১৪. শীতের শেষে সুরপতি অসুখে পড়িলেন

চর্তুদশ পরিচ্ছেদ

শীতের শেষে সুরপতি অসুখে পড়িলেন। শরীর খুবই মজবুত ছিল, বাগানের প্রিয় গাছগুলিতে নিজের হাতে পাম্প করিয়া জল তুলিয়া দিতেন। প্রত্যহ কয়েক মাইল হাঁটাহাঁটি চাকবিজীবনের অভ্যাসের মধ্যেই ছিল। তবুও কোন এক রন্ধ্রপথে দেহে অসুখ ঢুকিয়া পড়িল। অসুখ সুরপতি গ্ৰাহেব মধ্যে আনিতেন না, জ্বরজারি হইলে তিনি আরও বেশি ঘোরাঘুরি করিতেন। মনে ভয় ছিল, শুইলেই অসুখ তাহাকে কাবু করিয়া ফেলিবে। কাজল দাদুকে কখনও কোন কারণে শুইয়া থাকিতে দেখে নাই। একদিন কলেজ হইতে ফিরিয়া সন্ধ্যাবেলা সুরপতিকে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া সে অবাক হইল। পাশে সরযূ বসিয়া হাওয়া করিতেছে, বাড়িতে থমথমে আরহাওয়া।

হৈমন্তী বলিল–জ্বরটা হঠাৎ বেড়েছে বুড়ো। দুপুরের দিকে আমায় ডেকে বললেন গায়ের ওপর চাদরটা এনে দিতে। নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, বুকে খুব সর্দি। তুই খেয়ে নে, কী দরকার পড়ে কখন–

কাজল খাইতেছে, দিদিমা আসিয়া বলিলেন—খোকা, তুই খেয়ে সুরেশ ডাক্তারকে একটা খবর দিয়ে আসিস তো, তোর দাদুকে যেন দেখে যায়।

অসুখটা যে বেশি তাহাতে সন্দেহ নাই। বাড়ির সবাই সে কথা বুঝিতে পারিয়াছে। সুরেশবাবুও অনেকদিন হইতে সাবধান করিতেছিলেন, সিগারেট ছাড়িবার উপদেশ দিয়াৰ্হিলেন। সুরপতি তাহাতে কর্ণপাত করেন নাই।

সুরেশ ডাক্তার সুরপতিকে দেখিয়া গেলেন। প্রতাপ তাহাকে আগাইয়া দিতে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল—ভয়ের কিছু আছে নাকি ডাক্তারবাবু?

—ভয়ের তো বটেই। অনেক দিনের পোষা লোগ। নিঃশাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন, সেটা ঠিক বুঝতে পারছি নে। দেখি দুদিন–

সকালে খবরের কাগজ আসিলে সুরপতি আগে পড়িতেন। প্লাস পাওয়ারের চশমা চোখে লাগাইয়া কাগজটা আদ্যোপান্ত পড়িয়া শেষ করিতেন। আজ কয়েক দিন কাগজ আসিয়া তাহার টেবিলে পড়িয়া থাকে, প্রতাপ সময় পাইলে বিকালের দিকে একবার দেখে। কলিকাতায় সে ভালো কাজ করিতেছে কোন একটা সওদাগরী অফিসে, খুব সকালে বাহির হইয়া যায়।

রান্নাবান্নর দিকটা হৈমন্তী দেখে। কাজলের দিদিমা এবং সরযূ সুরপতিকে দেখাশুনা করে। খাওয়াদাওয়ার হাঙ্গামা মিটিয়া গেলে হৈমন্তী আসিয়া বাবার কাছে বসে। সুরপতির শরীরের শক্তি

একেবারে চলিয়া গিয়াছে, মাসাধিক কাল শয্যাগত থাকিয়া বুঝিতে পারিয়াছেন, রোগ কঠিন। হৈমন্তী আসিলে জিজ্ঞাসা করেন—ডাক্তার কী বললে রে?

–ভয় কী বাবা? বলে গেছেন কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

–বলেছে এই কথা?

–নয় তো আমি কি মিথ্যে বলছি?

অসুখ উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিল, কমিবার লক্ষণ নাই। বুকে যেন কে দুই মণ পাথর চাপাইয়া রাখিয়াছে, নিঃশ্বাস লইতে কষ্ট হয়। সুরেশ ডাক্তার নানাভাবে পরীক্ষা করিয়া বুকে টোকা মারিয়া বলিলেন—জল হয়েছে বুকে, ট্যাপ করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এত দুর্বল রোগী! সবাই এখন স্পষ্ট বুঝিয়াছে, সুরপতির আর বিছানা ছাড়িয়া উঠিবার আশা নাই। বোঝেন নাই কেবল সুরপতি নিজে। কঠিন অসুখ হইয়াছে ইহা অনুভব করেন, কিন্তু অসুখটা যে তাহাকে পরপারগামী খেয়ায় তুলিয়া দিয়াছে ইহা বুঝিতে পারেন নাই। দুর্বল গলায় প্রত্যেককে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা কবেন, অবস্থার কিছু উন্নতি দেখিতেছে কিনা।

শেষের দিকে বাঁচিবার আগ্রহ প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। অন্য কাহারও কথা বিশ্বাস হইত না, দুপুরবেলা হৈমন্তী আসিয়া বসিলে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিতেন—হৈম, সত্যি বল। আমার কাছে লুকোস নে—আমি বাঁচবো তো?

কাজলের যেন কেমন লাগিল। দাদু ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, পরলোকে বিশ্বাস করেন, পুনর্জন্মের স্বপক্ষে অনেক কথা কাজলকে বলিয়াছেন, অথচ পৃথিবী ছাড়িয়া যাইতে তিনি এত কাতর কেন?

বিছানার সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছেন সুরপতি—দুই মাস আগে যাহারা দেখিয়াছে, এখন দেখিলে তাহারা চিনতে পারিবে না। চোখ.কোটরে ঢুকিয়া গিয়াছে, হাড়ের উপর চামড়াটা কোনমতে লাগিয়া আছে মাত্র। নিঃশ্বাস লইবার সময়ে পাঁজরাগুলি প্রকট হইয়া ওঠে।

দিদিমা সমস্ত জীবন দাদুর দেখাশোনা করিয়াছেন। খাইতে বসিলে পাশে বসিয়া হাওয়া করিয়াছেন। শীতকালে আদা-চা এবং গরমকালে বেলের পানা করিয়া দিয়াছেন, বোম ছিড়িয়া গেলে লাগাইয়া দিয়াছেন। কাজল বোঝে এখন দিদিমা অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন। অথচ তাহাকে পরিষ্কার করিয়া কেহ কিছু বলে না। সকলের মুখের দিকে তিনি শঙ্কিতভাবে তাকান–যেটা তাহারা গোপন করিতেছে, মুখভাব হইতে সেটা বুঝিবার চেষ্টা করেন।

ডাক্তার একদিন বলিলেন—আর ভরসা দিতে পারছি না, আপনারা প্রস্তুত থাকুন।

প্রস্তুত সকলেই। সুরপতি মানুষ চিনিতে পারিতেছেন না। কষ্ট করিয়া শ্বাস লইবার সময় মুখ দিয়া হা-হা শব্দ হইতেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, অর্থহীন। দুপুরে সবাইকে বিশ্রাম করিতে পাঠাইয়া হৈমন্তী বাবার কাছে বসিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। অপুর মৃত্যুর পর সুরপতি বিরাট মহীরুহের নিচে তাহাকে আশ্রয় দিয়াছিলেন, সে আশ্রয় এইবার নষ্ট হইতে চলিল।

সুরপতি তাকাইয়া চিনিবার চেষ্টা করিলেন। বলিলেন—কে? হৈম?

-হ্যাঁ বাবা, আমি।

সুরপতির কথা বলিতে কষ্ট হইতেছিল, অস্বাভাবিক স্বরে বলিলেন-কাঁদিস নে, তোদর কান্না দেখলে আমি মনে জোর পাই নে।

কান্নার বেগটা হৈমন্তী জোর করিয়া দমন করিল।

-তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো বাবা?

মাথা নাড়িয়া সুরপতি সায় দিলেন। হৈমন্তী মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছে, এমন সময় সুরপতি হঠাৎ বলিলেন–দাদু কই?

কাজল কলেজে গিয়েছে বাবা।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সুরপতি বলিলেন–হৈম, দাদু খুব বড়ো হবে, দেখে নিস। ও অন্য রকম–

-তুমি ঘুমোও বাবা, কথা বোলো না–

–আমি বলে গেলাম হৈম, তুই মিলিয়ে নিস!

একটু পরে সুরপতি বলিলেন–গায়ে চাদর দিয়ে দে, আমার শীত করছে।

একদিন মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া কাজল শুনিল, পাশের ঘর হইতে দাদুর ক্ষীণ গলার স্বর ভাসিয়া আসিতেছে। দাদু কী বলিতেছেন, কেহ উত্তর দিতেছে না।

মশারি তুলিয়া কাজল সুরপতির ঘরে গিয়ে দাঁড়াইল। প্রথম রাত্রে সরযূর জাগিয়া থাকার কথা, অতিরিক্ত ক্লান্তিতে সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। পরপর কয়েক রাত্রি জাগিয়া দিদিমাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কোথাও কেহ নাই, সমস্ত বাড়িতে অপার্থিব নীরবতা খাঁ-খা করিতেছে।

সুরপতির মাথা বালিশ হইতে নিচে বিছানার চাদরে গড়াইয়া পড়িয়াছে। মাথা তুলিবার বার বার চেষ্টা করিয়াও পারিতেছেন না। কাজলকে দেখিয়া বলিলেন-মাথাটা তুই বালিশে তুলে দিয়ে যা দাদু, কেউ তো আসছে না।

কাজলের বড়ো খারাপ লাগিল। জীবনের পরিণতি যদি এমন হয়, তবে মানুষ বাঁচে কীসের আশায়! যৌবন অতিক্রান্ত হইবার আগেই তো আত্মহত্যা করা উচিত পরবর্তী দুর্দশার হাত হইতে রেহাই পাইবার জন্য।

পরের দিন সকালে সুরেশ ডাক্তার বলিলেন, দিন কাটে কিনা সন্দেহ। কাজল কলেজ এবং প্রতাপ অফিস কামাই করিয়া বাড়িতে থাকিয়া গেল। দুপুরে অনেক মাছ রান্না হইয়াছিল-সরযূ আর হৈমন্তী পরামর্শ করিয়া কাজটা করিয়াছিল। অন্য দিন হইতে বেশি মাছ দেখিয়া দিদিমা বলিলেন— এত মাছ কেন রে?

সরযূ বলিল–খাও না মা। সস্তা পেয়ে প্রতাপ নিয়ে এসেছে।

দিদিমা হাঁটুর ওপর মাথা রাখিয়া দিতে লাগিলেন—আমাকে তোরা সবাই কেন ঠকাচ্ছিস, আসল কথাটা কেন বলছিস নে?

কিছুতেই তাঁহাকে খাওয়ানো গেল না।

দুপুরবেলা সুরপতির শ্বাসকষ্ট ভীষণ বাড়িল। এক-একবার দম লইবার সময় মনে হইতেছিল, প্রাণ বাহির হইয়া যাইবে।

হৈমন্তী কাজলকে বলিল—একবার তুই চট করে সুরেশবাবুর কাছে যা, তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবি অবস্থাটা বলে—

গায়ে একটা জামা গলাইয়া কাজল সুরপতির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সুরপতি তাকাইয়া আছেন, কিন্তু চিনিতে পারিতেছেন কিনা কাজল বুঝিল না। সে ঝুঁকিয়া বলিল—দাদু, আমি কাজল।

সুরপতি কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিলেন। বুকটা হাপরের মতো সমানে ওঠা-পড়া করিতেছে। গোঙানির স্বরে সুরপতি বলিলেন—দা বুকে বড়ো কষ্ট

দাদুর আর্তস্বর কাজলের ভীষণ খারাপ লাগিল, সে দৌড়াইল সুরেশবাবুর বাড়িতে। রিকশা করিয়া সুরেশবাবুর সঙ্গে ফিরিবার সময় দেখিল প্রতাপ খালি পায়ে বাহির হইতেছে। তাহাদের দেখিয়া বলিল—বাবা মারা গেছেন ডাক্তারবাবু।

ডাক্তারবাবুর ঘড়িতে তখন তিনটা বাজিয়া পাঁচ মিনিট। কুড়ি মিনিট আগেও কাজল দাদুর সহিত কথা বলিয়াছে।

সুরপতির সঙ্গে দেওয়ার জন্য কাজল পাঞ্জাবি কিনিতে গিয়াছে, একটা নামাবলী কিনিতে হইবে। পাড়ার ছেলেরা ফুলের মালা ধূপকাঠি ইত্যাদির জোগাড় করিয়া ফেলিয়াছে। দোকানী রেডিমেড পাঞ্জাবির স্তূপ সামনে আনিয়া বলিল, কী মাপের চাই?

কাজলের শুনিয়া অদ্ভুত লাগিল। গলা পরিষ্কার করিয়া সে বলিল—মাপের দরকার নেই, মাঝারি দেখে দিন। যার জন্যে যাচ্ছে, তিনি মারা গেছেন।

দোকানীর এই মাপ জানিতে চাওয়ার কথা কাজলের বহুদিন মনে ছিল।

দাহ অন্তে লোহা এবং আগুন স্পর্শ করিবার জন্য শ্মশানবন্ধুরা বাড়িতে ঢুকিতেই দিদিমা অনেকদিন বাদে কাঁদিয়া উঠিলেন—ওরে, তোরা কোথায় শীতের মধ্যে রেখে এলি বুড়োকে–ও যে মোটে একলা থাকতে পারে না–

(কাজলের ডায়েরি থেকে)

এখন অনেক রাত। সবাই ঘুমুচ্ছে, আমার পোষা বেড়ালটাও গুঁড়িসুড়ি মেরে মা’র ট্রাঙ্কের ওপর শুয়ে আছে। বহু দূরের রেলওয়ে সাইডিং থেকে শান্টিং-এর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। পাশের বাড়ির মুকুলবাবুর পোষা কুকুরটা ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখে গরগর করে উঠছে।

আমার কেন ভালো লাগছে না, জানি না। দাদু মারা যাবার পর থেকেই কেমন একটা চিন্তার পোকা মাথার ভেতরের সুস্থ কোষগুলি কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে। বাবার মৃত্যুর পর আমার চিন্তাশক্তি বেশ কিছুদিন অবশ হয়ে ছিল, তাছাড়া আমার বয়সও তখন ছিল কম। কিন্তু দাদুর মৃত্যু আমি খুব কাছ থেকে দেখলাম, মৃত্যুর কালো পোশাক পরা অতিলৌকিক শরীরটা একেবারে আমার গা ছুঁয়ে গেল। সে চলে গেল বটে, কিন্তু তার ক্ষণিক উপস্থিতির নিদারুণ মুহূর্তগুলো আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।

পাশের ঘরের দরজা খোলা। এ ঘরে এই একমাস আগেও দাদু শুয়ে থাকতেন। আলো পছন্দ করতেন না। বিশ্রামের সময় আলো নেভানো থাকতো। অন্ধকারে দাদুর সিগাবেটের আগুন দেখতে পেতাম। গরমকালে দাদু হাত-পা নাড়তে নাড়তে আপনমনে গাইতেন—ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।

মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এ কথা জানবার জন্য সন্ন্যাসী হওয়ার দরকার হয় না। কিন্তু মৃত্যু এসে একদিন সব কেড়ে নিয়ে বিষাণ বাজাতে বাজাতে চলে যাবে—এটা সহ্য করতে হলে দৃঢ় মন দরকার। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি, আমার সে শক্তি নেই। মৃত্যু এসে অলক্ষ্যে আমার ঘরে দাঁড়াবে, তর্জনী তুলে ইঙ্গিত করে কঠিন আদেশ উচ্চারণ করবে—এসো। আমাকে চলে যেতে হবে। আমি পৃথিবীকে ভালোবাসি, জীবনকে শীতের রোদুরের মতো ভালোবাসি। বৃষ্টির দিনে জানালায় বসে ক্রমঘনায়মান অন্ধকারে অবিশ্রাম বৃষ্টি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার মনে হয়, মাটির পৃথিবী হয় ঋতু সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত বর্ষণকান্ত আকাশের ময়ূরকণ্ঠী রঙ-এসব ছেড়ে কখনও আমি যেতে পারবো না। কবিতা লিখি না কিন্তু আমি কবি, আমি রসিক। মাটির সঙ্গে যে নাড়ীর বন্ধন, তাকে ছিঁড়ে যেতে আমি পারবো না। অথচ সে আমার কথা শুনবে না। সে আমায় ছেড়ে যাবে না, প্রতিজ্ঞা শুনে নিঃশব্দে অহাস্য করে দিকচিহীন অন্ধকারে আমাকে চিরকালের জন্যে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

বেঁচে থাকার তবে অর্থ কী? সমস্ত পৃথিবীটার সৃষ্টি না হলেও ক্ষতি ছিল না। আমি তো চিরদিনের জন্য তাকে নিজের কাছে রাখতে পারবে না, তবে সামান্য সময়ের জন্য ধরে রাখার কী অর্থ?

অথচ ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনের কী যেন গৃঢ় অর্থ আছে। জীবনের সার্থকতা কোথায়, কে যেন তা আমাকে কানে কানে বলে যায়। আধো ঘুমের মধ্যে আমি হাতুড়ে বিছানায় খুঁজি—যেন সার্থকতার চাবিকাঠি কেউ আমার কাছেই রেখে গেছে। পাই না, হাতে ঠেকে মায়ের গা। শেষ রাত্রের তরল অন্ধকারে হঠাৎ জেগে যাওয়া চোখে মাকে আঁকড়ে শুয়ে থাকি। যেন মাকে ছেড়ে দিলেই আঁধার সমুদ্রের ঢেউ আমাকে ভাঙা পানসির মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কোথায়।

আমার স্বভাব বড়ো রুক্ষ হয়ে উঠছে। হয়তো মানসিক অসন্তুষ্টিই এর কারণ। আমি বুঝতে পারি না, সবাই কী করে একে অস্বীকার করে হাসিমুখে বেঁচে আছে। হয় তারা সবাই একযোগে বোকা, নয়তো আমার থেকে অনেক জ্ঞানী। আজকাল বেড়াতে গিয়ে মাঠের মধ্যে জঙ্গলের মধ্যে সব জায়গায় অতৃপ্তি অনুভব করি। কালো পোশাক পরা কে একজন আমার পেছন পেছন আসেতাকে আমি দেখতে পাই না, তাকে অনুভব করি। জানি দিন যত কাটবে, তার আর আমার ব্যবধান ততই কমে আসতে থাকবে।

পরমেশের বোনের শশুরবাড়ি ব্যারাকপুরে। বোনকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিতে সে ব্যারাকপুরে গিয়েছিল, সঙ্গে নিয়েছিল আমাকে। দুপুরবেলা তার ভগ্নীপতির বাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেবে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলাম। এধারে লোজন কম, কাছেই মিলিটারি ব্যারাক। গঙ্গার পাড়ে বাবলার বন, দূর থেকেই দেখা যায় বাবলাগাছের ফাঁকে ফাঁকে নদীর জল চিকচিক করছে।

উঁচু পাড়ে বসে ওপারে শ্রীরামপুরের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছি, এমনি সময় নজরে পড়ল পাড়ের নিচেই কাদার ওপর পড়ে আছে একটা ছোট কাগজের বাণ্ডিল-নীল সুতো দিয়ে বাঁধা। কী রকম মনের ভাব হল—জুতো খুলে টপ করে নিচে নামলাম জলের কাছাকাছি। তখন ভাটা চলছে, জল এসে কাগজগুলোকে স্পর্শ করেনি। যে ফেলেছে, কিছুক্ষণ আগেও সে এখানে ছিল।

সুতোটা না খুলে ভাববার চেষ্টা করলাম, এগুলো কী হতে পারে। বাজে কাগজ? দলিল? বাড়িভাড়ার পুরোনো রসিদ? প্রেমপত্র?

খুলে দেখি প্রেমপত্রই বটে। ঘটনাটা উপন্যাসের মতো শোনাচ্ছে—ডায়েরির ছেঁড়া পাতায় কাঁচা হাতের লেখায় ভুল বানানে প্রায় পনেরো-কুড়িটি প্রেমপত্র নীল সুতো দিয়ে বাঁধা। যাকে লেখা, তার জীবনে হয়তো এগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এতদিন সযত্নে রাখা ছিল বাক্সের কোণে, বেব করে আজ গঙ্গার বুকে ফেলে দিয়ে গেছে।

চিঠিগুলো তখন পড়িনি। বাড়ি এসে পড়বার ঘরে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে এক-একখানা করে পড়ে ফেললাম। নাম দেওয়া নেই। তবে এটুকু বোঝা যায় কোনো মেয়ে তার প্রেমিককে উদ্দেশ করে চিঠিগুলি লিখেছিল। চিঠির নিচে লেখা—’ইতি তোমার মিতা’। সম্বোধনেও প্রাণের মিতা। কাজেই মিতা তার নাম নয়। এদের ভালোবাসা পরিণতি লাভ করেনি, চিঠি ফেলে দেওয়া থেকে তা বোঝা যাচ্ছে। একটিতে লেখা—তোমাকে অনেকদিন পর দেখলাম। মনটা আনতে নেচে উঠলো। সত্যি, আজ সকাল থেকে দিনটা খুব ভালো যাচ্ছে। তোমার কাছ থেকে যা আশা করেছিলাম, তার থেকে অনেক বেশি পেলাম। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোমাকে সারাজীবন যেন এমনি করেই পাই। ইতি—তোমার মিতা। আর একটিতে—তুমি চলে গেলে, কিন্তু একবারও তো বললে না—যাচ্ছি। হয়তো ভুল হয়ে গেছে, হয়তো তুমি দেখো নি, দরজার পাশে আমি দাঁড়িয়েছিলাম তোমার পছন্দসই সেই ডুরে শাড়িটা পরে। আমার এক বন্ধু বলেছিল ভালোবাসলে দুঃখ পেতে হয়। আমার ভাগ্যে তাই আছে। সারাজীবন হয়তো কেবল দুঃখই পাবো। কেন যে এমন ভুল করলাম। ইতি—তোমার অবুঝ মিতা।

অন্য কেউ পড়লে হয়তো মনে মনে বিরাট এক গল্প তৈরি করে নায়িকার দুঃখে সন্ধেটা মুহ্যমান হয়ে কাটাতো। একবছর আগে চিঠিগুলো পড়লে আমিই অচেনা মেয়েটির কথা ভেবে ঘন্টা দুই কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার মনে এক উলটো প্রতিক্রিয়া হল। বাইরে থেকে বাতাস এসে বারবার টেবিল ল্যাম্পের আলো কঁপিয়ে দিয়ে দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের পাতা নিয়ে খেলা করছে, বাড়ির সামনে শম্ভ পাগলা এসে প্রতিদিনের মতো খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখ তুলে টানা সুরে বলে যাচ্ছে-ভাত খাবো, ভাত খাবো, ভাত—ভাত-ভাত! পাশের বাড়ির ছাদে কে যেন দুমদুম করে কয়লা ভাঙছে। এর মধ্যে আমার মনে বিচিত্র অসন্তোষের ঝড়। চিঠিগুলোর প্রেরক এবং প্রাপককে যেমন আমি কোনোদিনই জানতে পারবো না, তেমনি আমার প্রশ্নের উত্তরও আমি কোনদিন পাবো না। আমার অস্থিরতার সঙ্গে চিঠির ব্যাপারটা হঠাৎ মিলেমিশে এক হয়ে গেল। বাতি নিভিয়ে দিতেই তারাদের ছায়া নিয়ে একরাশ জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপরে। বাতাস বাইরের গাছগুলোকে ধবে খুব করে এক-একবার ঝাকিয়ে দিয়ে গেল। বাতিটা থেকে পোড়া সলতের কেমন একটা গন্ধ আসছে, নামিয়ে রাখতে গিয়ে নজবে পড়লো মেঝেয় জ্যোৎস্নার ফালি। আমার মাথার ভেতরে চেতনাটা অতীতকে ভালোবাসে, নাম-না-জানা ফুলের গন্ধে ভারাক্রান্ত অতীতের সন্ধেগুলোয় ফিরে যেতে চায়—সেই চেতনা শেকল ছিঁড়ে হঠাৎ লাফালাফি শুরু কবে দিল। চাদের আলোটুকুর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম একশো বছর আগেকার স্বাভাবিক সুন্দর জীবনের কথা, যেমনটি পড়েছি বই-এ। সে জীবনের সঙ্গে তুলনা কবে বর্তমানে ওপর আমার বিতৃষ্ণা হল, অসন্তুষ্টি বেড়ে উঠে মনে হতে লাগলো—পাই নি, পাবো না।

তখনও শম্ভ পাগলা সমানে চিৎকার করে চলেছে ভাত—ভাত—ভাত!

একদিন মিউজিয়ামে গেলাম। বহুদিন আগে বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম, আর এই। সময়ের দিক দিয়ে দেখতে গেলে খুব বেশিদিন নয় কিন্তু আমিই পালটে গেছি।

মিউজিয়ামের ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ঘুম-ঘুম ভাবটা আমার ভালো লাগে। করিডোরের সারি সারি ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি, অল্প আলোয় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর কঙ্কাল, মৃত্তিকাভ্যন্তর থেকে আনা বিচিত্র পাথর— এসবের মধ্যে, আমার মনে হয, কী যেন লুকিয়ে আছে। বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া মানুষের উপস্থিতি আমার চোখের সামনে, আমার মনের ভেতরে অনুভব করতে পারি।

লম্বা ঘরগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে তাকিয়ে মন বাধাবন্ধ মানতে চায় না ইচ্ছে করে সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে ফেটে পড়ি। ভূ-বিজ্ঞান প্রত্নতত্ত্ব জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানের শাখাগুলোর মধ্যে লুকোনো আছে মানুষের জন্মের ইতিহাস। সবকিছু একসঙ্গে না জানতে পেরে খালি মনে হয়, ঠকে গেলাম—বোকা রয়ে গেলাম। একটি ঘরে বৌদ্ধযুগেব মূর্তিশিল্প সংগৃহীত। আমি আইকনোগ্রাফির ধার ধারি না, অথচ কী এক আকর্ষণে আজ ঢুকেছিলাম। ভালোই করেছিলাম, তার ফলে আমার এক চমৎকার অভিজ্ঞতা হল।

পাথরের এক নারীমূর্তি আমার বড় ভালো লেগে গেল। মূর্তিকারের নাম নেই। শুধু লেখা মূর্তিটি খ্রিস্ট-জন্মের আগে তৈবি, সম্ভবত শিল্পীর প্রেয়সীর প্রতিকৃতি। ঘরের আয়তনের তুলনায় আলো যথেষ্ট নয়। ফলে সব সময়ই কেমন আধো আলো আধো অন্ধকার ভাব ঘরের মধ্যে। সেই মৃদু আলোকিত স্বপ্ন-স্বপ্ন পরিবেশে মূর্তিটির সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম।

স্পষ্ট দেখলাম মেয়েটি হাসছে।

তখন কাছাকাছি কোনো মানুষ ছিল না, খুব কাছে গিয়ে আমি মুখের দিকে তাকালাম। সে হাসি পাথরে উৎকীর্ণ বটে, কিন্তু আমার মনে হল মেয়েটি যেন এইমাত্র আমাকে দেখে হেসে উঠেছে।

আমার সে সময়কার মনের অবস্থা বোঝানো যায় না বলেই তেমন চেষ্টা করছি না। দরকারই বা কী, এ ডায়েরি আমি ছাড়া যখন অন্য কেউ পড়বে না। খালি মনে হতে লাগল, কবে যেন এর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। বহুদিন আগে উপহার পাওয়া আতরের শিশি বাক্স থেকে বার করে শুকলে তার গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে যেমন পুরোনো দিনটা আবার ফিরে আসে, তেমনি ওখানে দাঁড়িয়ে মনে হল অতীত আমার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বাতাসে ধূপের মৃদু গন্ধ পেলাম, প্রাচীন যুগের মহিলারা ধূপের ধোয়ায় চুল শুকোতে বসলে যেমনটি পাওয়া যেতো। অনুভূতি এত তীব্র ও স্পষ্ট যে, আমি নিজেকে সরাসরি সে যুগটার সঙ্গে জড়িত বলে বোধ করলাম।

বাড়ি আসতে মনে হলো আমি এবং সে অস্তিত্ব একই সমতলে অবস্থিত নই–দেশকালের বিভিন্ন দুই স্তরে কবে থেকে আমরা পরস্পরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কোনো এক ধ্রুবকেন্দ্রে এসে মিলিত হতে পারছি না। শুধু খুঁজছি, শুধু খুঁজছি।

কবে যেন সে আমার জন্য কুটিরাঙ্গণে দাঁড়িয়ে উদগ্রীব দৃষ্টিতে পথের দিকে চেয়ে থাকত। সে কবেকার ভুলে যাওয়া অতীতের কথা।

সমস্ত মনে কী যেন হারানোর যন্ত্রণা, খুঁজে না পাওয়ার অতৃপ্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *