১৪. কর্মজীবন : প্রথম পর্ব

কর্মজীবন : প্রথম পর্ব

১৯৪৭-এর শেষাশেষি এম.এ. পরীক্ষা হয়ে গেল। দেশ তখন স্বাধীন। কিন্তু চাকরিবাকরির ব্যাপারে, অর্থাৎ ওইসব বস্তুর অভাবের ব্যাপারে, ইংরেজ শাসনের স্বর্ণযুগ তখনও সব ক্ষেত্রে শেষ হয়নি। সুযোগসুবিধার দিক থেকে অন্তত মধ্যবিত্তর জীবনে স্বাধীনতা কী বিরাট পরিবর্তন এনেছিল সে বিষয়ে—যে-আঁতেলবৃন্দ তার সুবিধা পুরোপুরি ভোগ করে সার্বভৌম ভারত রাষ্ট্রকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপের পরামর্শ দেন, তাঁদের সংবিৎ ফেরাবার জন্য—সবিনয়ে কিছু তথ্য নিবেদন করি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত সরকার সর্বস্তরে বেশ কিছু নতুন চাকরি সৃষ্টি করেন। ইংরেজ চলে যাওয়ায় উপরের দিকে বেশ কিছু পদ খালি হয়। তাছাড়া ঔপনিবেশিক শাসনের শেষের দিকে সর্বভারতীয় ক্যাডারগুলিতে নতুন লোক নেওয়া প্রায় বন্ধ ছিল। আর স্বাধীন ভারত সরকার আর্থিক এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তার জন্যও অনেক নতুন পদ সৃষ্টি হয়। আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে যাঁরা পরীক্ষায় মোটামুটি ভাল করেছিলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই সর্বভারতীয় সরকারি চাকরিগুলির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসেন। যাঁদের পরীক্ষার ফল সে তুলনায় নিরেস, তাঁরা রাজ্য সরকারের চাকরিগুলির চেষ্টায় পরীক্ষা দেন। এ স্তরেও মুসলমান কর্মচারীরা পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় বহু পদ খালি হয়েছিল। ফলে চাকুরিজীবী বাঙালির জীবনে স্বাধীনতা কিছু সুযোগ-সুবিধা এনে দিয়েছিল সন্দেহ নেই। বাঙালি মধ্যবিত্তর জীবনে যেসব সমাধানহীন সমস্যার আবির্ভাব হয়, তার মূলে ছিল দেশবিভাগ।

শিক্ষাক্ষেত্রে পুরনো জমানার রেশ বেশ কিছুদিন চলে। আমি মাস্টারি করব সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বন্ধুবান্ধব শুভার্থীদের মধ্যে দুই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখি। আমার মা-বাবা ছাড়া অন্যান্য গুরুজন এবং তাঁদের প্রজন্মের বন্ধুবান্ধব পরিচিত মানুষরা আমার জন্য কিছুটা শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। নতুন সব সুযোগসুবিধা আসছে, সেগুলি উপেক্ষা করে এমন ভুলও কেউ করে? বাবার এক বন্ধু বললেন, “ছেলেটাকে এখনও বোঝাও। বাকি জীবন আধপেটা খেয়ে থাকবে?” ব্যবসাদার এক পাঠান বন্ধু ভারি চমৎকার একটি গল্প বললেন। সরদারদের জিরগা বসবে। প্রধান সরদার ভৃত্যকে হুকুম দিয়েছেন—যেন প্রত্যেক সরদারের জন্য এক একটি ভেড়ার মাথার ব্যবস্থা থাকে। পাঠানদের প্রিয় খাদ্য ভেজা বা মগজ। সুতরাং হুকুম হল যেন যথেষ্ট মগজওয়ালা ভেড়া জোগাড় হয়। কিন্তু মেষমুণ্ড যখন ভাঙা হল তখন দেখা গেল কোথাও কোনও মগজের চিহ্ন নেই। ক্রোধে গরগর ঘূর্ণিতমুণ্ড সরদার নাঙ্গা তলোয়ার হাতে মেষবিক্রেতার বাড়ি হাজির। এই মারে তো সেই মারে অবস্থা। জোড়হস্ত ভেড়াওয়ালা বলল, “করহ প্রভু অবধান। তুমি মগজওয়ালা ভেড়া চেয়েছিলে। তাই বেছে বেছে আমি সব এলেমদার মাস্টার পণ্ডিত ভেড়ার মুণ্ড পাঠিয়েছিলাম। এখন দেখছি ওটা ভুল হয়েছিল। পড়িয়ে পড়িয়ে বেচারাদের মগজ একেবারেই ক্ষয়ে গেছে। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।” দীর্ঘ দিন মাস্টারি করে কাহিনিটির অন্তর্নিহিত সত্য কিছুটা উপলব্ধি হয়েছে। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া সম্ভবত করা যায় না, তবে ওই অপচেষ্টায় বেশি দিন নিযুক্ত থাকলে, যে পেটায় তার গাধা বনার বিলক্ষণ সম্ভাবনা থাকে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

আমার যেসব শুভার্থী বন্ধুবান্ধব “কে তুই, ওরে দুর্মতি, মরিবার তরে করিস আরতি” বলে সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন না, তাঁরা আমার দুঃসাহসকে স্বাগত জানিয়ে জ্ঞানপীঠে আত্মনিবেদিত শহিদ বলে আমাকে অভিনন্দিত করলেন। এর ফলটা খুব ভাল হয়নি। যেমন ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর নিজেকে মহাপণ্ডিত জ্ঞান করতে শুরু করেছিলাম, তেমনই বন্ধুবান্ধবের এই স্তুতিবাক্য শুনে বিদ্যার হাড়িকাঠে স্বেচ্ছায় নিবেদিত বলি বলে নিজেকে কল্পনা করে বড়ই গরিমা বোধ করেছিলাম। যখন চাকরিবাকরি জোটে না তখন এই ধরনের আত্মতৃপ্তি অনেকটা সান্ত্বনা দেয় সন্দেহ নেই।

আসলে আমার শুভার্থীরা একটা ভুল করেছিলেন। কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা জীবনে শুধু বিশেষ একটা কোনও কাজই করতে পারে। আর সব কিছুই তাদের কাছে ভয়াবহ পরধর্ম। সেইসব পথে যাওয়া তাদের পক্ষে সত্যিতেই মহতী প্রণষ্টি। বেশ অল্প বয়সেই বুঝতে পারি যে, বইপত্র ঘাঁটা, পড়ানো আর লেখা ছাড়া অন্য কোনও কাজ আমার দ্বারা–সম্ভব নয়। ওই পথে গিয়ে অর্ধাহারে থাকলেও যে-তৃপ্তিটুকু পাব, আর কোনও উপায়ে তা পাওয়ার আমার সম্ভাবনা নেই। আমার বাবা এই কথাটা বুঝেছিলেন। তাই কিছুটা দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও অন্য কিছু করার জন্য কখনও কোনও চাপ দেননি।

স্বাধীনতা পাওয়ার ঠিক পরে পরে অন্য সুযোগ থাকতে যে-লোক মাস্টারি করতে গেল তাকে হয় শহিদ নয় পাঁঠা মনে করাটা সম্পূর্ণ যুক্তিবিরুদ্ধ ছিল না। আমার বন্ধুবান্ধবরা যখন চাকরির সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, আমি তখন গবেষণা করব বলে মাস্টারমশাইদের দ্বারস্থ হলে তাঁরা আমাকে অন্য পথ দেখার পরামর্শ দেননি ঠিকই। কিন্তু তাঁরা স্পষ্টই বলেন, “দেখ বাপু, শিগগিরই কোনও টাকাকড়ি পাওয়ার ভরসা কোরো না কিন্তু।” ইতিহাস বিভাগে তখন একটিই রিসার্চ ফেলোশিপ। তার অর্থমূল্য মাসিক একশো টাকা। সেটি পেয়েছে বি.এ. এবং এম.এ. দুই পরীক্ষায়ই ফাস্ট ঈশান স্কলার অশোক। সে আই.এ.এস হওয়ার আশায় পরীক্ষা দিচ্ছে। যতদিন না সে তার নতুন চাকরিতে যায় ততদিন ফেলোশিপটি পাওয়া যাবে না। প্রাইভেট কলেজে পার্ট টাইম চাকরি মাঝে মাঝে খালি হয় ঠিকই, মাইনে মাসিক পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তরের মধ্যে। তবে ঠিক তখন কোনও জায়গায় কোনও পদ খালি নেই। সুতরাং রোজগারের একমাত্র পথ প্রাইভেট টিউশনি। সবে পাস করে বের হয়েছি, তাই ও ব্যাপারেও একটু অসুবিধে আছে। তা হলেও সপ্তাহে তিন ঘণ্টা পড়ালে মাসে অন্তত পঁচিশ টাকা তো পাবই। তিন-চারটে টিউশনি করলে মোটামুটি চলে যাওয়া উচিত (সত্যিতে এই সময় মাসে একশো টাকায় একজন লোকেরও চলা সম্ভব ছিল না, যদি না সে পিতার হোটেলে বাস করত)। আর একটা উপদেশও মাস্টারমশাইরা দিলেন। অনেক প্রাইভেট কলেজই কোনও না কোনও বনেদি পরিবারের পারিবারিক সম্পত্তি ছিল। জানলাম—তাঁদের বাড়ি এক-আধটুকু যাওয়া-আসা রাখলে আখেরে কাজ দিতে পারে। সে চেষ্টাও করিনি এমন বলব না। কিন্তু ও করতে গিয়ে বিবমিষা প্রবল হওয়ায় চেষ্টাটা ছেড়ে দিতে হল। সকলের শরীরে সব কিছু পোষায় না। আমি এম.এ. পরীক্ষার পরও কয়েক মাস ডাফ হস্টেলেই থেকে যাই। সাত বছর সেখানে ছিলাম। পরীক্ষার ফলও বরাবরই ভালই হয়েছে। সুতরাং ওটুকু কৃপা কর্তৃপক্ষ করেছিলেন। মাসে তখনও আটত্রিশ টাকায় থাকা-খাওয়া। এমন সুবিধা আর কোথায় পাওয়া যাবে? তবুও চক্ষুলজ্জা বলে একটা ব্যাপার আছে। কতদিন আর অন্যায্য সুবিধে নেওয়া যায়? ‘৪৮ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ ডাফ হস্টেল থেকে সাত বছরের বাস তুলে বিচিত্র এক প্রতিষ্ঠানে। গিয়ে আস্তানা গাড়লাম।

তিব্বত ভ্রমণকারী এবং সম্ভবত ইংরেজ সরকারের গোয়েন্দা শরৎ দাস ৮০ নম্বর পার্ক স্ট্রিটে একটি বাড়ি করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘লাসা ভিলা’। দাঙ্গার সময় ওঁর পরিবার পরিজন লাসা ভিলা ছেড়ে অন্যত্র কোথাও আশ্রয় নেন। আমাদের এক বন্ধু দিলীপ ভাওয়ালের সঙ্গে শরৎবাবুর এক মেয়ের পরিচয় ছিল। সেই সুবাদে আমরা বাড়ির দোতলাটা ভাড়া পেলাম–মাসিক দেড়শো টাকায়। আবাসটির নাম দেওয়া হয় ব্যাচিলর্স ডেন। পাঁচজনে মিলে ভাড়া নিলাম। তারপর একটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ করা হয়। ভাড়া কমানোর জন্য রেন্ট কন্ট্রোলে মামলা রুজু করা হল। খুব বড় বড় তিন-চারটে ঘরওয়ালা ফ্ল্যাটটির ভাড়া কমে মাসিক পঁচাত্তরে নামল। পাঁচজন ভাড়াটে মাথাপিছু মাসে পনেরো টাকা দিয়ে সুখে বসবাস করতে লাগলাম। কিন্তু পাঁচজনের মধ্যে চারজনই বেকার। পনেরো টাকা দেওয়াও কারও কারও পক্ষে বেশ কঠিন। তাই আরও দু-একজন ভাড়াটে জুটিয়ে মাথাপিছু গচ্ছার অঙ্কটা দশ টাকায় নামানো হয়। তবে এ ব্যাপারে আমরা বাছবিচার না করায় এক-আধটু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। একজন এলেন—দু’দিনেই বোঝা গেল তিনি সমকামী। তখন সমকামিতা বিষয়ে এখনকার মতো উদার সহিষ্ণুতা ছিল না। আর আমাদের মধ্যে আর কেউই সমকামী ছিল না। ফলে ভদ্রলোক একটু অসুবিধেয় পড়েন। আর আবাসিকদের ভিতর দু-তিনজন রীতিমতো প্রাচীনপন্থী। তারা ওঁকে চলে যেতে বাধ্য করে।

ব্যাচিলর্স ডেনে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থায় কিছুটা অভিনবত্ব ছিল। ওই ফ্ল্যাটে আসবাবপত্র একুনে দুটি। একটি বেশ জমকালো ফোর পোস্টার খাট আর একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো। পিয়ানো বাজানোর কেউ না থাকায় ওই দ্বিতীয় আসবাবটিও পাট হিসেবে ব্যবহৃত হত। কিন্তু আবাসিকরা সবাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। তাই খাট বা পিয়ানোতে কেউ বেশিদিন শুতে পারত না, পালা করে শুতে হত। এই ব্যবস্থার ফলে আমাদের জীবনে বেশ একটা বৈচিত্র্য এবং অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ এসেছিল। কারণ কে খাটে-পাটে শশাবে তা লটারি করে স্থির করা হত। সেই অনিশ্চয়তা আমাদের আরব বেদুইনদের সমধর্মী করে তুলেছিল। মানে আজ যেখানে শুচ্ছি কাল সেখানে পোব তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর ঘোড়া ছুটিয়ে বালি ওড়াবার সুযোগ আমাদের না থাকলেও মেঝেয় পুঞ্জীভূত ধুলো সে অভাব পূরণ করত। কারণ খবরদারি করার কেউ না থাকায়, আমাদের যে কাজের লোক ছিল সে কখনও কোনও কাজ করত এমন অপবাদ তাকে কেউ দিতে পারত না। কথাটা অবশ্যি ঠিক বললাম। আসলে লোকটি ছিল যাকে ভাল বাংলায় বলে কম্বাইন্ড হ্যান্ড—মানে একাধারে পাচক এবং গৃহভৃত্য। [রাজনৈতিক শুদ্ধতার খাতিরে ভৃত্য এবং তার বাংলা প্রতিশব্দটি আমাদের ভাষা থেকে উঠে গেছে। একদিন শুনলাম এক প্রগতিবাদিনী গায়িকা মীরাবাইয়ের সেই বিখ্যাত ভজনটি একটু সংশোধন করে গাইছেন, কাজের লোক রাখ, কাজের লোক রাখ, কাজের লোক রাখ, জি! না, সত্যিতে এরকম শুনিনি! তবে শুনব ভরসা রাখি।] ঘর ঝাঁট দেওয়া জাতীয় নিম্নবর্গের কাজ আমাদের কম্বাইন্ড হ্যান্ড করত না ঠিকই, কিন্তু কম্বিনেশনের একটি অর্ধের ব্যাপারে চট্টগ্রামের ওই বডুয়ানন্দন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল–মানে সত্যিকার শিল্পী। আমাদের মতো হতদরিদ্র বেকার যুবকরা ওই রত্নের সেবা পেয়েছিলাম, পূর্বজন্মকৃত পুণ্যফল ছাড়া এ ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যায় না।

কিন্তু কাজে যোগ দেওয়ার সময় বড়ুয়াপুঙ্গব একটি শর্ত করেছিল। সে ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ। অতএব রক্তপাত তার দ্বারা সম্ভব হবে না। মানে সে কি মাছ-মাংস রাঁধবে না? স্বল্পভাষী। মানুষটির সংক্ষিপ্ত উত্তর—এমন কথা সে বলেনি। তার রান্না মাছ-মাংস খেয়ে আমরা উলটে যাব বলেই তার বিশ্বাস। ব্যাপারটা আমরা আর ঘাঁটাইনি। রক্তপাতমুক্ত তার আমিষ রন্ধন পরম তৃপ্তির সঙ্গে উপভোগ করেছি, কদিন পরপর ওর রান্না কই-মাগুর ইত্যাদি জিয়লমাছ। খেয়ে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম, “বড়ুয়া, রক্তপাত না করে এসব তুমি কি করে রাঁধো?” মোনালিসাকে হার মানানো রহস্যময় হাসি হেসে রন্ধনলোকের সেই চাটগেঁয়ে দা ভিঞ্চি বললেন, “খাইল [=কাল] আফনারে দ্যাহামু।“

বাড়িটার সঙ্গে ছোট একটুখানি জমি ছিল। সেখানে অল্পকটি অযত্নে মুমূর্ষ বিদেশি গাছ। সেই বাগানে নিয়ে গিয়ে বড়ুয়া তার বিনা রক্তপাতে জিয়লমাছ রান্নার রহস্য উদঘাটন করল। আসলে ব্যাপারটা খুবই সরল। মাটিতে দেখলাম একটি গর্ত খোঁড়া হয়েছে। মাছ কটি তাতে ফেলে মাটি দিয়ে গর্ত বোজানো হল। কয়েক মিনিট পর আবার যখন তাদের তুলে আনা হল, তখন তাদের পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। রক্তপাত হয়ে বড়ুয়ার ধর্মনাশের কোনও সম্ভাবনাই ঘটেনি। স্মিত হেসে পাচকশ্রেষ্ঠ জানাল—সে মুরগিও একইভাবে বিনা রক্তপাতে সংহার করে। অনেকদিন পর ওলন্দাজ নথিপত্রে পড়ি যে, আরাকানের বৌদ্ধ রাজা আরাকানি বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী মেয়েদের রক্তপাত করা নিষিদ্ধ বলে নিরম্বু উপবাসে রেখে শাহ সুজার পরিবারবর্গকে হত্যা করেন। চট্টগ্রাম এক সময় আরাকান রাজ্যের অংশ ছিল।

কয়েক মাস এমনই ভাবে কেটে গেল। দিগন্তে কোনও চাকরির ছায়াও দেখা গেল না। নতুন পাস করা মাস্টারের টিউশনির রেট দেখলাম পঁচিশ-তিরিশ না, দশ-পনেরো। কলেজে পড়ার সময় জলপানির কৃপায় বাড়ি থেকে পয়সা খুব সামান্যই নিয়েছি। এখন অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে জীবনধারণের জন্য হাত পাততে হল। এর মধ্যে দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানা ওরফে ন্যাশনাল আর্কাইভসে ছোটখাটো একটি চাকরি খালি হল। বাবার কাছ থেকে রাহাখরচা নিয়ে গেলাম। চাকরিটা হল না। এখন ভাবি—ওটা হলে বিশ বছরের মাথায় অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হয়ে আরও বছর দশেক চাকরি করে সগৌরবে অবসরগ্রহণ করতাম।

দিল্লি থেকে ফিরে ধুর্জটিবাবুর কনিষ্ঠ এবং কুমারের কাকা মিলাপ্রসাদবাবুর কাছ থেকে একটা ফোন পেলাম, “আরে তুমি কোথায় ছিলে হে? তোমার জন্যে আমরা একটা চাকরি নিয়ে বসে আছি।” আত্মদিত চিত্তে আমার জন্য তুলে রাখা সেই চাকরিটি নিলাম। কর্মস্থল হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজ। শুনলাম পর্তুগিজ বা আধা-পর্তুগিজ ব্যবসায়ী বেলিলিওস সাহেবের পত্নী সাহেবের দেওয়ান নরসিংহ দত্তের নামে কলেজটি স্থাপন করেন। ভদ্রমহিলা নাকি দত্তজকে বিশেষ স্নেহ করতেন। এরকম ঘটলে কুলোকে কুকথা বলবেই। সেসবে কান দিতে নেই। বেলিলিওস সাহেব সিঙ্গাপুরে ভেড়া চালান দিয়ে পয়সা করেছিলেন। ভেড়া বিক্রির টাকা গাধা পেটানোয় নিয়োগ করায় যুক্তিবিরুদ্ধ কিছু নেই।

হাওড়া স্টেশন থেকে বাস ধরে নরসিংহ কলেজে যেতাম। তখন কলেজটিতে অনার্স ক্লাস ছিল না। ফলে অন্যের কথা জানি না, আমাকে একটার পর আর পড়াতে হত না। যত দূর মনে পড়ে একটায়ই কলেজ বন্ধ হয়ে যেত। মাইনে ছিল মাসে একশো টাকা। এর উপরে মাগগি ভাতা হিসাবে আমাদের আরও দশ টাকা পাওনা ছিল। কিন্তু ভাতা হিসাবে টাকাটা যথেষ্ট নয় বলে কলেজ শিক্ষক সমিতি সভ্যদের ওই দশ টাকা নিতে মানা করেন। ফলে আমরা মাসের শেষে একশো টাকাই পেতাম। কলেজে কানাঘুষা চলত যে, অর্থনীতিতে যাকে রিয়াল ইনকাম বলে তা কারও কারও একশোর চেয়ে বেশি। কারণ ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে একটি বিষয় ছিল বায়োলজি। মাস্টারমশাইরা বায়োলজির প্র্যাক্টিকালে ব্যাঙ না কেটে জ্যান্ত চিংড়ি কাটতেন। পরে ওটা ভেজে খাওয়া হত। তবে এতে ইন্দ্রিয়সুখ কিছুটা বৃদ্ধি হলেও রিয়াল ইনকাম খুব বাড়ার কথা নয়। কারণ তখনকার দিনে দাম বেড়েও চিংড়ির সের [আজকের হিসেবে কিলো] এক টাকা পাঁচ সিকের বেশি না। হাওড়ার বাজারে বস্তুটি আরও সস্তা ছিল।

ইতিমধ্যে আমাদের জীবনের মস্ত বড় এক পরিবর্তন এসে গেছে। আটচল্লিশের জুলাই মাসে মা বাবা বরিশাল ছেড়ে আমার অবিবাহিতা ছোট বোন সুজাতা এবং পাঁচ বছর বয়স্ক ছোট ভাই অপুকে নিয়ে কলকাতা চলে এসেছেন। এই সিদ্ধান্ত আমাদেরই পীড়াপীড়ি এবং উদ্যোগের ফল। তখনও যে বরিশালে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল বা স্পষ্টত নিরাপত্তার কোনও অভাব হয়েছিল এমন নয়। কিন্তু আমাদের পক্ষে পাকিস্তানে জীবিকা উপার্জন সম্ভব হবে না, একথা বোঝা যাচ্ছিল। জমিদারি প্রথা আর বেশি দিন চলবে না সে বিষয়েও সন্দেহ ছিল না। এ অবস্থায় কলকাতা আর বরিশাল দুই জায়গায় দুটি সংসার চালাবার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তা ছাড়া কলকাতার দাঙ্গার পর থেকেই পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মনে একটা ভয় ধরে গিয়েছিল। নোয়াখালির ঘটনা এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই ভয়টা আরও বেড়ে যায়। ভয়টা যে অমূলক ছিল না বরিশাল শহরে ৫০ সনের দাঙ্গায় সেটা প্রমাণ হয়। আমরা বরিশাল থেকে চলে না এলে যে ওই নরমেধযজ্ঞের বলি হতাম সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। ওই যজ্ঞের প্রধান অকুস্থল ছিল আমাদের বাড়ির প্রায় সংলগ্ন স্টিমারঘাট।

মা বাবা বরিশাল থেকে চলে আসবার সময় ওঁদের সাহায্য করবার জন্য আমিও বরিশাল গিয়েছিলাম। তার আগেই জাতীয় জীবনে এক চরম বিপর্যয় ঘটে গেছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘপন্থী উগ্র হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম গডসের হাতে জাতির পিতা নিহত হয়েছেন। দিনটা তপ্ত লৌহের অক্ষরে স্মৃতিতে লেখা আছে। সেদিন দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ে দিলীপ রায় গান। করছিলেন। উপাচার্য ডক্টর প্রমথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। উপাচার্যর আসতে দেরি দেখে দিলীপকুমার রায় গান শুরু করে দেন। গানে খুব মন বসছিল না। কারণ গায়ক নানা ভাষার গান শোনাচ্ছিলেন। এক সময় বললেন, “আজ আপনাদের কিছু গুজরাটি হাসির গান শোনাব।” ভাষাটা জানা না থাকায় খুব যে একটা হাসি পাচ্ছিল, এমন না। হঠাৎ খুব দ্রুতপদে কয়েকজন হলে ঢুকলেন এবং তাঁদের একজন ডেইসে বসা কোনও কর্তাব্যক্তির হাতে এক টুকরো কাগজ দিলেন। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনাদের এক মর্মান্তিক দুঃখের সংবাদ শোনাতে হচ্ছে। জাতির পিতা মহাত্মা গাঁধী এক আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন।” ডেইসে যাঁরা বসেছিলেন তাঁদের মধ্যে এক মহিলা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। সভা জুড়ে একটা অর্ধস্ফুট কান্নার আওয়াজ উঠল। সবারই সঙ্গে আমিও কলেজ স্ট্রিটে বের হয়ে এলাম। দেখলাম রাস্তার পাশের দোকানগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কখন, কীভাবে পায়ে হেঁটে হস্টেলে পৌঁছলাম স্মরণ নেই। দেখলাম বারান্দায় বসে হাঁটুতে মাথা গুঁজে অনেকে কাঁদছে। নিজের ঘরে গিয়ে আমিও নিজেকে সান্ত্বনাহীন শোকের হাতে সমর্পণ করলাম।

বরিশাল যাওয়ার পথে স্টিমারে পুরনো পরিচিত একজন মুসলমান রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে দেখা হল। কথায় কথায় গাঁধী হত্যার প্রসঙ্গ উঠল। বন্ধুটি বললেন, “তোমরা হিন্দুরা না করতে পারো এরকম কাজ বোধ হয় নাই।” দেশভাগ এবং সাম্প্রতিক কালে গুজরাটের ঘটনাবলী দেখে কথাটার সত্যতা অস্বীকার করার পথ আর নেই। তবে অমানুষিকতার ব্যাপারে অন্য সম্প্রদায়রা পিছিয়ে ছিলেন–এমন কথা বলা চলে না। গাঁধী হত্যায় কিছু শিক্ষিত হিন্দুর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মিহির সেনগুপ্তর সাম্প্রতিক বইটিতে তার বর্ণনা আছে। একজন জগদ্বিখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত খবরটা শুনে মন্তব্য করেন “কী আর এমন হয়েছে। উনি তো কলেরায়ও মারা যেতে পারতেন।” কথাটা শুনে প্রমথ বিশী ওঁকে জুতো মারতে চেয়েছিলেন। তবে পাক-ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাস আলোচনা করলে মনে হয় আমাদের দেশের মানুষ—হিন্দু মুসলমান শিখ—কেউই অমানুষিক ক্রিয়াকর্মের ব্যাপারে খুব পিছিয়ে নেই। আর শিক্ষিত সভ্য মানুষ কোথায় নামতে পারে জার্মানিতে নাৎসিরা এবং বর্তমানে মার্কিন নিওকন গোষ্ঠী তার উজ্জ্বল সব উদাহরণ পরিবেশন করেছেন। আমাদের প্রজাতি হিসেবে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত অহমিকাবশত যেসব ব্যবহারকে পাশবিক বলে বর্ণনা করা হয়—এবং যেসব কার্যকলাপ মানুষ ছাড়া অন্য প্রজাতির মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না বোধহয় যে-কোনও মানবগোষ্ঠী প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সে জাতীয় কাজ করতে পারে। নীরদ চৌধুরী একটা কথা বলতেন, সে কথাটা আমিও বিশ্বাস করি। উনি বলতেন স্বভাবদত্ত নীতিজ্ঞানের দিক থেকে পশুরা মানুষের তুলনায় অনেক উঁচুতে। মানুষের ইতিহাসের এক বিরাট অংশ তার অকল্পনীয় কুকর্মের ইতিহাস। জাতীয় গৌরবের ইতিহাসের পাশাপাশি এই অগৌরবের ইতিহাস প্রতি দেশে অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা যেন মন্ত্রপাঠের মতো বলতে শেখে “আর কখনও না, আর কখনও না।”

প্রথমে বরিশাল, পরে কীর্তিপাশা গেলাম। কীর্তিপাশা থেকে চলে আসার সময় মাটির তৈরি পুরনো বাস্তুভিটায় পূর্বপুরুষদের প্রণাম জানাতে যাই। যোড়শ শতকে কোনও সময় বিক্রমপুর থেকে এসে আমাদের আয়ুর্বেদশাস্ত্রী পূর্বপুরুষ ওইখানে ভিত গেড়েছিলেন। গ্রামে গেলে প্রথমে ওই মাটির তৈরি বাড়িটিতে ঢুকে পূর্বপুরুষদের প্রণাম করতাম। গ্রাম ছাড়বার সময়ও শেষকৃত্য ছিল বাস্তুভিটায় গিয়ে পূর্বপুরুষদের প্রণাম জানানো। ১৯৪৮ সালে গ্রাম ছাড়ার সময় শেষবারের মতো এই পুণ্যকর্ম করি। এখন স্বীকার করতে লজ্জা নেই বুক ফেটে কান্না আসছিল। কারণ যেই যা ভাবুক, আমরা ভালই জানতাম যে ওখানে আর ফেরা হবে না। বাহান্ন বছর পরে আবার যখন কীর্তিপাশা যাই তখন আর সেই মাটির বাড়ি অবশিষ্ট নেই। কিন্তু গ্রামের লোক তার অস্তিত্ব ভুলে যায়নি। একজন বৃদ্ধ মুসলমান পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। বললেন, “আপনাগো বাস্তুবিটা এইহানে আছেলে।” দেখলাম একটা মাটির ঢিবি পড়ে রয়েছে।

বাবা অল্প কথার মানুষ ছিলেন। বিশেষ করে ওঁর গভীর দুঃখ বা সুখের কথা নিয়ে কারও সঙ্গে কখনও কোনও আলোচনা করতেন না। ফলে ওঁর জীবনে একটা নিঃসঙ্গতা ছিল। দেশ ছাড়ার পর কী ফেলে এসেছেন তা নিয়ে আক্ষেপ বা তার কোনও উল্লেখ ওঁকে কখনও করতে শুনিনি৷ ওঁর বোধহয় আশা ছিল যে, কখনও বরিশাল ফিরে যেতে পারবেন। অন্তত ওদিকে যাওয়া-আসা একেবারে বন্ধ হবে না। তাই অনেক জিনিসপত্র—যেগুলি তখনও নিয়ে আসা সম্ভব ছিল, তা উনি আনেননি। বললেই বলতেন—”পরে নিয়ে যাব।” সেই সুযোগটা ওঁর জীবনে আর আসেনি।

কলকাতায় এসে আমাদের দুঃখের দিন শুরু হল। বাড়ি কিনবার মতো সম্বল আমাদের ছিল না। আর বাড়িভাড়া তখন হু হু করে বেড়ে যাচ্ছিল। বাঙালগুলি এসে কলকাতাবাসীর কী সাঙ্ঘাতিক অনিষ্ট করছে—এ আলোচনা তখন প্রায়ই শুনতে হত। অথচ বাঙালরা আসায় কিছু কলকাতাবাসীর যে পোয়াবারো হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। যাঁর একটা ভাড়া দেওয়ার মতো ঘর আছে তিনিই তখন রাজা। যাঁরা আরও বুদ্ধিমান—তাঁরা এই সময় জমি তথা বাঙালদের জন্য কলোনির ব্যবসা খুললেন। এই ব্যবসায় বেশ কিছু বাঙালও নেমে পড়েন। এই ধড়িবাজদের পাল্লায় পড়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হলেন। আমাদের সামান্য পুঁজিরও প্রায় সবটাই গচ্চা গেল। শেষ অবধি টালিগঞ্জে ভবানী সিনেমার পিছনে দোতলা-তিনতলা মিলিয়ে একটা চার ঘরের ফ্ল্যাট দাদার এক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ারে ভাড়া করা হল। বাড়ির মালিক—জনৈকা মিসেস দাস। কোনও যন্ত্রণাদায়ক অসুখের জন্য উনি রোজই কয়েকবার মর্কিন ইনজেকশান নিতেন। আর যখন তাতেও কোনও কাজ হত না তখন যন্ত্রণায় চিৎকার করতেন। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গৃহস্থালিতে পাতলুন পরা’ অর্থাৎ পুরুষের ভূমিকা গ্রহণ তা ওই পরিবারে নিঃসন্দেহে মিসেস দাসই করেছিলেন। শিশুর স্বাভাবিক বোধি দিয়ে আমার পাঁচ বছর বয়স্ক ছোট ভাই ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছিল। তার প্রমাণ ও মিসেস দাসের বিষয় গুবান স্বামীটিকে পুরুষ মিসেস দাস বলে বর্ণনা করত। এই বর্ণনার কোনও বিদ্রুপাত্মক উদ্দেশ্য ছিল না। শিশুর সত্যদৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

বাড়িওয়ালার সঙ্গে কলহ কলকাতার জীবনে অতি পরিচিত ঘটনা, মানবিক অভিজ্ঞতা বা হিউম্যান কন্ডিশনের অপরিহার্য অঙ্গ। আমাদের উদ্বাস্তু জীবনে এই অভিজ্ঞতা খুব শিগগিরই এল। প্রথম মাসের ভাড়া দেওয়ার সময় রসিদ চাইলে মিসেস দাস বললেন রসিদ তিনি দেবেন না। কারণ বাড়ি তো উনি ভাড়া দেননি, উদ্বাস্তু দেখে দয়াপরবশ হয়ে উনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। তারপর যা ঘটার সবই ঘটল। রেন্ট কন্ট্রোলের শরণাপন্ন হওয়া, বাড়িওয়ালা কর্তৃক জল বন্ধ করা, প্রতিকারের জন্য পুলিশের শরণাপন্ন হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সব চেয়ে কষ্টকর এবং একই সঙ্গে কৌতুকময় দিক ছিল বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিসেস দাসের ঘন্টা ধরে গালিবর্ষণ। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল যে, আমরা হলাম ‘নির্লজ্জ বেহায়া’। টটোলজি কথাটা বোধ হয় বেচারির জানা ছিল না। না হলে বুঝতেন শব্দ দুটি সমার্থক, একটা ব্যবহার করাই যথেষ্ট।

মিসেস দাসের আশ্রয়ে বাস করা যখন অসহ্য হয়ে উঠেছে তখন আরও দুটি বিপর্যয় ঘটল। আমরা যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসি, তখন জমিদারি থেকে রোজগার কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মফস্বল শহরে নিজের বাড়িতে থেকে সেই রোজগারে একরকম চলে যেত। কলকাতা চলে আসার ব্যাপারে বাবার এক প্রধান আপত্তি ছিল এই যে, বরিশাল ছাড়লে ছেলেদের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। অত্যন্ত সম্মানী মানুষটির সে ব্যবস্থায় মোটেই মন সায় দিচ্ছিল না। নিতান্ত নিরুপায় হয়েই উনি আমাদের প্রস্তাবে রাজি হন। তবু সম্পত্তি থেকে কিছু রোজগার থাকায় ওঁকে সম্পূর্ণ আমাদের উপর নির্ভর করতে হয়নি। তবে সে রোজগার ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছিল। একে বাবুরা বরিশাল ছেড়ে আসায় তহশিলদার-গোমস্তাদের পোয়াবারো হয়েছিল। মুখোপাধ্যায় পদবির এক তহশিলদার হঠাৎ রায়চৌধুরী বনে গেলেন। তাঁর হালচালও সেই সঙ্গে রায়চৌধুরী জনোচিত হয়ে গেল এবং তার খেসারতটা রায়চৌধুরীদেরই দিতে হল। এই উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিই ব্যবস্থা করেন যে, আমাদের মাসোহারাটা বরিশালে এক মারোয়াড়ির হাতে দেওয়া হবে। সে ব্যক্তি শতকরা চল্লিশ টাকা কেটে রেখে শ’ প্রতি ষাট টাকা কলকাতায় আমাদের দেবে। এই ব্যবস্থায় সদ্য রায়চৌধুরীত্ব প্রাপ্ত মহাপুরুষটির কী লভ্য ছিল আমাদের জানা নেই। কিন্তু এই সমস্ত ব্যবস্থাটির মূলে একটি বিপদের সম্ভাবনা ছিল। কারণ পাকিস্তান থেকে ভারতবর্ষে টাকা পাঠানো তখন আইনসঙ্গত নয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকার হঠাৎ একদিন এইভাবে টাকা চলাচলের পথ বন্ধ করে দিলেন। শাস্তি মোটা জরিমানা এবং দীর্ঘদিন কারাবাস। মারোয়াড়ি ব্যবসাদারটি হাত গোটালেন। রাতারাতি সম্পত্তি থেকে যেটুকু প্রাপ্য ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেল। আক্ষরিক অর্থেই আমরা নিঃস্ব হলাম।

আমরা সবাই জানি—বিপদ কখনও একা আসে না। আমার রোজগার তখনও মাসিক একশো টাকা। দাদা ব্যবসা করতেন। ওঁর রোজগার ভালই ছিল, কিন্তু সব সময় না। হঠাৎ এই সময় দিয়ে উনি এক জোচ্চোরের পাল্লায় পড়েন এবং বিনা নোটিসে ওঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। তার উপর জোচ্চোরটি ওঁকে এক জটিল মামলায় জড়াল। বাড়িতে পুলিশের যাওয়া-আসা শুরু হল। তাঁদের শুভাগমন বন্ধ করার জন্য বেশ কিছু ধার করতে হল। মানে অবস্থা সব দিক থেকেই ভাল বাংলায় যাকে বলে চিত্তির।

এমন সময় আমার সদ্য ভাঙা কপাল আংশিকভাবে জোড়া লাগল। অর্থাৎ নরসিংহ দত্ত কলেজে চাকরিটির উপরে আর একটি স্বল্পমেয়াদি পার্ট টাইম চাকরি জুটল। হিতাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিরা বললেন ‘ঈশ্বরের করুণা’। এই ঈশ্বরের করুণা ব্যাপারটা আমার কাছে একটু রহস্যময় ঠেকে। হবেই তো। ঈশ্বর বলে কথা! প্রথম প্রশ্ন, কোন সুবাদে ভদ্রলোক সবাইকে ফেলে আমাকে কৃপা করতে যাবেন? আর কৃপা করারই যদি সদুদ্দেশ্য থাকে তবে তার আগে পথে বসাবার কী প্রয়োজন হয়েছিল? যাতে কৃপার মাহাত্মটা বেশ ভাল করে বুঝতে পারি? পৃথিবীর শতকরা সত্তর ভাগ লোক অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে বাস করছে। প্রাণিজগতে যে যাকে পারে ধরে ধরে খাচ্ছে। উডি অ্যালেনের ভাষায়, জগৎটা যেন পরস্পরকে খাবার এক বিশাল রেস্তোরাঁ। এই যদি ঐশ্বরিক করুণার নমুনা হয়, তবে আমার আবেদন করুণাটা একটু ভেবেচিন্তে করলে হয় না! দুর্বল প্রকৃতির মানুষ—তোমার প্রেম যে সইতে পারি এমন সাধ্য নেই।

ঈশ্বর অথবা গুরুকৃপায় যে-পার্ট টাইম চাকরি পেলাম তার বিষয়ে দু-একটি তথ্য নিবেদন করি। কথা ছিল রোজ দেড়টা থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে পড়াতে হবে। সপ্তাহে ছ’টার বেশি ক্লাস না। তখন আমারই এক পুরনো শিক্ষক কলেজে কর্তাব্যক্তি। তিনি বললেন—তুমি আরও এক জায়গায় পড়াচ্ছ, তাই একশোর বেশি দেওয়া যাবে না। এতে ওঁর ব্যক্তিগত কোনও লাভ ছিল না। পরে যখন স্নাতকোত্তর বিভাগে চাকরি পাই, তখন স্কেলের গোড়া থেকে শুরু না করে গোটা পঞ্চাশেক টাকা বেশি ধার্য হওয়ায় একজন সহকর্মী সোজাসুজি বলেছিলেন, “আমাদের এত কষ্ট করতে হয়েছে। ওকে অতিরিক্ত সব সুবিধে দেওয়া হবে কেন?” সত্যিতেই সে-আমলের শিক্ষাজীবীরা সারা জীবন এত কষ্ট পেয়েছেন যে, তাঁদের। এই মনোভাবের জন্য দোষ দেওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। ঈশ্বরকৃপায় পাওয়া পার্ট টাইম চাকরিটিতে আরও একটি ব্যাপার ঘটল। কথা ছিল সপ্তাহে ছ’ঘণ্টা পড়াবার। কিন্তু আমাকে দেখামাত্র আমার আর এক পুরনো শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ভদ্রলোক রীতিমতো দশাসই ছিলেন। বোধ হয় অগ্নিমান্দ্যর প্রকোপ হয়েছিল। যকৃৎঘটিতও কিছু হয়ে থাকতে পারে। সেসব রোগের প্রধান লক্ষণ সর্বকর্মে অনীহা। তা ছাড়া আর একটা ব্যাপার লক্ষ করছি। আমাকে দেখলে অনেক লোকই তৎক্ষণাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বোধ হয় অ্যালার্জি জাতীয় কোনও সমস্যা হয়। যা হোক, আমাকে বলা হল— “ওঁর ক্লাকটাও কদিন চালিয়ে নাও হে। এই তো কটা দিন।” কটা দিনই বটে। যতদিন স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াই ভদ্রলোককে আর দেখতে পাওয়া যায়নি। তবে সবই আপেক্ষিক। এই নশ্বর জগতে আমরা কটা দিনই বা বাস করি। মোট কথা ওখানে ছ’য়ের জায়গায় সপ্তাহে ষোলো ঘণ্টা পড়াতে আরম্ভ করলাম। তা ছাড়া নরসিংহ দত্ত কলেজে সকালের খেপে দশ ঘণ্টা। একুনে ছাব্বিশ ঘন্টা। পড়ানোর অভিজ্ঞতায় একটা সময় আসে যখন নিজের কণ্ঠস্বর শুনলে নিজেরই ঘুম পায়। সেই অবস্থায় পৌঁছতে তখনও কিছু দেরি আছে। সুতরাং অহোরাত্র পড়ানোর অভিজ্ঞতাটা খুব যে খারাপ লাগত, তা নয়।

প্রায় আক্ষরিক অর্থে অহোরাত্রই বটে। কারণ দুশো টাকায় ছ’জন মানুষের সংসার চলে। আবারও ঈশ্বর কৃপা করলেন। এবার একটু খোলা হাতে। এম.এ. ক্লাসের এক সহপাঠিনী বিয়ে করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। স্বামীর উৎসাহে আবার পড়তে শুরু করলেন। আমাকে মাস্টার রাখা হল। মাইনে রীতিমতো ভাল। ফলে রুটিনটা দাঁড়াল কতকটা নিম্নবৎ। সকাল সাড়ে আটটায় টালিগঞ্জ থেকে বাসে ঝোকুল্যমান হয়ে হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে আর এক বাসে নরসিংহ দত্ত কলেজ। একটায় হাওড়া স্টেশনে এসে। ওখানকার রেস্তোরাঁয় ভোজন—যার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই অগ্নিমান্দ্য হল। তারপর স্কটিশ চার্চ কলেজে ‘পার্ট টাইম’ ষোলো ঘণ্টা পড়ানো। সেখান থেকে কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে সহপাঠিনীর বাড়ি। ওখানে যাওয়ার ব্যাপারে আমার কিছু বেশি উৎসাহ ছিল। কারণ বাঙালবাড়ি এবং এরা উদ্বাস্তু নন। লুচি-তরকারি-মিষ্টান্ন সহযোগে বৈকালিক আহারটা ভালই হত। ওই রকম জলযোগ করার অবস্থা তখন আমাদের আর নেই। মোটকথা সকাল আটটা-সাড়ে আটটায় বাড়ি থেকে বের হয়ে রাত আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরতাম। রাত্রে খাওয়ার পর পরদিন যা পড়াতে হবে তা কিছুটা ঝালিয়ে নিতাম। তবে এই রুটিনের ভিতরে গবেষণার কোনও স্থান ছিল না। কিন্তু বইপত্র তখনও সস্তা। ওই আয়ের থেকেই পয়সা বাঁচিয়ে কিছু কিছু বই কিনতাম। বারট্রান্ড রাসেল এবং অলডাস হাক্সলির লেখার সঙ্গে এই সময়েই ঘনিষ্ঠ পরিচয় হল। আর কী একটা প্রাইজের টাকায় এভরিম্যানের প্রকাশিত অনুবাদে গ্রিক ক্লাসিক-এর প্রধান প্রধান বইগুলি কিনে ফেলোম। মূল্য একুনে চল্লিশ টাকা। দোতলায় বারান্দার এক দিকটা পার্টিশন করে ছোট একটি ঘর বানানো হয়েছিল। সেইটা আমার পড়ার ঘর হল। ওখানে বসে অনেক রাত অবধি পড়তাম। কোনও ক্লান্তি বোধ হত না তখন।

যে-জীবনযাত্রা বর্ণনা করলাম বিলিতি উপন্যাসের ভাষায় তাকে সম্ভবত স্ট্রাগল বলে। কিন্তু বাইশ বছর বয়সে কষ্টবোধটা কমই থাকে এবং সে তুলনায় উৎসাহটা কিছু বেশি। সুতরাং ওই জীবনযাত্রাকে জীবনযন্ত্রণা মনে হত না। বেশ খোশমেজাজেই ছিলাম। শুধু অনেক কিছু ইচ্ছা অপূর্ণ থাকত। ইচ্ছেমতো বই কেনা, ভাল রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ভাল জামাকাপড় পরা, ভাল সিটে বসে সিনেমা-থিয়েটার দেখা—এ সব কিছুই সম্ভব হত না। তবে যখন মাস্টারি করার সিদ্ধান্ত নিই, তখনই জানতাম যে, ঠিক রাজার হালে থাকা হবে না। অতএব খুব যে কিছু ব্যর্থতাবোধে ভুগতাম, তা নয়। যৌবনে আকাশ বাতাসে এক মাদকতার স্বাদ পাওয়া যায়। সেই স্বাদ ছোটখাটো সব অভাববোধকে ছাপিয়ে উঠে এক তৃপ্তির অনুভূতিতে মন ভরে রাখে। অন্তত আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাই। সুতরাং কর্মজীবনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমার সুখেরই হয়েছিল, দুঃখের নয়। তার একটা বড় কারণ পেশা বাছবার ব্যাপারে আমার ভুল হয়নি। পড়াতে আমার প্রথম থেকেই খুব ভাল লাগত। আর সেই ভাল লাগাটা সম্ভবত আমার চেতনা থেকে শ্রোতাদের চেতনায় কিছুটা সঞ্চারিত হত। পড়ানো থেকে অবসর নিয়েছি প্রায় বারো বছর হতে চলল। উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে এখনও ভাল লাগে।

উদ্বাস্তু হিসেবে নিজেদের ভাগ্যকে মেনে নেওয়ার আরও কারণ ছিল। যাঁদের সঙ্গে ছোটবেলা থেকে ওঠাবসা করে বড় হয়েছি, দেশভাগের পর তাঁদের কারও কারও জীবন আমাদের তুলনায় শতগুণে নির্মম হয়েছিল। আমাদের ‘সেজ কোঠা’ অর্থাৎ সেজ ঠাকুর্দার ছেলে এবং নাতি-নাতনিরা কেউ কেউ কীর্তিপাশায় থেকে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে সেজ জ্যাঠার ছোট ছেলে কালুদার সঙ্গে আমাদের বিশেষ প্রীতির বন্ধন ছিল। একদিন শুনলাম কালুদা রিজেন্ট পার্কে উদ্বাস্তুদের জবরদখল করা জমিতে নিজের হাতে বাড়ি তুলেছে। খুব উৎসাহের সঙ্গে সেই বাড়ি দেখতে গেলাম। দেখলাম একটি খোলার ঘর, মেঝে মাটির। স্নান বা পায়খানার কোনও ব্যবস্থা নেই। যে-সেজ জ্যাঠামশাইকে সবাই বাঘের মতো ভয় পেতাম, তিনিও দেখলাম ওই একটি ঘরের মধ্যেই আছেন। কীর্তিপাশার জমিদারভবন ছেড়ে ওই ঝুপড়িতে এসে থাকতে ওঁদের কেমন লাগছিল তা আমার জানা নেই। সেজ জ্যাঠা এখানে থাকতে পারেননি। বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে উনি কীর্তিপাশা ফিরে যান। সেখানেই ওঁর মৃত্যু হয়। কালদা সপরিবারে ওই ঝুপড়িতেই থেকে যায়। শুনেছি ওই কাঁচা বাড়ির পরে কিছু সংস্কার হয়েছিল। ওই প্রিয়জনটির তুলনায় আমরা যে প্রায় স্বর্গে বাস করছি, এই কথা জেনে ভাগ্যের বিরুদ্ধে নালিশ করার কুরুচি থেকে নিষ্কৃতি পাই।

আমাদের কিছু ভাগ্য পরিবর্তন ঘটল ‘৪৯ সনে। প্রথম, পূর্বজন্মকৃত পুণ্যের ফলে আমরা মিসেস দাসের আশ্রয় ছেড়ে বেনিয়াপুকুর অঞ্চলে বেশ বড় একটি ফ্ল্যাটে এসে উঠি। বেনেপুকুর অত্যন্ত ঘিঞ্জি জায়গা। তাই বাইরে থেকে ওই ফ্ল্যাটের মাহাত্ম্য বোঝা যেত না। আসলে আমাদের নতুন বাসস্থানটি ফ্ল্যাট না, উনিশ শতকের ছোটখাটো একটি প্রাসাদের নীচের তলা। সবাই জানে মহীশুর রাজ্য জয় করার পর ইংরেজরা টিপুর ছেলেদের কলকাতা নিয়ে আসে এবং তাদের কিছু জমিদারি সম্পত্তি দেওয়া হয়। তার একটি টালিগঞ্জ এবং কালীঘাট অঞ্চলে। অন্যটি এন্টালির কাছে তাঁতিপাড়া-বেনেপুকুর এলাকায়। দ্বিতীয় সম্পত্তিটির অধিকারীরা তাঁতিপাড়ার নবাব বলে পরিচিত ছিলেন। আমরা যে বাড়িটিতে তখন ভাড়াটে হয়ে ঢুকলাম সেটি আসলে তাঁতিপাড়ার নবাববাড়ি। এক সময় এই বাড়িটির সঙ্গে বিস্তৃত জমি, বাগান এবং অনেক আউট হাউস ছিল। বর্তমান বেনেপুকুর বাজারের সমস্তটাই এই বাড়ির কম্পাউন্ডের ভিতরে ছিল। ওই বাজারের প্রবেশপথে নিতান্তই বিসদৃশভাবে একটি সাবেকি তোরণ আছে। সেই তোরণটি এককালে নবাববাড়ির সিংদরজা ছিল। এইসব তথ্য আমার আবিষ্কৃত না। কথাগুলি কোথাও পড়েছি এমনও না। নেহাতই লোকমুখে শোনা। তবে যত দূর জানি খবরগুলি নির্ভুল। নবাববাড়িটি সম্ভবত এক হাত ঘুরে অহিধর ঘোষ নামে এক জমিদারের কাছে বিক্রি হয়। এই বিলাসব্যসনপ্রিয় ভদ্রলোকটি বাড়িখানা লর্ড সিনহার কাছে বাঁধা রাখেন। আমরা যাঁদের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিই, সেই নন্দীবাবুরা লর্ড সিনহার কাছ থেকে বাড়িটা কেনেন। মাঝের বিরাট হলঘরটা ছাড়া পুরো নীচতলাটা আমরা ভাড়া নিই। ওই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার আমাদের প্রয়োজন হয়নি। নন্দীবাবুরা কখনও আমাদের উৎখাত করার বা এক পয়সাও ভাড়া বাড়াবার চেষ্টা করেননি। এই নিপাট ভদ্রলোক পরিবারটির সঙ্গে লেনদেন আমাদের বিশেষ সুখের কারণ হয়েছিল। ওই বাড়িতেই আমার বাবা, মা এবং দাদা মারা যান এবং দাদা মারা যাওয়ার পর আমরা বাড়িটা ছেড়ে দিই। নন্দীদের সঙ্গে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কোনও আত্মীয়র কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আন্তরিক স্নেহ-ভালবাসা বা বিপদে-আপদে সাহায্য আমরা পাইনি।

এই যে বাড়িটিতে আমাদের পরিবারের অনেকগুলি বছর কাটে সেই বাড়িটি সম্বন্ধে আরও দু-এক কথা বলতে চাই। লিনটন স্ট্রিট এবং মধ্য কলকাতার আর পাঁচটা ঘিঞ্জি গলির ভিতর আপাতদৃষ্টিতে তফাত কিছু নেই। কিন্তু ওই রাস্তায় বড় গেটওয়ালা দু-তিনটে পুরনো জমিদার বাড়ি ছিল। ২৭ নম্বর লিনটন স্ট্রিট তাদের একটি। এইসব বাড়ির গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকলে মনে হত সম্পূর্ণ অন্য এক জগতে ঢুকেছি। আমরা যে বাড়িতে ভাড়াটে, সেখানে কম্পাউন্ডের ভিতরে অনেক জমি এবং বড় একটি পুকুর ছিল। সংস্কারের অভাবে। নষ্ট হওয়ার আগে বেশ কয়েক বছর ওই পুকুরে আমরা স্নান করেছি। আর ছিল নানা সৌখিন গাছপালা। যত্নের অভাবে তার বেশ কিছু জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। ঝোঁপঝাড়ের ভিতরে কোথাও কোথাও আধভাঙা পাথরের মূর্তিও উকিঝুঁকি মারত। বাড়িটির আর একটি বৈশিষ্ট্য ছেলেপিলেদের অপার আনন্দের কারণ হয়েছিল। নন্দীবাবু বাগানের পরিচর্যা করার বদলে তার বড় একটি অংশ এক ফিরিঙ্গি ভদ্রলোককে ভাড়া দিয়েছিলেন। ২৭ নম্বর লিনটন স্ট্রিটের বাসিন্দারা তাকে পাখি সাহেব আখ্যা দিয়েছিল। সাহেবটি প্রজাতি হিসাবে পাখি নন, মানুষই ছিলেন। কিন্তু ওঁর ব্যবসা ছিল পশুপাখির—মানে যেসব পশুপাখি মানুষের পোষবার সম্ভাবনা—সেই সুবাদে উনি পাখি সাহেব। সচরাচর দেখা যায় না এই রকম নানা পশুপাখি নিয়ে ওঁর কারবার। নন্দীবাবুদের অযত্নলাঞ্ছিত বাগানে ছোট বড় খাঁচায় এদের সাময়িক বাসস্থান নির্দিষ্ট হত। দক্ষিণ ভারতের জঙ্গল থেকে আনা লরিস বা লজ্জাবতী বাঁদর তার মধ্যে সংখ্যায় কিছু বেশি ছিল। এই ছোট বাঁদরের সাইজের জন্তুটি আসলে লিমার জাতীয় প্রাণী। এরা নিশাচর জীব। সারা দিন তারা পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে দলা পাকিয়ে থাকত। সন্ধে হলে দলা থেকে বের হয়ে এসে তারা নিজ নিজ বিশিষ্ট ব্যক্তিসত্তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ব্যাপৃত হত। আর সে চেষ্টার প্রধান অভিব্যক্তি প্রচণ্ড মারামারি, রক্তারক্তি কাণ্ড। বিদেশে বাঙালি গোষ্ঠীর ভিতর এই আচরণের প্রতিফলন অনেকবার দেখেছি। দশ-বিশটি পরিবার পরস্পরসম্পৃক্ত হয়ে প্রায় দলা পাকিয়ে বাস করেন। কিন্তু দেখবেন, এই বছর যারা পরস্পরকে ছেড়ে একদিনও থাকতে পারে না, পরের বছর হয়তো তাদের পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ। লরিরা তাদের আচরণ প্রবাসী বাঙালিদের কাছে শিখেছে না শেষোক্ত গোষ্ঠী লরিসদের ঘরে নাড়া বেঁধেছিল, সঠিক বলতে পারব না। ঈশপ বা পঞ্চতন্ত্রের লেখক এ জাতীয় ব্যাপার দেখলে সম্ভবত একটি নীতিবাক্য আবিষ্কার করতেন-বেশি জড়াজড়ি বা দলা পাকানো সুবুদ্ধির কাজ না।

আমাদের পারিবারিক জীবনে আরও দুটি ঘটনা ঘটল ‘৪৯ সালে। দাদা নেতাজির শিক্ষক বেণীমাধব দাসের দৌহিত্রী এবং বিপ্লবী বীণা দাসের দিদির মেয়ে মাধুরী সেনকে বিয়ে করলেন। আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার অল্পবিস্তর যে-পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন, তার সুবাদে আমাদের পরিবারকে কলকাতায় একটি বাস চালাবার লাইসেন্স দেওয়া হল। ওই বাসটি দিয়ে আমার মা-বাবার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হল। বাবা ছেলেদের উপর নির্ভরশীল হওয়ার অপমান থেকে নিষ্কৃতি পেলেন। শুভার্থীরা বলতে লাগলেন, এতদিনে খদ্দর পরিধানের সুফল ফলল। ‘লাইসেন্স পারমিট রাজ’ তার অন্যতম তাবেদারকে পুরস্কৃত করল। অর্থাৎ ১৯৪৯ সনে বাসের লাইসেন্স পাওয়া যাবে এই হিসাব করে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যুবক অমিয় রায়চৌধুরী ১৯২০ সনে নিজের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে এম.এ. ক্লাস থেকে বের হয়ে এসে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এই অপবাদের প্রত্যুত্তর দেওয়ার উৎসাহ বা প্রবৃত্তি বাবার হয়নি। কলকাতা চলে আসার পর বহু জনের সঙ্গপ্রিয় মানুষটি সমস্ত রকমের সামাজিকতা থেকে দূরে সরে এসেছিলেন। পিতৃভূমি এবং সাত পুরুষের সম্পত্তি হারিয়ে ওর যদি কোনও আঘাত লেগে থাকে তবে এ ছাড়া তার আর কোনও বহিঃপ্রকাশ ছিল না।

ওই বছরই নরসিংহ দত্ত এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ ছেড়ে সরকারি কলেজে চাকরি পেলাম। আগেই লিখেছি—সরকারি চাকরিতে হিন্দু এবং মুসলমান কর্মচারীর সংখ্যা সমান সমান করার চেষ্টার ফলে বেশ কিছু বছর ধরে যুক্তবঙ্গে হিন্দুদের চাকরি পাওয়া অসম্ভব না হলেও রীতিমতো কঠিন হয়ে উঠেছিল। এই ব্যবস্থার উলটো পিঠ হল সব সরকারি কাজেই বেশ কিছু মুসলমান বহাল হয়েছিলেন। দেশ ভাগ হওয়ার পর এদের বেশ একটা বড় অংশ পাকিস্তানে চলে যান। অতএব হঠাৎ অনেক পদ খালি হল—বিশেষ করে শিক্ষা বিভাগে। তারই সুবাদে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ-এ-যার আগে নাম ছিল ইসলামিয়া কলেজ এবং বর্তমান নাম মৌলানা আজাদ কলেজ—একটি চাকরি জুটল। এই চাকরির মান এবং প্রকৃতি বিষয়ে দু-একটি কথা বলা প্রয়োজন, তা থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের অনুচ্চারিত মূল্যবোধ বুঝতে কিছুটা সুবিধে হতে পারে। এবং সে মূল্যবোধ সমূলে উৎপাটন করতে যে বেশ কিছু সময় লেগেছিল সে কথাও বুঝতে সুবিধে হবে।

সরকারি চাকরিতে যে জাতিভেদ প্রথা বামুনকায়েত ভেদাভেদ অত্যন্ত প্রবল একথা সকলেরই জানা। গ্রেড শব্দটা চাকরির জগতে বর্ণধর্মেরই নামান্তর। সে হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা পাস করা চাকুরেরা ব্রাহ্মণ, অবশ্যি তাদের মধ্যেও কুলীন-অকুলীন, নৈকষ্য ইত্যাদি সূক্ষ্মতর ভেদাভেদ আছে। কেন্দ্রীয় সরকারে পরীক্ষা পাস করে চাকরি যারা পেত, তারা বি.এ, এম.এ-তে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস, যদিও তা হতেই হবে এমন কোনও নিয়ম ছিল না। বিশেষ সৌভাগ্য জ্ঞান করে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে যে-চাকরি আমি নিলাম, তার সরকারি নাম সাবর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিস। হাকিম গোষ্ঠীর মধ্যে এর তুলনীয় ছিল সাব-ডেপুটির চাকরি, গেজেটেড কর্মচারীদের মধ্যে নিম্নতম পদাধিকারী। তার নীচে শুধু করণিক এবং পিয়ন। যখন আমি সাবর্ডিনেট এডুকেশন সার্ভিসে ঢুকি তখন এম.এ-তে ফার্স্ট ক্লাস না পেলে ওই চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। সত্যিতে অনেক আই.এ.এস, আই.এফ.এস পদাধিকারী ডিগ্রির হিসাব করলে সাবর্ডিনেট এডুকেশন। সার্ভিসের চাকুরেদের তুলনায় নিরেশ ছিলেন। সরকারি শিক্ষা বিভাগে আরও এক বিচিত্র ব্যবস্থা ছিল। সাবর্ডিনেট সার্ভিসের উপরের স্তর ছিল প্রভিন্সিয়াল বা বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিস। পদমর্যাদায় ডেপুটিদের সঙ্গে তুলনীয়। এই স্তরে সোজাসুজি ঢোকা প্রায় অসম্ভব ছিল, সাবর্ডিনেট সার্ভিস দিয়ে শুরু করতে হত। কিন্তু প্রশাসনিক বিভাগে চাকরির ক্ষেত্রে এ নিয়ম ছিল না। মানে ডেপুটি হতে হলে প্রথমে সাব-ডেপুটির চাকরি নিতে হত না। আর ওই স্তর থেকে উচ্চতম স্তর সিনিয়র এডুকেশন সার্ভিস—যেখানে নাকি হাতে গোনা অল্প কয়েকটি চাকরি ছিল, সেখানে পদোন্নতির প্রায় কোনও উপায় ছিল না। সিনিয়র এডুকেশন। সার্ভিসে প্রবেশাধিকার বিলাতি ডিগ্রি ছাড়া সম্ভব ছিল না। তাই ভারতবিখ্যাত প্রফুল্ল ঘোষ যখন বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসে চাকরি করছেন, তাঁর তরুণ ছাত্র অপূর্ব চন্দ তখন অক্সফোর্ড থেকে সদ্য পাস করে এসে সিনিয়র এডুকেশন সার্ভিসে ঢুকলেন। এই বিলিব্যবস্থার আদর্শগত ভিত্তি খুব স্পষ্ট। শিক্ষাটা প্রাদেশিক সরকারের আওতায়, সুতরাং শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি চাকুরেরা কখনও সর্বভারতীয় আমলাদের সমকক্ষ হতে পারবে না। দ্বিতীয় কথা, প্রাদেশিক স্তরেও শিক্ষকদের আমলাদের সমকক্ষ হতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এগোতে হবে। আর তুমি মহামহোপাধ্যায়ই হও বা সামস-উল-উলেমাই হও, সদ্য পাস করা অক্সব্রিজের ছোঁকরা সাহেবের সঙ্গে তোমার তুলনা হয় না। এরপর ভারতীয়দের শিক্ষা প্রশিক্ষণ বিষয়ে ইংরেজ সরকারের চিন্তাধারা সম্পর্কে আর কিছু বলা প্রয়োজন মনে হয় না। নুরুল হাসান সাহেব শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগে অবধি এই চিন্তাধারার পুনর্বিচার হয়েছিল এমন কোনও প্রমাণ নেই। শুধু একটা ব্যাপারে বোধ হয় হয়েছিল। অধ্যাপক হামফ্রে হাউসের ‘আই স্পাই উইদ মাই লিটল আই’ গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, প্রেসিডেন্সি। কলেজের কিছু শিক্ষককে গোয়েন্দার কাজে লাগানো হত। আমাদের ছাত্রাবস্থায়ও এই। ব্যবস্থা চালু ছিল বলে আমাদের বিশ্বাস। আজাদ হিন্দুস্থানে অন্তত ওই ব্যাপারটায় দাঁড়ি টানা হয়।

সরকারি কলেজে চাকরির অভিজ্ঞতাটা আমার নানা কারণেই সুখের হয়নি। প্রথমেই গোলমাল বাধল স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে। চক্ষু পরীক্ষক রায় দিলেন সরকারি চাকরিতে চশমার পাওয়ার যত দূর পর্যন্ত বরদাস্ত করা হয় আমার তার চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং চাকরি নাকচ। কিঞ্চিৎ খুঁটির জোর ছিল। বিধান রায় এবং শিক্ষামন্ত্রী দু’জনেই পরিচিত। তারা চোখের ব্যাপারটা মকুব করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু ওভাবে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে গেলে আমলারা সাধ্যমতো বাধা দেয়। সুতরাং রফা হল দশ বছরের চুক্তিতে আমার চাকরি হবে, তবে প্রতি বছরই চোখ দেখাতে হবে, অন্ধত্বর লক্ষণ দেখা দিলেই চাকরি খতম। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার আমার উপায় ছিল না, কিন্তু এতে যে ঘোড়ারা বেজায় চটে যাবেন, সে বিপদ থেকে নিষ্কৃতির পথ ছিল না।

এই সময় থেকে একটি ক্ষমতাশালী মানুষের সঙ্গে আমার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত শুরু হয়। নানা কারণে এই বিষয়ে আমার পক্ষে কিছু লেখা কঠিন। কিন্তু কিছু না লিখলে আমার কর্মজীবনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকে। তার চেয়েও বড় কথা—বর্তমান রচনাটি একটি বিগত যুগের বর্ণনা। একজন সাধারণ মানুষের স্মৃতিকথা মারফত সেই অভিজ্ঞতার ছবি আঁকার চেষ্টা করছি। সমাজ এবং শাসনযন্ত্রের চাপে পড়ে ব্যক্তিমানুষের কী হাল হতে পারত আমার বিবরণীর অন্যতম বিষয় তাই। সুতরাং পরবর্তী ঘটনাগুলি সম্পূর্ণ চেপে গেলে আমার লেখার উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যাহত হবে।

আমার দ্বিধার কারণ–আমার অত্যন্ত কাছের কিছু মানুষ (যাদের একজন আমার স্ত্রী) যার কথা বলব তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন এবং তার কাছ থেকে স্নেহ পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন। ভারতীয় প্রতিভার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ যাঁর জীবনে, আমার আলোচ্য ব্যক্তি তার স্নেহধন্য। তার কিছু কীর্তি বাঙালি জীবনে সম্পদ হয়ে রয়েছে এবং ভারতের অন্যত্র উচ্চপদে তিনি বিশেষ সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছেন। এই বহু গুণসম্পন্ন উঁচুদরের মানুষটির আমার সঙ্গে বিরোধ ঘটেছিল বলেই তিনি ব্রাত্যপদবাচ্য এ কথা ভাবলে আমার ইতিহাস লেখার স্পর্ধা ত্যাগ করা উচিত। এক শিক্ষাব্রতীর আত্মচরিতে ওঁকে কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। সে গালিগালাজ ওঁর প্রাপ্য এ কথা আমি কোনও মতেই মনে করতে পারি না। সবচেয়ে বড় কথা তিনি প্রয়াত। আমার জবানি আমি লিখে যাব অথচ প্রতিপক্ষর জবাব দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই, এটা ভদ্রলোকের কাজ না। মৃত লোকের নিন্দা না করে ইতিহাস লেখা চলে না। কিন্তু যেখানে বিষয়বস্তু নিজের সঙ্গে বিবাদ সেখানে ঐতিহাসিকের কর্তব্য প্রতিটি অক্ষর সাবধানে হিসাব করে লেখা। তাই প্রথমেই একটা কথা বলে নিই। আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে ভদ্রলোক এমন কোনও কাজ করেননি যার একটিকেও ক্ষমতার অপব্যবহার বলা চলে। তবে যা আইনসঙ্গত, তা-ইন্যায়সঙ্গত কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এখানেও বলি—একটা সংঘাতের বিবরণে এক পক্ষের জবান অর্ধসত্য হওয়ার আশঙ্কা সব সময়েই থাকে। সুতরাং ঘটনাগুলি বলার আগে বর্তমান ভণিতাটির প্রয়োজন ছিল।

সরকারি কলেজে চাকরি করতে গিয়ে একটি দুঃখময় ব্যাপার আমার নজরে আসে। কতগুলি বিশেষ কারণে ওই প্রতিষ্ঠানগুলিতে এক হাত কচলানোর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। শিক্ষাদপ্তরে কেরানি শ্রেণির একটি ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি এক শক্তিশালী পদাধিকারীর একান্ত সচিব। ছুটি, বদলি, পেনশন, এই জাতীয় সব ব্যাপারেই এই লোকটি প্রকৃতপক্ষে সর্বেসর্বা ছিলেন। আর বিরাট বিরাট পণ্ডিত মানুষগুলিকে তিনি কখনও অপমান করে, কখনও তাচ্ছিল্য দেখিয়ে, কখনও বা দয়াদাক্ষিণ্য প্রকাশ করে নিজের ক্ষমতা বেশ রসিয়ে উপভোগ করতেন। দুঃখের কথা এই যে, বিদ্বান বুদ্ধিমান সব লোক এই অপমান মাথা পেতে মেনে নিতেন। অনেক সময় হয়তো অন্য কোনও পথ থাকত না। কিন্তু যে-প্রবল আত্মসম্মানবোধ থাকলে মানুষ দুঃখকষ্ট সহ্য করেও অন্যায় অপমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সেই আত্মসম্মান তখন আমি খুব অল্পসংখ্যক সংসারী লোকের মধ্যেই দেখেছি। আমার ধারণা আত্মসম্মানবোধের এই অবক্ষয় দীর্ঘ দিন বিদেশি শাসনের ফল। আমাদের জীবনে গাঁধীজির সবচেয়ে বড় অবদান এই হীনম্মন্যতার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার শিক্ষা। শুধু সরকারি কলেজ কেন, কোনও কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও দেখেছি, ডাকসাইটে সব পণ্ডিত ব্যক্তি পরিবারবিশেষের বৈঠকখানায় মোসাহেবের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এই পরিবেশে শিক্ষিত রুচিবান মানুষেরও কিছুটা সাংস্কৃতিক অবনতি না ঘটাই আশ্চর্য।

যে-সংঘাতের কথা বলছি, তা তিনটি পরস্পরবিচ্ছিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িত। একটির কথা পরে যথাস্থানে বলব। আর দুটি ঘটনা আমার কর্মজীবন শুরু হওয়ার সময়কার। এবং দুটি ঘটনাই ঘটবার বেশ কিছু পরে আমার কানে আসে। আমার সরকারি চাকরি সংক্রান্ত ঘটনার কিছুদিন পর মার্কিন সংবাদ দপ্তর ইউ.এস.আই.এস-এর পক্ষ থেকে ফুলব্রাইট স্কলারশিপের বিজ্ঞাপন বের হয়। আমি দরখাস্ত করি এবং স্কলারশিপটি আমি পেয়েছি জানিয়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষ আমাকে চিঠি দেন। তার আগের বছর অমলেশ ত্রিপাঠী ওই স্কলারশিপেই কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন। ওঁর পরামর্শমতোই আমিও কলাম্বিয়াতেই ভর্তি হই। যাত্রার প্রস্তুতির জন্য কী কী কেনা প্রয়োজন তা জানিয়ে আমাকে চিঠি দেওয়া হয় এবং আমি তার অনেক কিছু কিনেও ফেলি। যখন যাত্রার দিন প্রায় এসে গেছে তখন চিঠি এল যে, অনিবার্য কারণে স্কলারশিপ আমাকে দেওয়া যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ এজন্য দুঃখিত। এ বাবদ আমার কিছু খরচা হয়ে থাকলে তারা তার জন্য খেসারত দিতে রাজি। ধন্যবাদ দিয়ে ওঁদের প্রস্তাব আমি প্রত্যাখ্যান করি। অনেক বছর পর যে-ভদ্রমহিলা প্রোগ্রামটা চালাতেন তাঁর সঙ্গে আমার আমেরিকায় দেখা হয়। তিনি সেই পুরনো কথা তুলে বলেন যে, স্কলারশিপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হঠাৎ বদল হওয়ার কারণ তখন ওঁরা আমাকে জানাতে পারেননি। আসলে সিদ্ধান্তটা ওঁদের নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। তারা নাকি চিঠি দিয়ে জানান যে, আমি চাকরির শর্তাবলী উপেক্ষা করে ওঁদের অনুমতি ছাড়াই দরখাস্ত করেছিলাম। আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ সত্ত্বেও যদি মার্কিন কর্তৃপক্ষ আমাকে স্কলারশিপ দেন তা হলে তাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভবিষ্যতে কোনও সহযোগিতা করতে পারবেন না। এই চিঠির পর ওঁদের পক্ষে আমাকে স্কলারশিপ দেওয়া আর সম্ভব ছিল না। সত্যি কথা বলতে, আমার জানা ছিল যে, স্কলারশিপের জন্যও কর্তৃপক্ষের মারফত আবেদন করতে হয়। কারণ একই সময় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির দরখাস্ত করেছিলাম, তা সরকারের মাধ্যমেই। আমি চাকরিসংক্রান্ত আইন ভেঙে থাকলে সে বিষয়ে প্রথমে আমার কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার কথা। কিন্তু আমার যে কোনও অন্যায় হয়েছে এবং সেজন্য আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা হচ্ছে—সেসব কথা কখনওই আমাকে জানানো হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়াও হয়নি। আমার ধারণা আমার কিছুটা খুটির জোর না থাকলে অপরাধের শাস্তি হিসেবে আমার চাকরিটি যেত।

ফুলব্রাইট স্কলারশিপ না পেয়ে শেষ অবধি কিন্তু আমার শাপে বর হয়। পরের বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্টেট স্কলারশিপের জন্য বিজ্ঞাপন দিলেন। ততদিনে আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগে ইসলামিক ইতিহাসে লেকচারারের পদ পেয়েছি। তখনও মাস্টারি করতে এসে এত অল্পদিনের মধ্যে ওই বিভাগে পাকা চাকরি পাওয়া প্রায় অভাবনীয় সৌভাগ্য। ইসলামিক ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মাখনলাল রায়চৌধুরী সমর্থন করায় এই অসম্ভব সম্ভব হয়। তবে মাইনে তখনও দুশো থেকে চারশোর স্কেলে। যা হোক, বেড়ালের ভাগ্যে আরও একটি শিকে ছিঁড়ল। আমি স্টেট স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। আর পরের ঘটনাটি ইংরেজিতে যাকে বলে সাক্ষাৎ ঘোড়ার মুখ অর্থাৎ স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীর কাছে শোনা। আমাকে স্কলারশিপ দেওয়ার ব্যাপারে যিনি আমার মার্কিন স্কলারশিপ পাওয়া বন্ধ করেছিলেন তিনিই আবার আপত্তি তোলেন। এবারকার যুক্তি আমার মেডিক্যাল রিপোর্ট। স্টেট স্কলারশিপের অন্যতর শর্ত, ফিরে এসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে-চাকরি দেবে সেটা নিতে হবে। এই চাকরি সাধারণত কলেজে পড়ানোর কাজই হয়। কিন্তু ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির কারণে আমাকে পাকা চাকরি দেওয়া যায়নি, অতএব…। এবার আমার খুঁটির শরণাপন্ন হতে হয়নি। খুঁটি স্বয়ংই ঠিক করেন যে, এই যুক্তি শুভবুদ্ধি-প্রণোদিত। ফলে সচিবের পরামর্শ বাতিল হয়। আমি অক্সফোর্ড যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগে আমি দু বছর পড়িয়েছিলাম, প্রথম বছরটা পার্ট টাইমার হিসেবে। কর্মজীবনে ওই দুটি বছর আমার সুখের সময়। সহকর্মী আমার মাস্টারমশাইরা। তাদের সঙ্গে আমার শ্রদ্ধা এবং স্নেহের বন্ধনে কোনও খাদ ছিল না। এঁদের মধ্যে বেশ কিছু মানুষ সত্যিসত্যিই আদর্শবাদী জীবনযাপন করতেন। জীবনের নানা ব্যর্থতা, অভাব-অভিযোগ উপেক্ষা করে এক মনে নিজের কাজ করে যেতেন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে সাধনা বলে একটি শব্দ আছে। এঁদের কারও কারও জীবন সত্যিকার সাধনাকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হত। নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহকে দেখতাম—প্রতিদিন পড়ানো শেষ হওয়া মাত্র ট্রামে বা বাসে চড়ে হয় প্রাদেশিক সরকারের মহাফেজখানা, নয়তো হাইকোর্টের নথিপত্র দেখতে রওনা হচ্ছেন। এ নিয়মের ব্যতিক্রম হতে কখনও দেখিনি। তখন রীতিমতো অসুস্থ অধ্যাপক হেম রায়চৌধুরী সপ্তাহে একদিন পড়াতে আসতেন। শক কুষাণ আক্রমণ বিষয়ে ক্লাসে ওঁর বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম। উনি মধ্য এশিয়ার স্তেপ থেকে ঘোড়ার পিঠে একটার পর একটা যাযাবর দল ভারতবর্ষের সীমান্তের দিকে এগোচ্ছে তার বর্ণনা দিলে। তাদের পোশাক-আশাক, আহার-বিহার, যে প্রাকৃতিক পরিবেশ তাদের হাজার হাজার মাইল পার হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে যেতে বাধ্য করছে সব কিছু যেন চোখের সামনে ফুটে উঠত। হেমবাবু অত্যন্ত স্পর্শকাতর সাবধানী মানুষ ছিলেন। বই লেখার সময় ওঁর এক প্রধান চিন্তা থাকত—কোথাও কোনও ভুল না হয়। এই দিকটায় নজর বেশি দেওয়ায় ওঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ সব লেখা কিছুটা রসকষবিহীন হত। কিন্তু ওঁর ক্লাসে পড়ানো সম্পূর্ণ অন্য স্বাদের জিনিস ছিল। অমলেশ ত্রিপাঠী এবং দিলীপকুমার বিশ্বাস দু’জনের কাছেই ওঁর বক্তৃতার বিস্তৃত নোট ছিল। তা ছাপাবার কথা অনেকবারই হয়েছে। কিন্তু শেষ অবধি কিছু করা হয়ে ওঠেনি। এখন ওঁরা দু’জনেই প্রয়াত। বাঙালি সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চার মান কী ছিল তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে হেমবাবুর পড়ানোর কথা উল্লেখ করলাম। আরও সব বিরাট পণ্ডিতদের চারপাশে দেখতে পেতাম। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় নোজই আসতেন। অত্যন্ত বিদগ্ধ আলোচনার পাশাপাশি দমফাটা সব হাসির গল্প উনি বলতেন। ওঁর একটি কাহিনি ছিল প্রথম বিলেত যাবার সময় ওঁর এক পশ্চিম রাজস্থানী সহযাত্রীকে নিয়ে। এডেনে জাহাজ থামতেই সবাই বেড়াতে চলেছে—ওই ছেলেটি ছাড়া। ও অপেক্ষা করছে ‘ঠাস কুক’-এর জন্য। কারণ পিতাজি বলে দিয়েছেন বিলেতে “ঠাস কুক মেরা গার্জিয়ান হায়।” যখন সে শুনল সুনীতিবাবু ডক্টরেট করতে যাচ্ছেন, তখন সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করল, “ও মেরা ভি একঠো চাহিয়ে।” ওর কাম্য বস্তুটি কী জানতে চাইলে সে ব্যাখ্যা করল, “জিসকো বারে মে আপনে ক ওহি–ডগডরেড। সুনা হ্যায় ওহ বহৎ বঢ়িয়া চিজ হ্যায়।” অধ্যাপক বললেন, কিন্তু তুমি যে শুধু ম্যাট্রিক পাস। স্মিত হাস্যে মারবাড়নন্দনের উত্তর-”আরে আপকো পতা নেই। ঠাস কুক মেরা গার্জিয়ান হ্যায়। পয়সা দেনেসে ও সব কুছ লা দেতা।” সত্যিই তো, যে-পয়সা নিয়ে সাতসমুদ্র পার করে দিচ্ছে, ডগডরেড তো তার কাছে ছেলেখেলা! সুনীতিবাবুর আর একটি বিখ্যাত অ্যাক্ট ছিল মাউন্টব্যাটেন-রাজেন্দ্রপ্রসাদ পত্নীর সাক্ষাৎকার। রাষ্ট্রপতি নাকি তাঁর হুক্কাপানপ্রিয় পত্নীকে ‘মৃত্যুঞ্জয় কি মায়ী’ বলে সম্বোধন করতেন। রাজনৈতিক শুদ্ধতা এবং আন্তঃপ্রাদেশিক সুসম্পর্কের কথা মনে রেখে কাহিনির বাকি অংশটা চেপে গেলাম।

.

স্নাতকোত্তর বিভাগে পড়ানোর অভিজ্ঞতা বিষয়ে আর কিছু লেখার আগে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজের কথায় একবার ফিরে যেতে চাই। ওখানে সহকর্মী হিসাবে পেলাম ইতিহাস বিভাগের প্রধান অমলেশদাকে। আর অর্থনীতি পড়াতে এল সহপাঠী কল্যাণ সেন। এ ছাড়া ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক সুনীল সেন এবং কল্যাণের দাদা দিলীপ। আর সব চেয়ে বড় লাভ হল সহকর্মী হিসাবে কবি বিষ্ণু দে-কে পেলাম। অত্যন্ত রসিক প্রকৃতির মানুষ বিষ্ণুবাবু একটি ব্যাপারে বড় স্পর্শকাতর ছিলেন। উনি ওঁর কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে কোনও ঠাট্টা সহ্য করতে পারতেন না। আর সুনীল সেন খালি ওই প্রসঙ্গ তুলে ওঁকে খোঁচাতেন। একদিন উত্ত্যক্ত হয়ে বিষ্ণুবাবু বললেন—ওঁর কবিতা মেয়েদের আর শিশুদের বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না। ওঁর মুশকিল হয়েছে শুধু অর্ধশিক্ষিত মধ্যবিত্তদের নিয়ে। বিষ্ণুবাবুর কবিতা পড়ে বোঝে এরকম শিশু বোধহয় সংখ্যায় কিছু কমই হবে। কিন্তু ইচ্ছে হলে উনি সত্যিই এমন সব কবিতা লিখতেন যা কোনও শিশুরই দুর্বোধ্য মনে হওয়ার কথা নয়। এমনকী আমাদের মতো অর্ধশিক্ষিত মধ্যবিত্তরও বুঝতে অসুবিধে হত না। কল্যাণের দাদা দিলীপ সেনের বিয়ে উপলক্ষে উনি ওই রকম একটি চটুল কবিতা লিখেছিলেন। প্রথম লাইনটা শুধু মনে আছে : “দিলীপ সেনের কেন এত ঘোরাঘুরি।” আর ওঁর ওই পনেরোই আগস্টের লেখা কবিতা, “আনন্দ আজ আনন্দ অসীম”—তার চেয়ে মর্মস্পর্শী অন্তর থেকে উঠে আসা কবিতা আমি আর পড়িনি।

বিষ্ণুবাবু, কল্যাণ আর আমি ক্লাসের পর (কখনও কখনও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে) মাঝেমাঝেই কমলালয় স্টোরের ভিতরকার চায়ের দোকানে যেতাম। ওখানে প্রায়ই পরস্পরকে জগ দেওয়ার একটা প্রতিযোগিতা হত। বলা বাহুল্য, বিষ্ণুবাবু এই খেলায় শামিল হতেন না। বেশির ভাগ দিন উনিই আমাদের খাওয়াতেন। আর রোজই আমরা সেই অত্যাশ্চর্য ব্যাপার দেখতাম। তিল ধারণের স্থান নেই এমন সব বাস বা ট্রাম থেকে উনি নামতেন, কিন্তু ওঁর ধুতি বা পাঞ্জাবিতে একটি ভাঁজও পড়ত না। বিষ্ণুবাবুর মারফত ওঁর পরিবারস্থ সকলের সঙ্গে পরিচয় হল। বর্তমানে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক জিষ্ণু দে ওরফে পপা আমার ছোট ভাইয়ের সমবয়সি। বয়স আট। তারা দু’জনে এক সঙ্গে আমাদের পুকুরে মাছ ধরতে বসত। ওকে আমি একটা ছিপ কিনে দিয়েছিলাম। শুনেছি সেটা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য ছিল। ওর দিদি তারাও তখন নেহাতই ছেলেমানুষ। মস্ত বড় বড় চোখ নিয়ে ও যেন যামিনীবাবুর ছবি থেকে নেমে এসেছে মনে হত। আর বড় মেয়ে ইরা? ও এখন যেমন তখনও তেমনই ছিল। সাংঘাতিক বিচ্ছু। ওকে রীতিমতো সমীহ করে চলতে হত। বিষ্ণুবাবু। বাড়ি ফিরেই অধশায়িত একটা ভঙ্গিতে সুন্দর চাদরে ঢাকা একটি চৌকির উপর দেয়ালে হেলানন কুশনে মাথা রেখে বসে বা শুয়ে পড়তেন। পারতপক্ষে আর নড়াচড়া করতেন না। দেখতেন ওঁর স্ত্রী প্রতিদি একবার বের হচ্ছে, একবার ঘরে ঢুকছেন, কখনওবা দোকানদারদের পয়সা দিচ্ছেন। মানে, সে এক মহামারী কাণ্ড। কিন্তু বিষ্ণুবাবু নির্বিকার। কখনও গ্রামোফোনে বাখ শুনছেন, কখনও এলিয়ট বা পাউন্ডের কবিতা পড়ছেন, কখনও বিদেশ থেকে আসা পিকাসোর ছবির প্রতিলিপি দেখছেন আর অনেক সময়ই অলস বিশ্রম্ভালাপে নিমগ্ন। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতাম, “আচ্ছা আপনি এই যে অরিজিনাল বিষ্ণুর মতোই যোগস্থ হয়ে শায়িত থাকেন আর আপনার সংসারের যাবতীয় কাজ প্রণতিদি করেন, এতে আপনার কোনও অস্বস্তি হয় না?” উনি উত্তর দিতেন, “আসলে কী জানো? আমাকে যে চাকরি করতে হয় এর জন্য আমার স্ত্রী অত্যন্ত লজ্জিত।” এ কথার কোনও জবাব নেই।

উনি একবার আমাদের ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু যামিনী রায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। দেখলাম ওঁর ছবিগুলি মেঝের উপর দেওয়ালের গায়ে ঠেকিয়ে রাখা আছে। উনি যে এক সময় সাবেকি পাশ্চাত্য ধরনে শহর-গ্রামের ছবি আঁকতেন তা আমার জানা ছিল না। অ্যাকাডেমিক ঢঙে আঁকা এই ছবিগুলি আমার খুব অসাধারণ লেগেছিল। যামিনীবাবু অনেক কথা বললেন। তখনকার ইংরেজ গভর্নর ওঁর ছবির সমঝদার ছিলেন। লাট-সাক্ষাৎকার বর্ণনা প্রসঙ্গে উনি বললেন, “বুঝলে, লোকটা ঘর থেকে বের হয়ে এল। মনে হল যেন একটা কেউটে সাপ। আর ওর পিছন পিছন—যখন বের হল, মনে হল যেন ঢোঁড়া সাপ।” ওই ঢোঁড়া সাপই ওঁকে গভর্নরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মানুষটি বাংলার রাজনীতি ক্ষেত্রে বিখ্যাত ব্যক্তি। তাই ঢোঁড়া সাপের পরিচয়টা চেপেই গেলাম। বিষ্ণুবাবু একটু গলা নামিয়ে বললেন, “সম্ভব হলে ওঁর দু-একটা ছবি কিনো। একটু টানাটানি যাচ্ছে।” দেড়শোদুশো টাকায় এক একটা ছবি বিক্রি হচ্ছিল। এমনকী আমাদের মত হা-ভাতেরও এক আধখানা কেনা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু কেন যে কিনিনি, জানি না। বোধহয় গাধা পিটানোর শুরুতেই আমি গাধা বনে গিয়েছিলাম। না হলে এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে? তাছাড়া মাসের মাইনের অর্ধেক দিয়ে একখানা ছবি কিনতে যে-মানসিকতা প্রয়োজন, জমিদারি সম্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে সেটি বোধহয় আমার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছিল।

সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে যখন পড়াই তখন আমার বয়স বাইশ-তেইশ বছর। নানা অসুবিধে কষ্ট সত্বেও সব সময়ই একটা কারণহীন ফুর্তি বোধ করতাম। আমার স্বাভাবিক ফাজলামির প্রবণতা মাঝে মাঝেই সীমা ছাড়িয়ে যেত। অধ্যাপকজনোচিত গাম্ভীর্য কিছুতেই আয়ত্ত হত না। এখনও হয়নি। বহু লোককে দেখলেই ভয়ানক রকম হাসি পায়। আমি যে হাসি চাপার চেষ্টা করছি উপহাস্য ব্যক্তির তা বুঝতে কষ্ট হয় না। এর ফলে প্রবীণ সহকর্মীরা অনেকেই আমার প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। এঁদের মধ্যে একজন একটু দুর থেকে আসতেন। আর প্রিন্সিপাল পেরেরার অভ্যেস ছিল ইস্কুলের হেডমাস্টার মশাইয়ের মতো ঘুরে ঘুরে দেখা—অধ্যাপকরা সময়মতো ক্লাসে এসেছেন কি না। আমি বা সুনীল সেনের মতো পাকা ফাঁকিবাজরা কদাচিৎ হাতেনাতে ধরা পড়তাম। পড়লে ‘হ্যালো’ ‘গুড মর্নিং’ ইত্যাদি শুভাকাঙ্ক্ষামূলক সাক্য উচ্চারণ করে সাহেবের পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম। ওঁকে আর চেতাবনি উচ্চারণের সুযোগ দেওয়া হত না। কিন্তু যে-সহকর্মীটির কথা বলছি, তিনি ছিলেন নিপাট ভাল মানুষ। উনি রোজই পেরেরা সাহেবের মুখোমুখি পড়তেন আর ভদ্র ভাষায় কিছু গালিগালাজ শুনে স্টাফ রুমে আসতেন। এবং সেখানে ওঁর সেই বিখ্যাত আত্মবিলাপটি শোনার জন্য আমরা ওত পেতে থাকতাম। ওঁর সেই স্মরণীয় উক্তিটি উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারলাম না : “সাহেব আমাদের কষ্টটা কী করে বুঝবেন? উনি আসেন পাশের বাড়ি থেকে গাড়ি চালিয়ে। আর বালিগঞ্জ থেকে এসে রোজ যদি ধর্মতলার পেডেরাস্টিয়ান ট্রাফিকের ভিতর দিয়ে হেঁটে আসতে হত, তা হলে মজাটা বুঝতেন।” উচিত কথাই বটে! তবে আমরাও ধর্মতলা দিয়ে রোজই হেঁটে আসতাম। বোধহয় ভিড়ের চাপে। ‘পেডেরাস্টিয়ান’দের চিনতে পারিনি। পারলে নিশ্চয়ই আমরাও শঙ্কিত হতাম।

আর ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক বাকি সাহেব। কাবাবের লোভে কলেজফেরতা ওঁর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতে প্রায়ই যেতাম। উনি সুশোভনবাবুর বিশেষ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু এক ব্যাপারে বন্ধুর সঙ্গে বাকি সাহেবের মতের মিল কখনও হয়নি। এবং এই মতানৈক্যের কথাটা দেখা হলেই উনি অন্তত একবার স্মরণ করিয়ে দিতেন। “সুশোভন সেজ ইট ইস ম্যাটার। আই সে ইট ইজ মাইন্ড।” জগৎচিন্তার এই দুই মেরুর মধ্যে কী করে সমঝোতা হওয়া সম্ভব?

সহকর্মীদের মধ্যে সত্যিকার বিরাট পণ্ডিত ছিলেন সাবের খান। আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি যাবতীয় ইসলামি ভাষায় ওঁর অসাধারণ দখল ছিল। আমরা যখন অক্সফোর্ডে পড়ি, তখন উনিও গিবসের কাছে খুব উঁচু দরের গবেষণা করে ডক্টরেট পান। ইসলামি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গবেষক হিসাবে ওঁর খুবই খ্যাতি হয়েছিল। কিন্তু চাকরির দিক থেকে যথেষ্ট উপরে উঠলেও দেশে ওঁর যোগ্যতার অনুপাতে স্বীকৃতি উনি পাননি। নিতান্ত দরিদ্র ঘরের ছেলে এই পণ্ডিত মানুষটি বেনেপুকুরের এক বস্তিতে থাকতেন। ওঁর চলাফেরায় সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ ছিল না। পরে উনি ফরাসি, জার্মান ইত্যাদি প্রধান প্রধান ইউরোপীয় সব ভাষাও শিখেছিলেন। এবং ওই সব ভাষায় ইসলাম বিষয়ক নামজাদা সব পত্রিকায় ওঁর গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইংরেজি ভাষাটার উপর ওঁর দখল কিছু কমই ছিল। উনি বরাবরই পরীক্ষার ফাস্ট, সেকেন্ড পেপার ইত্যাদি প্রশ্নপত্রগুলিকে ইউরোপের রাজা মহারাজাদের কথা মনে রেখে পেপার দা ফাস্ট, পেপার দা সেকেন্ড ইত্যাদি বলে বর্ণনা করনে। ফলে আমরাও ওঁকে আড়ালে বলতাম—সাবের দা খান।

কোনও এক সমাজতাত্ত্বিক ইউরোপীয় দেশগুলির এশিয়া এবং আফ্রিকা উপনিবেশগুলির বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে এঁরা বেশির ভাগই জীবন থেকে এদের যা ন্যায্য প্রাপ্য তা থেকে বঞ্চিত হন। ফলে যে-স্বীকৃতি এঁরা পৃথিবীর কাছ থেকে পাননি, তার ক্ষতিপূরণস্বরূপ অনেক সময়ই আত্মপ্রশংসার আশ্রয় নেন। এই ধরনের অকুণ্ঠ আত্মপ্রশংসার দৃষ্টান্ত জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই চোখে পড়েছে। যে-রোগটা সামাজিক ব্যাধির রূপ নেয়, ব্যক্তিজীবনে অনেক সময় তার আপাতদৃষ্টিতে কোনও বুদ্ধিগ্রাহ্য কারণ থাকে না। ফলে মনে হয়, আত্মপ্রশংসাকারী মানুষটা হয় বোকা, নয়তো অসহ্য রকমের দাম্ভিক। আসলে সে হয়তো মনের দিক থেকে নিতান্তই হতভাগ্য মানুষ। জীবন তাকে যাই দিয়ে থাকুক, নিজের চোখে সে নিতান্তই পরাজিত ভাগ্যহীন ব্যক্তি। তাই তার বাহ্যিক সাফল্যর ফলগুলি বারবারই লোকচক্ষুর সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন মনে হয়। পাছে অন্য লোকেও জেনে ফেলে যে, সে জীবনযুদ্ধে পরাজিত ব্যর্থকাম এক মানব।

সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে একজন অত্যন্ত স্নেহশীল মধ্যবয়স্ক সহকর্মী ছিলেন। তিনি এই ব্যাধির এক চরম দৃষ্টান্ত। মানুষটির অনেক গুণ ছিল। সত্যিতেই ভাল বলতে পারতেন। এবং শিক্ষাসংক্রান্ত প্রশাসনিক কাজে ওঁর দক্ষতা ছিল অসাধারণ। কার্যত কলেজটা উনিই চালাতেন। কিন্তু এইসব সুকৃতির তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি না পেলে ওঁর মন ভরত না। কল্যাণ এবং আমাকে দেখতে পেলেই উনি আক্ষরিক অর্থেই পাকড়াও করতেন। পাকড়াবার টেকনিকটা ছিল অসাধারণ। আমাদের দু’জনকে এক সঙ্গে পেলে দু হাতে দু’জনের টাই। চেপে ধরতেন। তারপর সওয়াল জবাব। “সবাই বলছে তোমরা দু’জন আন্ডার মাই উইংস, আন্ডার মাই প্রোটেকশন, বেশ খোশ মেজাজে আছ। তোমরা কী বলো?” কিছু বলা তখন খুব কঠিন, কারণ টাইয়ের টানে কণ্ঠ প্রায় রোধ হয়ে এসেছে। ক্ষীণস্বরে উত্তর দিতাম। “কথাটা ঠিকই বলে।” আবার টাই-আকর্ষণ, “আচ্ছা বলো দেখি, এই যে সেদিন আমার বক্তৃতা শুনে তোমরা দু’জনেই খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করলে, সত্যি বলো তো, এর চেয়ে ভাল বক্তৃতা কখনও কোথাও শুনেছ?” প্রাণ তখন কণ্ঠ ছেড়ে ওষ্ঠায়ে পৌঁছেছে। অতি কষ্টে উত্তর দিতাম, “না।” দু’জনে একত্র থাকলে তবু কিছুটা রক্ষা। শ্বাসনালী যখন বন্ধ হয়ে আসছে। দেখতেন, ভদ্রলোক তখন ছেড়ে দিতেন। কিন্তু একা ওঁর হাতে পড়লে বিপদটা আরও মারাত্মক হত। কারণ তখন উনি সব্যসাচী রূপ পরিগ্রহ করতেন৷ বাঁ হাতে টাই চেপে ধরলে ডান হাতটা খালি থাকত। সে হাতটা অন্য কাজে ব্যবহৃত হত। প্রশ্ন নিক্ষেপ করেই উনি ডান হাতে পেটে প্রচণ্ড খোঁচা মারতেন। সেই খোঁচা খাওয়ার পর উনি যা-ই বলতে বলবেন তা-ই স্বীকার করা ছাড়া কোনও উপায় থাকত না। শেষাশেষি টাই পরা ছেড়ে দিলাম। মানুষের শরীর। কত আর সহ্য হয়। আমার দৃঢ় ধারণা, গুয়ান্টানামোতে স্বীকারোক্তি বের করার জন্য যেসব টেকনিক ব্যবহৃত হচ্ছে তার অনেকটাই ওই ভদ্রলোকের কোনও গোপন নোটবই থেকে সংগ্রহ করা। উনি অশেষ সাধনার ফলস্বরূপ উৎপীড়নের একটি ঘরানা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

তবে পেটে খোঁচা খাওয়া বোধহয় কোনও কোনও লোকের ললাটলিপি। আমাদের অন্যতম সহকর্মী ছিলেন ইতিহাসের লেকচারার তড়িৎ মুখোপাধ্যায়। নরেনবাবুর কাছে মেয়রস কোর্টের কাগজপত্র নিয়ে ভাল কাজ করেছিলেন। এক জোড়া গোঁফওয়ালা কাঠখোট্টা মানুষ। ওঁর চিত্ত যে নন্দনরসে পূর্ণ—এরকম সন্দেহ করার কোনও কারণ কখনও ঘটেনি। বাইরে থেকে মানুষকে আমরা কতটুকুই বা চিনি? নরেনবাবু স্থানীয় দলিল দস্তাবেজ অনুসন্ধানের জন্য সরকারের কাছ থেকে সামান্য অনুদান জুটিয়ে রিজিয়নাল রেকর্ড সার্ভে কমিটি বসালেন। আমাদের মতো কয়েকটি সবুজ শিংওয়ালা গবেষককে সেই কাজে পাঠাতে লাগলেন। ওঁর উৎসাহ আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত, হল। পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। একবার তড়িতের সঙ্গে মেদিনীপুর গেলাম। খাওয়াদাওয়ার পর কংসাই নদীর উপরকার পুলে উঠে নদীটির জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রূপ দেখে মোহিত হলাম। কিন্তু মুগ্ধ যে আমি একাই হইনি, অল্পক্ষণের মধ্যেই তার অলঙ্ঘ্য প্রমাণ। পেলাম। হঠাৎ পেটে প্রচণ্ড খোঁচা খেলাম। আর তৎসহ কানে এল তড়িতের উচ্ছাসবাণী, “তপন, বঃ বঃ।” প্রশংসাবাণীটির উদ্দিষ্ট আমি না, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত কংসাই। শুধু সেই সৌন্দর্যরস ভোগে যেন আমিও শামিল হই, পেটে প্রাণঘাতী খোঁচার উদ্দেশ্য শুধু তাই। একজনের অনাবিল আনন্দ যে আর একজনের এত বেদনার কারণ হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। বাকি ক’দিন তড়িতের থেকে একটু দুরে দুরে থাকারই চেষ্টা করি।

সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে পড়ানোর সময় ঠিকভাবে গবেষণার কাজ শুরু করি। আমার সুপারভাইজার নিযুক্ত হলেন বিভাগীয় প্রধান ইন্দুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভদ্রলোকের দেহ স্থূল হলেও বুদ্ধিতে কোনও সূক্ষ্মতার অভাব ছিল না। নিরভিমান মানুষটি জীবদ্দশায় ওঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। তা নিয়ে ওঁর যে খুব মাথাব্যথা ছিল এমনও নয়। কিন্তু শিখ ইতিহাস বিষয়ে ওঁর কাজ বোধ হয় ভারতীয় ইতিহাস গবেষণায় প্রথম সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমদানি করে। সম্প্রতি এক শিখ বিশ্ববিদ্যালয় ওঁর নামে একটি পুরস্কার প্রতিষ্ঠা করে ওঁর স্মৃতির প্রতি উপযুক্ত সম্মান দেখিয়েছে। কিন্তু গবেষণায় ইন্দুবাবু আমার শিক্ষক ছিলেন বললে সত্যের অপলাপ হবে। আমার বিষয় নির্বাচনের পেছনে প্রেরণা ছিল অল্পদিন আগে প্রকাশিত নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’। এবং আমার থিসিস সংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনা ওঁর সঙ্গেই হত। উনি বাঙ্গালীর ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্ব, অর্থাৎ মধ্যযুগের ইতিহাস লিখতে রাজি হলেন না। সেই অভাব আংশিকভাবে পূরণ করবার উচ্চাশা নিয়ে মোগল যুগে বাংলার সামাজিক ইতিহাস লিখব ঠিক করি, অনেকটা ওঁরই উৎসাহে। দিনের পর দিন অকৃপণভাবে ওঁর অত্যন্ত মূল্যবান সময় উনি আমাকে দিয়েছেন। উনি যে বিরাট পণ্ডিত আর আমি গবেষণার ক্ষেত্রে অজ্ঞ নবাগত, এই বিরাট পার্থক্যর কথা মনে রাখার কখনও কোনও কারণ ঘটত না।

আর আমার কাজে অত্যন্ত মূল্যবান সাহায্য পেয়েছিলাম অধ্যাপক সুকুমার সেনের কাছে। ওঁর গভীর সাহিত্যরসবোধ সঙ্গীতপ্রিয়তা অসাধারণ সংস্কৃতিবান মানুষটির বাইরের ধরনধারণে বোঝা যেত না। বরং ওঁকে অনেক সময় রসকষহীন শুষ্ক কাষ্ঠ বলে ভুল ধারণা হতে পারত। রবীন্দ্রকাব্যপ্রিয় এই বিরাট পণ্ডিতটির কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানের রেকর্ড ছিল। বেদ উপনিষদ থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা সাহিত্য অবধি ভারতীয় সংস্কৃতির যাবতীয় অভিব্যক্তির সঙ্গে ওঁর গভীর পরিচয় ছিল। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে কোনও আলোচনা উঠলেই উনি বলতেন—আমাদের সংস্কৃতির শেষ কথা রবীন্দ্রনাথ। রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, উপনিষদ, কালিদাস কারও বা কোনও কিছুরই ওই একটি মানুষের সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা হয় না। সুকুমারবাবু ছিলেন চলমান বিশ্বকোষ। যে-কোনও বিষয়ে তথ্যের প্রয়োজন হলে ওঁকে জিজ্ঞেস করলেই তা পাওয়া যেত। কিন্তু মুখত্বর ব্যাপারে উনি সহনশীল ছিলেন না। যা আমার জানা উচিত এরকম কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করলেই খেঁকিয়ে উঠতেন, “এটাও জানেন না? তবে লেখাপড়া করতে এসেছেন কেন?” আসাটা যে ঠিক হয়নি সেকথা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে তখন নরেনবাবু। ওঁর অন্তহীন উৎসাহ ‘দীপেন প্রজ্বালিত দীপবৎ’ আমাদের উৎসাহকে বাঁচিয়ে রাখত। ওঁর ইতিহাসচিন্তায় তত্ত্ব বা থিওরি সম্বন্ধে একটা অসহিষ্ণুতা ছিল। কিন্তু থিওরির সঙ্গে যে উনি অপরিচিত ছিলেন না, ওঁর লেখায় তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। নরেনবাবুর কাছে আমার সবচেয়ে বড় ঋণ একটি ব্যাপারে। উনি আমাকে আচার্য যদুনাথের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তখন স্যার যদুনাথ আইন-ই-আকবরির ব্লকম্যান কৃত অনুবাদের এশিয়াটিক সোসাইটির জন্য নতুন সংস্করণ করছেন। ওঁর কাজে সাহায্য করার জন্য একটি লোক দরকার। নরেনবাবু আমাকে ওঁর কাছে নিয়ে গেলেন। তার আগে আর একবার নরেনবাবুর সঙ্গেই ওঁর কাছে গিয়েছিলাম—আমার গবেষণা বিষয়ে কিছু প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্ন ক’টি লিখে নিয়ে যেতে হয়েছিল। সামনে বসবার ঘরে ঢুকতেই অন্য দরজা দিয়ে উনি ঢোকেন। বসতে বলার বালাই ওখানে ছিল না। উনি নিজেও বসলেন না। আমার প্রশ্নগুলি নিতান্তই কাঁচা ছিল। তা নিয়ে উনি কোনও মন্তব্য করলেন না। শুধু প্রশ্নের উত্তরে যা বললেন তার মোন্দা কথা—আমার গবেষণার বিষয় সম্বন্ধে সমস্যা আছে। প্রধান কারণ তথ্যের স্বল্পতা। অল্প বয়সে বুদ্ধি অবশ্যই কাঁচা থাকে। তাই ওঁর কথায় আমি দমিনি। কিন্তু জ্ঞানচর্চার ব্যাপারে ওই কঠোর মানুষটির উদারতার অভাব ছিল না। আমার থিসিস লেখা হয়ে গেলে উনি পরীক্ষক হতে রাজি হন। এই নিয়ে আমার খুব গর্ব ছিল। কারণ স্যার আশুতোষের আমল থেকে ওঁর সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের বিবাদ। মাস্টারমশায়রা বললেন যে, উনি পরীক্ষক হিসেবে আমার মৌখিক পরীক্ষা নিতে যখন আশুতোষ বিল্ডিংয়ে এলেন সেটি ওঁর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন দশক পরে পদার্পণ। কোনও কোনও জীব নতুন শিং গজালে মহীরুহের কাণ্ডে গুতো মেরে নিজের শক্তির পরীক্ষা করে। আমিও আমার থিসিসে স্যার যদুনাথের নাম উল্লেখ না করে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম বিষয়ে ওঁর মতামতের সমালোচনা করেছিলাম। উনি ওঁর রিপোর্টে লেখেন যে, ওই বিষয়ে আমি যা লিখেছি সেটাই ঠিক কথা। যদুনাথ সরকারের মত ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ওই রিপোর্ট দেখে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।

আইন-ই-আকবরির কাজ শেষ হওয়ার পর স্যার যদুনাথ ওঁর মোগল সাম্রাজ্যের পন বিষয়ক বিরাট গ্রন্থটির শেষ খণ্ডটি প্রেসে দেন। এই সময় প্রুফ দেখা ইত্যাদি ছোটখাটো কাজে আমি ওঁকে সাহায্য করতাম। গ্যালি থেকে শুরু করে শেষ প্রফ পর্যন্ত তিনবার উনি প্রফ দেখতেন। আমি প্রত্যেকটা প্রফই একবার দেখতাম। কিন্তু তাতে উনি নিশ্চিন্ত হতে পারতেন না। ওঁর নিজের হাতে শোধরানো কিছু কিছু গ্যালি প্রুফ আমি রেখে দিয়েছিলাম। ১৯৫৩ সনে অক্সফোর্ডে পড়তে যাই, তারপর ফিরে এসে আর খুঁজে পাইনি।

স্যার যদুনাথের সংগ্রহে ওঁর কাজে লাগতে পারে এরকম যাবতীয় নথিপত্র হস্তলিপির কপি ছিল! ওঁর অন্যতর বিখ্যাত আবিষ্কার প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত মোগলদের বঙ্গবিজয়ের কাহিনি ‘বাহারিস্তান-এ-গায়েবী’র হস্তলিপি। পুঁথিটির মাইক্রোফিলম কপি আনিয়ে তার ফোটোকপি করে কোনও মৌলবিকে দিয়ে সুন্দর নাস্তালিক অক্ষরে তার অনুলিপি করিয়েছিলেন। ওঁর সংগৃহীত অনেক পুঁথি এবং দলিল-দস্তাবেজই ওইভাবে মাইক্রোফিলম থেকে কপি করা। উদ্দেশ্য—ব্যবহারের সময় যেন কোনও অসুবিধা না হয়। বাহারিস্তান-ই-গায়েবীর প্রতিলিপিটি পড়বার জন্য আমি স্যার যদুনাথের বাড়ি যেতাম। উনি ওঁর বাইরের ঘরটিই পড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। হাতে লেখা বাঁধানো বইটি এনে দিয়ে নিজেও আর কোনও কাজ নিয়ে জানালার ধারে বসে যেতেন। অত্যন্ত তটস্থ হয়ে বসে পড়তাম। একজন অসাধারণ মানুষ ওই একই ঘরে বসে কাজ করছেন, যে কোনও কিছুতেই হয়তো তার কাজের ব্যাঘাত হবে, এই কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারতাম না। উনি মাঝে মাঝে উঠে এক-আধটা প্রশ্ন করতেন। কথাটা অনেক সময়ই ইংরেজিতে বলতেন। “উড ইউ লাইক সামথিং টু ড্রিঙ্ক?” “শ্যাল আই টার্ন দা ফ্যান অন?” ইত্যাদি অত্যন্ত সাধারণ কোনও কথা। উনি বেশির ভাগ সময়ে পাখা ব্যবহার করতেন না। তাই আমিও পাখা চালাতে সঙ্কোচ বোধ করতাম। জুন মাসের গরমেও বিনা পাখায় কাজ করার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।

আমার জীবনে প্রথম স্মরণীয় স্বীকৃতি ওঁর কাছ থেকেই পাই। বাহারিস্তান সেনাপতির লেখা যুদ্ধ আর রাজ্যজয়ের ইতিহাস। স্যার যদুনাথ ঠিকই বলেছিলেন—ওর ভিতর সামাজিক ইতিহাসের মালমশলা পাওয়া যাবে না। ঠিক, কিন্তু শতকরা একশো ভাগ ঠিক না। যুদ্ধবিগ্রহের ধারাবিবরণীতে খুঁজলে জনজীবনে শাসনব্যবস্থা এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিণাম সম্পর্কে অনেক টুকরো টুকরো তথ্য পাওয়া যায়। সেগুলি একত্র করলে যে, ছবি ফুটে ওঠে, মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বিবরণীর সঙ্গে তার মিল কমই। আমি ওইভাবে ছড়ানো-ছিটানো তথ্যগুলি একত্র করে বাংলায় মোগল শাসন ব্যবস্থার একটি বিবরণী লিখি। স্যার যদুনাথ সেটি পড়ে এশিয়াটিক সোসাইটির সভ্যদের সামনে লেখাটি পড়ার প্রস্তাব পেশ করেন। সে সময় আমার বয়সি অচেনা গবেষকের পক্ষে এ এক বিরল সম্মান। সেই রাতটা উত্তেজনায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘুমোতে পারিনি। আমি গুরুবাদে বিশ্বাসী। জীবনের যে-কোনও ক্ষেত্রে সার্থকসাধন ব্যক্তির নির্দেশ পেলে লক্ষ্যে পৌঁছনো সহজ হয় বলে মনে করি। এশিয়াটিক সোসাইটির কর্তৃপক্ষকে লেখা ওঁর দু লাইনের চিঠিটি আমি গুরুর আশীর্বাদ বলে গ্রহণ করেছিলাম।

স্যার যদুনাথের জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপ একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করে। বিশ বছর বয়সে এম.এ পাস করে উনি মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করবেন বলে মন স্থির করেন। প্রথম বিশ বছর তার জন্য প্রয়োজনীয় নানা ভাষা শেখা এবং উপাদান সংগ্রহে কেটে যায়। প্রেমাদ রায়চাঁদ স্কলারশিপের দশ হাজার টাকা দিয়ে উনি ওঁর গবেষণার জন্য দরকারি মূল পুস্তক সংগ্রহটি প্রথম গড়ে তোলেন। উনি ওঁর কাজ সাহিত্য বিষয়ক, ‘লিটারারি’ বলে মনে করতেন। ওঁর গ্রন্থসংগ্রহে ইংরেজি এবং সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক বহু বই ছিল। যত দূর জানি ওঁর গবেষণাভিত্তিক লেখা প্রথম যখন বের হতে শুরু করে ওঁর বয়স তখন চল্লিশ ছুঁয়েছে। চল্লিশ থেকে ষাট বছর বয়স অবধি পাঁচ খণ্ডে উনি আওরঙ্গজেবের ইতিহাস রচনা করেন। সে শুধু আওরঙ্গজেবের ইতিহাস না, মোগলের জয়স্কন্ধাবারের অনুগামী হয়ে সারা ভারত পরিক্রমা, সমস্ত স্থানীয় রাষ্ট্রশক্তিরই উত্থান পতনের ইতিহাস। ষাট বছর বয়সে উনি মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস লিখতে শুরু করেন, শেষ করেন আশি বছর বয়সে। এই সময় আমার সঙ্গে ওঁর পরিচয় হয়—কোন সুকৃতির ফলে তা আমার জানা নেই। দেখতাম, দিনের প্রতিটি প্রহর প্রতিটি কাজ ওঁর জীবনের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্যটির সঙ্গে বাঁধা। স্বাস্থ্য সম্বন্ধে ওঁর কিছু মজার ধারণা ছিল। মস্তিষ্কের পক্ষে কিছু কিছু খাদ্য বিশেষ পুষ্টিকর বলে উনি মনে করতেন—যথা কলা, ছোট মাছের মুড়ো এবং দই। রোজ নিজে বাজারে গিয়ে এই জিনিসগুলি কিনতেন। বলতেন, খাঁটি জিনিস খেতে হলে নিজে বাজারে যেতেই হবে। আশি বছর বয়স না হওয়া অবধি স্যার যদুনাথ রোজ আট ঘণ্টা কাজ করতেন, আট ঘণ্টা ঘুমোতেন। আশি পেীছে কাজের সময়টা ছ’ ঘণ্টায় নামিয়ে আনেন। সকাল বিকেল ঘড়ি ধরে এক ঘণ্টা করে হাঁটতেন। এই সব কাজেরই উদ্দেশ্য এক। শরীরটা ঠিক রাখতে হবে—যাতে একটি দিনও নষ্ট না হয়। ওঁর দৃঢ় ধারণা ছিল যে, বেশি গরমে আয়ুক্ষয় হয়। সেই জন্যই দার্জিলিঙে বাড়ি করেছিলেন। অনেক হিসেব করে বইপত্র ভাগ করে রেখেছিলেন। গ্রীষ্মে যা নিয়ে কাজ করবেন তার জন্য প্রয়োজনীয় সব বইপত্র দার্জিলিঙে রাখা ছিল। একটা বয়সের পর উঁচু জায়গা শরীরের পক্ষে অনুপযোগী মনে করে গ্রীষ্ম কাটানোর উনি অন্য ব্যবস্থা করলেন। ওঁর মারাঠা ইতিহাস সংক্রান্ত যাবতীয় বইপত্র দলিল-দস্তাবেজ উনি মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সরদেশাইকে দিয়ে দেন। গ্রীষ্মের মাসগুলি তারপর থেকে উনি পুনার কাছের ছোট্ট শহরটিতে ওই বন্ধুর বাড়িতে কাটাতেন। আমি যখন অক্সফোর্ড থেকে ফিরে দিল্লিতে জাতীয় মহাফেজখানায় চাকরি করতে যাই তখন উনি খুব উৎসাহ দেন। কিন্তু এ কথাও বলেন, আমি যেন মনে রাখি যে, দিল্লিবাসের ফলে পাঁচ থেকে দশ বছর আয়ু কমে যাবে। কথাটা ফলেছিল ঠিকই—তবে তার কারণ সম্ভবত তাপের আধিক্য নয়।

স্যার যদুনাথের ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। একটার পর একটা মর্মান্তিক শোক ওঁকে সহ্য করতে হয়েছে। ওঁর এক জামাই নৌবাহিনীতে কাজ করতেন। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাহাজডুবি হয়ে মারা যান। ওঁর বড় ছেলে ছেচল্লিশ সনের দাঙ্গায় আততায়ীর হাতে নিহত হন। এক মেয়ে লন্ডনে পাঠাবস্থায় আত্মহত্যা করেন। শেষের ঘটনার খবর পেয়ে রমেশ মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায়, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ এঁরা সবাই দেখা করতে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন উনি চিরকালের অভ্যেস অনুযায়ী জানলার পাশে বসে একটা বই পড়ছেন। রমেশবাবুদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। তারপর বললেন, “ও, আপনারা খবর পেয়েছেন? হ্যাঁ, কাল মাঝরাতে টেলিগ্রাম এল।” বলে একটু চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “আচ্ছা, আপনারা তা হলে এখন আসুন।” ওঁরা দেখলেন—শোকতপ্ত মানুষটি নিজের কাজে ফিরে গেলেন।

নরেনবাবুর কাছে শুনেছি—একদিন এক জ্যোতিষী স্যার যদুনাথের কাছে এক অনুরোধ নিয়ে আসে। সে লোকটি সব বিখ্যাত বাঙালিদের হাতের ছাপ নিয়ে সামুদ্রিকবিজ্ঞান অনুযায়ী তার বিচার করে একটি বই লিখছে। বিধান রায়, মেঘনাদ সাহা, সুনীতি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সব জ্ঞানীগুণী লোক ওঁকে হাতের ছাপ দিয়েছেন। এখন স্যার যদুনাথ যদি দেন তা হলে সে বাধিত হবে। স্যার যদুনাথ লোকটিকে বকাবকি করে তাড়িয়ে দিলেন। নরেনবাবু সাহস করে বললেন, “স্যার, গরিব মানুষ, এই করে খায়। দিলেও পারতেন।” স্যার যদুনাথ এই প্রসঙ্গে নরেনবাবুকে অদ্ভুত এক কাহিনি শোনান।

ওর যখন নিতান্তই অল্প বয়স তখন এক সন্ন্যাসী এসে ওঁদের বাড়ির অতিথিশালায় কিছুদিন থাকেন। যাবার সময় সন্ন্যাসীটি খুশি হয়ে যদুনাথের এক কুষ্টিবিচার করে ওর বাবার হাতে দিয়ে যান। যখন ওঁর জীবনে একটার পর একটা বিপর্যয় ঘটতে থাকে তখন উনি প্রথম ওই নথিটি খোলেন। দেখলেন ওর জীবনে যা যা ঘটেছে তা সবই ওতে লেখা আছে। এর পর উনি আর কখনও জ্যোতিষ নিয়ে মাথা ঘামাননি।

ওঁর জীবনের আর এক মর্মান্তিক দিনে আমি উপস্থিত ছিলাম। ওঁর দুই নাতি ফৌজি শিক্ষা শেষ হওয়ার পর পরীক্ষা পাস করে ফুর্তি করতে বের হয়েছিল। জিপ উলটে তাদের একজন মারা যায়। পরদিন সকালে কিছু কাজ নিয়ে ওর কাছে যাবার কথা। অনেক ইতস্তত করে শেষ অবধি গেলাম। এইদিন প্রথম উনি নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললেন, “শুনেছ তো? আর যে ক’টা আছে তারাও কেউ থাকবে না। এটাই আমার ভাগ্যলিপি।”

আর এক শুভ দিনে ওঁর কাছে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেদিন ‘ফল অফ দা মুঘল এম্পায়ার’-এর শেষ ক’টি পৃষ্ঠার শেষ প্রফ দেখা হয়ে গেছে। দীর্ঘ ষাট বছরের সাধনার সার্থক সমাপ্তির দিন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। ওইদিন উনি কাজে বসেননি। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বারান্দায় বসেছিলেন। এই প্রথম শুনলাম উনি গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছেন। মনে হল সহস্র দুঃখের সমুদ্র পার হয়ে উনি সার্থকতার কুলে পৌঁছেছেন। না, কথাটা ঠিক হল না। ওঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই তো সার্থকতায় ভরা ছিল। চেতনার যে-স্তরে এই মহান পুরুষ সর্বদাই স্থিতধী হয়ে বাস করতেন, শোক দুঃখ তো সেখানে পরাজিত।

যখন থিসিস লিখছি, তখন একজন সহপাঠী এবং সহকর্মীর উৎসাহ আমার পক্ষে বিশেষ মূল্যবান হয়েছিল। অরুণ দাশগুপ্ত তখন সদ্য বিয়ে করে কালীঘাট পার্কের পাশে একটি একতলার ফ্ল্যাটে ঘর বেঁধেছেন। আমরা তখনও সংসারহীন ভবঘুরে। গৃহস্থবাড়ির আনাচে কানাচে ঘোরাফেরা করা আমাদের পক্ষে তখন নিতান্তই স্বাভাবিক কর্ম। অরুণের স্ত্রী মানসী সুভাষিণী এবং সুগৃহিণী। দুটোই চিত্তাকর্ষক ব্যাপার। ফলে ওবাড়িতে প্রায়ই যেতাম। সামাজিক এবং মানবিক আকর্ষণ ছাড়া ওখানে যাওয়ার আরও একটা বড় কারণ ছিল। তখন আমি থিসিসের পরিচ্ছেদগুলি একটার পর একটা লিখে যাচ্ছি। যেমন শ্রোতা ছাড়া গান জমে না, তেমনই পাঠক ছাড়া কিছু লিখে তৃপ্তি পাওয়া যায় না। সন্ধে হলেই পায়ে পায়ে গিয়ে অরুণের বাড়ি উপস্থিত হতাম এবং আমার সদ্যলিখিত চ্যাপ্টারগুলি নির্মমভাবে ওর প্রতি নিক্ষেপ করতাম। এ ব্যাপারে কোনও দয়া-মায়ার প্রশ্ন ছিল না। অরুণ কখনও আপত্তি করেনি। মুখে অন্তত বলত, শুনতে ভাল লাগছে। হয়তো সত্যিই লাগত। না লেগে আর উপায় কী? দাম্পত্য সন্ধ্যাগুলি এইভাবে জলাঞ্জলি যাওয়ায় মানসী কী ভাবতেন কখনও বলেননি। তবে অনেক সময়ই মনে হয়েছে দরজা খুলেই আমাকে দেখলে ওঁর মুখ কিঞ্চিৎ মলিন হত।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির জন্য যখন থিসিস লেখা চলছে, তখনই আমি একটু এগিয়ে ভবিষ্যতে কী করব ভাবতে শুরু করেছি। আমার ফারসি ভাষাজ্ঞান একটা পর্যায়ে পৌঁছে আর এগুতে চাইছিল না। ফলে আমার মনে হয় যে, নতুন কিছু বলতে হলে নতুন অনাবিষ্কৃত তথ্যের সন্ধান করতে হবে। মোগল যুগের অর্থনৈতিক ইতিহাসের পথিকৃৎ মোরল্যান্ড এবং সরদার পানির-লিখিত মালাবার অঞ্চলে পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজদের কীর্তিকাহিনি পড়ে আমার ধারণা হল যে, ওই দুই ভাষায় ভারতীয় ইতিহাস-বিষয়ক মালমশলা প্রচুর পাওয়া যাবার সম্ভাবনা আছে। সে মালমশলা যে কত প্রচুর তা গবেষণা করতে গিয়ে জানতে পারি। আমি হঠকারী প্রকৃতির লোক। মানে, যা মনে হয় তখনই তা হট করে শুরু করে দিই। ফলটা কদাচিৎ ভাল হয়। কিন্তু যার যা স্বভাব।

আমি ডাচ ভাষা শেখাতে রাজি এরকম একজন অসাধারণ শিক্ষক পেলাম—জেসুইট ফাদার ভান এক্সেম, হাওড়ার ক্যাথলিক গির্জার ভারপ্রাপ্ত পাদ্রি। ভদ্রলোক বিশুদ্ধ বাংলা বলতেন। পর্দার আড়াল থেকে শুনলে বোঝার উপায় থাকত না যে উনি বাঙালি নন। পাদ্রি সাহেব একুনে আঠেরোটি ভাষা জানতেন। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে আরবি। কীভাবে ওই ভাষাটি শিখেছিলেন তা ওঁরই কাছে শুনি। একখানা কোরান, একটি আরবি ব্যাকরণ আর একটি আরবিফরাসি অভিধান হাতে করে ভাষাটা মোটামুটি শেখা না হওয়া পর্যন্ত ঘর থেকে বের হবেন না ঈশ্বরের নামে এই শপথ নিয়ে উনি ঘরের দরজা বন্ধ করেন। কপাট খুলে রোজ ওঁকে একটি পাউরুটি আর একপাত্র জল দেওয়া হত। এক মাস পরে যখন ওই ঘর থেকে বের হলেন, তখন অভিধানের সাহায্য ছাড়াই কোরান পড়ে বুঝতে পারছেন।

আরবি ভাষা শিক্ষার পরবর্তী পদক্ষেপ আর একটু সমস্যামূলক ছিল। ওঁর সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উপরিওয়ালারা এবার ওঁকে আরবদের দেশে হেজাজে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে এক বেদুইনদের তাঁবুতে থেকে ওঁকে ভাষাশিক্ষা করতে হবে। ব্যাপারটার ব্যবস্থাদি কোনও ব্রিটিশ কাউন্সিল বা সরকারি দূতাবাস করে দেয়নি। জায়গাটার নির্দেশ ওঁর কর্তৃপক্ষ দিয়ে দিয়েছিলেন। জেদ্দা অবধি একটা টিকিট আর খরচা বাবদ কিছু টাকা-পয়সাও ওঁরা দিয়েছিলেন। তাছাড়া ওঁকে বলা হয়—বেদুইনরা খুবই দিলদরিয়া লোক। খুবই খাতিরযত্ন করবে—যদি না প্রথম দর্শনেই হত্যা করে। সবাইকে ওভাবে ওরা হত্যা করে, এমন নয়। তবে কথা কি জানো, ইসলামে দু-একটি কাজের কোনও ক্ষমা নেই। ইসলাম থেকে ধর্মান্তরণ তার মধ্যে একটি। আর মিশনারিদের কাজ যে ধর্মান্তরণ, সে বেদুইনরাও জানে। সুবিধের কথা এই যে, একবার অতিথি হিসাবে কাউকে গ্রহণ করলে তার গায়ে ওরা হাত তোলে না। সেই সৌভাগ্য লাভের আগেই মুণ্ডহীন হলে একটু অসুবিধে হতে পারে।

এইসব ভরসার কথা শুনে পাদ্রি সাহেব বুঝলেন যে, সত্যিতে একমাত্র ভরসা ঈশ্বর। আর প্রভু যদি তাঁর বান্দাকে শহিদের মুকুটে ভূষিত করে ক্রোড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল।

বেদুইন তাঁবুতে পৌঁছে ভান এক্সেম প্রথমেই বলেন যে, তাঁর আগমনের একমাত্র উদ্দেশ্য হজরত নবী যে-ভাষায় কথা বলতেন সেই ভাষা শেখা। বেদুইনরা ওঁকে স্বাগত জানায়। তাঁবুর ভিতর নিয়ে গিয়ে প্রথমে ওঁকে রুটি আর নুন দিয়ে অতিথি হিসাবে গ্রহণ করে। তারপর সব কিছু সহজ হয়ে যায়। প্রথমে তাঁবুর প্রতিটি অংশর নাম ওঁকে শেখানো হয়। সে শিক্ষা শেষ হলে বিভিন্ন ধরনের উটের বিভিন্ন নাম, এবং তাদের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আরবি বিশেষ্য। এইভাবে অল্প দিনের মধ্যেই উনি কথ্য আরবিতে সুপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। তার চেয়েও বড় কথা, যখন দেশে ফিরলেন, ঈশ্বরকৃপায় তখনও মুণ্ডটি ঘাড়ের উপরেই রয়েছে।

ভান এক্সেম সাহেবের কাহিনি শুনে বড় শখ হয়েছিল ফারসি অভিধান, ব্যাকরণ (ওটা অবশ্যি সমস্যা নয়, এক পৃষ্ঠায় লেখা হয়ে যায়) আর শেখ সাদির গ্রন্থাবলী হাতে করে ভাষাশিক্ষার শপথ নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিই। কিন্তু রুটি-জল সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব নিতে কেউ রাজি হল না। আর তাছাড়া ঈশ্বরকৃপা ছাড়া ওসব হয় না। ভদ্রলোকের সাফ জবাব : আমাকে মানি না। তবে দেখ বেটা নিজের চেষ্টায় কত দূর এগুতে পারিস! ফলে মাঝপথেই ঠেকে রইলাম।

ভান এক্সেম সাহেবের শিক্ষাগুণে আধুনিক ডাচ ভাষাটা অল্পদিনের মধ্যেই বেশ রপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু উনি সাবধান করে দিলেন যে, সতেরো শতকের ডাচ ভাষা এবং লিখনশৈলী আলাদা। সেটা ওঁর জানা নেই। সেই ভাষা এবং শৈলী হল্যান্ডে গিয়ে কেঁচেগণ্ডুষ করে ফের শিখতে হয়। সেকথা যথাস্থানে বলব।

ডাচ ভাষার সঙ্গে সঙ্গেই পর্তুগিজও শিখতে শুরু করি। স্যার যদুনাথ বলেছিলেন–একটা শিখে তার পর অন্যটা শুরু করো। সে কথায় কান দেওয়ার মতো ধৈর্য আমার ছিল না। ফলে পর্তুগিজ ভাষাশিক্ষাটা আমার কিছুটা কাঁচা থেকে যায়। তবে গবেষণার কাজে ওই ভাষার ব্যবহার আমি অল্পই করেছি। পর্তুগিজ শেখার চেষ্টায় আমি একটি গোন ছেলের সাহায্য নিই। ওরমারফত কলকাতার জীবনের এক অচেনা দিকের সঙ্গে সামান্য পরিচয় ঘটে। ছেলেটি থাকত ধর্মতলার এক মেসে৷ মস্ত লম্বা একটা ঘরে গোটা কুড়ি খাট পাতা। তার পাশেই লম্বা বেঞ্চি পাতা একটি খাওয়ার ঘর। বাসিন্দারা সবাই হয় পর্তুগিজ, নয় ফরাসি উপনিবেশগুলির বাসিন্দা। পরস্পর আলাপের ভাষা ফরাসি বা পর্তুগিজ। কারও সঙ্গে কোনও বাঙালির পরিচয় নেই। এরা সবাই কোনও ছোটখাটো চাকরি করত, নয়তো কোনও কারিগরি শিক্ষায় নিযুক্ত। কিন্তু এক একজন দেখতাম কন্টিনেন্টাল সাহিত্য বেশ ভাল করে পড়েছে। এইসব গোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের যে কোনও আদান-প্রদান নেই, তা আমাদের দুর্ভাগ্য বলেই মনে করি।

ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে আমার ছটফটানি দেখে স্যার যদুনাথ নরেনবাবুকে বলেন যে, আমার সম্বন্ধে ওঁর একটাই আশঙ্কা। মনটা যেন সব সময়ই হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোনওখানে করে অজানার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা বিষয় ধরে থেকে গভীর থেকে গভীরে যাওয়ার ধৈর্য থাকলে ভাল হয়। কথাটা উনি ঠিকই বলেছিলেন, কিন্তু আমার গবেষণার ব্যাপারে চিত্তচাঞ্চল্যর একটা কারণ ছিল। আমি নানা ভাবে নানা দিক থেকে একটি প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছি। এই সন্ধান যে আমার সফল হয়নি, তার কারণ ক্রমাগত বিষয় পরিবর্তন নয়, গবেষণার অগভীরতা। স্যার যদুনাথ, ইরফান হাবিব, কীর্তি চৌধুরী এবং বর্তমান প্রজন্মে সঞ্জয় সুব্রহ্মণ্যম যেভাবে তাঁদের বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেছেন, আমার তা করা হয়ে ওঠেনি। আমার অসাফল্যের জন্য আমার কাজের অসম্পূর্ণতাই দায়ী, বিষয় পরিবর্তন নয়। তবে দুটোর মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকতে পারে।

যে-প্রশ্নের উত্তর গবেষণার মারফত আমি খুঁজেছিলাম, তার উৎস পুঁথিগত বিদ্যা নয়, আমার প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতা। ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক হিসেবে বরিশাল জেলা উপমহাদেশের সভ্যতার প্রত্যন্ত দেশ। সেখানে পৌঁছনই কঠিন কাজ। অথচ শৈশব থেকেই দেখেছি আমাদের গ্রাম এবং শহরের জীবনে বহু দূর দূর দেশের সংস্কৃতির গভীর প্রলেপ। প্রপিতামহ আরবি-ফারসি জানা আলিম ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সংগৃহীত বইগুলির মধ্যে একটা বড় অংশ সুফিদের রচনা। পরে শুনেছি উনি কোনও সুফি পিরের শিষ্য ছিলেন। আমাদের সম্পত্তির দক্ষিণ অংশে সম্পূর্ণ গণ্ডগ্রামের অধিবাসী কিছু লোক রোমান ক্যাথলিক। তাদের নাম গোমেজ, আলভারেজ ইত্যাদি—মানে খাঁটি পর্তুগিজ। গ্রামবাসী ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা নিষ্ঠাচারী হিন্দু, তাঁদের আচার ব্যবহার প্রতি পদে রঘুনন্দন-লিখিত অনুশাসন মেনে চলে। প্রপিতামহর মাতা এবং পিতামহী দু’জনেই সতী হয়েছিলেন। কোনও অজ্ঞাত অতীতে উত্তর ভারত থেকে আমদানি পৌরাণিক হিন্দু ধর্ম স্থানীয় লোকসংস্কৃতি এবং তান্ত্রিক আচার-অনাচারের সঙ্গে মিশে আমাদের ধর্মচেতনা গড়ে তুলেছিল। অথচ আমার পিতামহ নিরীশ্বরবাদী পজিটিভিস্ট। ওগুস্ত কোঁতের সম্পূর্ণ গ্রন্থাবলী তিনি কীর্তিপাশার স্কুল লাইব্রেরিকে দান করেছিলেন। ছোট মফসল শহরটির অখ্যাত বইয়ের দোকানে উঁচু মানের ফরাসি সাহিত্যগ্রন্থ বিক্রি হয়। আমাদের এই প্রত্যন্ত দেশের জীবনে দুর দূর থেকে নানা সভ্যতার বীজ নানা ভাবে উড়ে এসে পড়েছে। কেন, কীভাবে আমরা এই দুরের অতিথিদের নিজেদের জীবনে গ্রহণ করেছিলাম, ছোটবেলা থেকেই এই প্রশ্ন বারবারই আমাকে বিস্মিত করেছে। আমার সীমিত গবেষণায় নানা ভাবে এই প্রশ্নেরই আমি উত্তর খুঁজেছি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লেখা থিসিস, এবং তারই ভিত্তিতে রচিত আমার প্রথম গবেষণাগ্রন্থ আকবর-জাহাঙ্গিরের আমলে সদ্যবিজিত বাংলার সামাজিক ইতিহাস সেই প্রচেষ্টারই প্রথম ফল। দিল্লি-আগ্রা থেকে শাসিত বাংলাদেশ সব অর্থেই বিদেশি শাসনের আওতায় এসেছিল। অপর পক্ষে সুলতানরা তো আধা বাঙালি বনে গিয়েছিলেন। দিল্লিকেন্দ্রিক এই শাসনের ঘাত-প্রতিঘাতে বাঙালি জীবনে নতুন কোনও দিগন্ত উন্মুক্ত হয়েছিল কি? এই প্রশ্নেরই ছেলেমানুষি উত্তরের প্রচেষ্টা ওই বইয়ে। এখন পড়তে লজ্জা করে। কিন্তু লেখকের প্রচণ্ড উৎসাহ বোধহয় পাঠকের মন ছুঁতে পেরেছিল। তাই বইটি তখন প্রশংসা পেয়েছিল। এক এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে মহাপণ্ডিত দানীসাহেব ন্যায্য নিন্দা করেছিলেন। ‘৫৩ সনে এ. মুখার্জী এন্ড কোম্পানির অমিয়বাবু আমাকে বললেন, “আমাদের জন্য একখানা বুক আপনি ল্যাখেন।” প্রকাশকের দৃষ্টি নিয়ে উনি ওঁর প্রকাশিত সব বই এগারোশো বা দু হাজারের সংস্করণ ভাবে প্রত্যক্ষ করতেন। তাই লেখকদের উনি অনুরোধ করতেন একখানা ‘বুক’ লিখতে, সর্বদাই বহুবচনে। ছাব্বিশ বছর বয়সে লেখা আমার বুকটি উনি যত্ন করে প্রচার এবং বিক্রি করেছিলেন। পঞ্চাশ বছর আগে প্রকাশিত বইটি এখনও কিছু কিছু বিক্রি হয় দেখে মাঝে মাঝে বেশ বিব্রত বোধ করি। ওই বুকস’খানা বোধহয় না ছাপালেই ভাল ছিল।

এই প্রসঙ্গে একটা কথার পুনরাবৃত্তি করি। কলকাতার ডি.ফিল ডিগ্রি যারা পায় তাদের প্রথম কয়েকজনের মধ্যে আমি একজন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই অপেক্ষাকৃত নিচু মানের ডিগ্রিটি চালু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভাল কাজ করেননি। এর ফলে সস্তায় কেল্লা ফতে করার। একটা প্রবণতা দেখা দেয়। গবেষণার ভবিষ্যতের পক্ষে ব্যাপারটা ভাল হয়নি।

আমার ‘বুকস’খানা প্রকাশিত হওয়ার অল্প পরেই স্কলারশিপ পাওয়ার পাকা খবর পেলাম। অক্সফোর্ড যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হল। ওখানে পড়া অনেক দিনকার ইচ্ছা। কখনও সম্ভব হবে মনে করিনি। স্টেট স্কলারশিপ বেশ কিছু দিন হল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বোধহয়। ‘৪৭ সনে রোডস স্কলারশিপ ভারতীয়দের জন্যও চালু হয় বছরে দুটি। বার দুই চেষ্টা। করে পাইনি। দিল্লির স্মার্ট ছেলেদের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতাম না, যদিও প্রথম ভারতীয় রোডস স্কলার অসীম দত্ত, আমাদের অসীমদা। তার উপর ওই স্কলারশিপের একটি শর্ত ছিল—খেলাধুলায় পারদর্শিতা। ছোটবেলা থেকেই ও ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছি। স্টেট স্কলারশিপের বেলায় ওসব বালাই না থাকায় বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। এখানে বলা উচিত—পশ্চিমবঙ্গে স্টেট স্কলারশিপ যাঁর উদ্যোগে চালু হয় তিনি, আর আমি যাঁর বিরাগভাজন হয়েছিলাম, দু’জনে একই ব্যক্তি। স্কলারশিপ পেয়েছি খবর পেয়েই স্যার যদুনাথ কলিন ডেভিসকে চিঠি দিলেন। সেই সুবাদে বেলিয়ল কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেপ্টেম্বর মাসে জাহাজ ধরব বলে বম্বে রওনা হলাম হাওড়া স্টেশন থেকে। আমার কর্মজীবনের প্রথম পর্বের এইখানেই সমাপ্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *