১৪. চক্রপাণি (কাল : ১২০০ খৃষ্টাব্দ)

চক্রপাণি – কাল- ১২০০ খৃষ্টাব্দ

এই সময় কনৌজ  ভারতের সবচেয়ে বড় সমৃদ্ধ নগর ছিল- তার জমকালো হাট-বাট, চৌরাস্তায়। মিষ্টন্ন, সুগন্ধি তৈল, অলস্কার এবং অন্যান্য বিহুবিধ জিনিসের জন্য সারা ভারহে প্রসিদ্ধ ছিল কনৌজ। ছ’শ বছর ধরে মৌখরি, বৈশ্য, প্রতিহার, গহড়বার মতো ভারতের তদানীন্তন সর্বোচ্চ রাজবংশগুলোর রাজধানী থাকার ফলে তার প্রতি শ্রদ্ধার ভাবও লোকের মনে সজ্ঞাত হয়েছিল। সেই কারণে হিন্দুরা নিজেদের পদবীর সঙ্গে কনৌজ শ্বদটি জুড়ে নিত। তাই আজও ব্রাক্ষণ, আহীর, কাঁছ ইত্যাদি বহু জাতির মধ্যে কান্যকুজ ব্রাক্ষণ, কান্যকুজ আহীর ইত্যাদি দেখা যায়। পদবীর আগে কনৌজ শ্বদটি যোগ হলে হিন্দুদের মধ্যে কুলজ মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। হর্ষবর্ধনের সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত জগতে বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে, কিন্তু তখনকার চেয়ে এখন ভারতীয় মনোরাজ্যে অধিকতর কৃপমন্ডুকতা এসে বাসা বেঁধেছে।

হর্ষবর্ধরে সময়ে আরবে এক নতুন ধর্ম- ইসলাম জম্মলাভ করে। সেই সময় কে বলতে পেরেছিল,ইসলামের সংস্থাপকের মৃত্যুর (৬২২ খৃঃ ) একশ’ বছরের মধ্যেই এই ধর্ম সিন্ধু থেকে স্পেন পর্যন্ত ছেড়িয়ে পড়বে! এতদিন জাতি এবং রাজার নামে দেশবিজয়ের কথাই শোনা গিয়েছিল, এ-বার ধর্মের নামে দেশ জয়ে কথা প্রথম শোনা গেল। আপন শিকার-সমুহকে সতর্ক হবার সুযোগও সে দিল না এবং তাদের একের পর এক প্রাস করে ফেললে। সাসানিগণের ( ইরাণীগণের ) শক্তিশালী সাম্রাজ্য তআরবদের স্পর্শমাত্র কাগজের নৌকার ন্যায় গেল পড়ল, এবং ইসলাম সংস্থাপকের মৃত্যুর পর দুই শতাব্দী পার হতে না হতে ইসলামী রাজ্যের ধ্বজা পামীরের ওপর উড়তে লাগল।

ইসলাম প্রথমে সমগ্র দুনিয়াকে আপন আরবী উপজাতিগ্রলোর বিস্তৃত-রুপে রুপায়িত করতে চেয়েছিল, এবং সেই সঙ্গে উপজাতির সবলতা, সাম্যভাবও ভ্রাতৃত্বকে আপন অনুগামীগণের মধ্যে জাগ্রত করে তূলতে চেয়েছিল। এই সময় থেকে তিন হাজার বছর পুর্বেই দিক আর্ষভাষীদের পুর্বজগণ ৈএই অবস্থাকে অতিক্রম করে এসেছে।অতিবাহিত যুগের পুনরাবৃত্তি অসম্ভব। এই জন্য যেমন ইসলাম তার উপজাতিসমুহের পরবর্তী ধাপে অবস্থিত সামন্তযুগের সংস্পর্থে এসেছে এবং তার তরবারির সামনে আক্রান্তের রানৈতিক স্বাতস্ত্র্য বিলীন হয়ে গেছে, তেমনি ঐ সংস্পর্শে এসেই ইসলামী সমাজের উপজাতীয়তার স্বরুপও বিনষ্ট হয়ে গেছে। ইসলামের প্রধান শাসককে বহুকাল পর্যন্ত কেবল তার সংস্থাপকের খলিফা-উত্তরাধিকারী বলা হত। বস্তুত স সুলতান-নিরক্ষুশ রাজা হওয়া সত্ত্বেও। এখন অবশষ্য নামে নিজেদের সুলতান বলে জাহির করার মতো অনেকেই এসে ড় হয়েছে। এদের কাছে ইসলামের উপজাতীয়তা, তার সরলতা বা ভ্রাতৃভাবের বিশেষ কোনো মুল্য নেই। নতুন অষ্ণল জয় করতে প্রয়োজন হত অস্ত্রচালনাকারী সৈন্যের এবং অস্ত্রচালনাকারীরা ৈএই সময় সবাই আরব জাতের ছিল না। এইসব ন্যৈদের সুলতানের সামে লড়াই করার জন্য উৎসাহিত করা যেত না, এ জন্য স্বর্গস্থিত নানা প্রলোভনের সঙ্গে সঙ্গে পার্থিব আনন্দের ভাগও তাদের দেওয়া হত। লুটের মাল এবং বন্দীদের ওপর তাদের অধিকার ছিল, নব-জয়লব্ধ ভুমিতে বসতি করার স্বত্ত তাদের ছিল, পুর্বতন অত্যাচারী. প্রবুকুলের কবল থেকে মুক্তি পাবার, এমন কি তাদের অস্তিত্বকেও বিলুপ্ত করে দেবার ও অধিকার ছিল। বিজেতার ধ্বজাকে আপনজ্ঞানে সগর্বে বয়ে নিয়ে চলার মতো এত  সৈন্য বিজিতদের ভিতর থেকে কেউ কখনও লাভ করেনি। -যারা আক্রান্তদের ভিতর থেকেই নিজেদের জন্য ন্যৈ সংগ্রহ করতে সক্ষম, তাদের সম্মুখীন হওয়া সহজ কাজ নয়।

হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর একশ’ বছরও কাটেনি এমন সময় সিন্ধু িইসলাম শাসনে চলে গেল। বারাণসী থেকে সোমনাথ (গুজরাট ) পর্যন্ত সারা ভারত ইসলামী অস্ত্রের স্পর্শ অনুভব করতে লাগল। এই নতুন বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য প্রয়োজন ছিল নতুন কর্মপদ্দতির, কিন্তু হিন্দুরা নিজেদের পুরনো পথ পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল না। সমগ্র দেশকে যুদ্দের জন্য প্রস্তুত করার বদলে ভারতের ন্যৈবাহিনী তৈরী হল একমাত্র রাজপুতদের ( প্রাচীন ক্ষত্রিয় এবং এদের সঙ্গে বিবাহাদি সুত্রে আবদ্ধ শক, যবন, গুর্জর ইত্যাদি )নিয়ে। আবার অন্তবৈরিতা থেকে এরা মুক্ত ছিলনা এবং রাজবংশগুলোর মধ্যে নতুন-পুরাতন শক্রতার জন্য শেষ পর্যন্ত ও তারা পারস্পরিক সহযোহিতার ভিত্তিতে ইসলামী আক্রমণের বিরুদ্ েপ্রস্তুত হতে পারল না।

“মহারাজ কোনো চিন্তা করবেন না। স্ধিগুরু এমন সাধনা সুরু করেছেন যাতে তুর্কসেনা শুকনো পাতার মতো হাওয়ায় উড়ে যাবে।”

“আমার ওপর শুরু মিত্রপাদের (জগন্মিত্রানন্দ ) কি অসীম করুণা! আমার বা আমার পরিবারের যখনই কোনো সস্কট এসেছে, গুরুমহারাজ দিব্যবলে রক্ষা করেছেন।”

“মহারাজ, সিদ্ধগুরু হিমালয়ের ওপারে ভোট দেশ থেকে কান্যকুজের সস্কট দেখতে পেয়েছেন, এই জস্যই তিনি আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।”

“কি অপার করুণা !”

“বলেছেন, তারিণী ( তারাদেবী) মহারাজের সহায়তা করবেন। তুকীদের সম্বদ্ধে আনি কিছু ভাববেন না।”

“তারা মায়ের ওপর আমার পুর্ণ আস্থা আছে। তারিণী, বরাভয়দারিনী ! স্নেচ্ছদের হাত থেকে রক্ষা কর মা।”

বৃদ্ধ মহারাজ জয়চন্দ্র ইন্দ্রভবনতুল্য আপন রাজপ্রাসাদে এক কর্পুরশ্বেত সিংহাসনে বসে রয়েছেন। চাজন সুন্দরী তরুণী রানী তাঁর পাশে বসে, এদের গৌর মুখমন্ডল থেকে ভ্রমরের চেয়েও কালো চুলের রাশ টেনে পিছনের দিকে খোঁপা করে বাঁধা । চুড়ামণি, কর্ণফুল, অঙ্গদ, কষ্কণ , চন্দ্রহার, মুক্তাহার , কাটকিস্কিনী, নুপুর ইত্যাদি নানা অলস্কারের ভার এদের গেতের ওজন অপেক্ষা বেশী । পণে সুক্ষ পাড়ি কাঁচুলী, কিন্তু বেশ বোঝা যায়, দেহ আবৃত করার জন্য এগুলো পরা হয়নি, হয়েছে দেহ-সৌষ্ঠব সুপ্রকট করে তুলে ধরার জন্যেই! কাঁচুলি ভেদ করে স্মনের স্ফীতি এবং অরুণিমা সুন্দর রুপে পরিস্ফুট। নীচে নাভি পর্যন্ত সমগ্র উদর অনাচ্ছাদিত; উরু জঙ্ঘার আকৃতি ও বর্ণ পরিষ্কারভা্বে দেখা যাচ্ছে। চুলের দুগন্ধি তৈল এবং নব প্রস্ফটিত জুঁই  ফুলের মালার সুগন্ধে সমগ্র পুরী আমোদিত। রাণীরা ছাড়াও পচিশ জনের বেশী তরুণী পরিচারিকা রয়েছে। এদের  মধ্যে কেই চামর, কউ মোরছল বা ব্যজন দোলাচ্ছে। কারও হাতে পানদান, কারও হাতে আয়নাম চিরুণী, কারও হাতে সুগন্ধ জলের ঝারি, কারও হাতে কাঁচের সুরাপত্রও সোনার পেয়লা, আবার কারও হাতে সাপের চামড়ার মতো মসৃণ কোমল তোয়ালে। কউ কউ মৃদঙ্গ, মুরজ, বীণা, বেণু ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে রয়েছে, কউ বা স্বর্ণদন্ডু হাতে এখানে সেখানে টহল দিচ্ছে। রাজা জয়চন্দ্র এবং আগন্তুক মিত্রপাদের শিষ্যু শুভাকর ছাড়া এখানে আর সবাই মহিলা , সবাই সুন্দরী ও তরুণী। মহারাজের নিকট বিদায় নিয়ে ভিক্ষু চলে গেল। রাজা এবং রাণীরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন।

এখন শুধু নারীময় জগৎ। জয়চন্দ্র বৃদ্ধ, কিন্তু তাঁর অধপাকা লম্বা ‍চুল মাঝখান দিয়ে ভাগ করে যেভাবে পিছনের দিকে নিয়ে বাঁধা, বিরাট গোঁফ যে রকম যম্নসহকারে আঁচড়ানো, বস্তালস্কারে তাঁর দেহ যেভাবে সজ্জিত, তাতে মনে হয়, তিনি যৌবনকে অনবসিত বলেই মনে করেন। মহারাজের ইঙ্গিতে এক পরিচারিকা তাঁর সামনে ঝুঁকে মদের পেয়ালা এগিয়ে দিল, এবং জনৈকা রাণী সেই পেয়ালা মহারাজের সামনে তুলে ধরল। পেয়ালঅটি রাণীর ঠোঁটে লাগিয়ে তিনি বললেন, “তোমার উচ্ছিষ্ট না হলে আমি কেমন করে পান করব?” এরপর তাঁর প্রিয়তমা রাণীরা একে একে প্রসাদ দিল তাঁকে। মহারাজের  মুখাবয়ব থেকে তুকীদের চিন্তা বিদুরিত হয়ে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। রাজার স্থল দেহ মসনদের ওপর ঢলে পড়লএবং কোনো রাণীকে তাঁর এপাশে কোনো রাণীকে ওপাশে টেনে তিনি বসালেন । কারও কোলে মাথা রাখলেন, কারও বুকের ওপর হাত রাখলেন। মদের পেয়ালা চলতে লাগল; কামোদ্দীপক হাসি-ঠাট্রাও চলতে থাকল। রাণীদের নাচের আদেশ দিলেন মহারাজা। বিষন্তনা, করস নিতদ্বিনী সুন্দরীরা ঘাঘরা গানের তালে তালে নাচ সুরু হল। একটা গান শেষ হলে রাজা সুন্দরীদের নগ্ন-নৃত্যেন্ত আদেশ দিলেন। নর্তকীরা বেশবুষা সব খুলে ফেলল, রইল শুধু পায়ের নুপুর। রানী এবং তরুনী পরিচারিকাদের সঙ্গে আলিঙ্গন, চুম্বন এবং হাস্য পরিহাস চলতে লাগল। নর্তকীদের মধ্যে যার নগ্নদেহ মহারাজকে আকর্ষণ করল, সে-ই এসে বসতে লাগল মহারাজের পাশে, অন্য একজন নগ্নিকা তার স্থান পুরণ করল। আর লাল হয়ে উঠল মহারাজের চোখ, কণ্ঠস্বরে সুরা প্রভাব বিস্তার করল; মহারাজ গান ধরলেন-

‘ধ্‌ধত,–তে রি তো- তোর্‌র্‌-তু—তুর্‌—কী—ঈ—।আ—া—ম্‌মার ইন্‌—ন্‌—দ্‌র-ও পুর্—র্‌—ঈ—তে—তে কো—কো—ওন্‌শ্‌—শালা—আ—স্‌—সে। স্‌—স্‌—সব্‌জোর্‌সে ন্‌—না—া—চো ।’

সকল রাণী আপন আপন বস্ত্রালস্কার খুলে ফেলল। ওদের তরুণ সুন্দর দেহের ওপর ঘনস্থল কবরী রাজার পছন্দ হল না। কবরী খুলে ফেলতে বললেন তিনি, সব ক’জনের মাথা থেকে কালনাগিনীর মতো দীর্ঘ বেণী নিতস্বের ওপর আকছড়ে পড়ল। মহারাজকে স্বয়ং সষ্ণুক খুলতে দেখে তাঁর পরিধেয় বস্ত্র খুলে দিল তরুণীরা। তাঁর লোলচর্ম শীর্ণ চিবুক, কাঁচা-পাকা গোঁফ, প্রসুতির স্তনের মতো ঝুলে পড়া বুক, মহাকুন্তের মতো উদর এবং শীর্ণ ঢিলে চর্মাবৃত ঊরু এবং জঙ্ঘা আর কর্কম লোমশ বাহু সাধারণ তরুণীরাও ঘৃণা না করে পারে না, কিন্তু এখানে এদের দেহ প্রাণ সবই এই বৃদ্ধের হাতে। কউ তাঁর দন্তহীন ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল , কেউ বা তাঁর দেহে আপন স্তনদ্বয় পীড়িত করতে লাগল, আবার কেউ তাঁর লোমশ বাহু নিজের কাঁধে বা গালে বুলিয়ে দিতে লাগল। কামোদ্দীপক গানের সঙ্গে সঙ্গে নাচ সুরু হল, রাণী এবং পরিচারিকাদের মাঝে দাঁড়িয়ে মহারাজও তাঁর বিশাল ভুড়ি নিয়ে রাচতে আরম্ভ করলেন।

“এস কবি কুল-তিলক।”—বলে রাজা এক আধাবয়সী পুরুষকে আসন দেখিয়ে দিলেন এবং সে বসবার কপর বড় দু’খিলি পান সসম্মানে এগিয়ে দিলেন।

কবির বয়স পষ্ণাশের ওপর কিন্তু তাঁর সুন্দর সুগৌর মুখমন্ডলে অতীত যৌবনের চাপ স্পট। গোঁফের রঙ কালো , পরণে শাদা ধুতি এবং শাদা চাদর ছাড়াও তাঁর গলায় সুন্দর এক রুদ্রাক্ষের মালা এবং কপালে ভস্মাষ্কিত চন্দ্রাকার তিলক। সোনার পাতে মোড়া সুগন্ধি পান মুখে দিয়ে কবি বলল,“দেব’যাত্রা কুশলেই সাঙ্গ হয়েছে? শরীর সুস্থ ছিল? রাত্তিরে আরামেই গুমিয়েছেন তো?”

“আমি এখন পুরুষত্বহীন হয়ে পড়েছি কবি-পৃঙ্গব।”

“মহারাজ, কবি শ্রীহর্ষকে আপনি খুব ব্যঙ্গ করলেন যাহোক।”

“পুঙ্গব তো ব্যঙ্গ নয়, প্রশংসাসুচক কথা।”

“পুঙ্গব বলদকেই বলে, মহারাজ।”

“জানি, কিন্তু সেই সঙ্গে শ্রেষ্ঠকেও পুঙ্গব বলে।”

“আমি তো একে বলদ অর্থে গ্রহণ করি।”

“এবং আমি শ্রেষ্ঠ অর্থে। আর তা’ছাড়া, তোমার মতো অন্তরঙ্গ ইয়ারের সঙ্গে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ না গেলে, কার সঙ্গে করা যাবে করি?”

“কিন্তু সে তো দরাবারে বসে নয়, মহারাজ।” নীচু গলায় শ্রীহর্ষ বলল কবির হাত ধরে দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে ক্রীঢ়া-উদ্যানের দিকে চললেন জয়চন্দ্র।

গ্রীষ্ম সুরু হয়েছে—মনোরম বাতাস, সবুজ রঙয়ের গাছগুলোকে আন্দোলিত করছে। দীঘির সোপানের ওপর অবস্থিত শুভ্র শিলাসনে বসে পাশের আসনে কবিতে বলতে বললেন রাজা, এবং তারপর বাক্যলাপ আরম্ভ করলেন। “রাত্তিরের কথা তুমি কি জিজ্ঞেস করছিলে কবি? আমি এখন বেশ অনুভব করছি যে, আমি বুড়ো হয়ে পড়েছি।”

“কেন?”

“উলঙ্গ সুন্দরীরাও আমার কাম জাগাতে পারছে না।”

“তা”হলে তো আপনি পুরো যোগী হয়ে পড়েছেন, মহারাজ!”

“এই যোগীর কাছে থেকে এই ষোল হাজার সুন্দরী কি করবে?”

“বিলিয়ে দিন মহারাজ, নেবার মতো লোক অনেক জুটে যাবে; অথবা গঙ্গাতীরে জলকুশ দিয়ে ব্রাহ্মণদের দান করে দিন—সর্বেষামেব দানানাং  ভার্ষাদানং বিশিষ্যতে!”

“তাই করতে হবে। বৈদ্যরাজ চক্রপাণির বাজীকরণ নিষ্ফল হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র তোমার কাব্যরসের আশাতেই আছি।”

“নগ্ন-সৌন্দর্য-রস যেখানে কিছু করতে পারেনি, কাব্যরস সেখানে কি করবে মহারাজ?

তা’ছাড়া আপনি এখন ষাটের ওপরে চলে এসেছেন।”

“আমি কনৌজে আসার পর দু’মাস কেটে গেছে, কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে এতদিন দখো করনি কেন?”

“চৈত্রের নবরাত্রিতে আমি ভগবতী বিদ্ধ্যবাসিনীর চরণ দর্শনে গিয়েছিলাম।”

“ঐ পথেই তো আমার নৌকা এসেছে, যদি জানতাম তা’হলে ডেকে নিতাম।”

“অথবা ওখানে নেমে কুমারি-পূজায় ব্যাপৃত হয়ে যেতেন।”

“তা’হলে কবিবর, তুমিও কুমারী-পূজায় জন্যই ওখানে যাওনি তো!”

“মহারাজ, আমি ভগবতীর উপাসক—শাক্ত।”

“কিন্তু তুমি যেভাবে রাম-সীতার বন্দনা কর, তাতে মনে হয় যেন খাঁটি বৈষ্ণব।”

“অন্তঃ শাক্ত। বহিশ্যৈবাঃ সভামধ্যে চ বৈষ্ণবাঃ।”

“সভামধ্যে তুমি বৈষ্ণব তা’হলে?”

“হতেই হয় মহারাজ! আপনার মতো অন্যের জিভ টেনে ধরতে তো পারি না।”

“ধন্য হে তুমি বহুরূপী!”

“শুধু এইটুকুই নয় মহারাজ, আমি বুদ্ধকেও আমার আরাধ্য করে নিয়েছি।”

“সুগত—ভগবান তথাগতকেও?”
“ভগবান!”

“হ্যাঁ, কিন্তু এখানে বসে ও নাম শুনলে আমারও চক্ষুলজ্জা হয়!”

“মহারাজ, শাক্তদের সুবিধার জন্য সুগতের পূজা সরল করে দিয়েছি বজ্রযান রূপে।”

“ঠিক বলেছ বন্ধু, এই জন্যেই তো তাকে সহজিয়া বলা হয়।”

“এই সহজিয়া সিদ্ধগণের দোহা এবং গানে কোনো কবিত্বের স্ফুরণ আমি দেখতে পাই না; কিন্তু পঞ্চ ম-কার (মদ, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন) প্রচার করে যতটা জন-কল্যাণ এরা করেছেন, তার জন্য আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ।”

“কিন্তু আমার পক্ষে এখন আর এই পঞ্চ ম-কারের উপাসনা করা দুস্কর।”

“বজ্রযানের সঙ্গে নাগাজুর্নের মাধ্যমিক দর্শন—একেবারে যেন সোনায় সোহাগা।”

“তোমার কাব্যরস তো তবু চেখে দেখতে পারি, যদিও ওতেও কখনও কখনও মাথা ঘুরে যায়; কিন্তু এই দর্শনশাস্ত্র যেন পর্বতপ্রমাণ বোঝা  হয়ে চেপে বসে।”

“তা’হলে মহারাজ, নাগাজুর্নের দর্শন বহু মিথ্যা ধারণা দূর কর।”

“কিন্তু তুমি তো বেদাস্ত-বিশারদ কবি!”

“আমার গ্রন্থকে আমি বেদান্ত বলেই প্রসিদ্ধ করে নিয়েছি মহারাজ, কিন্তু ‘খণ্ডন-খণ্ড খাদ্য’-তে নাগার্জুনের চরণধুলিকেই বিতরণ করেছি সর্বত্র।”

“মনে তো থাকবেই না, তবু বল শুনি নাগার্জুনের মূল কথা কি?”

“সিদ্ধরাজ মিত্রপাদ তো নাগার্জুনের দর্শনেই বিশ্বাস করেন।”

“আমার দীক্ষাগুরু?”

“হ্যাঁ। নাগার্জুন বলেন—পাপ-পূণ্য, আচার-দুরাচার সবই কল্পনা, জগতের সত্তা-অসত্তা কিছুই প্রমাণ করা যায় না। স্বর্গ-নরক, বন্ধন-মোক্ষ সবই ভ্রম। পূজা, উপাসনা এগুলো মূর্খ লোকদের বঞ্চনা করার জন্য; দেবদেবী সম্বন্ধে লোকেত্তর সব ধারণাই অলীক।”

“আমিও তো এই দর্শনকে অনুসরণ করেই জীবন কাটিয়েছি কবি!”

“সকলেই কাটায় মহারাজ, মুর্খেরাই শুধু নগদ ছেড়ে ধারের পেছনে ছোটে!”

“কিন্তু এখন যে আমার নগদকে সামনে ফেলে রেখে শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয় বন্ধু! কিন্তু তোমার এখনও বয়স পেরোয়নি বলেই মনে হয়।”

“আপনার চেয়ে আমি আট বছরের ছোট, তা’ছাড়া একটির বেশী বিয়েও করিনি।”

“বেশী বিয়ে করলে বিয়ের পাকেই ক্লান্ত হয়ে মারা পড়ে মানুষ!”

“আমার ঘরে একটি মাত্র ব্রাহ্মণীই আছে মহারাজ।”

“এবং তোমার ধারণা যে, সমগ্র দুনিয়া তাই বিশ্বাস করবে—কবি শ্রীহর্ষ সেই দাঁতভাঙা একটি বুড়ির প্রতি একান্ত অনুরক্ত!”

“বিশ্বাস করবে এবং করছেও মহারাজ! আমার গ্রন্থে আমি আমার সমাধিস্থ হয়ে ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকারর কথা লিখেছি।”

“তোমাদের মাধ্যমিক দর্শনে তা’হলে ব্রহ্ম এবং তাঁর সাক্ষাৎকারের স্থানও আছে?”

“কিসের স্থান ওতে নেই মহারাজ!”

“প্রজাদের দৃষ্টি চিরকালের মতো অন্ধ করে রাখতে হবে তাই সব রকমের সাক্ষাৎকারের কথা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া দরকার!”

“ধর্মের ওপর থেকে আপনার বিশ্বাস তবে উবে গেল মহারাজ?”

“সে আমি জানি না, আমি বুঝতেই পারি না, কখন বিশ্বাস আসে কখন চলে যায়। তোমাদের মতো ধর্মাত্মা, ব্রাহ্মণদের আচার-উপদেরশ দেখে-শুনে মন স্থির করাই আমার পক্ষে মুস্কিল। আমি শুধু এইটুকু বুঝি, দান-পূণ্য, দেবালয়-সুগতালয় নির্মাণ ইত্যাদি যা ‍খুশী ধর্মে বলে তা কর; কিন্তু জীবনের নগদ সম্পদকে হাত থেকে চলে যেতে দিও না।”

প্রেম এবং ধর্ম থেকে এঁদের আলোচনা রাজকার্যে এসে পড়ল। শ্রীহর্ষ বললেন, “মহারাজ কি পৃথ্বিরাজকে সাহায্য করতে সত্যিই অস্বীকার করেছেন?”

“তাকে সাহায্য করার কি দরকার আমার? নিজে গায়ে পড়ে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই বাধিয়েছে সে,নিজেই ভুগবে তার ফল!”

“আমারও সেই মত মহারাজ, চক্রপণি মিছিমিছি ফালতু বিরক্ত করছে।”

“তার কাজ হল চিকিৎসা করা। সেখানেও সে কিছুই করে উঠতে পারছে না। তিনবার আমি বাজীকরণ চিকিৎসা করিয়েছি, কিন্তু সবই বিফলে গেছে। এখন উনি এসেছেন রাজকার্যে পরামর্শ দিতে!”

“ও একটা নিরেট মুর্খ, অনর্থক ওকে মাথায় তুলে রেখেছেন যুবরাজ।”

“ঠিক বলেছেন বৈদ্যরাজ! গহড়বারের মূল ঘুণ ধরাতে আরম্ভ করেছে শ্রীহর্ষ। বাবাকে সে অন্ধ কামুক বানিয়ে রেখেছে।”

!বিশ বছর আমি কন্যাকুত্তের রাজবৈদ্য, আমার ওষুধের কিছু গুণ অন্তত আছে।”

“ সে গুণের কথা সারা দুনিয়া জানে বৈদ্যরাজ।”

“কিন্তু বাজীকরণের ব্যাপারে মহারাজ খুশী ননা। অতিকামুক পুরুষের তারুণ্যকে ততদিন পর্যন্ত জীইয়ে রাখা যায় কুমার? এই জন্যই আহার-বিহারে সংযম অভ্যাস করার কথা লেখা হয়েছে। আমি তো মহারাজকে বলেছি যে, আমাকে মল্লগ্রাম (মালাঁও—গোরক্ষপুর) গিয়ে থাকতে দিন। কিন্তু উনি তাতেও রাজী নন।”

“বাবার দোষে  আমাকে ছেড়ে যাবেন না বৈদ্যরাজ। গহড়বারের যা কিছু আশা-ভরসা সবটাই আপনার ওপর।”

“আমাকে দিয়ে কিছু হবে না কুমার, হবে হরিশচন্দ্রকে দিয়ে। গহড়বার বংশে যদি জয়চন্দ্রের জায়গায় হরিশ্চন্দ্র থাকতেন তো কত ভালো হত। চন্দ্রদেবের সিংহাসনে হরিশন্দ্রেরই প্রয়োজন ছিল।”

“ অথবা যদি শ্রীহর্ষের জায়গায় বৈদ্যরাজ চক্রপাণি জয়ন্দ্রের প্রাণের বন্ধু হতেন! কিন্তু গহড়বার সুর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত আপনাকে থাকতেই হবে বৈদ্যরাজ।”

“অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও অস্তে যাওয়ার জন্য প্রস্তত কুমার। কিন্তু শুধু গহড়বার সূর্য অস্ত যাবে না, হিন্দুদের সূর্যও অস্ত যাবে। আমরা মল্লগ্রামের ব্রাহ্মণেরা শুধু শাস্ত্র ও ধর্মাচরণেই অভিজ্ঞ নই, অসি চালনাতেও আমরা দক্ষ। এই জন্য আমারও ত্বকীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই কুমার।”

“নিজের জামাইকে সাহায্য করতেও আমার পিতা রাজী নন। পথ্বিরাজ আমার আপন ভগ্নীপতি। তার সঙ্গে সংযুক্তার প্রণয় ছিল এবং নিজের ইচ্ছাতেই সংযুক্তা চলে গিয়েছিল। এতে বাবার অখুশী হওয়ার কারণ থাকতে পারে?”

“পৃথ্বিরাজ বীর, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।”

“ঠিক কথা। বীরত্বের জন্যই ত্বর্কী সুলতানের সঙ্গে লড়তে পারছে। না হলে আমাদের এই কান্যকুজ্বের তুলনায় কতটুকু তার রাজ্য? সুলতানের দৃষ্টি তো দিল্লীর ওপর নয়, কান্যকুব্জের ওপর। দু—শ’ বছর থেকে ভারতের সব চেয়ে বড় রাজ্য কনৌজ। কিন্তু তাঁকে বোঝাবে কে? বুঝবার মতো বুদ্ধির মাথা খেয়ে বসে আছেন বাবা।”

“এসময় যদি তিনি যুবরাজের হাতে রাজ্যের শাসনভার তুলে দিতেন!”

“আমার একবার মনে হয়েছিল বৈদ্যরাজ, যে বাবাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিই কিন্তু আপনার শিক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। বিশ বছর ধরে আপনার দেওয়া প্রতিটি শিক্ষা আমার কাছে হিতকারী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। এই জন্যেই তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারিনি আমি।”

“কান্যকুব্জের সিংহাসন জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে কুমার। সামান্য ভুল পদক্ষেপেই সমগ্র ইমারত ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। পিতাপুত্রের কলহের সময় এখন নয়।”

“এখন কি করা যায় বৈদ্যরাজ? আমাদের সমস্ত সেনাপতি ও সেনানায়কেরা ভীরু এবং অযোগ্য। তরুণ সেনানায়কদের মধ্যে অবশ্য যোগ্য এবং সাহসী কিছু লোক আছে, কিন্তু বুড়োরা পথ বন্ধ করে বসে আছে। মন্ত্রীদের ঐ একই অবস্থা, তারা রাজার প্রশস্তি গাওয়াকেই শুধু আপন কর্তব্য বলে জ্ঞান করে।”

“রাজান্তঃপুরে মেয়ে-বোনকে পাঠিয়ৈ যারা পদলাভ করে তাদের এই অবস্থাই হয়। কিন্তু অতীত নয়, ভবিষ্যতের চিন্তাই আমাদের করতে হবে এখন।”

“আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে সমস্ত হিন্দু তরুণের হাতে অস্ত্র তুলে দিতাম।”

“কিন্তু এ হল বংশানুক্রমিক ত্রুটি, যাতে শুধু রাজপুতকেই যুদ্ধের অধিকারী করে রাখা হয়েছে। মহাভারতে দ্রোণ এবং রুপের মতো ব্রাহ্শণরাও যুদ্ধ করেছে’ কিন্তু পরে শুধু এক জাতির…”

“এই জাত-বেজাতের ব্যাপারটাও আমাদের সামনে এক বিরাট বাধা।”

“সবচেয়ে বড় বাধা, কুমার। পূর্বজগণের দ্বারা অনুষ্ঠিত সৎকাজের জন্য সর্বানুভব করা এক জিনিস কিন্তু চিরদিনের জন্য হিন্দুদের সহস্রভাগে ভাগ করে রাখা মহাপাপ।”

“এর ফল এখন ভুগতে হচ্ছে। কাবুল এখন আর হিন্দুদের হাতে নেই, লাগোরও গেছে, এ-বার দিল্লীর পালা।”

“আজ যদি আমরা পৃথ্বিরাজের সঙ্গে এক হয়ে যুদ্ধ করতে পারতাম?”

“উঃ, কি দুর্ভাগ্য, বৈদ্যরাজ!”

“দুর্ভাগ্যের বোঝা ভারী হয়ে আামদের নৌকা ডুবতে যাচ্ছে কিন্তু মোহাচ্ছন্ন আমরা! কিছুটা বোঝা নামিয়ে দিয়ে নৌকা হাল্কা করতে চাইছি না।”

“ধর্ম থেকে অজীর্ণ হয়েছে, বৈদ্যরাজ।”

“ধর্মের ক্ষয়রোগ! কি অত্যাচারই না আমরা করেছি? কোটি-কোটি বিধবাকে প্রতি বছর আগুনে পুড়িয়েছি। নর-নারীকে নিয়ে পশুর মতো বেচা-কেনা করেছি। দেবলয় এবং বিহারে সোনা-চাঁদি আর হীরামোতির বাহার বসিয়ে স্বেচ্ছ লুণ্ঠনকারীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি, আর শুত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করার সময় আত্মকলহে ডুবে থেকেছি। আপন ইন্দ্রিয়লালসা চরিতার্থ করার জন্য প্রজাদের শ্রমার্জিত সম্পদকে নিষ্ঠুরভাবে লুণ্ঠণ করেছি আমরা।”

“শুধু লালসা নয় বৈদ্যরাজ, উদ্মত্ততা। নিজের কাম-সুখ চরিতার্থ করতে প্রিয়তমা সহৃদয়া একজন স্ত্রী-ই যথেষ্ট, আর ইন্দ্রিয় লোলুপতাকে প্রশমিত করতে পঞ্চাশ হাজারও কিছুই নয়।এখানে ভালোবাসার কোনো স্থান থাকতে পারে না। গত সংক্রান্তির দিন বাবা যখন আপন অন্তঃপুরবাসিনী স্ত্রীলোকদের অনেককেই ব্রাহ্মণদের দান করে দিলেন, তখন তারা কেউই মহারাজের জন্যে একফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি বরং ভিতরে ভিতরে খুশীই হয়েছে। ভামা আমাকে এ কথা বলেছে।”

“দান গ্রহণকারী ব্রাহ্মণের ঘরে খুব বেশী হলে একটি বা দুটি সতীন থাকতে পারে, ষোল হাজারের ভীড়ে সেখানে থাকবে না। অবশ্য একেও আমি দাসত্ব বলে মনে করি। স্ত্রী লোক কি একটা সম্পত্তি যে, তাকে এইভাবে দান করা যাবে?”

“আমাদের চেষ্টা করতে হবে সমবেতভাবে তুর্কীদের মোকাবিলা করার।”

“সে-সব তো মহারাজের হাতে। ভণ্ড শ্রীহর্ষ তাঁর কানের পাশে লেগে রয়েছে।”

অষ্টমীর রাত। সবে মাত্র চাঁদ উঠেছে; গোটা পৃথিবীটা আলোকিত হয়ে উঠতে এখনও দেরী। চারিদিকে অখণ্ড নিস্তব্দতা, তারই বুক চিরে মাঝে মাঝে পেচকের ভীতিপ্রদ ডাক শোনা যাচ্ছে। নিঃসীম এই নিস্তব্দথার মাঝে দু’জন লোক তীর থেকে দ্রুত যমুনার জলে নেমে পড়ল। মুখে আঙ্গুল দিয়ে তিনবার শিস দিল তারা। যমুনার অপর দিক থেকে একটি নৌকা আসতে দেখা গেল। নীরব-প্রবাহিত জলস্রোতে ধীরে ধীরে দাঁড় টেনে মাঝারি গোছের এক নৌকা পারে এসে ভিড়ল। লোক দু’জন নিঃশব্দে নৌকায় উঠে পড়ল। ভিতর থেকে কে যেন জিজ্ঞাসা করল,“সেনানায়ক মাধব?”

“হ্যাঁ আচার্য, আলহনও আমার সঙ্গে এসেছে। কুমার কেমন আছেন?”

“এখন পর্যন্ত তো জ্ঞান হয়নি; তার অবশ্য আমি সামান্য ওষুধ দিয়ে রেখেছি। কি জানি, জ্ঞান হলেই যদি রণক্ষেত্রে ফিরে যেতে চায়!”

“কিন্তু আচার্য, আপনার আদেশ কখনও অমান্য করতে পারেন না তিনি।”

“ সে আমিও বিশ্বাস করি; কিন্তু এই-ই ভালো, ক্ষতের ব্যাথাও এতে কমে যাবে।”

“ক্ষততে ভয়ের কিছু নেই তো, আচার্য?”

“না সেনানায়ক, ক্ষত আমি সেলাই করে দিয়েছি এবং রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্বলতা খুবই আছে, কিন্তু ভয়ের কিছু নেই আর। এ-বারে বল কি-কি কাজ শেষ করে এলে তুমি? মহারাজের শব রাজান্তুঃপুরে পাঠিয়ে দিয়েছ?”

“হ্যা।”

“এখন তবে  রাজান্তঃপুরের স্ত্রীলোকেরা মহারাজের সঙ্গে সহমরণে যাবে!”

“যার যাওয়ার সে যাবে।”

“আর সেনাপতি, তার খবর কি?”

“বুড়ো সেনাপতি তো মরতে মরতে শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়াল। অবস্থা সঙ্গীন দেখে বহু সেনানায়ক পালিয়েছে, কিন্তু পালাবার কৌশল তারা জানে না। আমি আশা করি না যে, ওদের মধ্যে কেউ বেচেঁ আছে।”

“এ-সব ব্যাপার যদি তিন বছর আগে ঘটত এবং কুমার হরিশ্চন্দ্র যদি আমাদের রাজা আর তুমি মাধব কান্যকুব্জের সেনাপতি হতে!”

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মাধব বলল, “আপনার প্রতিটি কথা তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার, আচার্য। মহারাজকে আপনি অনেক করে বুঝিয়েছিলেন যে, পৃথ্বিরাজের সঙ্গে এক হয়ে ত্বকীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত, কিন্তু সে সবই অরণ্যে রোদন হয়েছে।”

“এখন আপসোশ করে কোনো লাভ নেই। কি কি ব্যবস্থা করলে বল।”

“পঞ্চাশ জন করে ভাগ করা সৈন্যদলে বোঝাই পাঁচশ নৌকা এখনই এসে পড়বে। গাগা, মোগে, সলখুর নেতৃত্বে গোটা সৈন্যবাহিনীটাকে ভাগ করে আমি আদেশ দিয়ে দিয়েছি যে, চন্দাবর থেকে পুবে সরে এসে তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধ কর—সম্মুখ-সমরে কম এগুবে, অতর্কিত আক্রমণই বেশী চালাবে এবং পরিস্থিতি প্রতিকুল হয়ে পড়েছে দেখলে পুবদিক হঠে আসবে।”

“কনৌজের রাজপ্রাসাদ….?”

“সেখান থেকে জিনিস সরানো সম্ভব, সরিয়ে ফেলেছি আমি দু’দিনে আগে সঙ্গাতেই অনেকগুলো নৌকা নামিয়ে দিয়েছি।”

“এই জন্যই তোমাকে সেনাপতির রোষ থেকে বাঁচিয়েছিলাম মাধব। না হলে নিজের আগে, তোমাকেই সে মেরে ফেলত। তোমাকে এবং কুমারকে জীবিত দেখে আমি বড়ই সুখী। হিন্দুদের কিছু আশা রইল। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে, প্রতি পরমানু পরিমাণ শক্তি বুঝে-শুনে ব্যয় করে লড়তে হবে আমাদের।”

“কতকগুলো নৌকা আসছে বলে মনে হচ্ছে আচার্য?”

“সেনানায়ক আলহন, ওগুলো এলেই ওদের সব এখানে থেকে চলে যাওয়ার আদেশ দিয়ে দেবে।”

“আচ্ছা আচার্য’—বিনীতভাবে বলল আলহন।

“গলুয়ের ভিতরে চল আধব। ওখানে অন্ধকার রয়েছে—ইচ্ছা করেই আমি ওখানকার প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছি।” একটু এগিয়ে তিনি ডাকলেন, “রাধা!”

“বাবা!” এক তরুণী নারীকণ্ঠ থেকে আওয়াজ এল। চক্রপাপি মাধবের দিকে ফিরে বললেন, “কেউ বৈদ্যরাজ বলে, কেউ আচার্য, কেউ বা বাবা! এ-সব মনে রাখাও আমার পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়েছে। তোমরা সবাই আমার ছেলেবেলার নাম ‘চক্কু’ বলে আমাকে ডাকবে।”

“উহু। স্ত্রীলোকের অভ্যাস বদলানো শক্ত, এ জন্য আমরা আপনাকে বাবা চক্রপাণি পান্তেয়র জায়গায়,শুধু বাবা বলব।”

“বেশ! চল, বাতি জ্বলে গেছে।”

সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামল দু’জনে। নৌকায় দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে পাটাতন, তার নীচে পর পর দুটো কুঠুরী; নৌকার একদিকে খানিকটা জায়গা খালি। দু’জনে একটা কুঠুরীর ভিতর ঢুকল। প্রদীপের মৃদু আলোয় একটা খাট দেখা যাচ্ছে। আকণ্ঠ সাদা শাল ‍মুড়ি দিয়ে একটা লোক শুয়ে রয়েছে। খাটের পাশে মোড়ার ওপর থেকে এক তম্বী উঠে দাঁড়াল। চক্রপাণি বললেন, “কুমারের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো ভামা?”

“না বাবা, শ্বাস-প্রশ্বাস নেই এক রকম ভাবেই চলছে।”

“ঘাবড়ে যাওনি তো তুমি?”

“চক্রপাণির ছত্র-ছায়ায় থেকে ঘাবড়াব? গহড়বার বংশ যদি প্রথমেই তাদের এই গুরু দ্রোণেচার্ষাকে চিনতে পারত!”

“আমাদের প্রধান সেনাপতি পরম সহায়ক মহারাজাধিরাজ হরিশ্চন্দ্রের সেনাপতি জানাল মাধব এসে গেছে দেখ।”

“মহাদেবী ভামা, আপনাদের সেবক মাধব সেবার জন্য উপস্থিত”—এই বলে অভিবাদন জানাল মাধব।

“মাধবের সঙ্গে অপরিচিত নই আমি। কুমারের পাশাখেলার সঙ্গীকে কি ভুলতে পারি কখনও?”

“আর যার অমিত বীর্ষ গহড়বার বংশের ধূলি-লুণ্ঠিত লক্ষ্মীকে পুনরায় তুলে ধরবার শক্তি রাখে ভামা!”

“আপনার মুখে “ভামা” ডাক কত মধুর শোনায় বাবা!”

“নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যায় বোধহয়, না?”

“না বাবা, রাজকুলে আমাদের অন্য রকম আবহাওয়ার সৃষ্টি করতে হবে। উঃ কি মিথ্যা ঠাট, কি ভণ্ডামি! মানুষের মধ্যে সহজ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আমার শ্বশুরের সঙ্গে পুরাতন রাজকুলের নীতিকেও শেষ করে দিতে হবে।”

“শেষ হয়ে গেছে পুত্রী। বহুদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে তা। কুমারের অন্তঃপুর দেখেছ তো তুমি?”

চোখের জল মুছে ভামা বলল, “আপনিই আমাদের মানুষ করেছেন বাবা।”

“না পুত্রী, কুমার হরিশ্চন্দ্রের জায়গায় এ যদি অন্য কেউ হত, তবে আমাকে শুধু শূণ্য চেয়েই থাকতে হত। এ সব কিছুই কুমার হরিশ্চন্দ্র…”

“বাবা!”

কুমারের চোখের পাতা অর্ধ উম্মীলিত হতে দেখা গেল। দৌড়ে তার কাছে গিয়ে ভামা বলল, “চন্দ্র আমার! রাহুর গ্রাসমুক্ত চাঁদ!”

“ঠিক বলেছ ভামা! কিন্তু এইমাত্র যেন বাবার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিলাম আমি?”

“বাবা?”

“সে বাবা নয়, যিনি গহড়বারের সূর্যকে ডুবিয়ে দিয়েছেন; এইবার যাকে তুমি বাবা বলে ডাকলে, আর আমিও যাকে বাবা বলেই ডাকব।”

প্রদীপের আলোয় কুমারের পাংশু চেহারা দেখে তার কপালে হাত রেখে চক্রপাণি বললেন, “শরীর কেমন আছে কুমার?”

“শরীর এত ভালো যে, মনে হয়, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে আহত হয়ে ফিরিনি।”

“ক্ষত কিন্তু খুব সাঙ্ঘাতিক ছিল কুমার!”

“হবে, কিন্তু আমার পীষুবপাণি বাবাও যে কাছে ছিল আমার!”

“একটু কম কথা বল ‍কুমার।”

“বাবা চক্রপাণির মুখের প্রতিটি কথা হরিশ্চন্দ্রের কাছে ব্রক্ষবাক্যতুলা।”

“কিন্তু এমন হরিশ্চন্দ্র চক্রপণির কোনোই কাজে আসবে না যে!”

“ এ হল শুধু হরিশ্চন্দ্রের শ্রদ্ধার কথা; কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনার প্রশ্ন যেখানে, সেখানে হরিশ্চন্দ্র ব্রহ্মবাক্যকেও যাচাই না করে গ্রহণ করবে না।”

“আর বাবা চক্রপাণিকে পেয়ে…—একটু  জল।”

তাড়াতাড়ি গ্লাসে জল গড়িয়ে দিল ভামা। নৌকা চলতে শুরু করেছে দেখে বাবা বললেন, “আমরা দ্বিতীয় রাজধানী বারাণসী চলেছি কুমার। সেনাপতি মাধব সৈন্যবাহিনীকে যথারীতি আদেশ দিয়েছে। সৈন্যরা এদিক থেকে তুর্কীদের গতিরোধ করবে। ওদিকে বারাণসীতে গহড়বার লক্ষ্মীর জন্য নতুন সৈন্য সংগ্রহ করব আমরা।”

“না বাবা, আগে যেমনটি বলতেন আপনি, সেই হিন্দু রাজলক্ষ্মী পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার আয়োজন করুন। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত এই রাজলক্ষ্মী  এ-বার হিন্দুর রাজলক্ষ্মী হবে। হিন্দুর বাহুবলে জয় করেই একে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”

“চণ্ডাল এবং ব্রাহ্মণের ভেদাভেদও ঘুচিয়ে দিতে হবে।”

“নিশ্চয়ই গুরু দ্রোণ।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *