১৪. অজয়কে ঘুম পাড়াইয়া

অজয়কে ঘুম পাড়াইয়া প্রদীপ ছাতে চলিয়া আসিল। নিজের তক্তপোষটা বন্ধুকে ছাড়িয়া দিতে হইয়াছে; তাহা ছাড়া ঘুমও যে আসিবে এমন মনে হইতেছে না। অস্থিরপদে সে ছাতের এক প্রান্ত। হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পাইচারি করিতে লাগিল। সে এ কয়দিন প্রচুর আলস্যভোগ করিয়াছে, এইবার আবার তাহার দুই ব্যাকুল পক্ষ প্রসারিত করিতে হইবে। কিন্তু একটা করিবার মত কিছু না করিতে পারিলে তাহার আর স্বস্তি নাই।

রেলিঙ্‌-হীন ছাতের এক ধারে পা ঝুলাইয়। প্রদীপ বসিয়া পড়িল। অন্ধকার আকাশে অগণন তারা কোটি-কোটি ব্যর্থস্বপ্নের মত উজ্জ্বল হইয়া রহিয়াছে; রাস্তায় মুখ বাড়াইয়া চাহিয়া দেখিল একটি লোকও পথ চলিতেছে না। এই অবারিত স্তব্ধতার মধ্যে নিজেকে প্রদীপের কী যে নিঃসঙ্গ ও একাকী লাগিল! নিজের পেশীবহুল দৃঢ় বক্ষতটের দিকে চাহিয়া সে ভাবিল, সে কি জন্য নিশ্বাস ফেলিতেছে—এই পৃথিবীতে সে আসিয়াছে কেন? কি সে করিতে চাহিতেছে? অজয়ের দুই চোখে উগ্র মৃত্যু-পিপাসা; সে বলে : আমরা পৃথিবীতে আসিয়া মরিব এই আমাদের জীবনধারণের পরম পরিপূর্ণতা-কৰ্ম্মসাধনায়। আমাদের মৃত্যুকে মহিমান্বিত করিয়া তোলাই আমাদের কাজ। আমি আয়ুর ভিখারী নহি। স্ফটিক হইয়া চুর্ণ হইব তাহাও ভালো, তবু সামান্য প্রস্তরখণ্ড হইয়া গৃহচুড়ে অবিনশ্বর আলস্যে বিরাজ করিব না।

জীবনের মর্যাদা কষিতে হইবে মানুষের মৃত্যুর মূল্যে। . অজয় তাই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে সবলে উপেক্ষা করিয়া আসিয়াছে—সে তাহা চায় না। তার বাবার সম্পত্তির আয় বৎসরে কম করিয়া পনেরো হাজার টাকা, সে দুই হাতে তাহা নিয়া পুতুল খেলিতে পারিত। সে বলে : “বাবা যদি আমার এই ত্যাগ দেখে আমাকে ত্যাজ্যপুত্র না করেন ত’ এই টাকা দিয়ে আমি মাসিক একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করব। সামান্য হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু একটা উদার উদাহরণ ত’ দেখানো যাবে। সুদুর দৃষ্টি আমাদের দেশে অনেকেরই আছে প্রদীপ, কিন্তু সুন্দর একটা দৃষ্টান্ত নেই।”

প্রদীপ জিজ্ঞাসা করিয়াছিল : “কি তোমার সেই উদাহরণ?”

—“মোটামুটি এই। জেল থেকে যে-সব কয়েদি বেরিয়ে এসে ফের চুরি ও ডাকাতি করা ছাড়া বেকার-যন্ত্রণা নিবারণ করবার আর পথ পায় না, তাদের জন্যে ছোটখাট করে একটা ভরণপোষণের সংস্থান করে দেব। যারা চুরি-ডাকাতি করে, তারা যত গর্হিত কাজই করুক না কেন, তাদের বুদ্ধি আছে, সাহস আছে, দলবদ্ধ হ’বার কৌশল জানা আছে। শুধু তাই নয়, একত্র সবদ্ধ হয়ে কাজ করার মধ্যে যে-সব গুণ থাকে, তা থেকেও ওরা বঞ্চিত নয়।”

প্রদীপ ফের প্রশ্ন করিয়াছিল : “যেমন?”

—“যেমন ধরো কাৰ্য সিদ্ধ করতে কেউ যদি আহত হয়, তবে তাকে তারা নিরাপদ স্থানে বহন করে রক্ষা করে—গোপনে-গোপনে সেবা-শুশ্রুষা করতে ত্রুটি করে না। এরাও মানুষ প্রদীপ, এদেররা মহত্ত্ব আছে। তোমাদের মত এরাও মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে চাঁদ দেখে, কোনো একখানি মুখের সাদৃশ্য খুঁজে নিতেও হয়ত দেরি করে না। সমাজ থেকে এদের বহিষ্করণের পথ আমি বন্ধ করে দেব।”

প্রদীপ হাসিয়া বলিয়াছিল। কিন্তু তোমার বাবা যদি তোমাকেই বহিষ্কার করেন?”

উত্তরে অজয়ও হাসিয়াছিল বৈ কি। বলিয়াছিল : “বছরে পনেরো হাজার টাকা? ফুঃ! কেড়ে নিতে কতক্ষণ!”

অদ্ভুত, অসাধারণ অজয়। তাহার সঙ্গে পা মিলাইয়া চলে প্রদীপের সাধ্য কি। সে তাহা চাহেও না। সে তাহার দেহের প্রতিটি স্নায়ু ভরিয়া তপ্ত রক্তস্রোত অনুভব করিতে চায়। এই ভাবে মরিয়া বাচিতে তাহার ইচ্ছা করে না। অজয় তাহাকে বিলাসী, ভাবুক, অলস আরো কত-কি বলিবে, তবু আজিকার এই নক্ষত্ৰপ্লাবিত আকাশের নীচে সে নিজেকে বিরহী মানুষ বলিয়াই অভিনন্দিত করিয়া সুখ পাইল।

একটা ছোটখাট চাকুরি পাইলে সে বাঁচে। এমন করিয়া ভূতের খাটিতে সে লাহোর হইতে কলিকাতা আর ঘুরিতে পারে না সে এখন একটু জিরাইয়া লইলে পৃথিবীর দুর্দশা কি এমন ভয়াবহ হইত, তাহা সে ভাবিয়া পায় না। কত দিন পরে সে ছাতে উঠিয়া আকাশ দেখিল কে জানে! সে যে একদিন কল্পিত মানুষের সুখ-দুঃখ, মনদেওয়া-নেওয়া নিয়া গবেষণা করিয়াছে বা করিতে পারে এমন কথা সে নিজেই ভুলিতে বসিয়াছিল—কিন্তু আজ তাহার রাত জাগিয়া, ভারি মিষ্টি করিয়া একটি ছোট গল্প লিখিতে ইচ্ছা করিতেছে। একটি সাধারণ ঘরোয়া গল্প—দুইটি সংসারানভিজ্ঞ স্বামী-স্ত্রী লইয়া। গল্পের একটি ছত্রেও রোমাঞ্চকর উদ্দীপনা থাকিবে না—পুষ্করিণীর মত নিস্তরঙ্গ প্রশান্ত জীবন।

সে গল্প লিখিতে লিখিতে তন্ময় হইয়া থাকিবে, ঘরের আরেকটি লোক সামনের নিবুনিবু দীপশিখাটি উস্কাইয়া দিলে তাহার সহসা জ্ঞান হইবে যে, অন্ধকার ঘরে মাটির বাতিটির চেয়েও উজ্জ্বল আরেকখানি মুখ আছে। প্রদীপ চক্ষু বুজিয়া সে-মুখ ভাবিতে গেল। স্তিমিতাভ বিমর্ষ মুখ। আশ্চৰ্য্য, কপালে সিন্দুর নাই। মুখোনি দেখিয়া মনে হয়, কত বৎসর আগে যেন তাহাকে একবার দেখিয়াছে। নাম ধরিয়া ডাকিলেই কথা কহিবে।

এই সব কথা শুনিলে অজয়ের দলের লোকেরা তাহাকে যে কি ভাবিবে, তাহা সে জানিত। কিন্তু এমন করিয়া ভণ্ডামি, করিবারই বা কি মানে আছে? অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখের জন্য সে নিজের সুখকে তুচ্ছ করিতে পারিলে হয় ত’ কোনো দিন কলিকাতা শহরে তাহারই নামে একটা রাস্তা হইয়া যাইত; কিন্তু নিজের সুখকে যদি সে জুতার সুখতলার মত চুড়িয়া ফেলিতে না পারে তবে কি তাহার ক্ষমা মিলিবে না? সুখ সে পাইবে কিনা কে জানে, হয় ত’ যে-পথে সে পা বাড়াইবে ভাবিতেছে, সে-পথে দুঃখের রাজ-সমারোেহ চলিয়াছে—তবু হয় ত’ তা সমারোহই। কোথায়ই বা সমারোহ নয়? যে কিছু চাহে না বলিয়া ভগবানকেই চাহে, ঐশ্বৰ্য্য সে কম ভোগ করে না। মরিলে সে অমর হইবে, এমন একটা পরম প্রলোভনেই ত’ অজয়—অজয় হইয়াছে।

সে এই মরণের মধ্যে নমিতাকে টানিয়া আনিতে চাহিয়াছিল। ছি ছি! নমিতার মধ্যে সে বন্দী ভারতবর্ষের মৌনী মূর্তি দেখিয়া শিহরিত হইল, কিন্তু তাহার অন্তরালে যে কত কালের স্থবির সমাজের কলুষিত সংস্কার রহিয়াছে, সে দিকে তাহার দৃষ্টি পড়িল না। নমিতার মৰ্য্যাদা উচ্ছঙ্খল বিদ্রোহে নয়, সংযত আত্মপ্রতিষ্ঠায়। তাহার মুক্তি কৃপাণে নয়, কল্যাণে। প্রদীপ নমিতার পথ-নির্দেশ করিবে। সে আর স্থির হইয়া বসিতে পারিল না, হটিতে সুরু করিল।

তারাগুলি ক্রমে ক্রমে মিলাইয়া যাইতেছে। প্রদীপ ছাতের উপরই একটু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, বোধ করি কি-একটা শব্দ হইতেই তাহার ঘুম ভাঙিল। স্পষ্ট চোখে পড়িল, কে যেন তাহার শিয়রের কাছে বসিয়া আছে। প্রথমটা ভালো করিয়া ঠাহর হইল না। লোকটাকে চিনিবার জন্য সে জামার পকেট হইতে টর্চ বাহির করিতে গেল। একা ছাতে আসিয়াছে অথচ টর্চ লইয়া আসে নাই। এই লোকটা যদি এখন অপ্রতিবাদে অস্ত্র-প্রয়োগ করিয়া বসে! যে এত অসাবধান ও অমনোেযোগী, তাহার পক্ষে ত’ সব ছাড়িয়া-ছুড়িয়া দিব্য বিবাহ করাই প্রশস্ত। ঐ পক্ষ হইতে একটা কাণ্ড হইয়া গেলে কেলেঙ্কারির আর সীমা থাকিবে না। বেচারা অজয় অসহায়!

ভীষণ ঘাবড়াইয়া গিয়া প্রদীপ কি করিয়া বসিবে, ভাবিতে ভাবিতেই লোকটা ভারি স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল : “আমাকে চিনতে পাচ্ছ না? আমি সুধী।”

—“সুধী?” আতঙ্কে ও বিস্ময়ে প্রদীপ লাফাইয়া উঠিল। নক্ষত্রমণ্ডলীর প্রভাবে সে হঠাৎ পাগল হইয়া যায় নাই ত’? নাকের নীচে ডান-হাতের তালুটা পাতিয়া সে নিজের নিশ্বাস অনুভব করিল। মনে ত’ হইল সে বাঁচিয়া আছে। তবে ছাত বাহিয়া এই লোকটা কোথা হইতে আসিয়া নিজেকে সুধী বলিয়া পরিচয় দিতেছে। ধমক দিবার জন্য সে চেচাইতে চাহিল, কিন্তু স্বর বাহির হইল না।

লোকটি কহিল : “আমি বলেছি বলে’ ত’ একটুও মনে হয় না। অনেক দূর দেশে বেড়াতে গিয়েছিলুম,—বায়ুকোণে ঐ যে তারাটা দেখছ সেখানে। সেখানে সাহিত্যিক বলে আমার খুব নাম হয়েছে। তোমাদের ভাষায় আমার বইগুলি অনূদিত হয় নি?”

যাহা হক্‌, লোকটা মারমুখো নয়, বেশ বিনাইয়া কথা কহিতে জানে। প্রদীপ এবার গলা খুলিয়া বলিতে পারিল : “দূরদেশ থেকে এতদিন বাদে কি মনে করে? বায়ুকোণের তারায়ও বেকার-সমস্যা চলেছে নাকি?”

সুধী উদাসীন হইয়া কহিল,—“অনেকদিন পরে নমিতা আমাকে স্মরণ করেছে, প্রদীপ। না এসে থাকতে পারলুম না। আমি এখুনি তার কাছ থেকে আসছি।”

—“নমিতার কাছ থেকে আসছ—তার মানে? ভূত হয়েও তুমি তার ওপর স্বামীত্ব ফলাবে? কে আর তোমার নমিতা? সূর্য অস্ত গেলেও তোমাদের দেশে আলো থাকে নাকি? নমিতার প্রতি তোমার এই রূঢ় আচরণ আর আমি সহ্য করবে না।” প্রদীপ হাত বাড়াইয়া সুধীকে ধরিতে যাইতেছিল, সে একটু সরিয়া বসিল।

সুধীর মুখে স্বল্প-ম্লান হাসি : “আমি সেই কথাই নমিতাকে বুঝিয়ে দিয়ে এলুম। তার ইহজীবনে আমি যে তার সত্যি করে কেউ ছিলুম না, মরে’ তার পূজোপচার আমি কি করে’ গ্রহণ করব? তার কাছে আমি তোমার নাম করে এসেছি।”

—“আমার নাম কেন করতে যাবে? আমি কে? তুমি বলছ কি সুধী?”

সুধী নিরুত্তর। তাহাকে নাড়া দিবার জন্য প্রদীপ সামনের দিকে তাহার দুই হাত প্রসারিত করিয়া দিল। কিন্তু কঠিন একটা ইটে হাতের মুঠা দুইটা আহত হইতেই সে দেখিল ভোরের ফিকে আলোতে সুধীকে আর দেখা যাইতেছে না। বার কতক চক্ষু কচলাইয়া নীচু হইয়া ঝুঁকিয়া রাস্তায় তাকাইল—কতগুলি ময়লা-ফেলার গাড়ি জড়ো হইয়াছে। প্রদীপ কি করিবে ভাবিয়া পাইল না, ছাতে ফের পাইচারি করিতে লাগিল। ভালো করিয়া তাহার ঘুম হয় নাই। এমন স্বপ্নও মানুষে দেখে নাকি?

মেসের চাকর ছাতে কি-একটা কাজে আসিয়াছিল, তাহাকে প্রদীপ জিজ্ঞাসা করিল,—“তুই রাতে একবার উপরে এসেছিলি?”

একটা পরিত্যক্ত কাপড় গুটাইতে গুটাইতে যদু কহিল,—“না ত’।”

—“আচ্ছা, আমার ঘরের সবাই উঠেছে?”

—“অনেকক্ষণ।”

—“আমার বিছানায় কাল যিনি শুয়েছিলেন তিনি উঠেছেন?”

—“কৈ, জানি না, বাবু।”

—“যা, দেখে আয়।”

যদু কাপড় গুছাইয়া নামিয়া গেল। বিনা-সমাধানে হঠাৎ এই ছাত ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার সে নাম করিতে পারিল না। খানিক বাদে যদু ফিরিয়া আসিল; কহিল,—“সে বাবু এখনো ওঠেন নি, শুনলাম তাঁর জ্বর। কিন্তু নীচে আপনাকে কে ডাকছেন।”

—“আমাকে?” প্রদীপের অন্তরাত্মা শুকাইয়া উঠিল। অত্যন্ত ভীতস্বরে সে চুপি চুপি কহিল,—“কে ডাকছে রে?”

যদু হাসিয়া কহিল,—“একটি মেয়ে। চিনি না।”

—“মেয়ে? কে মেয়ে?” প্রদীপ দিবালোকেও রাতের স্বপ্নের জের টানিয়া চলিতেছে বোধ হয়।

হাত উল্টাইয়া যদু বলিল,—“তা ত’ আমি জিজ্ঞাসা করিনি, বাবু।”

নিশ্চয়ই নমিতা আসিয়াছে। প্রদীপ আর সন্দেহ করিল না। স্থাণ্ডে দুইটার মধ্যে পা দুইটা ঢুকাইয়া তাড়াতাড়ি নামিয়া চলিল। সেই প্রত্যাশিত প্রভাত আজ আসিল বুঝি—নমিতাকে সে আজ কোন্ মূর্তিতে দেখিবে? বিদ্রোহিনী বিজয়িনীর বেশে, না সরমনমিতা স্পর্শভীরু কবিকল্পনার মত? ভগবান করুন, সে যেন এই নির্মল প্রভাতটির সঙ্গে একটি অম্লান সাদৃশ্য রাখিয়াই অবতীর্ণ হয়! সেই অল্প কয়টি মুহূর্তের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সে যে কত কিছু ভাবিয়া নিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। কিন্তু নীচে আসিয়া যাহাকে সে দেখিল, তাহা স্বপ্নেরও অতীত ছিল বোধ করি।

দম নিয়া প্রদীপ কহিল,—“তুমি? এ সময়ে এখানে?”

উমা মিষ্টি করিয়া হাসিয়া বলিল,-“সকালবেলা যে আমি মাঠে বেড়াতে যাই। প্রত্যহ। শচীপ্রসাদকে কাল আসতে বারণ করে’ দিয়েছি। একাই বেরোলুম আজ।”

হতাশার আবেশটা কাটিয়া যাইতেই প্রদীপ যেন সুস্থ ও সচেতন হইল। কহিল,—“হঠাৎ আমার কাছে? কোনো দরকার আছে?”

উমা দুইটি টলটলে ডাগর চক্ষু নাচাইয়া কহিল,—“ববার মত দরকার কিছুই নেই তেমন।”

প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“না বলবার মত আছে ত’?”

—“তেমন একটা কিছু না থাকলে বিজ্ঞানই অচল হয়ে পড়ে শুনেছি। শুনতে চান? আপনার সঙ্গে অনেকদিন দেখা নেই, দেখা করতে এলুম। আমাদের বাড়ির মত আপনিও আমাকে তাড়িয়ে দেবেন নাকি?”

প্রদীপ কহিল,—“দিলেই কিন্তু ভালো হত। কেননা এটা মেষজাতীয় পুরুষদের একটা মেস। এখানে তোমার পায়ের ধূলো পড়লে অনেকের ব্যঞ্জনই বিস্বাদ হয়ে উঠবে।”

কৌতূহলী হইয়া উমা কহিল, “কারণ?”

—“কারণ, আমাকে সুনজরে দেখে না এমন প্রতিবেশী আমার উঠতে বসতে। প্রকাশ্যে তুমি আমার আতিথ্য স্বীকার করলে, কালক্রমে তুমিই হয় ত’ আমার ওপর অকরুণ হয়ে উঠবে; কারণ একদিকে তোমার সংসার, অন্য দিকে এই কুৎসিত জনতা।”

উমা একটুও বিচলিত না হইয়া বলিল,-“অত সব কথা আমার মুখস্ত নেই। আপনার সঙ্গে দেখা করার দরকার আমার আছে কি নেই, সে বিচার আমি আপনার সঙ্গে করব। অন্য লোকের যদি তাতে গাত্রদাহ বা পিত্তশূল হয়, হবে। তাদের বিনা-দামে আমরা চিকিৎসা করতে যাব কেন? চলুন, ওপরে আপনার ঘরে। বলবার মত। দরকার একটা পেয়েছি।”

প্রদীপ ঘামিয়া উঠিল। উমা উত্তেজিত হইয়া সিড়ির উপর পা বাড়াইয়া দিয়াছে। তাহাকে বাধা দিতে গেলেই সে আরো অবাধ্য হইয়া উঠিবে। প্রদীপ তাড়াতাড়ি রাস্তার উপর নামিয়া আসিল। বলিল,-“চল পার্কে, তোমার দরকার অদরকারের সমাধান হবে।”

উমা নড়িল না, কহিল,—“সেখানেও প্রকাশ্য জনতার ভয় আছে। আমি আপনার এই অন্যায় ও মিথ্যা সমাজহিতৈষণার শাসন করব। কথাটা খুব জমকালো করে বল্লম, কেননা সোজা কথা ঘোরালো করে’

বলে আপনারা বোঝেন না। আপনার এই আতিথেয়তার প্রতিদান আমি দেব একদিন—আমাদের বাড়িতেই নিমন্ত্রণ করে।”

প্রদীপের তবু সাহস হইতেছিল না; না জানিয়া-শুনিয়া উমা এই বিপদের মুখে কেন পা বাড়াইতেছে? সে ধীরে কহিল,—“ব্যাপারটা

খুব শোভন হবে না, উমা! তা ছাড়া—”

উমা হাসিয়া বলিল,-“আপনার ‘তা ছাড়া’-টা বলুন। আগের যুক্তিটা বাতিল।” পরে মুখ নিদারুণ গম্ভীর করিয়া সে কহিল,—“এত সব অমানুষিক কাজের ভার নিয়েছেন, অথচ একটি মেয়ের সম্পর্কে সামান্য লোকনিন্দা বহন করতে পারবেন না? তার চেয়ে বেত হাতে স্কুল-মাষ্টার হওয়াই আপনার উচিত ছিল। চলুন।”

প্রদীপও গম্ভীর হইল : “তা ছাড়া আমার ঘরে একটি অসুস্থ বন্ধু আছেন। তাঁর জ্বর।”

—“বন্ধু?” ভুরু কুচকাইয়া উমা কি ভাবিতে চেষ্টা করিল : “তার নাম কি?।

—“বন্ধুদের নাম যাকে-তাকে বলতে হয় না।”

—“বেশ ত’, তারই সঙ্গে আমার দরকার। কি করে আর আমার পথ আটকাবেন? এটা পঞ্চভূতের মেস, আপনার নিজের বাড়ি নয়। আপনার অসুস্থ বন্ধুর হার্টফেল থেকে তাকে শিগগির বাচা বলছি।” বলিয়াই উমা পাশের সিড়ি দিয়। উপরে উঠিতে লাগিল।

অগত্যা প্রদীপ আর পদানুসরণ না করিয়া করে কি। তাহাকেই ঘর দেখাইয়া দিতে হইল। অজয়ের ঘুম ভাঙিয়াছে; বালিশটাকে দেয়ালের গায়ে রাখিয়া তাহাতে পিঠ দিয়া সে অন্যমনস্কর মত বসিয়া ছিল। ঘরে হঠাৎ একটি অপরিচিতা কিশোরীকে দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। তাহার সর্বাঙ্গ হইতে চাপল্য যেন পিছলাইয়া পড়িতেছে; মুখোনিতে সাধারণ বাঙালি মেয়ের মুখের মত একটা নিরীহতা নাই, অন্তত নমিতার মুখে সে এই দীপ্তি ও ধী দেখিয়াছে বলিয়া মনে হইল না। সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপও ঘরে ঢুকিল। অজয়ের একটু আশ্বস্ত হইবার আগেই প্রদীপ বলিয়া উঠিল,—“নমিতাকে ত’ তুমি চিনতে, এ তারই ননদ। তোমার একটা সামাজিক পরিচয়ই দিলুম, উমা।”

উমা চক্ষু বড় করিয়া কহিল,—“আমার আরেকটা অসামাজিক পরিচয় আছে নাকি?”

প্রদীপ কহিল,—“নেই? বল্‌ব তবে?”

উমা বলিল,-“মিছিমিছি কেন অতিরঞ্জন করবেন?” আমিই বছি : “বাড়ির শাসন আমি মানি না, সকাল বেলা একা বেড়াতে বেরই, মে-এর দুয়ারে দাঁড়িয়ে কেউ বাধা দিলে তাকে টপকে উপরে উঠে আসি। এই ত’?”

দুই বন্ধু হাসিয়া উঠিল। অজয় বিছানার উপর একটু সরিয়া

বসিল : “বসুন এখানে।”

যে ব্যক্তি মোক্তারি পড়ে সে বাহিরে যাইবে বলিয়া কাছা আঁটিতেছিল, চক্ষু দুইটা তেছা করিয়া সে ফিক ফিক্‌ করিয়া হাসিল। বলিল,—“একটা চেয়ার এনে দেব?”

উমা কহিল,—“চেয়ারে বসে বক্তৃতা দিতে আমি আসিনি। (অজয়ের প্রতি) বয়েস আন্দাজে আমাকে আপনার খুব এঁচড়ে-পাকা মনে হচ্ছে, না? আমি তাই।”

কোটের উপর চাদর চড়াইয়া ভাবী মোক্তার অন্তর্হিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে অজয় কহিয়া উঠিল : “লোকটা ভালো নয়, প্রদীপ। কাল রাতে লুকিয়ে ও আমার সুকেশ ঘেঁটেছে। লোকটা হয় চোর, নয় তার চেয়েও জঘন্য। আমাকে কিছু পয়সা দাও। আমিও এক্ষুনি বেরব।”

প্রদীপ চকাইয়া উঠিল : “বল কি? এই অসুস্থ শরীরে তুমি কোথায় যাবে?”

অজয় এমন করিয়া অল্প একটু হাসিল যে, প্রদীপ অধোবদন হইল। তবু কহিল,—“পয়সা ত’ আমার কাছে একটিও নেই।”

–“না থাক্; লাগবে না। এক মুহূর্ত দেরি করা চলবে না।” বলিয়া ক্লান্তপদে সে উঠিয়া দাঁড়াইল। . কোন রকমে সার্টটা গায়ে দিল, পায়ে জুতা ছিল না—সুটকেসটা হাতে লইয়া বাঁ-হাতে চুলগুলি একবার নাড়িয়া দিয়া কহিল,-“আমি চলুম। (উমার প্রতি) আপনার সঙ্গে ভালো করে আলাপ হ’ল না। আবার যদি কোনো দিন দেখা হয়, আপনাকে ঠিক চিনে নিতে পারুব। কিন্তু আবার কি দেখা হবে?”

উমা ও প্রদীপের মুখে কোনো কথা আসিল না, সমস্ত ঘরের আবহাওয়াটা নিমেষে কেমন ভারি, থমথমে হইয়া উঠিয়াছে। অজয়কে সত্যসত্যই টলিতে টলিতে দরজার দিকে অগ্রসর হইতে দেখিয়া প্রদীপ বাধা দিয়া বলিল,—“একটা গাড়ি ডেকে দেব?”

অজয় হাসিয়া কহিল,—“কিন্তু ভাড়া? গাড়ি লাগবে না।”

উমা এইবার কথা পাইল : “যদি কিছু মনে না করেন ত’ আমার কাছে সামান্য কিছু আছে।”

-“মনে কিছু নিশ্চয়ই কবুব। দিন শিগগির।” বলিয়া অজয় হাত পাতিল।

সেমিজের মধ্য হইতে ছোট একটি ব্যাগ খুলিয়া তিনটি টাকা অজয়ের হাতে দিতেই সে মুঠা করিয়া কপালে ঠেকাইল। কহিল, “আমার লোভ যে আরো বেড়ে যাচ্ছে। এবার আপনি যদি কিছু মনে না করেন ত’ আপনার দু’-হাত থেকে একগাছি করে সোনার চুড়ি আমাকে উপহার দি। দু-হাত থেকে একগাছি করে’ চুড়ি আপনার খোয়া গেলে আপনাকে আরো সুন্দর দেখাবে। আমার একদম ট্রেন-ভাড়া নেই। (হাসিয়া) আমি আমার দেশের বাড়ি ফিরে যাচ্ছি কি না। আসচে সাতাশে তারিখে যে আমার বিয়ে হবে।”

মুহূর্তে যে কি হইয়া গেল, ভাবাবেশে উমা আদ্যোপান্ত কিছু বুঝিতে পারিল না। ধীরে ধীরে চুড়ি দুইগাছি সে খুলিয়া ফেলিল। তাহার হাত হইতে ছিনাইয়া লইবার মত করিয়া তাড়াতাড়ি চুড়ি দুইগাছি টানিয়া নিয়া অজয় কহিল,—“তা হলে গাড়ি একটা ডেকে দাও, প্রদীপ। পরের পয়সায় বাবুগিরি যখন কপালে আছেই, একটুতেই তাছাড়ি কেন? যাও দেরি করো না।”

 

 

প্রদীপ তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইতেছিল, উমা কহিল,-“দাঁড়ান, আমিও যাচ্ছি আপনার সঙ্গে।”

—“আমার সঙ্গে কোথায় যাবে তুমি? একা বাড়ি ফিরতে পারবে না?”

হাসিয়া উমা জবাব দিল : “না, পথ কি আর চিনি? কিন্তু আপনার সঙ্গে দরকারী কথাটাই যে বাকি রইল।”

অজয় কহিল,—“চট্‌পট্ সেরে নি, বেশিক্ষণ আমি দাঁড়াতে পারছি না।”

উমা প্রদীপকে কহিল,—“আপনি একদিন বৌদি’র ঠিকানা খুজছিলেন না? তিনি এখন আমাদের ওখানেই এসেছেন।”

—“কে? নমিতা? তোমাদের ওখানকার ঠিকানাঠটা কি শুনি?” বলিয়া অজয় পকেট হাতড়াইয়া এক-টুকরা কাগজ বাহির করিল। সামনের কেরোসিন কাঠের টেবিলটার উপর কোথাও পেন্সিল একটা পাওয়া যায় কি না তাহারই সন্ধানে অন্যমনস্ক অজয় কহিতে লাগিল, “যতই দুৰ্ব্বল আর সন্দিগ্ধ হোল্ক না কেন, সেবায় নমিতার হাত আছে। একটুও ঘেন্না না করে দু’হাতে আমার বমি কাচালে। ভেবেছিলুম এ-কথা স্মরণ করে’ নমিতাকে ভবিষ্যতে একটি অবিনশ্বর মর্যাদা দেব। কিন্তু পরে যখন তার ভেতর থেকে সঙ্কীর্ণদৃষ্টি ভীরু নারীপ্রকৃতি আত্মপ্রকাশ করল তখন তার সেই অধঃপতনকে ক্ষমা করতে পারলুম না।”

প্রদীপ বলিল,—“তাকে তোমার ক্ষমা না করলেও চলবে। স্বল্প পরিচয়ের অবসরে তুমি তাকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে, আর আবেগে অন্ধ হয়ে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করল বলেই সে ভীরু? আমি তার বিচক্ষণতাকে প্রশংসা করি। উত্তেজনার কুয়াশায় বুদ্ধিকে সে আচ্ছন্ন করে নি।”

—“ঐ রকম অকর্মণ্য বুদ্ধি নিয়ে সে চিরকাল কৃত্রিম বৈধব্য-পালনই করুক। অকারণ সন্তান প্রসবের চেয়েও তা নিন্দনীয়।”

প্রদীপের ইহা সহিল না। কহিল,—“অত্মিীয়ের নিন্দা আত্মীয়ের সামনে শোভন নয়। একটু সংযম শিক্ষা করলে ভালো করতে।”

অজয় উমার দিকে ফিরিয়া কহিল,—“ও! আপনি ব্যথিত হচ্ছেন? কিন্তু যেটা সত্যিই নিন্দনীয় সেটা গোপন করে রাখলেই পাপ। এমনি করে আমাদের সমাজে পাপের প্রসার হচ্ছে।”

উমা কহিল,—“এখন সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্যটাও আপনাকে শুনতে হলে আপনার এমনি করে অসুস্থ শরীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়বার মতলবের কোনো মানে থাকবে না। যান দীপদা, গাড়ি নিয়ে আসুন।”

উমাকে নিজের পক্ষে পাইয়া প্রদীপ জোর পাইল। কহিল, “তুমি ভাবছ এমনি সর্বনেশে উচ্ছলতার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়াটাই জীবন—”

অজয় চেঁচাইয়া উঠিল : “হাঁ, এই সৰ্বনেশে উচ্ছঙ্খলতা! এই জীবনের যথার্থ প্রতিশব্দ! নইলে ঐ ব্যর্থতা আমার সহ্য হয় নি, আমি তাকে বলিষ্ঠ কর্মের মধ্যে আহ্বান করেছিলুম—যে-কর্মের পুরস্কার মহামহিমান্বিত পরাজয়! নমিতা একটা পায়রার চেয়েও ভীরু।”

উমা কহিল,—“দুর্ভাগ্যবশত আপনি হাততালি পেলেন না। আমি বৌদিকে আরেকবার বলে দেখব ‘খন।”

অজয় পেন্সিল পাইল না। কহিল,—“তার ঠিকানাটা দিন, দরকার হলে তার কাছে আবার আমার আবির্ভাব হবে। ইতিমধ্যে আকাশের ঝড়ের আকারে তার ওপরে সমাজের অভিশাপ বর্ষিত হ’তে থাকু। এবার এলে আমাকে যেন শূন্য হাতে আর ফিরতে না হয়, ভগবান।”

উমা হাসিয়া কহিল,—“আপনি ভগবানে বিশ্বাস করেন নাকি?”

—“নিশ্চয় করি।” প্র

দীপ ঠাট্টা করিয়া কহিল,—“উনি অবতার।”

—“সত্যি তাই। আমি আমার নিজের ভগবান। কিন্তু অযথা বাকৃবিস্তার আর কবো না। ঠিকানাটা বলুন, মনে করেই রাখব ঠিক। নমিতাকে যদি না ভুলি ত’ তার ঠিকানাটাও ভুলব না।”

উমা কহিল,—“ঠিকানা জেনে লাভ নেই। আপনার আবির্ভাবের সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে।”

—“কেন? কেন?” অজয় উৎসুক হইয়া উঠিল : “আমার সম্পর্কে তার খুব নিন্দা হচ্ছে বুঝি? তার চরিত্রে দোষারোপ হয়েছে? তাই হোক। আমি শুনে খুব সুখী হলুম।”

প্রদীপ ঝাঝালো গলায় কহিল,—“সুখী হ’লে? তুমি দিন-কে-দিন ইতর হচ্ছ।”

অজয় চটিল না, কহিল,—“আমি নমিতার উপকার চাই। অপবাদ ওর যত উপকার করবে শত উপদেশেও তা হবে না। নমিতা যদি বাঁচে নিজেকে যেন ঘৃণ্য মনে করে’ই বাঁচে—তাতে যদি উদ্ধারের একটা উৎসাহ পায়। নিজের সতীত্ব নিজেই যেন লুণ্ঠন না করে।”

—“ঢের হয়েছে, এবার থাম। শালীনতা বলে’ জিনিস তোমার জানা নেই দেখছি। তুমি এখন গেলেই আমরা সুখী হ’ব।”

অজয় চকাইয়া উঠিল; কহিল,—“যাচ্ছি। বলুন ঠিকানাটা।”

—“বলো না, উমা খবরদার। তুমি একে চেন না।”

প্রদীপের মুখের এই কর্কশ কথা শুনিয়া অজয় মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হইয়া গেল, কি বলিবে ভাবিয়া পাইল না। নমিতার প্রতি সে কঠিন হইতেছে বলিয়া প্রদীপের কেন যে আঘাত লাগিতেছে তাহা তলাইয়া দেখিবার সময় ছিল না; এবং সময় থাকিতেও জাতির দুর্দশার দিনে কোনো যুবক সামান্য নারী-প্রেমে মাতোয়ারা হইতে পারে এমন একটা জাজ্বল্যমান সত্যকে সে প্রাণপণে অস্বীকার করে। তবু কি ভাবিয়া সে কহিল,—“সত্যিই আমাকে আপনি চেনেন না; চেনেন না বলেই তবু দুয়েকটা কথা বলছেন—আমাকে না চিন্বার আগেই যদি ঠিকানাটা দেন ত’ পাই, নইলে—” অজয় জোর দিয়া কহিল,–“নইলে ঠিকানা একেবারে পাবই না ভেবেছ, প্রদীপ? আমাদের কোটি কোটি কামনার ফলে পৃথিবীর সৌভাগ্য-সম্পদ যেমন অনিবাৰ্য, তেমনি নমিতার প্রতি আমার প্রয়োজনবোধ যদি কোনো দিন একান্ত হয়ে ওঠেই, তোমাদের শত-লক্ষ অবরোধ তাকে নিবারণ করতে পারবে না। এ-কথা তোমাকে আমি উঁচু গলায় বলে যাচ্ছি। কিন্তু ভগবান করুন, আমার প্রয়োজনে তাকে যেন মুক্ত না হতে হয়, সে যেন নিজের প্রয়োজনেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে।”

—“বলি তুমি যাবে, না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার কসরৎ করবে?” প্রদীপ অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছে।

অজয় কহিল,—“যাব বৈ কি। একজায়গায় বেশিক্ষণ থাকবার জো কোথায়? (উমার প্রতি) কিন্তু ঠিকানা যখন পেলুমই না, তখন নমিতার সম্বন্ধে বাকি খবরটুকু জেনেই যাই না হয়। তার সঙ্গে দেখা হবার সমস্ত পথ ত’ আপনারাই বন্ধ করে দিলেন।”

প্রদীপ চঞ্চল হইয়া উঠিল : “বাকি খবরে তোমার দরকার নেই। সে আমাকে উমা আরেকদিন বলবে। তোমার গাড়ি লাগবে কি না, বল। আমার কাজ আছে।”

অজয় হাসিয়া কহিল,—“তার চেয়ে আমার কাজ আরো জরুরি। নমিতার খবর আমার চাই। বলুন। আমি নমিতাকে উদ্যত শাসনের ফণা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলুম, সে স্বেচ্ছায় দাসত্ব যেচে নিয়েছে—

প্রদীপ ফের প্রতিবাদ করিল : “তুমি তার আচরণের এমন কদৰ্য্য ব্যাখ্যা করোনা বছি।”

—“হ্যাঁ, সে দাসত্বের যুপকাষ্ঠে আবার গলা বাড়ালে। মেয়েদের আত্মকর্তৃত্ব হয় ত’ প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ।”

-“তোমার সঙ্গে গেলে তুমি তার আচরণের যত মহান অর্থ-ই দিতে কেন আমরা তাকে স্বেচ্ছাচরিণী বলতাম। সেখানেও সে তোমার দাসত্ব করত।”

—“ভুল, প্রদীপ। সে দাসত্ব করত জাগ্রত ভাগ্য-বিধাতার। সে-দাসত্ব পূজা, নৈবেদ্য, জীবনোৎসর্গ!”

উমা এতক্ষণে কথা কহিল : “বৌদি ত’ পূজোই করছেন। বাকি খবরটুকু তার তাই।”

—“পূজো করছে? কার?” প্রশ্নের উত্তর পাইবার আগেই অজয় আপন মনে বলিয়া চলিল : “তার ক্ষণিক দুর্বলতা দেখে সত্যিই আমি একেবারে আশা ছাড়িনি, প্রদীপ। বহু যুগের প্রথা ও সংস্কারের ভস্মে আচ্ছাদিত থেকেও তার মধ্যে আমি বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ দেখেছিলুম। নিজের দৈন্য দেখে একদিন দেশকে সে বড়ো করে অনুভব করবেই।

সে পূজার লগ্ন তার জীবনে এল?”

উমা তরলকণ্ঠে কহিল,—“দেশ নয়, স্বামী।”

একটা বজ্ৰ ভাঙিয়া পড়িলেও বোধ করি এতটা ঘাবড়াইবার হেতু ছিল না। অজয় যেন স্বপ্নে একটা পৰ্বতচূড়া হইতে নীচে নিক্ষিপ্ত হইল। রূঢ় রুক্ষস্বরে সে কহিল,—“দেশ নয়, স্বামী! স্বামীপূজো করছে সে? স্বামীর ফোটো-পূজো?”

উমা ফিক্‌ করিয়া হাসিয়া কহিল,-“ঠিক তাই।”

এক মুহূর্তও দেরি হইল না। উমার বাক্যোচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গেই অজয় সমস্ত ঘর-বাড়ি ঝাপাইয়া তুমুল অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। ঐ কয়খানা জীর্ণ-পঞ্জরের মধ্য হইতে এমন একটা বিদ্রুপোচ্ছাস উদ্ভূত হইতে পারে এ-কথা কোনো শারীরতত্ত্বশাস্ত্রে লেখা নাই। উমার কথা শুনিয়া প্রদীপও সামান্য স্তম্ভিত হইয়াছিল বটে, কিন্তু এমন একটা কুৎসিত অপরিমেয় হাসি শুনিয়া তাহার স্নায়ুতে আর যেন বল রহিল না। উমাও দেয়ালের দিকে পিছাইয়া গিয়াছে। অজয় সুটকেশটার হাত বদল করিয়া বলিল,-“ঠিকানা আর আমার চাইনে। সে মরুক্‌!” বলিয়াই সে দুৰ্বল ক্লান্ত পায়ে নীচে নামিতে লাগিল। দুই-তিনটা সিড়ি নামিয়া সে কহিল, “আমি শরীরে এখন বেশ জোর পাচ্ছি, তোমার কষ্ট করে’ আর গাড়ি ডাতে হবে না।”

প্রদীপ কটুকণ্ঠে কহিল,—“পরকে ত’ মরবার অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছ, কিন্তু দেখো, নিজের উদ্ধৃঙ্খলতাই না তোমার শাপের বিপরীত অর্থ করে বসে।”

অজয় প্রায় নীচে নামিয়া আসিয়াছিল, এক ধাপ উঠিয়া কহিল, “আমি বহু পুণ্যাত্মার অভিসম্পাত কুড়িয়েই জীবনে যাত্রা করেছি,প্রদীপ। কোনো পরিণামই আমার পক্ষে অপ্রত্যাশিত হবে না। কিন্তু সবাই যদি সৰ্বান্তঃকরণে নমিতাকে শাপ’, তা হলেই তার কল্যাণ হবে। জান, আমি ক্ষণকালের জন্য তার চোখে বিদ্যুৎ দেখেছিলুম। অভি সম্পাতে সে-আগুন হয় ত’ আরেকবার জ্বলে উঠবে—আরেকবার।”

অজয়কে আর দেখা গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *