প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৫. মায়া : ভাববাদের আবির্ভাব

মায়া : ভাববাদের আবির্ভাব

অতীতের সেই বরুণ শুধুই যে ঋতযুক্ত ও ঋতজ্ঞ তাই নন, মায়াবীও।

ধর্মণা মিত্রাবরুণা বিপচ্চিতা ব্রতা রক্ষেথে অসূরস্য মায়য়া।
ঋতেন বিশ্বং ভূবনং বি রাজথঃ সূর্যমা ধত্থো দিবি চিত্র্যং রথম্॥
অর্থাৎ, —হে প্রাজ্ঞ মিত্রাবরুণ, তোমরা ধর্মদ্বারা ও অসুরের মায়াদ্বারা যজ্ঞসমূহ রক্ষা কর, ঋতদ্বারা এই বিশ্বভুবনকে দীপ্যমান কর, সূর্যকে তাহার বিচিত্র রথসহ ধারণ করিয়া থাক।। ঋগ্বেদ : ৫.৬৩.৭ ।৷

ঋতস্য বুধ্ন উষসামিষণ্যম্বৃষা মহী রোদসী আ বিবেশ।
মহী মিত্রস্য বরুণস্য মায়া চন্দ্রেব ভানুং বি দধে পুরুত্রা।।
অর্থাৎ, —উষাগুলিকে প্রেরণ করিতে ইচ্ছুক হইয়া ঋতের মূল বৃষ্টির সাহায্যে স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল; মিত্র ও বরুণের মহতী মায়া চন্দ্রের ন্যায় নিজপ্রভা বহুলভাবে প্রসারিত করিয়াছিল।। ঋগ্বেদ : ৩.৬১.৭ ।।

স্বভাবত অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল মন্তব্য(৮৯) করছেন,

The divine dominion of Mitra and Varuna is often referred to with the word Maya.

কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, উত্তরকালে, বিশেষত বেদান্ত-দর্শনের প্রভাবে, মায়া বলতে আমরা যা বুঝতে শিখেছি ঋগ্বেদে মায়ার অর্থ মোটেই তা নয়। ঋগ্বেদের মায়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল(৯০) মন্তব্য করছেন,

It has an almost exact parallel in the English word ‘craft’, which in its old significance meant ‘occult power, magic’, then ‘skilfulness, art on the one hand and ‘deceitful skill, wile’ on the other. The good sense of Maya, like that of asura (which might be rendered by ‘mysterious being’) is mainly connected with Varuna and Mitra, while its bad sense is reserved for demons. *

আমরা আগেই দেখেছি, প্রাচীন-সমাজে উৎপাদন-কৌশল অনুন্নত বলেই শ্রমের অপরিহার্য অঙ্গ ছিলো জাদুশক্তিতে বিশ্বাস। ঋগ্বেদের ‘মায়া’ শব্দটির মধ্যে আমরা হয়তো তারই আভাস পাই; মায়া হলো কৌশল, প্রজ্ঞা, ক্ষমতা এবং সেইসঙ্গে জাদুশক্তিও। এবং প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ে কর্মকৌশলের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়নি বলেই এই মায়াই তখন দেবতাদেরও পরম গৌরবময় শক্তি হিসেবেই কীর্তিত হয়েছে।

এই মায়ার দ্বারাই বরুণ সূর্যকে পৃথিবী থেকে পৃথক করেছিলেন।

ইমামু স্বাসুরস্য শ্রুতস্য মহীং মায়াং বরুবস্য প্র বোচম্‌।
মানেনেব তস্থিবা অন্তরিক্ষে বি যো মমে পৃথিবীং সূর্যেন।।
অর্থাৎ, —অসুরের হননোপযোগী এই মহৎ বিখ্যাত মায়ার কথা বলিতেছি—যাহার দ্বারা বরুণ অন্তরীক্ষে থাকিয়া যেন দণ্ডের দ্বারা সূর্যকে ও পৃথিবীকে পৃথক করিয়াছিলেন। ঋগ্বেদ : ৫.৮৫.৫ ॥

এই মায়াই মিত্রাবরুণের আয়ুধের মতো।

মায়া বাং মিত্রাবক্ষণা দিবি শ্রিতা সূর্যো জ্যোতিশ্চরতি চিত্রমায়ুধম্।
অর্থাৎ, —হে মিত্রাবরুণ, তোমাদের মায়া স্বৰ্গকে আশ্রয় করিয়াছে এবং সূর্যরূপে বিচিত্র আয়ুধ হইয়া ইহা পরিভ্রমণ করিতেছে।। ঋগ্বেদ : ৫.৬৩.৪।।

কিন্তু শুধু মিত্রাবরণই নন; অন্যান্য দেবতাদের কর্মকৌশলকেও ঋগ্বেদে মায়া বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।

ইন্দ্র যে গাভী নির্মাণ করেছিলেন তাও এই মায়ার দ্বারাই।

তদিন্ন্বস্য বৃষভস্য ধেনোরা নামভিৰ্মমিরে সক্‌ম্যং গোঃ।
অন্যদন্যদসূৰ্যং বসানা নি মায়িনো মমিরে রূপমস্মিন্‌।
অর্থাৎ, –অভিলাষ-পূরণকারীর হবনীয় গাভীকে মায়াযুক্ত ইনি (ইন্দ্র) ‘ধেনু’ এই নামের দ্বারা নির্মাণ করিয়াছিলেন; অন্যান্য অসূর্য-শক্তিকে পরাজিত করিয়া ইনি ইহাদিগকে (প্রকৃত) রূপে (মায়াদ্বারা) নির্মিত করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ৩.৩৮.৭ ।।

এমনকি ইন্দ্রের যে-রণকৌশল তারও নাম মায়া। মায়ার দ্বারাই তিনি মায়াবী শুষ্ণকে পরাজিত করেন।

মায়াভিরিন্দ্র মায়িনং ত্বং শুষ্ণমবাতিরঃ।
অর্থাৎ, —মায়াসমূহদ্বারা ইন্দ্র, হে মায়াবী শুষ্ণ, তোমাকে পরাজিত করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ১.১১.৭ ।।

এবং এই মায়ার দ্বারাই তিনি মায়াযুক্ত মৃগকে বধ করেছিলেন।

ত্যং মায়িনং মৃগং তমু ত্বং মায়য়াবধীঃ
অর্থাৎ,—তুমি (ইন্দ্র) মায়াদ্বারা সেই মায়াযুক্ত মৃগকে বধ করিয়াছিলে।। ঋগ্বেদ : ১.৮০.৭ ।।

ইন্দ্র যে ধনদাতাকে পর্যুদস্ত করেছিলেন তাও এই মায়ার দ্বারাই, মায়ার সাহায্যেই।

মায়াভিধনদাং পর্যভূবন্‌… … … …
… … … … নির্জোতিষা তমসো গা অদুক্ষৎ ॥
অর্থাৎ, —(ইন্দ্ৰ) ধনদাতাকে মায়াসমূহ দ্বারা পর্যুদস্ত করিয়াছিলেন এবং আলোকের দ্বারা অন্ধকার হইতে গরুগুলিকে দোহন করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ১.৩৩.১০ ॥

যে-পার্থিব ধনের এবং নিরাপত্তার কামনাকেই সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদের মূলসূত্র হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়, তা লাভ করবার কৌশলকেও মায়া বলা হয়েছে।

রেবদ্বয়ো দধাথে রেবদাশাথে নরা মায়াভিরিতঊতি মাহিনম্।
অর্থাৎ, —(হে মিত্রাবরুণ), তোমরা দুইজন ধন এবং অন্ন ধারণ কর; তোমরা নেতা, আমাদিগকে মায়াসমূহ অবলম্বনে ধন (ও অন্ন) দান কর, তোমরা মহৎ।। ঋগ্বেদ : ১.১৫১.৯ ।।

এবং মায়ার সাহায্যেই মিত্রাবরুণ অমোঘ নিয়মের ধারক হন।

যা বো মায়া অভিদ্রুহে যজত্ৰাঃ পাশা আদিত্যা রিপবে বিচৃত্তাঃ।
অর্থাৎ, —হে যজনীয়গণ (আদিত্যগণ), তোমাদের মায়া এবং পাশসমূহ বিদ্রোহী শক্রর উদ্দেশ্যে প্রসারিত ॥ ঋগ্বেদ : ২.২৭.১৬ ।।

এই মায়ার দ্বারাই ইন্দ্র স্বৰ্গকে পতন থেকে স্তব্ধ করেছিলেন।

অস্তভ্‌নাৎ মায়য়া দ্যামবস্রসঃ।
অর্থাৎ, —(ইন্দ্র) মায়াদ্বারা স্বৰ্গকে পতন হইতে স্তব্ধ করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ২.১৭.৫ ।।

আমরা ইতিপূর্বে দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, আদিতে ওই পার্থিব ধনলাভের পদ্ধতিকেই যজ্ঞ বলা হতো—এমন কথা অনুমান করবার সুযোগ আছে। এবং ঋগ্বেদে ধন-লাভ-কৌশলের নামান্তর যদি মায়াই হয় তাহলে যজ্ঞের সঙ্গেও মায়ার সম্পর্ক দেখতে পাওয়া উচিত। বস্তুত ঋগ্বেদেই এ-সম্পর্কের ইংগিত খুঁজে পাওয়া যায়।

মায়ার দ্বারাই হোতা ব্ৰতকে উর্ধ্বে ধারণ করেন।

এতি প্র হোতা ব্রতমস্য মায়য়োর্ধ্বাং দধাননঃ
অর্থাৎ, —হোতা ব্রতকে মায়ার দ্বারা উর্ধ্বে ধারণ করিয়া এইদিকে আসিতেছে। ঋগ্বেদ : ১.১৪৪.১ ।।

মায়ার দ্বারাই অগ্নি ভুবনসমূহকে পবিত্র করেন।

স বহ্নিঃ পুত্রঃ পিত্রোঃ পবিত্রবান্‌ পুনাতি ধীরো ভূবনানি মায়য়া।
ধেনুং চ পৃশ্নিং বৃষভং সুরেতসং বিশ্বাহা শুক্রং পয়ো অস্য দুক্ষত।।
অর্থাৎ,–পিতামাতার পুত্র সেই বহ্নি (অগ্নি) পবিত্র, ধীর; তিনি মায়ার দ্বারা ভুবনসমূহকে পবিত্র করেন; তিনি চিরকাল ধরিয়া শুক্লবৰ্ণ গাভী এবং শোভন রেতঃযুক্ত বৃষভ হইতে শুক্র এবং দুগ্ধ দোহন করেন।। ঋগ্বেদ : ১.১৬৩.৩ ।৷

এবং মায়াবীদের মায়া অগ্নির মধ্যেও সংস্থাপিত হয়েছিলো।

যাশ্চ মায়া মায়িনাং বিশ্বমিন্ব ত্বে পূর্বীঃ সংদধুঃ পৃষ্টবন্ধো।
অর্থাৎ, —মায়াবীদের যে-সমস্ত মায়া, হে জিজ্ঞাসুদিগের বন্ধু, বিশ্বম্ভর (অগ্নি), তাহা পূর্বেই তোমাতে সংস্থাপিত হইয়াছে।। ঋগ্বেদ : ৩.২০.৩ ।।

মায়া প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের আরো অনেক মন্ত্র উদ্ধৃত করা যায়। কিন্তু আমাদের মূল যুক্তির পক্ষে তার প্রয়োজন নেই। কেননা, আমাদের যুক্তির দিক থেকে শুধু এটুকু প্রতিপন্ন করাই প্রয়োজন যে, বৈদিক মানুষের এককালে মায়া বলতে কর্মকৌশলই বুঝতেন এবং তখন তার প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ে জীবনযাপন করতেন বলেই তাদের ধ্যানধারণায় শ্রম বা কর্মকৌশল নিন্দিত হয়নি। তাই ঋগ্বেদে মায়া তো নিন্দিত নয়ই; বরং এই মায়ার গৌরব-বর্ণনাতেই ঋগ্বেদ যেন ভরপুর। মায়ার গৌরবের সঙ্গে প্রাক্‌-বিভক্ত পর্যায়ের সম্পর্ক কী রকম ছিলো এবং সেই প্রাক্-বিভক্ত সমাজ-সংগঠন ভেঙে যাবার পর ঋগ্বেদেরই পরের অংশে মায়ার গৌরব কী ভাবে ক্ষুণ্ণ হতে শুরু করেছে এখানে তারই সামান্য উদাহরণ উদ্ধৃত করবো।

আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, বৈদিক সমাজের প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ের একটি প্রধান পরিচয় হলো সভা। ঋগ্বেদে দেখি, অগ্নি মায়ার দ্বারাই এই সভাসমূহকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

হোতা দেবো অমর্ত্যঃ পুরস্তাদেতি মায়য়া। বিদথানি প্রচোদয়ন্‌।।
অর্থাৎ,—মৃত্যুহীন হোতা দেবতা (অগ্নি) সভাসমূহকে অনুপ্রেরিত করিবার জন্য সম্মুখে মায়াযুক্ত হইয়া আসিতেছেন। ঋগ্বেদ : ৩.২৭.৭ ।।

কিন্তু ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল রচিত হবার সময় ওই বৈদিক সভায় ভাঙন ধরেছিলো বলেই অনুমান হয়; কেননা তা না হলে বৈদিক কবি অতীতের স্মৃতিকে উদ্বুদ্ধ করে সমিতিতে সমান হবার জন্য অমন ব্যাকুল আবেদন (পৃ. ৫৬৮) ঘোষণা করবেন কেন? এবং এই দশম মণ্ডলেই দেখা যায় মায়া যেন বন্ধ্যাত্ব প্রাপ্ত হচ্ছে—যে-মায়া দেবতাদের প্রধানতম কৌশল ছিলো, যে-মায়াদ্বারা দেবতারা সভাসমিতিকে অনুপ্রেরিত করতেন, সেই মায়াই নিষ্ফল ও বন্ধ্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

উত ত্বং সখ্যে স্থিরপীতমাহুর্নৈনং হিন্বন্ত্যপি বাজিনেষু।
অধেন্বা চরতি মায়য়ৈষ বাচং শুশ্রুবা অফলামপুষ্পাম্‌।
অর্থাৎ, (হে ব্ৰহ্মণস্পতি) তুমি এই সখ্যে স্থির নিশ্চয় হইয়াছ; কেহ আর সংগ্রামে ইহার অনুগমন করে না। এই ব্যক্তি ধেনুবিহীন হইয়া মায়ার দ্বারা বিচরণ করে, সে নিস্ফল পুষ্পবিহীন বাক্য শ্রবণ করে। ঋগ্বেদ : ১০.৭১.৫ ৷

ভাষ্যে সায়ণ বলছেন,

যথা বন্ধ্যা পীনা গৌঃ কিং দ্রোণমাত্ৰং ক্ষীরং দোগ্ধীতি মায়ামূৎপাদয়ন্তী চরতি যথা বন্ধ্যো বৃক্ষোহকালে পল্লবাদিযুক্তঃ সন্‌ পুষ্প্যতি ফলতীতি ভ্রান্তিমূৎপাদয়ংস্তিষ্ঠতি তথা…
অর্থাৎ,–যেমন কোনো বন্ধ্যা স্থূল গাভী,–হয়তো অল্প দুগ্ধ দান করে,–এইরূপ ভ্রম উৎপন্ন করিয়া বিচরণ করে, যেরূপ নিফল বৃক্ষ অকালে পল্লবাদি যুক্ত হইয়া—ইহা হয়তো পুষ্প ও ফল ধারণ করে, এইরূপ ভ্রান্তি উৎপাদন করিয়া থাকে, সেইরূপ।

আরো পরে—বেদান্তে—এই মায়া বলতে শুধুমাত্র, মিথ্যা, অনৃত ও ভ্রান্তিই বুঝিয়েছে। তারই নাম হয়েছে মায়াবাদ এবং এই মায়াবাদই ভারতীয় দর্শনে ভাববাদের প্রধানতম ভিত্তিস্তম্ভ।

 

ঋগ্বেদে মায়ার কথা আছে; কিন্তু বৈদান্তিক অর্থে মায়াবাদ নেই—বড়ো জোর ঋগ্বেদের অর্বাচীন অংশে মায়াবাদের আভাস দেখা দিয়েছে। মায়াবাদের পরিবর্তে ঋগ্বেদে দেখা যায় দেবতাদের কৌশল ও প্রজ্ঞারই নাম হলো মায়া। ঋতের পালক ঋতজ্ঞ সখা ও নিত্যবন্ধু বরুণের প্রধানতম শক্তির নাম মায়া; তারই সাহায্যে তিনি যজ্ঞসমূহকে রক্ষা করেন, চন্দ্রের ন্যায় নিজপ্রভা বহুলভাবে বিস্তারিত করেন; মায়ার সাহায্যেই তিনি অন্তরীক্ষে অবস্থান করে সূর্যকে পৃথিবী থেকে পৃথক করেন এবং এই মায়াই তার আয়ুধের মতো। ইন্দ্রেরও প্রধানতম কৌশল বলতে এই মায়াই; মায়ার সাহায্যেই তিনি গাভীগুলি নির্মাণ করেছিলেন, মায়ার দ্বারাই তিনি মায়াবী শুষ্ণকে পরাজিত করেন, মায়াযুক্ত মৃগকে বধ করেন এবং এমনকি ধনদাতাকে পর্যুদস্ত করেন। যে-পার্থিব ধন এবং নিরাপত্তার কামনা সমগ্র ঋগ্বেদের মূলসূত্র তা লাভ করবার কৌশলও ওই মায়াই। মায়ার দ্বারাই হোতো ব্রতকে উর্ধ্বে ধারণ করেন, অগ্নি ভুবনসমূহকে পবিত্র করেন এবং সভাগুলিকে অনুপ্রাণিত করেন। ইত্যাদি। ইত্যাদি।

এই হলো ঋগ্বেদে মায়ার কথা। এ-কথা আর যাই হোক, বেদান্তের মায়াবাদ নয়। বস্তুত, সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদের মূল স্বরটিই মায়াবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। পৃথিবীকে বা পার্থিব বস্তুকে অলীক বা মিথ্যা মনে করে কোনো এক চিন্ময় সত্তার কল্পনায় বিভোর হবার পরিচয় ঋগ্বেদে নেই। তার বদলে মেয়েলি ব্রতের ছড়াগুলির মতোই—বা আফ্রিকার দিন্‌ক ট্রাইবদের কবিতার মতোই—সহজ সরলভাবে একান্ত পার্থিব সম্পদের কামনা ব্যক্ত করাই বৈদিক মন্ত্রগুলির মূল কথা। তাই বৈদিক চিন্তাচেতনাকে যদি একান্তই কোনো দার্শনিক সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে তাকে বস্তুবাদ বলতে হবে—সে-বস্তুবাদ যতো অস্ফূট, যতো অচেতন, যতো আদিমই হোক না কেন। কেননা এখানে পরকাল বা পরলোকের কথার কোনো পরিচয় নেই, পরিচয় নেই চিন্ময় জগৎকারণের কোনো কল্পনার। তার বদলে শুধু কামনা— একান্ত পার্থিব সহজ সরল কামনা।

এবং পার্থিব কামনা-পরিপূরক কৌশল হিসেবেই ঋগ্বেদ মায়ার মহিমায় মুখর। অতএব, ঋগ্বেদে মায়ার যে কথা তাও ওই অস্ফূট ও আদিম বস্তুবাদী চেতনারই অঙ্গীভূত।

কিন্তু বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকেরাই—বৈদান্তিকেরাই—ঋগ্বেদের এই প্রাক-অধ্যাত্মবাদী ও প্রাক্-ভাববাদী চেতনার ধ্বংসস্তুপের উপর ভাববাদের প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন এবং সে-ভাববাদের প্রধানতম ভিত্তি বলতে মায়াবাদই। এবং এই মায়াবাদ প্রসঙ্গে মায়া শব্দ আর আদিম সমাজের craft বা কৌশল নয়; তার বদলে বন্ধ্যা-ধারণা, মিথ্যা, মরীচিকা। আমরা দেখাতে চাইছি, মায়া শব্দের এই অর্থ-বিপর্যয়টির অন্তরালেই ভাববাদের জন্মকাহিনী প্রচ্ছন্ন থাকা অসম্ভব নয়। অতএব, ভাববাদের উৎস-সন্ধানে অগ্রসর হতে হলে মায়া শব্দের অর্থ-বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

বেদ আর বেদান্তের মধ্যে একটা যুগান্তরের ইতিহাস রয়েছে—প্রাচীন প্রাক্-বিভক্ত পর্যায় থেকে প্রকট শ্রেণীবিভক্ত পর্যায়ে এসে পড়ার ইতিহাস। বেদের পর ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের পর উপনিষদ বা বেদান্ত। ঋগ্বেদের যুগের শেষেই—এবং ব্রাহ্মণের যুগে আরো স্পষ্টভাবে—প্রাক্-বিভক্ত প্রাচীন সাম্যসমাজ ভেঙে পড়বার ছবি দেখতে পাওয়া যায়। প্রাক্-বিভক্ত সমাজে সকলেই সমানভাবে যৌথশ্রমে অংশ গ্রহণ করে। তাই শ্রম বা কৌশল বা craft সে-পর্যায়ে নিন্দিত বা হেয় বলে পরিগণিত নয়। কিন্তু সমাজের এই যৌথ সংগঠন ভেঙে যতোই শ্রেণীবিভাগ ফুটে উঠতে থাকে—সমাজের শাসক মহল শ্রমের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব থেকে যতোই মুক্ত হয়—ততোই এই শ্রম হেয় বা হীনবৃত্তি বলে পরিগণিত হতে থাকে। কেননা, নবপরিস্থিতিতে যে-শ্রেণীর মানুষের উপর এই শ্রমের দায়িত্ব সামাজিকভাবে তারা মর্যাদাহীন হয়ে দাঁড়ায়। এই নবপরিস্থিতিতে কী ভাবে মানব-চেতনায় ভাববাদের আবির্ভাব হয় তার সাধারণ যুক্তি আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি (পৃ.৮২ এবং ৫৪৩)। ভারতীয় দর্শনের বিশিষ্ট ক্ষেত্রে ভাববাদের আবির্ভাব প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, যে-উপনিষদ বা বেদান্তে এই ভাববাদের আবির্ভাব তার নাম জ্ঞানকাণ্ড। বেদান্তে শুধু যে জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে বিরোধ কল্পিত হয়েছে তাই নয়, কর্ম নিন্দিত হয়েছে এবং একমাত্র জ্ঞানেরই গৌরব স্বীকৃত হয়েছে। অতএব যে-মায়া বা craft এককালে বৈদিক মানুষদের মধ্যেই পরম গৌরবময় শক্তি বলে পরিগণিত ছিলো কালক্রমে তাই হেয়, নিন্দিত ও মিথ্যাবোধক হয়ে দাঁড়ালো।

পূর্বপক্ষ বলবেন, বেদান্তে যে-কর্মের নিন্দা তার নাম যজ্ঞকৰ্ম—তাকে সাধারণভাবে শ্রম বললে অর্থবিকৃতি হবে। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, আদিতে এই যজ্ঞই ছিলো অন্নলাভের উপায়; যজ্ঞের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য স্বভাবতই উত্তর-যুগের উদ্ভাবন। তবু দ্রষ্টব্য এই যে, বৈদান্তিক চিন্তার মধ্যে অমন আধ্যাত্মিক প্রলেপ সত্বেও কর্মকে স্বীকার করা সম্ভব হয়নি।

 

আমাদের মূল যুক্তি এইখানেই সমাপ্ত হতে পারতো। কেননা, মায়াবাদ বা বৈদান্তিক ভাববাদ অত্যন্ত সুপরিচিত এবং আমাদের যুক্তির দিক থেকে তার বিশদ-বর্ণন নিম্প্রয়োজন। আমরা শুধু এটুকুই দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, বৈদিক সাহিত্যে সমাজ-বিকাশের প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ের বহু স্মারক পাওয়া যায়। তার থেকে প্রমাণ হয়, অন্যান্য মানবজাতির মতোই বৈদিক মানুষেরাও এককালে সমাজবিকাশের প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়েই জীবন-যাপন করতেন। তাদের চিন্তাচেতনাও তখন মূলতই প্রাক্‌-অধ্যাত্মবাদী। কিন্তু এই সমাজ-সংগঠন ভেঙে যাবার ফলে, কালক্রমে, তাদের কাছে কর্ম নিন্দিত হয় এবং তারই ফলে তাদের চেতনায় আবির্ভাব হয় ভাববাদের—ঋগ্বেদের মায়ার গৌরবের ধ্বংসস্তুপের উপর গড়ে ওঠে বৈদান্তিক মায়াবাদ।

কিন্তু এইখানেই আলোচনার শেষ না করে আমরা মায়া-প্রসঙ্গে আর একটি চিত্তাকর্ষক বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই।

ঋগ্বেদে মায়া অবশ্যই বরুণাদি দেবতাদের craft বা কৌশল হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু শুধু দেবতাদেরই নয়, অসুরদেরও। বস্তুত ঋগ্বেদে মায়া যে প্রধানতই অসুর-শক্তি-বোধক ছিলো তা অনুমান করবার যথেষ্ট কারণ আছে; কেননা, ‘অসুরস্য মায়য়া’ বা ওই জাতীয় কথা ঋগ্বেদে বিরল নয়।

চিত্রেভিরভ্রৈরুপ তিষ্ঠথো রবং দ্যাং বৰ্ষয়থো অসুরস্য মায়য়া।
অর্থাৎ,—বিচিত্র মেঘসমূহের দ্বারা তোমরা (মিত্রাবরুণ) সরবে স্বৰ্গকে বর্ষণ করিতে থাক অসুরের মায়ার সাহায্যে।। ঋগ্বেদ : ৫.৬৩.৩ ॥

তাহলে দেবতাদের এই মায়া আসুরী বৈশিষ্ট্য বলেই পরিগণিত হতে পারে। কালক্রমে বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকদের কাছে মায়া নিন্দিত হয়েছিলো। কিন্তু সম্ভবত অসুর বলে বর্ণিত মানুষগুলির মন থেকে মায়ার মহিমা এ-ভাবে মুছে যায়নি। আর হয়তে সেই কারণেই তাদের চেতনাও প্রাক্-আধ্যাত্মবাণী— এবং সেই অর্থে লোকায়তিকই—হয়ে থেকেছিলো। আমরা ইতিপূর্বে ঋগ্বেদ থেকেই অসুরদের লোকায়তিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছি : “হে ইন্দ্র, যাহারা নিজেদের মুখে অন্নহবি প্রদান করিত তুমি মায়াসমূহের দ্বারা সেই মায়াবীদিগকে পরাজিত করিয়াছিলে।” আমরা আরো দেখেছি, তন্ত্র ও সাংখ্যকে অসুরমত বলেই গ্রহণ করবার সম্ভাবনাও সংকীর্ণ নয়। এই কারণেই কি সাংখ্যে প্রকৃতি বা অচেতন-জগৎকারণের নামান্তর হিসেবে মায়ার গৌরব অক্ষুণ্ণ থেকেছে! বেদান্তমতেও মায়াই জগৎকারণ; কিন্তু মায়া মানে মিথ্যা, তাই জগৎ মিথ্যা। অপরপক্ষে, সাংখ্যমতে এই মায়াই চূড়ান্ত সত্য। আর হয়তো তাই-ই প্রাক্‌-অধ্যাত্মবাদী বৈদিক চেতনার ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বৈদান্তিক বাদরায়ণ ওই সাংখ্যমতকেই প্রধানতম প্রতিপক্ষ হিসেবে খণ্ডন করবার চেষ্টা করেছেন।

——————–
৮৮. A. B. Keith op. cit. 1:83.
৮৯. A. A. Macdonell VM 24.
৯০. Ibid.

 

(সমাপ্ত)