১৫. উক্ষতারণ (১৯৫৩-১৯৫৭)

উক্ষতারণ (১৯৫৩-১৯৫৭)

কলকাতায় স্নাতকোত্তর বিভাগে পড়ার সময় ম্যাক্স মুলার-সম্পাদিত ‘সেক্রেড বুকস অফ দা ইস্ট’-এর একটি খণ্ডের ক্রোড়পত্রে সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থকারের নাম প্রসঙ্গে লেখা ছিল : “উক্ষতারণস্য অধ্যাপকেন শ্রীমন্মোক্ষমূলরেণ বিরচিতম”। বর্ণনাটি বড় মনে ধরেছিল। সুদুর শ্বেতদ্বীপে আইসিস নদীর পাড়ে একটি শহর আছে। সেখানে নদীর অগভীর কোনও জায়গায় পার হওয়ার সুবিধে ছিল। পিঠে মাল নিয়ে যাড় এবং তার নিকটাত্মীয় অন্যান্য সব চতুষ্পদ নদী পার হত। তাই নদীতীরের শহরটির নাম অক্সফোর্ড—সেই স্থান যেখানে বড় নদী পার হয়। সেই জায়গায় এক সময় যে বিদ্যাচর্চা হবে, সেকথা শহরটির নাম যারা দিয়েছিলেন, তাদের জানা ছিল না। ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে একদা ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক সংস্কৃতের পণ্ডিত ম্যাক্স মুলার (যিনি স্বামী বিবেকানন্দের মতে সম্ভবত সায়নাচার্যের অবতার ছিলেন) শহরটির নাম সংস্কৃতায়িত করে রাখেন উক্ষতারণ। আর ম্যাক্স মুলার ডোল পালটে মোক্ষ মুলর হলেন। সেই যে শূন্যপুরাণে আছে—বিষ্ণু হৈলা পেকাম্বর ব্রহ্মা হৈলা মোহাম্মদ আদৰ্শ হৈলা শূলপাণি,—কতকটা সেই রকম আর কী!

ইংরেজ রাজত্বের সময় আমরা শুনতাম বিদ্যাচর্চার ব্যাপারে অক্সফোর্ডই শেষ কথা–পরো নাস্তি। ইউরোপ মহাদেশের বুদ্ধিজীবীরা অবশ্য কথাটা কখনও মানেননি। অক্সফোর্ডের ডিগ্রিধারী কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে এক সময় তারা প্রশ্ন করতেন, “কোন বিষয়ে ডিগ্রি? ক্রিকেট না ফুটবল?” মানে ইংরেজরা একটু অতিরিক্ত ক্রীড়াসক্ত। তার প্রতি কটাক্ষ। অক্সফোর্ডের নানা গল্প প্রথম শুনি আমার পিসেমশায় কিরণশঙ্কর রায়ের কাছে। উনি প্রথম মহাযুদ্ধের আগে অক্সফোর্ডে পড়তে গিয়েছিলেন। ১৯১৩ সনে রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল প্রাইজ পান, তখন ইউনিয়নে ভারতীয় ছাত্ররা ওঁর সম্মানার্থে এক ডিনারের আয়োজন করেছিল। সেই উপলক্ষে কালো টাই এবং ডিনার জ্যাকেট পরা সব ভারতীয় ছাত্রদের একটি গ্রুপ ফোটো ওঁর বসবার ঘরের দেওয়ালে ঝুলত। ওই ছবিটি দেখে জায়গাটা কীরকম তা নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা করতাম। কলেজের একটি বই সাজানো ঘরে জানালার ধারে টেবিল ল্যাম্পের স্নিগ্ধ আলোয় তরুণ কিরণশঙ্কর বসে পড়াশুনো করছেন এবং হয়তো একদিন আমিও ওইভাবে পড়বার সুযোগ পাব, ভাবতে ভাল লাগত। তারপর সুশোভনবাবুর কাছে পড়বার সুযোগ পেয়ে ওই ইচ্ছেটা আরও প্রবল হয়েছিল।

ইচ্ছে ছিল ওখানকার অনার্স ডিগ্রি করার। কারণ কিরণশঙ্করবাবু এবং সুশোভনবাবু দু’জনের কাছেই একই কথা শুনতাম—অক্সফোর্ডে পড়তে হলে ফাস্ট ডিগ্রি করাই ভাল। আমাদের সময়ও ওই কথাটাই সত্যি ছিল। এখন এখানে শিক্ষাব্যবস্থার কিছু রদবদল হয়েছে। যারা গবেষণা করতে আসে তাদের জন্যও পঠন-পাঠনের কিছু সুব্যবস্থা হচ্ছে। কিন্তু গত শতাব্দীর ষাটের দশক অবধি অক্সব্রিজের শিক্ষার প্রায় একমাত্র লক্ষ্য ছিল যারা প্রথম ডিগ্রি করতে আসত তাদের সুশিক্ষা দেওয়া। গবেষণার কাজটাও যে শিখতে হয়—এই চিন্তার উৎসস্থল আমেরিকা। এখন বিশ্বায়ন তো আর শুধু বিনিয়োগ আর ভোগ্যবস্তুতে সীমাবদ্ধ নেই, শিক্ষা সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই ছড়িয়েছে। তাই প্রভু মার্কিন মুলুক যথা নিযুক্ত করছেন সবাই সে পথেই চলছে। তবে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার শিক্ষা এর ফলে কিছুটা উন্নত হয়েছে সন্দেহ নেই। যা হোক, উনিশশো পঞ্চাশের দশকে অক্সফোর্ডে ডক্টরেট প্রত্যাশীরা নেহাতই দুয়োরানির সন্তান। সেকথা জেনেই গবেষক ছাত্র হিসেবে বেলিয়ল কলেজে ভর্তি হলাম। বয়স সাতাশ পার হয়ে গিয়েছে। ও বয়সে গোঁফ কামিয়ে বি.এ ক্লাসের ছাত্র হতে একটু সঙ্কোচও বোধ করছিলাম।

.

হাওড়া স্টেশন থেকে যখন বম্বের ট্রেনে উঠলাম, তখন আমার সহযাত্রী হলেন ডক্টর আশুতোষ সেন, তার পত্নী অমিতাদি এবং সদ্য বি.এ পাস করা পুত্র অমর্ত্য। অমর্ত্য যখন নোবেল প্রাইজ পেলেন, তখন তাকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনে এরকম লোক এবং নিকটাত্মীয়ের সংখ্যা বেজায় বেড়ে যায়। তাই দু-একটি পত্র-পত্রিকা থেকে অনুরোধ এলেও ওঁর সম্পর্কে কিছু লিখতে আমি রাজি হইনি। কারণ, মনে হয়েছিল—ভিড় বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। এখন কয়েক বছরে ব্যাপারটা একটু থিতিয়েছে। হয়তো ঘনিষ্ঠ পরিচিতের সংখ্যাও কিছু কমেছে। তাই এই অসাধারণ মানুষটি সম্বন্ধে দু-চারটে কথা লিখব ভাবছি। কারণ বম্বের ট্রেনে যে-পরিচয়ের সূচনা, তা বয়সের তফাত সত্ত্বেও এক সময় সত্যিই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল এবং কর্মজীবনে নানা জায়গায় একত্র কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু তার জীবন অন্তহীন কর্মযজ্ঞ। আর সাফল্যের যে-স্তরে তিনি পৌঁছেছেন, সেখানে তাল রেখে চলার সামর্থ্য আমার নেই। ফলে যে-অনিবার্য দূরত্ব এসে গেছে, সেটাকে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না। কিন্তু জীবনে যে ক’জন অসাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়েছে, অমর্ত্য তার প্রথম সারিতে, সুতরাং তার বিষয়ে আমার ধারণা এবং ভাবনা ঐতিহাসিক বিশেষত বাঙালি চেতনার ঐতিহাসিক হিসাবে লিপিবদ্ধ করা কর্তব্য মনে করি। কারণ ওঁর মধ্যে বিশিষ্টভাবে বাঙালি প্রতিভার চরম বিকাশ হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস, যদিও তিনি নিজেই বলেছেন যে, ওঁর নিজের চোখেই ওঁর ব্যক্তিপরিচয় এক নয়, বহুমুখী।

১৯৫৩-র সেপ্টেম্বর মাসে বম্বে থেকে স্ট্র্যাথনেভার জাহাজে আমরা ইংল্যান্ড রওনা হলাম। জাহাজে অনেক ভারতীয় ছাত্র। আমাদের সম্মতি নিয়েই কাপ্তেন সাহেব ভারতীয় ছাত্রদের আলাদা একটা টেবিলে খাবার ব্যবস্থা করলেন। আমরা আপত্তি করলে কী হত জানি না। তবে প্রস্তাবটা যে আমাদের প্রতি শুভেচ্ছাপ্রণোদিত নয়, তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। জাহাজে আমাদের পরিচিতদের মধ্যে ছিলেন পার্থসারথি গুপ্ত, অক্সফোর্ডে কুইনস কলেজে ইতিহাস পড়তে চলেছে। ফার্স্ট ক্লাসে যাত্রীদের মধ্যে একজন ভারতীয় ছাত্রী বলরুম শৈলীতে নৃত্যপটীয়সী বলে খ্যাতি অর্জন করেন। নাম রমিলা থাপার। তখন আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। যত দূর মনে পড়ে, অমর্তও ছিলেন ফার্স্ট ক্লাসের প্যাসেঞ্জার, যদিও তিনি বেশির ভাগ সময়টা আমাদের সঙ্গেই কাটাতেন।

জাহাজে দুটি মহিলা হকি খেলোয়াড়ের দল ছিল যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের হয়ে কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে যাচ্ছেন। লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খালে উষ্ণতা কিছু বেশি। সেখানে এরা যা পরে থাকতেন, ভারতীয় সংস্কৃতি অনুসারে তাতে লজ্জা নিবারণ হয় না। এ জাতীয় দৃশ্য দেখার অভ্যাস না থাকায় আমরা অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্করা কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়েছিলাম—একথা কবুল না করলে মিথ্যাচার হবে। এখানে প্রসঙ্গত বলি, জাহাজে প্রথম দেখলাম যে শরীর বিষয়ে লজ্জার ব্যাপারে পশ্চিমিদের সঙ্গে আমাদের তফাত খুব বেশি। পুরুষ মানুষের স্নানের জায়গায় রোজ সকালে যাঁরা লাইন দিতেন তাদের কাঁধে একটা করে তোয়ালে থাকত ঠিকই, কিন্তু শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিশুর মতো নিরাবরণ। উনিশ শতকে ইউরোপীয়দের শরীর বিষয়ে লজ্জার অভাব নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ মন্তব্য করে ব্যাপারটার একটা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন। এই লজ্জাহীনতার ইতিহাস অতি প্রাচীন। ইতিহাস শাস্ত্রের জনক হেরোডোটাস, পারসিকরা যে বর্বর তার প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করেন যে, তারা খেলা এবং ব্যায়ামের সময় কাপড়চোপড় পরে থাকে, সুসভ্য গ্রিকদের মতো সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে কুস্তি করে না।

প্রথম ইউরোপ যাবার সময় সমুদ্রযাত্রাটা যতটা আনন্দদায়ক হবে আশা করেছিলাম, কার্যত তা হয়নি। জাহাজের জীবন পশ্চিমি জীবনযাত্রারই এক সানন্দ প্রকাশ। সেই সারা দিন খেলাধুলা উৎসবে যোগ দেওয়ার সামাজিক বা মানসিক প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। তাই অবস্থাটা কতকটা মাছ ডাঙায় পড়লে যেমন হয় সেই গোছের হয়েছিল। আর ভারতীয় ছাত্ররা দলবদ্ধ হয়ে হইহল্লা করার একটা অভিনয় করত, যেন সব ব্যাপারটা তারা খুব উপভোগ করছে, তাতেও কেমন একটা গ্রাম্যতার গন্ধ থাকত। আমি অস্বস্তি বোধ করতাম। আর সূক্ষ্ম অথচ সন্দেহাতীতভাবে জাহাজের সমাজজীবনে সর্বব্যাপী যে-জাতিভেদপ্রথা ছিল, তার ফলে সহজ আনন্দ উপভোগের কোনও উপায় ছিল না।

জাহাজে কয়েকটি বিচিত্র চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের মধ্যে এক ব্রাহ্মণবটু বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ব্যক্তিটি প্রাতরাশের সময় আস্তিন গুটিয়ে হাতে বাধা একটি মাদুলি বের করতেন। তারপর সেই মাদুলি গ্লাসের জলে চুবিয়ে প্রথমে সেই বিশুদ্ধিকৃত জল পান করতেন। তারপর আহার। হিন্দুর অস্পৃশ্য নয় এরকম মাংসে তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু মাংসের পর আইসক্রিম খাওয়া চলত না। কারণ মাংসের পর দুধ খাইলে গোমাংস ভক্ষণের ফল হয়। রঘুনন্দন ভট্টাচার্য এরকম কোনও ব্যবস্থা দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিন্তু সেকথা কে শোনে? একদিন দেখি নিষ্ঠাবান চাটুজ্যে লাঞ্চের সময় ‘ভিইল’অর্থাৎ গোবৎসের মাংস ফরমাস করছেন। প্রশ্ন করলাম, “ওটা কী খাচ্ছেন?” উত্তর, “ক্যান? ভেড়ার মাংস? খাইয়া দ্যাহেন। খুব ভাল।” ভাল, তাতে আর সন্দেহ কী!

মাস তিনেক পরে লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে উপরতলার কাফেটেরিয়ায় বসে সস্তায় ঝোল-ভাত খাচ্ছি। জাহাজের একজন সহযাত্রী কাছে এসে বসলেন। তারপর গলা খুব নামিয়ে প্রশ্ন করলেন, “চাটুজ্যেকে মনে আছে?” ‘ভিইল’ভোজী সদব্রাহ্মণকে কি ভোলা। যায়? বললাম, “অবশ্যই।” প্রশ্ন, “সে আজকাল রোজ সন্ধেবেলা কী করে জানেন?” ভাবলাম নিশ্চয়ই কুসঙ্গে পড়ে বেচারা বড় রকম কোনও কুকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রশ্নকর্তা বললেন, “সে আপনারা ভাবতে পারবেন না।” ভাবতে পারি না। এরকম জিনিস দুনিয়ায় বেশি নেই। তাই সত্যিই চিন্তিত হলাম। ভাবলাম শিগগিরই ‘নিউজ অফ দা ওয়ার্লড’-এ খবর বের হবে—এক ভারতীয় ছাত্র বৃহৎ অপরাধচক্রে জড়িত। আর তার সঙ্গে ভারতীয় ছাত্রদের স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে নানা নিন্দাসূচক মন্তব্য থাকবে। না, ব্যাপার আরও জটিল। সহযাত্রীটি গলা আরও নামিয়ে বললেন, “রোজ সন্ধে হলেই সে নাচে মোশাই, নাচে!।” এই গুরুপাপের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যথাকালে ফলেছিল। চাটুজ্যে যখন দেশে ফেরে, ব্রাহ্মণসন্তান তখন ধর্মান্তরিত ক্যাথলিক। সঙ্গে সহধর্মিণী। জাতে ইতালিয়ান।

প্রথম ইউরোপের সাক্ষাৎ পেলাম যখন জাহাজ মার্সেই থামল। মার্সেই থেকে প্রমোদভ্রমণে নিয়ে যায় সমুদ্রতীরের অনিন্দ্যসুন্দর দুটি গ্রামে কাসি আর লা সিও। জায়গাগুলি তখনও ট্যুরিস্টের আক্রমণে পর্যন্ত হয়নি। মনে হয়েছিল—স্বৰ্গ কি আর এর চেয়ে বেশি সুন্দর? প্রথম দর্শনেই ইউরোপের প্রেমে পড়েছিলাম। সেই তীব্র আকর্ষণ আজও কাটেনি।

আমাদের দেশে অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য, অসাধারণ পুরাকীর্তির অভাব নেই। কিন্তু দারিদ্রদোষ যেন আমাদের সব গুণরাশি নাশ করেছে। সব কিছুরই রূপ ধুলায় মলিন। আর সেই মলিনতা যেন আমাদের অন্তরেও প্রবেশ করেছে। প্রকৃতির অসামান্য সব দান, পিতৃপুরুষের অবিস্মরণীয় সব কীর্তিকিছুর প্রতিই যেন আমাদের সত্যিকার কোনও মমতা নেই। যে বালুময় সমুদ্রতীরের সন্ধানে ইউরোপীয়রা বহু ব্যয়ে বহু দূর চলে যায়, আমাদের সৈকত ধরে তা তো সর্বত্র ছড়ানো। কিন্তু ঝগ্নিঝুপড়ি আর রূপহীন দোকান বাজারের ভিতর দিয়ে সেখানে পৌঁছতে হয়। সম্প্রতি পশ্চিমি টুরিস্টের তুষ্টিসাধনের জন্য ওদিকে আমাদের কিছুটা নজর পড়েছে। কিন্তু তার পরিণামও তো পাঁচতারা হোটেলের ছড়াছড়ি। দেশে অভ্যন্তরীণ ট্যুরিজম যেটুকু বেড়েছে, তার ফলও ভয়াবহ। দার্জিলিং কার্সিয়াং-পুরী বস্তিতে পরিণত হতে চলেছে, যদিও তিনতারা, পাঁচতারারা ব্যাঙের ছাতার মতো সর্বত্র গজাচ্ছে। এই সাংস্কৃতিক অধোগমন শুধু দারিদ্রের ফল নয়। মনের তথা রুচির দারিদ্র। নীরদবাবু একটা শব্দ ব্যবহার করতেন—রিবাৰ্বারাইজেশন, পুনর্বৰ্বরায়ণ। মানে একটা সভ্য জাতির আবার বর্বর বনে যাওয়া। প্রাচীন ভারতবর্ষের রাস্তাঘাট স্বর্ণমণ্ডিত ছিল না। কিন্তু মেগাস্থিনিস, ফা-হিয়েন, হিউয়েন-সাঙের বর্ণনা পড়লে দেখি যে, দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলি তখনও বস্তিতে পরিণত হয়নি। আর দারিদ্রের সঙ্গে কুরুচির যে অঙ্গাঙ্গী কোনও সম্পর্ক নেই, তা সাঁওতালদের গ্রামে গেলে বোঝা যায়।

আমাদের জাহাজের লক্ষ্যস্থল মার্সেইয়ের পরবর্তী বন্দর লন্ডনের টিলবেরি ডা। সেখানে পৌঁছে মনে হল—”এ কোথায় আইয়া পড়লাম?” ভূমধ্যসাগর উপকূলের রোমান্টিক উত্তেজনা মুহূর্তে ধুলিসাৎ। নোংরা নোংরা সব জেটি, অন্ধকার নোংরা জলের মতো আকাশ, টিপটিপ বৃষ্টি—জান কয়লা করার জন্য যা-কিছু প্রয়োজন, বিধাতা তার সব কিছুই যেন এখানে ঢেলে রেখেছেন। শুনেছি হায়দরাবাদের নিজাম ইংল্যান্ডে পদার্পণ করে মন্তব্য করেন, “গিদ্ধৌর কা মুলুক।” কিন্তু এই যদি দেশের সর্বকালীন চেহারা হয় তো স্বেচ্ছায় কোনও খেকশিয়ালের এখানে আশ্রয় নেওয়ার কথা না। কোথায় শেক্সপিয়ারের ‘গ্রিন অ্যান্ড প্লেজেন্ট ল্যান্ড’? টিলবেরি ডক্স থেকে সে দেশ বহুতই দূর অস্ত। এই দেশে তিন-চার বছর বাস করতে হবে ভেবে বুকটা নিতান্তই দমে গেল।

জাহাজে ভারতীয় হাই কমিশন থেকে এক মেজকর্তা এসে কিছু পিঠ-চাপড়ানো মুরুব্বিয়ানাসূচক কথা বলে গেলেন। মূল বক্তব্য—দেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে এবং আমরা তোমাদের দেখাশুনো করায় কী সুখে থাকবে তা তোমরা এখনও বোঝনি। আর আমরা যারা ইংরেজ রাজত্বের যুগের বিলাতফেরত, তাদের যে কী অপমান সহা করতে হত তোমরা তা ভাবতে পারবে না। যে-সাহেব ছোঁকরা জুতো পালিশ করত সেও নাকি পয়সা নিয়ে সেলামের বদলে প্রশ্ন করত, “স্যার, আমাদের শাসন কেমন লাগে তোমার?” সেদিন যে সম্পূর্ণ বিগত নয় তার বহু প্রমাণ পরে পেয়েছি।

টিলবেরি থেকে লন্ডনের ভারতীয় হস্টেল। অতি ওঁছা। ফলে বিলাতবাস সম্বন্ধে উৎসাহ আরও কমে গেল। আর সেই সেপ্টেম্বর মাসের অবিশ্রান্ত টিপটিপ বৃষ্টি। ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই দেশে ফিরে যাই।

অক্টোবরের পাঁচ তারিখের আগে কলেজে বাসস্থান পাওয়া যাবে না। ইচ্ছে হল একবার তার আগে অক্সফোর্ড শহরটা দেখে আসি। পার্থসারথি গুপ্ত আর আমি একসঙ্গে রওনা হলাম। ট্রেনে যেতে প্রথম চোখে পড়ল একটি চেনা নাম। রেডিং স্টেশন পৌঁছবার আগে বিস্কুট কোম্পানি হান্টলি অ্যান্ড পামারের ফ্যাক্টরির বাইরে কোম্পানির নাম লেখা বিরাট সাইনবোর্ড। ছোটবেলা থেকে চেনা নামটি দেখে কেমন যেন একটা পরিচয়জনিত স্বস্তি বোধ করলাম।

তারপর অক্সফোর্ডের ছোট্ট স্টেশনটি। এখন প্রগতির ফলে সেটি ভেঙেচুরে ঝকঝকে নয়া ইস্টিশান হয়েছে। দেখলে মনে হয় কোনও নিকৃষ্ট শপিং আর্কেড। কী করা যাবে? প্রগতি বলে কথা। কার সাধ্য রোধে তার গতি। কিন্তু অক্টোবরের সেই মধ্যাহ্নে মেঘলা আকাশ আর টিপটিপ বৃষ্টি সত্ত্বেও ছোট স্টেশন আর আমাদের হিসেবে ছোটই ওই শহরটিকে দেখে ভাল লেগেছিল। স্টেশন থেকে হেঁটে হাই স্ট্রিটে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে মধ্যযুগের ইংল্যান্ড আমাকে আত্মসাৎ করেছে। আমি ক্যান্টারবেরি টেলসের জগতে পৌঁছে গেছি—মধ্যযুগের দরিদ্র ছাত্র। শুধু দেহবর্ণ শ্বেত নয়। কিন্তু চসারের ছাত্রের কাহিনির নায়ক সাদা লোক এমন কথা তো কবি লেখেননি! পার্থকে বলেছিলাম, “পার্থ, এই শহরে যদি জীবন কাটত তাহলে বড় খুশি হতাম।” সেই কল্পনার শহর বিশেষ কোনও দেশ বা জাতীয় সমাজ-সংস্কৃতির অঙ্গ-একথা আমার তখনও মনে হয়নি, এখনও মনে হয় না। বহু শত বছরের পুরনো সৌধমালায় সাজানো মানুষের তৈরি এই জ্ঞানপীঠ সর্বকালের তথা সর্বমানবের সম্পদ—এই চিন্তাই আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। আমার অসম্ভব ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছিল ঠিক বিশ বছর পরে। সে অভিজ্ঞতা সুখ-দুঃখে মেশানো। কিন্তু ওই ইচ্ছেপূরণে আমার কোনও মোহভঙ্গ হয়নি। বাস্তব অভিজ্ঞতা আর রোমান্টিক ধ্যানধারণা কখনওই সম্পূর্ণ মেলে না। কিন্তু আচার্য মোক্ষমূলরের উক্ষতারণ আমাকে নিরাশ করেনি।

বেলিয়ল কলেজের উনিশ নম্বর সিঁড়ির পাশের একটি ঘরে আমার বাসস্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল। সেখানকার জানালা দিয়ে কলেজের পিছনকার কোয়াড্রাঙ্গল অর্থাৎ চক চোখে পড়ে। সবুজ লন, বিরাট মহাম, বন্ধ্যা চেরি গাছ, শুধু ফুল ফুটিয়েই যার জীবনের সার্থকতা, সব মিলিয়ে দৃশ্যটি মনোরম সন্দেহ নেই, যদিও বেলিয়ল কলেজ হিসেবে প্রাচীন হলেও তার দালানকোঠা প্রায় সবই উনিশ শতকের। আত্মবিদ্রুপের সুরে ছাত্ররা বলত ফরাসি প্রেসিডেন্ট ক্লেমাঁসো বেলিয়ল কলেজ দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “সে মানঞিফিক, ম্যা সে নে পালা গার।” অর্থাৎ এই সৌধ অত্যাশ্চর্য হলেও ঠিক রেল স্টেশন হয়ে ওঠেনি। সত্যিতে ক্লেমাঁসো বিখ্যাত চার্জ অফ দা লাইট ব্রিগেড সম্পর্কে অনুরূপ একটি উক্তি করেছিলেন ঠিকই, “সে মানঞিফিক, ম্যা সে নে পা লা গের।” অর্থাৎ ঘটনাটি অসাধারণ হলেও এই নিরর্থক প্রাণদানকে যুদ্ধ বলা চলে না। যুদ্ধের ফরাসি ‘গের’। তার বদলে ‘গার’ অর্থাৎ রেল স্টেশন কথাটি বসিয়ে বেলিয়ল কলেজ সম্পর্কে এই কাহিনিটির সৃষ্টি। বাস্তশিল্প সম্পর্কে আমার রুচিবোধ উল্লেখযোগ্য না। তাই বেলিয়লের ভিক্টোরীয় যুগসুলভ নকল গথিক স্থাপত্য আমার চোখে ভালই লাগত। যুগে যুগে মানুষের রুচি পরিবর্তন হয়। রুচিবাগীশ রাসকিন সাহেব যে-কিবল কলেজের নকল-গথিক স্থাপত্য যাতে দেখতে হয় এই উদ্দেশ্যে উলটোবাগে ছ মাইল ঘুরে কাজে যেতেন, সেই কিবল কলেজের স্থাপত্যের সুখ্যাতি সাম্প্রতিক কালে বিদগ্ধজনের মুখেই শুনেছি।

কলেজের স্থাপত্য যেমনই হোক, তার মানবসম্পদ চমকে দেওয়ার মতো—সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল না। আমার পাশের ঘরের বাসিন্দা ই. এইচ. কার–কেমব্রিজে নানারকম সমস্যা হওয়ায় সাময়িকভাবে বেলিয়ল কলেজে আশ্রয় নিয়েছেন। আমার জন্য দুটি ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে একটি শেয়ার একটি বসার। বসার ঘরের পাশেই টমি বেলঘের ঘর। এই বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ বিচিত্র চরিত্রের মানুষ ছিলেন। ছাত্রছাত্রীরা ওঁর তীক্ষ্ণ বিপকে বিশেষ ভয় করে চলত। এক হতভাগ্য বালিকাকে উনি বলেছিলেন, “ডার্লিং, ইউ মে হ্যাভ বিউটিফুল থাইস, বাট ইউ ইউল নেভার লার্ন ইকনমিক্স।” আজকের দিনে এমন কথা কেউ বললে নারীবাদীরা তাকে শুল্যপক করে কাবাব বানাত। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে উনি ডার্লিং বলে সম্বোধন করতেন। যখন দিল্লি আসেন তখন পরবর্তীকালে শ্ৰীমতী গাঁধীর উপদেষ্টা পি, এন, ধারকে উনি ‘ধারলিং’ বলে আপ্যায়ন করতেন। টমির প্রতিবেশী হলেও আমার সঙ্গে ওঁর কখনও পরিচয় হয়নি। মাঝে মাঝে ভদ্রলোক আমাকে ‘বয়’ বলে সম্বোধন করতেন। এই আহ্বানের তাৎপর্য কখনও ঠিক বুঝে উঠিনি। প্রতিবেশীদের মধ্যে যাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল, তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত মাকর্সবাদী ঐতিহাসিক এবং পরবর্তীকালে বেলিয়ল কলেজের মাস্টার বা অধ্যক্ষ ক্রিস্টফার হিল। উনি থাকতেন আমার উপরতলার ঘরে, কিন্তু স্নানের ঘরটি আমাদের ভাগ করে ব্যবহার করতে হত। সেই সুত্রেই প্রথম পরিচয়। তারপর প্রায়ই ওঁর ঘরে বিয়ার খাওয়ার আমন্ত্রণ হত। এবং ওঁর সুত্রেই অনেক প্রগতিবাদী ছাত্রছাত্রী, ঐতিহাসিক হবসবম, প্রত্নতাত্ত্বিক গর্ডন চাইল্ড এদের অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। এইসব আলাপ-পরিচয়ের এক অপ্রত্যাশিত ফল ফলেছিল। সেকথা যথাস্থানে বলব।

বেলিয়লের ঘরে বিলাস ছিল, স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। বিরাট শোওয়ার ঘরটি গরম করার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। পুরুষ স্কাউট, অর্থাৎ খেদমতগার বিল রাত্রে পুরনো আমলের ডাকবাংলোর ব্যবস্থার মতো একটি বেসিন আর এক জাগ গরম জল ঘরে দিয়ে যেত। পাথরে তৈরি বাড়ি, ফলে সকালবেলা সেই জল বরফ হয়ে থাকত। বসা-তথা-পড়ার ঘরটিতে গ্যাসের আগুনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর একটি করে শিলিং ফেলে ওটিকে চালু রাখতে হত। শীতের কমার্স কলেজবাসটা শারীরিক সুখের কারণ হয়েছিল এমন কথা বলা কঠিন। আর আহার যদি জৈবিক সুখের অন্যতর ভিত্তি হয়, তবে বেলিয়লের বিরাট হল বা ভোজনাগারে যে-অভিজ্ঞতা রোজ হত তাকে পূর্বজন্মকৃত পাপের ফল ছাড়া আর কিছু ভাবা সম্ভব না। এর কারণ ইংরেজি খানার বহু প্রচারিত বিস্বাদ নয়। পরে দেখেছি ফরাসিদের মতো অমৃতবৎ খাদ্য ইংরেজরা রাঁধে না ঠিকই, কিন্তু ভাল ইংরেজি রান্না কোনও অর্থেই অখাদ্য নয়। আসলে আমাদের কলেজে প্রধান পাচকটি অসৎ লোক ছিল। রন্ধনশালার এই সম্রাট নাকি আমাদের টাকায় দু-দুটি বাড়ি তুলেছিলেন। যে বছর আমি অক্সফোর্ড ছাড়ি সেই বছর নতুন এক বারসার এসে তার কুকীর্তি ধরে ফেলে এবং বেলিয়লে আহার্যের ব্যাপারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু এই সৌভাগ্যের ভাগীদার মাত্র অল্প কদিনই হয়েছিলাম।

প্রথম যেদিন কলেজে থাকতে আসি, সেদিনই সিনিয়র টিউটর ডেকে একটি কথা বলেন। তার সারমর্ম এই যে, অক্সফোর্ডে গবেষক ছাত্রদের জীবন কিছুটা নিঃসঙ্গ। কারণ তাদের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের জন্য কোনও বাঁধাধরা ব্যবস্থা নেই। নিজেই নিজের পথ করে নিতে হয়, খুব কারও কোনও সাহায্য পাওয়া যায় না। এখন আর এ কথাটা তখনকার মতো সত্যি নেই। গবেষণার পরিদর্শকদের কর্তৃপক্ষের কাছে রীতিমতো জবাবদিহি করতে হয় যে, তাঁরা কতটা দেখভাল করছেন এবং ছাত্রদের কাজ কীরকম এগোচ্ছে। আর ছাত্র যে-বিষয়ে গবেষণা করতে চায় সে বিষয়ে কোনও বিশেষজ্ঞ না থাকলে ভর্তি করা হয় না। আমাদের সময় এত নিয়ম-কানুনের বালাই ছিল না। অনেক গবেষণা-পরিদর্শক প্রথমেই বলে দিতেন যে, ছাত্রর থিসিসের পঞ্চাশ ভাগ তাঁরা পড়বেন। এর বেশি কিছু তাঁদের দায়িত্ব নেই। তারপর ডোবা বা ভাসা—সে তোমার ব্যাপার।

আমাদের সময় অক্সফোর্ডে যাঁরা ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে আসতেন, তাঁরা সবাই কলিন ডেভিসকে পরিদর্শক বা সুপারভাইজার হিসাবে পেতেন। ডক্টর পুরি কুষাণ যুগ নিয়ে গবেষণা করবেন, পরিদর্শক কলিন ডেভিস। ইরফান হাবিব মোগল আমলের কৃষি এবং রাজস্বব্যবস্থা নিয়ে থিসিস লিখলেন, তাঁরও পরিদর্শক ডেভিস। এই ব্যবস্থার সমর্থনে বলা হত যে, বিষয়-বিশেষজ্ঞ না হয়েও গবেষণার রীতিপদ্ধতি জানা থাকলে ছাত্রর কাজ পরিদর্শন করা যায়। একথার সত্যতা অস্বীকার করা চলে না।

ডেভিস সাহেবের নিজের গবেষণার বিষয় ছিল এক দিকে ওয়ারেন হেস্টিংস, অন্য দিকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে। একদা ফৌজে মেজর এবং কেমব্রিজের ডক্টরেট পাওয়া জাতিতে ওয়েলশ এই মানুষটি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্বের ইতিহাস ভালই জানতেন। এবং সে যুগে রাজনৈতিক ইতিহাস সাধারণত যেভাবে চর্চা করা হত—অর্থাৎ যত্ন করে নথিপত্র ঘেঁটে ধারাবিবরণী রচনা এবং নিজের বুদ্ধিসাধ্য মতো কার্যকারণ ব্যাখ্যা করা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ওঁকে ভাল ঐতিহাসিক বললে কিছু ভুল হত না। কিন্তু আধুনিক অর্থে বিশ্লেষণ বা ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে সমাজবিজ্ঞানের ব্যবহার ওঁর আয়ত্ত ছিল না। এবং কথাবার্তা ধরনধারণ কিছুতেই উনি ইনটেলেকচুয়াল ছিলেন না। রক্ষণশীল অক্সফোর্ডে অনাধুনিক ভাবনাচিন্তা পাপ বলে গণ্য হত না ঠিকই, কিন্তু আধুনিক চিন্তাধারাকে বর্জন করার ধ্বজা তুলতেও এক ধরনের ভাষা তথা বুদ্ধির খেলা চালু ছিল। কলিন ডেভিস চিন্তাজগতের ওইসব দাবা-বোড়ের চাল জানতেন না। এক কথায় বলতে গেলে ভদ্রলোক। নেহাতই সাদামাটা মানুষ ছিলেন। অক্সব্রিজের চালবাজি ওঁর সম্পূর্ণই আয়ত্তের বাইরে। ওঁর আরও একটি ক্ষমার অযোগ্য দোষ ছিল। ওঁর পিতা ছিলেন শ্রমিকশ্রেণির লোক। এসব কথা অবশ্যই কেউ মুখে কখনও বলত না। উদার চিন্তার শেষ আশ্রয়স্থল অক্সফোর্ড শ্রমিকশ্রেণির লোক বলে কাউকে উপেক্ষা করবে? এমন কথা তুমি চিন্তা করতে পারলে? পারলাম কারণ শ্রেণিচেতনার ব্যাপারে ভণ্ডামির উচ্চতম সোপানে পৌঁছতে হলে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ইংল্যান্ডে যে রকম পাওয়া যাবে তেমন আর কোথাও না। মোট কথা অক্সফোর্ড ডেভিসকে গ্রহণ করেনি। ব্রাত্যজনজ্ঞানে তার সামাজিক এবং বৌদ্ধিক জগতের সীমানার বাইরে মানুষটির স্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল। সেনাবিভাগে ওঁকে স্পষ্টই বলে দেওয়া হয় বাপু এখানে তোমার খুব সুবিধে হবে না। মেজর হয়েছ—ওই পর্যন্তই। বড় ঘরের ছেলে না হলে এর উপরে ওঠা যায় না। অক্সফোর্ডে প্রত্যাখ্যানের পদ্ধতি এর চেয়ে কম নিষ্করুণ না। এখানে চাকরি এবং উন্নতির দুটি সিঁড়ি আছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি–যথা লেকচারার, রিডার, প্রফেসর আর দ্বিতীয়টি কলেজের ফেলোশিপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিযুক্ত প্রফেসর ইত্যাদি সবাই এখন কোনও না কোনও কলেজের ফেলো নির্বাচিত হন। এঁরা মাইনেটা পান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে। আহার বাসস্থান জোগান কলেজ। আগে এই নিয়ম ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরেরা সবাই ফেলোশিপ পেত না। আর ফেলোশিপ না পাওয়ার মানে ছিল এই যে—অক্সফোর্ডের সুধীসমাজ তোমাকে তাঁদের একজন হিসাবে মেনে নিল না। ডেভিস কোনও দিনই কোনও কলেজের ফেলো নির্বাচিত হননি। ওঁর শুধু বেলিয়ল কলেজে ডাইনিং রাইটস অর্থাৎ পানাহারের অধিকার ছিল। বারবার তিনবার ওঁকে ফেলো নির্বাচনের প্রস্তাব বাতিল হয়। এই অপমান ওঁকে অত্যন্ত আঘাত করেছিল। জীবনের শেষ দশ বছর অক্সফোর্ডে থেকেও ইনি ওখানকার কোনও কলেজের সীমানার মধ্যে পদার্পণ করেননি। আমরা যখন ছাত্র তখন কলেজে ‘ডাইনিং রাইটস’-এর অনুষঙ্গ হিসাবে ওঁর যেসব পাওনা ছিল, তার একটি রীতিমতো মধ্যযুগীয়। উনি ওঁর পরিবারের জন্য দৈনিক যে-পাউরুটি আর দুধ প্রয়োজন সেটা পেতেন। এবং রোজ সকালে বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে এই দুধরুটি উনি সংগ্রহ করতেন।

অক্সফোর্ড বাসের প্রথম দিনই কাউলি পাড়ায় ১০০ নম্বর ডিভিনিটি রোডে ওঁর বাড়ি যাই। বহু বছর ধরে ভারতীয় ছাত্রদের কাছে সুপরিচিত এই বাড়িটি আমার ভাল লেগেছিল। ডেভিসের স্ত্রী বাড়িটিকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন। ওঁরা বেশ গর্ব করে বলতেন যে, ওঁদের বিয়ের সময় দু’জনেরই বয়স আঠারো। এবং ওঁদের দাম্পত্য সম্পর্কে আমৃত্যু কখনও কোনও চিড় ধরেনি। এখানে উল্লেখযোগ্য–সে সময় কাউলি নিরঙ্কুশভাবেই শ্রমিক পাড়া ছিল। কিন্তু অক্সফোর্ডে শ্রমিক পাড়া মানে বস্তি বা পাশ্চাত্যের বড় শহরগুলির শহরকেন্দ্রের মতো মুমূর্ষ চেহারা না। দিব্যি পরিষ্কার ছিমছাম। তবে অধ্যাপকশ্রেণির আর কোনও মানুষ তখন ও পাড়ায় থাকতেন বলে আমার জানা নেই। ডেভিসের বসবার ঘরে একটি জিনিস আমার খুব ভাল লেগেছিল। ওঁর প্রশিক্ষণে যত থিসিস লেখা হয়েছে তার প্রতিটির একটি করে কপি সুন্দর করে বাঁধিয়ে শেল্ফে রাখা ছিল। ছাত্রদের কাজ সম্পর্কে গৌরববোধের এই রকম সুই প্রকাশ আমার আর কোথাও নজরে আসেনি।

বিধিমতো অক্সফোর্ডে আমার যা-কিছু শিক্ষা তা ডেভিস সাহেবের কাছে। কারণ উক্ত বিদ্যাস্থান আর কারও কাছে আমার অন্য কোনও শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। গবেষণাভিত্তিক ডিগ্রি নিতে গেলে তখন সুপারভাইজার ছাড়া আর কারও কাছে কোনও শিক্ষালাভের ব্যবস্থা ছিল না। এর বাড়তি যা-কিছু তা তোমার নিজের চেষ্টায় সংগ্রহ করতে হবে—অর্থাৎ সেটা হচ্ছে ফাউ। হিল আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন—এত খরচা করে সাতসমুদ্র পার হয়ে ডেভিসের কাছে পড়তে এলে? এই প্রশ্নের কোনও সরল উত্তর সম্ভব ছিল না। না, শুধু। ডেভিসের কাছে পড়ার জন্য সাতসমুদ্র পাড়ি দেওয়া যুক্তিযুক্ত হত না। পড়তে গিয়ে আর কী লাভ হয়েছিল সে কথায় পরে আসছি। তার আগে আইনত অক্সফোর্ডে আমার একমাত্র শিক্ষক এই হেরে যাওয়া মানুষটি সম্পর্কে আরও দু-এক কথা বলতে চাই।

ডেভিস যদি বড় ঘরের ছেলে হতেন, তা হলে ফৌজের চাকরি ছেড়ে মাস্টারি করতে আসতেন না। যথাকালে অন্তত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদ অবধি পৌঁছে বক্ষদেশ অনেক মেডালে সুশোভিত করে নামের পিছনে ইংরেজি বর্ণমালার অনেকগুলি অক্ষর লাগিয়ে সগৌরবে অবসর গ্রহণ করতেন এবং জীবনান্তে সাঁজোয়া গাড়ি চেপে পুরোদস্তুর সামরিক সম্মানসহ কবরস্থ হতেন। কিন্তু ওঁকে স্পষ্টই বলে দেওয়া হয় যে, এসব উচ্চাশা করা সুবুদ্ধির কাজ হবে না। তাই অনেক লড়াই করা মানুষটি পুরস্কার হিসাবে কেমব্রিজে পড়ার সুযোগ পান এবং তিরিশের দশকের শেষাশেষি অক্সফোর্ডে চাকরিও জোটে। তবে শেষের ব্যাপারটা খুব সম্মানসূচকভাবে হয়নি। পাঁচ বছর পাঁচ বছর করে বাঁধা মেয়াদে বহাল হতেন। বোধহয় জীবনের শেষ ক’বছর এই অপমান সহ্য করতে হয়নি। এসব ব্যাপারে ইংরেজদের এক বাঁধা বুলি আছে : “কী করা যাবে? নিয়ম।” নিয়ম যে বদলানো যায় এবং খুঁটির জোর থাকলে বদলানো হয়েও থাকে, সুনীতির মুখোশধারী এই সামাজিক সংস্কৃতিতে সেসব কথা উল্লেখ করা ভদ্রজনোচিত নয়। ডেভিস সম্পূর্ণ অহঙ্কারমুক্ত সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কোনও ঘোরপ্যাঁচ বা অসত্য ভাষণ করতে কখনও দেখিনি। কিন্তু ব্রিটেনের অতিরিক্ত শ্রেণিসচেতন সমাজ ওঁকে একটি অর্ধসত্য বলার প্রেরণা জুগিয়েছিল। উনি বলতেন যে ওঁর বাবা একটি টুইড ফ্যাক্টরির মালিক ছিলেন। অনেক পরে জানতে পারি উক্ত টুইড ফ্যাক্টরিতে মানুষটি মালিক না, শ্রমিক ছিলেন।

জীবনের অনেকটা সময় কলিন ডেভিস পেশাদার সৈনিক হিসাবে কাটিয়েছেন। ওঁর স্মৃতিচারণে ফৌজি জীবনের কথা একটা বড় অংশ জুড়ে থাকত। প্রথম মহাযুদ্ধের প্রসঙ্গে উনি যেসব ভয়াবহ কাহিনি শোনাতেন তা আমি অন্য কারও কাছে শুনিনি বা কোথাও পড়িনি। উনি বলেন যে, অনেক সময়ই কোনও জার্মান সৈন্য ধরা পড়লে ছোঁকরা ইংরেজ সেপাইরা তাদের প্যান্টের ভিতর সলতেয় আগুন ধরিয়ে বোমা ঢুকিয়ে দিতেন। জার্মান ছেলেগুলি ভয়ে চিৎকার করতে থাকত। তারপর বোমা ফেটে ওদের শরীর চৌচির হয়ে যেত। জার্মানরাও ইংরেজ বন্দিদের নিয়ে একই খেলা খেলতেন।

অফিসারদের কোয়ার্টারে মৃত্যু নিয়ে নানা বিকট ঠাট্টা হত। যোদ্ধাদের মধ্যে চালু একটি কুসংস্কার ছিল যে, সকালবেলা দাড়ি কামাতে গিয়ে কারও রক্তপাত হলে সেদিন তার মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব প্রবল। যেদিন ওঁর নিজের এই দুর্ঘটনা ঘটত সেদিন উনি ভয়ে কুঁকড়ে থাকতেন। একবার ওঁর গায়ে গুলি লাগে। সে গুলি শরীরের কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বহু বছর পরে তার হদিস পাওয়া যায়। ডেভিসের শরীরে ভ্রমণের ফলে সেটা বেঁকে ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের আকারপ্রাপ্ত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের জাদুঘরে এই বিচিত্র জিনিসটি বহুদিন রাখা ছিল। পরে ডেভিস ভারতে গোরখা রেজিমেন্টের মেজর হন। এবং দীর্ঘদিন সৈন্যদের সঙ্গে ধরমশালায় বাস করেন।

গোরখাদের সম্পর্কেও উনি গা শিউরানো সব কাহিনি শোনাতেন। ডেভিস শেষ ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে লড়েছিলেন। তারপর উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে শান্তিরক্ষার কাজে বহুদিন নিযুক্ত ছিলেন। শান্তিরক্ষার মানে অনেক সময়ই যে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এ কথা গোপন করার চেষ্টা উনি কখনও করেননি। ওঁর কাছেই শুনি যে, শান্তির সময় গোরখারা। শিশুর মতো সরল। সীমান্তের পাঠান গ্রামগুলিতে ওরা বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে খুব ভালবাসত। কিন্তু পরদিনই ওই অঞ্চলে বিদ্রোহ হলে শান্তি স্থাপনের জন্য যখন গোরখারা যেত তখন কাল যাদের সঙ্গে খেলা করেছে সেই বাচ্চারা নির্ভয়ে ওদের কাছে এলে বিনা দ্বিধায় তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করত। আর তার সঙ্গে অট্টহাস্য—যেন দারুণ একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত নখদন্ত গোপন করার চেষ্টা ডেভিস কখনও করেননি। উনি বলতেন, “আমি যদি ভারতীয় ভদ্রলোক হতাম তা হলে কংগ্রেসের সভ্য হতাম সন্দেহ নেই।” মানুষের রাজনীতি তার শ্রেণিস্বার্থের উপর নির্ভর করে, সহজ বুদ্ধিতে উনি এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছিলেন।

ভারতীয় রাজনীতির এক বিশেষ মুহূর্তে উনি অভিনেতা না হলেও দর্শকের ভূমিকায় অংশ নিয়েছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার অল্প ক’দিন আগে ডেভিস অমৃতসর হয়ে কর্মস্থল ডালহাউসি যান। ফেরার পথে দেখেন—হঠাৎ যেন চেনা পৃথিবীটা বদলে গেছে। রাস্তার মানুষগুলি হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে—যেন পারলে ওদের ছিঁড়ে ফেলবে। ওঁর কাছে শুনি যে, ওঁর কোনও কোনও সহকর্মী দেশি ভৃত্যদের নিয়মিত চাবকাতেন। এই তথ্য উল্লেখ করে সঙ্গে সঙ্গেই উনি বলতেন, “আমার গায়ে কেউ হাত তুললে আমি অবশ্যই তাকে খুন করতাম। ভারতীয়রা মার খেয়ে তার প্রতিশোধ কেন নিত না, একথা আমি আজও বুঝতে পারিনি।” ভারতীয় মনিবরাও যে ভৃত্যদের পেটাত, এ কথা বলার মতো সৎ সাহস সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি।

অক্সফোর্ডে ওঁর চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে রাজনীতির খেলা ছিল—এ কথা উনি অকপটে স্বীকার করতেন। পদটির জন্য ওঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন টমসন—যাঁর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস ঠিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী না হলেও, ভারতবাসীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন রচনা। ত্রিশের দশকে গাঁধীর আন্দোলনে ভারতে ইংরেজ শাসনের ভিত রীতিমতো নাড়া খেয়েছে। সময়টা ঠিক রাজনৈতিক উদারতা দেখাবার জন্য অনুকূল না। ওই দশকের গোড়ার দিকে শ্রমিক দলের মন্ত্রিসভা সাম্রাজ্যরক্ষার ব্যাপারে কোনও দয়ামায়া দেখিয়েছেন এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। সুতরাং টমসনের নরম মনোভাব তাঁর শত্রু হয়ে দাঁড়াল। চাকরিটা ডেভিস পেলেন। টমসন যে ওঁর তুলনায় অনেক উঁচুদরের ঐতিহাসিক সে কথা ডেভিস নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেন।

অক্সফোর্ডে আইনত আমার একমাত্র শিক্ষক ডেভিসের কাছ থেকে শিক্ষণীয় কিছু কি পেয়েছিলাম? এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক। শুধু ইতিহাস কেন, মানববিষয়ক যে কোনও শাস্ত্রেই বক্তব্য কীভাবে বাছতে এবং পরিবেশন করতে হবে তার কতকগুলি সনাতন নিয়ম আছে। এ নিয়মগুলি কোথাও লেখা নেই। কিন্তু তাদের ভিত্তি মানবমনের কতগুলি স্বাভাবিক প্রবণতা—যেনন্দন এবং বৌদ্ধিক চেতনা জাতীয় সংস্কৃতির সীমা ছাড়িয়ে সমস্ত পরিশীলিত মনকে স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে। আধুনিকোত্তর চিন্তায় যথাযথভাবেই যুগে যুগে রুচির পরিবর্তন, শ্রেণিতে শ্রেণিতে রসবোধের বিভিন্নতা এই সব মনে রেখে ‘রিয়াল রিডার’ বা সত্যিকার পাঠকের কথা ভোলা হয়েছে। সে পাঠক কোনও সর্বত্র প্রযোজ্য নিয়ম অনুযায়ী সাহিত্য বা শিল্পর বিচার করে না, করে তার বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক পটভূমি দ্বারা নির্ধারিত ভালমন্দ বিচার দিয়ে। একথা স্বীকার করলেও সাহিত্য বা শিল্পের প্রামাণ্য রীতিনীতি বা ‘ক্যানন’ সম্ভবত বাতিল হয়ে যায় না। বোধহয় এসব ব্যাপারে সংস্কৃতি-নিরপেক্ষ কতগুলি ধারা সব জায়গায়ই চোখে পড়ে। দু-একটা নেতিবাচক উদাহরণ দিয়ে আমার বক্তব্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। লিখতে বসে একগাদা অবান্তর কথা সম্ভবত কোনও সংস্কৃতিই আনন্দদায়ক বলে মনে করে না। আমাদের লোকসংস্কৃতিতে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ বলে প্রচলিত প্রবাদটিতে অবান্তর কথার বর্জনীয়তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তেমনই অতিকথন দোষ কোনও সংস্কৃতিতেই জনপ্রিয় না। ভীমরতিপ্রাপ্তির ফলে আমার যদি এই দোষ জন্মে থাকে তা হলে দেশ পত্রিকার পাঠকসংখ্যা অন্তত কিছুদিনের মতো হ্রাসপ্রাপ্ত হবে সন্দেহ নেই। আর দুর্বোধ্যতা? প্রতিভাবান পুরুষ হোমি ভাবার লেখা পড়ে যদি সত্যিতে কেউ আনন্দ পেয়ে থাকেন তো তিনি নিশ্চয়ই শিরোপা পাওয়ার যোগ্য। এইসব উদাহরণের উলটো উদাহরণও অনেক দেওয়া যায়। আমরা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এবং তিন যুগব্যাপী কাহিনি ভালবাসি। গ্রিকরা সীমিত স্থানকালের বাইরে গেলে বিরক্ত হতেন। এ তর্কের শেষ নেই। তবে ডেভিসের কাছে কী শিখেছিলাম সে প্রসঙ্গে এই আলোচনার গভীরে যাওয়া নিষ্প্রয়োজন।

ওঁর কাছে যা শিখি তা কতকটা হাতেনাতে কারিগরি শিক্ষার মতো। উনি কোনও তত্ত্ব আওড়াতেন না। একটা লেখা নিয়ে দেখালে তার ভাল-মন্দ বিচার করে কীভাবে লেখা উচিত বা অনুচিত সেটা বুঝিয়ে দিতেন। আনকোরা গবেষকদের এক স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, যা কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে তার সবই লেখার মধ্যে ঢোকানো। সেই সুকুমার রায়ের উন্নতিশীল যুবক ভবদুলালকে মনে পড়ে? যা-কিছু শুনছেন তার সবই তাঁর পরিকল্পিত বই চলচিত্তচঞ্চরী’র ভিতর ঢুকিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করতেন? এই ভবদুলালী প্রবৃত্তি নতুন গবেষকের পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত মারাত্মক শত্রু। ডেভিস সাহেব ‘ডেড ইনফরমেশন’অর্থাৎ প্রাণহীন তথ্য—যাতে বিষয়টি সম্বন্ধে পাঠকের ধারণা একটুও এগুচ্ছে না, তা কী করে নির্মমভাবে ছাঁটাই করতে হয় হাতে ধরে সেই শিক্ষা দিয়েছিলেন। তখন এবং পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে এসে দেখেছি—এত যত্নে এই শিক্ষা তার কেউ দিতেন না বা দেন না। অথচ অনেক নয়া গবেষকেরই এই শিক্ষা বিশেষ প্রয়োজন। ওঁর কাছে কাজ করে তথ্যসমুদ্র থেকে সার গ্রহণ করার ক্ষমতা অন্তত কিছুটা অর্জন করতে পেরেছি বলে আমার ধারণা। দ্বিতীয় কথা, ঐতিহাসিক রচনায় বিবরণী এবং যুক্তি দুদিকেই সমান নজর রাখতে হয়। বিষয়-নিরপেক্ষ বক্তৃতায় ব্যাপারটা বোঝানো যায় না। দিনের পর দিন প্রতিটি পরিচ্ছেদ বারবার লিখিয়ে ডেভিস এই শিল্পকর্ম শিক্ষা দিয়েছিলেন। আজ যদি মোটামুটি লিখতে শিখে থাকি তো তার জন্য যে শিক্ষক আমার উত্তমর্ণ তাঁর নাম কলিন ডেভিস। উন্নাসিক আঁতলামি ভঙ্গি নিয়ে এই কথা অস্বীকার করলে আমার দশ হাজার বছর রৌরব নরকবাস সাজা হওয়া উচিত।

থিসিস তথা ঐতিহাসিক রচনা লেখার শিক্ষা আরও একটি মানুষের কাছে পেয়েছিলাম। তিনি সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অধ্যাপক ভিনসেন্ট হারলো। স্নাতকোত্তর ছাত্রদের জন্য শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে সেমিনার তখন খুব চালু ছিল না। এক হারলো সাহেব নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজটি করতেন। ওঁর বিশেষ জনপ্রিয় সেমিনারের বিষয় ছিল কী করে থিসিস লিখতে হয়। উনি প্রথমেই ছাত্রকে বলতেন যে, গবেষণা শুরু করার আগেই বিষয়টি সম্বন্ধে কীরকমের সব প্রশ্ন তার মনে আসছে তার একটি তালিকা তৈরি করতে। সেই প্রাথমিক প্রশ্নমালা থেকেই ক্রমে ক্রমে থিসিসের মূল কাঠামো রূপ পরিগ্রহ করত। এ শিক্ষাও উনি হাতেনাতেই দিতেন। আর অনেকটাই বিভিন্ন বয়সে নিজের লেখা থেকে উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক দেখাতেন কীভাবে অল্প বয়সের লেখায় কাব্য বা আঁতলামি করে বিষয়বস্তুকে অকারণে ঘোলাটে করে তোলার আশঙ্কা থাকে। আর ওই সেমিনারে অত্যন্ত দরকারি একটি আলোচনা ছিল পাংচুয়েশন নিয়ে। ব্যাপারটা যে কত দরকারি তা ওই সেমিনারের অভিজ্ঞতা হলে কখনও বুঝতাম না। এখন অবশ্য আঁতলামি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইতিহাস আর বস্তু-উত্তীর্ণ মায়াবাদে কোনও পার্থক্য থাকছে না। আর দুর্বোধ্যতাই যখন বক্তব্যের শ্রেষ্ঠত্বর নিদর্শন, তখন কমা সেমিকোলোন নিয়ে কে মাথা ঘামায়?

অক্সফোর্ডে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আমার সংস্পর্শ আর শুধু একটি মানুষের মারফত হয়েছিল। তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ স্যার জর্জ ক্লার্ক। ডেভিস নিজেই আমাকে ওঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন। বারতিনেক ওঁর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। আমি ভারতবর্ষের উপকূলে ডাচ কোম্পানির ব্যবসা নিয়ে গবেষণা করব শুনে উনি আমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন। ওঁর প্রথম প্রশ্নটি আমার খুব মনে আছে। সতেরো শতকে এশিয়ার সঙ্গে ডাচদের ব্যবসার প্রধান উপজীব্য ছিল মশলা। স্যার জর্জ জানতে চান যে, ওইসব মশলাগুলি আমি স্বচক্ষে দেখেছি কি না এবং কোনটা কী কাজে লাগত এবং এখনও লাগে তা আমার জানা আছে কি না। ইংল্যান্ডে ইতিহাসচর্চার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য বস্তুনিষ্ঠা। স্যার জর্জের প্রশ্নে তারই প্রমাণ পেয়েছিলাম।

আমাদের সময় যারা গবেষণা-ভিত্তিক ডিগ্রি করতে যেত তাদের সঙ্গে প্রথম অর্থাৎ অনার্স ডিগ্রি করতে যারা যেত তাদের পঠন-পাঠনে কতটা তফাত ছিল একটা হিসাব থেকেই বোঝা যাবে। আমার গবেষণা-পরিদর্শক বা সুপারভাইজারের সঙ্গে আমার আট সপ্তাহের টার্মে দুবার দেখা হত। তাও তিনি যতটা ছাত্রদের দেখাশুনো করতেন আর কেউ ততটা করতেন বলে আমার জানা নেই। কোনও কোনও নামজাদা অধ্যাপক গবেষক ছাত্রদের ক্ষমাঘেন্না করে বছরে দু-একবার মাত্র দেখা দিতেন। তারপর পাস করে ফেল করো সে তোমার ললাটলিপি। ডি.ফিল পরীক্ষায় কোনও কোনও বিষয়ে ফেলের সংখ্যা ছিল শতকরা ষাট এবং তার একমাত্র কারণ পরীক্ষার কাঠিন্য নয়। ডেভিস ছাড়া আর যে দু’জনের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে কিছুটা শিক্ষালাভ করেছিলাম, সে একান্তই নিজের উৎসাহে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে নয়। আর আন্ডার গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত একজন, কখনও কখনও দু’জন, বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের কাছে তাদের লেখা প্রবন্ধ বা। প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করতে হত। সুতরাং অক্সফোর্ডের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে তারা যে তুলনায় অনেক বেশি ফায়দা ওঠাত সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এখানে ছাত্রাবস্থায় সব চেয়ে মূল্যবান শিক্ষা যা পেয়েছি তা বাঁধাধরা ব্যবস্থার বাইরে। যে কেউ যে-কোনও বক্তৃতা শুনতে যেতে পারত। কিন্তু শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনে অনেক সময়ই হতাশ হয়েছি। তখন সেই বাঁদরের বাঁশে চড়ার আদর্শে প্রতি বছর কেঁচেগষ করে বিষয়টি আগাগোড়া বক্তৃতা মারফত বুঝিয়ে দেওয়ার প্রথা চালু ছিল না। নিজের ইচ্ছে এবং রুচি অনুযায়ী সাধারণত যখন যে বিষয় নিয়ে কেউ চিন্তা বা গবেষণা করছেন তারই কোনও দিক নিয়ে বক্তৃতা করতেন। বিরাট বিরাট সব পণ্ডিত কীভাবে তাঁদের কাজে এগুচ্ছেন বক্তৃতা মারফত তার আঁচ পাওয়া যেত। কিন্তু এঁরা অনেকেই বক্তা হিসেবে নিরেস ছিলেন। তাই অনেক সময়ই বক্তৃতা শুনে কোনও রস পেতাম না। তবে এ নিয়মের ব্যতিক্রম যথেষ্টই ছিল। ইতিহাসে ট্রেভর রোপার, সাহিত্যে হেলেন গার্ডনার এবং এনিড স্টার্কি, শিল্পের ইতিহাসের অধ্যাপক উইনডট—এঁদের বক্তৃতায় পাণ্ডিত্য, অভিনব চিন্তা, রসবোধ আর ভাষাচাতুর্যর যে অদ্ভুত সমন্বয় দেখেছি তার তুলনা অন্যত্র কোথাও পাইনি। উইনডট-এর বক্তৃতায় এত ভিড় হত যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও হলে শ্রোতাদের স্থান সঙ্কুলান হত না। স্থানীয় থিয়েটার ‘প্লেহাউস’-এ বক্তৃতার ব্যবস্থা করতে হত এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে যারা শুনত তাদের জন্য মাইকের ব্যবস্থা থাকত। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা ভাল যে, ভিড় করে বক্তৃতা শোনা অক্সফোর্ডের স্বভাবধর্ম নয়। বেশির ভাগ বক্তৃতায়ই দু-চার জনের বেশি শ্রোতা জোটে না। শুনেছি ডক্টর রাধাকৃষ্ণনের বক্তৃতায় প্রথম দিন জনা পঞ্চাশেক লোক আসত। ক’দিন পর শ্রোতার সংখ্যা দাঁড়াত দুই-মিস্টার স্পন্ডিং এবং তাঁর পত্নী। ওঁর চেয়ারটির জন্য টাকা স্পল্ডিংই দিয়েছিলেন।

উইনডট-এর বক্তৃতা প্রতি বছরই শুনতে যেতাম। রেনেসাঁস ইটালির চিত্রশিল্পের এই ঐতিহাসিক বহু বিষয়ে বক্তৃতা করতেন। যে বক্তৃতামালা আমার বিশেষ করে মনে আছে তার বিষয়বস্তু ছিল ‘দা মাস্ক ইন মডার্ন অ্যাবস্ট্রাক্ট পেন্টিং’। ব্রাখ, ক্লে, পিকাসো—এঁদের সবার ছবি বিশ্লেষণ করে উনি দেখান যে, অনেক ক্ষেত্রেই খুব সাধারণ কোনও বিষয়, যার বেশ কিছুই ইউরোপীয় শিল্পের ইতিহাসে ‘লা পেতি মানিয়ের’ অর্থাৎ ছোট মাপের শিল্পপ্রচেষ্টার গণ্ডির ভিতর পড়ে, তার উপর অসাধারণ মুনশিয়ানা দেখিয়ে দুর্বোধ্যতার মুখোশ চাপিয়ে দর্শককে ধাঁধা লাগানোর চেষ্টা হয়। অর্থাৎ পাকা কারিগররা তাঁদের চিন্তার সামান্যতা দুর্বোধ্যতার মুখোশে ঢেকে মহৎ শিল্প বলে পরিবেশন করেছেন। কথাটা সত্যি কি বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে যখন শুনেছিলাম তখন মনে হয়েছিল কথাটা ঠিকই বলছেন।

তখনকার এবং সাম্প্রতিক কালের অক্সফোর্ডের মধ্যে একটা বড় তফাত ঘটেছে মার্কিন চিন্তাধারার প্রভাব এবং বাজারু অর্থনীতি মানবজীবনের পরা-সত্য বলে গ্রহণ করার ফলে। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থায় গবেষণার উপর চাপ খুব বেশি দেওয়া হয়। বেশ কিছু লেখা নিয়মিত না ছাপালে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে উন্নতির আশা থাকে না। ‘পাবলিশ অর পেরিশ’ এই শিক্ষাদর্শনের মূল কথা। পুরনো অক্সফোর্ডে এ বালাই ছিল না। বলা হত—তোমার কিছু বলার থাকলে তবেই লেখা প্রকাশ করো, চাকরি রাখার জন্য লেখা ছাপাতে হবে এই কারণে না। গাদি গাদি দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির লেখা ছাপানোর চেয়ে কিছু না লেখা ভাল। গবেষণার দাম হয় তার গুণ বিচার করে, পরিমাণ হিসেব করে নয়। বরং একটা ধারণা ছিল যে, অল্প কিছু লোক বাদ দিলে যারা বেশি লেখে তারা অধিকাংশই চিন্তার গভীরতা বা নতুনত্বর বিচার করলে নিরেস। আর হিউম্যানিটিস-এর ক্ষেত্রে গাদি গাদি লেখা কি খুব দরকার? রোজ সকালবেলা উঠে আদাজল খেয়ে চসারের উপর বছরে বারোটা প্রবন্ধ না লিখলে মানব-সংস্কৃতি কি খুব সঙ্কটাপন্ন হবে? যদি বলো যে, পরিমাণে বেশি গবেষণা আর গুণগত সৌকর্য দুটোর দিকেই নজর দেওয়া দরকার, তার উত্তর—আসলে ওটা ভুয়ো কথা। পরিমাণের দিকে বেশি নজর দিয়ে সবাইকে গবেষণা করতে বাধ্য করলে চিন্তার গভীরতায় শেষ অবধি ঘাটতি পড়া ছাড়া উপায় নেই। সম্প্রতি এক আলোচনায় বলা হয় যে, কিথ টমাস তাঁর প্রথম বই, যা নাকি ইতিহাসচিন্তায় বিপ্লব ঘটায়, সেটি লিখতে আঠারো বছর সময় নিয়েছিলেন। এখনকার দিনে এইভাবে চললে চাকরি জোটে না। ফলে আর কিথ টমাসেরও আবির্ভাব হয় না। এই আলোচনা প্রসঙ্গে একজন বললেন, ‘উই ক্যান নট অ্যাফোর্ড ইট দিস ডেজ’। কেন? হঠাৎ কোন বিপর্যয়ের ফলে ব্রিটিশ সংস্কৃতি যুগান্তকারী কাজের জন্য সময় দিতে অক্ষম? উত্তরবাজার জীবনাদর্শ। ম্যাগি থ্যাচারের রাজত্বকাল থেকে সরকার ঠিক করেছেন যে, করদাতার টাকা যারা খরচা করছে তাদের প্রতিটি পয়সার হিসাব দিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই হিসাব কীভাবে হবে? বছরে ক-পৃষ্ঠা লিখেছ তা গুনে। আর যদি না লেখো তবে উন্নতির আশা জলাঞ্জলি দাও এর নাম রিসার্চ অ্যাসেসমেন্ট। যে ব্যক্তি সারা জীবন একমনে জ্ঞানের গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে তাঁর বিদ্যা আর মননের সুফল দিনের পর দিন ছাত্রদের দিয়েছেন এবং তার ফলে তাদের মনোজগতে বিপ্লব ঘটেছে, তাঁর এই ব্যবস্থায় কোনও স্থান নেই। তারক সেনের মতো মানুষের এই নয়া জমানায় সম্ভবত চাকরি যেত, কিথ টমাসের অধ্যাপক হওয়ার কোনও সম্ভাবনা থাকত না। এই ব্যাধি এখন পৃথিবীময় ছড়িয়েছে। আমার ধারণা শিক্ষাকে অশিক্ষায় পরিণত করার এর চেয়ে ভাল ফর্মুলা কেউ চেষ্টা করেও আবিষ্কার করতে পারত না। এখানকার এক কোপনস্বভাব স্কট পণ্ডিতকে এক মার্কিন গবেষক প্রশ্ন করেছিলেন, “হোয়াট ইস ইওর ফিল্ড?” কুদ্ধ অধ্যাপকের সগর্জন উত্তর, “আই অ্যাম নো কু [অর্থাৎ কাউ], মান! আই ডোনট হ্যাভ নো ফিন্ড।” এখন গবেষকরা নিজের নিজের ফিল্ড বেছে নিয়ে শুধু সেখানেই চরে বেড়াচ্ছেন। আধা হজম হওয়া ঘাসপাতা অনর্গল ছাপার অক্ষরে উগরে দিচ্ছেন। দুর্গন্ধে মা সরস্বতী পালাবার পথ। পাচ্ছেন না।

.

অক্সফোর্ডে শিক্ষার একটা বড় অংশ পাওয়া যেত সহপাঠী এবং ছাত্রমণ্ডলীর কাছ থেকে। আমার ধারণা এখনকার তুলনায় সেই সময়ে ছাত্ররা পড়াশুনো অনেকটা বেশি করতেন। তার অন্যতম কারণ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন। এখন দেখি অনেক ছাত্রই প্রায় প্রতি ছুটিতেই বাইরে কোথাও চলে যায়। বছরে বেশ লম্বা একটা ছুটি নেয় না এরকম ছাত্র সংখ্যায় বোধহয় কম৷ ছুটিটার উদ্দেশ্য যদি ভ্রমণ হয়, তবে তার জন্য পয়সা দরকার। এবং এই পয়সা অনেকেই নিজেরা রোজগার করে। তার জন্যও বেশ কিছুটা সময় যায়। সুতরাং সব মিলিয়ে পড়াশুনোর জন্য যে সময় বাকি থাকে তা বোধহয় আগের তুলনায় কম।

একটা ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। পঞ্চাশের দশকে যারা প্রথম শ্রেণিতে পরীক্ষা পাস করত তারা ইংরেজি ছাড়া অন্তত অন্য আর একটা কোনও ভাষা—বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফরাসি—স্বচ্ছন্দে পড়তে পারত। এই ভাষাজ্ঞানের ঐতিহ্য এখন প্রায় লুপ্ত হয়েছে। তবে বিদ্যায় কিঞ্চিৎ ঘাটতি যদিবা হয়েও থাকে, বুদ্ধি বা ধীশক্তিতে কোনও তারতম্য সম্ভবত ঘটেনি।

ক্রিস্টফার হিলের দৌলতে, কতকটা রাজনৈতিক মতবাদের মিল থাকায়, বেশ কিছু বামপন্থী ছাত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে যাঁদের নাম বিশেষ করে মনে পড়ে তারা হলেন পরবর্তীকালে হিস্ট্রি ওয়ার্কশপের প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতা র‍্যালফ [বা র‍্যাফায়েল স্যামুয়েল, ট্রটস্কির জীবনীকার পিটার সেজউইক, ডিকেন্স-বিশারদ গ্যারি বা গ্যাব্রিয়েল পিয়ারসন, ট্রটস্কিপন্থী দক্ষিণ আফ্রিকার বুদ্ধিজীবী মাইকেল কিড্রন প্রমুখ। আরও কয়েকজন ছিলেন যাদের একটু দূর থেকে সম্ভ্রমের চোখে দেখতাম, ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। এঁদের মধ্যে প্রধান আমাদের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক কিথ টমাস বর্তমানে প্রফেসর স্যার কিথ টমাস, নতুন ইতিহাসচিন্তার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাবশীল ‘পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট সোসাইটি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাসের সঙ্গে নৃতত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে যারা মানুষের অতীতকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, স্যার কিথ তাদের পুরোধা। কিথের সঙ্গে পেশাগত আদানপ্রদান হয়েছিল অনেক পরে এবং আমার কিছু কাজে ওঁর প্রভাব রয়েছে। আর কানাডা থেকে আগত রোডস স্কলার চার্লস বা চাক টেলর পরে অক্সফোর্ডে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গ্ল্যাডস্টোন অধ্যাপক হয়েছিলেন। কানাডার প্রগতিবাদী রাজনীতিতে ওঁর অবদান আছে। বামপন্থী যেসব সহপাঠীর কথা লিখলাম এঁদের অনেকেই ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। কিথের কাছে গল্প শুনেছি—যেদিন স্তালিন মারা যান সেদিন নাকি র‍্যালফ সজল নয়নে ওঁকে বলেন, “কিথ। আঙ্কল জো ইস ডেড।” কিন্তু হাঙ্গেরির ঘটনার পর এঁদের অনেকেরই মোহভঙ্গ হয়। বেলিয়লের কমিউনিস্ট ছাত্ররা দল বেঁধে পদত্যাগ করে। ক্রিস্টফার হিল পলিটব্যুরোর সভ্য ছিলেন। উনি দলের ভিতরে থেকে সোভিয়েত নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই করেন। শেষে যখন দেখলেন পার্টির মত বানীতি বদলানো সম্ভব নয়, তখন পদত্যাগ করলেন।

অক্সফোর্ডে ছাত্রদের কতকগুলি সভা বা প্রতিষ্ঠান ছিল যেখানে নানা দেশের প্রগতিবাদী ছাত্ররা একত্র হতেন। আফ্রো-এশিয়ান সলিডারিটি এবং প্যান-আফ্রিকান পার্সোনালিটি এই দুটি কথা খুব শোনা যেত। মনে রাখা ভাল তখনও ষাটের দশকের ম্যাকমিলানবর্ণিত ‘উইন্ড অফ চেঞ্জ’ অর্থাৎ আফ্রিকায় বিদেশি শাসনের উপর যবনিকা পতন শুরু হয়নি। কিকুয়ুদের বিদ্রোহ তখন তুঙ্গে। আর মালয়ে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। ভিয়েতনামে মার্কিনরা তখনও আসরে নামেনি। তবে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে গেছে। অল্পদিন আগেই চার্চিল সাহেব লৌহযবনিকা কথাটি ব্যবহার করেছেন। অক্সফোর্ডে ছাত্রদের মধ্যে দেখলাম রাজনৈতিক মতভেদ খুব স্পষ্ট। বড় ঘরের ছেলে বা টাকাওয়ালা কিছু ছাত্ৰ দামি রেস্তোরাঁয় ডিনার খেয়ে নেচেকুঁদে ফুর্তি করে সময় কাটায়। মাঝে মাঝেই দেখা যায় তারা দীর্ঘ রাত্রি জাগরণের পর কালো বো-টাই পড়ে আলাদা একটা টেবিলে বসে শ্যাম্পেন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় রাজনীতিতে তাদের কোনও উৎসাহ নেই। কিন্তু একটু আঁচড়ালেই দেখা যেত তারা অত্যন্ত রক্ষণশীল। শ্রেণিভেদ এবং পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্বে যোর বিশ্বাসী। এদের কেউ কেউ ন্যাশনাল সার্ভিসের অঙ্গ হিসেবে মালয়ে লড়াই করে এসেছে। খাওয়ার ঘরে একদিন শুনলাম কীভাবে জঙ্গলের ভিতর ষোলোসতেরো বছর বয়সের সব বিপ্লবী ছেলেমেয়েদের গুলিবিদ্ধ শরীর পড়ে থাকতে দেখেছে একজন বেশ উৎসাহের সঙ্গেই তা বর্ণনা করছে। এই ব্যক্তিই একদিন আমার সঙ্গে পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও কলেজের গেটের কাছে হঠাৎ প্রশ্ন করল, “পাঁচটা পাউন্ড ধার দিতে পারো?” মহানুভবতা নয়, নেহাতই চক্ষুলজ্জাবশত টাকাটা দিলাম। ওটা আর ফিরে পাইনি। রালফ বলল বখে যাওয়া ইংরেজ ধনীসন্তানদের এটা একটা বহুপ্রচলিত কায়দা। বিনা দ্বিধায় লোকের কাছ থেকে পয়সা ধার নেয়। নামেই ধার, কারণ ফেরত দেওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। প্রভু যে কৃপা করে তোমার দিকে তাকিয়েছেন, এমনকী অনুগ্রহের চরম দেখিয়ে তোমার পয়সা টাকস্থ করেছেন, এতেই কৃতার্থ হওয়া উচিত। ফেরত পাওয়ার কথা কী করে মুখে আনলে?

ডিয়েন বিয়েন ফু বিপ্লবীরা কজা করার উপলক্ষে আমরা ছোটখাটো এক উৎসব করলাম। ফল হল—আমি কট্টর কমিউনিস্ট এই বার্তা চারিদিকে রটে গেল। সত্যিতে কৈশোরে কংগ্রেসের চার আনা চাঁদা দিয়ে সভ্য হয়েছিলাম। তার পরে আর কোনও দলের সভ্য কখনও হইনি। নির্বিচারে কোনও মত সম্পূর্ণ মেনে নেওয়ার মানসিকতা আমার ছিল না। সুতরাং সাবালক হওয়ার পর কোনও রাজনৈতিক দলের সভ্য হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই নতুন ভ্রান্ত পরিচয় চালু হওয়ায় এক ধরনের ‘খ্যাতি’ বা কুখ্যাতি হল ঠিকই, কিন্তু ব্যাপারটা আমার পক্ষে মুখ্যত অস্বস্তিকরই হয়েছিল। কারণ যুদ্ধের সময়কার ইংরেজ-রুশি ভাই-ভাইয়ের দিন তখন অস্তমিত। দক্ষিণপন্থী ছাত্ররা তো বটেই, রাজনীতি নিয়ে সাধারণত মাথা ঘামায় না যেসব ছাত্র, তাদের কাছেও ‘কমি’ শব্দটা এক ভয়াবহ আদর্শগত বিকৃতির দ্যোতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ করলাম বেশ কিছু ছাত্র আমার মুখোমুখি হলে একটু বিব্রতভাবে না-দেখি না-দেখি করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। নবলব্ধ এই অযাচিত গৌরবে বেশ বিব্রতই বোধ করতাম।

যে রাজনৈতিক ঘটনাটি আমাকে সত্যিতেই বিস্মিত করেছিল সেটি হল সুয়েজ খালে ইঙ্গ ফরাসি আক্রমণের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক-অফিসের কর্মীদের যৌথ প্রতিবাদ। অ্যান্টনি ইডেন তখন প্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতায় রক্ষণশীল দলের মন্ত্রিসভা। মিশরের গামাল আবদুল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলেন। আর ইজরায়েলের প্ররোচনায় ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স তার সঙ্গে গোপন চুক্তি করে মিশর আক্রমণ করল। দেশব্যাপী এত বড় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলন ইংল্যান্ডের ইতিহাসে কখনও হয়নি। এই প্রতিবাদের ফলে ইডেনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। অক্সফোর্ডের ইতিহাসে এই দ্বিতীয়বার পূর্ণ ধর্মঘট হল। এর আগে শুধু ১৯২৬ সনে সাধারণ ধর্মঘটের সময় অক্সফোর্ডে ছাত্র-শিক্ষক সবাই যোগ দিয়েছিলেন। জি. ডি. এইচ কোল স্বয়ং ইউনিভার্সিটি প্রেসের কর্মীদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সুয়েজ খাল আক্রমণের বিরুদ্ধেও দেখলাম প্রতিবাদ মিছিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, অফিস এবং ঘরেলু কর্মী সবাই পথে নামলেন। রক্ষণশীল বলে বিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয় এত বড় এক গণতান্ত্রিক প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিতে পারে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা যে ঝুটা নয়, সে কথা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। সাম্প্রতিক কালেও এদেশে ইরাকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু সে আন্দোলন ব্লেয়ার সাহেবের আসন টলাতে পারেনি।

অক্সফোর্ডে বামঘেঁষা রাজনীতির বেশ একটা কৌতুকের দিক ছিল। ‘আফ্রো-এশিয়ান সোলিডারিটি’র মুখ্য প্রবক্তাদের মধ্যে ছিলেন আল-মাহদি পদবিধারী সুদানের দুই খুড়ো ভাইপো। হ্যাঁ, যে মাহদি জেনারেল গর্ডনের জীবনান্ত ঘটান এঁরা তারই বংশধর। প্রগতিপন্থী কোনও সভা বা অনুষ্ঠান হলেই ‘আফ্রো-আশিয়ান-সোলিদারিটি’ এই মহামন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে ভাইপো সাদিক মঞ্চে আবির্ভূত হতেন। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যেত, সম্ভবত ওই মন্ত্রে অভিভূত হয়ে কারও না কারও বান্ধবী অদৃশ্য হয়েছেন। সাদিককেও আর দেখা যাচ্ছে না। ঔপনিবেশিকতার শিকার দুই মহাদেশের সোলিদারিটি যে এইভাবে খুবই সমৃদ্ধ হয়েছিল সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। দেশে ফিরে খুড়ো-ভাইপো দুই পরস্পরবিরোধী দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। খুড়ো যখন প্রধানমন্ত্রী, ভাইপো তখন বিরোধী দলের নেতা, আর ভাইপো সরকার বানালে খুড়ো বিরোধীদের নেতৃত্ব করেন। তবে বিরোধীদের নেতৃত্বে কাজ কিছু কম। কারণ ওই পদাধিকারী সাধারণত জেলে থাকতেন। এইভাবে খুড়ো-ভাইপোর রাজত্বে সুদান মনে হয় সুখেই ছিল। এক ডারফুরের বাসিন্দারা সেই স্বর্গসুখের ভাগীদার হয়নি। কী করা যাবে? সব কি আর হয়?

বামপন্থী সমাবেশে যাঁদের সব সময়ই দেখা যেত, পার্থসারথি গুপ্ত আর রঘুবীর চক্রবর্তী তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রশ্ন তোলার আহ্বান হলেই প্রথম যে-হাতটি উত্তোলিত হত সেটির মালিক পার্থসারথি। একটা দীর্ঘ বিবৃতির পর পার্থ তাঁর বক্তব্য সম্বন্ধে বক্তার মত কী জানতে চাইত। বক্তার উত্তর সাধারণত খুবই সংক্ষিপ্ত হত, “আই এগ্রি।” আর বামপন্থী জলসায় অবশ্যম্ভাবীভাবেই কোনও সময় শোনা যেত, “উই আর ট্রাইং টু পারয়েড কমরেড গাপটা টু সিং।” কমরেড গাপটার এসব ব্যাপারে অকারণ অভিমান ছিল না। উপরোধ শেষ হওয়ার আগেই তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ধ্বনিত হত। সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। বেচারি রঘুবীর বাপের একমাত্র আদুরে ছেলে। এমন সচ্চরিত্র বালক কলিতে সাধারণত চোখে পড়ে না। সম্ভবত দ্বাপরেই প্রজাতিটি শেষ হয়ে গেছে। সে শুধু দুটি ব্যাপারে উত্তেজিত হত। এক, কোনও বামপন্থী চিন্তাবীরের বক্তৃতা শুনে অথবা মিল্ক শেক খেয়ে। দ্বিতীয় বস্তুটা ককাতায় থাকতে কোনও অজ্ঞাত কারণে তার খাওয়া হয়ে ওঠেনি। অক্সফোর্ডে এসেই সে প্রথম এই অমৃত আস্বাদন করে। প্রথম পরিচয়েই আমাকে রয় বলেছিল, “চলো, তোমারে দারুণ এক জিনিস খাওয়াই।” আমি ভেবেছিলাম কোকেন টোকেন কিছু হবে। কিন্তু মিল্ক শেকেই রঘু তুরীয়ানন্দের সাক্ষাৎ পেয়েছিল। কিন্তু এক ব্যাপারে রঘু অত্যন্ত সেয়ানা ছিল। ওর গবেষণার বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক আইন। ভাবী পত্নীর জন্মদিনে সে সব সময়ই মোটামোটা আইন বিষয়ক বই উপহার দিত। বইগুলি অত্যন্ত দামি। মেয়েটি ওর প্রেমের গভীরতার এই নিদর্শনে মুগ্ধ হয়ে যেত। প্রিয়তমাকে ঝট করে পঞ্চাশ পাউন্ড দামের বই কে দেয় বলুন, তা তার বিষয় যা-ই হোক! বইগুলি রঘুর গবেষণার কাজে খুবই লাগত। রঘু যখন তার মনোনীতাকে বিয়ে করা মনস্থ করে, তখন খবরটা বরুণ দের মারফত পিতাঠাকুরকে জানায়। পাত্রীটি বৈদ্যকন্যা। খবর শুনে রঘুর বাবা বলেন, “আমার এখনই হার্ট অ্যাটাক হবে।” ভদ্রলোক নাকি রঘুর জন্য একটি না দু দুটি পাত্রী দেখে রেখেছিলেন। নেহরু সরকার তখন অবধি বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি। গভীর সহানুভূতির সঙ্গে বরুণ বলে, “আমি একটু অপেক্ষা করব?” মানে ব্যাপারটা শেষ অবধি কী দাঁড়ায় সেটা দেখে যাওয়ার জন্য নিতান্তই মানবিক কৌতূহল তো হওয়াই স্বাভাবিক।

আমাদের সময় বেশ কয়েকজন ভারতীয় এবং পাকিস্তানি ছাত্র অক্সফোর্ডে পড়তে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ছিলেন রোডস স্কলার রাঘবন আয়ার। অত্যন্ত প্রতিভাবান এই মানুষটি উৎকেন্দ্রিকতায়ও সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। এঁর সম্বন্ধে নানা সত্যমিথ্যা গল্প চালু ছিল। কীভাবে ইনি অহমিকা জয় করেছেন তা ব্যাখ্যা করে উনি নাকি বলেছিলেন যে রোজ সকালে মন্ত্রপাঠের মতো উনি নিজেকে বলেন “যে রাঘবন আয়ার রোডস স্কলারশিপ পেয়েছে আমি সেই ব্যক্তি নই। যে পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে সেও আমি নয়। যে ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছে সে আর আমিও এক লোক নয়। আমার শুধু একটিই পরিচয়। আমি শুধু ঈশ্বরপুরুষের কিরণমণ্ডলীর একটি ছটা—আ স্পার্ক অফ দা ডিভাইন।” যখন ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের নির্বাচনে ভোট গোনা চলছে, রাঘবন তখন নিজের ঘরে বদ্ধপদ্মাসনে নিমীলিত নেত্রে ধ্যানস্থ। যখন কোনও অনুগামী জয়ের বার্তা নিয়ে এল, চোখ খুলে উধ্বদৃষ্টি হয়ে রাঘবন বললেন, “দা ভিক্টরি ইস ইওর্স, নট মাইন।” ঈশ্বর তথা ধর্মের জয় যে অবশ্যম্ভাবী এ কথা কে না জানে। তখন অনেক সময়ই শোনা যেত কালে রাঘবন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ডামাডোলে ডুবে না গিয়ে ভেসে থাকার মতো ক্ষমতা মানুষটির ছিল না। সে চেষ্টাও তিনি শেষাশেষি করেননি।

আমাদের সময়কার আর একজন রোডস স্কলার ছিলেন অনন্তরমণ। ইনি পরে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। কেমিস্ট্রির ছাত্র এই সনাতনপন্থী হিন্দু যুবক সমাজসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। তখনকার দিনে ট্রিনিটি কলেজের বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারে কিছুটা দুর্নাম ছিল। সত্যিতে অনন্তরমণের আগে তারা কোনও অশ্বেতবর্ণ ছাত্র কখনও নেয়নি। রোডস স্কলারদের কলেজ বাছবার অধিকার থাকে। অনন্ত ট্রিনিটিতে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং সগৌরবে সেখানে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যাপারে একটু অসুবিধে ছিল। সামাজিক রীতিনীতির ব্যাপারে ভালমন্দ জ্ঞান সব সমাজে যে এক না, এই তত্ত্বে অনন্তরমণ বিশ্বাসী ছিলেন না। যা অশালীন তা সর্বত্রই অশালীনতার এই বিশ্বাস আমরা কেউ টলাতে পারিনি। ফলে কোনও প্রেমিকযুগলকে রাস্তাঘাটে চুম্বনরত দেখলে বীতশ্রদ্ধ অনন্তরমণ তাদের বাধা দিতেন। তার এই প্রচেষ্টার পিছনে যে-যুক্তি, তার ভিত্তিমূল কিন্তু নীতিবাগীশতা নয়, মানবিকতা। বিস্মিত প্রেমিকযুগলকে আরও বিস্মিত করে অনন্ত বলতেন, “তোমরা কি কখনও অন্য লোকের কথা ভাবো না? এসব বাড়ি বসে করতে পারো? কখনও ভেবে দেখ না যে যাদের এইসব সুযোগসুবিধা [ফেসিলিটি] নেই তাদের কীরকম লাগে? বৃদ্ধবৃদ্ধা, অবিবাহিত বা সঙ্গীহীন নারীপুরুষ—এদের কথা তোমাদের একবারও মনে হয় না?” পরাহত প্রেমিক-প্রেমিকা অধোবদনে মঞ্চ ত্যাগ করতেন।

দেশ থেকে যারা এসেছিল তাদের কেউ কেউ আমার ছাত্রস্থানীয়। এদের মধ্যে বরুণ দে এবং পার্থর ছাত্র হিসাবে খুব সুখ্যাতি হয়েছিল। আমার পরিচিতদের মধ্যে অক্সফোর্ডের শিক্ষাব্যবস্থার যদি কেউ পুরো সদ্ব্যবহার করে থাকে তো এরা দু’জন। এরা অল্পদিনের মধ্যে যে-পরিমাণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিল তা সত্যিই ঈর্ষা করার মতো। ওদের দেখে আফসোস হত—কেন দ্বিধা ত্যাগ করে প্রথম ডিগ্রি করলাম না। আমার ধারণা এখনকার তুলনায় সে সময়ে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া আরও কঠিন ছিল। পার্থ আর বরুণ ফার্স্ট ক্লাস পেতে পেতে পায়নি। সেই অসাফল্য সুদে-আসলে পুষিয়ে দিয়েছে বরুণের কন্যা ঊর্মিলা—ইতিহাসে অনার্স লিস্টে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে।

আর আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বেলিয়লেই সমসাময়িক রোডস স্কলার অযোধ্যানাথ কওলের সঙ্গে। পরে কওল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান হন। আর অধ্যাপক মহম্মদ হাবিবের ছেলে ইরফান ওঁরই পুরনো কলেজ নিউ কলেজে প্রথমে অনার্স ডিগ্রি করতে এসেছিলেন। ভাল না লাগায় ডি.ফিল ডিগ্রির জন্য কাজ শুরু করেন। তার ফল জগদ্বিখ্যাত বই ‘দা অ্যাগ্রারিয়ান সিসটেম অফ মুঘল ইন্ডিয়া’। ডেভিস বলতেন–এর তুলনীয় থিসিস উনি আর দেখেননি। মেয়েদের মধ্যে আমাদের সমসাময়িক ছিল কাজল বোস [পরে সেন]-প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপিকা হিসাবে কলকাতায় সুপরিচিত। আর পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন কামাল হোসেন—যিনি পরে মুজিবের সঙ্গে বন্দি ছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। আমাদের পরের বছর রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত এলেন। দিনে চোদ্দো থেকে আঠারো ঘণ্টা কাজ করে, আগে না জানা দুটি ভাষা শিখে ছয় টার্মে অর্থাৎ তিন মাস কম দুই বছরে মিলটনের কাব্যচিন্তা বিষয়ে থিসিস লিখে ডিগ্রি নিয়ে উনি দেশে ফিরে যান। আমাদের মনে হয়েছিল উনি অসাধ্যসাধন করলেন। ইংরেজি সাহিত্যে ডি.ফিল ডিগ্রিপ্রার্থীদের মধ্যে তখন ফেলের সংখ্যা শতকরা ষাট। ওঁর অক্সফোর্ডে খাওয়াদাওয়ার অসুবিধে হত। কতকটা সেই সমস্যার সমাধান করার জন্য মেয়েকে নিয়ে ওঁর স্ত্রী চলে এলেন। একদিন দেখি ওন্ড বড়লেয়ানে বেশ দামি একটি টুইড জ্যাকেট পরে বসে পড়াশুনো করছেন। বললেন, “দেখছ কী? সে রবি দাশগুপ্ত আর নেই। সে এখন সস্ত্রীক বাস করছে। দুবেলা পেট পুরে খায়। গায়ে নতুন জ্যাকেট। তবে ডিগ্রি পাবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহটা রয়েই গেছে।” নীতিবান মানুষ রবিবাবু অক্সফোর্ডে একবার এক নীতিগত সমস্যার সম্মুখীন হন। উনি যে পাকিস্তানি রেস্তোরাঁয় মাস হিসেবে পেতেন সেখানকার মালিক যুগপৎ দুটি মহিলার স্বামী হয়ে বসায় ইংরেজের অন্যায্য আইনে জেলে গেলেন। রবিবাবু বিপদে পড়লেন। শেষ মাসের টাকাটা কাকে দেবেন? আমরা বললাম দুই স্ত্রীকে ভাগ করে দিন। নীতিগত কারণেই এই সমাধান ওঁর মনঃপূত হয়নি। উনি বহুবিবাহের পক্ষপাতী ছিলেন না—তা স্মৃতি বা শরিয়তে যাই ব্যবস্থা থাক।

কেমব্রিজে আমাদের সমসাময়িক ভারতীয়দের সঙ্গে আমাদের বেশ যাওয়া-আসা ছিল। পরিচয়টা ঘটে প্রধানত অমর্ত্যর মারফত। ১৯৫৪ সনের ইস্টারের ছুটিতে ওদের সঙ্গে বাসে লেক ডিস্ট্রিক্ট বেড়াতে যাই। সহযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন অপর্ণা মেহতা (বর্তমানে বসু), দীপক মজুমদার (পরে ওয়ার্ড ব্যাঙ্কের উচ্চ পদাধিকারী), অমর্ত্য, রঞ্জনা রায়। সারা পথ দীপক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল। না গাইলে কোনও অনিষ্ট হত, এমন কথা জোর করে বলতে পারব না। মাঝে মাঝে অমর্তও যোগ দিত। ওটা না করলে বঙ্গসংস্কৃতি বিপন্ন হত না বলেই আমার ধারণা। ওর নিজের মুখেই শুনি—শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে প্রথম দিনের গানের ক্লাসে সঙ্গীতশিক্ষক ওর কণ্ঠস্বর শুনে ওকে বাইরে ডেকে নিয়ে যান। নিয়ে গিয়ে বলেন, “গাও তো সা-আ-আ।”অমর্ত্য গাইল। শিক্ষক বললেন, “এবার গাও তো রে-এ-এ” অমর্ত্য তাও গাইল। শিক্ষক ওকে গানের ক্লাস থেকে বরাবরের মতো ছুটি দিয়ে দিলেন। অর্থনীতিতে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের যতটা প্রতিষ্ঠা হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ঠিক ততটা হয়নি, একথা সর্বজনবিদিত। তবে ওর একটি গান বেশ চিত্তাকর্ষক ছিল, “কে তুমি দাঁড়িয়ে আড়ালে, ন হাত লম্বা পাটি বাড়ালে?” অর্থনীতিতে ওর ভবিষ্যৎ কী চেহারা নেবে তাও কেমব্রিজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। অল্পদিন পর পরই খবর পেতাম ওখানে কোনও ছাত্রের পক্ষে যা-কিছু সম্মান পাওয়া সম্ভব, একে একে তা সবই ও পাচ্ছে। ও যে কালে কালে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদদের একজন হবে প্রথম থেকেই তা বোঝা যাচ্ছিল।

এক সময় আমাদের পররাষ্ট্রসচিব এবং বেলজিয়ান কঙ্গোয় ডাগ হ্যামারশোন্ডের সহকারী রাজেশ্বর দয়াল উনিশশো ত্রিশের দশকে অক্সফোর্ডে ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে আই.সি.এস. পরীক্ষায় পাস করার পর কিছুদিন পড়েছিলেন। উনি না ঢেকে-চেপে স্পষ্টই লিখেছেন যে, ইংরেজ ছাত্ররা ভারতীয়দের সঙ্গে মিশত না। আমাদের সময় ঠিক এই অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে কিছু ছাত্র যে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বিশেষ উৎসাহী ছিল না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। মধ্যবিত্ত ইংরেজ, বিশেষ করে দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে যাদের বাস, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে তাদের আড়ষ্টতা জগৎ কুখ্যাত। কিন্তু এটার কারণ নাক উঁচুপনা না এক ধরনের চক্ষুলজ্জা বা ইংরেজিতে যাকে বলে গকিনেস, তা কোনও দিনই ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তবে একটা জিনিস বরাবরই লক্ষ করেছি, আমাদের দেশে বন্ধুত্ব বলতে যেবাধাবন্ধহীন ঘনিষ্ঠতা বোঝায়, এদের সমাজে তার সঙ্গে তুলনীয় সম্পর্ক সম্ভবত যৌন সম্বন্ধের বাইরে হয় না। এমনকী সেখানেও মনে হয় মনের দিক থেকে কিছু আব্রু থাকে। ছাত্রাবস্থায় তবু যেটুকু স্বচ্ছন্দ সম্পর্ক হয়, মানুষ সংসারী হওয়ার পর সেটুকুও আর থাকে না। একটা উদাহরণ দিই। যখন ছাত্র ছিলাম অনেকে খবর দিয়ে ঘরে এসে বসতেন। কখনও কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন। কোনও সংসারী লোককে এই ধরনের ব্যবহার করতে কখনও দেখিনি। যাদের সঙ্গে সারারাত আড্ডা দিয়েছি, তাদের সঙ্গে এখন কচিৎ কখনও দেখা হয়। আর বিনা নোটিসে কেউ দেখা করতে চলে আসবে—এমন কথা কল্পনাও করা যায় না।

তা ছাড়া আরও একটা কথা আছে। আমরা যখন ছাত্র তখনও এখানে শ্রেণিসচেতনতা শুধু প্রবল নয়, তার প্রকাশ রীতিমতো নগ্ন। বিখ্যাত পাবলিক স্কুলগুলির ছাত্ররা নিজেদের গণ্ডির মধ্যেই থাকত। হঠাৎ না বুঝে খাওয়ার সময় তাদের পাশে গিয়ে বসলে রীতিমতো অস্বস্তিকর অবস্থা হত। কেউ অনাহুত ব্যক্তিটির সঙ্গে কথা বলত না। বাঙালপনা করে কথা বলার চেষ্টা করলে নাকাল হতে হত। অবশ্যি এ নিয়মের ব্যতিক্রম যথেষ্টই ছিল। ইটনের একটি ছাত্রর সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তার নাম টিমথি টার্টন। ওর বাবা রক্ষণশীল মন্ত্রিসভার বেশ ভারী ওজনের সভ্য ছিলেন। একটা ব্যাপারে বিরাট এক পরিবর্তন নজরে পড়ে। ১৯৫০-এর দশকে ইটন-হ্যারোর ছাত্র কথাটা গায়ে লেখা না থাকলেও ওই সৌভাগ্য কাদের হয়েছে বুঝতে কিছু অসুবিধে হত না। আর এখন কেউ বিখ্যাত পাবলিক স্কুলে পড়ে থাকলে, কথাটা জাহির না করার একটা চেষ্টা দেখা যায়। এটা যে সামাজিক মানসিকতায় কত বড় বিপ্লবের দ্যোতক তা অভিজ্ঞতা না থাকলে বোঝানো কঠিন।

প্রত্যেক সমাজেরই কিছু বিশিষ্ট দোষগুণ থাকে। বারি মধ্যবিত্ত ইংরেজের সামাজিক ব্যাধি। ও কথাটার বাংলা হয় না, যদিও বাঙালিদের মধ্যে স্নবের অভাব আছে এমন নয়। এ ব্যাধির লক্ষণ দুটি। প্রথম, নিজের তুলনায় যাদের সামাজিক মানমর্যাদা কম তাদের ক্ষেমাঘেন্না করা। দ্বিতীয়, যারা ওই হিসাবে উপরতলার লোক তাদের পিছনে ল্যাকল্যাক করা। বামপন্থী রাজনীতির অনুরাগী আর অন্যতর জীবনযাত্রার অনুসারীদের বাদ দিলে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ইংরেজই এই ব্যাধিতে ভুগত বললে বোধ হয় খুব অন্যায় হবে না। এই সত্যের চরম প্রকাশ দেখেছিলাম একটি ভারতীয় ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। প্ৰাঙ্গাব্রার মহারাজা গুজরাতের একটি ছোট দেশীয় রাজ্যের রাজা ছিলেন। নেহরুজির কৃপায় ওঁদের রাজত্ব তখন অতীতের ইতিহাস। বছরে দেড়-দুই লাখ টাকা ভাতা পেতেন। আর ভাতা বাড়াবার জন্য মাঝে মাঝেই আবেদন করতেন। অক্সফোর্ডে নৃতত্ত্ববিভাগে যজ্ঞোপবীত সম্পর্কে থিসিস লিখবেন বলে এসেছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনার জন্য ওঙ্কার মণ্ডল নাম দিয়ে উনি একটি সমিতি স্থাপন করেন। ওঁর আহ্বানে আমি ওই মণ্ডলীর সভ্য হই। ওঁর বিগত রাজ্যের আয়তন যাই হোক, রাজকীয়তার ব্যাপারে মহারাজের কুলোপনা চক্কর। ওঁর লেটারহেডে লেখা ছিল ‘কোর্ট অফ ধ্রাঙ্গাধ্রা, ক্যাম্প অক্সফোর্ড, ক্রাইস্ট চার্চ কলেজ, অক্সফোর্ড’। অভিজাত ঘরের ছেলেদের কলেজ ক্রাইস্ট চার্চ, ছাত্রদের থাকবার জন্য সেখানে এমন সাইজের ঘরও আছে যেখানে দুশো লোককে পার্টি দেওয়া যায়—তাকে প্ৰাঙ্গার ক্যাম্প বলে বর্ণনা করায় যে-বিরাট আত্মশ্লাঘার পরিচয় পাওয়া যায়, সে বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়? ওঁর দুটি অক্সফোর্ডের ডিগ্রিধারী সেক্রেটারি ছিল। একজন প্রাইভেট সেক্রেটারি আর দ্বিতীয়টি মিলিটারি সেক্রেটারি। দ্বিতীয় জন কার সঙ্গে যুদ্ধ ব্যাপারে মহারাজকে পরামর্শ দিতেন তা জানার সৌভাগ্য আমার হয়নি। মহারাজা সকালবেলা বাথরুমে সিংহাসনারূঢ় হয়ে দরজার বাইরে বসা প্রাইভেট সেক্রেটারিকে চিঠির শ্রুতিলিপি লেখাতেন। মুখচোখ লাল করে মেয়েটি লিখে যেত। এই মহা চালিয়াত মহারাজার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করার জন্য বড় ঘরের ইংরেজ ছেলেমেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত। ওদের এই আদেখলে অবারিতে মহারাজা খুবই মজা পেতেন।

প্রাচ্যবিদ্যার ছাত্র তিনটি ব্যক্তির সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তাঁদের একজন হচ্ছেন পোলান্ড থেকে যুদ্ধের সময় পলাতক এক পরিবারের ছেলে ইয়ান ওয়েরিহো। ইয়ান ফারসি ও আরবির ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ওর বিশেষ দুর্বলতা ছিল ভারতীয় মেয়েদের সম্পর্কে। অরুন্ধতী রায়ের মাতুল জর্জ আইসাক (অনেকে বলেন, উপন্যাসটির মাতুল চরিত্র ওকে নিয়েই রচিত) বলতেন যে, কেরলে নারকেল গাছে জড়িয়ে শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়। ইয়ান যদি কেরল যেত তা হলে নাকি সেই দৃশ্যও মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত। এ কথার সত্যতা বিচারের সুযোগ আমার হয়নি। কিন্তু ওর জীবনের এক ট্র্যাজিক অভিজ্ঞতার মুহূর্তে আমাকে সান্ত্বনা দিতে হয়েছিল। ইয়ান কোথায় শুনে এল যে, হোলির দিন ভারতীয় ছেলেরা মেয়েদের আবির পাঠায়। সেই আদর্শে ও লেফাফায় মুড়ে বেশ কয়েক জন ভারতীয় মেয়েকে ‘আবির’ পাঠাল। লেফাফা খুলে সেই আবির নাকে-চোখে যাওয়ায় মেয়েদের তো মরণদশা। কারণ আবির জিনিসটা অক্সফোর্ডে পাওয়া যেত না। যা পাওয়া যেত সে হচ্ছে লঙ্কার গুঁড়ো। এই সামান্য তফাতটা ইয়ান ধর্তব্য মনে করেনি। মেয়েরা কেউ কেউ প্রোক্টরের কাছে নালিশ করবে ঠিক করেছিল। অনেক কষ্টে তাদের নিবৃত্ত করি। কোনও ভারতীয় সুন্দরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলে কীভাবে নতজানু হয়ে সে তার প্রেম নিবেদন করবে, শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক ট্র্যাডিশনে অভিনয় করে ইয়ান তা আমাদের দেখাত। কিন্তু ভারতীয় নারী তো আর তাদের পশ্চিমি ভগিনীদের মতো লজ্জাহীনা নয়, তাই তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া হবে : “শি উইল হাইড হার ফেস ইন দা ম্যান্টিলা।” বলে ঘোমটায় মুখ ঢেকে লজ্জাবতী রমণীর ভূমিকায় ইয়ান ওড়িশি নৃত্যের স্টাইলে পোজ মেরে দাঁড়িয়ে থাকত। সঙ্গিনীর সন্ধানে বিবাগী হয়ে বেচারা সিন্ধুনদী অতিক্রম করতে পারেনি বটে, কিন্তু তার পূর্বাভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি। সে শেষ অবধি বাগদাদের এক আরব মেয়েকে সাদি করে।

আর আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিতদের মধ্যে ছিল দুই সংস্কৃতের ছাত্র—প্লাদিমির জোয়া এবং সিরিল লুইস। দু’জনেই বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ব্যক্তি। প্লাদিমির আমস্টাডামের ইহুদি। যুদ্ধের গোড়ায় ওঁর মা-বাবা ওকে আর ওর বোনকে নিয়ে পালিয়ে আসেন। ওঁদের পরিবারের আর সবাই হিটলারের গ্যাস চেম্বারে নিহত হন। গ্লাদিমির সত্যিকারের কসমোপলিটান ইহুদি। ওঁর দাদামশায় ছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রধান র‍্যাবাই। ফলে অনেকগুলি আধুনিক ইউরোপীয় ভাষা ও জন্মসূত্রেই শিখেছিল। তার সঙ্গে গ্রিক, ল্যাটিন, সংস্কৃত, প্রাকৃত এবং আরও কয়েকটি ভাষার জ্ঞান ও নিজের চেষ্টায় অর্জন করে। ওর মাতৃভাষা ডাচ। সেই ভাষাশিক্ষার সুত্রেই ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। পরে এই দেশে আমার জীবনযাত্রার নানা পর্যায়েই ম্লাদিমির এবং তার স্ত্রী আইলিনের সাহায্য পেয়েছি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যাদের জীবনে বিপর্যয় এনেছিল, প্লাদিমিরের মারফত তাদের সঙ্গে পরোক্ষ পরিচয় হয়। আর পরোক্ষই বা বলি কী করে? ওর দাদামশায়-দিদিমা সবারই তো জীবন শেষ হয়েছিল আউসউইৎসের গ্যাস চেম্বারে। যুদ্ধের ভয়াবহতার অন্যতম পরিচয় পেয়েছিলাম আর একটি ছেলের মারফত। সে জাতিতে জার্মান। নামটা ভুলে গেছি। পঞ্চান্ন সনে সে বিজ্ঞানবিষয়ক কিছু পড়তে বেলিয়ল কলেজে আসে। বার্লিনের পতনের সময় যেসব অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয় ও তাদের একজন। ওর বয়স তখন দশ। বাড়ির ছাদে বিমানধ্বংসী কামান চালানোর কাজে ওদের লাগানো হয়েছিল। ভয় পেয়ে যাতে পালিয়ে না যায় সেই উদ্দেশ্যে কামানের সঙ্গে শিকল দিয়ে ওদের বেঁধে দেওয়া হত। ছেলেটি বলত—শত্রুপক্ষের উড়োজাহাজ মাথার উপর এলে ভয়ে ওরা প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত। কিন্তু তা বলে সামরিক কর্তব্য থেকে নিস্তার পাওয়া যেত না।

সিরিল ল্যুইসের মতো বিচিত্র চরিত্রের মানুষ আমি আর দেখিনি। ব্রিটেনে প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে লর্ড স্কারবরা প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি ইডেনকে এক প্রস্তাব দেন। ইডেন স্বয়ং অক্সফোর্ডে ফারসিতে ডিগ্রি নিয়েছিলেন। তিনি বন্ধুর প্রস্তাব গ্রহণ করে কতগুলি এশীয় ভাষা এবং সাহিত্য পড়বার জন্য অত্যন্ত লোভনীয় কিছু স্কলারশিপ প্রতিষ্ঠা করেন। যারা কোনও না কোনও ভাষা নিয়ে পড়ে পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাস করেছে, তারাই শুধু এই স্কলারশিপের জন্য দরখাস্ত করতে পারত। ব্রিস্টল থেকে ল্যাটিন এবং ফরাসিতে ফার্স্ট ক্লাস ডিগ্রি নিয়ে সিরিল অক্সফোর্ডে সংস্কৃত আর প্রাকৃত পড়তে আসে। ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটে গিয়ে বোজ বাঁধা চার ঘণ্টা পড়াশুনো করত। কিন্তু এ ছাড়া ওকে কখনও পড়াশুনো করতে দেখিনি। ঘরে একটিও বই ছিল না, শুধু টেনিস সম্বন্ধে একটি মাসিক পত্রিকা ছাড়া। গত বিশ বছরের যাবতীয় টেনিস প্রতিযোগিতার ফল ওর মুখস্থ ছিল। বলত—অভিজাত সমাজে চলাফেরা করতে হলে ওই জ্ঞান ওর কাজে লাগবে। তিনটি ফল কামনায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যেত। প্রথম ফার্স্ট ক্লাস এবং ডক্টরেট পেয়ে পরবর্তী জীবনে অধ্যাপকের পদ পাওয়া, দ্বিতীয় নাইটহুড পাওয়া এবং তৃতীয় বড় ঘরে বিয়ে করা। তৃতীয় উচ্চাশা ফলবতী করার জন্যই টেনিস সম্পর্কে জ্ঞানার্জন। মাঝে মাঝে দেখতাম কোনও না কোনও অভিজাত চেহারার মেয়ের সঙ্গে ও পায়চারি করছে। পরে প্রশ্ন করলে বলত, “নো গুড! উড নট স্ট্যান্ড এনি শেকিং।” এই মানদণ্ডর প্রাসঙ্গিকতা কখনও বুঝে উঠতে পারিনি। জীবনসঙ্গিনীকে কেন প্রচণ্ড ঝাঁকুনি সহ্য করতে হবে—সে ব্যাপারটা সিরিল আমাদের বোঝাতে পারেনি। ভিন্ন রুচিৰ্হি লোকা—এই ভেবেই সিরিলের বিস্ময়কর বাসনা মেনে নিয়েছিলাম।

সিরিল স্নায়বিক দৌর্বল্যে ভুগত। একবার সাময়িকভাবে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল। ওই অবস্থায় সে বারবারই বলছিল, “আই ওয়ান্ট টু ডাই উইদ এন আই।” পরে সুস্থ হলে ওকে প্রশ্ন করি কী বলছিল ওর মনে আছে কি না। ও বলল—”অবশ্য।” জিজ্ঞেস করলাম— “এ কথার তাৎপর্য কী?” উত্তর, “আই লাইক টু বি প্রেসাইস। আই ডু নট ওয়ান্ট পিপল টু থিংক দ্যাট আই ওয়ান্টেড টু ডাই উইদ এ ওয়াই।” সব ব্যাপারটা খোলস হয়ে গেল। সিরিল মরতে চাইছিল—’ডাই উইদ আন আই’। লোকে যাতে না ভাবে যে ও কাপড় রাঙাতে চাইছে—’ডাই উইদ এ ওয়াই’–সেই জন্য ওর সাবধানতা। এ রকম ভুল হওয়া তো খুবই সম্ভব।

সিরিল যথা সময়ে সংস্কৃতে ফার্স্ট ক্লাস পেল এবং তার পর দু বছর ভারতবর্ষে কাটাবার জন্য যাবতীয় খরচ-খরচা। একদিন ওর ঘরে ঢুকে দেখি ও একটা অয়েল হিটারের সামনে খালি গায়ে বসে আছে। তখন আগস্ট মাস। প্রচণ্ড গরম। জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কী করছ?” উত্তর, “আই অ্যাম ট্রাইং টু অ্যাক্লিমেটাইজ মাইসেলফ টু দা ইন্ডিয়ান ওয়েদার।” ভারতযাত্রার প্রস্তুতি যাতে পূর্ণাঙ্গ হয় এ ব্যাপারে সাবধানী মানুষ সিরিল কোনও খুঁত রাখতে চায়নি।

অক্সফোর্ডে কয়েকশো বছর ধরে কিছু ভূত-পেত্নি বাস করছে। এ খবরটা বাইরের লোকের ভাল জানা নেই। এখনও অক্সফোর্ডে ট্যুরিস্টদের জন্য ভৌতিক ট্যুরের ব্যবস্থা আছে। আস্ত ভূত দেখিয়ে দেবে–গাইডরা এমন প্রতিশ্রুতি দেয় না। তবে কোথায় কোথায় ভূতেরা বাস করে সে জায়গাগুলি দেখিয়ে দেয়। ইচ্ছে করলে রাতে থেকে দেখতে পার। কতকটা সুন্দরবনে বাঘ দেখতে যাওয়ার মতো। অনেকবার গিয়েছি। বাঘ কখনও দেখিনি, তবে কিউরেটর আশ্বাস দিয়েছিলেন—বাঘ কিন্তু আপনাদের দেখছে। শুনে তৃপ্ত হয়েছিলাম।

বেলিয়ল কলেজের অ্যানেক্স হলিওয়েল ম্যানর। সেখানে সিরিল এবং আমি দুজনেই বাস করতাম। সিরিল একটু রাত করে পানাগার অর্থাৎ পাব থেকে ফিরত। এবং মাঝে মাঝেই নাকি শুনতে পেত পিছনে ক্ল্যাং ক্ল্যাং ধ্বনি। পশ্চিমি লোকবিশ্বসমরকন্তু আত্মাদের হাতে পায়ে শিকল বাঁধা থাকে। সেই শৃঙ্খলের ঝনঝনাৎ সিরিল শুনতে পেত। এ সৌভাগ্য আমার কখনও হয়নি। তার একটা কারণ বোধহয় বেশি বিয়ার আমার পেটে সহ্য হত না। তা ছাড়া যে-হতভাগাদের আগুনে ফেলে কাবাব বানানো হচ্ছে, তারা কী করে অক্সফোর্ডে এসে ক্ল্যাং ক্ল্যাং আওয়াজ তুলে লোকের ঘুমের ব্যাঘাত করবে—এ কথাও আমি বুঝে উঠতে পারিনি। আরও কথা আছে। নরকবাস এবং নানাবিধ পৈশাচিক শাস্তি তো হবে শেষ বিচারের পরে। তার আগেই সব হাতে পায়ে শিকল বেঁধে ঘুরে বেড়াবে কোন আইনে? বিনা বিচারে শাস্তি দেবেন—ঈশ্বর কি গুয়ান্তানামোর ম্যানেজার? আর রোজকেয়ামতের আগে অবধি সবার তো কবরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাবার কথা। কথা নেই বার্তা নেই যত্রতত্র চরে বেড়ালেই হল?

তবে শাস্ত্রে যাই বলুক—একবার পাশ ঘেঁষে ভূত বেরিয়ে গিয়েছিল মনে হয়। আমাদের পাশের ঘরে একটি ছেলে পিয়ানো বাজানো প্র্যাকটিশ করত। সেই বাজনা খুব জনপ্রিয় ছিল বললে মিথ্যাভাষণ হবে। গ্রীষ্মের এক বিকালে ও পিয়ানো বাজাচ্ছিল। হঠাৎ ধুম করে একটা আওয়াজ শোনা গেল। আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি ছেলেটা হতভম্ব হয়ে বসে আছে। আর ওর নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। শুনলাম হঠাৎ কে যেন ওর নাকে প্রচণ্ড ঘুষি মেরেছে। কিন্তু বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না সে ব্যাপারটা এই যে, পিয়ানোটা দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো এবং ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ঘুধিটা দেওয়ালের দিক থেকেই এসেছিল। যা হোক, পিয়ানো বাজানো সেই থেকে বন্ধ হয়ে গেল। হস্টেলবাসীদের। সিদ্ধান্ত হল যে, ভৌতিক কিছু নয়, আবাসিকদের সম্মিলিত মনোবলই ঘুষিরূপে মেটিরিয়ালাইজ করেছিল। মানে ওই বাজনা আর সহ্য হচ্ছিল না।

‘সত্যিকার ভূতের’ কাহিনি শোনান হলিওয়েল ম্যানরের ওয়ার্ডেন বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক রাসেল মেগস। উনি হস্টেলবাসীদের পালা করে খেতে বলতেন। আমাদের যেদিন খেতে বলেন সেদিন ভদ্রতার নিয়ম ভেঙে আমি প্রশ্ন করি, এ কথা কি সত্যি যে ম্যানরে প্রেতাত্মা আছে এবং পণ্ডিতপ্রবর তা স্বচক্ষে দেখেছেন। এই প্রসঙ্গে আগেই বলি, ম্যানর এক সময়ে আটশো বছর আগে ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীদের পরিচালিত অনুশোচনাগার বা পেনিটেন্সিয়ারি ছিল। অভিজাত ঘরের যেসব মেয়েদের পদস্খলন হত, মানে যাঁরা বেচাল কিছু করে ধরা পড়তেন, তাঁদের ওইখানে থেকে পরের নোংরা কাপড় ধুয়ে নিজ নিজ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। তাদেরই একজন সহ্যের সীমা ছাড়ানোয় বাড়িটায় আগুন লাগিয়ে দেয়। সেই মর্মন্তুদ ঘটনারই স্মৃতি বহন করছে এক প্রেতাত্মা। মানে জনপ্রবাদ তাই। মেগস একটু চুপ করে থেকে বললেন, হ্যাঁ, আমরা ঠিকই শুনেছি। শুধু উনি না। ওঁর পরিবারের অনেকেই দেখেছেন-সাদা কাপড়ে ঢাকা এক মূর্তি ম্যানরের সিঁড়ি থেকে নেমে মাঝের চক পার হয়ে আস্তে আস্তে কবরখানার দিকে চলে যায়। এই কাহিনি আমাদের শোনাবার পর উনি বলেন—এ বিষয়ে আর আলোচনা না হলেই উনি খুশি হবেন। প্রশ্নটা শুনে যে উনি খুব খুশি হননি সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না।

অক্সফোর্ডে গবেষণার অনেকটা সময় আমার কাটে হল্যান্ডে। কারণ আমি ঠিক করেছিলাম যে, প্রধানত ডাচ নথিপত্রে প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাসের মালমশলা যা আছে তা নিয়েই আমি কাজ করব। কাজটা ঠিক কী হবে তা হল্যান্ড গিয়ে কাগজপত্র কিছু ঘাঁটাঘাটি করার পর ঠিক করা যাবে। আমার গবেষণার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। এক–মোরল্যান্ডের পর মুঘল যুগের অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে কাজ আর বেশি এগোয়নি। ওঁর শেষ প্রকাশন ১৯২৯ সনে। অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে চিন্তাভাবনা গবেষণাপদ্ধতি তারপর অনেক এগিয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া কৈশোরে এবং প্রথম যৌবনে যে প্রশ্ন আমার মনে এসেছিল এই সূত্রে তারও কিছু উত্তর পাব ভরসা ছিল। আমার মূল প্রশ্ন যদি হয় বিদেশি সভ্যতার সংস্পর্শে এসে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতি কীভাবে তার মোকাবিলা করেছিল, অপরিচিত কর্মধারার সংস্পর্শে আমাদের জীবনে অনন্যপূর্ব কোনও প্রচেষ্টার সূচনা হয়েছিল কি না, তবে ইংরেজ শাসনের আগে দূরদেশের সঙ্গে স্বাধীন ব্যবসার বিশ্লেষণ থেকে তার কিছু উত্তর পাওয়া সম্ভব। আর শিল্পবিপ্লবের আগে সতেরো শতকে বাণিজ্যবিপ্লব ঘটায় ইউরোপের অর্থনৈতিক জীবনেও রদবদল হয়েছিল। তাই ওই যুগের বাণিজ্যের ইতিহাস নানা দিক থেকেই মূল্যবান। এ ছাড়া ডাচ নথিপত্রর বিপুলতা বিষয়ে আমার ধারণা যদি ঠিক হয়, তা হলে ওই সূত্র থেকে ভারতীয় জীবনের যে-পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যাবে তার মূল্যও হবে অসাধারণ।

১৯৫৪-র এপ্রিল মাসে হারউইচ থেকে জাহাজে চড়ে হল্যান্ডের অন্যতম প্রধান বন্দর হুক অফ হল্যান্ড রওনা হলাম। এর আগে একবার ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছি, প্যারিস দেখার জন্য। সমুদ্র পার হওয়ার ওই অভিজ্ঞতা খুব সুখের হয়নি। ছোট ছোট জাহাজগুলিতে তখন স্ট্যাবিলাইজার থাকত না। ফলে সারা পথ বমি করতে করতে যেতে হয়। কিন্তু আশ্চর্য, শক্ত মাটিতে পা দিতেই শরীর সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। নর্থ সি পার হতে সারা দিন কেটে গেল। সারা পথ কিছু মুখে দেওয়ার অবস্থা ছিল না। কিন্তু আবার সেই একই অভিজ্ঞতা। মাটির ছেলে মাটিতে পা দিতেই সব কুছ ঠিক। প্রথম দর্শনেই হল্যান্ড আমার ভাল লেগেছিল : “এ দেশ লেগেছে ভাল নয়নে।” ভান এক্সেম ভাষা শেখানোর জন্য যে বইটি ব্যবহার করতেন তাতে হল্যান্ডের কোনও বন্দরের একটি ছবি ছিল। ছবিটির প্রধান দ্রষ্টব্য ছিল অসংখ্য সিগাল। এখানে পৌঁছে ঠিক সেই দৃশ্যই দেখলাম। ডাচরা নরম-সরম চুপচাপ মানুষ। কিন্তু তাদের সিগালদের চরিত্র ঠিক বিপরীত। এমন গোলমালপরায়ণ প্রাণী বোধহয় দুনিয়ায় আর নেই। দু-মিনিটেই কান এবং তৎসহ প্রাণ ঝালাপালা করে দিল। হুক ভান হল্যান্ড আসলে রটেরডামের বন্দর। ওখান থেকে ট্রেনে ডেন হাগ যেতে আধ ঘণ্টাখানেক লাগল। হল্যান্ড ছোট জায়গা। ওর বিখ্যাত শহরগুলি পরস্পরের খুব কাছাকাছি। ট্রামেও যাতায়াত করা যায়। দা হেগ বা ডেন হাগ নেদারল্যান্ডসের রাজধানী। কিন্তু নিতান্তই ছোট শহর। লোকে বলে ইউরোপের সবচেয়ে বড় গ্রাম। সত্যিতে দেশটির প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে অ্যামস্টারডাম। ডেন হাগে শুধু সরকারি দফতর আর দূতাবাসগুলির অবস্থান। ফলে পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে এ শহরে কোনও ভিড়ভাড় ছিল না। ছবির মতো সাজানো শহর। খালের পাড় ধরে ঝকঝকে পরিষ্কার সব রাস্তা। আর তার পাশ ধরে বাড়িগুলি বেশির ভাগই সতেরো থেকে উনিশ শতকের মধ্যে তৈরি। সাম্প্রতিক কালে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেই পুরনো ডেন হাগ হারিয়ে গেছে। আমার এই অতি প্রিয় শহরটিতে প্রতি বছরই দু-তিনবার যেতাম। এখন আর উৎসাহ পাই না।

যেসব ইউরোপীয় দেশের দুনিয়াজোড়া সাম্রাজ্য ছিল, নেদারল্যান্ডস তাদের অন্যতম। দুর্ভাগ্যক্রমে ফ্রান্সের মতো এই দেশটিও যুদ্ধের পর জাপানিদের কেড়ে নেওয়া এশিয়ায় তাদের সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে অনেক লোকক্ষয়ের কারণ হয়। এবং এই প্রচেষ্টায় স্বাধীনতাপ্রেমিক ব্রিটেন তাদের সাধ্যমতো সাহায্য করেছিল। ওলন্দাজরা তাদের এশিয়ার সাম্রাজ্য ফিরে পায়নি। কিন্তু কয়েক শো বছর ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজত্ব করার ফলে বেশ কিছু ডাচ পণ্ডিত ব্যক্তি ওই অঞ্চলের জীবনের নানা দিক সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। আধুনিকতা-পরবর্তী, মানে পোস্ট-মডার্নিস্ট তাত্ত্বিকরা এই জাতীয় বিদ্যাকে পাওয়ার নলেজ নাম দিয়েছেন। মানে যে-জ্ঞান ক্ষমতা অর্জন বা দৃঢ়ীকরণের জন্য অর্জিত। এই অভিধা যুক্তিযুক্ত হোক বা না হোক, মোদ্দা কথা যুদ্ধোত্তর হল্যান্ডে বেশ কিছু লোক ছিলেন, এশিয়া সম্বন্ধে মূল্যবান অভিজ্ঞতা যাঁদের আয়ত্তাধীন। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতিতে এঁদের বিদ্যাবুদ্ধি কাজে লাগানোর জন্য ডাচ সরকার ইউনেসকোর কাছে এক প্রস্তাব দেন। তার ফল ডেন হাগে ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল স্টাডিজ। এখানে মুখ্যত এশিয়ার ছেলেমেয়েরা ডাচ পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করতে আসবেন—এই উদ্দেশ্যে ইউনেসকো মোটা টাকা মঞ্জুর করেন। আর হল্যান্ডের রানি জুলিয়ানা হেগ শহরে তাঁর বাসভবনটি এই শুভকাজের জন্য দান করেন। পরে অবশ্য তাঁর কন্যা বিয়াট্রিক্স রানি হয়ে প্রাসাদটি ফিরিয়ে নেন। দিয়ে ফিরিয়ে নিলে কীসব হয় বলে বাঙালিদের যে লোকবিশ্বাস আছে, সে খবরটা হল্যান্ড অবধি পৌঁছয়নি। ওই রাজপ্রাসাদে কিঞ্চিৎ নজরানা দিয়ে অন্য দেশের ছাত্রদেরও থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। আমি সেই সুবাদেই ওখানে একটি থাকার ঘর পেয়েছিলাম।

সে অতি সুব্যবস্থা। রাজপ্রাসাদ বলে কথা! আধুনিকতায় অক্সফোর্ডের তুলনায় অনেক এগিয়ে। ইউরোপে বাস করছি অথচ ঘরের মধ্যে শীত করছে না। এ এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। খাওয়াদাওয়া নিয়ে ভারতীয় আবাসিকরা কিঞ্চিৎ ঘ্যানঘ্যান করলেও এখানকার ভোজনব্যবস্থা বেলিয়লের তুলনায় স্বর্গীয়। দু সপ্তাহেই গায়ে রীতিমতো গত্তি লাগল। বলতে নেই—গায়ে গত্তি লাগার ব্যাপারে ওলন্দাজরা ইউরোপে অগ্রগণ্য। প্রচুর পরিমাণে চিজ আর বিয়ার খাওয়ার ফলে অধিকাংশ স্ত্রী-পুরুষই দিব্যি গোলগাল, মোটাসোটা। লন্ডনে একটি মেয়েদের পোশাক-আশাকের দোকান আছে, নাম ‘ইয়াং আউটসাইজেস’। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম—দোকানটির বেশির ভাগ বিক্রি হল্যান্ডে। হেগ-এ বাস করার অন্যতম সুফল হল ইন্দোনেশীয় খানা আবিষ্কার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রন্ধনশৈলীদের মধ্যে না পড়লেও রীতিমতো সুস্বাদু। আর ডাচরা তাদের স্বাভাবিক প্রতিভা প্রকাশ করে ওই খানা থেকে রাইসটাফেল সৃষ্টি করেছে—দশ বারো থেকে চল্লিশ পদের ভোজ। আমরা সাধারণত তিন-চারজন একত্র হয়ে একটি বহু পদের রাইসটাফেল অর্ডার দিতাম। বিশ্বাস করুন—মাত্র একজন ওলন্দাজ ব্যক্তিকে একা বসে পুরো একটি চল্লিশ পদের রাইসটাফেল খেতে দেখেছি। গভীর মনোযোগ দিয়ে, দিব্বি রসিয়ে রসিয়ে।

ভূতপূর্ব রাজপ্রাসাদে বাস করার সময় যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাদের মধ্যে দুটি চরিত্র বিশেষ স্মরণীয়। একজন কেরলের লোক, এবং পরে কোনও ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। ডাচরা ক্রিসমাসে তত হইচই করে না, যত করে নভেম্বর মাসে সান্টাক্লস দিবসে। আমাদের এই বন্ধুটি ডাচ প্রথানুযায়ী সান্টাক্লসের সহগামী জোয়ার্তো পিট (কৃষ্ণবর্ণ পিটার)-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। কৃষ্ণকায় পিটের সঙ্গে বিরাট থলে। সারা বছর শিশুরা ভালমন্দ কী করেছে শুনে সন্ত হুকুম দিতেন—এ অতি উত্তম বালক বা বালিকা। একে পুরস্কার দাও। পিট নর্তনকুর্দন সহযোগে থলে থেকে উপহার বের করে সুকর্মের পুরস্কার দিত। আর বছরটা যদি সদাচারে না কেটে থাকে তো নাবালকের ভাগ্যে মহতী প্রণষ্টি। কালো পিটার তাকে ঝোলার মধ্যে ভরার উপক্রম করত। আর ভ্যা ভ্যা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হত। এই মানুষটি প্রকৃতির নিয়ম অনুসরণ করে একদিন প্রেমে পড়ল। ওঁর স্বভাবটা ছিল কতকটা মধ্যযুগের নাইটদের মতো। প্রেমে পড়ে চুপচাপ থাকবেন সে বান্দা তিনি নন। সর্বত্র ঘোষণা করে বেড়াতে লাগলেন—”আই অ্যাম ইন লাও।” এই ‘লাও’ যথাকালে ফলবতী হয়েছিল। ভদ্রলোক ওলন্দাজ পত্নী নিয়ে দেশে ফেরেন।

সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের লোক ছিলেন হৃষীকেশ ব্যানার্জি। কতকটা যাকে নৈতিক মৌলবাদ বা মরাল ফান্ডামেন্টালিজম বলা চলে উনি তাতে বিশ্বাসী ছিলেন। সব ব্যাপারেরই, হয় নৈতিক নয় যুক্তিভিত্তিক, যাথার্থ্য প্রমাণ না হলে ওঁর সক্রিয় সম্মতি পাওয়া কঠিন হত। বিখ্যাত ওলন্দাজ অর্থনীতিবিদ নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক টিনবার্থেনের ছাত্র এই ভদ্রলোক হঠাৎ প্রায় খেপে গেলেন। মানে, কাজ যতটা এগোনো দরকার তা এগোচ্ছিল না দেখে উনি প্রায় আহারনিদ্রা ত্যাগ করে প্রাসাদের হলঘরে এসে আশ্রয় নিলেন। সেখানে সিগারেট মুখে দিনে গড়পড়তা ষোলো থেকে আঠারো ঘণ্টা গ্রামোফোনে রামধুন বাজাতে লাগলেন। কেউ মৃদু আপত্তি জানালে বলতেন—আমাকে দেখাও কোথায় লেখা আছে হলঘরে রামধুন বাজানো নিষিদ্ধ। কথাটা কোথাও লেখা ছিল না। ফলে রঘুপতি রাজারামের প্রশস্তিতে ডেন হাগের আকাশবাতাস ধ্বনিত হতে লাগল। বীতশ্রদ্ধ হয়ে কিছু রামভক্ত ধর্মান্তরণের বিষয় খোঁজখবর নিতে লাগলেন। টিনবার্থেন সাহেব সেন্টারের রেক্টরের সঙ্গে পরামর্শ করে এক মনস্তাত্ত্বিককে পাঠালেন। লোকটি ঘণ্টা দুয়েক ব্যানার্জির সঙ্গে কথাবার্তা বলে বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে অবনত মুখে বাড়ি ফিরে গেলেন। ওঁদের কী কথাবার্তা হয়েছিল তা ব্যানার্জির কাছেই শুনলাম। ব্যানার্জি অত্যন্ত ভদ্রভাবেই মনস্তাত্ত্বিককে বুঝিয়ে বলেন যে, সে নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে পশ্চিমে মনস্তত্ত্ব ঠিক বিজ্ঞানের স্তরে পৌঁছয়নি। আর বিষয়টা কখনও ঠিক বিজ্ঞান হতে পারে কি না সে বিষয়ে কি কিছুটা সন্দেহের অবকাশ নেই? আর একটু দ্বিধার সঙ্গেই বলতে হচ্ছে যে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে মানুষের অন্তর্জগৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা তুলনায় কিছুটা বেশি এগিয়েছে। ভদ্রলোক যদি চান তা হলে ব্যানার্জি ওকে ইংরেজিতে পাওয়া যায় এরকম তন্ত্রবিষয়ক কিছু বইয়ের সন্ধান দিতে পারে। তবে ঠিকভাবে ব্যাপারটা বুঝতে হলে সংস্কৃত শেখা ছাড়া পথ নেই। টিনবার্ধেন ব্যানার্জির গুরু। ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে গুরুবাক্য লঙ্ঘন করতে নেই। না হলে ব্যানার্জি ভদ্রলোকের অকারণে সময় নষ্ট করতেন না। এরপর পশ্চিমি মনস্তাত্ত্বিকের আর কিছু বলার বা করার ছিল না। তিনি গুটিগুটি পশ্চাদপসরণ করলেন। আমার ধারণা উনি নে হাগে প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে তারাপীঠে অঘোরীবাবার কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন।

মরিয়া হয়ে সেন্টারের কর্তৃপক্ষ শেষাশেষি আমাকে ধরলেন, “তুমিই না হয় করো না ভাই চেষ্টা!” বাবা, ওকে একটু বোঝাও, অন্যত্র খুব ভাল থাকার ব্যবস্থা করে দেব। ভয়ে ভয়ে কথাটা তুলোম। প্রতিপ্ৰশ্ন, “কেন যাব?” “লোকে যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।” “তাতে আমার কী?” “মানে কোড অফ কনডাক্ট বলে একটা জিনিস আছে।” “ডিফাইন কোড, ডিফাইন কনডাক্ট।” আমি সম্পূর্ণ পরাজিত। বয়স থাকতে অ্যারিস্টটল ভাল করে পড়া হয়নি। এখন এই কুট প্রশ্নের জবাব দিই, আমার সাধ্য কী? ব্যানার্জির মুখে এর পরবর্তী প্রস্তাব শুনে সসম্মানে পশ্চাদপসরণই বুদ্ধির কাজ মনে হল। তিনি বললেন, “আপনাকে যদি জানালা দিয়ে ফেলে দিই, তবে?”তাহলে আর কিছুই বলার উপায় থাকবে না, অতএব কয়েক বছর পরে কলকাতার রাস্তায় ব্যানার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ। খুব উৎসাহের সঙ্গে নেমন্তন্ন করে বাড়ির ঠিকানা দিলেন। বললাম, “একটু পথ বাতলাবেন?” উত্তর, “কোনও অসুবিধে হবে না। যে বাড়িটার সামনে একটা ষাঁড় বসে আছে দেখবেন, সেইটে।” “ষাঁড়টা আপনাদের?” “না।” “ওখানে ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা থাকে?” “না, কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না। রোজই আসে।” যথা সময়ে ব্যানার্জির বাড়ির রাস্তায় ঢুকলাম। সেখানে কোনও ষাঁড় নেই। কিন্তু ব্যানার্জি পায়চারি করছেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তিমুখে ব্যানার্জি ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন, “ষাঁড়টা আজ আসেনি।” কিন্তু ব্যানার্জি এসেছেন। অতএব আমার কোনও অসুবিধে হল না।

.

ডেন হাগের অফিসপাড়ায় জগদ্বিখ্যাত অভিলেখাগার আলখমেইন রেইকসআরখিফ। ডাচ ভাষার শব্দসমষ্টি অন্য কোনও ভাষার বর্ণমালায় পাঠান্তরিত করা যায় না। যত দূর সম্ভব চেষ্টা করলাম। ডাচরা নিজেরাই বলেন- ওদের ভাষাটা আসলে একটা কণ্ঠপীড়া। খুব খারাপ রকমের সর্দিকাশি হলে মোটামুটি শুদ্ধ উচ্চারণ করা যায়। ওই যে সবাই বলে ভ্যান গঘ, ওটা আসলে হবে ভান খখ। না, অত সোজা না, খুব ভাল করে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করুন, কাছাকাছি পৌঁছতে পারবেন—মানে, হয়তো পারবেন। ঠিক কিছুতেই হবে না। যাক সে কথা। ওলন্দাজদের ওই কেন্দ্রীয় অভিলেখাগারে পৌঁছে মুন্ডু ঘুরে গেল। এশিয়া-সংক্রান্ত নথিপত্রের রক্ষক ডাকসাঁইটে পণ্ডিত শ্রীমতী মেইলিংক-রুলফসন। ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝলাম, সতেরো-আঠারো শতকে ওলন্দাজ কোম্পানির ভারতবর্ষ-সংক্রান্ত কাগজপত্রের পরিমাণ বহু লক্ষ পৃষ্ঠা। তার কোনও ছাপানো বা টাইপ করা তালিকা নেই। বছর প্রতি একটি বা দুটি ভলুম। প্রতিটি ভলমের সঙ্গে হাতে লেখা তালিকা আছে। তার থেকে খুঁজে বের করতে হবে তোমার জ্ঞাতব্য কোথায় আছে। তবে নথিপত্রগুলি পড়ে দেখলেই সবচেয়ে ভাল হয়। এ আর এমনকী কথা। কয়েক লক্ষ পৃষ্ঠা। পড়ে শেষ করতে একশো দেড়শো বছরের বেশি লাগা উচিত না। মানে, অভিলেখাগার দিনে আট ঘণ্টা খোলা থাকে। আর মাইক্রোফিল্ম করারও ব্যবস্থা আছে। সস্তা একটা রিডার কিনে নিলে বাড়িতে আরও ঘণ্টা দশেক পড়া যায়। মানে একটু চেপে কাজ করলে শতখানেক বছরে হয়ে যাওয়া উচিত। মনে হল এই ধরনের চিন্তা রাইসটাফেলভোজী সংস্কৃতিতেই সম্ভব। না, শ্রীমতী রুলফসন আমাকে একশো বছর নথিপত্র ঘাঁটার পরামর্শ দেননি ঠিকই। কিন্তু তার চেয়ে খুব যে কিছু কম কাজের কথা বলেছিলেন, তাও নয়।

পরিমাণ ছাড়া আরও দু-একটা অসুবিধে আছে দেখলাম। প্রথম অসুবিধে—যে ভাষায় নথিপত্রগুলি লেখা, সেই সতেরো শতকের সওদাগরি ডাচ ভাষা আমি শিখিনি। ও ভাষা যাদের জানা আছে সেই অল্পসংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তির এমন সময় নেই যে আমাকে বসে ভাষাশিক্ষা দেবেন। আর সেই হস্তলিপি? অক্সফোর্ডে এসে সতেরো শতকের ইংরেজি হস্তলিপি পড়তে শিখেছি ঠিকই। কিন্তু সেই লেখা আর এই লেখা এক না। তিন বছরের মধ্যে থিসিস শেষ করতে হবে। তার ছ’ মাস চলে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসলাম। “দরিয়ায় ঘোর তুফান, পার কর নাইয়া।”

ক্রমে ক্রমে অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে ক্ষীণ রবিরশ্মি দেখতে পেলাম। শ্রীমতী রুলসনের সহকর্মী হের ইয়াপিকস। তাঁর পত্নী বিনা পয়সায় পুরনো হস্তলিপি শেখাতে রাজি হলেন। মাঝে মাঝে ওঁদের বাড়িতে কাটা-মুলোটা নিয়ে যেতাম। কিন্তু এই মহানুভব দম্পতির কাছে পেয়েছি অনেক, তার বদলে ওঁদের দিয়েছি অতি সামান্যই। রোজ মিসেস ইয়াপিকসের সাহায্যে কয়েক পৃষ্ঠা পুরনো দলিল নকল করতাম। আর শ্রীমতী রুলফসন একটি বই হাতে ধরিয়ে দিলেন। সতেরো শতকের শেষ ভাগে লেখা পিটার ভান দামের ডাচ কোম্পানির ইতিহাস। তার ভাষা আর আমার পাঠ্য দলিলগুলির ভাষা এক। আর একজন শিক্ষকও ঠিক করে দেওয়া হল। তিনি ইস্কুলে ইংরেজি পড়ান। ভান ভেইলোর ইংরেজি জ্ঞানে কোনও খুঁত নেই। ওঁর সঙ্গে বসে ভান দামের বই নিয়ে রোজ কুন্তি হত। গলিয়াথের সঙ্গে বালক ডেভিডের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত দানবের পরাজয় ঘটল। হঠাৎ একদিন দেখি দলিলগুলি পড়ে বুঝতে পারছি। সে কী প্রচণ্ড উল্লাস। পাশের রাস্তায় কাফেতে গিয়ে বোতল দুই হিমশীতল আমস্টেল বিয়ার খেলাম। আহা! যেন অমৃত।

মাস খানেক অহোরাত্র দলিল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে থিসিসের বিষয়ও ঠিক করে ফেলোমকরমণ্ডল উপকুলে ডাচ কোম্পানির ব্যবসার সুত্র ধরে ভারতীয় বাণিজ্য এবং অর্থনীতির ইতিহাস। প্রতি পনেরো দিনে কোম্পানির ঘোট ঘোট কুঠির কর্তারা বড়কুঠির বড়কর্তাকে রিপোর্ট পাঠাতব্যবসা এবং স্থানীয় রাজনীতি বিষয়ক সব খবর দিয়ে। অতি পুঙ্খানুপুঙ্খ সেই বর্ণনা। আমি সেই তথ্যসমুদ্রের কণামাত্র ব্যবহার করেছি। আমার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী গবেষকরা আরও কিছু কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু এই বিশাল তথ্যভাণ্ডারের অধিকাংশই এখনও অব্যবহৃত। আশা করি ভবিষ্যৎ গবেষকরা এই কাজটা ছেড়ে দেবেন। গবেষণার যে এক রোমাঞ্চকর দিক আছে, ডাচ কোম্পানির কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন হই। তিনশো, চারশো বছর আগেকার নিতান্ত বিষয়ঘটিত চিঠি আর রিপোর্টগুলিতে যেন বহুদিন আগেকার জীবিত মানুষের প্রাণের স্পন্দন শুনতে পেতাম। এক বছরের কাগজপত্র পাওয়া যায়নি, কারণ জাহাজডুবি হয়ে সেগুলি হারিয়ে গিয়েছিল। পরে সেই ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে চিঠিগুলি উদ্ধার হয়। সেই কাগজে সমুদ্রের জলের দাগ ছিল। কত অপ্রত্যাশিত খবর এইসব চিঠিপত্রে হঠাৎ চোখ পড়ত। রোসাঙ্গের কুঠিয়ালের কয়েকটি চিঠি থেকে শাহ সুজার পরিবারের ভয়াবহ মৃত্যুর সংবাদ জেনেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ লিখিত ‘দালিয়া’র সুমিষ্ট কাহিনি নিদারুণ সত্যের নিষ্ঠুর চাপে কোথায় তলিয়ে গেল। একবার পড়াটা সহজ হয়ে যাবার পর ওই দলিলপত্র ঘাঁটা একটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়ায়।

অভিলেখাগারে ন’টা-পাঁচটা কাজ করা একটা সানন্দ দিনপঞ্জীর কেন্দ্রীভূত হয়ে গিয়েছিল। সকাল সাড়ে আটটায় পায়ে হেঁটেই রওনা হতাম। যেখানে থাকতাম সেখান থেকে আফিসপাড়া খুবই কাছে। মানুষের খোঁড়া এক প্রাচীন দিঘি নাম ভেইভেরবার্গ (কী করা যাবে, বলুন), তার পাশ দিয়ে দু’পাশে গাছের সারির মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলে পাঁচ-সাত মিনিটের পথ রিডেরজাল, ওরফে হল্যান্ডের পার্লামেন্ট ভবন—ইউরোপে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের তীর্থভূমি। ষোড়শ শতকে স্পেনের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এইখানে স্বাধীন নেদারল্যান্ডস রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। পার্লামেন্টের চৌহদ্দি পার হয়ে শহরের প্রধান চক, প্লাৎস—ভারী সুন্দর। অফিসপাড়া এত সুন্দর হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। চকের চারপাশ ঘিরে সব সরকারি দফতর সতেরো থেকে উনিশ শতকের মধ্যে তৈরি সব প্রাচীন সৌধ। আর একটু বিসদৃশভাবেই তার মাঝে মাঝেই নাইট ক্লাব, রেস্টোরেন্ট, কাফে এবং একটি অতি সুন্দর অভিজাত ভবন, মাউরিটসহাউস (ইংরেজিতে মরিস হাউস)। কাফেগুলিতে নগরবধুরা দিনের বেলায়ই খদ্দেরের সন্ধান করে, নিতান্তই গদ্য ছন্দে, যেন টুরিস্টদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করছে। এর মধ্যে ঢাকা-চাপা কিছু নেই। মিল্ক শেক খেতে খেতে শিশু বাপকে প্রশ্ন করে “ওরা কারা?” নিরুত্তাপ স্বরে অন্য দিকে তাকিয়ে পিতা উত্তর দেন “হুরচ্যা।” হুর মানে গণিকা। চ্যা-টা প্রত্যয়, অর্থ ছোট। অনেক সময়ই আদরের ইঙ্গিত বহন করে। যেমন ওলিফ্যানচা—অর্থাৎ ছোট হাতি। হাতি আর কত ছোট হতে পারে? তেমনই জাতীয় সৌন্দর্যের আদর্শ অনুসরণ করে হুরচ্যারাও অনেক সময়ই রীতিমতো দশাসই। এই ক্ষেত্রে চ্যা’টা স্নেহ এবং কিছুটা সামাজিক স্বীকৃতির দ্যোতক। বোধহয় ওলিফ্যানচ্যার খাঁটি বাংলা অনুবাদ হবে হাতি-সোনা। সহনশীল এবং স্নেহপ্রবণ ডাচদের কাছে সবাই চ্যা। আমিও শিগগিরই তপনচ্যা হয়ে গেলাম, যদিও যে রেটে চিজ-রুটি-বিয়ার খেয়ে দেহের আয়তন বাড়ছিল তাতে আক্ষরিক অর্থে ওই ক্ষুদ্র প্রত্যয়টি আর আমার প্রতি প্রযোজ্য ছিল না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে হল্যান্ডের সামাজিক এবং আবেগঘটিত ব্যাপারে তফাত বোঝাতে একটি কথা বলাই যথেষ্ট; প্রথমোক্ত দেশে আমাকে কেউ লিটল তপন বা তার সমতুল্য কোনও শব্দে বর্ণনা করবেন এমন সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। তবে বিপণি বালিকারা স্ত্রী-পুরুষ জাতিধর্মনির্বিশেষে সবাইকে ডার্লিং সম্বোধন করে বটে। কিন্তু সেই সম্বোধনকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।

আর্কাইভস যাওয়ার পথে মাউরিটসহাউস। ডাচ চিত্রশালাগুলির মধ্যে এটি একটি ক্ষুদ্র রত্নভাণ্ডার। পঞ্চাশের দশকে ওখানে ঢুকতে পয়সা লাগত না। ফলে প্রায় রোজই কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়েছি। মাউরিটসহাউসের জানালা দিয়ে ভেইভেরবার্গ দেখা যেত। সেখানে নানা জলচর পাখির ভিড়। আর চিত্রশালার ভিতরে জগদ্বিখ্যাত সব ডাচ ছবি। সংখ্যায় অল্প হলেও তাদের জায়গা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছবির তালিকায়। এইখানেই রেমব্র্যাটের আঁকা নিজের সব প্রতিকৃতি, ওঁর বিখ্যাত অ্যানাটমি লেসন, ভেরমিয়ারের মুক্তার দুল পড়া বালিকা এবং তাঁর অতুলনীয় ডেলটের দৃশ্য। শেষে উল্লিখিত ছবিটি থেকে যে লোকোত্তীর্ণ আনন্দ পেয়েছি তার তুলনীয় অন্য কোনও অভিজ্ঞতার কথা আমি ভাবতে পারি না। ওই ছবি দেখার পর সুযোগ পেলেই ডেলফট চলে যেতাম। খালপাড়ের এই শহরটির একটা নিদ্রালু ছায়াময় রূপ আছে। আধুনিকতা তাকে নষ্ট করতে পারেনি। শহুরে জীবনে এত নিরিবিলি শান্তির সন্ধান বোধহয় আর কোনও সংস্কৃতি আবিষ্কার করতে পারেনি। সতেরো শতকের বিখ্যাত ডাচ চিত্রশিল্পে সেই সচ্ছল নগরজীবনেরই সানন্দ প্রকাশ। বাড়ির চত্বরে গৃহকর্তা একটি লম্বাটে গেলাস থেকে বিয়ার খাচ্ছেন। রান্নাঘরে টেবিলে কিছু রুটি আর চিজ, খালের পাড় ধরে শহরের বাড়িগুলি বিকেলের সূর্যালোকে কোথাও আলোকিত কোথাও ছায়াময়, ঘরের ভিতরে, মানুষের অবয়বেও সেই আলোছায়ার খেলা। সব মিলিয়ে জীবনের তুচ্ছ দৈনন্দিনতার মধ্যে গভীর তৃপ্তি খুঁজে পাওয়া। খজেলিখ, লেকের, হেরলেঈখ তৃপ্তিব্যঞ্জক এই শব্দগুলি দিনের মধ্যে কতবার শুনেছি যে মনে হত এদের জীবনে অতৃপ্তির কোনও স্থান নেই। ডাচ চিত্রশিল্পীদের মধ্যে অনেকের জীবনই খুব নিরুপদ্রব বা নিরবচ্ছিন্ন সুখের ছিল না। কিন্তু তাঁদের শিল্পকর্মে জীবনযন্ত্রণার ছাপ প্রায় নেই।

আনন্দ বা এক্সট্যাসির সঙ্গে ডাচ সংস্কৃতির পরিচয় আছে কিনা বলতে পারব না। কিন্তু অতি সাধারণ অভিজ্ঞতাগুলি থেকে গভীর তৃপ্তি বা সুখ আস্বাদনের ক্ষমতা ওদের অসাধারণ। দুপুরে খালের পাড়ে বসে একটা চিজের স্যান্ডউইচ বা মেশিন থেকে এক কোয়াচা বা গিলডারের চতুর্থাংশ (আমাদের তখনকার হিসাবে ছ’ আনার সমান) দিয়ে একটা লম্পিয়া অর্থাৎ ইন্দোনেশীয় স্প্রিং রোল কিংবা মাংসের ক্রকেট কিনে খেতে খেতে, যে খাচ্ছে তার সে কী আনন্দ। “লেকের, হ্যাঁ?” দারুণ খেতে, কী বলল! সহকর্মী তার লুম্পিয়ায় কামড় বসিয়ে সানন্দ প্রত্যুত্তর জোগালেন, “ইয়া, হোর, এখত লেকের।” হাঁ ঠিকই বলেছ, সত্যিই দারুণ। শীতের সন্ধ্যায় শরীর গরম করার ভরসায় দু-তিন বন্ধু মিলে সাত-আট মাইল সাইকেল চালিয়ে এসে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে এক কাপ কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্ত কণ্ঠে উক্তি, “খজেলিখ, হোয়ে?” উত্তর, “ইয়া, এখত খজেলিখ!” হ্যাঁ, সত্যি বড় আরাম। এই বোধহয় একমাত্র দেশ যেখানে বাচ্চারা খাওয়া নিয়ে কোনও নকশা করে না। দিনের পর দিন প্রাতরাশ আর দ্বিপ্রহরিক আহার্য ওই সেই এডাম বা খাউদা চিজের স্যান্ডউইচ। কিন্তু তা নিয়ে বাচ্চাদের কী উদ্দাম ফুর্তি। “লেকের বটেরহাম, লেকের বটেরহাম।” লেকের মানে অতি সুস্বাদু, বটেরহাম স্যান্ডউইচ, যদিচ জিনিসটায় বাটার বা হ্যাম দুটোর কোনওটাই থাকে না। আর খজেলিখ? দেহমনের এই সুখের অনুভূতিবোধক শব্দটির কোনও বাংলা প্রতিশব্দ নেই। তবে অনুভূতি দিয়ে যদি অনুভূতির অনুবাদ সম্ভব হয় তো বলি—শীতের সকালে রোদে পিঠ দিয়ে বসে যে আরাম, গ্রীষ্মের দুপুরে শীতলপাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে অথবা শৈশবে হিমশীতল বিছানায় লেপের নীচে ঢুকে যে প্রাথমিক উল্লাস তার পরিবেশ বর্ণনার সুষ্ঠুতম বিশ্লেষণ খজেলিখ। তবে অনুভূতিটা বিশিষ্টভাবে ডাচ আর শব্দটার উচ্চারণ তো বটেই। দুটোর একটারও ঠিক বঙ্গীকরণ সম্ভব নয়।

আধুনিক ইউরোপের সংস্কৃতিতে ডাচদের জায়গা প্রথম সারিতে নয়। ওদের বুদ্ধি বা বোধির জগৎ জীবনযন্ত্রণায় তিক্তবিচ্ছিন্ন নয়। ওদের জীবনের মূল সুর শান্তরসে বাঁধা। ফরাসি বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য ওদের নেই। ওদের জীবনচর্যায় চমক লাগার মতো কিছু নেই। কিন্তু শান্ত সুস্থ বুদ্ধির চর্চায় ওরা ইউরোপ তথা পৃথিবীর জীবন সমৃদ্ধ করেছিল। ইরাসমাস মানবিকতাবাদের জনক, হিউগো গ্রোটিয়াস আন্তর্জাতিক আইনের, স্পিনোজা যুক্তিভিত্তিক দর্শনের। আর ডাচ চিত্রকলায় ওদের জীবনানুভূতির অনবদ্য প্রকাশ সর্ব মানবের হৃদয় হরণ করেছে। ঘরের ভিতর এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে—তার রূপের শেষ নেই। এক টুকরো রুটি আর চিজের স্বাদ—সে বড় তৃপ্তিদায়ক। এক গ্লাস হিমশীতল লাগার যখন গলা দিয়ে নামে, তখন কি আর জগতের কোনও দুঃখ কষ্টের কথা মনে থাকে? ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই জগৎ অতীন্দ্রিয় আনন্দের সংবাদ বয়ে আনে। অসংখ্য অবিরত ছোট ছোট সুখের প্রবাহ এই জীবনবড় তৃপ্তিকর, বড় খজেলিখ। বেঁচে থাকা বড় সুখের, বড় সৌভাগ্যের আকর। বেঁচে থাকতে ভাল লাগে। সমস্ত স্নায়ুপথে এই সৌভাগ্য সানন্দে স্বীকার করার শিক্ষা হল্যান্ডে থেকে পেয়েছিলাম।

ডাচ জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম একটি বিশেষ কারণে। আমি দীর্ঘদিন একটি ডাচ পরিবারে অতিথি হয়েছিলাম। আমি যখন ইনস্টিটিউট অফ সোস্যাল স্টাডিজের বাসিন্দা তখন একদিন পরিচিত একজন বললেন, “অকারণে এত খরচা করছ কেন? এখানে এর প্রায় অর্ধেক খরচায় থাকা যায়।” কথাটা প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। ছাত্রাবাসে পরিণত রাজপ্রাসাদে মাসিক থাকা-খাওয়ার খরচা, পঁচিশ পাউন্ড। এই খরচায় কোথাও থাকা ইংল্যান্ডে কল্পনা করা যায় না। আরও সস্তা কীভাবে সম্ভব? কিন্তু অসম্ভব সত্যিতেই সম্ভব হল। মাসিক দেড়শো গিলডার বা পনেরো পাউন্ডে এক ভদ্র ভবনে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আর হাতখরচা মাসিক পাঁচ পাউন্ডের মতো। এতে যে হালে থাকতাম তা ঠিক রাজার না হলেও উজির নাজিরের তো বটেই। ফলে হাতে এত পয়সা জমে গেল যে স্কলারশিপ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও প্রায় ছ’ মাস নিজের খরচায় ইউরোপে থাকা সম্ভব হয় এবং বহু দেশ ঘুরে দেশে ফিরতে পারি।

যে-বাড়িতে ছিলাম সে বাড়ির কর্তা হেগ শহরের বিখ্যাত আর্কিটেক্ট। কিন্তু ডাচরা কৃপণ হলেও হিসেবি। তিন ছেলের বাবা হেরম্যান লেলি দুই ছেলে সাগ্নিক হওয়ায় তাদের ঘর দুটি অদানে অব্রাহ্মণে ফেলে রাখতে রাজি নন। তাই পেয়িং গেস্ট নেওয়া। ওদের

পারিবারিক ইতিহাস খুব সুখের নয়। মিস্টার লেলির বাবা ছিলেন ইহুদি। কিন্তু যুদ্ধের সময় নাৎসিদের আর্কিটেক্ট প্রয়োজন। তাই ওঁকে বলা হয় জার্মান রাইখের সেবায় লাগতে অথবা আর পাঁচজন ইহুদির মতো সপরিবারে গ্যাস চেম্বারে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে। বীরত্ব সকলের আসে না। ফলে লেলি সাহেব নাৎসিদের হয়ে কাজ করেন। এর জন্য যুদ্ধের পরে ওঁকে কারাবাস করতে হয়েছিল এবং দীর্ঘদিন ওঁরা প্রায় একঘরে হয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য ওইখানেই শেষ হয়নি। বড় ছেলে হেরম্যানের বয়স তখন ষোলো। চারিদিকে সবাই লড়ছে? সে শুধু ঘরে বসে থাকবে? নাৎসি তরুণদের পাল্লায় পড়ে শেষে ও জার্মান ফৌজে যোগ দিল। তবে লড়াই করার সুযোগ সে খুব পায়নি। তার প্রথম দিনের লড়াইয়ের প্রথম ঘণ্টায়ই কামানের গোলায় তার ডান পা উড়ে যায়।

লেলি পরিবারে মেজ ছেলে ইডো আমার সমবয়সি এবং কালে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে দাঁড়ায়। সেও আর্কিটেকচারের ছাত্র, তবে ডিগ্রি পেতে ওর বহুদিন লেগেছিল। তার কারণ গতানুগতিক স্থাপত্যে ওর বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেসব খামখেয়ালি কাজ করা যায়, ছাত্র অবস্থায় তা করতে গেলে মুশকিলে পড়তে হবেই। ইডোর আর একটি পেশা বা শখ ছিল। সে মাটির আর কাঠের মূর্তি বানাত। মানুষেরই সব প্রতিকৃতি। তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের মুখভাবে। পৃথিবীর সব কিছুর প্রতি সম্পূর্ণ অনীহা বা বিস্ময়বোধ ফুটিয়ে তোলার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ইডোর। বড় ছেলে হেরম্যান, তার স্ত্রী ইড়া, ছোট ছেলে ইয়ান, তার বাগদত্তা এলি-এরাও প্রায়ই রাত্রের খাওয়ায় যোগ দিত। আর এরা এলে খাওয়ার পর রোজই একটি ছোটখাটো উৎসব হত। তার নাম ছিল আফওয়াস-সাজেন বা বাসন ধোওয়ার গান। বাসন ধোওয়া এবং মোছর সঙ্গে সঙ্গে এইসব অনবদ্য সঙ্গীত নৃত্যসহ পরিবেশিত হত। কয়েকটি গান বেশ মনে আছে। যথা–

উই হেইফৎ সাইকর ইন দা এরতে সুফ খদান
        দ হেইলঅ কম্পানি হেইফত এত এতেন লাতেন স্তান।

সঙ্গীতটি করুণরসের। মানে মটরশুটির সুপে কে চিনি ঢেলেছে? ফৌজি দলের কেউই আর ওটা মুখে তোলেনি। আর একটি গান আরও ভয়াবহ।

দার খাত ইয়নচ্যা নার দ ব্লিকসাম তু
        নার সেইন আল-অ লাতস্ত-অ রান্দে ভু

অনুবাদ : ওই যায় ইয়ানচ্যা রসাতলে (আক্ষরিক অনুবাদ : ইয়ানচ্যা চলেছে যেথায় বজ্রপাত হবে) এই তার অন্তিম সাক্ষাৎকার বা রাঁদেভু।

ওলন্দাজ সাহিত্য যেটুকু নাড়াচাড়া করেছি খুব রস কিছু পাইনি। ওদের এক মিলটন আছেন, নাম ভন্দেল। চেষ্টা করেছিলাম। এগুতে পারিনি। সাহিত্যের ক্ষেত্রে শুধু এক ব্যাপারে পাঠকের চিত্ত জয় করার ক্ষমতা ওদের আছে। ওদের উদ্ভট কবিতা অসাধারণ। কেন যে ও বস্তু দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি, তা আমার জানা নেই। দু-একটি উদাহরণ দিই। প্রথমটি আজকের দিনে খুবই প্রাসঙ্গিক।

জেকের আখমাদ ভান বাখদাত
        লাখ মেৎ জেইন খাত অপ জেইন বাদমাৎ।
        এন সো হেই লাস সেইন দাখব্লাদ
        ইদেরএইন সাখ দাৎ
        এত ইস রার
        মার ইন বাখদাত, দার মাখ দাত।

এই অনবদ্য কাব্যের ভাবার্থ শুধু দিতে পারি, অনুবাদ আমার সাধ্যাতীত। বাগদাদ শহরে আহমেদ নামে কোনও ব্যক্তি, পশ্চাদ্দেশ স্নানের জন্য ব্যবহার্য আসনটিতে রেখে তার দৈনিক কাগজটি পড়ত। সকলেরই মত, ব্যাপারটা রোজ যা ঘটে তার মধ্যে পড়ে না ঠিকই। তবে বাগদাদ বলে কথা সেখানে এ ঘটতেই পারে।

আর পরের কবিতাটি আমার অতি প্রিয়। মানুষের অন্তহীন নিঃসঙ্গতা বা হিউম্যান কন্ডিশনের এমন মর্মন্তুদ ছবি আমি আর কোথাও পাইনি।

ইক সিত বেই দ ভেনস্তারগ্লাস-অ অননুমলেইক ত ভেরভেইলে
        ইক ঔ দাত ইক টোএই হঞ্চাস ওয়াস
        সো দাত ইক কন সামেন স্পেলে।

জানলার ধারে বসে আছি, বিরক্তির (কথাটার ইংরেজি অনুবাদ হবে ‘বোরডম’) শেষ সীমায় পৌঁছেছি। ইচ্ছে করে, যদি এক জোড়া কুকুরছানা হতাম, তবু না হয় দুটিতে এক সঙ্গে খেলা যেত।

এইসব কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ইডো এবং ইডোর বাবা। বৃহত্তর হল্যান্ডের সঙ্গে পরিচয়ও প্রথমে ওদের মারফত। খালের পাড় ধরে অ্যামস্টার্ডামের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, ওখানকার সরকারি চিত্রশালায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান, রটেরডাম-এর (যে শহর নাৎসিরা আত্মসমর্পণ না করার অপরাধে তিন ঘণ্টার অবিরত বোমাবর্ষণে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল) হোমাপক্ষীর মতো ভস্ম থেকে উঠে আসা শহরে অতি আধুনিক চিত্রশালা দর্শন আর সবার উপরে ছুটির বিকেলে এবং সুযোগ পেলেই প্রতি সন্ধ্যায় খেভেনিঙ্গেনের সমুদ্রতীর-জীবনের বহু সুন্দরতম মুহূর্ত ইডোর সঙ্গে কেটেছে। আর বছরে কয়েকটি সপ্তাহ মাঠ জুড়ে রঙের খেলা-টিউলিপের মরসুম। ইউরোপে কর্মোপলক্ষে ফেরার পরেও বারবার ওই দৃশ্য দেখতে ফিরে যাই। ইডো চলে গেছে। লেলিদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রও ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু অল্প কথার মানুষ ডাচদের মানবিক উষ্ণতায় সমৃদ্ধ পারিবারিক জীবনে কিছুদিনের জন্য অঙ্গীভূত হওয়ার সেই স্মৃতি আমার সারা জীবনের সম্পদ হয়ে রয়েছে।

আমার প্রায় সব ছুটিগুলি এবং তার উপরেও দুটি টার্ম ডেন হাগে কেটেছিল। সব মিলিয়ে প্রায় দু বছরের মতো। ওরই মধ্যে কয়েক সপ্তাহ প্যারিস আর কোপেনহেগেনের অভিলেখাগারে কাটিয়েছি। প্যারিসের কাজেও শ্রীমতী ইয়াপিকস-এর সাহায্য পেয়েছি। ওঁর স্বামী তখন ওখানে ডাচ অভিলেখাগারের হয়ে কাজ করছেন। আর ডেন হাগে রেইখসআর্কিফে কাজ করতে গিয়ে পেশা এবং ব্যক্তিগত জীবন দুদিক থেকেই বিশেষ মূল্যবান কিছু বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। প্রবীণ মার্কিন ঐতিহাসিক হোলডেন ফার্বার তখন প্রতি বছরই কিছুটা সময় ডেন হাগে কাটাতেন। ভারতবর্ষের প্রতি ওঁদের বিশেষ প্রীতি ছিল। হল্যান্ডে ওই প্রবীণ দম্পতির সঙ্গে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, ওঁরা যতদিন জীবিত ছিলেন তা অটুট ছিল। আর ছিলেন ডেনমার্কের গ্লামান-দম্পতি। বাণিজ্যের ইতিহাসে ক্রিস্টফ গ্লামান এক স্মরণীয় নাম। ডেনমার্কের নামকরা দুটি বিয়ার কোম্পানি কার্লসবার্গ আর টুবার্গ–ওখানকার সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত। কারণ ওদের মুনাফার বড় অংশই ডেনমার্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রাপ্য। ক্রিস্টফ ওই বিয়ার কোম্পানিগুলির ইতিহাস লেখেন এবং কালে তাদের বড়কর্তা হন। তার মানে এই তরুণ ঐতিহাসিক সাধারণ শিক্ষাব্রতীদের কাছে প্রায় অকল্পনীয় ক্ষমতা এবং সম্পদের অধিকারী হন। কিন্তু মানুষটির কোনও পরিবর্তন হয়নি। আর ছিলেন সিংহলের অরসরত্নম। নামটা ওলন্দাজ ভাষায় অনুবাদ করে ও বলত ইয়ুয়েলচ্যা বা ক্ষুদ্র রত্ন। খুদে রত্নই বটে। অনেক সুকাজ ও অকাজের সঙ্গী এই মানুষটি দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়ায় পড়িয়েছেন। অর্থনৈতিক ইতিহাসে মূল্যবান কাজ করে ক’বছর আগে অরসরত্নম লোকান্তরিত হয়েছেন। দিনের পর দিন গ্লামান আর অরসরত্নমের সঙ্গে আর্কাইভসের কাছাকাছি কোনও সস্তা কাফেতে বা তাপমান একটু বেশি হলে খালের পাড়ে বসে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা বটেরহাম ভক্ষণ করতাম। হল্যান্ডে হিসেবি তথা দরিদ্র খদ্দেরদের জন্য সস্তা কাফেতে এক সুব্যবস্থা ছিল, যার তুলনা পৃথিবীর আর কোথাও দেখিনি। বাড়ি থেকে স্যান্ডউইচ নিয়ে এসে কাফেতে বসে খাওয়া যেত। একটা স্যুপ বা বিয়ার অর্ডার দিলেই যথেষ্ট। নেট খরচা তখনকার দেশি হিসাবে আনা আষ্টেকের মতো।

১৯৫৬ সনের মাঝামাঝি শেষবারের মতো আর্কাইভসের কাজ শেষ করে অক্সফোর্ড ফিরে এলাম। পরিকল্পনা—মাস ছয়েকে থিসিসটা লিখে ফেলব। এর আগে কিছু কিছু খসড়া করে ডেভিস সাহেবকে দেখিয়েছি। কিন্তু লেখার কাজটা বেশির ভাগই বাকি। আসলে থিসিসের খসড়া ডেভিস যত্ন করে দেখতেন ঠিকই, কিন্তু বিষয়বস্তুর সঙ্গে ওঁর পরিচয় না থাকায় সত্যিতে সুপারভিশন যাকে বলে তা আমি পাইনি। তখন অক্সফোর্ডে গবেষণা করতে এসে অনেকেরই এই অভিজ্ঞতা হত। নিজের রাস্তা নিজে করে নিতে গিয়ে থিসিসের পক্ষে অতিরিক্ত লম্বা একটা সময়কাল—প্রায় নব্বই বছর—বেছে নিয়েছিলাম। এটা অনুচিত উৎসাহের পরিণাম। ফলে প্রায় তিনশো ভলম নথিপত্র দেখতে হয়। আর যতটা সময় মালমশলা সংগ্রহের জন্য দিয়েছি, বিষয়টা চিন্তা করার জন্য তুলনীয় সময় বাজেট করিনি। তাই নোটস নিয়ে যখন লিখতে বসলাম তখন দেখি তারা পরিমাণে হিমালয় না হলেও বিন্ধ্য পর্বতের কাছাকাছি পৌঁছেছে। মহাভারতে গল্প আছে যে, দ্বারকায় পৌঁছে সমুদ্র দেখে সুভদ্রার হাত-পা পেটের মধ্যে সিধিয়ে গিয়েছিল। নোটসের পরিমাণ উপলব্ধি করে আমার হাত-পা অবশ হয়ে গেল। স্কলারশিপের আর ছ’ মাস বাকি। তার মধ্যে লেখা শেষ হবে এমন কোনও সম্ভাবনা দেখলাম না। দরিয়ায় এই যে ঘোর তুফান, কোন নাইয়া এখন পার করবে? মাথায় হাত দিয়ে বসলাম। বাড়িতে চিঠি দিলাম—বেশি কিছু আশা কোরো না। ডিগ্রি না নিয়েই ফিরতে হবে। জানতাম না যে দেশে এর মধ্যে বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। আমার চিঠিটা বাবাকে দেওয়া হয়নি।

লেখা কষ্টেসৃষ্টে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোয়। দু-এক পৃষ্ঠা লিখি আর ডেভিসকে নিয়ে দেখাই। ক্রিস্টমাসের দিনটাও ভদ্রলোককে রেহাই দিই না। বিনা আপত্তিতে ভদ্রলোক সব সহ্য করেন। কিন্তু বুঝতে পারি যে উনিও বেশ চিন্তিত। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর স্ত্রীও। ছেলেটা পারবে তো? এত দূর থেকে এসেছে। অনেক সময়ই দিনেরবেলা কিছু লেখা হয় না। বেনজিড্রিন খেয়ে রাত জাগি। এইভাবে শেষ অবধি থিসিসটা প্রায় তৈরি হয়ে এল। আমার অবস্থা তখন রেসের ঘোড়ার দৌড় শেষ করার সময় দিয়ে যেমন হয় অনেকটা সেই রকম। তবে বেনজিড্রিন খেলে একটা সাময়িক উত্তেজনা হয়। পৃথিবীর রঙে একটু গোলাপি ছোপ লাগে। সে রং যে কত মারাত্মক হতে পারে তা পরে বুঝি। উপসংহার লিখছি—এমন সময় আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল। আমার সংগৃহীত আমদানি-রপ্তানির হিসাবগুলি দেখে খেয়াল হল যে, এতদিন এশিয়া আর ইউরোপের আমদানি সম্বন্ধে যা-কিছু বলা হয়েছে সবই ভুল। ফলে উপসংহারটা আগাগোড়া ফিরে লিখলাম। বরুণের সঙ্গে পাব-এ দেখা। আমার আবিষ্কারের কথাটা ওকে বললাম। আর দুদিন পরে থিসিস জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। বরুণ আমার নতুন সিদ্ধান্তের খসড়াটা দেখতে চাইল। সন্ধেবেলা খাওয়ার পর আমার ডিগসে এসে লেখাটা দেখল। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “একটা গোলমাল হয়ে গেছে। আপনি আমদানি আর রপ্তানির স্ট্যাটিস্টিকস গুলিয়ে ফেলেছেন।” পড়ে দেখি—ঠিকই ধরেছে। বেনজিড্রিনের প্রভাবে রপ্তানির স্ট্যাটিস্টিকস আমদানির আর আমদানিরটা রপ্তানির ধরে নিয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। বুঝলাম বেনজিড্রিন গঞ্জিকারই ছোট ভাই। তাই খেয়ে অত আনন্দ হত। আরও বুঝলাম—যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে চট করে পৌঁছনো ঠিক না—একটু রয়েসয়ে এগুতে হয়। এখন কী করা? বরুণ বলল, “আপনি এখন সারারাত বসে লিখুন। বেনজিড্রিন খেয়েছেন। ঘুম পাবে না। তবে আলসেমি লাগতে পারে।” বলে আমার বিছানায় ও শুয়ে পড়ল, যাতে আমার শোওয়ার কোনও উপায় না থাকে। এতে কাজ হল। সকাল নাগাদ থিসিস লেখা শেষ। পরদিন যথা সময়ে জমা দিলাম।

যথাকালে মৌখিক পরীক্ষা হয়ে গেল। পরীক্ষকরা মৃদু পিঠ চাপড়ালেন। সেদিন রাত্রে বরুশ, মার্কিনি বন্ধু ওয়েড মাক আর শ্যামলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে শহরের সব চেয়ে দামি রেস্তোরাঁ এলিজাবেথ-এ খেতে গেলাম। এমন অবিমৃশ্যকারিতা আগে কখনও করিনি। কথাটা তুলোম এই জন্য যে, কত খরচ হয়েছিল মনে আছে। মাথাপিছু এক পাউন্ড। এখন ওখানে খেতে মাথাপিছু সত্তর পাউন্ডের মতো লাগে।

তার কদিন পরে মালপত্র জাহাজে পাঠাবার ব্যবস্থা করে একটা হোল্ড-অলে কিছু জামাকাপড় ভরে নিয়ে স্থলপথে দেশে ফেরার জন্য অক্সফোর্ডকে বিদায় জানিয়ে লন্ডনের প্যাডিংটন স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। বিদায় অক্সফোর্ড। তবে চিরদিনের জন্য নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *