১৬. আকাশটা লাল

বাবর চোখ খুলে দেখে আকাশটা লাল হয়ে উঠছে। আরাম চেয়ারে শুয়ে ঘাড়টা ব্যথা করছে তার। পাশে তাকিয়ে দেখে, জাহেদা। তখন বুঝল জাহেদা তার ঘুম ভাঙ্গিয়েছে। দুপুরের পোশাকটা পালটে শাদা জামা পাজামা পরেছে। তাতে কালো বর্ডার দেয়া। চুল পিঠের পরে ছেড়ে দেয়া, কাঁধের নিচে ডোল হয়ে আছে।

বাবর হাসল।

যান, মুখ ধুয়ে নিন। চা আনতে বলেছি।

বাথরুমে এসে দেখল জাহেদার পাজামা ঝুলছে হুক থেকে। স্তম্ভিত নিঃশ্বাসে সে একবার তাকিয়ে দেখল, তারপর কম্পিত হাতে স্পর্শ করে রইল ঠিক যেখানে জাহেদার রাজহাঁসটা লুকিয়ে থাকে। জাহেদা যখন হেঁটে যায় তখন পেছনটা দেখায় ঐ রকম। সুতোর, মাড়ের, সাবানের, সুগন্ধের স্তব্ধ উষ্ণ একটা অনুভব। পাজামাটা আবার ঝুলিয়ে রেখে মুখ ধুল বাবর। মুখ মুছল জাহেদার তোয়ালে দিয়ে। টাক ঢেকে সিথি করে জাহেদার স্প্রে ব্যবহার করল।

বেরিয়ে দেখে চা নিয়ে বসে আছে জাহেদা।

বাবর বলল, ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখলাম এখন।

জাহেদা হেসে বলল, আপনি জেগেও স্বপ্ন দেখেন নাকি?

হ্যাঁ দেখি। এই যে তুমি, আমি, কোথাকার কোন রংপুরের ডাকবাংলো, এই চা খাচ্ছি, এটা স্বপ্ন নয়?

আবার বক্তৃতা।

আমার অভ্যাস। বাবর হেসে ফেলল।

এটা তো টিভি নয় যে বক্তৃতা দিলে পয়সা পাবেন।

যা পাচ্ছি সেটা টাকার চেয়ে বড়।

কথা ঠিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক জায়গায় আনতে আপনার দ্বিতীয় নেই।

নিঃশব্দ হাসিতে উজ্জ্বল হলো বাবর। দরোজায় টোকা পড়লে চমকে তাকাল। দরোজা খুলে দেখল, প্রণব বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে টুক টুক করছে পান। হাতে চুন লাগান বোটা। দেখা হতেই চিবুক তুলে, যাতে রস গড়িয়ে না পড়ে, বললেন, বিশ্রাম হলো? হলো। আসুন। জাহেদা, এই প্রণব বাবু।

প্রণব বাবু নমস্কার করলেন।

চলুন তাহলে, আপনাদের জন্যে ব্যবস্থা করে এলাম।

ব্যবস্থা মানে?

এই একটু লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করবেন। কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যানুরাগী সংস্কৃতিমনা ভদ্রলোককে খবর দিয়েছি। ওরা সবাই পাবলিক লাইব্রেরীতে আসবেন। পাশে বহুদিনের গৌরবময় রংপুর সাহিত্য পরিষদ আছে সেটাও এক নজর দেখে নেবেন। ব্যস।

করেছেন কী? বাবর চোরচোখে জাহেদার দিকে তাকাল।

প্রণব বাবু জাহেদার দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝেছেন দিদি, কোনো রকমে সংস্কৃতির সলতে টিমটিম করে জ্বালিয়ে রাখা যাচ্ছে, রংপুরেব সেদিন নেই, সেই মানুষও নেই, তবু কয়েকজন আছেন, বিশেষ উৎসাহী, একেবারে নিবেদিত প্ৰাণ। ঢাকা থেকে এসেছেন, তাদের সঙ্গে আলাপ করে না গেলে মনে বড় ব্যথা পাবেন তারা। ন খলু ন খলু বানঃ সন্নিপাতোহয়মস্মিন মৃদুনি মৃগ-শরীরে তুলরাশবিবাগ্নিঃ। শেষাংশে সংস্কৃতটুকু তিনি বাবরের উদ্দেশে বললেন।

একে ঐ রকম বাংলা তার ওপর সংস্কৃত, বাবর যার একবর্ণ নিজেও বোঝে না, শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল জাহেদা। বাবর নিজে তার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে। বাংলা কখনো বললে তার কঠিন শব্দটা সঙ্গে সঙ্গে তর্জমা করে দেয়। প্রণব বাবু তা দুঙ্গীনবেন কোত্থেকে? তিনি ভেবেছেন, জলের মত স্বচ্ছ তরল তার বাংলা না বোঝার কী আছে? জাহেদাকে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে বাচাল বাবর। বলল, চলুন তবে বেরোই। চল জাহেদা।

বেরিয়ে এক ফাঁকে জাহেদার কানে কানে সে বলল, চুপচাপ থাকবে। বোঝার ভাণ করবে। আর তোমাকে আমার বোন বলেছি। ওঁর বাসায় খেতে যেতে হবে কিন্তু।

ডাকবাংলো থেকে বেরিয়ে অল্প একটু গেলেই রাস্তার ওপারে পাবলিক লাইব্রেরী। সমুখে মস্ত মাঠ। আঁধারে ঢেকে আছে এখন। ভুতের মত এক আধটা লোক চলাচল করছে। খোলা দরোজায় লালচে আলো পর্দার মত ঝুলে আছে। মাঠের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল ওরা। মুর্খানে একূটা বাঁধান বেদির ওপরে খুঁড়ে পাওয়া প্রাচীন কোনো দেবীমূর্তি যেন সন্ধ্যা শাসন করছে। প্রণব বাবু অনর্গল বলে চলেছেন রংপুরের ইতিহাস, এই লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস–এখানকার প্রতিটি বস্তু এবং মানুষের ইতিহাস যেন তার নখদর্পণে।

বারান্দায় দেখা গেল। কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। প্রণব বাবু তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন বাবরের। ভেতরে সে দেখতে পেল শাদা চাদরে ঢাকা একটা টেবিল, তার মাঝখানে স্নিগ্ধ ফুলের স্তবক, সমুখে কিছু ভাঁজ খোলা চেয়ার। প্রণব বাবু আজ না ড়ুবিয়ে ছাড়বেন। না। এযে একেবারে একটা সভার আয়োজন। বাবর একটু সন্ত্রস্ত একটু সংকুচিত বোধ করল। পাগলের পাল্লায় পড়া বোধহয় একেই বলে।

প্রণব বাবু বললেন, আরো কিছু সুধী আসবেন, এই এসে পড়লেন বলে, চলুন ততক্ষণে সাহিত্য পরিষদটা ঘুরে আসি। জাহেদাকে বললেন, দিদি, একটু অন্ধকার বটে সাবধানে পা ফেলবেন।

বাবর পকেট থেকে মিনিলাইটটা বের করল। সেদিন কেনার পর আজ এই প্ৰথম ব্যবহাব হচ্ছে। মাকড়শা জালের মত ফিনফিনে একটা আলো পড়ল ঘাসের ওপব। জাহেদার হাতে দিয়ে বলল, এটা তোমার কাছে রাখ।

ছোট্ট, ঠাণ্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে, পরতের পর পরত ধুলো জমা, স্বল্পালোকিত একটা ঘর। মিটমিট করে বাতি জ্বলছে মাথার ওপর। এই সাহিত্য পরিষদ। দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে চারদিকে রাখা সব প্রাচীন মূর্তি মূর্তির ভগ্নাংশ। স্তুপ স্তুপ পুঁথি। একহাঁটু ধুলো তার ওপর। ন্যাকড়া দিয়ে জড়ান কোনোটা। কোনোটায় কাঠের পিড়ি দিয়ে মলাট।

এত পুঁথি এখানে? বিস্ময়ে প্রায় শিষ দিয়ে উঠল বাবর। এবং পরীক্ষণে চৈতন্য হলো তার, শিষটা স্থানোপযোগী হলো না।

কে একজন জবাব দিলেন, আরো বহু পুঁথি ছিল, কিছু নষ্ট হয়েছে, কিছু হারিয়ে গেছে। বহুদিনের বহুকালের সংগ্রহ এসব

দেখতে লাগল বাবর। হঠাৎ দেখে পাশে জাহেদা নেই। ঘরের মাঝখানে প্রশস্ত তাকের জন্য ওপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল ঝর্ণার মত অবিরল প্রণব বাবুর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। কান খাড়া করে বাবর টের পেল, জাহেদাকে তিনি একেকটা সংগ্রহের পরিচয়, ইতিহাস ইত্যাদি বলে চলেছেন। আস্তে আস্তে কাছে গেল বাবর। তার সঙ্গে যারা ছিল তারাও অনুসরণ করলেন। বাবর দেখল একটা ভাঙ্গা বিষ্ণু মূর্তি নত হয়ে দেখছে জাহেদা সেই মিনিলাইট জ্বালিয়ে। সমস্ত পেছনটাকে একটা বিরাট বলের মত মনে হচ্ছে। প্রায় স্পর্শ করে রয়েছে দুই হাঁটু। ফলে চমৎকার একটি জীবন্ত ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। বাবর তার সঙ্গীদের দিকে একবার দেখল। এবং তার ভেতরে একটা তীব্র ইচ্ছে লাফিয়ে উঠল এই বাঁঝাল ধুলি গন্ধ স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে জাহেদাকে পেতে, তার শাদা ঐ পোশাকটার ভেতর থেকে শরীরটাকে জন্মদিনের চিঠির মত খুলে ফেলতে। সে টোকা দিল জাহেদার পিঠে।

কী দেখছ?

প্ৰায় পলকে লাফিয়ে সোজা হলো জাহেদা। বলল, দেখছিলাম।

প্রণব বাবু বললেন, আরো দেখুন দিদি, এই যে পেতলের ধুপপাত্র দেখছেন এটি ডিমলার মহারাজা দান করেছিলেন। অতি প্ৰাচীন বস্তুটি। অনুমান করা হয রাজা রামপালের সময়ের। সম্ভবত এই পাত্র দেবীর আরাধনাকালে ব্যবহার করা হতো। দেবদাসীরা নৃত্য করতেন এই ধুপপাত্র কোমল লীলায়িত হস্তে ধারণ করে।

জাহেদা বলল, আই সি।

বাবর তাকে সাততাড়াতাড়ি বলল, জাহেদা, তোমাকে আমি রামপালের কাটা দীঘি রামসাগর, বলেছি না?

বলতে বলতে তাকে নিয়ে বাইরে এলো সে। প্রণব বাবু বলল, চলুন লাইব্রেরিতে যাই। বোধহয় সবাই এসে গেছেন।

আরো কয়েকজন এসে পৌঁছেছেন। দলটা বেশ ভারি হয়ে উঠেছে। জনা ত্ৰিশ পঁয়ত্রিশ হবেন। প্রণব বাবু হাত ধরে বাবরকে ভাল চেয়ারটায় বসালেন। জাহেদাকে বললেন, বসতে আজ্ঞা হোক দিদি। তারপর করজোড়ে সবাইকে উদ্দেশ করে নিবেদন করলেন, আপনারা আসন গ্রহণ করুন। এটা কোনো বিধিবদ্ধ সভা নয়, সংবর্ধনা হিসেবেও এ আয়োজন অতি সামান্য, আমরা সম্মানিত অতিথির সঙ্গে আলাপ করবার মানসে মিলিত হয়েছি। তার মত মহৎ একজন সংস্কৃতিসেবীর কাছ থেকে দুচার কথা শুনে। ধন্য হব। সুধীবৃন্দ, আপনারা আসন গ্ৰহণ করুন।

শিশুর মত কৌতূহল নিয়ে জাহেদা তাকিয়ে রইল। বারান্দায় যারা ছিলেন তাঁরা এসে বসলেন। তরুণেরা প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধদের জন্যে সমুখের আসনগুলো ছেড়ে দিল। বাইরে পেয়ালা পিরীচের শব্দ হতে লাগল টুং টাং। বাবর বুঝল, চায়ের ব্যবস্থাও হয়েছে।

প্রণব বাবু একটু থেমে গলা পরিষ্কার করে বলে চলেছেন, অলমতিবিস্তরেণ। সুদূর রাজধানী ঢাকা থেকে আমাদের এই নগণ্য শহরে বাবর আলী সাহেব তাঁর সহোদরাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। আমরা তাঁর সান্নিধ্যলাভের এই সহসা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চাইনি বলেই এই মিলন-সভার আয়োজন। সম্মানিত অতিথির পরিচয় নিষ্প্রয়োজন। দেশের এই ক্রান্তিকালে নিঃশব্দ দীপাবর্তিকার মত যে কয়জন সংস্কৃতিসেবী এ দেশের অন্ধকারে আলো দিয়ে চলেছেন ইনি তাদেরই একজন।

জাহেদা প্রশ্ন-চোখে বাবরের দিকে তাকাল। একবৰ্ণ সে বুঝতে পারছে না। বাবর তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল এবং আবার হাতের দশ আঙুল ডগায় ডগায় ছুঁইয়ে একটা শোভন ভঙ্গি ধারণ করে অবনত মস্তকে বসে রইল।

প্রণব বাবু বলছেন, ইনি যখন যেখানে অবস্থান করেন সংস্কৃতির একটা সুবাতাস সেখানে প্রবাহিত হয়ে যায়। আমরা আজ এই মহতী সন্ধ্যায় যে যার কাজ ফেলে ক্ষণকালের জন্যে হলেও এই সুফলা শস্যশ্যামলা স্বদেশের সাহিত্য-শিল্প সংস্কৃতির দিকে যে মনঃসংযোগ করেছি তা এই বাবর আলী সাহেবের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে, সম্মোহনে। বন্ধুগণ, কিমত্ৰ চিত্ৰং যদি বিশাখে শশাঙ্কলেখামনুবৰ্ত্ততে?–অর্থাৎ বিশাখা তারা দুটি যে সর্বদাই চন্দ্রের অনুকরণ করবে, অনুসরণ করবে, এত আশ্চর্যের কী আছে? প্রণব বাবু স্নিগ্ধ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে সস্নেহে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে আনলেন। তারপর বললেন, ইনি একজন সুনিপুণ বক্তা। এর বক্তৃতার অনায়াস ভঙ্গি, যুক্তির অপূর্ব ঋজুতা—

জাহেদা বলল, কী বলছেন উনি?

বাবর নীরবে হাসল এবং শুনতে পেল তাকে এবার প্রবন্ধকার, সমালোচক, দার্শনিক ইত্যাদি একের পর এক বলা হচ্ছে। অভিভূতের মত তাকিয়ে আছে জাহেদা। একাগ্র হয়ে প্রণব বাবুর বক্তৃতা শুনছে উপস্থিত সকলে। মাথার ওপরে জ্বলছে কড়া শাদা আলো। চারদিকের আলমারিতে সার সার বই, নীল সবুজ হলুদ কাপড়ে বাঁধান, ক্রমিক সংখ্যার টিকিট সাটা। একটা টিকটিকি কাচের ওপর পেট চেপে স্থির হয়ে আছে।

বাবরের হঠাৎ কথাটা মনে হলো। ফিসফিস করে হেসে বলল, জাহেদা, তখন স্বপ্ন আর বাস্তবের কথা বলছিলাম।

জাহেদা মাথা ঝুঁকিয়ে নীরবে সায় দিল।

স্বপ্ন থেকে বাস্তবের কোনো তফাৎ নেই। বাবর নিচু গলায় বলে চলল, একটা বাঘ মনে কর হরিণকে দেখতে পেয়েছে। সে স্বপ্ন দেখল ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার ওপর, এবং তক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। দুয়ের মধ্যে এক পলেরও কম ব্যবধান। আসলে স্বপ্ন হচ্ছে ভবিষ্যৎ। কিন্তু ভবিষ্যৎ আসলে বর্তমানেরই সম্প্রসারণ।

বাবর থেমে থেমে বলছিল এবং ফাঁকে ফাঁকে সভার দিকেও তাকাচ্ছিল। এক সময়ে দেখল সভার ভেতর থেকে একজন উঠে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কার্যাবলীর বর্ণনা দিতে শুরু করলেন। বক্তা অত্যন্ত আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বর্ণনা করে চলেছেন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কী কী বাঁধার সম্মুখীন তারা প্রতিনিয়তই হন। একটা টুকরো কানে এলো এখন বাবরের—

রবীন্দ্র-বিরোধী দল এখানেও বেশ ভারি। এবং তাদের অনেকেই আমাদের মুরুকিব। মফঃস্বলে অসুবিধা এই মুরুব্বিদের বিরোধিতা প্রকাশ্যে করা যায় না। এখানে সবাই আমাদের বাবা-চাচা কিংবা বাবা-চাচার মত। বাবা-চাচার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারপর ধরুন— বর্ষা। সেবার বর্ষ উপলক্ষে আমরা একটি গান ও কবিতার আসর করতে চেয়েছিলাম। সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলেন, আমরা হিন্দু হয়ে গেছি। বর্ষার গানের আসর করলে যদি সেই হিন্দু হয়ে যায়, তাহলে ঈদের নামাজ পড়লেই মুসলমান তাকে বলতে হবে?

সহাস্য দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন সবাই।

বক্তার কণ্ঠ আবেগে আরো ঘন হয়ে উঠল।

জাহেদা জিগ্যেস করল চাপা গলায়, তখন কী একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন বলছিলেন।

হ্যাঁ।

দেখেছিলাম, মিসেস নাফিস, তাকে চেনো? না, তুমি চিনবে না। তাকে দেখি ঢাকার রাস্তা দিয়ে এক ষাঁড়ের পিঠে চড়ে যাচ্ছেন। সম্পূর্ণ উলংগ। কিন্তু সেটাই যেন স্বাভাবিক। কেউ ফিরেও দেখছে না। যে যার মত চলে যাচ্ছে।

লজ্জায় মাথা নিচু করল জাহেদা।

বাবর তখন বলল, বাংলা ভাল বোঝা না বোঝা শোনার ভাণ করে যাও।

এবারে শোনা গেল, বক্তা বলছেন, এই কথাগুলো আমাদের প্রিয় বাবর সাহেবকে বললাম, তিনি যেন ঢাকায় গিয়ে সমস্ত শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীকে জানিয়ে দেন।

আমার আর কিছু বলার নাই। প্রণব বাবু বললেন, আমরা স্থানীয় তরুণ কবি, আমাদের পরম স্নেহভাজন আকসাদ মোল্লার কথা শুনলাম। এবার বাবর সাহেব আপনি কিছু বলুন।

বাবর সলজ্জ হেসে বলল, বলতেই হবে?

কিছু না বললে, এরা সবাই এসেছেন, বলুন কিছু।

বাবর উঠে দাঁড়াল। সবার দিকে দেখে মুখ নিচু করল একবার। সত্যি বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক মুহূর্ত পর তার চিরকালের যে অভ্যোস ঝুঁকির মধ্যে বাস করা, সেই অভ্যেসের বশে কিছু না ভেবেই শুরু করল এবং বলতে বলতে নিজেই আরেকবার চমৎকৃত হলো নিজের গুণে, চমৎকৃত হলো কথার পিঠে কথা কী স্বচ্ছন্দভাবে এসে যাচ্ছে বলে।

সে বলতে লাগল, বন্ধুগণ! প্রণব বাবু আসলে একটি পরকলা। ছোট জিনিস বড় দেখায় তার কল্যাণে। নইলে আমার মত মানুষকে যে সমস্ত বিশেষণে তিনি সম্মানিত করেছেন, তার একটিও শাদা চোখে দেখা যেত না। মানুষকে, কোনো মানুষকে এই যে আপন করে নেবার অসাধারণ ক্ষমতা, তার এবং আপনাদের সবার, এর একটা বিশেষ মূল্য আছে। এটা প্ৰাণের পরিচয় বহন করে। নির্মল প্ৰাণ, স্বচ্ছন্দ প্ৰাণ, সংবেদী প্ৰাণ। আমি বলি, সবার ওপরে এই প্ৰাণের স্থান। এই প্ৰাণের অনুমতি নিয়ে, এই প্ৰাণের অন্তর্নিহিত শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে, এই প্ৰাণের প্রেরণায়, যারা যা কিছু করেন তাই সত্য, তাই সুন্দর, তাই কল্যাণ। মনের ভাষা আমরা সবাই শুনতে পারি না। আপনাবা শুনছেন। তাই আপনারা আমার চিরকালের প্রিয় হয়ে রইলেন। আজকের এই সন্ধ্যার স্মৃতি আমি আমৃত্যু বহন করব। এবং হ্যাঁ আপনাদের ক্ষোভ, আপনাদের এই প্রতিরোধের সংবাদ আমি ঢাকার শিল্পী সাহিত্যিকদের কাছে পৌঁছে দিব। আপনাদের রংপুরের ছেলে সৈয়দ শামসুল হক, টেলিভিশনে প্রায়ই আসেন, আমি তাকে বিশেষ করে বলব। ধন্যবাদ।

একজন তরুণ উঠে দাঁড়াল। বলল, তাঁকে বলবেন সিনেমার জন্যে লিখে, টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করে যেন নিজেকে নষ্ট না করেন। আমাদের দাবি আছে তাঁর ওপরে।

বাবল বলল, আমি যতদূর জানি, সেটা তার জীবিকা। তিনি তো লিখছেন। অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা এসব করেও তো লোকে লেখে।

আরেকজন উঠে দাঁড়াল। হাত নেড়ে বলল সে, হক সাহেবকে বলবেন তিনি যেন ব্যক্তির কথা না লিখে সমাজের কথা লেখেন! আমরা বেঁচে থাকতে চাই, আমরা সংগ্ৰাম করছি সে নিয়ে তাকে উপন্যাস লিখতে বলবেন।

আচ্ছা বলব।

আরো একজন উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, তাকে বলবেন গোর্কির মার মত উপন্যাস কেন হচ্ছে না? নাজিম হিকমতের মত কবিতা কেন বেরুচ্ছে না? আমরা জানতে চাই।

নিশ্চয় বলব। আমি জানতাম না। তিনি জীবনের কথা লেখেন না।

তাঁকে লিখতে বলবেন।

সভা শান্ত হলো। চা এলো, সন্দেশ এলো। সভা শেষে হাঁটতে হাঁটতে সবাই বাবর জাহেদার সঙ্গে ডাকবাংলো পর্যন্ত এলো। তারপর বিদায় নিল একে একে। সবাই অনুরোধ করল আরো একদিন থেকে যাবার জন্য। না, কালই বেরুবে বাবর। অনেকেই বাসায় ডাকলেন, অনুগ্রহ করে চাট্টি খাবেন। অনেক ধন্যবাদ, প্রণব বাবুর বাড়ি আপনাদের সবারই বাড়ি, সেখানে আতিথ্য স্বীকার করেছি, মনে করব আপনাদের সবার প্রতিনিধি তিনি।

প্রণব বাবু বললেন, চলুন তবে, রাত হয়ে গেল।

করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।

বাবর জাহেদাকে বলল, চল, খেয়ে আসি।

গাড়ি করে বেরুল ওরা। শীতের মফঃস্বল। হিম হিম হাওয়া বইছে। ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করছে। সারা শহর। এখানে ওখানে বাতি জ্বলছে, গান হচ্ছে কোথাও লাউড স্পীকারে, চাদর মুড়ি দিয়ে রিকশা চালাচ্ছে রিকশাওয়ালা। বড় রাস্তা থেকে বাঁয়ে কেটে একেবারে অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে পড়ল ওরা। পেছনে প্রণব বাবু। সামনে জাহেদা। বাবর জাহেদার আঙুল স্পর্শ করল একবার। বরফের মত ঠাণ্ডা।

এইবার ডানে, ডানে যান মশাই। এই ডাইনে।

অন্ধকার গলিটাতে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে লাগল বাবর। জাহেদা বলল, এত চুপচাপ আর অন্ধকার কেন?

পেছন থেকে হাসলেন প্রণব বাবু।

দিদি, এ যে মফঃস্বল। এই যে এলাকাটা দেখছেন পঞ্চাশ বছর আগেও এখানে বাঘ টাঘ দেখা যেত। বাবর সাহেব, যদি একটু কষ্ট করেন, এই সামনেই, দেবী সিংহের দরবার যেখানে ছিল দেখিয়ে আনি?

এই রাতে? থাক।

এখন অবশ্য নেই কিছু। শুধু ফাঁকা মাঠ। তবু দেখতেন। একবার কী হলো জানেন, কলকাতা থেকে তিন ইংরেজ কাপ্তান পাঠানো হয়েছে দেবী সিংকে গ্রেফতার করতে। দেবী সিংহ খবর পেয়ে এক হাজার সেপাই নিয়ে দরবার জাঁকিয়ে হুঁকোর নল হাতে করে গদিতে গদিয়ান হয়ে বসলেন।

দেবী সিং কে? জাহেদা জিগ্যেস করল।

প্রণব বাবু বাবর আর জাহেদার মাঝখানে মাথা এগিয়ে বললেন, দেবী সিং? সে এক নররূপী রাক্ষস। রক্ষসের তবু ক্ষুধার তৃপ্তি আছে, তার ছিল না। তার অত্যাচারে প্রজাকুল জর্জরিত হয়ে উঠেছিল। বাবর সাহেব জানেন না বোধহয়, এই রংপুরেই প্রথম কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। ব্যাস, এই আমার বাড়ি মশাই, এইখানে রাখুন।

দরোজা খুলে চটি ফটফট করে এগিয়ে গেলেন পুরনো খোয়া ওঠা বিশাল দুটো থামের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ডাকলেন, কইরে, রামটহল ব্যাটা কুম্ভকর্ণ। ওঠ, ওঠ। লণ্ঠনটা ধর। এই যে আসুন, সাবধানে, সিঁড়ির একটা দিক ভাঙ্গা আছে।

ভেতরের আঙিনায় গিয়ে পড়ল ওরা। বিশাল উঠান। চারদিকে চাকমিলানো ঘর। সব ঘরের দরোজা বন্ধ। অন্ধকার। ভূতুড়ে বাড়ির মত মনে হয়। মনে হয় যারা ছিল তাদের কথাবার্তা নিঃশ্বাস এখনো গমগম করছে।

প্ৰদীপ হাতে এক তরুণী কোথা থেকে বেরিয়ে এসে বলল, নমস্কার।

এটা হচ্ছে সুষমা।

চৌকো শ্যামল মুখ। চোখে ঘুম জড়ান। মিষ্টি হেসে বলল, আসুন।

সব তৈরি তো সুষি? প্রণব বাবু জিগ্যেস করলেন।

কখন সব করে রেখেছি। কাকা, তুমি ওঁদের বসতে দাও। আমি এক্ষুণি আসছি।

চলে যেতে যেতে সুষমা জাহেদার দিকে তাকিয়ে আবার হাসলেন। নির্মল কিন্তু করুণ একখণ্ড হাসি। চোখে লেগে রইল বাবরের।

প্রণব বাবু বললেন, আমার এক আশ্রিত পরিবার, তাদের মেয়ে। আমার কেউ না। আমার দেখাশোনাটা হয়ে যায়, বাড়িটাও খালি থাকে না। এই আর কী।

ভেতরে গিয়ে বসল। ওরা। একদিকে বিরাট একটা খাট–ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠের মত। এতবড় বিছানা এর আগে কখনো বাবর দেখেনি। জাহেদা বলে উঠল, মাই গুডনেস।

আগাগোড়া নিভাঁজ চাদর। একজোড়া বালিশ। তিনটে কোলবালিশ মুখখোলা নিখুঁত একটি আয়তক্ষেত্র সৃষ্টি করে আছে মাঝখানে। বিশাল মশারির মুখটা থিয়েটারের পর্দার মত দুদিক থেকে তোলা। ঘরের আরেক দিকে প্রণব বাবু লেখাপড়া করেন। সুন্দর করে সাজান টেবিল। পুরনো কাচের আলমারি। ভারি ভারি কাসার তৈজসপত্র। দেয়ালে বাধান স্বামী বিবেকানন্দ। আরেক দিকে জিন্নাহ সাহেবের ঐঙ্গিন একটা ছবি! একটা পুরনো ঢাল ঝুলছে। খোলা জানালায় স্তিমিত হয়ে আছে অন্ধকার। দুটো গোল পাথরের টেলিল ঘরের মাঝখানে এনে খাড়া পিঠ চেয়ার টেনে প্রণব বাবু বললেন, আসন নিন।

বাবর জিগ্যেস করল, আপনার পিতৃপুরুষের কারো ছবি দেখছি না।

ছিল। সব ছেলেমেয়েরা নিয়ে গেছে। আমার হয়েছে মশাই সেই অবস্থা–কৃত্যয়োর্ভিন্ন দেশাত্বাব্দ দ্বৈধীভবাতি মসে মনঃ, পুরঃ প্রস্হিতং শৈলে স্রোতঃ শ্রোতোবাহো যথা। অর্থাৎ কিনা, পর্বতে নদী বাধা পেলে যেমন দুভাগ হয়ে যায়, আমার মনের অবস্থাও তাই। ছেলেমেয়েরা ইন্ডিয়া চলে গেল, আমি পারলাম না। বুঝে দেখুন মশাই। এটা আমার দেশ নয়? আমার মাটি নয়? এক কথায় চলে যাব? বলি, মাটি কখনো পর হয়ে যায়? শুনে দেখবেন মশাই যারা গেছে তারা ঐ রাত্তিরে দেশের দিকে মুখ করে কাঁদে।

এর মধ্যে নিঃশব্দে সুষমা খাবার সাজিয়ে দিয়েছে। এখন সেই মিষ্টি হাসিটা ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এককোণে।

গরম ধোঁয়া ওড়ানো ভাত। তার ওপর গলে পড়ছে সোনার মত ঘি। চারদিকে ছোট ছোট দশ বারোটা করে বাটি। সব নিরামিষ। কোনোটায় ঝাল, কোনোটায় ভাজা, টক, মিষ্টি তেতো, দুরকম ডাল, বেগুনি, চচ্চড়ি, মাংসের মত করে রাধা ছানার বিরফি, অম্বল, কিসমিস উঁকি দিচ্ছে কোনোটা থেকে।

সুষমা বলল, কাকাবাবু শুধু বকবক করেন। আপনারা খান তো।

একটি বাটি নিতে যাচ্ছিল, সুষমা বলল, না, ওটা নয়। এটা নিন। আগে ঐটে খেতে হয়। একের পর এক বলে যেতে থাকল সুষমা, কোন বাটিতে কী, কোনটার পর কোনটা খেতে হয়। প্রণব বাবু বললেন, নিজের বাড়ি মনে করে খাবেন দিদি। কী ছাইপোশ রেঁধেছে কে জানে? সুষি পড়াশোনায় যেমন লাড্ডু তেমনি রাঁধাবাড়ায়। বুঝলেন? দোষ নেবেন না।

না, না, চমৎকার হয়েছে। এত সুন্দর রানা বহুকাল খাইনি।

বাবারের সঙ্গে জাহেদাও যোগ করল, খুব ভাল।

কিন্তু কৌতুকের সঙ্গে বাবর লক্ষ করল, জাহেদা খাচ্ছে কত। শুধু নিরামিষ দেখে হকচকিয়ে গেছে বেচারা। প্রণব বাবুকে জিগ্যেস করল জাহেদা, মাছ মাংস ডিম কিছু খান না আপনি?

আমি তো খাইই না, আমার সাতপুরুষে কেউ কখনও খায়নি।

পারেন না খেয়ে?

হ্যাঁ, পারব না কেন? কোনো অসুবিধে হয় না তো!

মাছ মাংস যারা খায় তাদের অপছন্দ করেন?

হা হা করে হেসে উঠলেন প্রণব বাবু।

কেন, এই যে সুষি, সুষমা! ওরা মাছ মাংস হরদম খাচ্ছে।

বাবর জিগ্যেস করল, সুষমাকে এই প্রথম সে কথা বলল, তুমি পড়?

হ্যাঁ।

কী পড়?

এবার বি.এ পড়ছি। ফাস্ট ইয়ার।

বাহ, চমৎকার।

ও-কী, হয়ে পেল?

হ্যাঁ, অনেক খেয়েছি।

না, না, ঐ কটা ভাত রাখলেন যে। জাহেদাকে বলল, আপনি তো কিছুই খেলেন না।

জাহেদা হাসল।

সুষমা দুগ্নাশ গরম দুধ নিয়ে এলো। বাবর বলল, এ-কী!

কিছু না। দেখতেই তো পাচ্ছেন। খেয়ে নিন।

দুধ খাবার তো অভোস নেই। বাবর বলল, জাহেদা?

জাহেদা মাথা নাড়াল।

নিঃশব্দে সুষমা একে একে সব বাটি থালার ওপর সাজিয়ে চলে গেল। ফিরে এলো রূপার তশতরিতে সুন্দর করে কাটা সুপুরি আর লং এলাচ নিয়ে। বলল, বারান্দায় হাত ধোয়ার জল আছে।

বারান্দায় এসে গায়ে কাঁপুনি তুলে জাহেদা বলল, যা অন্ধকার। নিচু গলায় বাবর জিগ্যেস করল, খেয়েছ ঠিক মত? কেমন লাগল?

এক রকম। — দেখেছেন মেয়েটা কেমন অন্ধকার দিয়ে যাচ্ছে, আসছে, একটু ভয় নেই।

কীসের ভয়?

সাপ-টাপ। বলেই শিউরে উঠল জাহেদা। কোনো রকমে হাত মুছে ঘরে ছুটে গেল।

বাবর ভেতরে এসে বলল, জানেন প্রণব বাবু, আজ সকালে মহারাজ দর্শন হয়েছে।

মহারাজ মানে?

প্রায় পাঁচ হাত লম্বা এক গোখরো।

সঙ্গে সঙ্গে কাঁন্দ কাঁদ হয়ে গেল জাহেদা। বলল, প্লীজ।

হা হা করে হেসে উঠে কোলে বালিশ টেনে প্রণব বাবু বললেন, দিদির বোধহয় খুব ভয়? তাহলে শুনুন বলি, আপনি ওকে যতটা ভয় পান, ও-ও আপনাকে ঠিক ততটাই ভয় পায়। আপনি কিছু না করলে ও আপনাকে কিছুই করবে না।

অবিশ্বাস আর ভয় ভরা চোখে তাকিয়ে রইল জাহেদা।

প্রণব বাবু বলে চললেন, জন্তু জানোয়ার এদের মধ্যে এই নিয়মটা ভাল, যার যার তার তার মত থাকে। কেউ কারো গায়ে পড়ে কিছু করতে ওরা একেবারেই নারাজ। কেবল মানুষের মধ্যেই এটি দেখবেন না। গায়ে পড়ে আপনার উপকার করবে, গায়ে পড়ে আপনার ক্ষতি করে যাবে। কোথা থেকে কে যে কোন কলটি নেড়ে দিলেন টেরটি পাবেন না মশাই। ভয় পাবেন না দিদি। সাপের দেশ রংপুর। জীবন কাটিয়ে দিলাম। কত রকম সাপ দেখলাম, এখনো তো বেঁচে আছি। শুনুন তবে।

জাকিয়ে গল্প বলতে শুরু করলেন তিনি। তাঁর তখন ছেলেবেলা, একদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখেন বাড়িশুদ্ধ মানুষ জেগে। সবাই চুপচাপ, শ্বাস-প্ৰশ্বাস একেবারে বন্ধ। শুধু ওপাশের ঐ ভাড়ার, ওখান থেকে ভীষণ ফোসফোসানি আর ঠকাস ঠকাস একটা শব্দে শোনা যাচ্ছে। খুড়ো মশাইয়ের কোলে চেপে গিয়ে দেখেন, হারিকেনের আলোয় দেখা যাচ্ছে ইয়া এক কেঁদো সাপ। এই এতবড় একটা ফণা–প্রণব বাবু দুথাবা পাশাপাশি ধরে দেখালেন। দুধের মত ধবধব করছে, মাথায় সিঁদুরের ফোঁটা। কী গর্জন তার। লকলক সকসক করছে জিভ। চোখ হীরের মত জ্বলজ্বল করছে–এই এত বড় বড় দুটো চোখ। একবার করে ছোবল মারছে একটা ছোট্ট খাট ছিল বাচ্চাদেশ, ভাঙ্গা, তার পায়ার ওপর। আবার ঘুরে যাচ্ছে। আবার গজরাচ্ছে, আবার এক ছোবল। শব্দ উঠছে ঠিকাস ঠকাস। ফোসাচ্ছে না তো যেন শালকাঠ চিরছে করাতিরা। সে-কী ভয়ানক ক্ৰোধ। রাজকীয় ক্ৰোধ মশাই! সে-কী সৌন্দর্য। সে-কী আক্ৰোশ। বাবা লোক পাঠালেন সামাদ নামে এক চরিত্রের কাছে। ইয়া দশাসই চেহারা, লাল ভাটার মত চোখ, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বাবড়ি, দেবী চৌধুরাণী দলের ডাকাত যেন মশাই। সে খবর পেয়ে তেলপাকা কুচকুচে লাঠি নিয়ে এলো। এলো বটে। কিন্তু দূর থেকে দেখেই বলল, কর্তা, বলেন তো জান দেব, কিন্তু সাহস পাই না। সালাম করে চলে গেল সে।

যতটা সঙ্কুচিত হয়ে থাকা যায় জাহেদা তাই আছে। বারবার পায়ের কাছে দেখছে। মুখ একেবারে ছাই। বাবর বলল, সাপটা অমন করছিল। কেন?

কী জানি মশাই, তা জানি না। বোধহয় কোনো ইঁদুর টিদুর ফসকে গিয়েছিল।

আর কোনোদিন দেখেছেন? সম্মোহিত গলায় জাহেদা প্রশ্ন করল। ভয়ের একটা সম্মোহন আছে যখন আর ভয় করে না।

না। আর একবার দেখেছিলাম। বাবা মারা গেলেন। শ্মশান থেকে ফিরে এসে দাওয়ায় বসে আছি দেখি সাপটা চলে যাচ্ছে।

কোথায়?

বোধহয় বাড়ি ছেড়েই যাচ্ছিল। তারপর আর দেখিনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন প্রণব বাবু। সাপ না স্বর্গীয় পিতা কাকে তিনি কল্পনায় প্রত্যক্ষ করছেন বোঝা গেল না। গমগম করতে লাগল সারা ঘর। বাবর তাকিয়ে দেখল সুষমা কখন দরোজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

স্মিতহাসি ফুটে উঠল প্রণব বাবুর মুখে।

আরেক দিনের কথা। এই তো মাত্র বছর খানেক আগে। সেদিন একেবারে ফুটফুটে পূৰ্ণিমা। রাত অনেক হয়েছে। সুষিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। বারান্দায় চুপচাপ একা বসে আছি। রামটহল ব্যাটা সেদিন, ইয়ে, সিদ্ধি বানিয়েছিল, একগ্লাশ পান করা হয়েছে। এই যে বারান্দা, এখন রাত বলে বুঝতে পারছেন না, এর পুব কোণ থেকে বাঁশঝোপটা দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে আছি। পূর্ণিমার আলোয় খাড়াখাড়া ছায়া পড়ে ভারি সুন্দর লাগছিল। বাঁশতলা। হঠাৎ দেখি জোড়ায় জোড়ায় সাপ।

অস্ফুট আৰ্তনাদ করে উঠল জাহেদা। বাবর তার হাত ধরল ক্ষণেকের জন্যে।

বুঝলেন, জোড়ায় জোড়ায় সাপ। একজোড়া দুজোড়া নয়, অন্তত শখানেক হবে। একেবারে কিলবিল কিলবিল করছে। পূর্ণিমার আলোয় দেখাও যাচ্ছে স্পষ্ট। সব মাথা তুলে জড়াজড়ি করে নাচছে। নাচ করছে মশাই, নাচ। হেলে দুলে ডাইনে বাঁয়ে। এমনি এমনি করে।

প্রণব বাবু নিজের দুহাত জড়িয়ে ফণার মত তুলে নাচিয়ে নাচিয়ে দেখালেন।

জাহেদা বাবরের হাত শক্ত করে ধরল। বলল, চলুন।

হ্যাঁ, এইতো।

খপ করে হাত নামিয়ে নিলেন প্রণব বাবু।

যাবেন?

ওর শরীরটা ভাল নেই। তাছাড়া ছেলে মানুষ তো, ঘুম পাচ্ছে। রাত হলো। বড্ড হতাশ হলেন প্রণব বাবু। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্বেও উঠে দাঁড়ালেন। হতাশ গলায় বললেন, আর একটু বসবেন না? চা খাবেন? চা? সুষি চা করে আনুক।

না, এত রাতে আর কষ্ট করবেন না। এমনিতেই সুষমাকে অনেক জ্বলিয়ে গেলাম।

সুষমা পথ ছেড়ে দিয়ে আবার সেই মিষ্টি হাসিটা তৈরি করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *