1 of 2

১৫. প্রস্রাবে রক্তের ধারা

মরার দুই দিন আগে হুমায়ুন সারা দিনে প্রস্রাব করলো তিন বার, প্রস্রাবে রক্তের ধারা। তার সারা শরীর জুড়ে জ্বর মেতে ওঠে মাতালের মতো, বাড়তে বাড়তে জ্বর উঠে পড়ে ১০৬ ডিগ্রিতে। মাথায় অনেকক্ষণ পানি ঢাললে তাপ একটু কমে। জ্বর তখন আড়ি পেতে থাকে বালিশের তলায়, তোষকের নিচে। রোগীর মাথায় পানির ধারা একটু থামতে না থামতে জ্বর ফের লাফিয়ে এসে আসন পেতে বসে হুমায়ুনের কপালে। হরেন ডাক্তার বলে গেলো, এতো পানি ঢাললে নিউমোনিয়া হতে পারে, বরং কপালে জলপট্টি দিলে হয়।

অনেক রাত পর্যন্ত জলপট্টি দিলো মণ্ডলের ছোটোবিবি, পাশে পালা করে বসছিলো আজিজ ও কাদের। কিছুক্ষণ পরপর বাটির পানি পাল্টে দিচ্ছিলো হামিদা। নিজের ঘরে। জলচৌকিতে রাকাতের পর রাকাত নামাজ পড়ে চললেও নাতির প্রতিটি মুহূর্তের খবর রাখছিলো শরাফত মণ্ডল। পুবদুয়ারি ঘরে বড়োবিবি হুমায়ুনের জ্বরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিয়মমাফিক গালাগালি করছিলো স্বামীকে, রাত বাড়তে বাড়তে ক্লান্ত হয়ে না খেয়ে ও এশার নামাজ না পড়েই সে ঘুমিয়ে পড়ে। রোগীর ঘরে এশার নামাজ পড়ার পর ছোটোবিবির হাত আর চলে না, চোখ খুলে রাখাও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাদের চলে গিয়েছিলো আগেই। আজিজ আর হামিদা ছোটোবিবিকে একরকম জোর করেই পাঠিয়ে দিলো, অন্তত ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে আসুক। ছোটোবিবি চলে যাবার পরপরই আবদুল আজিজ ঝিমুতে শুরু করে, কখন গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়েছে ছেলের পায়ের কাছে সে বুঝতেই পারে নি। মিহি স্বরে তার নাক ডাকার আওয়াজ পেয়ে হামিদা আস্তে করে ডাকে, বাবরের বাপ। ও বাবরের বাপ। এতে তার নাক ডাকা থামে, কিন্তু ঘুম ভাঙে না। ঘরটা সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায়। টিনের চালে শুকনা পেয়ারা পাতা পড়ে তিন ফোঁটা শিশিরের ভারে, হালকা ভিজে শব্দে ঘরের নীরবতায় এক ফোঁটা ফাঁক থাকে না।

ঘরে একা জাগে হামিদা। জলপট্টির ভিজে ন্যাকড়া হুমায়ুনের শিওরের বালিশের পাশে রাখা কাঁসার জামবাটির পানিতে ভিজিয়ে হামিদা ওর কপালে রাখতে না রাখতে শুকিয়ে যায়, শুকিয়ে গরম হয়ে যায়। মানুষের শরীরে এতো তাপ? হুমায়ুনের শরীর থেকে ভাপ বেরোয়, এই ভাপে হামিদার চোখ জ্বলে। চোখ বুজলে একটু আরাম পাওয়া যায়। বেশ আরাম!-বাবা আম, সোনা আমার, আমার আব্বা, আমার ময়না।হামিদা তার ঠোট রাখে ছেলের কপালে, ঠোট রাখে ছেলের গালে। ঠোট রেখে সে ছেলেকে চুমু খেতে থাকে। চুমুর চুমুকে সে শুষে নেবে ছেলের সব তাপ, সব জ্বালা।আল্লা, আল্লা গো, আমার ছেলেকে তুমি ভালো করে দাও। আমার ছেলের সব রোগ, সব তাপ তুমি আমাকে দাও আল্লা। আমার হুমায়ুনকে তুমি ভালো করে দাও।আল্লাকে সে এইসব কথা বলছে, এমন সময় হামিদার পিঠে লাগে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক। তাহলে আল্লা তার মিনতিতে সাড়া দিয়েছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা পাঠিয়ে দিলো, এই শীতল বাতাসে। ছেলের গা জুড়াবে। এরপর হামিদার গায়ে লাগে আরেক ঝাপটা ঠাণ্ডা হাওয়া, তার মাথাটা আরো ঝরঝরে হয়। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নাকে লাগে লোবানের গন্ধ। লেবানের গন্ধে তার বুকে ধক করে আওয়াজ হয়, সে চট করে মাথা তোলে। তার সামনে সাদা ধবধবে কাপড়পরা কাচাপাকা দাড়িওয়ালা একটা মানুষ। লোকটার গলায় ঝোলানো লম্বা লোহার শেকল। হামিদার ডান হাতটি তখন ছেলের বুকের ওপর, সেই হাতটিতে তার ধরা রয়েছে জলপট্টির শুকনা ন্যাকড়া। তার হাতের ভারে ছেলেটা বুঝি হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু হামিদা না পারে তার হাতটা তুলতে, না পারে সাদা কাপড় জড়ানো লোকটির চেহারা থেকে চোখ সরাতে। ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ; হুমায়ুন অসুখে পড়ার পর থেকে জানলাগুলো সব সময়েই বন্ধ থাকে, আর বিকাল হতে না হতে দরজা আটকে দেয় বড়োবিবি। তাহলে এই লোকটি ঘরে ঢুকলো কী করে, এই প্রশ্নটি কিন্তু তখন হামিদার মাথায় ওঠে নি। বরং সুবেহ সাদেকের হালকা আলোর মতো একটি জিজ্ঞাসার আঁচ লাগে তার শরীর জুড়ে : এই মানুষটিকে সে কোথায় দেখেছে? কবে দেখেছে? ঘোলাটে লাল চোখে লোকটি হুমায়ুনকে দেখে। তার চোখের ঘোলাটে সাদা জমি জুড়ে ঘোলা আলো। মণিহীন চোখ সে ফেরায় হামিদার দিকে। তার ঠোট নড়ে না, কিন্তু বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ফ্যাসফেসে কথা, আর কদ্দিন? বেটাকে এখন আরাম দে, আরাম দে! লোবানের গন্ধ আরো তীব্র হয়।

এই খসখসে স্বর হামিদা আগেও শুনেছে। কোথায় শুনলো? কবে শুনলো? কোনোদিন কি শুনেছে?–এসব মনে করার চেষ্টা বাদ দিয়ে সে বলে ফেলে, যাও।। যাও। কিন্তু বোৰা-ধরা মানুষের মতো তার গলা থেকে আওয়াজ বেরোয় না। দুই কামরার মাঝখানে খোলা দরজায় পেরেক ঝোলানা হ্যারিকেনে সলতে জ্বলছিলো কালচে লাল আলোয়। সেই আলোয় মানুষটির পরনের সাদা কাপড়টিকে হামিদা কাফনের কাপড় বলে ঠাহর করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হ্যারিকেন দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গেলো। বাতি নেভার আগে দুপ-করে জ্বলে-ওঠা আলোয় কাফনের ওপর কয়েক জায়গায় ছোপ ছোপ মাটির দাগও হামিদার চোখে পড়ে। আলো যাওয়ার পর মানুষটিকে আর দেখা গেলো না। তবে এর পর উঠানে গুনগুন শোলোক শোনা যায়। গানের কথাগুলো হামিদা শুনতে পায় সবই, কিন্তু ঘর্ঘর গলার স্বর মিশে যেতে না যেতে হামিদা চিৎকার করে পড়ে যায় ছেলের বুক ঘেঁষে।।

কিছুক্ষণের মধ্যে পানির ঝাপটায় তার জ্ঞান ফেরে, ঘরে তখন ঘরভরা মানুষ। বাকি রাতটায় হুমায়ুন ছাড়া আর কারো ঘুম হয় না। হঠাৎ করে তার জ্বর নেমে আসে ১০০ ডিগ্রিতে। হামিদা রাতভর তার দেখা দৃশ্য শব্দ ও গন্ধের বিবরণ দেয়, ভয়ে কাঁপা গলায় তার বর্ণনা ক্রমেই অস্পস্ট ও এলোমেলো হতে থাকে।

শরাফতের ছোটোবিবি টের পায়, এসব চেরাগ আলি ফকিরের কেরামতি। কাউকে বলে সে কোথায় না কোথায় চলে গিয়েছে, কোথায় তার মরণ হয়েছে কে জানে? সে-ই কোনো ভেক ধরে এসে এই গাঁয়ের ছেলেদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের ঠিকানায়। হামিদার এই খোয়বের মাজেজা যদি কেউ বার করতে পারে তো এক তমিজের বাপ ছাড়া আর কেউ নয়। চেরাগ আলির সঙ্গে সঙ্গে থাকতে তো কেবল সেই। ফকিরের নাতনিকে বিয়ে করার পর তার যাবতীয় বিদ্যা, যাবতীয় বুদ্ধি, যাবতীয় ফন্দিফিকির এখন চলে এসেছে তার কবজায়। হামিদা বারবার জানায়, সে তো স্বপ্ন দেখে নি। স্বপ্নই যদি দেখবে তো হ্যারিকেন সত্যি সত্যি নিভে যায় কী করে? সে বেহুঁশ হয়ে পড়লে আবদুল আজিজ জেগে উঠে ঘর কি অন্ধকার পায় নি। তারপর, স্বপ্নে মানুষ কি আর লোবানের গন্ধ পায়? এই গন্ধটি কিন্তু ছোটোবিবির নাকেও ঢুকেছিলো।

পরদিন সকাল থেকে বাড়ির সবার মেজাজ ফুরফুরে। হুমায়ুনের জ্বর ৯৯.৫ ডিগ্রি, নেবুর রস দিয়ে সে বার্লিও খেয়েছে আধ বাটি। হামিদা কিন্তু ছেলের রোগশষ্যা থেকে এক পা নড়ে না। কিছুক্ষণ পরপর সে কেবল শিউরে শিউরে ওঠে।

তমিজের বাপেক ডাকো। বাবরের মায়ের খোয়বের তাবির না শুনলে হুমায়ুনের কী হবি কেউ করার পরবি না। মণ্ডলের ছোটোবিবি বারবার করে বললে আজিজেরও ভয় লাগে। ছেলের সঙ্গে বৌও পড়ে গেলে আবদুল আজিজের হালটা হবে কী? সুতরাং

তমিজকে দিয়ে খবর পাঠানো হলো তার বাপকে। ঘরের ব্যাপারে চারবাকর কি আধিয়ারদের জড়ানো শরাফত মণ্ডল কিংবা আজিজ একেবারেই পছন্দ করে না। কিন্তু হামিদার জোর হলো তার সৎশাশুড়ি, ছোটোবিবির সঙ্গে লাগতে যাওয়া শরাফতের। পক্ষে কঠিন। আর আজিজ কি আর নিজের বৌকে ভয় পেয়ে মরতে দেখবে?

তমিজের বাপ কিন্তু আসে নি। বেটার কাছে টুকরা টুকরা করে হামিদার স্বপ্ন বা জাগরণে দেখা ঘটনার সবটাই সে শোনে। প্রায় ঝিমাতে ঝিমাতে শোনে এবং শুনে ঝিম ধরে বসে থাকে। সন্ধ্যা হতে না হতে সানকিভরা ভাত খেয়ে মাচার ওপর চিৎপটাং হয়ে সে ঘুমায়। ঘুমের ভেতর তার যাবতীয় বিড়বিড় করা শুনতে সেদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত জেগে ছিলো কুলসুম। তমিজের বাপের মুখ থেকে মেলা আওয়াজই তো বেরোয়, কিন্তু এর কোনোটাই কুলসুমের কানে শব্দের গড়ন পায় না। তবে দাদার কোনো কোনো শোলোকের রেশ আঁচ করা যায়। এতে কুলসুমের মাথাটা শুধু কামড়ায়।

সেই রাতে নাকে লোবানের গন্ধ পেয়ে ও কানে গুনগুন শোলোক শুনে হামিদা নতুন করে ভয় পায়। ঘরভরা মানুষ সেদিন তার সঙ্গে জেগে ছিলো। হামিদার বড়ো বড়ো চোখে অপরিচিত ছায়া দেখে তাদের গা ছমছম করে। সকালবেলা কাদের তাড়া দেয় তমিজকে, তার বাপ এসে হামিদাকে অন্তত বানিয়ে বানিয়েও দুটো কথা বলুক। বাড়িতে তমিজ বাপকে রীতিমতো শাসায়, সে যদি মণ্ডলবাড়ি না যায় তো শরাফত তাদের জমি বর্গা করতে দেবে আর? বাপ এরকম করলে তমিজ কিন্তু এসপার ওসপার একটা কিছু করে ফেলবে। ছেলের হুমকিতে বাপ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, . তাকিয়েই থাকে। এ ছাড়া তার আর কোনো প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না।

কুলসুম তখন নিজে মণ্ডলবাড়ি যাবার প্রস্তাব করে। তা কুলসুম গেলেও হয়। হাজার হলেও সে হলো চেরাগ আলি ফকিরের নাতনি। তমিজ জানে তার এই সত্যটি কম মানুষ নয়। তার বাপটাকে এখনো ফকিরের কবজার মধ্যে ধরে রেখেছে এই কুলসুমই।

তমিজ ও কুলসুম পাশাপাশি হাঁটে এবং তমিজ মহা উৎসাহে হামিদার ভয় পাওয়ার গল্প বলে। অনেকটা এসে, বুলু মাঝির পালান পেরিয়ে তমিজ পেছনে তাকিয়ে দেখে, একটু দূরে ফকিরের ঘাটে দাঁড়িয়ে বাপ তাদের একসঙ্গে হাঁটা আর কথা বলা দেখছে। তমিজের বাপ দাঁড়িয়েই থাকে, তারা চলে মণ্ডলবাড়ির দিকে।

কুলসুমের কাছে হামিদা সেই রাতের বিস্তারিত বয়ান পেশ করে। সে শুরু করেছিলো ওইদিন সন্ধ্যা থেকে হুমায়ুনের কপালে জলপট্টি দেওয়া, এশার নামাজের পর তার ক্লান্ত সৎশাশুড়ির পাশের ঘরে জিরোতে যাওয়া এবং ছেলের পায়ের কাছে। আজিজের ঘুমিয়ে পড়ার বর্ণনা দিয়ে। যতোটা সময় জুড়ে এইসব কাণ্ড ঘটে, বর্ণনাতে সে বরাদ্দ নেয় প্রায় ততোটা সময়। এর ফাঁকে ফাঁকে তার ছেলের বিদ্যাবুদ্ধি, } খেলাধুলায় তার পারঙ্গমতা, ছেলের ওপর তার টাউনবাসী মামুদের প্রভাব এবং বড়ো ছেলে বাবর ও ছোটো ছেলে হুমায়ুনের স্বভাবের মিল ও পার্থক্য সম্বন্ধে অনেক তথ্য সে পরিবেশন করে যায়। অনেকগুলিই কুলসুম কিছু না বুঝলেও তার কাছে সেসব বিরক্তিকর কিংবা অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে নি। হামিদার প্রত্যেকটি কথাই সে শুনছিলো নিবিষ্টচিত্তে, তার মুখ ছিলো সম্পূর্ণ বন্ধ। মাঝে মাঝে ঠায় বসে থেকে একটুও না ঝুঁকে সে নাক টেনে গন্ধ নিচ্ছিলো, গন্ধে গন্ধে হামিদার স্বপ্নের ভুলে-যাওয়া টুকরাগুলো হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে। তবে সেই রাতে ছেলের জ্বরতপ্ত কপালে হামিদার চুমু খাওয়ার কথায় কুলসুম কেঁপে ওঠে। কাঁপুনি চেপে রাখতে চেষ্টা করলে তোলপাড় ওঠে তার বুকে, খানিকটা পাঁজরার হাড়ে এবং এতেই সেখানে বেড়ে ওঠে চেরাগ আলির গলা। কুলসুম স্পষ্ট শোনে,

খোয়বে জননী চুধে পুত্রের ললাটে।
ঝাঁপ দিয়া পড়ে বাছা মণ্ডতের ঘাটে।।
চুম্বিলে পুত্রেরে মা গো কী কহিব আর।
আজরাইল লুকায়া ছিলো ওষ্ঠেতে তোমার।।

তারপর হামিদার স্বপ্নে, হামিদা অবশ্য স্বপ্ন বলে মানতে চায় না, স্বপ্ন হলে হ্যারিকেন সত্যি সত্যি নিভে যায় কী করে?-কাফনপরা মানুষটি গায়েব হয়ে গেলে বাইরে যে শোলোক শোনা গিয়েছিলো কুলসুম সেটা শুনতে চায়। হামিদা তার একটি অক্ষরও মনে করতে পারে না, কুলসুমের বারবার তাগাদায় সে চোখ বন্ধ করে ভাবে, কিন্তু লাভ হয় না। ততোক্ষণে কুলসুম মাথার ভেতরে শোনে চেরাগ আলির দোতারার টুংটাং বাজনা। কুলসুম আস্তে করে বলে, আমি কই? মনে করা দেখেন, এই শোলোক লয়? এরপর কুলসুমের গলা একটু মোটা হয়, বোধহয় তার গলায় গাইতে শুরু করে চেরাগ আলি,

তপ্ত দেহে পোড়ে পাখি, জননীর না পড়ে আঁখি
আঁখিটি মুঞ্জিলে পরে ঘরত পাখি নাই।
ওগো ওগো মা জননী ঢাকো তোমার চোক্ষের মণি
ডিমের ভেতরে ডানা কেমনে ঝাপটাই।
জননী মুঞ্জিলে চক্ষু উড়াল দিয়া যাই।
মা জননী ঘুমাও গো এবার বিদায় চাই।।

শুনতে শুনতে হামিদার চোখে নামে ভয় আর উত্তেজনা। এই ভরদুপুরে নামে হ্যারিকেন নিভে-যাওয়া ঘনঘোট আন্ধার রাত, এর মধ্যে কুলসুমের গলায় সে শোনে সেই রাত্রির শোলোক। ব্যাকুল হাতে সে জড়িয়ে ধরে কুলসুমের হাত এবং জড়ানো গলায় বলে, ওই শোলাকই তো। একটা কথার ফারাক নাই। আরেকবার ক বুবু, আরেকুবার ক।

বুবু সম্বোধনে কুলসুম বিগলিত হয়, এক্ষুনি গুনগুন করা শোলোক তার গুলিয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে পুরো শোলোক ফের মনে করার চেষ্টা করে, হামিদা মিনতি করে, বুবু, তুই আমার মায়ের পেটের বোন। আরেকবার ক বুবু। কিন্তু হামিদার চোখ তন্দ্রায় জড়িয়ে আসছে। কুলসুম ফের বলে,

চান্দ জাগে বাঁশ ঝাড়ে কতো কতো ডিম পাড়ে।
ভাঙা ডিমে হলুদবরণ হইল সকল ঠাঁই।
উঁকি দিয়া দেখি হামার ফকির ঘরত নাই।।
ময়না পাখি উড়াল দিছে কোনঠে তারে পাই।।

হুঁ, এই গানই করিছিলো গো, মানুষটা এই গানই করিছিলো গো, মানুষটা এই গানই করিছিলো। জড়ানো জিভ থেকে তার কথা পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে, চোখজোড়া তার খুঁজে খুঁজে আসে। পিড়ি থেকে সে পড়েই যেতো, মণ্ডলের ছোটোবিবি পেছন থেকে তাকে ধরে ওঠায় এবং নিয়ে যায় হামিদার শোবার ঘরে। হুমায়ুনের পাশে তাকে শোয়াতে না শোয়াতে হামিদা ঘুমিয়ে পড়ে।

হুমায়ুনের দাফনের সময় হামিদার ভাই টাউনের এক জবরদস্ত মৌলবিকে নিয়ে এসে বাড়িটাকে দোয়াদরুদ পড়িয়ে ভালো করে বাঁধিয়ে দেয়। চল্লিশ দিন ধরে হামিদার ঘরে কোরান শরিফ পড়া হচ্ছে। তবে হামিদার দেখা কাফনপরা মানুষটার ব্যাপারে কারো কোনো গা নাই। সেই একটি রাতের পর হামিদাকে সেও তো একবার চোখের দেখাটাও দেখতে এলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *