ভিসুভিয়াসের প্রান্তভূমি পর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলে। এর প্রায় চার বছর পর আদ্রিয়াতিকের তীরে অবস্থিত বারী মুসলমানরা অধিকার করে বসে। এরপর প্রায় ত্রিশ বছর পর্যন্ত এই বারী ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘাঁটি। প্রায় এই সময়ই বিজয়ী মুসলমানরা ভেনিসের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। ৮৪৬ সালে একদল আরব সৈন্য রোম আক্রমণে উদ্যত হয়। ওসটীয়াতে এই সৈন্যদল অবতরণ করে এবং রোমের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয়ে ভ্যাটিকানের পার্শ্ববর্তী সেন্টপিটার গীর্জা ও প্রাচীরের বাইরের সেন্টপল গীর্জা পুড়িয়ে দেয়। তিন বছর পর একটি মুসলিম নৌ বাহিনী ওসটীয়াতে পৌঁছে; কিন্তু ঝটিকা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্র ও ইটালীর নৌ বাহিনীর প্রতিরোধের সামনে বিধ্বস্ত হয়। র‍্যাফেলের একটি চিত্রে এই নৌ যুদ্ধ ও রোমের বিস্ময়করভাবে উদ্ধারের কাহিনী রঙের ভাষায় বর্ণিত আছে। কিন্তু ইটালীর উপর মুসলমানদের প্রভাব এমনি অপ্রতিহত হয় যে, পোপ অষ্টম জন (৮৭২-৮৮২) দুই বছর পর্যন্ত তাদের কর দেওয়া সমীচীন বোধ করেন।

আগলাবীরা ইটালীর উপকূলে অভিযান করেই ক্ষান্ত হয় নাই। ৮৬৯ সালে তারা মালটা দখল করে। দশম শতাব্দীতে ইটালী ও স্পেন হতে আল্পস পর্বতের ভিতর দিয়ে মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত লুণ্ঠন চলতে থাকে। আল্লাস পর্বতমালায় কতকগুলি দুর্গ ও দেয়াল আছে; পর্যটকদের পথনির্দেশ পুস্তকে বর্ণিত তথ্য (টুরিস্ট গাইড) অনুসারে এগুলি আরব আক্রমণের ফল। সুইজারল্যান্ডের ‘গ্যাবী’, ‘আলগ্যাবী প্রভৃতি কতকগুলি স্থানের নাম বোধহয় আরবী হতে উদ্ভূত।

৮৭১ সালে খুস্টানদের দ্বারা বারী’র পুনর্দখল মুসলমানগণ কর্তৃক ইটালী ও মধ্য ইউরোপে আক্রমণ আশঙ্কার সমাপ্তির সূচনা করে। বারীতে সেনাপতিরা এতদূর যায় যে, তারা পালারমোর আমীরের আনুগত্য অস্বীকার করে নিজেদের স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করে। ৮৮০ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট ১ম বেসিল মুসলমানদের নিকট হতে টারানটো কেল্লা পুনর্দখল করেন এবং তার কয়েক বছর পর কালাত্রিয়া হতে অবশিষ্ট আরবগণকে বহিষ্কৃত করেন। আড়াইশ’ বছর আগে সুদূর আরবে যে বিস্তৃতি শুরু হয়েছিল, এইরূপে তার সমাপ্তি ঘটে। যে সব আরব স্তম্ভ’ হতে সিসিলী বা আফ্রিকার আরব নৌ-বাহিনীর আগমন বার্তা ঘোষণা করা হত, আজো তা নেপলস-এর দক্ষিণ অঞ্চলে উপকূল ভাগের সৌন্দর্য বর্ধন করছে। ট্যানক্রেড-দ্য-হটেভিলের পুত্র কাউন্ট রোজার ১০৬০ সালে মেসিনা অধিকার করেন। এইরূপে নর্মানদের দ্বারা সমগ্র সিসিলী দখলের সূচনা হয়। ১০৭১ সালে পালারমো এবং ১০৮৫ সালে সিরাকিউস অধিকৃত হয়। ১০৯১ সালে অধিকার-কার্য সমাপ্ত হয়। ১৯৯০ সালে রোজার মালটা দখল করেন। মূল ভূখণ্ডে আগেই নর্মানদের একটা শক্তিশালী রাজ্য ছিল; এই বার তারা তাদের নব-বিজিত দেশ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়।

সিসিলী দ্বীপ নর্মানদের অধীনে থাকাকালে সেখানে খৃস্টান ও মুসলমানদের কৃষ্টির সংমিশ্রণে এক নতুন তমদ্দুনের উদ্ভব হয়। সিসিলী আগে হতেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনে সমৃদ্ধ ছিল। আরব শাসনাধীনে থাকাকালে প্রাচ্য সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা এখানে প্রবেশ করতে থাকে এবং আগের জামানার গ্রীক ও রোমক সভ্যতার নিদর্শনের সঙ্গে মিশে গিয়ে নর্মানদের আমলে নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করে এবং নর্মান সংস্কৃতি এক সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যে ফুটে ওঠে। এতকাল পর্যন্ত আরবরা যুদ্ধ-বিগ্রহে এমন গভীরভাবে লিপ্ত ছিল যে, তারা শান্তি কালোপযোগী কোন শিল্পের বিকাশ সাধন করার অবকাশ পায় নাই। এক্ষণে তাদের প্রতিভা আরব শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অপূর্ব সাফল্য সম্পদে ফুটে উঠল।

প্রথম রোজার নিজে অশিক্ষিত খৃষ্টান ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর বেশীর ভাগ পদাতিক সৈন্য মুসলমানদের মধ্য হতে সংগ্রহ করেন। তিনি আরব জ্ঞান বিজ্ঞানে উৎসাহ দিতেন, প্রাচ্য দেশীয় দার্শনিক, জ্যোতিষী এবং চিকিৎসক দ্বারা পরিব্রত থাকতেন এবং অখৃস্টানদের আচার অনুষ্ঠানের স্বাধীনতা দিতেন। ফলে মনে হত, পালারমোর দরবার মুখ্যত : প্রাচ্যদেশীয় এবং গৌণতঃ পাশ্চাত্যদেশীয় ছিল। এর একশত বছরেরও পর সিসিলীতে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যেত ও দেখা যেত, এ খৃস্টান রাজ্যের কতকগুলি উচ্চতম পদে অধিষ্ঠান করছে মুসলমান কর্মচারী।

ইউরোপ মহাদেশে প্রাপ্ত কাগজে-লিখিত প্রাচীনতম দলীল হচ্ছে গ্রীক ও আরবীতে লেখা একটি হুকুমনামা। সম্ভবতঃ ১৯০৯ সালে প্রথম রোজারের পত্নী এই আদেশ জারী করেন। মনে হয়, এ কাগজ সিসিলীতে উৎপাদিত হয় নাই সিসিলীর আরবরা প্রাচ্য দেশ হতে আমদানী করে।

প্রথম রোজার যে আরব-সিসিলীর মৈত্রীর সূচনা করেন, তার পূর্ণ বিকাশ দেখা যায় তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় রোজার (১১৩০-১১৫৪) এবং দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের মধ্যে। দ্বিতীয় রোজার মুসলমানের মত পোশাক পরতেন। তার সমালোচকরা তাকে বলত “আধা-বিধর্মী রাজা’। তার পোশাকে পূর্ণাঙ্গ আরবী সাজ-সজ্জার বৈশিষ্ট্য ছিল। এমনকি তাঁর পৌত্রের আমলেও একজন ভ্রমণকারী পালারমোর মহিলাগণকে মুসলিম পোশাক পরতে দেখে।

দ্বিতীয় রোজারের দরবারের প্রধান অলঙ্কার ছিলেন আল-ইদরিসী। সমস্ত মধ্যযুগের মধ্যে তাঁর মত কৃতী ভৌগোলিক ও মানচিত্রবিদ আর একজনও ছিলেন না। তার পুরানাম ছিল আরু আবদুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে মুহম্মদ আল ইদরিসী। ১১০০ সালে সিউটার এক স্পেনীয় আরব পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। দ্বিতীয় রোজারের পৃষ্ঠপোষকতায় পালারমো শহরে থেকে তিনি তার জীবনব্যাপী সাধনা করেন। তাঁর রোজারীয় গ্রন্থে তিনি টলেমী, আল-মাসুদী প্রমুখ ভৌগোলিকদের মতের সংক্ষিপ্ত সার দিয়েই তুষ্ট হন নাই; বরং যে সব লোক তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশে প্রেরিত হয়, তাদের প্রদত্ত মূল বিবরণের উপরই প্রধানতঃ নির্ভর করেন। এই সব তথ্যের তুলনমূলক আলোচনা ও বিশ্লেষণে তিনি দৃষ্টির অসামান্য প্রসারতা প্রদর্শন করেন এবং পৃথিবী যে গোল, তা’ এবং দ্রুপ বহু মৌলিক তত্ত্ব-জ্ঞানের পরিচয় দেন। তিনি নীলনদের উৎপত্তি স্থান নির্দেশ করেন, যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে এ তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ গ্রন্থ তাঁর এক অমর কীর্তি। এছাড়া তিনি তার নর্মান পৃষ্ঠপোষকের জন্য রূপ দিয়ে মহাশূন্যের একটি ম্যাপ ও পৃথিবীর একটি ম্যাপ তৈরী করেন। সিসিলীর দ্বিতীয় ‘খৃস্টান-সুলতান ছিলেন দ্বিতীয় রোজাবের পৌত্র হোহেনস্টফেনের দ্বিতীয় ফ্রেডারিক। তিনি সিসিলী ও জার্মানী উভয় দেশই শাসন করতেন। ১২২০ সালের পর তিনি পবিত্র রোমক সম্রাজ্যের অধিপতি’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং ব্রিয়েনের ইসাবেলাকে বিয়ে করে বায়তুল মোকাদ্দেসের রাজা হন। সুতরাং, ধর্মের বিষয়াদির বাইরে সম্রাট ফ্রেডারিক খৃস্টজগতের উচ্চতর ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এই বিয়ের তিন বছর পর তিনি এক ক্রুসেডে বের হন। এর ফলে ইসলামী আদর্শে তিনি আরো প্রভাবান্বিত হন।

ব্যক্তিগত ও সরকারী জীবনে ফ্রেডারিক অর্ধ-প্রাচ্যপন্থী ছিলেন। তিনি হেরেম প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দরবারে দীর্ঘ দাড়ি ও দোলায়মান পোশাক নিয়ে সিরিয়া ও বাগদাদের দার্শনিকরা বিরাজ করত, প্রাচ্যদেশ হতে নর্তকী বালিকা এসে হাজির হত, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় অঞ্চল হতে ইহুদীরা আসত। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্বন্ধ সূত্রে তিনি মুসলিম জগত-বিশেষতঃ মিসরের সুলতানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করে চলতেন। সূর্য কিরণে উটপাখীর আণ্ডা ফুটানোর পন্থা পরীক্ষা করার জন্য তিনি মিসর হতে বিশেষজ্ঞ আনেন। সিরিয়া হতে তিনি দক্ষ বাজপালক এনে উক্ত পাখীকে শিকার শিক্ষা দেওয়ার কাজ পর্যবেক্ষণ করেন এবং বাজের চোখ পরীক্ষা করে বুঝতে চেষ্টা করেন যে, বাজ কেবল গন্ধের সাহায্যে তার খাদ্য খুঁজে বের করতে পারে কিনা। থিওড়ো এনটিওক একজন জোকোবাইট খৃস্টান ছিলেন। তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র জানতেন এবং ফ্রেডারিকের দোভাষীর কাজ করতেন। সম্রাটের আদেশে তিনি বাজপাখী দ্বারা শিকার সম্বন্ধীয় বই লেখেন। এই-ই ছিল প্রকৃতির ইতিহাস বিষয়ক প্রথম আধুনিক পুস্তক। থিওডোরের আগে মাইকেল স্কট ফ্রেডারিকের দরবারের জ্যোতিষী ছিলেন। ১২২০ হতে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম-স্পেনের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বন্ধে তিনি বিশেষজ্ঞ বলে গণ্য হতেন। ম্রাটের জন্য স্কট আরবী হতে ইবনে সিনার ভাষ্য সম্বলিত আরাস্তুর শরীর-তত্ত্ব ও পশু-পাখী তত্ত্ব সম্বন্ধীয় বইয়ের অনুবাদ করে বইখানি সম্রাটের নামে উৎসর্গ করেন। এই অনুসন্ধান শৃহা এবং এই পরীক্ষামূলক নীতি ও গবেষণা ফ্রেডারিকের দরবারের বৈশিষ্ট্য ছিল আর এখান হতেই ইটালীর রেনেসার সূচনা হয়।

কিন্তু ফ্রেডারিকের একক মহত্তম অবদান ছিল তার নেপলস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা (১২২৪)। সুস্পষ্ট সনদ অনুসারে স্থাপিত এই-ই ছিল ইউরোপের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে তিনি সংগৃহীত বহু আরবী পাণ্ডুলিপি মওজুদ করেন। আরাস্তু ও ইবনে রুশদের গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য করেন। এই অনুবাদের কপি তিনি প্যারিস ও বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন। নেপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রদের অন্যতম ছিলেন টমাস একুইনাস। চতুর্দশ শতাব্দী হতে শুরু করে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্যারিস, অক্সফোর্ড প্রভৃতি ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী অধ্যয়নের ব্যবস্থা ছিল; কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ আলাদা–মুসলিম দেশসমূহের জন্য মিশনারী তৈরী করা।

সিসিলী দুই সাংস্কৃতিক অঞ্চলের মিলনভূমি হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় জ্ঞান আদান-প্রদানের এক অপূর্ব মাধ্যমে পরিণত হয়। এর বাসিন্দাদের মধ্যে কতক ছিল জাতিতে গ্রীক, তারা গ্রীক ভাষায় কথাবার্তা বলত; কিছুসংখ্যক ল্যাটিন জানা পণ্ডিত ছিল। এ তিনটি ভাষাই সরকারী কাগজে, রাজকীয় সনদে এবং পালারমোর জনসাধারণের কথা-বার্তায় ব্যবহৃত হত।

সিসিলীর নর্মান রাজারা তাদের পরবর্তীদেরসহ কেবল সিসিলী নয়, দক্ষিণ ইটালীও শাসন করতেন। এইরূপে সিসিলী হতে মুসলিম সংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণ সমগ্র ইটালী ও মধ্য ইউরোপে যাওয়ার জন্য তারা সেতু-বন্ধ স্বরূপ ছিলেন। দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত আল্পস পর্বতের উত্তর অঞ্চলে মুসলিম তমনের স্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। দান্তের পরলোক সম্বন্ধীয় ধারণা কোন নির্দিষ্ট আরবী বই থেকে না নেওয়া হতে পারে, কিন্তু একথা নিশ্চিতই মনে হয় যে, সে ধারণার মূল ছিল প্রাচ্য দেশে, যদিও কবি তা ইউরোপীয় লোক-কাহিনী হতে গ্রহণ করেন। প্রাচ্য দেশ হতে নানা পথে এই অনুপ্রবেশ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয় ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে। সিসিলী ও ইটালীর দক্ষিণ ভাগ খৃস্টান শাসনে চলে যাওয়ার বহুদিন পরেও মুসলিম কারিগর ও শিল্পীদের আদর ছিল। প্যালেটাইন চ্যাপেলে তাদের মোজাইক ও লিপি-শিল্পই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। পালারমো রাজপ্রাসাদে মুসলিম শাসকরা যে বিখ্যাত বয়ন-শিল্পাগার স্থাপন করেন, তা হতে উৎপন্ন সূক্ষ্ম কাপড় (আরবী লিপি-শিল্পের অলংকারসহ) ইউরোপীয় রাজপরিবারসমূহের পোশাকের অভাব পূরণ করত। প্রাচ্যে বোনা কাপড়ের চাহিদা এত প্রবল ছিল যে, তার অন্ততঃ এক প্রস্থ না থাকলে কোন ইউরোপীয় ভদ্রলোকই স্বস্তিবোধ করতেন না।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভেনিস অত্যন্ত ক্ষিপ্ততার সঙ্গে মুসলিম ফ্যাশন গ্রহণ ও চারদিকে বিস্তার করতে থাকে। এই সময় ইটালীর দফতরিখানায় বাধা এই আরবী চেহারা গ্রহণ করতে শুরু করে। আরব দফতরিদের বাঁধানো বইয়ে পাতার সামনের প্রান্ত রক্ষার জন্য ফ্ল্যাপ থাকত। খৃষ্টানদের বইয়ে এই ফ্ল্যাপসহ আরব বাঁধাইয়ে অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়। সেই সঙ্গে চামড়ার খাপ কারুকার্য খচিত করার বিদ্যাও ইটালীর বিভিন্ন শহরের মুসলিম কারিগরদের নিকট হতে শিক্ষা করা হয়। ভেনিস আরো একটি আরব-শিল্পের কেন্দ্র ছিল পিতলের উপর সোনা, রূপা অথবা লাল তামার কাজ। মুসলিম সংস্কৃতি বিস্তারে স্পেনের পরই সিসিলীর স্থান এবং ক্রুসেডের যুগে তার স্থান ছিল সিরিয়ার উপরে।

মুসলমানদের শেষ চিহ্ন যখন ইউরোপের বুক হতে মুছে যাচ্ছিল, তখন বাগদাদের খিলাফত ষড়যন্ত্র ও রক্তপাতের দরীয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছে। এর পরের অবস্থা কি হবে এবং কোন্ পথে সে নতুন অবস্থার আগমন ঘটবে, নবম শতাব্দীতে তুলুনিদ বংশের প্রতিষ্ঠায় তার আংশিক পরিচয় পূর্বাহ্নেই পাওয়া যায়। খিলাফতের বুকের মধ্যে যে তুর্করা বাসা বেঁধে এতকাল নীরব ছিল, এ বংশের প্রতিষ্ঠায় তাদেরই রাজনৈতিক আশা-আকাক্ষা দানা বেঁধে ওঠে। এরপর আরো শক্তিশালী তুর্ক বংশ রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়। খিলাফতের ধ্বংসের উপর যে সব রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তার মধ্যে আহমদ ইবনে তুলুন-এর রাজ্য অন্যতম। আহমদ ৮৬৮ সালে ক্ষমতা হস্তগত করেন। এইসব রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্বন্ধ সম্পূর্ণ রকমে ছিন্ন করে এবং কেবল নামেমাত্র বাগদাদের খলীফার আনুগত্য স্বীকার করতে থাকে। কোন উচ্চাভিলাসী অধীনস্থ কর্মচারী তার আপন বাহুবলে এবং গোলাম ও অনুচরদের সাহায্যে অমন বিরাট রাজ্যের বুকে কি করে সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে প্রভুত্ব স্থাপন করতে পারে, আহমদ তার প্রমাণ। কিন্তু যে রাজ্যের উপর তুলুনিদ ও দ্রুপ অন্যান্য বংশ শাসন-ক্ষমতা পরিচালন করত, সে রাজ্যের ভিতর তাদের জাতীয় ভিত্তি ছিল না। তাদের দুর্বলতার মূল ছিল, রাজ্যে তাদের স্বজাতীয় ঐক্যবদ্ধ কোন দলের সমর্থনের অভাব। শাসকরা ছিল অনধিকার প্রবেশকারী। তাদের দেহ রক্ষীরাই ছিল তাদের সৈন্য এবং এ দেহরক্ষীদের তারা বাইরের বিজাতীয়দের মধ্য হতে সংগ্রহ করত। কেবল অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকই এমন শাসন চালাতে পারে। এদের সবল বাহু দুর্বল হয়ে পড়া মাত্রই চারদিকে ভাঙ্গন শুরু হয়। ইবনে তুলুন যে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন, তা রাজ্যের চতুর্থ উত্তরাধিকারী তার পুত্রের আমলে ৯০৫ সালে আব্বাসীয় খলীফাদের হাতে ফিরে যায়।

আর একটি স্বতন্ত্র বংশ দুইশ’ বছরের উপর শাসন পরিচালনা করে এবং ইতিহাসে একটা পাতা যোগ করে। এদের দিকে এখন আমাদের মনোযোগ দিতে হয়। এ ছিল ফাতেমীয় খলীফাদের বংশ-মুসলিম-জগতে একমাত্র উল্লেখযোগ্য শীয়া খিলাফত। বাগদাদের খলীফারা মুসলিম-জগতের যে নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিল, তারই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ৯০৯ সালে তিউনিসে এর প্রতিষ্ঠা হয়। অল্পকাল মধ্যেই এরা মিসর ও সমগ্র উত্তর আফ্রিকার উপর আধিপত্য স্থাপন করে এবং তাদের অধীনে কায়রো শহর নব গৌরব মহিমায় উন্নীত হয়। কিন্তু সাময়িকভাবে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও এরা দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে নাই। নীলনদের যে পানি তীর ছাপিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত, তারই উপর বাসিন্দারা তাদের রুটির জন্য নির্ভরশীল ছিল; সুতরাং তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল একান্ত অনিশ্চিত। দুর্ভিক্ষ, প্লেগ ও খাজনা আদায়কারীদের অত্যাচার, ষড়যন্ত্র ও অনাচারের সেই পুরানো কাহিনী–সমস্ত মিলে ফাতেমীয়দের দুর্বল করে ফেলে। ক্রুসেডের আমলে ১১৭১ সালে বিশ্ব বিখ্যাত সালাহউদ্দীন এ খিলাফতের অবসান করেন।

রাজনৈতিক দিক হতে ফাতেমীয় বংশ মিসরে এক নতুন যুগের সূচনা করে। ফেরাউনদের পর মিসর এই প্রথম একটা সার্বভৌম এবং জীবন্ত শক্তির অধীশ্বর হয়। একজন পারসিক মিশনারী ১০৪৬–১০৪৯ সালে মিসরে ভ্রমণ করতে আসেন এবং উচ্চ প্রশংসাপূর্ণ একটি বিবরণ রেখে যান। খলীফার প্রসাদে ৩০ হাজার লোক থাকত; তার মধ্যে চাকর ছিল ১২ হাজার, অশ্বারোহী এবং পদাতিক ১০ হাজার। ভ্রমণকারী একদা এক উৎসব উপলক্ষে তরুণ খলীফাকে দেখেন। তিনি একটি খচ্চরের উপর সওয়ার ছিলেন। চেহারাটি সুন্দর দাড়ি ছাটা। পরনে কেবল একটি সাদা জামা আর পাগড়ী–তাঁর মাথার উপর প্রসারিত বহু মূল্য রত্ন খচিত ছত্র। রাজধানীতে খলীফার ২০ হাজার বাড়ী ছিল–বেশীর ভাগই ইটে তৈরী ও পাঁচ হতে ছয় তলা। তার দোকানও অনুরূপ সংখ্যক ছিল; প্রত্যেক দোকান মাসে দুই হতে দশ দিনার হারে ভাড়া দেওয়া হত। প্রধান রাস্তাগুলির ছাদ ও ছাদের নীচে বাতি ছিল। দোকানদাররা একদামে জিনিস বিক্রি করত। কোন দোকানদার গ্রাহককে ঠকালে তাকে উটে চড়িয়ে ঘন্টা বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরানো হত আর অপরাধী অনবরত তার অপরাধ স্বীকার করতে থাকত। এমন কি মনিকার ও বাট্টাদারদের দোকানও খোলা রেখে যাওয়া হত। সমস্ত দেশব্যাপী এমন নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি ভ্রমণকারীর নজরে পড়ে যে, তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, আমি এ দেশের ধন-সম্পদের কোন পরিমাণই করতে পারলাম না। আমি আর কোথাও এত সমৃদ্ধির নিদর্শন দেখি নাই।’

ফাতেমীয়রা যখন মিসর ও উত্তর আফ্রিকায় আধিপত্য বিস্তার করে, তখন বাগদাদের পুরানো সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন ধরে। সালজুক তুর্করা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এবং তুগরীল নমে তাদের একজনকে ১০৩৭ সালে রাজধানীতে শাসনকর্তা নিযুক্ত করে। নতুন নতুন তুর্কী উপজাতীয় কওমের লোক এসে এদের সৈন্যদল পুষ্ট করতে থাকে। সালজুকরা তাদের রাজ্যও চারদিকে বাড়াতে থাকে। আবার পশ্চিম এশিয়া এক সাম্রাজ্যে একীভূত হয় এবং ইসলামের বাহু বলের বিলীয়মান গৌরব ফিরে আসে। ইসলামের বিশ্ব-নেতৃত্বের সগ্রামে মধ্য এশিয়া হতে এক নতুন জাতি এসে রক্তের খেলায় মেতে ওঠে। এই বর্বর অবিশ্বাসীরা কি করে পয়গম্বরের অনুচরদের ঘাড়ে পা রাখে–আবার তাদেরই ধর্ম গ্রহণ করে সে ধর্মের একনিষ্ঠ রক্ষক হয়ে দাঁড়ায়, ইসলামের বিচিত্র ইতিহাস তার কাহিনী নতুন নয়। তাদেরই জ্ঞাতি এয়োদশ শতাব্দীর মঙ্গোলরা এবং তাদের অন্য জ্ঞাতি চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের ওসমানীয় তুর্করা তো এই একই কাজের পুনরাবৃত্তি করে। রাজনৈতিক ইসলামের সর্বাপেক্ষা দুর্দিনে ধর্মীয় ইসলাম তার কতিপয় শ্রেষ্ঠতম বিজয় অর্জন করে।

ইসলামের আসমানে সত্যি তখন ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। ১২১৬ সালে চেঙ্গীজ খ ষাট হাজার দুর্ধর্ষ মঙ্গোল যোদ্ধার এক ভয়াবহ বাহিনী নিয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অদ্ভুত ধনুক হাতে চারিদিকে ত্রাস সৃষ্টি আর নিষ্ঠুর ধ্বংসের আগুন জ্বালাতে বের হন। এদের হামলার তাণ্ডবে প্রাচ্য ইসলামের তামদুনিক কেন্দ্রগুলির অস্তিত্ব মুছে যায়; তাদের স্থান রয়ে যায় উষর নির্মম মরুভূমি; অথবা যেখানে ছিল মস্ত বড় বড় ইমারত ও কুতুবখানা, সেখানে পড়ে থাকে বিকট ধ্বংসস্তূপ। তাদের পেছনে লোহিত দাগ রেখে চলে বিশুষ্ক রক্ত প্রবাহ। হিরাটের ১ লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে বেঁচে যায় মাত্র ৪০ হাজার। বোখারার সুবিখ্যাত মসজিদগুলিকে বর্বররা তাদের ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে। বলখ ও সমরকন্দের বাসিন্দাদের অধিকাংশকে নির্মমভাবে হত্যা করে অবশিষ্টদের বন্দী করে নেয়। খাওয়ারিজমকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। শীঘ্রই বাগদাদের পালা আসে। বোখারা দখল করে নাকি চেঙ্গীজ খ ঘোষণা করেন : আমি আল্লাহর গজব, পাপীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি। যে লোকদের তিনি পরিচালন করেন, তারা ব্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চীন হতে আদ্রিয়াতিক পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগ ওলোট পালোট করে তোলে। রাশীয়া আংশিকভাবে অধিকৃত হয় এবং তারা মধ্য ইউরোপের পূর্ব শীয়া পর্যন্ত প্রবেশ করে। ১২৪১ সালে চেঙ্গীজ খাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারীর মৃত্যু হয় বলে পশ্চিম ইউরোপ মঙ্গোল হামলাকারীদের হাত হতে বেঁচে যায়। কিন্তু বাগদাদের রেহাই ছিল না।

হালাকু খাঁ ছিলেন চেঙ্গীজ খাঁর অন্যতম পৌত্র। ১২৫৩ সালে এক বিপুল বাহিনীসহ হালাকু খিলাফত ধ্বংসের জন্য মঙ্গোলীয়া হতে নির্গত হন। এমনিভাবে মঙ্গোল যাযাবরদের দ্বিতীয় তরঙ্গ এগিয়ে আসতে থাকে। বাগদাদ সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ হতে যে সব ছোট ছোট রাজ্য মাথা তুলে উঠেছিল, হালাকুর সৈন্য প্রবাহে তাদের সবগুলি ভেসে যায় । ১২৫৮ সালের জানুয়ারী মাসে হালাকুর দুর্বার মঙ্গোল তরঙ্গ বাগদাদের প্রাচীরে প্রাচীরে ভেঙ্গে পড়ে। রাজধানীর দেয়াল সে তরঙ্গের অভিঘাত সইতে পারে না; ভগ্নপথে মঙ্গোল প্রবাহ প্রবেশ করে সমস্ত বাধা-বিঘ্ন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হালাকুর একজন খৃস্টান স্ত্রী ছিল; সেই ভরসায় খলীফার উজীর নেস্টোরীয়ান ধর্মযাজককে সঙ্গে নিয়ে হালাকুর শিবির দুয়ারে পৌঁছে সন্ধির শর্ত জিজ্ঞাসা করে পাঠান। কিন্তু হালাকু তাকে সাক্ষাত দান করতে রাজী হন নাই। কেউ কেউ গিয়ে হুঁশিয়ারীর বাণী উচ্চারণ করে বলেন : বাগদাদ শান্তির শহর। অতীতে এ শহর যারা আক্রমণ কিংবা আব্বাসীয় খিলাফত ধ্বংস করতে এসেছে, তারা নিপাত গিয়েছে। কিন্তু হালাকুর মনে ভয়ের রেখাপাত মাত্র হয় না। কেউ কেউ গিয়ে বলে–খলীফাকে হত্যা করলে সমস্ত বিশ্বে বিপ্লব শুরু হবে; সূর্য তার মুখ লুকাবে, বৃষ্টিপাত থেমে যাবে, গাছ-পালার জন্ম বন্ধ হবে। কিন্তু হালাকুর সাথে জ্যোতিষী ছিল এবং তাঁরা তাঁকে জয়ের পক্ষে নিশ্চয়তার পরামর্শ দেয়। হালাকু অবিচলিত থাকেন। দশই ফেব্রুয়ারী তক তার বর্বর অনুচরেরা শহর ভরে ফেলে। হতভাগ্য খলীফা তার তিনশ’ সভাসদসহ এসে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেন। দশ দিন পর তাঁদের সবাইকে হত্যা করা হয়। শহর আগুন আর লুণ্ঠনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। খলীফার পরিবারের লোকজনসহ বেশীর ভাগ বাসিন্দাকেই কতল করা হয়। পথের পাশে পাশে লাশ পচে গলে যায়; তার দুর্গন্ধে হালাকু কয়েক দিনের জন্য শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। বাগদাদে তাঁর বাস করার ইচ্ছা ছিল বলে অন্যান্য বিজিত শহরের মত বাগদাদকে ধ্বংসতূপে পরিণত করা হয় নাই। নেক্টোরীয়ান যাজক-পতি বিশেষ ভাষার অনুশীলন, অনুগ্রহ পান। কয়েকটি মসজিদ এবং মদ্রাসা বেঁচে যায় বা পুনর্নির্মিত হয়। জুমার নামাজে যার নামে খোতবা পড়া চলে, এমন খলিফার অভাব মুসলিম জগতে এই প্রথম দেখা দেয়।

১২৬০ সালে হালাকু উত্তর সিরিয়া আক্রমণে উদ্যত হন। এখানে তিনি হামা, হারিম ও আলেপ্পো দখল করেন। শেষোক্ত শহরে ৫০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়। ইতিমধ্যে তার ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ আসে। কাজেই দামেস্ক বিজয়ের জন্য সৈন্য পাঠিয়ে তিনি পারস্যে ফিরে আসেন। তাঁর ফেলে-আসা সৈন্যরা দামেস্ক অধিকার করে। কিন্তু তারপর ১২৬০ সালে নাজারেথের নিকট তারা বায়বার্সের হাতে বিধ্বস্ত হয়। বায়বার্স আরব জগতের শেষ উল্লেখযোগ্য বংশ মামলুকদের কৃতী সেনাপতি ছিলেন।

হালাকুই প্রথম ইল-খান উপাধি গ্রহণ করেন ১৯৬৫ সালে তাঁর মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে হযরত মুহম্মদের (সঃ) ধর্ম আবার এক মহোজ্জ্বল বিজয় লাভ করে : সপ্তম খান ইসলামকে রাষ্ট্রের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন। যেমন মামলুকদের বেলায়, তেমনি মঙ্গোলদের বেলায় মুসলমানদের বাহুবল যেখানে পরাজয় মানে, ইসলাম সেখানে জয়লাভ করে।

ইতিমধ্যে দূর পশ্চিম প্রান্তে ইসলাম আর এক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। এ সঙ্কটের ফলে আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় পৃষ্ঠা যুক্ত হয় এবং ইসলামের এক মহত্তম সেনানী ও বন্ধুর আবির্ভাব ঘটে। এ ছিল ক্রুসেড-আর সালাহউদ্দীনের যুগ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *