প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৪. রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব

রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব

সমাজ-বিজ্ঞান অনুসারে, ওই প্রাগ-বিভক্ত গণসমাজের ধ্বংসস্তূপের উপরই রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু এ-বিষয়ে আমাদের দেশের প্রাচীন পুঁথিপত্রের মধ্যে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় কি? যায়। কেবল মনে রাখতে হবে, প্রাচীন পুঁথিপত্রের এই নজিরগুলিকে ঠিকমতো বুঝতে হলে মানবসমাজের ক্রমবিকাশে-সংক্রান্ত যে-তথ্যকে সাধারণ সত্য হিসাবে জানতে পারা গিয়েছে তারই আলোয় বোঝবার চেষ্টা করতে হবে।
মহাভারতের(১৫৮) এক জায়গায় ভীষ্ম বলছেন:

সর্বপ্রথমে পৃথিবীতে রাজ্য, রাজা, দণ্ড ও দণ্ডার্হ ব্যক্তি কিছুই ছিল না। মানুষেরা একমাত্র ধর্ম অবলম্বন পূর্বক পরস্পরকে রক্ষা করিত। মানবগণ এইরূপে কিছুদিন কালযাপন করিয়া পরিশেষে পরস্পরের রক্ষণাবেক্ষণ নিতান্ত কষ্টকর বোধ করিতে লাগিল। ঐ সময়ে মোহ তাহাদিগের মনোমন্দিরে প্রবিষ্ট হইল। মোহের আবির্ভাব বশতঃ ক্রমশঃ জ্ঞান ও ধর্মের লোপ হইতে লাগিল এবং মানবগণ ক্রমে ক্রমে লোভপরতন্ত্র, পরধনগ্রহণতৎপর, কামপরায়ণ, বিষয়াসক্ত ও কার্য্যাকার্য্য-বিবেকশূন্য হইয়া উঠিল।

ভীষ্ম বলে চলেছেন (১৫৯), এই অবস্থার হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার জন্যে সৃষ্টি হলো রাজা, রাজধর্ম, রাষ্ট্রনীতি, ইত্যাদি।

তার মানে, প্রাগ-বিভক্ত সাম্য-সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপেরই ওপর যে রাষ্ট্র-যন্ত্র দেখা দিয়েছে এ-কথা ভীষ্মের উক্তিতে একটুও অস্পষ্ট নয়। অবশ্যই। এখানে তিনি এমন কথা নিশ্চয়ই বলছেন যা যে, ওই প্রাগ-রাষ্ট্র অমাজ-সংগঠনেরই নাম হলো গণ। কিন্তু ১০৭ অধ্যায়ে গণ-সংগঠন কেমন করে ধ্বংস হয় তার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি যেহেতু একই কারণের উল্লেখ করছেন, সেই হেতু অনুমানের অবকাশ থাকে বই কি যে, ৫৭ অধ্যায়ের ওই প্রাগ-রাষ্ট্র সংগঠনের নামই গণ-সংগঠন। দুঃখের বিষয় ১০৭ অধ্যায়টি তর্জমা কালীপ্রসন্ন সিংহের সংস্করণে প্রায় একেবারেই মূল্যহীন। গণ শব্দের বদলে শূর শব্দ ব্যবহারে করে সেখানে মৌলিক ভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে।
ভীষ্ম বলছেন(১৬০):

গণানাঞ্চ কুলানাঞ্চ রাজ্ঞাং ভরতসপ্তম।
বৈরসন্দীপনা বেতৌ লোভামর্ষৌ নরাধিপ।।
লোভমেকো হি বৃণুতে ততোহমর্ষমণস্তরম্‌।
তৌ ক্ষয়ব্যয়সংযুক্তাবন্যোন্যশ্চ বিনাশিনৌ।।

ইত্যাদি ইত্যাদি।

অবশ্যই, এখানে ভীষ্মের সামনে সমস্যাটা একটু অন্য রকমের : উদীয়মান রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে আশপাশের গণ-সঙ্ঘগুলিকে কীভাবে তাঁবে রাখা যায় তারই সমস্যা। তাই গণের মধ্যে ভেদসৃষ্টির কৌশল নিয়ে আলোচনাও। কিন্তু, এ-আলোচনা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে অনেক ধারালো আর নির্লজ্জও। তাই কৌটিল্য-প্রসঙ্গেই সে-কথা তোলা যাবে।

আপাতত যে আলোচনা হচ্ছিলো : প্রাগ-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপরই কীভাবে রাষ্ট্রশক্তি দেখা দিলো তার স্মৃতি যে শুধুই মহাভারতের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে তাই নয়, বৌদ্ধ সাহিত্যেও এর নজির রয়েছে। নমুনা, মহাবস্তু অবদান। বরং, মহাভারতের চেয়ে এখানের বর্ণনাটি অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক; কেননা, বাস্তবনিষ্ঠ। মহাভারতে শুধুমাত্র লোভ। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু মহাবস্তু অবদান দেখাচ্ছে যে, সবকিছুর মূলে আসল কারণ হলো উৎপাদন-পদ্ধতির উন্নতি। কৃষি ব্যবস্থা শেখবার পর দরকার পড়লো দলের সবাইকার মধ্যে জমি আলাদা-আলাদাভাবে বিলি করে দেয়ার ব্যবস্থা। আর শেষ পর্যন্ত এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে নানান সমস্যা সমাধানের জন্যেই রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব। অবশ্যই মহাবস্তু অবদানের ভাষাটা পুরাণ-ঘেঁষা, তবুও কিন্তু অস্পষ্ট নয়। সেই ভাষায় বর্ণনাটি কী রকমের তাই দেখা যাক।

আগেকার যৌথ-জীবন কী রকম ছিলো? মহাবস্তু অবদানে(১৬১) বলা হচ্ছে, “সুখনিবাসে থাকিয়া তাঁহারা প্রীতিভক্ষণ করিয়া জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন। তাঁহারা যাহা করেন সকলই ধর্ম।” কিন্তু চাষবাসের কায়দাকানুন শেখবার পর, দলের মধ্যে জমি বিলি হবার পর, দেখা দিলো চুরি, মিথ্যে কথা, মারামারি কাটাকাটি। “তখন সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিতে লাগিল: আইস, আমরা একজন বলমান বুদ্ধিমান, সকলের মন যোগাইয়া চলে,– এমন লোককে আমাদের ক্ষেত রাখিবার জন্য নিযুক্ত করি। তাহাকে আমরা সকলে ফসলের অংশ দিব। সে অপরাধের দণ্ড দিবে, ভালো লোককে রক্ষা করিবে আর আমাদের ভাগমতো ফলস দেওয়াইয়া দিবে। তাহারা একজন লোক বাছিয়া লইল। তাঁহাকে তাহারা ফসলের ছয়ভাগের এক ভাগ দিতে রাজী হইল।…এইরূপে তেজোময় জীব অনন্ত আকাশে ঘুরিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে ক্রমে লোভ পড়িয়া মাটিতে মাটি হইয়া গেলো। শেষে তাহাদের ক্ষেত আগলাইবার জন্যে একজন ক্ষেতওয়ালার দরকার হইল। সেই ক্ষেতওয়ালাই রাজা, ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগই তাহার মাহিনা”(১৬২)।

এইখানে অবশ্যই অনেকগুলি কথা মনে রাখতে হবে। প্রথমত, বৌদ্ধ ঐতিহ্যে গণতন্ত্রের প্রভাব অনেক প্রবল, তাই রাজাকে যে-চোখে দেখা হয়েছে তারও বৈশিষ্ট্য আছে। দ্বিতীয়ত, মহাবস্তু অবদানের বর্ণনাটাই পুরাণ-ঘেঁষা, তায় উদ্ধৃতিটা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশায়ের লেখা থেকে, তিনি কিনা ঘরোয়া গল্পের ঢং-এ মহাবস্তু অবদানের কথাটা নতুন করে বলছেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য তো আর এই উপাখ্যান থেকে সমাজ-বিজ্ঞানে হাতেখড়ি নয়। তার বদলে শুধু এইটুকুই দেখা যে, সমাজ-বিজ্ঞানের একটি মূল সিদ্ধান্ত হিসেবে এঙ্গেল্‌স্‌ ও মর্গান যে দেখাচ্ছেন প্রাগ-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপরই দেখা দিয়েছে রাষ্ট্রশক্তি, প্রাচীনদের লেখা ঠিকমতো বুঝতে পারলে এই সিদ্ধান্তের সমর্থন খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।

জয়সওয়াল প্রমুখ পণ্ডিতেরা নিশ্চয়ই তর্ক করে বলবেন, মহাভারত কিংবা মহাবস্তু অবদানে যে রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্মকথা বর্ণিত হচ্ছে তা রাজতন্ত্র। তাই উদ্ধৃতগুলি এখানে অবান্তর। কেননা, রাজতন্ত্রের জন্মবৃত্তান্ত মোটের ওপর এই রকম, একথা মানলেও উদ্ধৃতির বর্ণনাকে রাষ্ট্রমাত্রের জন্মবৃত্তান্ত বলে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা চলবে না। অপরপক্ষে, ওঁরা বলবেন গণ বলে সংগঠনের মধ্যে যদি সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় তাহলে এই গণকে রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে অস্বীকার করবার সুযোগ কোথায়? উত্তরে, ওঁদের রচনা থেকে যেটা কিনা একমাত্র যুক্তি হিসেবে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছি, সেটা হলো গণ-এর মধ্যে নিখুঁত গণতন্ত্রের আয়োজন। এইটেই হলো ওঁদের তরফের আসল কথা আর এইখানেই ওঁদের দৃষ্টিভঙ্গির আসল সংকীর্ণতাও। কেননা, ওঁদের মূল কথা হলো, গণকে কোনো-না-কোনো রকমের রাষ্ট্রব্যবস্থা হতেই হবে, তাই এ রাষ্ট্র যদি রাজতন্ত্র না হয়, যদি এর মধ্যে পাওয়া যায় গণতন্ত্রের পরিচয়, তাহলে একে সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া আর কী বলা সম্ভব? অথচ, সমাজ-বিজ্ঞান অনুসারে, রাষ্ট্রব্যবস্থার আবির্ভাব হবার আগে পর্যন্ত যে সাম্যসমাজ তার শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের আয়োজন একেবারে ষোলো আনাই। তাই, গণতন্ত্র অতএব সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র—এমনতরো কথা যুক্তি বিজ্ঞানসম্মত নয়। অবশ্যই, তাই বলে, গণতন্ত্র অতএব প্রাগ্‌-বিভক্ত সমাজ—এমনতরো পালটা যুক্তিও নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য নয়। আর আমাদের যুক্তি তা নয়ও। গণ বলতে যে প্রাগ্‌-বিভক্ত ট্রাইব্যাল সমাজই বুঝতে হবে তার অন্যান্য প্রমাণ হলো গণের ওই যৌন-সম্পর্ক আর যৌথ-চেতনা।

—————
১৫৮. শান্তিপর্ব ১০৭।
১৫৯. ঐ।
১৬০. ঐ।
১৬১. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : বৌদ্ধধর্ম ১৪২।
১৬২. ঐ ১৪৫।