১৫. সৎকার

মাটি খুঁড়তে কতক্ষণ আর লাগে? ইস্কুলের পাশেই?

না।

তাহলে আবার কোথায়?

কবর নয়।

হঠাৎ খেয়াল হয়। শিস দিয়ে ওঠে মেজর।

ভুলেই গিয়েছিলাম, হিন্দু। হিন্দুরা কবর দেয় না। পোড়ায়। পোড়ায় কেন?

নীরবতা।

খোদা মানুষকে মাটি থেকে তৈরি করেছেন। আর শয়তানকে আগুন থেকে। সেইজন্যই হিন্দুরা আগুনে ফিরে যায়।

নীরবতা।

আগুন।

মেজর মৃদু স্বরে শব্দটা উচ্চারণ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নেয়।

দুটিন পেট্রল হলেই চলবে তো?

না।

একটা মানুষ পোড়াতে দুটিনের বেশি লাগে না। যথেষ্ট।

কাঠ চাই।

কাঠ?

সম্ভব হলে চন্দন কাঠ চাইতাম।

মেজর আবার শিস দেয়।

স্যান্ডল উড?

কাঁধ ঝাঁকুনি দেয় সে। অদ্ভুত মনে হয়। কৌতুক অনুভব করে।

আর বিলকিস ফিরে পায় তার সেই অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতা, গত রাতের মতো স্থির প্রেরণা।

কাঠ চাই।

এত রাতে কাঠ কোথায় পাবে?

আমি জানি না।

আমার সহিষ্ণুতার পরীক্ষা করছ না তো?

নীরবতা।

মৃত্যু তোৰ হোক। বিপ্লবীদের খবর দেব দিয়ে আসতে। আমি অপেক্ষা করতে তৈরি। তুমি?

অপেক্ষা কাঠের জন্যে নয়, বিলকিসের জন্যে অপেক্ষা করতে সে প্রস্তুত, এটা স্পষ্ট হয় মেজরের নিঃশব্দ হাসিতে বিদীর্ণ মুখ দেখে।

সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে বিলকিস যে উত্তর দেয় মেজরের তা বোধগম্য হয় না, তাই বিচলিত বোধ করে না।

আমিও তৈরি।

প্রদীপের গালে একটু আগে, দুহাত স্থাপন করবার মুহূর্তেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিল। বিলকিস। তাই তার কণ্ঠস্বর এখন উদাস, বর্তমান থেকে বিযুক্ত এবং উচ্চারণ সংক্ষিপ্ত।

কাঠ এখানে নয়।

তাহলে কোথায়?

নদীর তীরে।

নদীর তীরে কেন?

মেজর হঠাৎ তীক্ষ্ণ চোখে বিলকিসকে বিদ্ধ করে। মুহূর্তের জন্যে সুরা ও নারীর নেশা

অন্তর্হিত হয়ে যায়। হিন্দু মেয়েটার কোনো মতলব নেই তো? নদীর ওপারে ইন্ডিয়া খুব বেশি দূরে নয়। মাত্র তিরিশ মাইল, পাখির উড্ডয়নে।

হিন্দুদের সৎকার নদীর তীরে হয়।

অদ্ভুত!

আবার কাঁধ বাকুনি দেয় মেজর।

আচ্ছা, বিহারীদের জিগ্যেস করব। যদি তারা বলে হিন্দুদের দাহ নদীর তীরে হয় তো নদীর তীরেই হবে। আরেকটা কথা বল—। তোমাদের কোন দেবীর নাকি পাঁচ স্বামী ছিল?

ছিল!

মেজর লম্বা করে শিস দেয়।

ভোর হয়ে যায়।

প্ৰদীপের লাশের পাশে খোদিত মূর্তির মতো বসে থাকে বিলকিস। অনেকক্ষণ। তারপর শাড়ি দিয়ে প্রদীপের দেহ থেকে রক্ত মুছে ফেলতে চেষ্টা করে সে। কিছু ওঠে, কিছু ওঠে না। মানচিত্রে দ্বীপের মতো রক্তের চিহ্ন প্ৰদীপের শরীরে অংকিত হয়ে থাকে।

দুপুরের দিকে মেজর ফিরে আসে।

চল।

জনা চারেক বিহারী ছোঁকরাকে দেখা যায়। সম্ভবত এরাই বাজারে দেখা দিয়েছিল। এখন তারা প্ৰদীপের লাশ নিয়ে বাইরে পিকআপ ভ্যানে তোলে। বিলকিসকে উঠতে ইশারা করে মেজর। তারপর দুজন সৈনিকের সঙ্গে সে সমুখে গিয়ে বসে। আরো দুজন সৈনিক লাফিয়ে ওঠে পেছনে।

ইস্কুলের মাঠ ছেড়ে জলেশ্বরীর জনশূল্য সড়ক দিয়ে চোখ ঝলসানো রোদ্দুরের ভেতরে ভ্যান আধকোশা নদীর দিকে ছুটে যায়। মোটরের গর্জন স্তব্ধতাকে আরো বিকট করে তোলে।

আধিকোশার নিকটতম তীরে এসে দেখা যায় সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে আরো কয়েকজন বিহারী ছোকরা। তারা একস্তুপ কাঠের অদূরে বন্দুক হাতে নিয়ে লম্বা পায়ে টহল দিচ্ছে। নদীর তীরও একই প্রকার জনশূন্য। জল বয় না। পাখি ওড়ে না। নদী শুকিয়ে পাড়ে যে বিস্তৃত বালির বিছানা হয়ে আছে, রোদুরে উত্তপ্ত হয়ে আছে, খালি পায়েও বিলকিস তা অনুভব করতে পারে না।

ভ্যান থেমে যাবার পর মেজর নেমে এসে ভ্যানেরই পাশে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবার প্রস্তুতি নিয়ে সে পা ঈষৎ ফাঁক করে দাঁড়ায়।

অতঃপর কী কর্তব্য বুঝতে না পেরে বিহারী ছোঁকরাগুলো একে অপরের কাছাকাছি গা ঘেষাঘেষি করে নিচু গলায় নিজেদের ভেতর কথা বলে। বার বার জিজ্ঞাসু চোখে মেজরের দিকে তাকায়। বন্দুক হাতে সৈনিকদের দিকে সসম্ভ্রমে ঘনঘন দৃষ্টিপাত করে তারা।

বিলকিস কখনো চিন্তা রচনা দূরে থাক, দাহ-সৎকার পর্যন্ত দ্যাখে নি। মানুষের রক্তের ভেতরে মৌলিক কিছু কর্তব্য সম্পাদনের নীল-নকশা থাকে। বিলকিস নীরবে দ্রুত হাতে কাঠগুলো বিছানার মতো করে সাজায়। উনোনে কাঠ দেবার স্মরণে সে দুসারি কাঠ ঢালু। করে সাজায়, যেন আগুনের বিস্তার সহজ ও সতেজ হয়। তারপর মেজরের দিকে তাকায়। মেজরের নিঃশব্দ ইশারা পেয়ে বিহারী ছোঁকরাগুলো প্ৰদীপকে ভ্যান থেকে নামিয়ে আনে। চিতার দিকে এগোয় তারা। চিতার কাছে, বিলকিসের পাশে দাঁড়িয়ে তারা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে। অচিরে বিলকিসের নীরব অথচ স্পষ্ট নির্দেশ পেয়ে লাশটিকে তারা চিতার ওপর শুইয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে সরে যায়। তারা আগের জায়গায় ফিরে না গিয়ে আরো দূরে ভ্যানের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।

রোদের ভেতরে প্রদীপের মুখ ধৌত দেখায়। একবার সেদিকে দৃষ্টিপাত করেই বিলকিস চোখ ফিরিয়ে নেয়। আর সে তাকায় না। প্ৰদীপের সমস্ত দেহ ঢেকে দেয় কাঠ দিয়ে। তারপর মাথার কাছে স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে। সুদূর কোনো চিত্রের মতো বাজারে শায়িত খোকার লাশের কথা মনে পড়ে যায় তার।

মেজর ঢালু বেয়ে নেমে আসে। নদীর তীরে বিলকিসের একাকী তৎপরতা এতক্ষণ সে দেখছিল। দীর্ঘ সময় নেবে। আগুন ধরে উঠতে, সে উপলব্ধি করে একজন সৈনিককে পেট্রলের টিন নিয়ে অনুসরণ করতে বলে। সৈনিকটি চিতার চারপাশ ঘিরে পেট্রল দিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায়।

বিলকিস তা লক্ষ করে না। ছায়ার মতো সঞ্চারণ তার পাশে সে অনুভব করে, কিন্তু চেতনায় তা প্ৰবেশ করে না।

অচিরকালের ভেতরের একটি বোধ জেগে ওঠে। সমুখে শায়িত মৃতদেহটিকে সে আর বিশেষ বলে গণনা করে না। স্বয়ং মৃত্যুই তার সমুখে শায়িত মনে হয়।

বিহারী একটি ছোঁকরা মেজরের ইশারায় দেশলাই ছুঁড়ে দেয় বিলকিসের দিকে।

মৃত এবং মৃত্যু দপ করে জ্বলে ওঠা আগুনের আলিঙ্গনে দৃষ্টির অতীত হয়ে যায়।

অপলক চোখে সেই লেলিহান শিখার দিকে তাকিয়ে থাকে বিলকিস।

মেজরের নির্দেশে বিহারী দুটি ছোঁকরা বিলকিসের কাছে এসে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে হাত ধরে। বিলকিস নড়ে না। আবার তারা টান দেয়। এবার আরো জোরে।

দূরে মেজর বিড়বিড় করে, ধৈর্য ধৈর্য।

ছোঁকরা দুটো নারী দেহের কোমলতা অনুভব করছে, তার ঈর্ষা হয়। বিরক্তির উদ্রেক হয়।

সে নিজেই ঢালু বেয়ে নেমে আসে নিচে। ছোঁকরা দুটো থাতমতো খেয়ে সরে দাঁড়ায়। নারীবাহুর কোমলতা তারা ভুলতে পারে না।

মেজর এসে বিলকিসকে বলে, এরপর কী?

বিলকিস সাড়া দেয় না।

তার পেছনে নদীর জল হঠাৎ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।

পোড়া মাংসের গন্ধে পেটের ভেতর থেকে সব উল্টে আসতে চায়, সে সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও। আগুনের প্রবল হালকা অনুভব করে। নাকমুখ ঢাকবার চেষ্টা করে মেজর প্রাণপণে। বিলকিসকে আকর্ষণ করে।

ঠিক তখন বিলকিস তাকে আলিঙ্গন করে। সে আলিঙ্গনে বিস্মিত হয়ে যায় মেজর। পর মুহূর্তেই বিস্ফারিত দুই চোখে সে আবিষ্কার করে, রমণী তাকে চিতার ওপর ঠেসে ধরেছে, রমণীর চুল ও পোশাকে আগুন ধরে যাচ্ছে, তার নিজের পিঠ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। রমণীকে সে ঠেলে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু রমণীকে আগুন দিয়ে নির্মিত বলে এখন তার মনে হয়। তার স্মরণ হয়, মানুষ মাটি দিয়ে এবং শয়তান আগুন দিয়ে তৈরি। জাতিস্মর আতঙ্কে সে শেষবারের মতো শিউরে ওঠে।

মশালের মতো প্রজ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে তাকে ঠেসে ধরে রাখে বিলকিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *