১৫. দুপুরের খাওয়ার টেবিলে

দুপুরের খাওয়ার টেবিলে এক পাশে একটা ছোট ট্রানজিস্টর রেখে তাঁরা একই সঙ্গে খাওয়া এবং সংবাদ শোনার কাজ সারলেন। ভারতীয় বেতার আকাশবাণীর সংবাদ। পরম আগ্রহে শুনলেন সকলে।

নাহ্, ওরা এখনো আমাদের দুর্গতির খবর বিশেষ কিছু শোনে নি। এখান থেকে আমাদের কারো যাওয়া দরকার।

।কিন্তু ভারত আমাদের জন্য কতোখানি করবে? এবং কেন করবে?

ফিরেজি প্রশ্ন তুললেন একজন খাঁটি রাজনীতিবিদের মতো। কিন্তু যার সামনে তুললেন তিনি কখনো রাজনীতির তর্ক করেন না। তিনি তাঁর মতো করেই বললেন…।

মানুষের এত বড়ো বিপর্যয় ওরা দেখবে চুপচাপ!

কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোন কিছু করার সুযোগ তাদের কতখানি?-আমিনা আলোচনায় যোগ দিলেন।

অতএব সুদীপ্ত চুপ থাকতে পারেন না। তিনি বললেন–

তাই বলে পাশের বাড়িতে এক ভাই আর-এক ভাইকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে আর আমরা প্রতিবেশী হয়ে চুপচাপ তা দেখব? বলব, ওটা ওদের। ঘরোয়া ব্যাপার!

এ যুক্তির কাছে ফিরোজ নতি স্বীকার করলেন। এবং সুদীপ্তর ঐ কথাটা মেনে নিলেন যে, এখনি বিশ্বের সর্বত্র আমাদের লোক ছড়িয়ে পড়া দরকার। এই বিংশ শতাব্দীতেও আসুরিক শক্তির কাছে সভ্যতাকে মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে এ সংবাদ তাদের জানা দরকার।

কিন্তু জানা সম্ভব ছিল না। পাকিস্তান বেতার থেকে প্রচার হচ্ছে অবস্থা সব। স্বাভাবিক। বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্বাহ্নেই প্রদেশছাড়া করা হয়েছে। এখন। এরা যা বলবে তাই সত্য হবে। অর্থাৎ সকলে জানবে, কতকগুলো বাজে লোক দেশে অশান্তি ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, তাদের দমন করে শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের ধন সম্পত্তি রক্ষা করা হয়েছে। দেশবাসী এখন পরম সুখলাভ করে সরকারের। কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে ব্যস্ত।

শালাদের……, বলতে থেমে গেলেন ফিরোজ। আমিনার উপস্থিতি তার কারণ। নিজেকে তিনি সংযত করে নিয়ে জলের গ্লাসে হাত বাড়ালেন! এক ঢোক পানি খেয়ে অতঃপর তার বক্তব্য ভদ্র ভাষায় প্রকাশ করলেন—

বর্বর পাকিস্তানিদের ঠাণ্ডা করতে হলে ডাণ্ডা ছাড়া কোনো ওষুধ নেই। আপাততঃ ভারত যদি আমাদের হয়ে দুঘা দিত ওদের পিঠে!

কিন্তু পয়ষট্টি সালে তোমরাই তো বাধা দিতে এগিয়েছিলে। তা না হলে ওদেরকে ডাণ্ডা সেবার ভারতের হাতে ভালো করেই খেতে হত।

সে কথা ওই বর্বরগণও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টই পঁয়ষট্টির যুদ্ধে ওদের লাহোর রক্ষা করেছিল। নিশ্চয়ই আজ আর ঐ কর্মের ভালোমন্দ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। যাই হোক, তবু আমরা তখন পাকিস্তানি ছিলাম। যা তখন করেছি, একজন নাগরিকের কর্তব্য হিসাবেই তখন তা করেছি। কিন্তু পঁচিশ মার্চ থেকে আমরা আর পাকিস্তানি নই। অতএব এখন আমাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের বুক থেকে পাকিস্তানিদের নিশ্চিহ্ন করাই হবে আমাদের প্রধান কর্তব্য। ওরা পাকিস্তানি, ওদের দেশ পাকিস্তান, মানে পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিস্তান ইত্যাদি। আমরা বাঙালি, আমাদের বাংলাদেশে ওরা বিদেশী। আলোচনা এগোতে থাকলে কথাটা এক সময় এই ভাবেই মোড় নিল। ফিরোজ এই আলোচনার সূত্রে বললেন–

আজ বিদেশী শত্রুদের স্ব-দেশভূমি থেকে বিতাড়িত করতে প্রতিবেশী বন্ধুদের সাহায্য চাই। অতি সরল কথা।

কেমনি সব পুরুষ আপনারা আমিনা আবার মুখ খুললেন, বাইরে থেকে কারা এসে আপনাদের সাহায্য করবে, তারপর দেশকে মুক্ত করবেন, সেই আশায় গোঁফে তা দিচ্ছেন এখানে বসে!

সহসা গর্তে পড়ে গেলে কিভাবে লাফ দিয়ে পালাতে হয় সে কায়দা।–ফিরোজ জানতেন কিছুটা। বলে উঠলেন—

আমার কিন্তু গোঁফ নেই ভাবী, এই দেখুন!

সেই জন্যই ভারি সুন্দর দেখায় মুখোনা, ঠিক মেয়েদের মতো।

না, আমিনা নয়, মীনাক্ষী বললেন কথাগুলি। এ্যাঁ, মীনাক্ষী ভাবী এমন করে বলতে পারেন! সুদীপ্ত মীনাক্ষীর মুখের দিকে তাকালেন। মীনাক্ষী কথাটা বলেই যেন লজ্জা পেয়েছেন এমনভাবে মুখ নামিয়ে নিয়েছেন। তার ফলেই আরো সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে। এমন চমৎকার রসিকতাও জানেন মীনাক্ষী ভাবী!

এই রসিকতার ফল কিন্তু ভালো হল। কিছুক্ষণের জন্য অন্তঃত সকলে। তারা বর্তমানের উদ্বেগাকুলতা থেকে মুক্তি পেলেন। কিন্তু শীঘ্রই তারা এল। খাওয়া শেষ হতেই আবার সেই দুশ্চিন্তার কুয়াশায় দৃষ্টির সম্মুখবর্তী অতি নিকট ভবিষ্যতও অত্যন্ত অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য হয়ে উঠল। অতএব কর্মসূচী স্থির করতে অক্ষম হয়ে সুদীপ্ত সব ভার স্ত্রীর উপর ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। অগত্যা কথা যা হল তা ফিরোজের সাথে আমিনার। কিন্তু আমিনার কথা অনুসারে কাজ হল না। খালার বাড়ি আজ কিছুতেই নয়, সে আগামীকাল দেখা যাবে।

না, তা বলে এ বাড়িতে থাকতেও বলছি নে আপনাকে। বিশ্বাস করে চলুন না আমার সাথে। নিশ্চয়ই বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছি নে।

ইচ্ছে করলেই তা পারবেন নাকি! এখান থেকে বঙ্গোপসাগর কতো দূরে জানেন। সেখানে পৌঁছবার সাধ্যই নেই আপনার।

অবশ্যই নেই। ফিরোজ আমিনার যুক্তি মেনে নিলেন বিনা প্রতিবাদে। অতঃপর মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই। ফিরোজ-মীনাক্ষী, সুদীপ্ত-আমিনা এবং তাদের তিন সন্তান-ফিরোজের ভক্সওয়াগনে বেরিয়ে পড়লেন। নীরবে, এবং নত নেত্রে।

পথে দু-একটি গাড়ি চলছিল, কিন্তু হেঁটে-চলা মানুষ একটিও না। নিউ মার্কেটের পাশ দিয়ে যাবার সময় সুদীপ্ত দেখলেন, বলাকা বিল্ডিংয়ের ফুটপাথের ধারে আমনের লাশ তখনও পড়ে আছে। ফিরোজও দেখলেন। কিন্তু মেয়েদেরকে দেখানো হল না। তারা নিজেরাই তখন দেখছিলেন। অন্যদিকের ফুটপাথেও কয়েকটি শব তখনও ছড়িয়েছিল। কিন্তু অন্য সময় কতো মানুষ থাকে ঐ পথে চব্বিশ ঘণ্টার এক মুহূর্তও এ স্থান জনশূন্য থাকে না।

মোড় ঘুরতে গর্তের মধ্যে কয়েকজনকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল–একজনের পায়ের কয়েকটা আঙ্গুল এখনো দেখা যাচ্ছে। সহসা দেখা যায় না। কিন্তু আমিনা। কিভাবে যেন দেখে ফেলেছেন। তিনি শিউরে উঠলেন। তিতাস গ্যাসের পাইপ বসানোর জন্য রাস্তার পাশে গর্ত করা হয়েছিল। সেই গর্তকেই গোর বানিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের ঈমানদার মুসলিম বেরাদরগণ। হাজি মহসিন হলের মাঠের কাছে গাড়ি আসতেই পচা দুর্গন্ধে সকলের নাক যেন জ্বলে উঠল। নাকে রুমাল চাপলেন সকলে। আর্টস্ বিল্ডিংয়ের কাছে পৌঁছবার। মুখে গন্ধ আরো তীব্র হল। বাঁ দিকের মাঠে মৃতদেহ ছিল কতগুলি? কাক চিল শকুন কিন্তু অনেকগুলি দেখা গেল। ডানদিকে উপাচার্যের শূন্য বাড়িটার দিকে সুদীপ্ত একবার তাকালেন। উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী এখন দেশের বাইরে না? হাঁ তো, পনেরোই এপ্রিল পর্যন্ত তার বাইরে থাকার কথা। আশ্চর্য, তিনিও। বাইরে চলে গেলেন, এদিকে বিদায় নিলেন প্রদেশের গভর্ণর, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আহসান সাহেবও। আহসান সাহেবের মতো ভদ্রলোক পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন? কেন? পশ্চিম পাকিস্তানের সকলেই ইয়াহিয়া-টিক্কার মতো হবে নাকি! সেখানে আজম খান, ইয়াকুব খান ছিলেন না? তোমাদের এখানে মোনায়েম খান নেই? ঐ একটা সমাবেশ ঘটেছিল বটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে—আচার্য মোনায়েম খান, আর উপাচার্য ওসমান গনি। আচার্য বললে মোনায়েম খান। চটতেন।–

আমারে কি তোমরা হিন্দু ঠাওরাতেছ? মুসলমানের আচার্য কওয়া বড়োই দুষের (দোষের) কথা। কুটি কুটি (কোটি কোটি) টাকা খরচ কইরা তোমাদেরে আচ্ছা কইরা শিক্ষা দিবার লাইগা এই যে বিন্ডিং বানাইয়া দিছি তা কি এমনি কাফের হওন লাইগা? কেন, আমারে তোমরা চ্যাঞ্চেলর কইতে পার না!

চ্যান্সেলর কথাটা মোনায়েম খান ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারতেন না, কিন্তু ঐ পদের গৌরবটুকু ভোগ করতেন ঠিকই। এক সভায় সম্মুখে উপবিষ্ট ওসমান গনি সাহেবকে দেখিয়ে বলেছিলেন–

এই যে আপনারা ওসমান গনি সাবরে দেখতেছেন, আমি হ্যারে ভাইচ চ্যাঞ্চেলর বানাইলাম। হেইডা ল্যাখা-পড়ায় বালো ছাওয়াল আচিল। আমি তার মতো পি-এইচ, ডি এম এইচ ডি কিছুই করবার পারি নাই। কিন্তু আল্লাহ আমারে গভর্ণর কইরা চ্যাঞ্চেলর বানাইয়া দিল। আর ওইটা আমার অধীনে ভাইচ চ্যাঞ্চেলর হইল।

মোনায়েম খানের অধীনে অতি দৌর্দণ্ড প্রতাপে ভাইস চ্যান্সেলরগিরি। করেছেন জনাব ওসমান গনি। কি যে ভয়ে ভয়ে তখন কেটেছে সুদীপ্তদের দিনগুলি! কবে কোন ছাত্র এসে তাদের পিটিয়ে দেয় সেই এক ভয়। তার উপর। ভয় চাকরির। কোনো কারণে অপছন্দ হলেই হল, কোন দিক দিয়ে ফাঁক বের করে দয়া করে একটা চিঠি পৌঁছে দেবে তোমার বাড়িতে—অমুক দিন থেকে তোমার চাকরির দরকার নেই আর। ওদের দুজনের মধ্যে একজন তো ছিলেন। পাড় মূখ-বাংলা বিভাগের তৎকালিন অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাইকে রবীন্দ্র সঙ্গীত রচনার ফরমায়েস দিয়েছিলেন। এবং আর একজন? কেবল নিজের উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্য যিনি একজন মূখের তাঁবেদার হতে পারেন তার নাম কি দেওয়া যেতে পারে? সে কি যেমন তেমন তাঁবেদারি? হুজুরের নির্দেশে ছাত্রদের ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে ছাত্ৰনামধারী গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে। অধ্যাপককে পিটানো পর্যন্ত কোনোটাই বাদ যায় নি। অতঃপর আবু সাঈদ চৌধুরী যখন এলেন। উনিশ শো সাতচল্লিশ খ্রিস্টাব্দের পনেরোই আগস্টের মতো মনে হয়েছিল দিনটাকে। ধোয়া-ভরতি বদ্ধ ঘরে দম আটকে মরতে মরতে সহসা যদি নির্মল নদীতীরের বাতাসে মুক্তি মেলে তা হলে কেমন লাগে। সেটা? ওসমান গনির পর আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন ঠিক তেমনি। এখন বাইরে, বেঁচে গেছেন ভদ্রলোক। হাঁ, বেঁচেছেন। এখানকার সব চোখে দেখলে শোকেই হয় তো মরে যেতেন। ছাত্র-শিক্ষকদের যা ভালোবাসতেন? সকল মানুষকেই ভালোবাসতেন। ভালোবাসার তো মৃত্যু নেই। তিনি যেখানেই থাকুন দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে কর্মের পথ দেখাবে।

উপাচার্যের বাসার বিপরীত দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। কলাভবনের প্রাঙ্গণে সেই সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ। এই বটতলার এক বিশাল সভায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। গত দোসরা মার্চ। পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে উড়িয়েছিল বাংলাদেশের পতাকা। আইনের চোখে ওটা দোষের? কিন্তু বেআইনী, কর্ম তো গত তেইশ বছর ধরে তোমরাই চালিয়ে আসছ। সৈনিক দিয়ে দেশ শাসন করাটা কি আইনসম্মত? আইনের শাসন তোমরা পাকিস্তানে চলতে দিয়েছ কবে শুনি? পাকিস্তানের তেইশ বছরের ইতিহাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে মাত্র একবার। কিন্তু সেই নির্বাচনের রায়কেও বানচাল করার জন্য তোমরা যখন ষড়যন্ত্র শুরু করলে তখনই তো ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্ররা, তাও ছাত্ররাই, পাকিস্তানের পতাকা পুড়াল, বাংলাদেশের পতাকা উড়াল। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার শপথ নিল তারা এই তো সেদিন। এই বটতলায়। হাঁ, শহীদ মিনারের মতো এই বটতলাও ছাত্রদের সংগ্রামী প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। সে জন্য–

শহীদ মিনারের মতো এই বটতলার উপরেও ওদের তো রাগ থাকার কথা।

রাগ আছেই তো। একদিন দেখবে, বটগাছটাকে ওরা নির্মূল করে দিয়েছে।

গবেটদের পক্ষে ওটাই সম্ভব বটে।

সুদীপ্ত বলেন। এবং রোকেয়া হলের সামনে এসে আমিনা বললেন—

একটু দাঁড়ান না!

আমিনার এক বান্ধবী এখানকার হলের হাউস টিউটর। একবার তার খোঁজ নেওয়া যায় না! ফিরোজ গাড়ি থামালেন। কিন্তু নামবার সাহস কারো হল না। সকলেই দেখলেন, রোকেয়া হলের প্রাচীরের একাংশ ভাঙা। রোকেয়া। হলের ভেতরের প্রাঙ্গণে কোনো গাড়ি যাবার পথ না থাকায় কামান দেগে ভেতরে যাবার পথ করে নিয়েছিল পাক-ফৌজের দল। তারপর? ওরা কেউ ভেতরে গেলে দেখতেন, আট-দশজন মেয়ের মৃতদেহ তখন গলতে শুরু করেছে! শকুন ছিল মাত্র তিনটি কি চারটি আর গুটি কয়েক কাক ও একটা কুকুর। কতো আর খাবে তারা। বহু মৃতদেহই এখনো পাখি কিংবা কুকুরে স্পর্শ করে নি। পথে পথে তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে। কেউ গেলে দেখতেন, দুটো লাশ তখনও সনাক্ত করা সম্ভব। কোথাও একটু ক্ষত চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কেবল মনে হয়, শরীরটাকে কে যেন ধরে দুমড়ে মুচড়ে রেখে গেছে।

তার কারণ তারা গুলিতে মরে নি। পঁচিশ তারিখের রাতে কামান দেগে প্রাচীর ভেঙ্গে যারা ঢুকেছিল তারা মেয়েদের সন্ধান বিশেষ পায় নি। ঘরে ঘরে ঢুকে মেয়ে জোর সময় ছিল না তাদের। এদিকে ওদিকে এলোপাথাড়ি গুলি করে সামনে ঝি-চাকর যাদের পেয়েছিল তাদের মেরে চলে গিয়েছিল তারা। আওরাত-সন্ধানী সৈনিকেরা এসেছিল ছাব্বিশ তারিখের দিনের বেলা। বেলা তখন দেড়টা কি দুটো জুমার নামাযের সময় তখন। গত রাত্রি থেকে একটানা কারফিউ থাকায় কেউ পালাতে পারে নি। যতীকলে ইঁদর আটকে থাকার মতো হলের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল তারা। এবং সকাল বেলাটা আশঙ্কায়-উদ্বেগে অতিবাহিত হওয়ার পর দুপুরের দিকে মেয়েরা একটু নিশ্চিন্ত বোধ করেছিল কেন করেছিল তার কোন কারণ নেই। সম্ভবতঃ দীর্ঘক্ষণ ধরে। শঙ্কিত থাকার ক্ষমতা মানুষের নেই। নাকি তারা ভেবেছিল, জুমার দিনে কি আর তাদের ওপর ওরা অত্যাচার করবে! ওরা মুসলমান না! যে ভাবেই হোক, একটু নিশ্চিত বোধ হতেই ক্ষিধে পেয়েছিল মেয়েদের। সারা সকাল অভুক্ত থাকলে ক্ষিধে তো হবেই। ওরা তখন আলু সিদ্ধ-ভাতের ব্যবস্থা করে নিয়ে সবে খেতে বসেছিল। এবং তখনই আক্রান্ত হয়েছিল। সৈনিকদের আগমন টের পেয়ে পাতের অন্ন পাতে রেখেই তারা ছাদে উঠে গিয়েছিল। ছাদের কর্মসূচী আগে থেকেই ঠিক করা ছিল তাদের। মুসলমান মেয়েরা মনে মনে কলেমা পড়ে আল্লাহর নাম নিয়ে তৈরি হয়ে গেল। একজন হিন্দু মেয়ে ছিল তাদের। মধ্যে, সে মনে মনে মা কালিকে স্মরণ করল। তারপর আওরাত-লোলুপ রাইফেলধারিদের আবির্ভাব হতেই এক সঙ্গে সকলে ঝাপ দিল নিচে। খুবই সামান্য ঘটনা। সৈনিকরা ফিরে চলে গেল। এর জন্য আবার আফসোস কিসের? এতোগুলো চমৎকার শিকার যে হাতছাড়া হয়ে গেল সে জন্যও একটু দুঃখ হতে পারত। ধুত্তোর, ঢাকা শহরে আবার আওরাতের অভাব! [ সকালে গোপনে কয়েকজন সাংবাদিক এসে এই মেয়েদের ছবি নিয়ে গেছে। হয়ত ফিরোজও ছবি নিতেন। একটা ক্যামেরা তাঁর হাওয়াই সার্টের নিচে গোপনে রক্ষিত আছে। কিন্তু গাড়ি থেকে নামতেই কেমন যেন ভয়। করতে লাগল। মনে হল হাঙর-সঙ্কুলিত সমুদ্রে একটি ক্ষুদ্র ভেলায় তিনি বসে আছেন। হলের ভাঙা দেয়ালের পানে তাকিয়ে মাত্র কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা যেন ভাবতে চেষ্টা করলেন। অতঃপর গাড়িতে ষ্টার্ট দিতে দিতে বললেন–

না ভাবী, যেতে পারবেন না। ভয়াবহ অবস্থা।

অবস্থার ভয়াবহতা নিয়ে কেউ আর কোন প্রশ্ন তুললেন না। গাড়ি এগিয়ে গেল। কিন্তু বেশি দূরে এগোতে পারল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কেন্দ্রের কাছে সেনাবাহিনীর দুজন জওয়ান পথ আটকাল। সামনে দুখানা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। ফিরোজের গাড়ি হল তিন নম্বর। পরক্ষণেই আর-একখানা গাড়ি এসে থামল ফিরোজের পেছনে। ফিরোজ দেখলেন, কেবল তার গাড়ির ছাড়া আর প্রত্যেকটিতেই একটি করে ছোট পাকিস্তানি পতাকা। শোভা পাচ্ছে। আর সামনের গাড়িটার নম্বর দেখলেন উর্দুতে লেখা। গতকালও গাড়ির নম্বর ছিল সব বাংলাতে। এক রাতেই তা পালটে উর্দু হয়ে গেল! আর এক রাত পেরোলে বাংলার পরিবর্তে সবি উর্দু হয়ে যাবো নাকি! এইভাবে বাঙলার অস্তিত্বই বিলুপ্ত করার খোয়ব দেখছে নাকি আমাদের মুসলিম বেরাদরগণ! সে গুড়ে বালি।

কিন্তু এটা কি মুসকিলে পড়া গেল! পাকিস্তানি পতাকা লাগিয়ে গাড়ি বের করতে হবে এমন তো জানা ছিল না ফিরোজের। এর জন্য আবার শাস্তি পেতে হবে না তো! হলে তা কি ধরনের। মনে মনে একটু তিনি ঘাবড়ে গেলেন বৈ কি। কিন্তু ঘাবড়াবার সময় তো ছিল না। এখন কৈফিয়ৎ দিতে হবে! হাঁ, গাড়ি সার্চ হবে। সে পরের কথা। তার আগে কৈফিয়ৎ দাও, তোমার গাড়িতে ঝাণ্ডা নেই কেন? জানতাম না বললে রেহাই মিলবে না—ফিরোজ জানতেন। অতএব বুঝতে চেষ্টা করলেন—

সকলেরই গাড়িতে পতাকা লাগানোর অধিকার তো নেই। সে অধিকার থাকতেও নেই।

ফিরোজ পরিষ্কার ইংরেজিতে তার বক্তব্য পেশ করলে পাকিস্তানি জওয়ান তার কিছুই বুঝল না। তবু প্রচুর বুঝেছে এমনি ভান করে বলল–

নেহি। তোম হামারা সাথ মে চালো।

তোমার ও-সব কিছু শুনতে চাই নে। আমার সঙ্গে চল। যেতে হল। দুজন মহিলা ও তিনজন শিশু নিয়ে ফুটপাথের উপর একাকী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন সুদীপ্ত। ফিরোজ গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কেন্দ্রের অভ্যন্তরে, যেখানে সেনাবাহিনীর একজন মেজর ছিলেন। এবং ফিরোজের সৌভাগ্য। মেজরটি ছিলেন করাচীর অধিবাসী, জাতিতে বালুচ। তিনি ফিরোজের বক্তব্য শুনলেন। এবং জওয়ানটিকে আদেশ দিলেন—গাড়িতে ঝাণ্ডা থাকার দরকার নেই। যাও। জওয়ানটি ফিরে এসে প্রত্যেকটি গাড়ি থেকে। পতাকা নামিয়ে ফেলার হুকুম জারি করল। কিন্তু ফিরোজের পেছনের গাড়িটা ছিল হাইকোর্টের একজন জাস্টিসের। তার গাড়ি থেকেও পতাকা নামাতে হবে। নাকি। না বললেও চলে, তার গাড়িতে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ছিল না, ছিল হাইকোর্টের নিজস্ব পতাকা। এ আবার কী ধরনের ফিলাগ? জওয়ানটি কয়েক সেকেণ্ড পতাকাটাকে দেখল, এবং ভাবল। স্বাধীন বাঙলার পতাকা সে বিস্তর দেখেছে। এটা সে জিনিস নয়। তবে কোনো বিদেশী কূটনীতি মিশনের পতাকা? না তো। গাড়ির মালিক এই তো দাঁড়িয়ে আছেন! দিব্যি মালুম হচ্ছে দেশী আদমী। এবং বাঙালি। তা হলে! দূর, আর চিন্তা করা যায় না। গাড়িতে পতাকা থাকবে না কারো। মেজর সাহেব বলে দিয়েছেন। ব্যাস। ওই নিয়মই চলবে। পতাকা নামিয়ে ফেল। নীরবে পতাকা নামিয়ে গাড়ির ভেতর রাখা হল। আইনের বিচার যেখানে নেই, সেখানে বিচারকের সম্মানই বা থাকে কোথায়!

অতঃপর গাড়ি সার্চ করার পালা। ফিরোজদের গাড়িতে আলপনা আঁকা। একটা লক্ষ্মীর ভাঁড় দেখেই এক লাফে দু পা পিছিয়ে গেল জওয়ানটি।—ওরে। বাবা, বোমা নাকি।

না, ওটা বোমা যে নয় সেটা প্রমাণ করতে হিমসিম খেতে হল ফিরোজকে। এবং শেষ পর্যন্ত ভেঙে দেখিয়ে তবে রেহাই পাওয়া গেল। লক্ষ্মীর আলপনা-দেওয়া সুন্দর গোল ভাঁড়টা-চারিদিক বন্ধ, কেবল একটি ফুটো দিয়ে ভেতরে পয়সা ফেলা যায়। ভাড়টা এলার ভারি পছন্দ হওয়ায় আজ সকালেই মিনাক্ষী ওটা তাকে উপহার দিয়েছেন। এবং খালা যখন, তখন তো আর এমনি দেওয়া যায় না। ওর মধ্যে পাঁচ টাকার একখানা নোটও দিয়েছিলেন। ফিরোজ ওটাকে ফুটপাথে ভেঙে দিতেই নোটটা ছিটকে পড়ল এক পাশে। তজ্জব কা বাত! বোমার ভেতর থেকে টাকা বেরিয়ে আসতে জওয়ানটি কখনো দেখে নি। তাড়াতাড়ি সে নোটখানা কুড়িয়ে নিয়ে ফিরোজদের একখানা সালাম ঠুকে সরে দাঁড়াল।—আপ চলা যাইয়ে।

তারা চলতে শুরু করল। চুপচাপ সকলে চড়ে বসল গাড়িতে। কথা বলার প্রবৃত্তি কারো নেই। কিন্তু ফিরোজের মনের জোর বোধহয় মোটামুটি বজায়। ছিল। নাকি সবাই যেখানে ঘাবড়ে যায় সেখানে কারো না কারো মনে কোনো অদৃশ্য একটা শক্তি উড়ে এসে বাসা বাঁধে। ফিরোজের মনে হচ্ছিল, তার সঙ্গের এতোগুলি নারী পুরুষকে বাঁচানোর চেষ্টা তাঁকেই করতে হবে। তাতে আনন্দ আছে না! দায়িত্ব ঘাড়ে এসে চাপলে তা কি শুধুই বোঝা হয়? একটা পৌঁরুষ তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। পৌঁরুষের উদ্বোধনই পুরুষের পক্ষে আনন্দের।

একটু এগিয়ে এক পাশে কলোকালের প্রাচীন কালি-মন্দির। আর-এক পাশে বাংলা একাডেমী। দুটোই ছিল ওদের চক্ষুশূল। ওই দেখ না, গোলার আঘাতে বাংলা একাডেমীর একাংশ কেমন ঝাঝরা করে দিয়েছে। মাত্র একাংশ? কি জানি, শহীদ মিনারের দুর্ভাগ্য থেকে কি করে যে বাচল ওটা! কী। করে এখনো টিকে রইল ওই কালিবাড়ি? অবশ্যই কালি-মন্দিরের সম্মান রক্ষা পায় নি। পাকিস্তানি দুবৃত্তরা ওর ভেতরে প্রবেশ করেছিল। সেখানে সেবায়েত কতোজন ছিলেন কেউ জানেন না। কিন্তু হানাদাররা জীবিত একটাকেও রাখে। নি। শেষ পর্যন্ত কালি-মন্দিরটাকে রাখবে তো! না, রাখতেও পারে। বাইরের জগতের সামনে এতোগুলি সেবায়েত হত্যার কৈফিয়ৎ খাড়া করতে হবে না।

বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মন্দিরে প্রবেশ করে সেখানে থেকে পাক-ফৌজের উপর। গুলি চালাচ্ছিল। অগত্যা পাক-ফৌজকে তখন কামান দাগাতে হয়েছিল মন্দির লক্ষ্য করে। তার ফলেই মারা গেছেন মন্দিরের সেবায়েতগণ। বিশেষ করে ঐ সেবায়েতগণকেই হত্যা করা আমাদের সেনাবাহিনীর অভিপ্রায় ছিল না এই ধরনের কোনো যুক্তির আড়ালে নিজের অপকর্মের সাফাই গাওয়ার দরকার ওই দুর্বৃত্তদের অতি শীঘ্রই হতে পারে। তখন প্রশ্ন উঠবে, তোমাদের কামানের গোলা বেছে গিয়ে কেবল মানুষ হত্যা করল, মন্দিরের গায়ে তার বিশেষ কোনো আঁচড়ই লাগল না। এ কেমন কথা! অতএব

শীঘ্রই হয়ত দেখবে সুদীপ্ত কথা তুলেছিলেন, মন্দিরের কিয়দংশ ভেঙে রেখে দেবে ওরা।

অথবা গোটা মন্দিরটাকে গোড়াসুদ্ধ উপড়ে ফেলতে পারে, তখন বলতে পারবে—ওখানে মন্দিরই ছিল না কোনো কালে। অতএব সেবায়েত হত্যার কথা শত্রুদের বানানো কাহিনী।

বেকুবদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। ঐ মন্দিরের কত ছবি কতজনের কাছে আছে সে হিসেব হয়ত মনেই থাকবে না।

আর একটু এগোতেই শেরে-বাংলা ফজলুল হকের মাজার, তাঁর পাশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিন। জীবদ্দশায় ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলার স্বার্থ নিয়ে কথা বলেছিলেন। নানাভাবে নানা সময়ে সেজন্য তাদেরকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কোপদৃষ্টিতে পড়ে লাঞ্ছনা সইতে হয়েছিল। পক্ষান্তরে খাজা নাজিমুদ্দিনের সমগ্র জীবনে একটি কর্মও নেই যার সঙ্গে বিশেষ করে বাঙালির স্বার্থ জড়িত ছিল। অতএব এই দুই দেশ-নায়কের পাশে খাজা নাজিমুদ্দিনের নাম উঠতেই পারে না। এই নিয়ে ক্লাবের আড়ায় একদিন তর্ক উঠেছিল মাজারের কাছে আসতেই সে কথা সুদীপ্তর মনে পড়ল। না, নিজে তিনি তর্কে যোগ দেন নি। কেননা এ সব রাজনীতির ব্যাপার ভালো বোঝেন না তিনি। বস্তুতঃ নিজে তিনি তাই মনে করেন। তাই চুপচাপ তিনি শুনেছিলেন ওদের কথা। একজনের বক্তব্য ছিল–

শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে নাজিমুদ্দিনের মাজার কেমন খাপ ছাড়া দেখায় বরং ওটা করাচীতে জিন্না কিংবা লিয়াকত আলির পাশে মানানসই হত।

তা যদি বলেন, তবে সোহরাওয়ার্দীর কবর হওয়া উচিত ছিল কলকাতায়। শরৎ বোসের সঙ্গে স্বাধীন যুক্ত-বাংলার কথা তুলে এক সময় ভদ্রলোক জন্মলগ্নেই পাকিস্তানকে ছুরিকাঘাত করতে চেয়েছিলেন।

এবং ঠিক ঐ কাজটির জন্যই সোহরাওয়ার্দীর আর সকল ভুলভ্রান্তি চাপা পড়ে যাবে। তিনি ভবিষ্যৎ বাঙালির কাছে ন্যাশনাল হিরোর মর্যাদা পাবেন।

প্রতিপক্ষ এ কথায় ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। ঘটনাটা উনিশ শশা ঊনসত্তরের মার্চের। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার কল্পনা কারো মাথায় ছিল না। কোনো কালেই কি সে কল্পনা কারো মাথায় জাগত? একাত্তরে এসে যদি ইয়াহিয়া-টিক্কার গণহত্যা শুরু না হত তা হলে? পঁচিশে মার্চের ওই হত্যাকাণ্ডের পর সোহরাওয়ার্দী-শরৎ বসুর সেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের চিন্তা এখন অধিকাংশ বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে পেয়ে বসেছে। বুদ্ধিজীবীদের দোষ নেই। পাকিস্তানিরা তো প্রমাণ করে দিয়েছে, বাংলা ও পাকিস্তান দুটো আলাদা দেশ। বাংলাকে ওরা যদি বিদেশই না ভাববে তা হলে এমন নির্বিচার গণহত্যা সেখানে চালাতে পারে! যতোই অমানুষ হোক, নিজের দেশের লোককে এমন কুকুর-শেয়ালের মতো তাড়িয়ে ধরে মারতে পারে কেউ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *