১৫. পদ্মের মূৰ্ছা

পদ্মের মূৰ্ছা রীতিমত মূৰ্ছা-রোগে দাঁড়াইয়া গেল। এবং মাসখানেক ধরিয়া নিত্যই সে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িতে লাগিল।

ফলে মাসখানেকের মধ্যে বন্ধ্যা মেয়েটির সবল পরিপুষ্ট দেহখানি হইয়া গেল দুর্বল এবং শীর্ণ। একটি দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে সে; এই শীর্ণতায় এখন তাহাকে অধিকতর দীর্ঘাঙ্গী বলিয়া মনে হয়; দুর্বলতাও বড় বেশি চোখে পড়ে। চলিতে ফিরিতে দুর্বলতাবশত সে যখন কোনো কিছুকে আশ্রয় করিয়া দাঁড়াইয়া আত্মসংবরণ করে, তখন মনে হয় দীর্ঘাঙ্গী পদ্ম যেন থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। সেই বলিষ্ঠ ক্ষিপ্রচারিণী পদ্মের প্রতি পদক্ষেপে এখন ক্লান্তি ফুটিয়া ওঠে, ধীরে মন্দগতিতে চলিতেও তাহার পা যেন টলে। কেবল তাহার চোখের দৃষ্টি হইয়া উঠিয়াছে অস্বাভাবিক প্রখর। দুর্বল পাণ্ডুর মুখের মধ্যে পদ্মের ডাগর চোখ দুইটা অনিরুদ্ধের শখের শাণিত বগি দাখানায় অ্যাঁকা পিতলের চোখ দুইটার মতই ঝকঝক করে। স্ত্রীর চোখের দিকে চাহিয়া অনিরুদ্ধ শিহরিয়া ওঠে।

অনটনের দুঃখের উপর এই দারুণ দুশ্চিন্তায় অনিরুদ্ধ বোধ করি পাগল হইয়া যাইবে। জগন ডাক্তারের পরামর্শে সেদিন সে কঙ্কণার হাসপাতালের ডাক্তারকে ডাকিয়া আনিল।

জগন বলিয়াছিল—মৃগী রোগ।

হাসপাতালের ডাক্তার বলিল-এ এক রকম মূৰ্ছা-রোগ। বন্ধ্যা মেয়েদেরইমানে যাদের ছেলেপুলে হয় না তাদেরই এ রোগ বেশি হয়। হিস্‌টিরিয়া।

পাড়া-পড়শীরা কিন্তু প্ৰায় সকলেই বলিল—দেবরোগ। কারণও খুঁজিয়া পাইতে দেরি হইল না। বাবা বুড়োশিব ভাঙাকালীকে উপেক্ষা করিয়া কেহ কোনোকালে পার পায় নাই! নবান্নের ভোগ দেবস্থলে আনিয়া সে বস্তু তুলিয়া লওয়ার অপরাধ তো সামান্য নয়! অনিরুদ্ধের পাপে তাহার স্ত্রীর এই রোগ হইয়াছে। কিন্তু অনিরুদ্ধ ও-কথা গ্ৰাহ্য করিল না। তাহার মত কাহারও। সহিত মেলে না। তাহার ধারণা, দুষ্ট লোকে তুক্‌ করিয়া এমন করিয়াছে। ডাইনী-ডাকিনী বিদ্যার অভাব দেশে এখনও হয় নাই। ছিরুর বন্ধু চন্দ গড়ী এ বিদ্যায় ওস্তাদ। সে বাণ। মারিয়া মানুষকে পাথরের মত পঙ্গু করিয়া দিতে পারে। পদ্মের একটা কথা যে তাহার মনে অহরহ জাগিতেছে!

প্রথম দিন পদ্মের মূৰ্ছা জগন ডাক্তার ভাঙাইয়া দেওয়ার পর সেই রাত্রের ভোরের দিকে সে ঘুমের ঘোরে একটা বিকট চিৎকার করিয়া আবার মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল। সেই নিশুতি রাত্রে অনিরুদ্ধ আর জগনকে ডাকিতে পারে নাই এবং সেই রাত্রে মূৰ্ছিতা পদ্মকে ফেলিয়া যাওয়ার উপায় তাহার ছিল না। বহু কষ্টে পদ্মের চেতনা সঞ্চার হইলে নিতান্ত অসহায়ের মত পদ্ম তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিল—আমার বড় ভয় লাগছে গো!

–ভয়? ভয় কি? কিসের ভয়?

–আমি স্বপ্ন দেখলাম—

–কি? কি স্বপ্ন দেখলি? অমন করে পেঁচিয়ে উঠলি ক্যানে?

–স্বপ্ন দেখলাম—মস্ত বড় একটা কালো কেউটে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

–সাপ?

–হ্যাঁ, সাপ! আর—

–আর?

–সাপটা ছেড়ে দিয়েছে ওই মুখপোড়া–

–কে? কোন্ মুখপোড়া?

–ওই শত্তুর–ছিরে মোড়ল। সাপ ছেড়ে দিয়ে আমাদের সদর দুয়োরের চালাতে দাঁড়িয়ে হাসছে।

পদ্ম আবার থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়াছিল।

কথাটা অনিরুদ্ধের মনে আছে। পদ্মের অসুখের কথা মনে হইলেই ওই কথাটাই তাহার মনে পড়িয়া যায়। ডাক্তারেরা যখন চিকিৎসা করিতেছিল, তখন মনে হইলেও কথাটাকে সে আমল দেয় নাই, কিন্তু দিন দিন ধারণাটা তাহার মনে বদ্ধমূল হইয়া উঠিতেছে। এখন সে রোজার কথা ভাবিতেছে, অথবা কোনো দেবস্থল বা ভূতস্থল।

তাঁহার এই ধারণার কথা কেহ জানে না, পদ্মকেও সে বলে নাই। বলিয়াছে—কেবল মিতা গিরিশ ছুতারকে। জংশনের দোকানে যখন দুজন যায়, তখন পথে অনেক সুখ-দুঃখের কথা হয়। দুজনে ভালমন্দ অনেক মন্ত্ৰণা করিয়া থাকে। সমস্ত গ্রামই প্রায় একদিকে, তাহাদিগকে জব্দ করিবার একটা সজ্ঞাবদ্ধ ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলিতেছে। অনিরুদ্ধ ও গিরিশের সঙ্গে আর একজন। আছে, পাতু মুচি। ছিরু পালকে এখন শ্রীহরি ঘোষ নামে গ্রামের প্রধানরূপে খাড়া করিয়া গোমস্তা। দাশজী বসিয়া বসিয়া কল টিপিতেছে; গ্রামের দলের মধ্যে নাই কেবল দেবু পণ্ডিত, জগন ঘোষ এবং তারা নাপিত। দেবু নিরপেক্ষ, তাহার প্রীতি-স্নেহের উপর অনিরুদ্ধের অনেক ভরসা; কিন্তু এ সকল কথা লইয়া অহরহ তাহাকে বিরক্ত করিতেও অনিরুদ্ধের সংকোচ হয়। জগন ডাক্তা দিবারাত্র ছিকে গালাগালি করে, কিন্তু ওই পর্যন্ত তাহার কাছে তাহার অতিরিক্ত কিছু প্রত্যাশা করা ভুল। তারাচরণকে বিশ্বাস করা যায় না। তারাচরণ নাপিতের সঙ্গে গ্রামের লোকের হাঙ্গামাটা মিটিয়া গিয়াছে। গ্রামের লোকই মিটাইতে বাধ্য হইয়াছে, কারণ সামাজিক ক্রিয়াকলাপে নাপিতের প্রয়োজন বড় বেশি। জাতকৰ্ম হইতে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ক্রিয়াতেই নাপিতকে চাই। তারাচরণ এখন নগদ পয়সা লইয়াই কাজ করিতেছে, রেট অবশ্য বাজারের রেটের অর্ধেক দাড়ি-গোঁফ কামাইতে এক পয়সা, চুল কাটিতে দু পয়সা, চুলকাটা এবং কামানো একসঙ্গে তিন পয়সা।

অন্যদিকে সামাজিক ক্রিয়াকলাপে নাপিতের প্রাপ্যও কমিয়া গিয়াছে। নগদ বিদায় ছাড়া চাল, কাপড় ইত্যাদি যে-সব পাওনা নাপিতের ছিল, তাহার দাবি নাপিত পরিত্যাগ করিয়াছে। তারাচরণ নাপিত ঠিক কোনো পক্ষভুক্ত নয়, অনেকটা নিরপেক্ষ ব্যক্তি। অনিরুদ্ধ বা গিরিশ জিজ্ঞাসা করিলে চুপি চুপি সে গ্রামের লোকের অনেক পরামর্শের কথাই বলিয়া যায়। আবার অনিরুদ্ধ ও গিরিশের সংবাদ গ্রামের লোক জিজ্ঞাসা করিলে তা-ও হা-না করিয়া দুই-চারিটা বলে। তবে তারাচরণের আকর্ষণ অনিরুদ্ধ-গিরিশের দিকেই বেশি। পাতুর সহিত তাহার কোনো সম্বন্ধ নাই। ইহাদেরই সে দুই-চারিটি বেশি খবর দেয়, কিন্তু অযাচিতভাবে সকল খবর দিয়া যায় দেবুকে। দেবুকে সে ভালবাসে। আর কিছু কিছু খবর বলে জগন ডাক্তারকে। বাছিয়া বাছিয়া উত্তেজিত করিবার মত সংবাদ সে ডাক্তারকে বলে। ডাক্তার চিৎকার করিয়া গালিগালাজ দেয়; তারাচরণ তাহাতে খুশি হয়, দাঁত বাহির করিয়া হাসে। কৌশলী তারাচরণ কিন্তু কোনোদিন প্রকাশ্যে অনিরুদ্ধ-গিরিশের সঙ্গে হৃদ্যতা দেখায় না। কথাবার্তা যাহা কিছু হয় সেসব ওপারের জংশন শহরে বটতলায়। সেও আজকাল গিয়া ক্ষুর ভাঁড় লইয়া হাঁটের পাশেই একটা গাছতলায় বসিতে আরম্ভ করিয়াছে। শিবকালী, দেখুড়িয়া, কুসুমপুর, মহুগ্রাম, কঙ্কণা এই পাঁচখানা গ্রামে তাহার যজমান আছে, তাহার দুইখানার কাজ সে একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছে। বাকি তিনখানার একখানি নিজের গ্রাম—অপর দুইখানি মহুগ্রাম ও কঙ্কণা। মহুগ্রামের ঠাকুরমশায় বলেন মহাগ্রাম। এই ঠাকুরমশায় শিবশেখর ন্যায়রত্ন জীবিত থাকিতে ও-গ্রামের কাজ ছাড়া অসম্ভব। ন্যায়রত্ন সাক্ষাৎ দেবতা। এই দুইখানা গ্রামে দুদিন বাদে সপ্তাহের পাঁচ দিন সে অনিরুদ্ধ-গিরিশের মত সকালে উঠিয়া জংশনে যায়। হাঁটতলায় অনিরুদ্ধের কামারশালার পাশেই বটগাছের ছায়ায় কয়েকখানা ইট পাতিয়া সে বসে। সেই তাহার হেয়ার কাটিং সেলুন। দস্তুরমত সেলুনের কল্পনাও তাহার আছে। অনিরুদ্ধের সঙ্গে কথাবার্তা হয় সেইখানে। কঙ্কণা তাহাকে বড় একটা যাইতে হয় না। বাবুরা সবাই ক্ষুর কিনিয়াছে। যাইতে হয় ক্রিয়াকর্মে, পূজা-পার্বণে। সেগুলা লাভের ব্যাপার।

পদ্মের অসুখ সম্বন্ধে নিজের ধারণার কথা অনিরুদ্ধ গিরিশকে বলিলেও তারাকে বলে নাই তারাচরণকে তাহারা ঠিক বিশ্বাস করে না।

কিন্তু তারাচরণ অনেক সন্ধান রাখে, ভাল রোজা, জাগ্ৰত দেবতার অথবা প্রেতদানার স্থান, যেখানে ভর হয়—এ সবের সন্ধান তারা নাপিত দিতে পারে। অনিরুদ্ধ ভাবিয়াছিল—তারা নাপিতকে কথাটা বলিবে কি না।

সেদিন মনের আবেগে অনিরুদ্ধ কথাটা তারাচরণের পরিবর্তে বলিয়া ফেলিল জগন ডাক্তারকে। দ্বিপ্রহরে জংশনের কামারশালা হইতে ফিরিয়া অনিরুদ্ধ দেখিল, পদ্ম মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া আছে। ইদানীং পদ্মর মূর্ঘা-রোগের পর সে দুপুরে বাড়ি ফিরিয়া আসে। সেদিন ফিরিয়া পদ্মকে মূৰ্ছিত দেখিয়া বারকয়েক নাড়া দিয়া ডাকিল, কিন্তু সাড়া পাইল না। কখন যে মূৰ্ছা হইয়াছে—কে জানে! মুখে-চোখে জল দিয়াও চেতনা হইল না। কামারশালায় তাতিয়া পুড়িয়া এতটা আসিয়া অনিরুদ্ধের মেজাজ ভাল ছিল না। বিরক্তিতে ক্রোধে সে কাণ্ডজ্ঞান হারাইয়া ফেলিল। জলের ঘটিটা ফেলিয়া দিয়া, পদ্মের চুলের মুঠি ধরিয়া সে নিষ্ঠুরভাবে আকৰ্ষণ করিল। কিন্তু পদ্ম অসাড়! চুল ছাড়িয়া দিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে অনিরুদ্ধের বুকের ভিতরটা কান্নার আবেগে থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। সে পাগলের মত ছুটিয়া আসিল। জগনের তেজী ওষুধের ঝুঁজে পদ্ম অচেতন অবস্থাতেই বারকয়েক মুখ সরাইয়া শেষে গভীর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চোখ মেলিয়া চাহিল।

ডাক্তার বলিল—এই তো চেতন হয়েছে। কাঁদছিস কেন তুই?

অনিরুদ্ধের চোখ দিয়া দরদরধারে জল পড়িতেছিল। সে ক্রন্দনজড়িত কণ্ঠেই বলিল–আমার অদেষ্ট দেখুন দেখি, ডাক্তার? আগুন-তাতে পুড়ে এই এক ক্রোশ দেড় ক্রোশ রাস্তা এসে আমার ভোগান্তি দেখুন দেখি একবার!

ডাক্তার বলিল—কি করব বল? রোগের উপর তো হাত নাই! এ তো আর মানুষে করে দেয় নাই!

অনিরুদ্ধ আজ আর আত্মসংবরণ করিতে পারি না, সে বলিয়া উঠিল—মানুষ, মানুষেই করে দিয়েছে ডাক্তার; তাতে আমার এতটুকুন সন্দেহ নাই। রোগ হলে এত ওষুধপত্র পড়ছে, তাতেও একটুকু বারণ শুনছে না রোগ! এ রোগ নয়—এ মানুষের কীর্তি।

জগন, ডাক্তার হইলেও, প্রাচীন সংস্কার একেবারে ভুলিতে পারে না। রোগীকে মকরধ্বজ এবং ইনজেকশন দিয়াও সে দেবতার পাদোদকের উপর ভরসা রাখে। অনিরুদ্ধের মুখের দিকে চাহিয়া সে বলিলতা-যে না হতে পারে তা নয়। ডাইনী-ডাকিনী দেশ থেকে একেবারে যায় নাই। আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রে তো বিশ্বাস করে না! ওরা বলছে

বাধা দিয়া অনিরুদ্ধ বলিল বলুক, এ কীর্তি ওই হারামজাদা ছিরের।

ক্রোধে ফুলিয়া সে এতখানি হইয়া উঠিল।

সবিস্ময়ে জগন প্রশ্ন করিলছিরের?

–হ্যাঁ, ছিরের। ক্রুদ্ধ আবেগে অনিরুদ্ধ পদ্মের সেই স্বপ্নর কথাটা আনুপূর্বিক ডাক্তারকে বলিয়া সে বলিলই যে চন্দর গড়াই, ছিরে শালার প্রাণের বন্ধু–ও শালা ডাকিনী-বিদ্যে জানে! যোগী গড়ায়ের বিধবা মেয়েটাকে কেমন বশীকরণ করে বের করে নিলে—দেখলেন তো! ওকে দিয়েই এই কীর্তি করেছে। এ একেবারে নিশ্চয় করে বলতে পারি আমি।

জগন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া গেল, কিছুক্ষণ পর বার দুই ঘাড় নাড়িয়া বলিল।  ক্রোধে অনিরুদ্ধের ঠোঁট থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। পদ্ম এই কথাবার্তার মধ্যে উঠিয়া বসিয়াছিল; দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া সে হাঁপাইতেছিল। অনিরুদ্ধের ধারণার কথাটা শুনিয়া সে অবাক হইয়া গেল।

জগন বলিল—তাই তুই দেখ্‌ অনিরুদ্ধ; একটা মাদুলি কি তাবিজ হলেই ভাল হয়। তারপর বলিল—দেখ্‌, একটা কথা কিন্তু আমার মনে হচ্ছে; দেখিস তুই-এ ঠিক ফলে যাবে; নিজের বাণে বেটা নিজেই মরবে।

অনিরুদ্ধ সবিস্ময়ে জগনের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। জগন বলিল-সাপের স্বপ্ন দেখলে কি হয় জানিস তো?

–কি হয়?

–বংশবৃদ্ধি হয়, ছেলে হয়, তাদের কপালে ছেলে নাই, কিন্তু ছিরে নিজে যখন সাপ ছেড়েছে, তখন ওই বেটার ছেলে মরে—তোর ঘুরে এসে জন্মাবে। তোর হয়ত নাই, কিন্তু ও নিজে থেকে দিয়েছে।

জগনের এই বিচিত্র ব্যাখ্যা শুনিয়া অনিরুদ্ধ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল, তাহার চোখ দুইটা বিস্ফারিত হইয়া উঠিয়াছিল, সে জগনের মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

পদ্মের মাথার ঘোমটা অল্প সরিয়া গিয়াছে, সে-ও স্থির বিচিত্র দৃষ্টিতে চাহিয়া ছিল সম্মুখের দিকে। তাহার মনে পড়িয়া গেল—ছিরুর শীর্ণ গৌরবর্ণা স্ত্রীর কথা। তাহার চোখ-মুখের মিনতি, তাহার সেই কথা—আমার ছেলে দুটিকে যেন গাল দিয়ো না ভাই! তোমার পায়ে ধরতে এসেছি আমি।

জগন ও অনিরুদ্ধ কথা বলিতে বলিতে বাহিরে চলিয়া গেল। জগন বলিল চিকিৎসা এর তেমন কিছু নাই। তবে মাথাটা যাতে একটু ঠাণ্ডা থাকে, এমনি কিছু চলুক। আর তুই বরং একবার সাওগ্রামের শিবনাথতলাটাই না হয় ঘুরে আয়। শিবনাথতলার নামডাক তো খুব আছে।

শিবতলার ব্যাপারটা ভৌতিক ব্যাপার। কোন পুত্ৰহারা শোকার্ত মায়ের অবিরাম কান্নায় বিচলিত হইয়া নাকি তাহার মৃত পুত্রের প্রেতাত্মা নিত্য সন্ধ্যায় মায়ের কাছে আসিয়া থাকে। অন্ধকার ঘরের মধ্যে তাহার মা খাবার রাখিয়া দেয়, আসন পাতিয়া রাখে; প্রেতাত্মা আসিয়া সেই ঘরে বসিয়া মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। সেই অবসরে নানা স্থান হইতে লোকজন আসিয়া আপন আপন রোগ-দুঃখ অভাব-অভিযোগ প্রেতাত্মার কাছে নিবেদন করে; প্রেতাত্মা সেসবের প্রতিকারের উপায় করিয়া দেয়। কাহাকেও দেয় মাদুলি, কাহাকেও তাবিজ, কাহাকেও জড়ি, কাহাকেও বুটি, কাহাকেও আর কিছু।

অনিরুদ্ধ বলিল—তাই দেখি।

–দেখি নয়, শিবনাথতলাতেই যা তুই। দেখ না, কি বলে।

একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অনিরুদ্ধ একটু হাসিল—অত্যন্ত ম্লান হাসি। বলিল–এদিকে যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে, এগিয়ে যাই কি করে?

ডাক্তার অনিরুদ্ধের দিকে চাহিল, অনিরুদ্ধ বলিলপুঁজি ফাঁক হয়ে গেল ডাক্তারবাবু, বর্ষাতে হয়ত ভাই জুটবে না। বাকুড়ির ধান মূলে-চুলে গিয়েছে, গাঁয়ের লোকে ধান দেয় নাই, আমিও চাইতে যাই নাই। তার ওপর মাগীর এই রোগে কি খরচটা হচ্ছে, তা তো আপনি সবই জানেন গো। শিবনাথের শুনেছি বেজায় খাই।

প্ৰেত-দেবতা শিবনাথ রোগ-দুঃখের প্রতিকার করিয়া দেয়, কিন্তু বিনিময়ে তাহার মাকে মূল্য দিতে হয়। সেটা লাগে প্রথমেই।

জগন বলিল—সঁচ-সাত টাকা হলে আমি না-হয় কোনো রকমে দেখতাম অনিরুদ্ধ, কিন্তু বেশি হলে তো—

অনিরুদ্ধ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল—ডাক্তারের অসমাপ্ত কথার উত্তরে সে বলিয়া উঠিল, তাতেই হবে ডাক্তারবাবু, তাতেই হবে, আরও কিছু আমি ধারধোর করে চালিয়ে নোব। দেবুর কাছে কিছু, আপনার আর দুগ্‌গার কাছে যদি

ডাক্তার ক্র কুঞ্চিত করিয়া প্রশ্ন করিল দুগ্‌গা?

অনিরুদ্ধ ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল, তারপর মাথা চুলকাইয়া একটু লজ্জিতভাবেই বলিল—পেতো মুচির বোন দুগ্‌গা গো!

চোখ দুইটা বড় করিয়া ডাক্তারও একটু হাসিলও! তারপর আবার প্রশ্ন করিল-ষ্টুড়ির হাতে টাকাকড়ি আছে, নয়?

—তা আছে বৈকি। শালা ছিরের অনেক টাকা ও বাগিয়ে নিয়েছে। তা ছাড়া কঙ্কণার বাবুদের কাছেও বেশ পায়। পাঁচ টাকার কমে হাঁটেই না।

–ছিরের সঙ্গে নাকি এখন একেবারেই ছাড়াছাড়ি শুনলাম?

চোখ দুইটা বড় বড় করিয়া অনিরুদ্ধ বলিল-আমার কাছে একখানা বগিদা করিয়ে নিয়েছে, বলে—ক্ষ্যাপা কুকুরকে বিশ্বাস নাই। রাত্রে সেখানা হাতের কাছে নিয়ে ঘুমোয়।

—বলিস্ কি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ!

–কিন্তু তোর সঙ্গে এত মাখামাখি কিসের? আশনাই নাকি?

মাথা চুলকাইয়া অনিরুদ্ধ বলিল–না–তা নয়, দুগ্‌গা লোক ভাল, যাই-আসি গল্পসল্প করি।

—মদটদ চলে তো?

–তা—এক-আধ দিন মধ্যে-মাঝে—

অনিরুদ্ধ লজ্জিত হইয়া হাসিল।

* * *

পথের উপর দাঁড়াইয়া ডাক্তারকে অকপটে সে সব থাই খুলিয়া বলিল।

দুর্গার সঙ্গে সত্যিই অনিরুদ্ধের ঘনিষ্ঠতা হৃদ্য হই গড়িয়া উঠিতেছে। আজকাল দুর্গা শ্ৰীহরির সহিত সকল সংস্রব ছাড়িয়া নূতনভাবে জীবনের ছক কাটিবার চেষ্টা করিতেছে।

আজকাল দুর্গা জংশনে যায় নিত্যই, দুধের যোগান দিতে। ফিরিবার পথে অনিরুদ্ধের কামারশালায় একটি বিড়ি বা সিগারেট খাইয়া, সরস হাস্য-পরিহাসে খানিকটা সময় কাটাইয়া তবে বাড়ি ফেরে। অনিরুদ্ধও সকালে দুপুরে বিকালে জংশনে যাওয়া-আসার পথে দুর্গার বাড়ির সম্মুখ দিয়াই যায়; দুৰ্গাও একটি করিয়া বিড়ি দেয়, বিড়ি টানিতে টানিতে দাঁড়াইয়াই দুই-চারিটা কথাবার্তা হয়। দাখানাকে উপলক্ষ করিয়া হৃদ্যতাটুকু স্বল্পদিনের মধ্যেই বেশ ঘন হইয়া উঠিয়াছে; মধ্যে একদিন লোহা কিনিবার একটা গুরুতর প্রয়োজনে—টাকার অভাবে বিব্রত হইয়া অনিরুদ্ধ চিন্তিতমুখেই কামারশালায় বসিয়া ছিল, সেদিন দুর্গা আসিয়া প্রশ্ন করিয়াছিল—এমন করে গুম মেরে বসে কেন হে?

দুর্গাকে বিড়ি দিয়া নিজেও বিড়ি ধরাইয়া অনিরুদ্ধ কথায় কথায় অভাবের কথাটা খুলিয়া বলিয়াছিল। দুর্গা তৎক্ষণাৎ অ্যাঁচলের খুঁট খুলিয়া দুইটা ঢাকা বাহির করিয়া তাহাকে দিয়া বলিয়াছিল চার দিন পরেই কিন্তুক শোধ দিতে হবে ভাই।

অনিরুদ্ধ সে টাকাটা ঠিক চার দিন পরেই দিয়াছিল। দুৰ্গা সেদিন হাসিয়া বলিয়াছিল–সোনার চাঁদ খাতক আমার!

অনিরুদ্ধকে দুর্গার বড় ভাল লাগে। ভারি তেজী লোক, কাহারও সে তোয়াক্কা রাখে না। অথচ কি মিষ্ট স্বভাব! সবচেয়ে ভাল লাগে কামারের চেহারাখনি। লম্বা মানুষটি। দেহখানিও যেন পাথর কাটিয়া গড়া! প্ৰকাণ্ড লোহার হাতুড়িটা লইয়া সে যখন অবলীলাক্রমে লোহার উপর আঘাতের পর আঘাত করিতে থাকে তখন ভয়ে তাহার সর্বাঙ্গ শিহরিয়া ওঠে; কিন্তু তবুও ভাল লাগে, একটি আঘাতও বেঠিক পড়ে না।

***

ডাক্তারকে বিদায় করিয়া অনিরুদ্ধ বাড়ির মধ্যে ফিরিয়া দেখিল পদ্ম চুপ করিয়া বসিয়া আছে, রান্নাবান্নার নাম-গন্ধ নাই। পদ্মকে সে আর কিছু বলিল না, কতকগুলো কাঠ-কুটা উনানের মুখে আনিয়া উনান ধরাইতে বসিল। রান্না করিতে হইবে, তাহার পর আবার ছুটিতে হইবে জংশনে। রাজ্যের কাজ বাকি পড়িয়া গিয়াছে।

পদ্ম কাহাকে ধমক দিল–যা!

অনিরুদ্ধ ফিরিয়া চাহিল, কিন্তু কেহ কোথাও নাই। কাক কি কুকুর, কি বিড়াল, তাও কোথাও নাই। সে ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া প্রশ্ন করিল–কি?

পদ্ম উত্তরে প্রশ্ন করিল–কি?

অনিরুদ্ধ একেবারে ক্ষেপিয়া গেল, বলিল—ক্ষেপেছিস নাকি তুই? কিছু কোথাও নাই, ধমক দিচ্ছিস কাকে?

পদ্ম এইবার লজ্জিত হইয়া পড়িল, শুধু লজ্জিতই নয়, একটু অধিক মাত্রায় সচেতন হইয়া সে ধীরে ধীরে উঠিয়া উনানশালে আসিয়া বলিল—সর। আমি পারব। তুমি যাও।

অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া উঠিয়া গেল। আর সে পারিতেছে না।

কিন্তু তাহার অনুপস্থিতিতে যদি পদ্মের রোগ উঠিয়া পড়ে! সে দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া দাঁড়াইল। পড়ে পড়ুক, সে আর পারে না। সে বাহির হইয়া গেল।

পদ্ম রান্না চাপাইল। ভাতের সঙ্গে কতকগুলো আলু, একটা ন্যাড়ায় বাঁধিয়া কতকগুলি মসুরির ডাল ফেলিয়া দিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

অনিরুদ্ধ বাহিরে গিয়াছে। বাড়িতে কেহ কোথাও নাই। নির্জন নিঃসহ অবস্থায় আজ অহরহ। মনে হইতেছে তাহার সেই স্বপ্নের কথাগুলি, জগন ডাক্তারের কথাগুলি। ছিরু পালের বড়। ছেলেটা তাহার মাকে কি ভালই না বাসে।

ওই–ওই কি আসিবে?

ধক্‌ধক্ করিয়া তাহার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হইয়া উঠিল।

সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল, ছেলেটির শীর্ণ গৌরাঙ্গী মা ওই খিড়কির দরজার মুখেই আধকালো আধ-অন্ধকারের মধ্যে পদ্মের দিকে মিনতিভরা চোখে চাহিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সে একটা সকাতর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। বার বার আপন মনেই বলিলনা-না-না, তোমার বুকের ধন। কেড়ে নিতে আমি চাই না। আমি চাই না। আমি চাই না।

উনানের মধ্যে কাঠগুলা জ্বলিয়া উঠিয়াছে, হাঁড়ি-কড়া সম্মুখেই–এইবার রান্না চড়াইয়া দেওয়া উচিত; কিন্তু সে তাহার কিছুই করিল না। চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। অন্তরের মধ্যে থাকিয়া থাকিয়া অকস্মাৎ চকিতের মত অধীর অতৃপ্ত কেহ অতি নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে বলিয়া উঠিতেছে–মরুক, মরুক! মনশ্চক্ষে ভাসিয়া উঠিতেছে পাল-বধূর সন্তান। সভয়ে চাঞ্চল্যে শিহরিয়া উঠিয়া নীরবেই পদ্ম বলিতেছিলনা-না-না।

পাল-বধূর আটটি সন্তান হইয়াছিল, তাহার মধ্যে মাত্র দুইটি অবশিষ্ট আছে; আবারও নাকি সে সন্তানসম্ভবা। তাহার গেলে সে আবার পায়। যাক, তাহার আর একটা যাক। ক্ষতি কি!

উনানের আগুন বেশ প্রখরভাবেই জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, তবুও সে কাঠগুলাকে অকারণে ভিতরে ঠেলিয়া দিল, অকারণেই স্কুটস্বরে বলিয়া উঠিল—আঃ, ছিছিছি! ছি-ছিকার করিল

সে আপন মনের ভাবনাকে।

তারপরই সে ডাকিল পোষা বিড়ালটাকে—মেনী মেনী, আয় আয়, পুষি আয়!

ছেলে না হইলে কিসের জন্য মেয়েমানুষের জীবন! শিশু না থাকিলে ঘর-সংসার! শিশু রাজ্যের জঞ্জাল আনিয়া ছড়াইবে,-পাতা, কাগজ, কাঠি, ধুলা, মাটি, ঢেলা, পাথর কত কি! কি তিরস্কার করিবে, আবার পরিষ্কার করিবে, রূঢ় তিরস্কারে শিশু কাঁদবে, পদ্ম তখন তাহাকে বুকে লইয়া আদর করিবে। তাহার আবদারে নিজের ধুলার মুঠা মুখের কাছে লইয়া খাওয়ার অভিনয় করিবে। হামহামহাম! শিশু কাঁদবে হাসিবে, বকবক করিয়া বকিবে, কত বায়না ধরিবে, সঙ্গে সঙ্গে পদ্মও আবোল-তাবোল বকিয়া ক্লান্ত হইয়া শেষে তাহাকে একটা চড় কষাইয়া দিবে। কাঁদিতে কাঁদতে সে কোলে আসিয়া ঘুমাইয়া পড়িবে। তাহার গায়ে-মাথায় হাত বুলাইয়া, দুটি গালে দুটি চুমা খাইয়া তাহাকে লইয়া উঠানময় ঘুরিয়া বেড়াইবে আর চাদকে ডাকিবে-আয় চাদ, আয় আয়, চাঁদের কপালে চাঁদ দিয়ে যা!

এইসব কল্পনা করিতে করিতে ঝরঝর করিয়া তাহার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।

তাহার নিজের নাই, কেহ যদি তাহাকে একটি শিশু পালন করিতেও দেয়! একটি মাতৃহীন শিশু। শিশুসন্তানের জননী কেহ মরে না! ওই পালবধূ মরে না! পণ্ডিতের স্ত্রী মরে না! না হয় তো তাহার নিজের মরণ হয় না কেন। সে মরিলে তো সকল জ্বালা জুড়ায়।

বাহিরে অনিরুদ্ধের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, চণ্ডীমণ্ডপের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ নাই। ওখানে আর যাচ্ছি না। আমার পৌষ-আগলানো আমার নিজের বাড়ির দরজায় হবে।

পদ্মের মনের মধ্যে অকস্মাৎ জাগিয়া উঠিল একটা দুরন্ত ক্ৰোধ। ইচ্ছা হইল—উনানের জ্বলন্ত আগুন লইয়া এই ঘরের চারিদিকে লাগাইয়া দেয়। যাক, সব পুড়িয়া ছাই হইয়া যাক। অনিরুদ্ধ পর্যন্ত পুড়িয়া মরুক। পরমুহূর্তেই সে জ্বলন্ত উনানের উপর হাড়িটা চাপাইয়া দিল, তাহাতে জল ঢালিয়া, চাল ধুইতে আরম্ভ করিল।

কাল আবার লক্ষ্মীপূজা, পৌষ-সংক্রান্তিতে পৌষ-লক্ষ্মী।

লক্ষ্মী! তাহার আবার লক্ষ্মী! কার জন্যে লক্ষ্মী? কিসের লক্ষ্মী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *