১৫. আবার ফিরে আসি মহর্ষিভবনে

আবার ফিরে আসি মহর্ষিভবনে। এখন অবশ্য ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। বাড়িতে রয়েছেন অনেকগুলি নাতনী আর নাতবৌ। কবির নতুন নাটকে তারা পার্ট নেবেন, ভরে দেবেন নতুনগানের ডালি। এখন আর কোন একক ভূমিকা যেন স্পষ্ট নয়। এখন সারা বাংলার মেয়েরা এগিয়ে এসেছেন নব জাগৃতির পথ বেয়ে। সেই প্রথম পায়ে চলা একহারা সরু পথটা কোথায়? সেই বুঝি পথ হারিয়েছে। রবীন্দ্রনাথও ধরলেন বেলা শেষের গান। এই শেষ বেলাকার রাগিনীর ধুয়ো ধরতে এগিয়ে এলেন আরো কয়েকজন।

সুধীন্দ্রনাথের তিনটি মেয়ে—রমা, এণা, চিত্রা। তিনজনেরই নানারকম সুকুমার কলায় দক্ষতা ছিল। যদিও কেউই সাময়িকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। রমার গানের গলা ছিল অসাধারণ। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালবাসতেন কবি স্বয়ং। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের কথায় তার দিদির গলায় এই যে কালো মাটির বাসা, না গো এই যে ধূলা আমার না এ, সাঁঝের রঙে রাঙিয়ে গেল হৃদয় গগন, সন্ধ্যা হল মা বুকে ধবো এই গানগুলো যারা কখনো শোনবার সৌভাগ্য লাভ করেছে তারা কখনো ভুলবে না। কবি বলতেন, তাঁর গান রমার গলায় যেমন রূপ নেয় এমনটি খুব কম লোকের গলাতেই নেয়। আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর গানের কোন রেকর্ড হয়নি। যারা শুনেছেন তারা বলেন সে গানে মিশে থাকত মাধুর্য আর গভীরতা।

লেখা এবং লেখানো, গান গাওয়া এবং শেখানো সবেতেই রমার উৎসাহ ছিল। অভিনয়ও করেছেন বারকতক। মায়ার খেলায় একবার কুমার আরেকবার শান্তা সেজেছিলেন রমা। দুবারই সুন্দর হয়েছিল তার অভিনয়। প্রফুল্লময়ীর আমাদের কথা হয়ত কোনদিনই শোনা যেত না, যদি না রমা থাকতেন। আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে তিনি বসতেন দিনের পর দিন বলো নদিদি বলো তোমার কথা বলে। ধীরে ধীরে খুলত স্মৃতির দুয়ার—অনেক চোখের জল মাড়িয়ে প্রফুল্লময়ী এই নাতনীর আবদারেই ফিরে যেতেন নিজের কৈশোরে। এ কি কম কৃতিত্ব! নিজেও লিখতেন রমা। শান্তিনিকেতনে বেরোত মেয়েদের কাগজ শ্রেয়সী। তাতে তিনি দু-একটা ইংরেজী গল্প স্বচ্ছন্দ অথচ সাধু ভাষায় অনুবাদ করেছেন। স্নেহলতা দেবীর একটা গল্প সাপুড়ের গল্প নামে অনুবাদ করেন রমা। ইন্দিরার ভারি ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনাথের নারী সংক্রান্ত রচনাগুলি একত্র করবার। বলেছেন একে তাকে, কেউ যদি সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্য অনুসন্ধান করে মেয়েদের সম্বন্ধে কোথায় কি তিনি লিখেছেন তা একত্র করে প্রকাশ করতে পারেন তবে মস্ত একটা কাজ হয়। সেই ভার নিয়েছিলেন রমা। রবীন্দ্র সাহিত্যে নারীর স্থাকোথায় তাই দেখার জন্যে। শ্রেয়সীর কয়েকটা সংখ্যায় রবীন্দ্র সাহিত্যে নারী নাম দিয়ে অনেক রচনা সংকলনও করেন। তবে সময়ের অভাবে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি।

শেষ জীবনে তার মন ঝুকেছিল তথাগতের আদর্শের প্রতি। কিছু মানসিক অশান্তি তাকে আরো ঠেলে দিয়েছিল মহাবোধি সোসাইটির দিকে। পারিবারিক ট্র্যাডিশন অনুযায়ী তিনি একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাগবাজারে। নাম সাবিত্রী শিক্ষালয়। ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলে অনেক পরিশ্রম করে তিনি এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেন লেখিকা প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, পরে সেখান থেকেও নীরবে সরে এসেছিলেন রমা। নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন মহাবোধি সোসাইটির সৌম্য-শান্ত বুদ্ধদেবের চরণতলে। সেখানে তিনি একটি রচনা সংকলন প্রকাশ করেন লর্ড বুদ্ধ এ্যাণ্ড হিজ মেসেজ নামে। তাতে তার নিজের লেখা না থাকলেও তিনি সংগ্রহ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, ইন্দিরা, অসিত হালদার, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের রচনা। রমার শেষ জীবনের কথা বলেছিলেন তার মেজো বোন এণা। দিদির লেখা-আঁকা সযত্নে তিনি রেখে দিয়েছিলেন। জিনিষ হারায় না, মানুষ হারায়। তাই ভাইবোনদের মধ্যে এখন তাদের এক বোন ছাড়া কেউ নেই। দিদির মতো গাইতে না পারলেও এণা শিখেছিলেন বাঁশী আর সেতার বাজাতে। বিচিত্রায় যে ট্যাবলো অভিনীত হত তাতে এণাও যোগ দিতেন। একবার সেজেছিলেন শকুন্তলা। এণা বিয়ে করেছিলেন রাজেচন্দ্র রায়কে। বিয়ের ব্যাপারে ঠাকুরবাড়ির ট্র্যাডিশন ভেঙেছিলেন তিনিই। তাই পরিণয়ে প্রগতির লেখিকা শৈলসুতা দেবী তার গ্রন্থে এই বিয়ের কথা বর্ণনা করেছেন। আধুনিক সমাজকে ব্যঙ্গ করে প্রগতিশীলদের নিয়ে লেখা অনেকের কথাই পরিণয়ে প্রগতিতে আছে! লেখিকা এণা ও রাজেন্দ্রের প্রসঙ্গে বইয়ের ২১৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন :

এণা দেবী জোড়াসাঁকো ঠাকুর-বংশের কন্যা। মিঃ আর. সি. রায়ের পূর্বপুরুষরা হিন্দু ছিলেন, জাতিতে তারা বৈদ্য। মিঃ রায়ের পিতা গোপাল রায় খ্রস্টধর্মে আস্থাবান …এ বিদুষী ও গুণবতী। তাহার সহিত পরিচয় লাভে আর. সি. রায় মুগ্ধ হইলেন; এণও তাঁহার প্রতি অনুরাগিনী হইয়া পড়িলেন। দুজনে বিবাহ সম্বন্ধে পরামর্শ হইল—এই স্থির হইল যে ধর্মগত বিভেদের জন্য তাহারা পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিবেন না। বিবাহে আবদ্ধ হইয়াও নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস বজায় রাখিবেন।

বিয়ের পর এ চলে গিয়েছিলেন ঢাকায়, একেবারে ভিন্ন পরিবেশে। সেখানেও যে অনুকূল পরিবেশ ছিল না তা নয়, তবু এণ ইচ্ছে করেই হাই সোসাইটির কেন্দ্রমণি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি। ঘরের মধ্যে ছোট্ট একটা সুখের সংসার গড়তেই তার ভাল লেগেছিল। তার মেয়ে কৃষ্ণা বর্তমানে ফ্রান্সে নানারকম সাংস্কৃতিক কাজে-কর্মে জড়িয়ে আছেন।

 

সুধীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে চিত্রা কিছুদিন ছিলেন শান্তিনিকেতনে। নাচ-গান অভিনয়ের ধারা মিশেছিল তার রক্তে তাই খুব সহজেই তিনি এ তিনটি জিনিষ আয়ত্ত করে ফেললেন। বিশেষ করে নাচে তাঁর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেল। শান্তিনিকেতনে প্রতিমার পরিকল্পনা মতো নাচ শেখানো তখন সবে শুরু হয়েছে। নৃত্যশিক্ষক হিসেবে এসেছেন মণিপুরী শিক্ষক নবকুমার। অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যে তিনটি মেয়ে এ সময় নাচ শেখেন তারা হলেন চিত্রা, নন্দিতা ও নন্দিনী। অন্য মেয়েদের মধ্যে ছিলেন শ্রীমতী হাতিসিং, গৌরী ব, নিবেদিতা দেবী, অমিত চক্রবর্তী, মালতী সেন, উমা দেবী, অমল রায় চৌধুরী, যমুনা দেবী এবং আরো অনেকে। এঁদের মধ্যে শ্ৰীমতী ও অমিতা পরে ঠাকুরবাড়ির বৌ হয়েছিলেন। চিত্রা নাচের দলে ছিলেন ট্র্যাডিশন ভাঙার সময়। ঠাকুরবাড়ির উঠোনে প্রথম যে নৃত্যানুষ্ঠান হয় তাতে নেচেছিলেন চিত্রা ও নন্দিতা। তারপর নেচেছিলেন ঋতুরঙ্গে সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে গানটির সঙ্গে। নিউ এম্পায়ারে সরলাদেবীর পরিচালনায় যে মায়ার খেলার অভিনয় হয় চিত্রা তাতে সেজেছিলেন মায়াকুমারী। আলোড়ন জাগিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালের ১৮ অগাস্টের The Englishman জানিয়েছে,…an entirely novel Indian dance by Miss Chitra Tagore and another by Miss Reba Roy…were greatly appreciated by the larger audience.

Forward কাগজের প্রতিনিধিও অনুরূপ কথাই লিখেছেন, The Dances forined a salient feature of the play. It was a sheer delight to watch Sm. Reba Ray and Sm, Chitra in their movements. In the magic of Chitras feet was revealed the enchantment of first love.

সরলাদেবীর মায়ার খেলা হয়ে যাবার কয়েকদিন পরে ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের উদ্যোগে আরেকবার মায়ার খেলা হয়। এই অনুষ্ঠানে চিত্রা পরিবেশন করেছিলেন একটি স্বতন্ত্র জাপানী নৃত্য। Forward কাগজের প্রতিনিধি ১৯২৭-এর ১৩ সেপ্টেম্বর পুনরায় লিখেছেন :

Srimati Chitra, who excelled in her Japanese dayce, came in for the largest share of the claps. Her quick and jumpy steps, though an adaptation from the west, seemed to have a fascination all their own.

শুধু নৃত্য নয়, অভিনয়েও চিত্রা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। নটির পূজায় তিনি সেজেছিলেন বাসবী। তপতী নাটকে নিয়েছিলেন মঞ্জরীর ভূমিকা। এই নাটকের গানের দলেও গান গাইতেন তিনি। এর পরেও অন্যান্য অনুষ্ঠানে চিত্রা যোগ দিয়েছেন। চিরকুমার সভার অভিনয়ে নৃপবালা সেজে অবাক করে দিয়েছেন সবাইকে কিন্তু পরে খুব বেশি অনুষ্ঠানে তিনি আর যোগ দেননি।

 

অরুণেন্দ্রনাথের তিনি মেয়ের কথাও এ প্রসঙ্গে সেরে নেওয়া যেতে পারে। ললিতা (লতিকা), সাগরিকা ও কণিকা তিনজনেই ছিলেন সহজ, সরল এবং সাংসারিক। অত্যন্ত হাসিখুশি আমুদে ললিতা ও তার স্বামী জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়া গোড়ায় গলদ নাটকে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। ক্ষান্তমণি। সেজেছিলেন ললিতা, যেন বইয়ের পাতা থেকে সশরীরে আবির্ভূত হয়েছিল ক্ষান্তমণি। ললিতার ছোট বোন কণিকাও ভাল অভিনয় করতেন। তিনি ও তার দিদি সাগরিকা দুজনেই খুব পড়তে ভালবাসতেন। যদিও ডিগ্রী-ডিপ্লোমা নেবার কোন রকম ঝোঁক এঁদেরও ছিল না। গান শিখেছিলেন, কণিক। সেতারও বাজাতে পারতেন। সাগরিকাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রথম মেয়ে, যিনি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। তার আগে রবীন্দ্রনাথের মেয়েরা ছাড়া ঠাকুরবাড়ির কোন মেয়েই শান্তিনিকেতনে যাননি। কণিকার অভিনয়ের কথা আগেই বলেছি। তিনি লেখা-পড়া, গানবাজনা, ইংরেজীতে কথা বলা, অভিনয় করা সবই শিখেছিলেন। গোড়ায় গলদে সেজেছিলেন ইন্দুমতী। চিরকুমার সভায় নীরবালা, নীরবালাকে হাসি-গানে-অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলা কঠিন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন কণিকার অভিনয়ে প্রাণ পেয়েছিল নীরবালা। কিন্তু দ্বিজেন্দ্র পরিবারের ধারা অনুযায়ী কোন মেয়েই বাইরে ছড়িয়ে পড়েননি।

 

সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই মেয়ে মঞ্জুশ্রী ও জয়শ্রীর মধ্যে মঞ্জুশ্রী কবির সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন বেশি। শান্তিনিকেতনের ছোট ছোট অনুষ্ঠানেই তাঁর গান এবং অভিনয় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অসামান্য সুকণ্ঠের অধিকারিণী মঞ্জুশ্ৰ৷ আরো একটি দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারিণী। বিসর্জন নাটকের একটি অভিনয়ে তিনি কবির সঙ্গে অভিনয় করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেজেছিলেন জয়সিংহ। বৃদ্ধ হয়েও অসামান্য প্রতিভার সাহায্যে তিনি রূপায়িত করেছিলেন পূর্ণ যুবক জয়সিংহকে। অপর্ণা হয়েছিলেন রানু অধিকারী কিন্তু তিন দিনের অভিনয়ের একদিন তিনি অভিনয় করতে পারেননি। তাই সেদিন কবির একান্ত আগ্রহেই অপর্ণার ভূমিকায় অভিনয় করতে সম্মত হন মঞ্জুশ্রী। সুন্দর হয়েছিল সে অভিনয়। অভিনয়ে মঞ্জুশ্রীর মা সংজ্ঞাও অভিনয় করেছিলেন। তিনি সেজেছিলেন গুণবতী কিন্তু দুদিন অভিনয় করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তৃতীয় অভিনয়ে পুনরায় মঞ্জুশ্রীকেই নিতে হয়েছিল গুণবতীর ভূমিকা। পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না, দুটি ভিন্নধর্মী চরিত্রকে পর পর দুটি রাত্রে দর্শকদের সামনে সার্থকভাবে উপস্থিত করাও খুব সহজ নয়। দর্শকরাও ঘরের মানুষ ছিলেন না, ছিল না শান্তিনিকেতনের ঘরোয়া আসর তবু কোন অসুবিধেই হয়নি। এমনিই সহজ সাবলীল ছিল মঞ্জুশ্রীর অভিনয়। তার অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় আরেকবার পাওয়া যায় ভৈরবের বলি নাটকের অভিনয়ে। রবীন্দ্রনাথ রাজা ও রাণীকে নতুন রূপ দিলেন ভৈরবের বলিতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ১৯২৯ সালে দুদিন অভিনয়ের আয়োজনও হয়! মঞ্জুশ্রী রাণী সুমিত্রার ভূমিকায় খুব ভাল অভিনয় করেন। এই ভূমিকাতেই প্রথম অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন মঞ্জুশ্রীর পিতামহী জ্ঞানদানন্দিনী। রাজার ভূমিকা গ্রহণ করেন মঞ্জুশ্রীর স্বামী ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। এ সময় রবীন্দ্রনাথ বিদেশ সফরে যাত্রা করায় তার আর দেখা হয়ে ওঠেনি। একবার মঞ্জুশ্ৰীও কবির সঙ্গে যুরোপ-ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তারপর লণ্ডনের একটি বোর্ডিং হাউসে বছর খানেক থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন।

পরবর্তী জীবনে মঞ্জু ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর স্বামী ক্ষিতীশপ্রসাদ ছিলেন কংগ্রেসের অন্যতম নেতা, অসহযোগ আন্দোলনের উদ্যোক্তা। কিন্তু মঞ্জুশ্রী প্রখর রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেননি, দিয়েছিলেন সহানুভূতি ও সমবেদনার দুর্বার আবেগে। এই সমবেদনাই তাকে টেনে এনেছিল কম্যুনিস্ট পার্টিতে।

১৩৫০-এর ভয়াবহ মন্বন্তরের সময় মঞ্জুশ্রী রয়েছেন কৃষ্ণনগরে। দুর্ভিক্ষের আঁচে ঝলসে যাওয়া কলকাতার খবর তার অজানা। হঠাৎ কি করে যেন হাতে এসে পড়ল একটা কম্যুনিস্টপন্থী পত্রিকা। আলতোভাবে চোখ বোলাতে গিয়ে শিউরে উঠলেন একটা প্রবন্ধ পড়ে। উঃ কী ভয়ঙ্কর! প্রবন্ধটি হল সোমনাথ লাহিড়ীর tieties of Death in Calcutta. পড়ার পর দু চোখ জলে ভরে গেল। অনাহারে অনুশোচনায় বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে মনস্থির করে ফেললেন মঞ্জুশ্রী। কিছু করতেই হবে। এদের জন্যে কিছু করতেই হবে। পরদিনই কলকাতায় ফিরে এসে স্বামীর সাহায্যে কিছু অর্থসংগ্রহ করে ফেললেন। আত্মীয়স্বজনেরাও মঞ্জুশ্রীর ঝুলি ভরে দিলেন সাধ্যমতো। মঞ্জু শ্ৰ সংগৃহীত অর্থ নিয়ে ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের পরামর্শ মতো কিছু ওষুধপত্র কিনে নিয়ে ফিরে গেলেন কৃষ্ণনগরে। মহামারী দূর করবার জন্যে বাড়িতেই খুলে ফেললেন রিলিফ সেন্টার। এসময় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল স্থানীয় কমুনিস্ট পার্টির সদস্যরাও। তখনও পার্টির কোন মহিলা-সমিতি গড়ে ওঠেনি। মঞ্জুশ্রীই কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন মহিলা আত্মরক্ষা-সমিতি। এই সমিতিরই মুখপাত্র ছিল ঘরে বাইরে। সম্পাদিকাও মঞ্জুশ্রী নিজেই। সমিতির উদ্দেশ্য ছিল, যে সব মেয়েরা সমাজসংসার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পায়নি তাদের সঙ্গত অধিকার দাবি করা। তিনি দেখেছিলেন সাধারণত এই ধরনের প্রতিষ্ঠাহীন মেয়েরাই বঞ্চিত হয় সব রকম অধিকার থেকে। তাই তাদের জন্যেই তিনি সংগ্রাম শুরু করেছিলেন :

আত্মরক্ষা সমিতি সেই মেয়েদেরই প্রতিষ্ঠান, যারা সমাজে, সংসারে, অর্থনীতি আর রাজনীতি ক্ষেত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠা পায় না কোনদিন, বঞ্চিত হয় সকল রকম অধিকার থেকেই। এই মেয়েদের সঙ্গত অধিকারের দাবি নিয়েই আত্মরক্ষা সমিতির আন্দোলন। যে সমাজ এবং শাসনব্যবস্থা নারীর শক্তিকে করে অপচয়, বঞ্চিত করে তাকে মানুষের অধিকার থেকে—সে ব্যবস্থাকে সুশাসক বা সুবিচার বলে মেনে নেয়নি আত্মরক্ষা সমিতি, নেবেও না কোনদিন। এই বঞ্চিত মানুষের কথাকেই ঘরে বাইরে পৌঁছে দেবে ঘরে ঘরে।

চার পাঁচ সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর ঘরে বাইরে প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। মঞ্জুশ্র আর একটা পত্রিকা প্রকাশ করেন জয়া নামে কিন্তু ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমুনিস্ট পার্টি ভারতে নিষিদ্ধ হলে বঙ্গীয় সরকার পত্রিকাটির প্রচার বন্ধ করে দেন। এই ঘটনার মাসখানেক আগেই মঞ্জুশ্রী মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাই সকলের সঙ্গে তিনিও কারারুদ্ধ হন। সঙ্গে ছিলেন মণিকুন্তলা সেন ও আরো অনেকে। সমস্ত কমুনিস্ট কর্মীরা এ সময় অনশন আরম্ভ করেন। প্রথমে পুরুষেরা এবং পাঁচ দিন পরে মহিলারা এই অনশনে যোগ দিয়েছিলেন। মঞ্জুশ্রীও অন্যান্যদের সঙ্গে একটানা অনশন করেছিলেন একান্ন দিন। তার বয়সের কথা বিবেচনা করে সকলেই তাকে বারণ করেন কিন্তু কোন নিষেধই তাকে টলাতে পারেনি। প্রায় একবছর কারাবাস করার পর ১৯৫১ সালে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে মঞ্জুশ্রী মুক্তি পান। এর পরে তিনি আর রাজনীতির সঙ্গে বিশেষ যোগ রাখেননি তবে ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে চীন যাত্রা করেন The First Asian and Pacific Peace Conference-a catat catata জন্যে। এই দলে ছিলেন সয়ীফুদ্দীন কিচলু, ডাঃ জ্ঞানদ প্রমুখ অনেকে। মঞ্জুশ্রকে তারাই নির্বাচন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাতনী হিসেবে।

অবশ্য চীনে গিয়ে মঞ্জুশ্রী সেখানকার রাজনৈতিক বা সামাজিক জীবনের সঙ্গে খুব বেশি পরিচয় লাভের সুযোগ পাননি, তবে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ক্যান্টন রেল স্টেশনের একটি সামান্য কুলিকে তন্ময় হয়ে লু সুনের গল্প পড়তে দেখে। একজন সাধারণ শ্রমিকের এই সাহিত্যপ্রীতি তার চোখে নতুন লেগেছিল, ভালও লেগেছিল। কোন সম্মেলনের প্রতিনিধি হয়ে কোথাও গিয়ে তো আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেশ দেখা যায় না তবু যা দেখেছিলেন তাই নিয়েই পরে লিখেছিলেন একটি গ্রন্থ নয়াচীনে যা দেখেছি। সে বইও এখন পাওয়া যায় না, ধূসর স্মৃতির ধূলো মাড়িয়ে আর অতীতে ফিরে যেতে চান না মঞ্জুশ্রী নিজেও।

 

জয়শ্রী আত্মপ্রকাশে বড়ই অনিচ্ছুক। ছোটবেলায় দিদির সঙ্গে তিনিও বিলেতে একসঙ্গে লেখাপড়া শিখেছেন, কোন কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, একবার বিসর্জনে সেজেছিলেন সরস্বতী। কিন্তু বড় হয়ে আর সে সব নিয়ে বিশেষ মেতে ওঠেননি। একবার ঋতুরাজ সেজেছিলেন ঋতুরঙ্গে, পেছন থেকে গান করেছিলেন সাহানা দেবী। জয়শ্রীর বিয়ে হয়েছিল কুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গে। অসবর্ণ বিবাহ। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী বাধা এসেছিল, আপত্তিও উঠেছিল। সুরেন্দ্রনাথ শোনেননি। বলেছিলেন, আমরা সকলেই যখন উচ্চ কণ্ঠে প্রচার করে আসছি যে দেশমাতা এক, আমরা সকলেই তার সন্তান, তখন মেয়ে অন্য জাতে বিয়ে করবার ইচ্ছে প্রকাশ করলে কোন্ মুখে আপত্তি করব? আমাদের বাপ-দাদা তাদের পূর্বপুরুষের প্রচলিত পথের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, আমরা আবার বাপ-দাদার প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে যাচ্ছি, সুতরাং তাদের অনুরূপ কাজই করছি। এই বিবাহে পৌরোহিত্য করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। অসবর্ণ বিয়ে হলেও এখানে রেজিস্ট্রি করার কথা ওঠেনি।

 

হেমেন্দ্রনাথের চারজন পৌত্রী—গায়ত্রী, মেধা, গার্গী ও বাণীর মধ্যে বাণী সঙ্গীতের জগতে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এই বাড়িতে নিরন্তর যে সঙ্গীতের স্রোত বয়ে চলেছিল বাণী তার যথার্থ উত্তরাধিকারিণী। অবশ্য হেমেন্দ্র-পরিবারের আরো দুটি বৌ-অমিয় ও মেনকাও গানের জগতে সুপরিচিত। কিন্তু সে শুধু সঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে। বাণী গানের সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা করেছেন সঙ্গীতশাস্ত্রের। তারা চার বোনই দেশী-বিলিতি বহু গান শিখেছিলেন। গায়ত্রী ও মেধা হিতেন্দ্রনাথের মেয়ে আর গার্গী ও বাণী ক্ষিতীন্দ্রনাথের মেয়ে। প্রথম তিন জনকে আমরা সংসার-জীবনের বাইরে খুব বেশী দেখতে পাইনি। গান গাওয়া, পিয়ানো বাজানো, কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দেওয়া, স্কুলে এবং কলেজে পড়া—ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এ সবই ছিল তাদের জীবনে। গায়ত্রী খুব ভাল পিয়ানো বাজাতে পারতেন। মেধার গানের গলাটিও ছিল চমৎকার। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ অনেক হিন্দী গান শুনতেন, সেই সব গান ভেঙে নতুন গান তৈরি হত। তার মুখে অব তো মেরে কাণ শুনে কবি কার বাঁশি নিশিভোরে বাজিল রে গানটি তৈরি করেন। মেধা সেই গানটি গেয়েছিলেন শেষ বর্ষণের অভিনয়ের সময়। তার স্বভাবটি ছিল সলজ্জ-মধুর, কমনীয়। আত্মপ্রকাশে উৎসাহ ছিল না বলে একরকম চোখের আড়ালেই রয়ে গেলেন তিনি, তাঁর গানের সঙ্গেও সকলের পরিচয় ঘটল না। তিনি গান শিখেছিলেন গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। গার্গীও গান। জানতেন। কারুর গান শুনলেই সেটা তুলে নিতে পারতেন। ঘর-সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি মাঝে মাঝে হাতে লেখা কিশলয় পত্রিকায় দুটোএকটা লিখেওছেন। তবে সে সব পত্রিকা এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না।

বাণী স্বতন্ত্র প্রতিভার অধিকারিণী। ডক্টর বাণী চ্যাটার্জী নামে তিনি স্বদেশে যত পরিচিত বিদেশেও তাই। বিদেশীদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগে প্রধান বাধা ভাষা। তাই বাণী হাত দিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুবাদের কাজে। কবির সুর ও ছন্দকে বজায় রেখে তিনি যে গানগুলির অনুবাদ করেছেন সেগুলি বিদেশে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বাণীর কম্পােজ করা আনন্দলোকে মঙ্গলালোকের অনুবাদ In the realms of joy and good যিনি শুনেছেন তিনিই এর গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। কবি নিজেও চেয়েছিলেন বাণীর কম্পােজ করা গান শুনতে। বাণীর কম্পােজ করা জয় ভারতের জয় গানের প্রশংসা শুনে কবির ইচ্ছে ছিল তার জনগণমন অধিনায়ক জয় হে গানটিকেও ওয়েস্টার্ন হারমনিতে পরিণত করবার জন্য বাণীকেই অনুরোধ জানাবার। সে, আর হয়ে ওঠেনি। এখন তো সেই জনগণমনের একটা স্তবক জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। অথচ বাণীর বেশ মনে পড়ে, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে সময় সংক্ষেপ করার জন্যে জনগণমনের কিছু অংশ বাদ দিয়ে গাওয়ার অনুমতি চাওয়া হলে কবি সম্মত হননি। তাই গোটা গানটাই গাওয়া হয়। ঐ গানের দলে ছিলেন বাণী।

বাণীর সঙ্গীতের জ্ঞান সহজাত। তাই সুরসৃষ্টি করা ছাড়াও বাণী মন দিয়েছিলেন একটা নতুন কাজে। তিনি সঙ্গীতশাস্ত্র ও সঙ্গীতবিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় তো ছিলই, স্বামী ডঃ শচীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিদেশে গিয়ে সে পরিচয় আরো পাকা করে এলেন। এরপর তিনি কতকটা আপন মনেই মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সঙ্গীতকে বিচার করতে বসেন। জিনিষটা একেবারেই নতুন। পরে তার আলোচনা সমাদর লাভ করে ও তিনি এসিয়াটিক সোসাইটি থেকে বেশ কয়েকটা বক্তৃতা দেবার জন্যে আমন্ত্রিত হন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তার বিষয়টা কি ছিল। কোন একটা বিষয় নয় অবশ্য। বাণী সঙ্গীতকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করবার চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় এবং য়ুরোপীয় উভয় সঙ্গীতের প্রভাবে মনস্তাত্ত্বিক কিংবা অন্য কোন পরিবর্তন বাস্তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সত্যিই কি সম্ভব? বাণীর প্রশ্ন এটাই। উত্তর দেবার চেষ্টাও করেছেন তিনি। আমরা সব সময় শুনে থাকি গানের মতো শক্তিশালী প্রভাবশালী জিনিষ আর নেই। গানে পাষাণ গলে, বনের পশু বশ হয়। মানুষের মন? সে তো না বদলালে পাষাণকেও হার মানায়। প্রশ্ন, সত্যি সত্যি এই পরিবর্তন সম্ভব কি না? তা যদি হয় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে তার বিচার বিশ্লেষণ করা যায় কি না। না গেলে ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞরা এক একটা রাগ ও রাগিণীর মানবায়িত রূপ দিলেন কি করে? কি করে বললেন দীপক রাগে আগুন জ্বলে, মেঘ রাগ বৃষ্টি নামায়। বাণীর মতে গানের শব্দ হাওয়াতে যে কম্পন সৃষ্টি করে তারই সাহায্যে নানারকম পরিবর্তন সম্ভব হয়। ভারতের সঙ্গীতশিল্পীরা এর সন্ধান রাখতেন এবং এর সাহায্যে গড়ে উঠেছিল রাগ দর্শন :

This encourages tis to look forward confidently for the time when the truths underlying the science of Raga-Music should be further unearthed and extricated by scientists from the leap of accuinulated debris of iguorance and colourful iuter polationis perhaps, the hieroglyphics of the Raga-Music deciphered and the subline philosophy of the Raga-Music, in all its purity, to its pristine glory restored.

বাণীর মতে প্রাচ্য বিজ্ঞানের একটা বিরাট সম্ভাবনাময় দিক লুকিয়ে আছে ভারতীয় সঙ্গীতের রাগরাগিণীর মধ্যে। রাগসঙ্গীতের চর্চা এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে হয়ত সেই সম্ভাবনার স্বর্ণদুয়ার খুলে যেতেও পারে। এ নিয়ে বিতর্ক নিশ্চয় আছে। তবু পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের জার্নালে বাণীর কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধের কিছু অংশ ছাপা হয়। অবশ্য তার আগেই তিনি য়ুরোপ সফর করবার সময় এসব বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার বক্তৃতার প্রধান বিষয় ছিল, সাইকোলজি অ্যান্ড মিউজিক (১৯৩৪), সাইকো-মিউজিক ইন্ ওয়ার অ্যাণ্ড আফটার (১৯৪৪) ও মিউজিক ইন্ বেসিক এডুকেশন সাইকোলজি (১৯৪৯)। পাশের সালগুলো অবশ্য পুস্তিকা প্রকাশের সময়, বক্তৃতাও দিয়েছিলেন এ সময়েই বা একটু আগে।

এখানকার এসিয়াটিক সোসাইটিতে আরো কয়েকটা বক্তৃতার হদিশ মেলে, ভাইভারসনাল থেরাপি অ্যামিউজিক, টেগোর অ্যাণ্ড মিউজিক, এ্যাপলায়েড মিউজিক, কালচারাল কনট্যাক্ট অ্যাণ্ড মিউজিক, দি ভেদিক সঙস অ্যাণ্ড দি টেগোর, ওয়েস্টার্ন মিউজিক অ্যাণ্ড রাগরাগিণীজ, দি ওয়েস্ট অ্যাণ্ড দি ইস্ট ইন মিউজিক দে মীট, ইডিয়ান্ মিউজিক অ্যাণ্ড সিলটেইনিয়াস হারমনি ও কপ্যারেটিভ স্টাডিজ অব মিউজিক।

শেষোক্ত বিষয় নিয়ে বাণী গবেষণা করছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতে ভারতীয় রাগরাগিণীর প্রভাব খুঁজছিলেন। মানুষের মধ্যে, মানব প্রবৃত্তির মধ্যে যদি সাদৃশ্য থাকে তবে গানে কেন থাকবে না? ভাষাহীন সুরেই তো দুটি ধারার সাদৃশ্য থাকার কথা। তিনি দেখেছিলেন ভারতীয় সঙ্গীতের মধ্যেও আছে Harmony যা একান্ত ভাবে বিদেশী বলেই পরিচিত। শেষ জীবনে বাণী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের তুলনামূলক ইতিহাস লিখছিলেন কিন্তু সে আর শেষ হয়ে উঠল না।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুবাদের কাজে বাণী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের বহু গান তিনি অনুবাদ করেছেন সুরের সঙ্গে, ছন্দের সঙ্গে, ভাবের সঙ্গে কথা মিলিয়ে। তাঁর অনুবাদ করা গানই বিদেশীদের আকৃষ্ট করে সবচেয়ে বেশি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এসিয়-ভাষাবিভাগের অধ্যাপক এডোয়াড ডিমক বাণীর অনুবাদ করা গান শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে একটা অভিনন্দনপত্র পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠিটি পড়লে বোঝা যায় বাণীর কাজের গুরুত্ব কতখানি। তিনি জানিয়েছেন, সমস্ত পৃথিবীর মানুষই এতে উপকৃত হবেন কারণ রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান সম্বন্ধে এঁদের কোন স্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠতে পারেনি। একটু বড় হয়ে গেলেও ডিমকের পত্রাংশ অনুসরণ করা যাক :

This is just a note to express appreciation for the work you are doing in translating Rabindranaths song into English. In the first place, anything at all that is done to make the work of that genius more knowu to the nonBengali-speaking people of the world is that much to the good. Your work, however, goes one step farther. The world seems to have some idea, however, vague, of Rabindranaths greatness as a poet, and perhaps somewhat less, of his greatness as a novelist. But as far as I know, there is very little idea of how very many facets his creative had. He seems to be very little known outside Bengal, for example, as a lyricist and musician, even though he towers, as high in these fields as in the others.

This gap you will be helping to fill by giving the English-speaking world the opportunity to hear Rabindranaths words in translation, sung to his original music. It seems to me a unique and wonderful thing. I am looking forward very much to the publication of your book, but even more to the first performance of the music. For, as you have showu, songs are ineant to be sung and heard and not read. I am grateful to you for your work, and when your work becomes known, I will not be alone.

 

প্রতিমার নৃত্যশিক্ষার স্কুলের সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্ন বোধহয় নন্দিতা। রবীন্দ্রনাথের একমাত্র দৌহিত্রী, মীরার মেয়ে বুড়ি বা নন্দিতা। যদিও দৌহিত্রীদের সবাইকে ঠিক ঠাকুরবাড়ির মেয়ে বলা যায় না তবে নন্দিতার কথা স্বতন্ত্র। তিনি শান্তিনিকেতনের উৎসবের সঙ্গে প্রথম থেকেই জড়িয়ে আছেন। নৃত্য নিয়ে কবির নবনিরীক্ষায় তিনি প্রথম থেকেই যোগ দিয়েছিলেন সানন্দে। ১৯৩৬ সালে চিত্রাঙ্গদার তোড়জোড় শেষ হলে নন্দিতা মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন সুরূপা চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায়। অবশ্য নাচের পরিকল্পনা চলছিল বর্ষামঙ্গল, ঋতুরঙ্গের সময় থেকেই। শান্তিদেব ঘোষের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ১৯৩৬ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চিত্রাঙ্গদা অভিনীত হয়েছিল চল্লিশবার। প্রথমবার কলকাতা থেকে পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন শহরে নাচের দল নিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি সব সময়ে মঞ্চে স্বয়ং উপস্থিত থাকতেন। ফলে নৃত্যানুষ্ঠানকে কেউ অবজ্ঞা করতে পারত না। পাটনা, দিল্লী, এলাহাবাদ, লাহোর, মীরাট, লক্ষে—সর্বত্র চিত্রাঙ্গদা দারুণভাবে সফল হল। দলের সকলের অভিনয়ই সুন্দর। নন্দিতা সব সময়ই সাজতেন সুরূপা। তবে অন্যান্য ভূমিকাগুলিও তাঁরা সকলেই জানতেন। একদিন দেখা গেল যমুনাদেবীর জর। সর্বনাশ! কুরূপ কে সাজবেন, একা নন্দিতাই দুজনের কাজ চালিয়ে দিলেন অবলীলায়! এর উল্টোটাও মাঝে মাঝে ঘটত।

চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে আরো কটি নৃত্যনাট্য তৈরি করা হল—চণ্ডালিকা, শ্যামা ও তাসের দেশ। প্রতিটিতেই নন্দিতার প্রধান ভূমিকা, অনবদ্য অভিনয়। তার অপূর্ব দেহমুদ্রা ও ভাবব্যঞ্জনায় প্রতিটি চরিত্রই যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। আরো কয়েকজনের নামও করা যায়। মটীর পূজায় শ্ৰীমতীর ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন গৌরী বস্তু। একক নৃত্যাভিনয়ে খ্যাতি অর্জন করেন শ্রীমতী হাতিসিৎ। রবীন্দ্রনাথ চণ্ডালিকার রূপ দেবার সময় শ্ৰীমতী ও নন্দিতার কথাই ভেবেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত শ্ৰীমতী চণ্ডালিকায় অভিনয় করেননি। নন্দিতা অবশ্য চণ্ডালিকা ও তাসের দেশ দুটিতেই অভিনয় করেন। তাদের দেশে তার ভূমিকা ছিল হরতনীর, শুধু প্রথম অভিনয়ে তিনি দিয়েছিলেন চিড়েতনীর রূপ। নাতনী মঞ্চে নামলে কধিও স্বস্তি পেতেন। তাই সময়-অসময়ে ডাক পড়ত তার। কবি লিখতেন মীরাকে :

…বিপদে পড়েছি। হঠাৎ সংবাদ পেয়েছি, এক ঝাক জাপানী আসবেআমাদের নাচের পরীক্ষার জন্য।…বুড়িকে না পেলে এমন একটা লোক-হাসানো ব্যাপার হবে যা সমুদ্র পার হয়ে যাবে।

নন্দিতাও এসেছেন। যখনই ডাক পড়েছে সাড়া দিয়েছেন। অপরিসীম প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ ছিলেন তিনি। শান্তিনিকেতনে থাকলে সব রকম অনুষ্ঠানেই যোগ দিতে ভালবাসতেন। আরেকবার ঠিক হল অরূপরতন অভিনীত হবে। সুরঙ্গমা কে সাজবে? কবির ইচ্ছে ছিল তিনি নিজেই নেবেন সুরঙ্গমার পার্ট কিন্তু অন্যেরা তাতে রাজী না হওয়ায় বাধ্য হয়েই পাটটা দিলেন নাতনীকে। আর সুদর্শনা সাজলেন অমিতা।

একটু আগেই বলেছি, কবি জয়শ্রীর অসবর্ণ বিবাহ সমর্থন করেছিলেন। নন্দিতার ক্ষেত্রে তাকে আরো উদার হতে দেখা গেল। কৃষ্ণ কৃপালনী যখন তার কাছে নন্দিতার পাণিপ্রার্থনা করলেন তখন অনুমতি দিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেননি রবীন্দ্রনাথ। বিস্মিত হয়েছিলেন কৃপালনী স্বয়ং। তিনি বাঙালী বা ব্রাহ্মণ বা ব্রাহ্ম কিছুই নন তবু কবির সানন্দ সমর্থন তাকে অভিভূত করে দিয়েছিল। কবি বিয়েতে নাতনীকে উপহার দিলেন পত্রপুট, নবজীবনের মাধুর্য থাকবে যার কাণায় কাণায় ভরে। বিয়ের পরেও নন্দিতা ছিলেন কবির খুব কাছে। দারুণ অসুখের সময় নন্দিতা অন্যান্য শুশ্ৰষাকারিণীদের সঙ্গে সমানে সেবা করেছেন দাদামশাইকে। প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত এক নাগাড়ে সেবা করতেন নন্দিতী, অমিতা থাকতেন তার সঙ্গে। অমিতার এখনো মনে হয়, সেবাশুশ্রুষা করবার ও পরিশ্রম করবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল নন্দিতার। কবিও যেন সেই সেবার মধ্যে পেয়েছেন সান্ত্বনা :

দিদিমণি–
অফুরান সান্ত্বনার খনি।
কোনো ক্লান্তি কোনো ক্লেশ
মুখে চিহ্ন দেয় নাই লেশ।
কোনো ভয় কোনো ঘৃণা কোনো কাজে কিছুমাত্র গ্লানি
সেবার মাধুর্যে ছায়া নাহি দেয় আনি।

এই সেবার প্রয়োজনও একদিন ফুরল। এরপর নন্দিতা জড়িয়ে পড়লেন নানা কাজে।

১৯৪২ সালে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে শুরু হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলন। স্বাধীনতা আন্দোলন বাংলা দেশে নারী সমাজের মধ্যে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল তার বুঝি তুলনা হয় না। প্রতিটি ঘরের শিক্ষিত অশিক্ষিত মেয়েরা এগিয়ে এসেছিলেন প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে। বাস্তবিক পক্ষে বাঙালী নারীসমাজের পূর্ণমুক্তি ঘটেছে এই বিপ্লবকে কেন্দ্র করেই। চিরলাঞ্ছিত অপমানিতা নারীদের মনে স্বাধীনতার বাণী এত সাড়া জাগিয়েছিল কি করে কে জানে? নন্দিতাও কবির মৃত্যুর পর মহাত্মাজীর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন নন্দিতার জ্যাঠতুতো বোন অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ও। পরে যিনি অরুণ আসফ আলী নামে পরিচিত হন। এ সময় সক্রিয় রাজনীতির উন্মাদনা কম। শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, বীণা দাস, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওহদেদারের সাহসিক কার্যকলাপ হয়ে উঠেছে গল্প। এসেছে আগস্ট বিপ্লব। বহু নারী এই বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন। এগিয়ে এসেছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা, বাসন্তী দেবী, অমল দাস, আরো অনেকে। যোগ দিয়েছিলেন নন্দিতা, শ্ৰীমতী, রাণী চন্দ ও আরো অজস্র বঙ্গললনা। তাদের গ্রেপ্তার করা হলে নন্দিতারও কারাদণ্ড হল ছ মাসের জন্যে। তিনি এসময় রাজশাহী জেলে কারারুদ্ধ ছিলেন।

মায়ের মতোই আত্মপ্রচারে বিমুখ নন্দিতার অধিকাংশ গুণই ঢাকা পড়ে। আছে। সব কিছুতেই তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছেন। না হলে তার সম্বন্ধে তথ্য এত কম পাওয়া যাবে কেন? কাজ তো তিনি কম করেননি। শান্তিনিকেতনে থাকার সময় তিনি শিখেছিলেন বাটিক, চামড়ার কাজ, কাপড়ের ওপর ব্লক প্রিন্টিং। ছবি আঁকা শিখেছিলেন নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিংকর প্রমুখ শিল্পীদের কাছে। এখনো চীনা ভবনের দেওয়ালে একটা ফ্রেসকো পেন্টিং তার শিল্প-দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। গানের ক্ষেত্রেও নন্দিতা আত্মপ্রকাশ করেননি। একটিমাত্র রেকর্ডের সমবেত সঙ্গীতে ধরা আছে। নন্দিতার কণ্ঠ। গান দুটি হল জনগণমন অধিনায়ক ও যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে। নন্দিতার বাকী তিনজন সহশিল্পী ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ, সুধীন দত্ত ও অমল দত্ত। ভারত যেদিন স্বাধীন হয় সেদিন মধ্যরাতে সুচেতা। কৃপালনীর সঙ্গে নন্দিতাও গেয়েছিলেন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। এতে বোঝা যায়, নন্দিতার আত্মপ্রচারবিমুখতা কুণ্ঠার গুণ্ঠনে ঢাকা নয়। এ তার স্বাভাবিক নিস্পৃহতা। নয়ত যখন যেখানে ডাক পড়েছে দেশে কিংবা বিদেশে, নন্দিতা এগিয়ে এসেছেন হাসিমুখে। ১৯৪০ সালে মৃণালিনী সরাভাইয়ের নৃত্যদলের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকা যাত্রা এবং ১৯৬০ সালে সোভিয়েট সরকারের আমন্ত্রণে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে গিয়ে Kuibyshey on the Volga ব্যালেতে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য শিখিয়ে আসা এমনি দুটি ঘটনা। অবশ্য দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের ভারতীয় দূতাবাসে সাংস্কৃতিক মন্ত্রকের অধিকা ছিলেন কৃষ্ণ কৃপালনী। নন্দিতা স্বামীকে নানাভাবে সাহায্য করেন; তাছাড়া ব্রাজিলের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গেও পরিচিত হন এবং সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তার দক্ষিণ আমেরিকা সফরের বিষয়ে কিছু লেখেন। নন্দিতার লেখার হাত ভাল হলেও তিনি লেখিকা নন। কিছু চিঠিপত্র এবং সফর কাহিনীতে তাঁর কলমের শক্তির পরিচয় ছড়িয়ে আছে। তবে নন্দিতার সব কিছুই যেন অসমাপ্ত-অধসমাপ্ত রয়ে গেছে। নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, লেখা-কোন কিছুতেই সবাইকে ছাপিয়ে ওঠেননি। অন্যান্য অসমাপ্ত জিনিষের সঙ্গে আরো একটা জিনিষ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। সেটি হল একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নন্দিতা তাতে মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন কিন্তু অর্থাভাবে চিত্রটি সম্পূর্ণ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তার এই দিদিমণিটিকে নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন। কিন্তু নন্দিতাকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত ভালরকম আলোচনা হয়নি বললে ভুল হবে না। অনেকেই কবি-দৌহিত্রী হিসেবে নন্দিতাকে খুব মনে রেখেছেন কিন্তু নন্দিতাকে স্বতন্ত্রভাবে দেখবার চেষ্টা করা হয়েছে খুব কম। নিকট আত্মীয়রূপে নন্দিত যে মহামানবকে পেয়েছিলেন, তার নিবিড় সান্নিধ্য নন্দিতার একক ব্যক্তিত্বকে যেমন খানিকটা ঢেকে রেখেছিল তেমনি কয়েকটি রাবীন্দ্রিক গুণেরও অধিকারী করে তুলেছিল। অপরিসীম রোগযন্ত্রণা নীরবে সহ করে তিনি যেদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন প্রকৃতপক্ষে সেদিনই ঠাকুরবাড়ির অঙ্গন থেকে মুছে গেল শেষ রবিরেখা! রেখে গেল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে অতুল বৈভব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *