১৫. পাশ্চাত্য-জগতে আরবের অবদান

পাশ্চাত্য-জগতে আরবের অবদান

মুসলিম-স্পেনের কলেজগুলির ফটকের গায় সাধারণতঃ একটি লিপি উল্কীর্ণ দেখা যেত। সে উল্কীর্ণ লিপিটি এই : মাত্র চারটি বস্তু পৃথিবীর ভার বহন করে : বিজ্ঞের বিদ্যা, মহতের হক-বিচার, সত্যাশ্রয়ীর এবাদাত আর সাহসীর পরাক্রম।

বিশেষ একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার যে, মুসলিম-আদর্শের এই ইউরোপীয় বর্ণনায় বিদ্যার সাধনা সকলের পুরোভাগে স্থান পেয়েছে। আরবের বাহুবল পাশ্চাত্য জগতের মনে গভীর দাগ কাটে। তবে সে দাগ বেশী দিন টিকে নাই। কিন্তু মুসলমানদের বিদ্যা ও জ্ঞান বহুপথে পাশ্চাত্য চিন্তার ভিতর অনুপ্রবিষ্ট হয়। মধ্যযুগের জ্ঞান-সাধনার ইতিহাসে মুসলিম-স্পেন একটি অত্যুজ্জ্বল অধ্যায় যোগ করে। আমরা আগে দেখেছি, অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর আরম্ভ–এ দুইয়ের মধ্যবর্তীকালে আরবী ভাষা-ভাষীরাই পৃথিবীর সর্বত্র সংস্কৃতি ও সভ্যতার আলোকবর্তিকার প্রধান বাহক ছিল। তাদেরই মাধ্যমে প্রাচীন দর্শক ও বিজ্ঞান পুনর্জীবন ও পুষ্টি লাভ করে এবং সম্প্রসারিত হয়। আর এরই ফলে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর জন্মলাভ সম্ভব হয়। মুসলিম-স্পেনের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক চিন্তানায়ক ছিলেন আলী-ইবনে-হাজম (৯৯৪–১০৬৪)। তিনি মুসলিম জগতের সর্বাপেক্ষা বেশীসংখ্যক বইয়ের লেখক এবং দুই বা তিনজন অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন বিদ্বানের অন্যতম ছিলেন। তার জীবনী লেখকেরা বলেন, তিনি ইতিহাস, ধর্ম-বিজ্ঞান, হাদীস, তর্ক-শাস্ত্র, কবিতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে ৪০০ বই লিখেন। তাঁর যেসব বই এখন পাওয়া যায়, তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে, ধর্মের তুলনামূলক বিচার বিষয়ক গ্রন্থ। এক্ষেত্রে তিনিই জগতে প্রথম গবেষক পণ্ডিত। এই গ্রন্থে তিনি বাইবেলের কাহিনী সংক্রান্ত নানা সমস্যার কথা আলোচনা করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে যে উন্নত শ্রেণীর সমালোচনা উদ্ভব হয়, তার আগে বাইবেলীয় কাহিনীর উক্ত অসামঞ্জস্য সম্বন্ধে আর কেউ কোন শব্দ করেন নাই।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপে উপকথা, গল্প ও নীতি কাহিনী ঘটিত যে সাহিত্য উৎকর্ষ লাভ করতে থাকে, তাতে পূর্ববর্তী আরবী গ্রন্থরাজির প্রভাব ও পরিচয় নিঃসন্দেহ রকমে বর্তমান। এসব আরবী গ্রন্থের ভিত্তি আবার অনেকাংশে ছিল ইন্দোপারসিক। কালীলা ও দিমনার চিত্তাকর্ষক উপকথাগুলি ক্যাস্টাইল-লিয়নের সুবিজ্ঞ এলফনসোর জন্য (১২৫২১২৮২) স্পেনীয় ভাষায় অনূদিত হয়। কিছুকাল পর খৃস্টধর্মে দীক্ষিত একজন ইহুদী ল্যাটিনে এর অনুবাদ করেন। ফারসীতে এর যে অনুবাদ ছিল, ফরাসী ভাষা মারফত তাই লা ফনটেইন’ গ্রন্থের অন্যতম মূল ছিল। কবি নিজে একথা স্বীকার করেছেন। ‘মাকামা’ ছন্দোময় গদ্যে লিখিত গ্রন্থ। এতে শব্দ-বিজ্ঞানের অনেক কৌতূহলোদ্দীপক অলংকার রয়েছে। কোন সুন্দরীর দেহরক্ষী বীরপুরুষের দুঃসাহসী কাজের বর্ণনার মারফত এতে নৈতিক উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মাকামার সঙ্গে স্পেনীয় ভাষার বর্ণনামূলক উপন্যাসগুলির ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য অনস্বীকার্য। কিন্তু আরবী ভাষা তার প্রকাশ-ভঙ্গী দ্বারা যে প্রভাব বিস্তার করে, ইউরোপের মধ্যযুগীয় সাহিত্যে তাই তার শ্রেষ্ঠ অবদান। এ প্রভাব ইউরোপীয় সাহিত্যকে তার চিরাচরিত প্রথার নির্মম সংকীর্ণতা হতে উদ্ধার করে। স্পেনীয় সাহিত্যের ভাব-ঐশ্বর্যের মূলে আছে আরবী-সাহিত্যের আদর্শ। উদাহরণ স্বরূপ, সারভেনটিস লিখিত ‘ডন কুইজটের পরিহাস রসের কথা বলা যায়। গ্রন্থকার একদা আলজিয়ার্সে বন্দী ছিলেন এবং তামাসা করে বলতেন যে, আরবীতে তার বইয়ের একটা মূল কপি আছে। যখনই যেখানে আরবী ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, তখনই সেখানে কবিতা রচনার তীব্র আকাভা দেখা গেছে। অসংখ্য কবিতা মুখে মুখে চলত এবং ছোট বড় সবারই প্রশংসা লাভ করত। শব্দের সৌন্দর্য ও শ্রুতি-মাধুর্যের এই যে অনিবার্য আকর্ষণ ও আনন্দ, এ আরবী ভাষাভাষীদের প্রকৃতিগত। স্পেনীয় ভাষাতেও এ বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়। প্রথম উমাইয়া শাসনকর্তা কবি ছিলেন। তাঁর পরবর্তী কতিপয় খলীফারও কবিতা রচনার সুনাম ছিল। বেশীর ভাগ খলীফার দরবারেই রাজ-কবি থাকত এবং ভ্রমণ বা যুদ্ধকালে খলীফারা কবিদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সেভিল সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক কবির গর্ব করত। তবে এ কবিতার মশাল অনেক আগে কর্ডোভায় প্রজ্জ্বলিত হয় এবং গ্রানাডা যতকাল মুসলিম-শক্তির অধিষ্ঠান ভূমি ছিল, ততকাল তথায় এ মশাল জ্বলতে থাকে।

ইবনে-জায়দুন (১০০৩–১০৭১) একজন প্রতিষ্ঠাবান কবি ছিলেন। এক আরব অভিজাত বংশে তাঁর জন্ম হয়। তিনি প্রথমে কর্ডোভা রাজ-শক্তির বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ছিলেন। পরে তিনি রাজ-অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হন। জনৈক খলীফার কবি কন্যা ওয়াল্লাদার প্রতি জায়দুনের প্রবল আসক্তিই বোধহয় তার পতনের কারণ ছিল। কয়েক বছর কারাগার ও নির্বাসনে থাকার পর তিনি মুক্তি লাভ করেন এবং উজিরে আজম ও সিপাহসালারের যুক্ত পদে নিযুক্ত হন। তাঁর উপাধি হয় ‘দুই ওজাতের অধিকর্তা-কলমের ওজরত আর তলোয়ারে ওজারত। উক্ত সুন্দরী এবং প্রতিভাশালিনী ওয়াল্লাদাকে মৃত্যু ১০৮৭ অপরূপ সৌন্দর্য ও সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা উভয় দিক দিয়ে গ্রীসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাচীন গীতি-কবি স্যাফফোর সঙ্গে তুলনা করা হয়। কবিতা ও সাধারণ-সাহিত্য উভয়ের প্রতি স্পেনীয় আরব নারীর একটা প্রবল আকর্ষণ ছিল।

সনাতন রীতির আওতা হতে আংশিক মুক্তি লাভ করে স্পেনীয় আরবী কবিতা নব নব প্রকাশ-ভঙ্গী এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি প্রায় আধুনিক মনোভাব গড়ে তোলে। মধ্যযুগীয় দুঃসাহসিক বীরত্ববাদের দৃষ্টিভঙ্গী আগেই। আরবী লোক-গাথা ও প্রেম-গীতির অভিনব ভাব-লালিত্যে আত্মপ্রকাশ করে। কণ্ঠ ও যন্ত্র উভয় প্রকার সঙ্গীতই বরাবর কবিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রক্ষা করে চলত।

আরবী কবিতা সাধারণভাবে ও এর গীতি কবিতাংশ বিশেষভাবে দেশীয় খৃস্টানদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে এবং উভয় সংস্কৃতির মিলনে সাহায্য করে। ক্যাস্টাইলের লোক-প্রিয় ভিলানসিকো’ কবিতা আরবী গীতি-কবিতা হতে গড়ে ওঠে। এ কবিতা খৃস্টানদের প্রার্থনার বিশেষ করে বড় দিনের আনন্দ-সঙ্গীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত।

অষ্টম শতাব্দীতে স্পেনীয় সাহিত্যে প্ল্যাটোনিক (নিষ্কাম) প্রেমের যে একটা বিশেষ প্রকাশ-ভঙ্গী বিকাশ লাভ করে, তা আরবী কবিতারই প্রভাবের ফল। দক্ষিণ ফ্রান্সে প্রথম প্রভেনকাল’ কবিদের আবির্ভাব ঘটে একাদশ শতাব্দীতে এবং তারা পুরাদস্তুর নিপূণ কাব্যকারের মত অদ্ভুত এবং অপূর্ব কল্পনা বিনাসের বিচিত্র লীলায় তাঁদের অদম্য প্রেষকে রূপদান করেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে ট্রাবেডুরদের অভ্যুদয় হয় এবং তারা তাদের দক্ষিণ অঞ্চলে সমসাময়িক গজল গায়কদের অনুকরণ করেন। চ্যানসন-ডি-রোল্যান্ড প্রাথমিক যুগের ইউরোপীয় সাহিত্যের মহত্তম কীর্তি। ১০৮০ সালের আগে রচিত এ গ্রন্থ এক নতুন সভ্যতার সূচনা করে। এই সভ্যতাই পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতা। এ গ্রন্থের উদ্ভব হয় মুসলিম-স্পেনের সঙ্গে এক সামরিক সংঘর্ষের ফলে।

আমরা দেখেছি, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল। আর সব মুসলিম দেশের মত এখানেও কোরআন এবং আরবী ব্যাকরণ ও কবিতার উপর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি স্থাপিত হয়। শিক্ষিত মহলে নারীর যে ইজ্জত ছিল, তাতে প্রমাণিত হয় যে, নারীরা লিখতে পারে না বলে যে প্রবাদ ছিল তা আন্দালুসিয়াতে পালিত হয় নাই। উচ্চশিক্ষার বুনিয়াদ ছিল কোরআনের তফসীর, হাদীস, ফেকা, দর্শন, কাব্য, ইতিহাস, ভূগোল, অভিধান রচনা-রীতি এবং আরবী ব্যাকরণ । প্রধান শহরগুলি অনেকটিতেই উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল। সেসবকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়। এ শহরগুলির মধ্যে প্রধান ছিল কর্ডোভা, সেভির, মালাগা এবং গ্রানাডা। কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম-শাস্ত্র ও আইন-শাস্ত্র ছাড়া জ্যোতিষ, গণিত এবং চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ানো হত। এখানে নিশ্চয়ই হাজার হাজার ছাত্র ছিল এবং এখানকার সনদের দৌলতে রাজ্যের বড় বড় চাকরী পাওয়া যেত। গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য বিষয়ের তালিকায় ছিল ধর্ম শাস্ত্র, আইন শাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র, রসায়ন, দর্শন এবং জ্যোতিষশাস্ত্র ক্যাস্টিলিয়ার এবং অন্যান্য বিদেশী ছাত্র এখানে লেখাপড়া করত।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে কুতুবখানা উন্নতি লাভ করে। কর্ডোভার রাজকীয় কুতুবখানা সর্বাপেক্ষা বড় ও শ্রেষ্ঠ ছিল। অনেকের ব্যক্তিগত সংগ্রহও ছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন নারীকেও দেখা যায়। রাজনৈতিক সভা ও থিয়েটার গ্রীস ও রোমের জাতীয় জীবনের এক অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ছিল। মুসলিম-জগতে এ দুইয়ের একান্ত অভাব হেতু বই-ই তাদের জ্ঞানার্জনের একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়।

বাগদাদ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছি যে, ইউরোপে কাগজ আমদানী সে মহাদেশের প্রতি ইসলামের মহত্তম অবদানসমূহের অন্যতম ছিল। আন্দালুসিয়াতে এই কাগজ উৎপন্ন হত। আর ওখানে কাগজ উৎপন্ন না হলে আন্দালুসিয়াতে এত বই স্থূপীকৃত করা সম্ভবপর হত না। কাগজ তৈরীর বিদ্যা প্রাচ্য হতে প্রথমে মরক্কোতে যায় এবং দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে স্পেনে প্রবেশ করে। এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি আজো ইংরেজি ‘রীম’ শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে। শব্দটি আসলে ছিল আরবী ‘রিজমা’। স্পেনীয় ভাষায় গিয়ে শব্দটি হয় ‘রেসমা । আর স্পেন হতে ফরাসী ভাষায় গিয়ে শব্দটি হয় রেইম’। তারপর ফরাসী ভাষা হতে ইংরেজিতে বীম’ শব্দের আকারে নব-রূপ গ্রহণ করে। সিসিলীর মুসলিম-প্রভাব ইতালীতে বিস্তৃত হয় এবং স্পষ্টতঃই সেই প্রভাবের ফলে ১২৭০ সালের কাছাকাছি সময়ে ইতালীতে কাগজ তৈরীর শিল্প প্রবর্তিত হয়। কেউ কেউ বলেন, ক্রুসেডাররা ফিরে এসে ফ্রান্সে প্রথম কাগজের কল স্থাপন করে। কিন্তু এ কথা সত্য নয়। আসলে ফ্রান্স প্রথম কাগজের কলের জন্য মুসলিম-স্পেনের নিকট ঋণী। এইসব দেশ হতে কাগজ-শিল্প বাকী ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। আবদুর রহমানের এক সেক্রেটারী নিজ বাড়ীতে বসে চিঠিপত্র লিখতেন। তারপর কপি করার জন্য সেগুলি এক বিশেষ অফিসে পাঠানো হত। এ ছিল এক রকম প্রিন্টিং। এখান হতে পত্রের কপি সরকারের বিভিন্ন দফতরে বিলি হত।

স্পেনে মুসলিম-শক্তি বিধ্বস্ত হওয়ার পর দুই হাজার বালামেরও কম বই রক্ষা পায় এবং সেসব বই দ্বিতীয় ফিলিপ (১৫৫৬-১৫৯৮) ও তার পরবর্তী বিভিন্ন আরব লাইব্রেরী হতে সংগ্রহ করেন। এইসব বই দিয়েই এসকুরিয়াল লাইব্রেরী শুরু হয়। আজো সে লাইব্রেরী মাদ্রিদের অদূরে অবস্থিত আছে। এ লাইব্রেরীর সঙ্গে অন্যান্য বালাম কিভাবে এসে যুক্ত হয়, তার একটা মজার কাহিনী আছে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মরক্কোর সুলতান রাজধানী হতে পালিয়ে যাওয়ার সময় তার কুতুবখানাটি এক জাহাজে পাঠিয়ে দেন। জাহাজের ভাড়া পুরোপুরি অগ্রিম না পাওয়ায় জাহাজের কাপ্তান বইগুলি নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দিতে অস্বীকার করে। মার্সাই যাওয়ার পথে জাহাজটি স্পেনীয় জলদুস্যর কবলে পড়ে। নূষ্ঠিত বইগুলি সংখ্যায় তিন হতে চার হাজার–তৃতীয় ফিলিপের হুকুম মোতাবেক এক্ষুরিয়াল লাইব্রেরীতে জমা দেওয়া হয়। এইরূপে এস্কুরিয়াল  লাইব্রেরী আরবী পাণ্ডুলিপির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

ইবনুল খতীব ও ইবনে খালদুন ছিলেন দুই বন্ধু। সাহিত্যিক পারদর্শিতা এবং ঐতিহাসিক প্রজ্ঞার দিক দিয়ে এঁরা দুইজন পাশ্চাত্য-ইসলামের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি ছিলেন। ইবনুল খতীব উজীর ছিলেন। কোন দরবারী ষড়যন্ত্রের ফলে তিনি ১৩৭১ সালে গ্রানাডা হতে পলায়ন করেন। এর তিন বছর পর ব্যক্তিগত কলহের ফলে কাছ নামক স্থানে তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে গ্রানাডা-হয়তো সমস্ত স্পেনই তার শেষ কৃতী সাহিত্যিক, কবি ও রাজনীতিজ্ঞকে হারায়। কবিতা, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, চিকিৎসা প্রভৃতি নানাবিষয়ে তিনি ৬০ খানা বই লেখেন। তার মধ্যে ২০ খানা এখনো পাওয়া যায়। এ সবের মধ্যে গ্রানাডার ইতিহাস আমাদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বই।

ইবনে খালদুন তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি মুকাদ্দামার জন্য বিখ্যাত। মুকাদ্দামা ইতিহাসের ভূমিকা বিষয়ক বই। দেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও আবহাওয়া এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি এ সমস্তই যে ইতিহাসের বিকাশ-ধারাকে প্রভাবিত করে, এ মতবাদ তিনিই প্রথম এ পুস্তকে ব্যক্ত করেন। তিনি জাতীয় জীবনের উন্নতি ও অবনতির আইন খুঁজে বের করতে সাধনা করেছেন। এ হিসেবে তাকে ইতিহাসের প্রকৃত ক্ষেত্র ও প্রাকৃতিক আবিষ্কর্তা বলা চলে। তিনি নিজেও এ দাবী করেছেন। অন্ততঃপক্ষে তাকে সমাজ-বিজ্ঞানের প্রকৃত স্থাপয়িতা বলতেই হবে। ইতিহাসের এমন ব্যাপক ও দার্শনিক ধারণা তার আগে কখনো কোন আরব, এমন কি কোন ইউরোপীয়ানের কল্পনায় আসে নাই। ১৪০৬ সালে ইবনে খালদুনের মৃত্যু হয়। সমস্ত সমালোচক সমবেত কণ্ঠে স্বীকার করেন যে, ইবনে খালদুন ইসলামের সবচেয়ে বড় এবং জগতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক দার্শনিকদের অন্যতম ছিলেন।

আরবদের ভৌগোলিক গবেষণা পাশ্চাত্যের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে নাই। তবে পৃথিবী যে গোল, তারা এ প্রাচীন ধারণাকে জিইয়ে রাখে। আমরা আগেই বলেছি, হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল যে, আমরা পৃথিবীর যে অর্ধাংশকে জানি তার একটা মধ্যবিন্দু বা কেন্দ্র আছে চারদিক হতে এই কেন্দ্র সমদূরে অবস্থিত। ১৯১০ সালে প্রকাশিত একটি ল্যাটিন বইয়ে এই ‘আরিন’ মতবাদ প্রবেশ লাভ করে। এই বই হতে কলম্বাস তাঁর মতবাদ গঠন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবী আকারে নাশপতির মত এবং পূর্ব গোলার্ধের ‘আরিন’–এর ঠিক উল্টা দিকে পশ্চিম গোলার্ধেও একটি আরিন আছে।

গ্রহ-বিজ্ঞান ঘটিত ভূগোল ও গণিতের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য-জ্ঞানভাণ্ডারে কয়েকটি নতুন ধারণা দান করা হয়। দশম শতাব্দীর মধ্য ভাগের পর স্পেনে দস্তুরমত গ্রহ-বিজ্ঞানের অধ্যয়ন শুরু হয় এবং কর্ডোভা, সেভিল ও টলেভোর শাসনকর্তারা জ্ঞানের এশাখাকে যথেষ্ট প্রীতির চোখে দেখতে থাকেন। আন্দালুসীয়ার অধিকাংশ গ্রহ-বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করতেন যে, জীবন-মৃত্যুর মাঝখানের বেশীর ভাগ ঘটনার উপরই গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব সক্রিয়। এই নক্ষত্রের প্রভাব সম্পর্কিত গবেষণা হতেই জ্যোতিষশাস্ত্রের উদ্ভব হয়। এই শাস্ত্র অনুশীলনের জন্য অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমার হিসেব মোতাবেক পৃথিবীর সকল স্থানের অবস্থান নির্ণয় করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এইরূপে জ্যোতিষশাস্ত্র হতে গ্রহ-বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়। ল্যাটিন-পাশ্চাত্য স্পেনের মারফতই প্রাচ্য পণ্ডিতগণ গ্রহ-বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র ঘটিত প্রেরণা লাভ করেন। স্পেনে মুসলমানদের গ্রহ-বিজ্ঞানের প্রধান বইগুলি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং ব্রয়োদশ শতাব্দীতে দশম এলফনসো যে এলফোনসাইন নির্ঘন্ট তৈরী করেন, তা আরব গ্রহ-বিজ্ঞানের উন্নত সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয়। আরবদের নক্ষত্র বিষয়ক গবেষণার ফলে আমরা তাদের নিকট হতে স্ফিরিকাল ও সরল ত্রিকোণমিতির প্রথম অধ্যায় পেয়েছি। কারণ, এলজাবরা ও বিশ্লেষণমূলক জ্যামিতির মত ত্রিকোণমিতিও অনেকাংশে আরবরা উদ্ভাবন করে। একটা সাধারণ আকাশ গোলকে যেসব তারার নাম থাকে, তার দিকে একটু চাইলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে, আরব গ্রহ-বিজ্ঞানীরা আকাশের গায় তাদের সাধনার অমর-চিহ্ন রেখে গেছেন। ইউরোপীয় ভাষায় তারার যে সব নাম আছে, তার অধিকাংশই আরবী ভাষা হতে উদ্ভূত। যেমন–আকরাম (আকরাব–বিছা), অ্যালগেডী (আল-জোদী-ছাগল ছানা), অ্যালটেয়ার (আল-তায়ের–উড়নেওয়ালা), ডেনের (ধানব–লেজ), ফারকাড (ফারকাদ-বাছুর)। এছাড়া অনেক পরিভাষাও আরবী হতে নেওয়া হয়েছে। যথা : এজিমুথ (আস-সুমুত), নাদির (নাজির), জেনিথ (আল-সামত)। এসব থেকেই স্পষ্টই বোঝা যায় যে, ইসলাম খৃস্টান-ইউরোপকে কি অজস্র দানই না করেছে।

আরবী হতে যেসব গণিত-ঘটিত শব্দ ধার নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে নিতান্ত কৌতূহল-উদ্দীপক একটি শব্দ হচ্ছে, সাইফার বা জিরো (শূন্য)। আরবরা শূন্য আবিষ্কার করে নাই বটে, কিন্তু তারা আরব-সংখ্যার সঙ্গে শূন্য’ ইউরোপে আমদানী করে এবং ইউরোপীয়দের এর ব্যবহার শিক্ষা দেয়। এরই ফলে জীবনের দৈনন্দিন ব্যাপারে গণিতের ব্যবহার সম্ভব হয়।

অমুসলিম-ইউরোপে আরবী সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকম ধীরগতিতে বিস্তৃতি লাভ করে। সমস্ত একাদশ, দ্বাদশ এবং এয়োদশ শতাব্দীর কতকাংশ পর্যন্ত খৃস্টান গণিতবিদরা কোমর বেঁধে সেকেলে রোমক সংখ্যা ব্যবহার করতে থাকে; অবশ্য মাঝে মাঝে আপোষ সূত্রে তারা রোমক সংখ্যা ও নতুন আল গোরিজম পাশাপাশি ব্যবহার করত। ইটালীতেই সর্বপ্রথম এই নতুন সংখ্যা ব্যবহারিক জীবনে খাটানো শুরু হয়। পাইসার লিওনার্ডো ফিবোনাকসি মুসলিম ওস্তাদের নিকট শিক্ষালাভ করে উত্তর আফ্রিকায় পরিভ্রমণ করেন। তিনি একখানি বই প্রকাশ করেন। এই বই-ই আরবী সংখ্যা প্রবর্তনে সবচেয়ে বেশী সাহায্যে করে। তারো চেয়ে বড় কথা এই যে, এই বই হতেই ইউরোপীয় গণিত শুরু হয়। পুরাতন সংখ্যার সাহায্য কোন কোন ক্ষেত্রে গণিতের অগ্রগতি অসম্ভব হত । আমরা বর্তমানে যে হিসাব-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত, তার মূলে ছিল আরবী সংখ্যা ও গুণ্য।

গ্রহ-বিজ্ঞান ও গণিতের মত উদ্ভিদ-বিজ্ঞানেও পাশ্চাত্য মুসলিমরা তাঁদের গবেষণা দ্বারা পৃথিবীর জ্ঞান-ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁরা খেজুর গাছ ও শন প্রভৃতি বৃক্ষ-লতার যৌন-পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করেন। বৃক্ষ-লতাকে তারা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেন : যথা–যে সব উদ্ভিদ কলম হতে জন্মে, যে সব বীজ হতে জন্মে আর যে সব (তাদের বিবেচনায়) আপনা-আপনি জন্মে। সেভিলের ইবনুল আওয়াম দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কৃষি সম্বন্ধে একখানি বই লেখেন। এই বইখানি সমগ্র মুসলিম-জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম তো ছিলই, উক্ত বিষয়ে মধ্যযুগীয় শ্রেষ্ঠতম বইসমূহেরও অন্যতম ছিল। কতকটা পূর্ববর্তী গ্রীক ও আরব গবেষণা ও কতকটা স্পেনের মুসলিম কৃষকদের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে এ বইয়ে ৫৮৫টি উদ্ভিদ এবং পঞ্চাশটির অধিক ফল গাছ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়। গাছে কলম করা, বিভিন্ন রকম জমি ও সারের গুণাগুণ, আঙ্গুর ও অন্যান্য গাছের ব্যারামের লক্ষণ এবং সে ব্যারামের সহজ প্রতিকার ইত্যাদির উপর নতুন আলোকপাত করা হয়।

ইবনুল বায়তার স্পেনের হয়তো সমগ্র মুসলিম-জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ ও ঔষধ-মিশ্রণ বিজ্ঞানী ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তার লিখিত সহজ প্রতিকার’ মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ ছিল।

স্পেনীয় আরব চিকিৎসকদের বেশীর ভাগেরই চিকিৎসা ছিল একটা অতিরিক্ত পেশা। আসল পেশা ছিল অন্যকিছু। ইবনুল খতীব আরো অনেক চিকিৎসকের মত উজীরের পদে সমাসীন ছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কালো মৃত্যু’ ইউরোপকে উৎসন্ন করতে থাকে। খৃষ্টান চিকিত্সকরা এ ব্যারামকে আল্লাহর গজব মনে করে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তখন গ্রানাডার এই মুসলিম চিকিৎসক সংক্রমণবাদের বাস্তব দিক বিশ্লেষণ করে একখানি বই লিখেন। বইখানিতে একটি সত্যিকার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়, যথা : ‘কেউ কেউ বলেন, সংক্রমণবাদকে কি করে স্বীকার করতে পারি?’ তাঁদের আমরা বলি : অভিজ্ঞতা, অনুসন্ধান, ইন্দ্রিয়ের সাক্ষ্য এবং নির্ভরযোগ্য দলীল সমস্তই সংক্রমণের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। কাজেই আমাদের যুক্তি নির্ভুল। যখন কেউ নিজ চোখে দেখে যে, ব্যারামীর কাছে গেলেই ব্যারাম হয়, আর দূরে থাকলেই ব্যারাম হয় না এবং কাপড়-চোপড়, বাসন-কোসন ও কানের গয়না মারফত কি রকমে ব্যারাম ছড়িয়ে পড়ে, তখন আর সংক্রমণের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তার কোন সন্দেহ থাকে না।

স্পেনে মুসলিম-আধিপত্যের প্রথম কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচ্য সংস্কৃতি উন্নততর স্তর হতে আন্দালুসীয়াতে প্রবাহিত হতে থাকে। স্পেনের জ্ঞানীরা বিদ্যার অন্বেষণে মিসর, সিরিয়া, ইরাক, পারস্য এবং ট্রান্স অকসিয়ানা ও চীন পর্যন্ত চলে যেতেন। কিন্তু একাদশ শতাব্দী হতে শুরু করে পরবর্তী শতাব্দীসমূহে স্রোতের গতি ফিরে যায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে এই স্রোত এত কেঁপে ওঠে যে, তা ইউরোপেও গড়িয়ে পড়ে। আরব চিকিৎসা-বিজ্ঞান ইউরোপে প্রচার করার কাজে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা এবং স্পেন–বিশেষ করে টলেডো উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করে। এই টলেডোতেই ক্রেমোনার জিয়ার্ড এবং মাইকেল স্কট কাজ করতেন। এইভাবে মুসলিম, খৃস্টান ও ইহুদী চিকিৎসাশাস্ত্রের পরস্পর সাক্ষাৎ ঘটে এবং ভবিষ্যৎ মিলনের পথ প্রশস্ত হয়। এই উপায়ে এবং কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থ। মারফত কতকগুলি আরবী পরিভাষা ইউরোপীয় ভাষায় প্রবেশ করে। যথা : জ্বলেপ’–(আরবী জুলাব), ফারসী গুলাব–গোলাব পানি) ঔষধ মিশ্রিত সুগন্ধ পানীয়; সীরাপ’ (আরবী শরাব) সরকারী ফরমূলা মোতাবেক তৈরী চিনির শরবত অনেক সময় ঔষধ মিশ্রিত। সোডা’–মধ্যযুগীয় ল্যাটিনে এর মানে ছিল মাথাধরা; আর সোডানাম’-এর মানে ছিল মাথা-ধরার ঔষধ। আসলে এ শব্দের মূল আরবী হচ্ছে, সুদা’–মাথার তীব্র বেদনা। আরবী হতে যেসব রাসায়নিক শব্দ ল্যাটিন মারফত ইউরোপীয় ভাষায় চলে গেছে, তার মধ্যে ‘অ্যালকোহল’, এলেমবিক’, ‘অ্যালকালী’ এবং অ্যানটিমনী’ উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রেই স্পেনীয় আরবরা মহত্তম কীর্তি অর্জন করে। গ্রীক-দর্শনকে স্পেনীয় ও প্রাচ্য দেশীয় মুসলিম মনীষীদের হাতে প্রয়োজন মোতাবেক–বিশেষ করে বিশ্বাসও যুক্তি ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের ব্যাপারে রূপান্তরিত করা হয় এবং সেই রূপান্তরিত জ্ঞান পাশ্চাত্যে প্রেরিত হয়। যে দর্শন গ্রীক মনীষীর সাধনায় এবং যে একেশ্বরবাদ-মূলক তত্ত্ব হিব্রু পয়গম্বরদের সাধনার বিকাশ লাভ করে, দুনিয়ার প্রতি প্রাচীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেই ছিল শ্রেষ্ঠতম অবদান।

পশ্চিম ইউরোপে এইরূপে যে নতুন ভাবধারা প্রথম প্রবেশ করে, তা প্রধানতঃ ছিল দর্শন ও চিকিত্সা ঘটিত এবং এই ভাবধারাই ‘অন্ধকার যুগের অবসান এবং তত্ত্ব-সাধকদের যুগের আগমন সূচনা করে। ইউরোপীয় পণ্ডিত ও দার্শনিকরা আরবদের সংস্পর্শে উজ্জীবিত হয়ে এবং গ্রীক জ্ঞানের নব পরিচয়ে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে অল্পকাল মধ্যে নিজেরা স্বাধীনভাবে জ্ঞান-সাধনা শুরু করেন। আজো আমরা তারই ফল ভোগ করছি।

আমরা এখানে মুসলিম স্পেনের কৃতী দার্শনিকদের মাত্র কয়েক জনের নাম করতে পারি। এদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন ইবনে তোফায়েল (মৃত্যু ১১৮৫)। হায়য়ী-ইবনে-ইয়াজান’ (জাগ্রত জনের পুত্র জীবন্ত ব্যক্তি) নামক দার্শনিক উপখ্যান তার শ্রেষ্ঠতম কীর্তি। এ গ্রন্থের মূলকথা এই যে, মানুষের ধারণা শক্তি বাইরের কোন সহায়কের আনুকৌল্য ছাড়াও উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং সে যে সর্বশক্তিমানের উপর নির্ভরশীল, ক্রমে ক্রমে তাও সে আবিষ্কার করতে পারে। কাহিনীটি মধ্যযুগীয় সাহিত্যে একটি মনোরম এবং মৌলিক অবদান। কেউ কেউ মনে করেন যে, রবিনসন ক্রুসোর মূল উৎস এই গ্রন্থ। বইটি ১৬৭১ খৃস্টাব্দে ছোট (ইয়াঙ্গার) এডওয়ার্ড পোক’ক কর্তৃক ল্যাটিনে অনূদিত হয়। এরপর ইউরোপের অন্যান্য বহু ভাষায় এর অনুবাদ হয়; যথা–১৬৭২ খৃস্টাব্দে ডাচ ভাষায়, ১৯২০ খৃস্টাব্দে রুশ ভাষায় এবং ১৯৩৪ খৃস্টাব্দে স্পেনীয় ভাষায়।

সুবিখ্যাত মনীষী চিন্তানায়ক ইবনে রুশদ ১১২৬ সালে কর্ডোভা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রহ-বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং আরাস্তুর ভাষ্যকার ছিলেন। পাশ্চাত্য-জগতের উপর তিনি যে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেন, সে হিসেবে তাকে মুসলিম জগতের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক বলতে হয়। ইবনে রুশদের বড় অবদান একটি চিকিৎসা-পুস্তক। এতে তিনি বলেন যে, বসন্ত একজনকে একাধিকবার আক্রমণ করে না। তিনি রেটীনার কাজ নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেন। ইহুদী ও খৃস্টান জগতে কিন্তু তিনি প্রধানতঃ আরাস্তুর ভাষ্যকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মধ্যযুগের ভাষ্যকার মানে ছিল, সেই ব্যক্তি যিনি পূর্ববর্তী চিন্তাবিদের লেখাকে পটভূমি করে কোন বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক বই লিখতেন। এই নিয়ম অনুসারে ইবনে রুশদ এক সিরিজ বই লেখেন এবং তাতে তিনি আংশিকভাবে আরাস্তুর বইয়ের নাম ব্যবহার করেন এবং তাঁর লেখার ব্যাখ্যা করেন। তিনি এশিয়া বা আফ্রিকার ছিলেন যতখানি, তার চেয়ে বেশি ছিলেন ইউরোপের। পাশ্চাত্য-জগতের চোখে আরাস্তু যেমন ছিলেন ‘প্রকৃত শিক্ষক, ইবনে রুশদ তেমনি ছিলেন প্রকৃত ভাষ্যকার।’ মধ্যযুগীয় ইউরোপের খৃস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ ও পণ্ডিতদের মনে ইবনে রুশদ যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন, এমন আর কোন গ্রন্থকারই করতে পারেন নাই। ইবনে রুশদের বই প্রথমে স্পেনের গোঁড়া মুসলমানদের মনে, পরে তালমুদীদের মনে এবং সর্বশেষে খৃস্টান পাদ্রী-পুরোহিতদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে মোড়শ শতাব্দীর অবসান কাল পর্যন্ত চিন্তা-জগতে ইবনে রুশদের মতবাদই প্রবল থাকে। ইবনে রুশদ যুক্তিবাদী ছিলেন এবং ধর্মের প্রত্যাদিষ্ট আদেশ-নিষেধ ছাড়া সব বস্তুরই স্বাধীনভাবে যুক্তির সাহায্যে বিচারের অধিকার দাবী করতেন। কিন্তু অনেকে যে মনে করে তিনি স্বাধীন চিন্তা ও কুফরের জনক এবং ধর্মের শত্রু ছিলেন, তা মোটেই সত্য নয়। প্রাথমিক মুসলিম আরাস্তুবাদীরা নিও-প্যাটোনিক ধরনের কতকগুলি বই সহ অনেকগুলি প্রক্ষেপ-দুষ্ট বইকে নিভাজ বলে মনে করেন। ইবনে রুশদের দর্শন সে সব বর্জন করে অকৃত্রিম ও বিজ্ঞানসম্মত আরাস্তুবাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। পাদ্রীদের দ্বারা আপত্তিকর অংশ বাদ দেওয়ার পর তাঁর লেখা প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবইরূপে, নির্বাচিত হয়। এ লেখার যত নিন্দা ও ভুল ব্যাখ্যাই থাক, তবু আধুনিক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের অভুদয়ের আগ পর্যন্ত ইবনে রুশদের প্রবর্তিত চিন্তাধারাই ইউরোপীয় চিন্তা-জগতে জীবন্ত শক্তিরূপে ক্রিয়া করতে থাকে।

ইবনে রুশদের পর এ যুগের দার্শনিকদের মধ্যে প্রথম স্থানের দাবীদার হচ্ছেন, তাঁর সমসাময়িক কর্ডোভার মনীষী ইবনে মায়মুন। ইনি মোশেহ মায়মুন। বা মায়মুনাইডিস বলেও বিখ্যাত। সমস্ত আরবীয় অগ্রগতির যুগের মধ্যে ইনিই সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ইহুদী চিকিৎসক ও দার্শনিক ছিলেন। ১১৩৫ সালে ইনি কর্ডোভায় জন্মগ্রহণ করেন; তাঁর পরিবার ১১৬৫ সালে কায়রোতে চলে যায়। কেউ কেউ বলেন যে, স্পেনে ইবনে মায়মুন প্রকাশ্যে নিজকে মুসলমান বলে পরিচয় দিতেন; কিন্তু নিজ গৃহে গোপনে ইহুদী ধর্ম পালন করতেন। ইদানীং গবেষকরা সকলে এ মত সমর্থন করতে পারেন নাই। কায়রোতে তিনি বিশ্ববিশ্রুত সালাহউদ্দীন ও তার পুত্রের সরকারী চিকিৎসক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সাল হতে তিনি কায়রোর ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মযাজক ছিলেন। এইখানে ১২০৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর ওসিয়ৎ মোতাবেক যে পথে একদা হযরত মুসা চলেছিলেন, সেই পথে তার লাশ হাতে বহন করে টাইবেরিয়াসে সমাহিত করা হয়। আজো সেখানে তার অনাড়ম্বর সমাধির পাশে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী সমবেত হয়ে থাকে। কায়রোতে রাব্বী মোশে-বেন-মায়মুনের যে গীর্জা (সিনাগগ আছে, আর সংলগ্ন ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে দূর দূরান্তর হতে দরিদ্র ইহুদী বিমারীরা এসে ভিড় করে এবং তথায় রাত্রি যাপন করে রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করে। ইহুদী সমাজে যে তিনি কত বড় শ্রদ্ধার আসন অধিকার করে আসছেন, তা সে সমাজে প্রচলিত এই প্রবাদ বাক্যটিতেই বোঝা যায় : মুসা হতে মুসা পর্যন্ত মুসার মত কেউ ছিল না?

ইবনে মায়মুন গ্রহ-বিজ্ঞানী, ধর্ম-বিজ্ঞানী, চিকিত্সক এবং সর্বোপরি দার্শনিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ত্বক-ছেদন পদ্ধতির উন্নতি বিধান করেন, কোষ্ঠ কাঠিন্যকে হেমোরাইডস ব্যারামের কারণ বলে রায় দেন এবং স্বাস্থ্য বিজ্ঞান সম্বন্ধে উন্নত ধারণা পোষণ করতেন। তাঁর প্রধান দার্শনিক গ্রন্থের নাম ‘দালালাতুল হায়রিন’ (বিভ্রান্তদের পথপ্রদর্শক)। এ পুস্তকে তিনি ইহুদী ধর্ম শাস্ত্রের সঙ্গে মুসলিম আরাস্তুবাদ অথবা ব্যাপক অর্থে বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তি সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। এইদিক হতে অন্ততঃ তিনি বাইবেলের স্বতঃসিদ্ধবাদের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাহসী সমর্থক ছিলেন। ফলে তিনি গোঁড়া শাস্ত্রবিদদের রোষ-ভাজন হন। এরা তার বইয়ের নাম দেয়, দালালাহ’ (গোমরাহকরণ)। স্বাধীনভাবে গবেষণা করলেও তাঁর দার্শনিক মতবাদের সঙ্গে ইবনে রুশদের মতবাদের সাদৃশ্য দেখা যায়। ইবনে রুশদের মত তিনিও গ্রীক ভাষায় অজ্ঞ ছিলেন এবং সম্পূর্ণভাবে আরবী অনুবাদের উপর নির্ভর করতেন। সৃষ্টি সম্বন্ধে তিনি অনু-মতবাদ (আল্লাহ সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা) আর নিও প্ল্যাটোনিক ও আরাস্তুর দার্শনিক মতবাদ। একটি ছাড়া ইবনে মায়মুনের সব বই আরবী ভাষায় লিখিত হয় এবং শীঘ্রই সে সব বই হিব্রুতে ও পরে আংশিকভাবে ল্যাটিনে অনূদিত হয়। তাঁর মতবাদের ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ইহুদী ও খৃস্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তাঁর গ্রন্থাবলীই ইন্দী চিন্তাকে জেনটাইলদের নিকট পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম ছিল। আধুনিক সমালোচকেরা তার প্রভাবের পরিচয় বহু জনের মধ্যে দেখতে পান : যেমন–ডমিনিকান, ডান স্কোটাস, শিনোজা, এমন কি ক্যান্ট। এ যুগের মরমীবাদীদের মধ্যে ইবনে আরাবী প্রধান ছিলেন। সমগ্র ইসলামী সুফী-জগতে ইনি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাশালী চিন্তাবিদ ছিলেন। ইবনে আরবী সেভিলে জন্মগ্রহণ করেন। ১২৪০ সালে দামেস্কে তাঁর মৃত্যু হয়। আজো তাঁর মাজার তথায় বিদ্যমান। তার একখানা বইয়ে তিনি হযরত মুহম্মদের (সঃ) নৈশ ভ্রমণ ও আসমানে যাওয়ার কাহিনী নিয়ে আলোচনা করেন। এতে দান্তের মহাকাব্যের পূর্বাভাব মিলে।

এয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত আরব-বিজ্ঞান ও দর্শনের ইউরোপ গমন সমাপ্ত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই স্রোত টলেডো হতে পিরেনীজ পর্বতের আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে প্রোভেন্স এবং আল্পসের গিরি-পথে লোরেইন, জার্মানী এবং মধ্য-ইউরোপে গিয়ে পৌঁছে এবং সেখান হতে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে হাজির হয়। ফ্রান্সে মার্সাই, তুলো, নারবেন এবং মন্টপেলিয়ার আরব চিন্তার কেন্দ্রস্থল ছিল। পূর্ব ফ্রান্সের অন্তর্গত কুনিতে একটি বিখ্যাত মঠ ছিল; এই মঠে কয়েকজন স্পেনীয় পাদ্রী ছিলেন। ফলে দ্বাদশ শতাব্দীতে এই স্থান আরব-জ্ঞান প্রচারের একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানকার পিটার ভেনারেবল নামক মঠাধ্যক্ষ ১১৪১ সালে অন্যান্য বহু পুস্তিকা ছাড়া কোরানের প্রথম ল্যাটিন অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। অবশ্য এসব ইসলামের বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। দশম শতাব্দীতে লোরেইন বা লোথারিনজীয়াতে আরবী-বিজ্ঞান প্রবেশ লাভ করে। তার ফলে পরবর্তী দুই শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান বৈজ্ঞানিক প্রভাবের কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হয়। লোথারিনজীয়ার শহরগুলির মধ্যে লীজ, গোরজ এবং কোলন আরবী জ্ঞানের অঙ্কুর উদগমের জন্য একান্ত উর্বর-ভূমি ছিল। লোরেইন হতে এ জ্ঞানের আলোক জার্মানীর চারদিকে বিচ্ছুরিত হয় এবং লোরেইনবাসী বা লোরেইনে শিক্ষাপ্রাপ্ত লোক দ্বারা নর্মান যুগের ইংল্যান্ডে নীত হয়।

এভাবে স্পেনীয় আরব জ্ঞান-বিজ্ঞান সমস্ত পশ্চিম-ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে । আর এর মাধ্যম হিসেবে স্পেনের ব্রতও সাধিত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *