১৪. চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সচেষ্ট হোন

১৪. চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সচেষ্ট হোন

আপনার যুদ্ধংদেহী রুক্ষ ব্যবহার আপনাকে হয়তো আত্মপ্রকাশের তৃপ্তি দেবে, কিন্তু অপর পক্ষ তাতে রীতিমত ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হতে পারে। এ কথা আপনার ভালোভাবে বোঝা দরকার।

একজন সমালোচক এ বিষয়টিকে আরো সরল করে দিয়েছেন-তার মতে, প্রতিপক্ষের সঙ্গে যদি ঠাণ্ডা মাথায় ও সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলা যায় তাহলে উভয় পক্ষ সহজেই তাদের ভুল সংশোধন করে নেবার জন্যে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। কারণ, উত্তেজিত মাথায় কোনা সমস্যার সুচিন্তিত সমাধানের পথ পাওয়া যায় না। অযথা গণ্ডগোলে পণ্ড হয়ে যায় অনেক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় কাজ।

আমেরিকার এক জ্বালানী কোম্পানির শ্রমিকদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর মালিক ম্যাকর্বন এই সত্যটিকে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

বেশি বেতনের আন্দোলনে শামিল শ্রমিকদের যুক্তিযুক্ত ধৈর্যশীল কথায় শান্ত করার দিকে না গিয়ে তিনি ব্যাপারটিকে ‘শ্রমিক পক্ষ’ ‘মালিক পক্ষে’র মধ্যে এক জেদাজেদীর সৃষ্টি করেছিলেন বলে ধর্মঘট, গুলিগোলা, রক্তপাত, অজস্র ক্ষতি হল। এবার ম্যাকবর্ন বুঝলেন যে, বিষয়টাকে এভাবে শক্ৰমনোভাবাপন্ন দৃষ্টিতে না দেখে শ্রমিকদের সঙ্গে একটা মত বিনিময়ের ব্যবস্থা করাই ভালো হবে।

এ চেতনার জাগরণে তিনি শ্রমিক প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা বৈঠকে এলেন। ম্যাকবর্ন তাদের মতামত ও স্পর্শকাতরতা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এমন সহানুভূতির সঙ্গে কথা বললেন যে শ্রমিকরা খুশি হলেন। তাদের আলোচনায় একদিকে যেমন শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা পেল তেমনি রক্ষা পেল কোম্পানির স্বার্থ। একরোখা হয়ে লড়াকু হয়ে যাওয়া অসন্তুষ্ট শ্রমিকেরা তাদের এতদিনকার যন্ত্রচালিত সংগ্রামটির থেকে বিরত হলেন। ম্যাকবর্নকেও তারা তার সহমর্মিতার জন্যে প্রচুর প্রশংসা করলেন।

আসলে ম্যাকবর্নের সহৃদয় কথাগুলি সংগ্রাম জর্জর মৃতপ্রায় শ্রমিকদের কাছে ওষুধের কাজ করেছিল। তাঁর কথায় এমন এক সুধা ছিল যা ওই বিদ্রোহীদের কাছে টেনে আনতে পেরেছিল তার স্বপক্ষে।

বলুন তো কি বলেছিলেন ম্যাকবর্ন ওই ভীষণভাবে বিদ্রোহী শ্রমিক শ্রেণীর কাছে?

ম্যাকবর্ন বলেছিলেন–তিনি ওই বিরাট কোম্পানির অধিকর্তা, তিনি তাঁর শ্রমিকদের সামনে বক্তব্য রাখতে পেরে গর্বিত।

মাত্র দুসপ্তাহ আগেও ম্যাকবর্ন তার শ্রমিকদের ভালোভাবে চিনতেন না। তিনি সাদার্ন কোলফিল্ড পরিদর্শন করার সময় সেই শ্রমিকদের পুরো পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হলেন। তাঁর অহঙ্কারহীন বিনীত ব্যবহারে অচিরেই ওই বিদ্রোহী শ্রমিকেরা আর পরিবারের সকলে তার গুণমুগ্ধ হয়ে গেল। ম্যাকবর্ন লাভ করলেন তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা। তিনি বক্তৃতায় আরো বললেন–যদিও আমি মালিক পক্ষের প্রতিভূ তথাপি আমি আপনাদের অনুগ্রহভাজন হতে পেরে ধন্য হলাম।

বলুন তো শত্রুকে বন্ধু করে তোলার কী সুন্দর এই কৌশলটি।

মনে রাখতে হবে, নিজের মতামত সুষ্ঠুভাবে করাতে চাইলে গায়ে জোর ফলালেই হয় না, কারণ মানুষ সহজে তার নিজের মত থেকে সরে আসতে চায় না। তাই বন্ধুর মতো ব্যবহার করে তাকে জয় করুন, আর আত্ম-গৌরবকে আহত না করে তাকে কাছে ট্রেনে নিন। একশ বছর আগে একথাই বলে গেছেন লিঙ্কন–যে কোনো মানুষের ওপর পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে হলে সহৃদয় ব্যবহার মধুর মতোই মিষ্টি হয় উঠবে।

ফোর্ড মোটর কোম্পানির শ্রমিকেরা যখন বিদ্রোহ করেছিলেন মাইনে বাড়াবার দাবিতে, তখন জেকব নামে এক ব্যক্তি তাদের প্রতি বন্ধুত্ব প্রদর্শন করে চনমনে হয়ে উঠবার জন্যে তাদের বেসবল খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আর এর জন্যে তিনি নাকি একটা খেলার মাঠও ভাড়া করে ফেলেছিলেন!

প্রেসিডেন্ট জেকব এভাবেই আন্দোলনকারী শ্রমিকদের মন থেকে বিদ্রোহের আগুন নির্বাপিত করে তাদের বন্ধু হিসেবে কাছে পেয়েছিলেন। তারা তাঁর ব্যভহারে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে মাইনে বাড়াবার দাবি মুলতবি রেখে কোম্পানির ওয়ার্কশপের জঞ্জাল পরিষ্কার করে ঝকঝকে করে তুললেন। খুব শীঘ্রই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকের এই শত্রুতার নিরসন হল, তার বদলে প্রতিষ্ঠা পেল এক সৌহার্দ্যপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত। আমেরিকার বিপুল শ্রমিক সংগ্রামের ইতিহাসে এ ধরনের উল্লেখযোগ্য ফলশ্রুতি আর কখনো দেখা যায় নি।

সুদক্ষ বক্তা ও তার্কিক সৌম্যদর্শন ব্যারিস্টার জোনস্ লিঙ্কনের বন্ধুত্ব লাভ করতে পেরেছিলেন।

ইঞ্জিনিয়ার চার্লি স্ট্রেনার তার মেয়াদ শেষ হওয়া ইজারা নেয়ার বাড়িটিতে আরো কিছু দিন থেকে যেতে চায়। অথচ তিনি ভালো ভাবেই জানতেন মালিক ভদ্রলোক বেশ কড়া ধাতের মানুষ। নিছক আবেদন-উপরোধে তার মন গলানো অসম্ভব। অতঃপর তিনি অভিজ্ঞতালব্ধ তার মূল্যবান জ্ঞানটিকে কাজে লাগালেন। মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি মেয়াদ বাড়াবার কথা মোটেও বললেন না। উষ্ণ অভিবাদন জানানোর পরে তিনি মালিককে বললেন–কী সুন্দর ছিল বাড়িটাতে থাকবার দিন কটি। বাড়িটি এত সুন্দর যে, সত্যিই আপনার রুচি পছন্দকে তারিফ করতে হয়। আরো কিছুকাল থাকার ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু কি করে আর থাকি!

ওঁর আন্তরিক প্রশংসা ও মধুর বাক্যে বাড়িওয়ালা এত প্রীত হলেন যে, চার্লিকে আরো কিছুদিন থেকে যাবার অনুমতি দিলেন, এমনকি বর্ধিত ভাড়াও নিলেন না।

চার্লি আসলে মালিককে অন্য ভাড়াটেদের মতো পেশাদারী কথা না বলে তাঁর মনটিকে ছুঁতে চেষ্টা করেছিলেন–ফলে জয় তার হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছিল।

এবার অন্য প্রসঙ্গে বলি, মিসেস এমিলি একবার একটি হোটেলে মধ্যাহ্নকালীন ভোজের আয়োজন করেছিলেন তার বান্ধবীদের নিয়ে। আমিও সেখানে ছিলাম আমন্ত্রিত। গল্পগুজব ইত্যাদির পর আমরা কয়েকজন আহারে বসলাম। খাবারের ব্যবস্থা ভালোই ছিল। কিন্তু বাদ সাধল তার বেয়ারটি। সে সম্মানীর অতিথির খাদ্য পরিবেশন করবার শিল্পটি বলতে গেলে জানেই না। আমার তখন বদরাগী স্বভাব ছিল। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের আগে আমি মানুষের এ ধরনের ব্যবহারের একটি সঙ্গত কারণ থাকে এই বিষয়টির ওপর একটা বক্তৃতা শুনেছিলাম। তাই বেয়ারটিকে তিরস্কার বা ভৎর্সনা কিছুই না করে আম এমিলির কাছে ঘেলাম। তাকে বললাম বেশ বন্ধুত্বপূর্ণভাবে–দেখ এমিলি, আমি জানি এ ব্যাপারে তোমার কোনো ত্রুটি নেই, আসলে কি জানো তোমার বেয়ারটি বদ্ধ কালা।

সরাসরি এমিলির ব্যবস্থাকে অভিযোগ না করায় এমিলি কৃতজ্ঞ হল আমার ওপর! বাকি পার্টিটা সে এত সুন্দরভাবে অতিথিদের যত্ন করল যেন মনে হল কুইন মেরিক ওই পার্টিতে অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে! এমিলির বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে আমি সেদিন মুগ্ধ হয় গেলাম।

ছেলেবেলার একটা গল্প এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে আমার।

বাতাস এবং সূর্য একদা পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে রত হল কার গুরুত্ব বেশি তাই নিয়ে। তারা নিজেরাই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে উদ্যোগী হল। এক পথিক রৌদ্রোজ্জ্বল পথে চলছিল। সূর্য আর বাতাস বললে–ওই পথিকের কোটটিকে যে ভোলাতে পারবে সেই আমাদের মধ্যে হবে সেরা।

সূর্য মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। বাতাস বেগে বইতে শুরু করে দিল। ফলে পথিক শীতাত হয়ে গায়ের কোটটা ততই জড়িয়ে ধরতে লাগল। তারপর বাতাস শান্ত হল। এবার সূর্য প্রবলভাবে কিরণ ছড়াতে লাগল, প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে এবার পথিক তার গায়ের কোটটা খুলে ফেলল। সূর্যই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করল নিজের। তার পর বাতাসকে ডেকে বলল-ভদ্রতা, বন্ধুত্ব ও উষ্ণতা সর্বদাই শক্তিমান থাকে জোরজবরদস্তির চেয়ে।

যিশুর জন্মের একশ বছর আগে রোমান কবি পাবলিয়ার্শ সাইরাম বলে গেছেন-যখন অন্যের প্রতি আমার অনুরাগ হবে তখন আমরাও তাদের প্রতি অনুরক্ত হতে পারব।

একটা কথা সর্বদাই মনে রাখবেন, জনপ্রিয়তা বাড়াবার একমাত্র উপায় হল নিজেকে নিমেষে অন্যের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা।

আমি আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। আশা করি, আমার প্রিয় পাঠক-পাঠিকাবৃন্দ তাদের প্রতিদিনকার জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, তাঁরাও হয়তো তাদের সুখী জীবনের সার্থক ও সুন্দর চিত্র লেখায় ফুটিয়ে তুলবেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে। আর এখানেই এই লেখার চরম সার্থকতা।

1 Comment
Collapse Comments

The book us very instructive and useful.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *