১৪. আজ মায়মুনের বিয়ে

৯ই অগ্রহায়ণ। আজ মায়মুনের বিয়ে। লতিফ মিয়ার বাড়ী গিয়ে এই শুভ দিনটি জেনে এসেছিল শফির মা।

লতিফ মিয়া তার পকেট পঞ্জিকা বের করে। একটা পাতার ওপর নজর দিয়ে সে আপন মনেই বলে—চন্দ্র রাজ্জা বুধ মন্ত্রী। তারপর শুভকার্যের নির্ঘণ্ট দেখে বলে দেয়—অগ্রাণ মাসের ১ তারিখে একটা শুভদিন আছে। আর একটা আছে শেষাশেষি-২৭ তারিখ। এছাড়া অগ্রাণ মাসে আর দিন নেই।

লতিফ মিয়া তার পঞ্জিকা বন্ধ করে। পঞ্জিকার ওপরের রাশিচক্র অঙ্কিত মলাটের দিকে তাকিয়ে লতিফ মিয়ার গণনায় শফির মার মনে একটু সন্দেহ জাগে না। সে ভাবে—এমন বই-এর গণনা কখনও ভুল হতে পারে না। লতিফ মিয়াকে দাওয়াত করে শফির মা বিদায় হয়। পথে আসতে আসতে সে শুভদিনটি মনে মনে ইয়াদ করে।

গণনা নির্ভুল সন্দেহ নেই। কারণ, এই তারিখে আশেপাশে আরো অনেক বাড়ীতে বিয়ের ধুম লেগেছে। গায়ের জমিদার বাড়াতেও আজ বিয়ে। বাজারে দুধ কিনতে গিয়ে তা টের পাওয়া যায়। দুধের সর ছয় আনা থেকে বেড়ে এক টাকা হয়। মাছের দর চড়ে হয় দ্বিগুণ। বাজারের অর্ধেক দুধ, ঝাকায় ঝাকায় বাছা-বাছা রুই কাতলা মাছ যায় জমিদার বাড়ী।

হাসু ও শফি আসে বিয়ের বাজার করতে। চার সের দুধ, দুটো শোল মাছ, দুটো লাউ আর চাল-ডাল এবং আরো কিছু সওদা নিয়ে তারা বাড়ী আসে।

বাজার-ফেরত তিন টাকা ও কয়েক আনা হাসু মা-র কাছে ফেরত দেয়।

জয়গুন বলে বারো টাকা যে খতম করলি, আরো ত অনেক খরচ আছে।

শফির মা বলে—থুইয়া দ্যাও। অতহত দরকার নাই। পনেরো টাকা দিছে মোট্টে। ওয়াগ ট্যাকা দিয়া ওয়াগ খাওয়াই। আমরা খরচ করতে যাইমু কোন্‌ দুক্‌খে?

—গোশত অইলে ভালা অইত।

থুইয়া দে, আবার গোশত। আরো পাঁচখান ট্যাকা দিবার কইছিলাম, হেইয়া দিল না, কিরপিন।

—দিছে পনেরো টাকা। আইব ত ভেড়ার পালের একপাল।

—আহনের কত দশ জনের। কয়জন আহে, আল্লা মালুম।

-তাইত আমি আগেই কইছিলাম, মায়মুনের বিয়াতে টাকা নিমু না। পান-শরবত খাওয়াইয়া বিদায় করমু।

—হেইডা ভালা আছিল।

—কিন্তু কেও হোনলা না আমার কথা। অহন ট্যাকা নিয়া বদনামের ভাগী অই।

—তুমি কিছু চিন্তা কইর না, হাসুর মা। শইল মাছ আর কদু দিয়া একটা ঘণ্ড, ডাইল। আর দুধ-বাতাসা, ব্যস! আবার কি! এ খাইয়া তোর বেয়াই সোলেমান খাঁ তার বউর কাছে, গল্প ছাড়বো! তারিফ করবো তোর রান্দার।

জয়গুলোর হাসি পায়।

নওশা আসবে সন্ধ্যার পরে। বিকেল বেলায় হাসু ও শফি পাড়ার থেকে হোগলা যোগাড় করে এনে পেতে দেয় অতিথিদের বসবার জন্যে। উঠানের এক পাশে পা ধোয়ার জন্যে পানি ভরা কলসী ও বদনা রেখে দেয়। তার পাশে রাখে জলচৌকি ও খড়ম।

সময়টা ভালো। বৃষ্টি-বাদলের ভয় নেই।

সন্ধ্যার পর বরযাত্রীরা আসে। দুলাও আর সকলের মত পায়ে হেঁটেই আসে। গরীবের বিয়েতে পাল্কীর কথা কেউ কল্পনা করতেও পারে না। পাল্কীর ভাড়ায় একটা পুরোদস্তুর বিয়ে স্বচ্ছন্দে হয়ে যেতে পারে।

বেড়ার ফাঁক দিয়ে জয়গুন জামাই দেখে নেয়। গোলাপী মাদ্রাজী লুঙ্গি পরনে, গায়ে বেগুনী রঙের পাঞ্জাবী আর মাথায় লাল টুপি। তার মুখের বসন্তের কালো কালো দাগ আর ছাগলে দাড়ি কয়গাছা জয়গুনের কাছে বিশ্রী ঠেকে। বয়স পঁচিশের ওপরে হবে, জয়গুন অনুমান করে। মেয়েকে নদীতেই ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। তা ছাড়া আর কি!

দুলা এবং আর যে দু’এক জনের পায়ে জুতো আছে, তারা উঠে গিয়ে বিছানায় বসে। বাকী সবাই এক এক করে জলচৌকির ওপর বসে পা ধোয়। তারপর বিছানার পাশে আর একজনকে খড়ম ছেড়ে দিয়ে মজলিশে এসে বসে।

সকলের শেষে জুতো পায়ে থপথপ শব্দ করতে করতে আসে গদু প্রধান। বেঢপ চটি জোড়া বিছানার পাশে রাখতে ভরসা হয় না তার। শফিকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করে—এই হানে রাখলে থাকবো ত? না চুরি যাইব?

মজলিশের মাঝ থেকে একজন বলে—গেলই বা চুরি। পুরান গেলে নতুন আনবেন।

—তোমরা এহনও নাবালক। জানো, পুরান জোতা আর পুরান চাদরের মর্ম? পুরান জোতা আর পুরান চাদরের সর্মান বেশী।

জুতো জোড়া হাতে করে যেতে যেতে আবার বলে—নতুন জোত পায়ে দিয়ে মজলিশে গেলে মাইনষে কি মনে করে, জানো? মনে করে, নতুন হিখছে জোতা পায় দিতে।

মৃদু হাসির গুঞ্জন শোনা যায়।

গদু প্রধান মসজিদের মৌলবী সাহেবের পাশে জায়গা বেছে নেয়। বসবার আগে জুতো জোড়া পেছনে হোগলার নিচে রেখে দেয়।

গদু প্রধান এসে জুতো চুরির যে প্রসঙ্গ তুলে দেয়, তা আর থামতে চায় না। কার বিয়েতে কার জুতো চুরি গিয়েছিল, কার চামড়ার জুতো কার রবারের জুতোর সঙ্গে বদল হয়েছিল—এসব গল্প।

সবাই যখন গল্পে মেতে আছে, তখন হাসু এক ফাঁকে লোক গুণে যায়। জয়গুনকে গিয়ে বলে বেবাকে তেইশ জন, মা।

জয়গুন মাথায় হাত দেয়। সব শুদ্ধ পনেরো জনের আয়োজন করা হয়েছে। এখন কি উপায় করা যায় সে ভেবে উঠতে পারে না।

শফির মা-কে ডেকে বলে—তুমি সামলাও। আমি আর পারি না, বইন।

—কোন চিন্তা নাই। এক কাম কর। চাইর সের চাউলের ভাত চাপাইয়া দে। আমি ডাইলে দুই বদনা আর দুধে এক বদনা পানি মিশাইয়া দেই। যেমুন মাছ, তেমুন বড়ি না অইলে কি দুইন্যাই চলে? পালবরাদ্দে আইছে যেমুন, খাইব তেমুন ঝড়া পানি।

জুতো চুরির চাপ ছেড়ে কার জমিতে কি রকম ধান হবে, কোন বিলের ধানে পোকা। ধরেছে, কার বছরের খোরাকি হবে, কার হবে না—এ সব আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে।

একজন বলে—পরধানের চিন্তা নাই। কম কইরাও পাচ-ছয় হাজার টাকার ধান বেচতে পারব।

গদু প্রধান চুপ করে থাকে। মজলিসের মধ্যে তার টাকার তারিফ করলে সে খুশীই হয়।

এবার দুলার বাপ সোলেমান খাঁ অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে পড়ে। সে বলে, স্বাদীন যে অইল হের কোন নমুনাই যে পাইলাম না আইজও। দিন দিন যে খারাপের দিগেই চুলল। মওসুমের সময়ই চাউলের দর এত, শেষে না জানি কি অয়!

শেষে যদি কিছু হয়, তবে গদু প্রধানের পোয়াবারো। চালের দর চড়ক—মনে মনে সে তাই কামনা করে।

একজন বলে—দ্যাখছ, কাপড় পাওয়া যায় না বাজারে। খালি জোলইরা কাপড়। তাও কুড়ি-বাইশ টাকা জোড়া। একি কিনতে পারে?

গদু প্রধান বলে—আর কিছু দিন পর এও পাইবা না। বউ-ঝিরা ঘরের বাইর অইতে পারব না।

দুলার চাচা লোকমান বলে—কত আশা-ভসসা আছিল। স্বাদীন অইলে ভাত কাপড় সাইয্য অইব। খাজনা মকুব অইব। কিন্তু কই? বেবাক ফাঁটকি, বেবাক ফাঁকি। আবার রেল গাড়ীর ভাড়াও বাইড়া গেল।

—আরো কত দ্যাখা মিয়া, মাত্র বিছমিল্লা।—মৌলবী সাহেব বলেন। তারপর গদু প্রধানের কানে কানে কি বলেন।

গদু প্রধান বলেন—দশটার মইদ্যে বিয়া পড়াইতে অইব। কই সোলেমান? শোন এদিগ। সোলেমান খাঁ এলে আস্তে আস্তে গদু প্রধান বলে—তোমার বেয়ানরে আগে তোবা করাইতে অইব।

—ক্যাঁ?

—ক্যাঁ আবার! হায়ানের মত যেইখানে হেইখানে ঘুইরা বেড়ায়, দ্যাখতে পাও না? ভাল মাইনষের মাইয়া। বিয়াও অইছিল ভালা ঘরে। ভালা জাতের মাইয়া এই রকম বেজাত বেপর্দা অইলে আমাগই বদনাম। তোবা করাইয়া দিতে অইব। পরচাতে আর যেন বাড়ীর বাইর না অয়।

—হেইডা ত ভালা কথাই।

—তুমি কথাডা মজলিশে উড়াও। জোরে কইও যেন ঘরের তন তোমার বেয়ান হোন্‌তে। পায়। আমি আছি তোমার পিছে।

—না, আপনেই উড়ান। আমার শরম করে।

গদু প্রধান বলে বেশ জোরের সাথেই–বিয়ার আগে বৌর মারে তোবা করাইতে অইব। তোবা না করাইলে মৌলবী সাব কলমা পড়াইব না। আর হে ছাড়া কে কলমা পড়ায় আমি দেইক্যা লইমু।

মৌলবী সাহেবের মুখের ওপর মজলিশের সমস্ত চোখ একযোগে এসে পড়ে। মৌলবী সাহেব এবার একজন বেপর্দা স্ত্রীলোক ও তার স্বামীর কেচ্ছা শুরু করেন।

জয়গুন মায়মুনের চুলের জট ছাড়াতে শুরু করেছিল। গদু প্রধানের কথা তার কানে। আসতেই সে লাফ দিয়ে ওঠে। শফির মা-র কাছে গিয়ে বলে—হোনলা নি শফির মা?

—হ, হোনলাম। তার কি করতে চাও?

—কি করতে চাই? তোবা আমি করতাম না। আমি কোন গোনা করি নাই। মৌলবী সা’ব বিয়া না পড়াইলে না পড়াউক। আমার মায়মুনের বিয়া দিমু না।

—এইডা কি কথার মতোন কতা। ট্যাকা দিছে তারা।

—ট্যাকা দিছে, পেড় ভইরা খাইয়া ট্যাকা ওসুল কইরা যাউক। আমি ত আর টাকা সিন্দুকে ভইরা থুই নাই।

—না, না। ওই হগল কথা রাখ। এমুন ঘর আর পাবি না। আর আইজ এই রহম কইর‍্যা ফিরাইয়া দিলে বদনামী অইব কত! তোর বাড়ীতে আর কেও থুক ফেলতেও আইব না। আবার গদু পরধান আছে এর পিছে। ওকি যেমুন তেমুন গোঁয়ার! ও যদি মনে করে, উর মাডি চুর করে।

জয়গুন চিন্তিত হয়। তার মুখে কালো ছায়া। সে ভাবে—তওবা করলে ঘরে বদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। ঘরে বন্ধ হয়ে থাকার অর্থ না খেয়ে তিলে তিলে শুকিয়ে মরা। জয়গুনের চোখ ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়। সে তীব্র কণ্ঠে বলে—না, আমি তোবা করতাম না।

মজলিশে মৌলবী সাহেবের গলা শোনা যায়। তিনি গল্প বলছেন—ঐ লোকটা তার বেপর্দা স্ত্রীকে কিছুতেই তালাক দিল না। তখন একজনের ওপর হুকুম অইল—ওরে কতল কর। লোকটাকে কাইট্যা ফেলা অইল। আর তার লহু থেইকা পয়দা অইল কি? না, একটা হারাম জানোয়ার–খিঞ্জির—শুয়োর। এইবার আপনারা দ্যাখেন, পর্দা কি চীজ। পর্দা না মানলে চল্লিশ বছরের এবাদত কবুল হয় না খোদার দরগায়। সব বরবাদ অইয়া যায়। বেপর্দা স্ত্রীলোক আর রাস্তার কুত্তী সমান।

জয়গুন চমকে ওঠে।

শফির মা কেরামত ও জহিরুদ্দিন মোড়লকে ডেকে আনে।

জহিরুদ্দিন বলে—মৌলবী সা’ব ঠিক কথাই কইছে হাসুর মা। তোবা কইরা ফ্যাল।

কেরামত সায় দিয়ে বলে—হ চাচি, তোবা কর।

জয়গুন জ্বলে ওঠে—তোবা কইরা ঘরে বইস্যা থাকলে আমারে খাওয়াইতে পারবি?

শান্ত হয়ে আবার বলে—তোমরা ইনসাফ কইর‍্যা কও, তোবা করলে কে আমারে ঘরে আইন্যা খাওয়াইব? হাসু যা রোজগার করে ও দিয়া দুই পেট চলে না। মায়মুনেরে আইজ বিদায় দিলেও ওরে নাইয়র আনত অইব। ও অহনতরি শিশু। মাসের মইদ্যে দশদিন ও আমার বাড়ীতেই থাকব। এতগুলা পেট কেমন কইর‍্যা চালাই, তোমরাই কও।

জহিরুদ্দিন বলে—খোদায় খাওয়াইব। মোখ দিছে যে, আহার দিব সে।

জয়গুন হাসে শ্লেষের হাসি।

কেরামত বলে—আইজকার দিনডার লেইগ্যা তোবা কইর‍্যা নেও। তারপর–

—তোবা তো’বা-ই। একবার করলে তা আর ভাঙতে পারতাম না।

বাইরে দু প্রধানের গলা শোনা যায়—অনেক রাইত অইল। কই কেরামত? চালাক কর।

—করতাছি মিয়া সাব।

কেরামত মজলিশে যায়। মৌলবী সাহেব দোর গোড়ায় এসে তার মাথার লম্বা পাগড়িটা খুলে তার এক প্রান্ত কেরামতের হাতে তুলে দিয়ে অন্য প্রান্ত নিজের কাছে রাখেন।

কেরামত ঘরের ভেতর গিয়ে বলে—ধইর‍্যা থাক, চাচি। হুজুর যা যা কইবেন, খেয়াল কইর‍্য। দিলের মইদ্যে গাইথ্যা রাইখ্য সব।

দ্বিধার সাথে জয়গুন পাগড়ির মাথাটা দুই হাতে চেপে ধরে। তার মনের মধ্যে তখনও দ্বন্দ্ব চলছে।

মৌলবী সাহেব টানা সুরে থেমে থেমে কি বলে যান তার একটা কথাও তার কানে ঢোকে না। কেরামত যখন আবার তার হাত থেকে পাগড়ির প্রান্তটা নিতে আসে, তখন তার সম্বিত ফিরে আসে।

এবার খাওয়ার পালা।

জয়গুন তওবা করায় আজ মৌলবী সাহেবেরও খেতে আপত্তি নেই। একদিন তিনি জয়গুনের দেয়া হাঁসের ডিম ফেরত দিয়েছিলেন। কিন্তু সেইদিনের সেই জয়গুন আর এখনকার জয়গুনে তফাত অনেক। একটু আগেও সে মৌলবী সাহেবের কাছে ছিল রাস্তার কুকুরের সামিল।

 

গদু প্রধান সামনের সারির একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে—কিরে আদেল, ভাত সামনে কইর‍্যা বইস্যা আছস ক্যান? খাইতে পারস না বুঝি?

—পারমু না ক্যাঁ? দুধ দিয়া মাইর‍্যা দিমু।

সাদত আলী বলে—আইজ কাইলকার ছেঁড়ারা পোয়া চাউলের ভাত খাইতে পারে না। এই বয়সে আমরা লোয়া খাইয়া লোয়া অজম করছি। খাইতে খাইতে মাজার কাপড় যে। কয়বার ঢিলা করতে অইত তার শুমার নাই।

গদু প্রধান বলে—জোয়ান বয়সের কালে এক সের চাউলের ভাত অজম করছি আমি।

সাদত আলী বলে—পরধানের মনে আছে? হেই মধু আলইকরের দোকানে তুমি আর আমি বাজী রাইখ্যা রসোগোল্লা খাইছিলাম। তুমি আমার তন ছয়খান বেশী খাইছিল। আমি খাইছিলাম একচল্লিশটা, আর তুমি–

—আর আমি সাতচল্লিশটা। সাদত আলীর কথা শেষ না হতেই গদু প্রধান বলে।

লেদু পাশ থেকে বলে রাইখ্যা দ্যাও ওই হগল কিচ্ছা। আইজ কাইলকার ডোরা খাইতে পারে না? খাইতে পারে, মিয়াভাই কিন্তু খাওয়ায় কেডা? খাইতে না পারলে ভালই আছিল। খোদা খোরাক কমাইয়া দিলে ত খুশী অইতাম। শুকুর ভেজতাম খোদার দরবারে। মসজিদে শিন্নি দিতাম!

লেদুর মাথায় ছিট আছে। কিন্তু তার স্পষ্টবাদিতার জন্য অনেকে তাকে পছন্দ করে। গদু প্রধান কিছু বুঝতে না পেরে বলে—কি রহম?

—বোঝলা না, মিয়াভাই? তোমার গোলাভরা ধান আছে। এক সেরের বদলে দুই সের খাইলেও তোমার গোলা ঠিক থাকব। কিন্তু আমি সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলাইয়া রুজি করি পাঁচ সিকা। এই টাকা পেড়ে দিমু, কাপোড় পিল্ম, না এর তন রাজার খাজনা দিমু? ঘরে পরিবার আছে। তিনডা বাচ্চা আছে। আমার পেড যদি তোমার মতন এক সের খাইতে চায়, তয় উপায়খান অইব কি? সারাদিন খাইট্যা সোয়া সের চাউল গামছায় বাইন্দা ঘরে ফিরি। সাধে কি আর আইজকাইলকার ছেঁড়ারা খাইতে পারে না। খাইতে পারে না, না, খাইতে পায় না, কও। মাইনষের পেড ছোড অইয়া যাউক খোদার কাছে আরজ করি। বেবাকের পেড়ে মাজায় লাইগ্যা এক অউক। এক ছড়াকের বেশী যেন খাইতে না অয়। এইডা অইলে আর আকাল অইব না দ্যাশে।

অনেকক্ষণ ধরে থাকা গ্রাসটা এবার মুখে দেয় লেদু।

তার কথা সবারই ভালো লাগে। শুধু দাদু প্রধানের কাছে ভালো লাগে না। সে এবার। হক দেয়–আরে, এই খানে ভাতের গামলা লও। ডাইল লও। কেমুন খাদেম, অ্যাঁ! খানেওয়ালা চিন না?

থালার ওপর ঝুঁকে পড়া নিব্জদেহ বৃদ্ধ নাজিমুদ্দিন মাথা উঠিয়ে বলে—লেদুরে আমরা। পাগল কই আর ছাগল কই, ওর কথা কাডায় কাডায় সত্য। মাইনষের পেডটা না থাকলে আমি খুশী অইতাম। পেডের জ্বালাই বড় জ্বালা মাইনষের। নানা জনের নানা কথার মধ্য দিয়ে খাওয়া শেষ হয়। সোলেমান খাঁ মজলিশের মধ্যে একটা জায়গায় নিজের কাঁধের গামছাটা বিছিয়ে দেয়। তার চারপাশে কন্যাপক্ষের কেরামত ও জহিরুদ্দিন এবং বরপক্ষের প্রায় সমস্ত লোক কাঁধে কাঁধে মেশামেশি হয়ে বসে। প্রথম সারির পেছনে অল্প বয়সী ছেলেরা হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে তাকায় উৎসুক হয়ে।

সোলেমান খাঁ একটা টিনের পুরাতন সুটকেস খুলে গয়নাগুলো গামছার ওপর আলাদা করে জোড়ায় জোড়ায় সাজিয়ে রাখে। গয়নার মধ্যে বয়লা, গোলখাড়, নাকফুল, নোলক। এগুলো হাত দিয়ে নেড়ে প্রথমেই আপত্তি করে কেরামত—আপনের গয়নার জোখা নেন নাই? এত বড় গয়না কে পরব?

—বড় অওয়ন ভালা। বউ আমাগ অহন ডেগা অইলে কি অইব? এক বচ্ছর পর যহন। সিয়ানা অইব তহন ঠিক কাপাকাপা অইব। ভাঙা-গড়া করলে রূপা আর রূপা থাকে না। ফুক্কা আইয়া যায়।

আসলে গয়নাগুলো ছিল ওসমানের প্রথমা স্ত্রীর। সে মারা যাওয়ার পর চোখা রূপার এই গয়নাগুলোকে মেজে ধুয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

জহিরুদ্দিন গয়না হাতে নিয়ে ভালো করে পরখ করে। নাকের নোলক ও নাকফুল ছাড়া আর কোনটাই তার কাছে রূপার বলে মনে হয় না। সে কেমিক্যালের কানফুল জোড়া এক দিকে সরিয়ে হাত দিয়ে আর গুলো চোখের কাছে নিয়ে দেখে। কিন্তু বরপক্ষের এত লোকের সামনে কথা বলতে তার সাহস হয় না। সত্যিই যদি রাপার জিনিস হয়ে থাকে তবে মজলিশের এত লোকের সামনে লজ্জায় কান কাটা যাবে। কেউ হয়ত বলেও বসতে পারে—বাপের বয়সে রূপা দ্যাহ নাই কোন দিন?

ওসমানের প্রথমা স্ত্রীর পাটের শাড়ী, একখানা লাল পেড়ে শাড়ী ও গয়নাগুলো ঘরে নিয়ে যায় কেরামত। হাতের বয়লা ও পায়ের গোলখাড় সুতো দিয়ে বেঁধে পরিয়ে দেওয়া হয় মায়মুনকে। পাটের দশ হাত শাড়ীটা এমন পেঁচিয়ে সামলান হয় যে, দূর থেকে মায়মুনকে দেখে বোঝা যায় না। মনে হয় একটা কাপড়ের পুটলি।

মায়মুন আবদারের সাথে তার মা-কে বলে—মা, তুমি যাইবা না আমার লগে?

—আমি যাইমু কি করতে মা?

—আমি তোমারে ছাইড়্যা কেমনে থাকতাম?

—ক্যাঁ? হাসু যাইব, শফি যাইব।

মায়মুন নিশ্চিন্ত হয়।

জয়গুণ আবার বলে—তোর চিন্তা নাই। দুই দিনের বেশী রাখতাম না তোরে পরের বাড়ী। পরশু লইয়া আইমু আবার। এই বার আঁইট্যা যা দেহি দুয়ার তক, দেহি কেমুন দাহা যায়।

মায়মুন উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু এত বড় শাড়ীটা সামলান তার পক্ষে কষ্টকর। শাড়ীটা বারবার পায়ের নিচে পড়ে তার হাঁটায় বাধার সৃষ্টি করে।

মায়মুনকে দেখে জয়গুনের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এ চোখের পানি সুখের না দুঃখের বলা শক্ত।

সাক্ষী ও উকিল যখন ঘরে আসে, তখন মায়মুন বসে বসে ঝিমুচ্ছে। জয়গুন মাথার কাপড়টা একটু টেনে মায়মুনকে হাত দিয়ে আকষর্ণ করে—একি মায়মুন! ওঠ দ্যাখ কারা আইছে!

উকিল তখন বলতে শুরু করে—তোমারে সোলেমানের ব্যাটা ওসমানের লগে পঞ্চাশ টাকা দেন মোহরে নিকাহ দিলাম। তুমি রাজী আছ?

জয়গুন মায়মুনকে বুকে চেপে ধরে। বলে—কও মায়মুন, হ রাজী আছি।

একথা বোঝার বা বলার মধ্যে কোন নতুনত্ব নেই মায়মুনের কাছে। কথা কয়টা তার অনুভূতিকে একটুও নাড়া দেয় না। তোতা পাখীকে শিখিয়ে দিলে সে যেমন বলে, মায়মনও তেমনি মা-র কথা অনুসরণ করে।

—রাজী আছি।

সাক্ষী ও উকিল পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হাসে। জয়গুন একগ্লাস শরবত মায়মুনের হাতে দিয়ে বলে—নে লক্ষী, এক চুমক খাইয়া গেলাসটা দিয়া দে।

উকিল সরবতের গ্লাস নিয়ে সাক্ষীর সাথে বিয়ের মজলিশে চলে যায়।

এক সঙ্গে অনেকগুলো বিয়ে হচ্ছে বলে একটা ভুলিও পাওয়া যায়নি। বিয়ের পর তাই সোলেমান বা তার ছেলে-বৌকে কোলে তুলে নিয়ে সকলের সাথে বাড়ীর দিকে পথ নেয়। মায়মুনের ছোট ও পাতলা শরীরের ওজনে সোলেমান খ বিস্মিত হয়। একটা তুলো ভরা বালিশের মত মনে হচ্ছে তার কাছে। সে মনে মনে চিন্তিত হয়। জোয়ান ছেলের জন্যে এতটুকু মেয়ে নেয়া ঠিক হল না বুঝি। আরো তিন তিনটি বছর পুষতে হবে ভাত-কাপড় দিয়ে, তবে ছেলের উপযুক্ত হবে বউ। কিন্তু এ তিন বছর–

সোলেমান খাঁ জোর করে চিন্তাটাকে সরিয়ে দেয়। ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে সে আজকের বিয়ের আনন্দটা মাটি করে দিতে চায় না।

 

ভোর রাত্রের দিকে বেশ শীত পড়ে। জয়গুন বাইরে চুলোর পাশে গিয়ে বসে। চুলোর মধ্যে বিয়ের রান্নার আগুন তখনও নিবে যায়নি। জয়গুন ঠাণ্ডা হাত দুটো চুলোর ওপর মেলে ধরে। মাথাটাও ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে। তার চোখ-ঝরা পানি চুলোর আগুনে পুড়ে অস্পষ্ট ছ্যাং-ছ্যাৎ শব্দ করে আর সাথে সাথে বাষ্প হয়ে মিশে যায় বাতাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *