১৩. যজ্ঞির জন্যে ছানাবড়া ভাজা হচ্ছে

যজ্ঞির জন্যে ছানাবড়া ভাজা হচ্ছে। ভিয়েনের ‘চালা’য় বড় বড় কাঠের উনুন জ্বেলে কারিগররা লেগে গেছে ভোর থেকে। প্রথমে বোঁদে ভেজে স্তুপাকার করে রেখেছে কাঠের বারকোশে, এখন থেকে শুরু হয়েছে। ছানাবড়া। প্রচুর পরিমাণে না করলেও চলবে না, নিমন্ত্রিতদের পেট উপচে খাওয়ানোর পর আবার সরাভর্তি ছাঁদা দিতে হবে তো। তা ছাড়া যখন কুল্লে ওই দু-রকম মিষ্টি!

তাড়াহুড়োর যজ্ঞি, ওর বেশী আর সম্ভব হল না, অথবা সেটাও হয়তো ঠিক কথা নয়, মোটামুটি কথা মাত্র। রামকালী চাটুয্যে যদি দরকার বুঝতেন, তা হলে একদিনের মধ্যেই কাটোয়া কি গুপ্তিপাড়া থেকে ওস্তাদ ময়রা আনিয়ে পাঁচ-সাত রকম মিষ্টি বানিয়ে তোলাও অসম্ভব হত না তার পক্ষে। কিন্তু দরকার বোধ করেন নি তিনি।

রাসুর প্রথম বিয়েতে ঘটা হয়েছিল বিস্তর, গ্রামে এখনও তার গল্প ফুরোয় নি। মিষ্টির কারিগর এসেছিল নাটোর থেকে, কেষ্টনগর থেকে, মুড়োগাছা থেকে। কাঁচাগোল্লা ক্ষীরমোহন মতিচুর সরভাজা ছানার ছিলিপি খাজা অমূতি নিখুঁতি ইত্যাদি করে বারো-তেরো রকম মিষ্টি হয়েছিল। আর মাছের কথা তো বলেই শেষ হবে না। এক-একজনের পাতে বড় বড় এক-একটা মালসা ভর্তি মাছের তরকারি বসিয়ে দিয়ে আবার তিন-চারবার করে পরিবেশন। তা ভিন্ন রান্নার পদ তো বাহান্ন রকম, বাহান্ন ব্যঞ্জন নইলে আবার ঘটা কিসের?

কুমোরবাড়ি বরাত দিয়ে সাইজের হাঁড়ি গড়িয়ে আনা হয়েছিল ঝোড়া ঝোড়া, তাতেই গলা উপচে মিষ্টির ছাঁদা। যজ্ঞির জের চলেছিল দিন পনেরো ধরে।

সে কথা আলাদা। সে বিয়ের সঙ্গে এ বিয়ের তুলনা করার কোনও মানেই হয় না। অন্য বাড়ি হলে যজ্ঞিই করত না, নেহাৎ রামকালী চাটুয্যের বাড়ি বলেই এত আয়োজন। পরিমাণে প্রচুরই হচ্ছে, তবে ওই মাত্র দুরকম মিষ্টি, মোলো-কুড়ির মত রান্নার পদ। রান্না এখন চাপে নি, পাশের চালায় তার তোড়জোড় চলছে, হালুইকর ঠাকুর স্নান করতে গেছে।

এ গ্রামে হালুইকর ঠাকুর এনে রাধানোর প্রথা প্রবর্তন করেছেন রামকালীই। মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে দেখেছিলেন এ ব্যবস্থা। নইলে এ গ্রামে চিরদিন কাজেকর্মে গ্রামের ব্রাহ্মণ কন্যারাই বেঁধে থাকেন। সেটা রীতিমত একটা সম্মান-সম্ভ্রমের ব্যাপার। ডাকসাইটে রাঁধুনী বলে খ্যাতি আছে যাদের তাদেরই ডাকা হয় অনেক তোয়াজ করে। রান্নায় বসবার আগে পূর্ণপাত্র, নতুন কাপড়ের জোড়া, সধবা ব্রাহ্মণী হলে আলতা সিঁদুর–এই সব দিয়ে তবে পাকশালে ঢোকাতে হয় তাদের।

তথাপি এই রান্নার পর্ব থেকেই অনেক গদাপর্ব মুষলপর্ব বেধে যায়। গ্রামের যে একদল ছুতো খুঁজে বেড়ানো লোক আছে, তারাই যজ্ঞি দেখলে দক্ষযজ্ঞের আয়োজন করবার তালে ঘোরে। মন কষাকষি, কথান্তর, মান-অভিমান, এসব প্রায় যজ্ঞিরই অঙ্গ। রামকালী ওসব ঝামেলার মধ্যে নেই। পরমা দিয়ে লোক আনাবেন, কাজ করাবেন, চুকে গেল। রাধুনী বামুনের হাতে খেতে যাদের আপত্তি, তারা যাও বিধবার হেসেলে ভর্তি হও গে। মাছ জুটবে না।

তা সে দু-চারজন নিতান্ত নিষ্ঠাপরায়ণ গ্রামবৃদ্ধ ছাড়া না হু করে সকলেই বসে পড়ে রামকালীর বাড়ির ভোজে। ওস্তাদ কারিগরের রান্নার হাত, রামকালীর দরাজ হাত, আর রামকালীর প্রতি সমীহ (শোধ এই ত্রিশক্তির আকর্ষণে সকলেই প্রায় নরম হয়ে আসে। পয়সা যে এ অঞ্চলে কারুরই নেই তা তো নয়, কিন্তু এমন দরাজ হাত? এত বড় দিলদরিয়া মন?

খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে সদ্য কাটানো টাটকা ছানার মিষ্টান্ন ভেজে তোলার সুগন্ধে শুধু আশপাশেরই নয়, সারা গ্রামখানারই বাতাস যেন ম ম করছে। বাড়ি বাড়ি ছোট ছেলেপুলেদের ঘরে আটকে রাখা দুঃসাধ্য হচ্ছে তাদের অভিভাবকদের।

পায়ে রূপোর বোল দেওয়া খড়ম, গায়ে বেনিয়ান, পরনে নেত্রকোণার থান। সবদিকে চৌকস হয়ে তদারকি করে বেড়াচ্ছেন রামকালী। শুধু মিষ্টির ভিয়েনে শেকড় গেড়ে বসে থাকবার ভারটা দিয়েছেন বড়দা কুঞ্জকে। ওর থেকে বেশী দায়িত্বর কাজ কুঞ্জকে দেওয়া চলে না।

.

গয়লারা দইয়ের ‘ভার’ এনে নামিয়েছে, ক’মণ দইয়ের যোগান দিতে পেরেছে তারা, দাঁড়িয়ে তারই হিসেব নিচ্ছিলেন রামকালী, হঠাৎ নেড়ু এসে কাছে দাঁড়াল। রামকালী গ্রাহ্য করতেন না, কিন্তু নেড়ু একেবারে গায়ের কাছে দাঁড়িয়েছে, ভাবটা যেন কিছু বক্তব্য আছে। গয়লাদের উপর চোখ রেখেই রামকালী মাথাটায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কি রে নেড়ু?

নেড়ু সভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে বলল, একবার অন্দর বাড়িতে যেতে বলছে।

অন্দরবাড়িতে যেতে বলছে? কাকে বলছে?

তোমাকে।

রামকালী ভুরু কুঁচকে বলেন, আমাকে এখন যেতে বলছে? পাগলটা কে হল? অগ্রাহ্যভরে আবার অদূরবর্তী গোয়ালাদের দিকেই মন দেন, বলিস কি রে তুই, ওই পাঁচ মণ বৈ দই দিয়ে ওঠতে পারছিস না! তা হলে আমার উপায়? তুই ভরসা দিলি

তুষ্টু মাথা চুলকে বলে, আজ্ঞে ভরসা তো দেছলাম, কিন্তু মা ভগবতীরা যে আমাকে নিভর্সা করে ছাড়লেন। কাল রেতে তো আর নিদ্রেই দিই নি, চৌদিকে সকল গোহালার ঘরে ঘরে বরাত দিয়ে দিয়ে বেড়ায়েছি, তা সবাইয়ের ঘরের দই যোগসাজস করে এই হল!

এই হল তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমার কি হবে তাই বল? দাঁড়িয়ে অপমান হতে বলিস আমায়?

অপমান! তুষ্টু বীরবিক্রমে বলে ওঠে, বলি একটা ঘাড়ে বিশটা মাথা কার আছে কবরেজ ঠাকুর যে আপনাকে অপমান্যি করবে?

মাথা এ গাঁয়ের এক একজনের একশটা করে, বুঝলি রে তুই! বলে হাসলেন রামকালী, আর ঠিক সেই সময় নেড়ু আর একবার মিহিগলায় ডাক দিল, মেজখুড়ো!

আরে, এ ছোকরা তো ভাল বিপদ করল! কে তোকে পাঠিয়েছে শুনি?

পিসঠাকুমা।

রামকালী বিরক্তভাবে বললেন, তা আমি বুঝেছি, নইলে আর কার এত– বোধ করি কার

বে আক্কেল হবে বলতে যাচ্ছিলেন, সামলে নিলেন। ছোটদের সামনে গুরুজন সম্পর্কে তাচ্ছিল্যসূচক মন্তব্য করবার মত অসতর্কতা এসেছিল বলে রীতিমত বিরক্ত হলেন নিজের উপর। অথচ মোক্ষদার মত কাণ্ডজ্ঞানহীন গুরুজন সম্পর্কে সকলপ্রকার সমীহনীতি মেনে চলাও শক্ত।

        অসতর্কতা সামলে নিয়ে বললেন, বল গে যাও আমার এখন বিস্তর কাজ, তার যা বলবার যখন ভেতরে যাব তখন যেন বলেন।

        তুমি এ কথা বলবে পিসঠাকুমা জানে, তাই আমাকে বলে দিল– নেড়ু ঢোঁক গিলে বলে, বলে দিল বল গে যা বড় পিসঠাকুমার ভেদবমি হয়েছে, বাঁচে কি না, এক্ষুনি দরকার।

         মুখটা আরো কুঁচকে উঠল রামকালীর। পিসীর ভেদবমির দুর্ভাবনায় নয়, মেয়েমানুষের বিবেচনাহীন আবদারের ধৃষ্টতা দেখে। রোগ যে কাশীশ্বরীর হয় নি সেটা নিশ্চিত, তবু অনর্থক হয়রানি করতে ডাকাডাকি। হয়তো বা অভ্যাগত কুটুম্বিনীদের নিয়ে কোনরূপ সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, আর সালিশ মানতে ডাকা হয়েছে রামকালীকে। কিন্তু এই কি তার সময়?

সাতপাড়া লোক নেমন্তন্ন হয়েছে, একদিনের যোগাড়ে যজ্ঞি, মাথায় পর্বত বয়ে ঘুরছেন রামকালী, তখন কিনা এই সব মেয়েলিপনা!

তা ছাড়া আরও বিরক্তিকর, ছোট ছেলেটাকে মিথ্যে কথায় তালিম দিয়ে পাঠানো। কিন্তু যে রাগিণী মোক্ষদা, নেড়ুকে ফেরত দিলে নির্ঘাত নিজেই এখুনি রণরঙ্গিনী মূর্তিতে বার-উঠানেই হানা দেবেন এবং পাঁচজনের কান বাচাবার চেষ্টামাত্র না করে বকাবকি শুরু করবেন, পয়সার দেমাকে ধরাকে সরা দেখিস নে রামকালী, গুরুজন বলে একটু সমেহা করিস।–হ্যাঁ, এরকম কথা স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন মোক্ষদা, দ্বিধামাত্র করেন না।

সংসারের এই একটা মানুষকে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারলেন না রামকালী। পারতেন, অনায়াসেই পারতেন, যদি সত্যিই রামকালীর গুরুজনে সমীহবোধ না থাকত। গুরুজন হয়েই মোক্ষদা রামকালীকে জব্দে ফেলেছেন।

কিন্তু শুধুই কি গুরুজন বলে জব্দ?

আরও একজনের কাছেও কি মাঝে মাঝে জব্দ হয়ে পড়েন না রামকালী? যে মানুষটা নিতান্তই লঘুজন! হ্যাঁ, মনে মনে স্বীকার না করে পারেন না রামকালী, মাঝে মাঝে সত্যবতীর কাছে জব্দ হতে হয় তাঁকে, হার মানতে হয়। কিন্তু তাতে কি বিরক্তি আসে?

মেজখুড়ো! ছেলেটাও কম নয়। তাই রামকালীর কোঁচকানো ভুরু দেখেও ভয়ে পালিয়ে গেল, বলল, পিসঠাকুমা তোমায় চুপি চুপি ডেকে নিয়ে যেতে বলল, খুব বিপদ!

আঃ, এ তো আচ্ছা মুশকিলে ফেলল।

বিপদটা তো দেখছি আমারই! বলে রামকালী হাঁক দিলেন, তুষ্টু, দই সব ভেতর-দালানে তুলে দাও, আর খোঁজ করে দেখ আর কারও ঘরে আরও দু-দশ সের পাওয়া যাবে কিনা।

পাওয়া গেলে তো ঠাকুর মশাই, আমি নিজেই তুষ্টু মাথা চুলকে ধৃষ্টতা করে বসে, তা তোমার আজ্ঞে পাঁচ মণই কি কম? এ তো বড় খোকার পেরথম বিয়ে নয়

রামকালী ভুরুটা একবার কুঁচকেই মৃদু হাসলেন। বললেন, কথাটা গয়লার ছেলের মতই বলেছিস তুই, পেরথম বিয়ে নয় বলে কুটুম্বজনকে খাওয়াতে বসে অপরিতুষ্ট রাখব? আচ্ছা তুই ওগুলো তুলে দে গে, আসছি আমি।

.

নেড়ুর সঙ্গে সঙ্গে ভিতরবাড়িতে ঢুকলেন রামকালী, মাঝখানে প্রকাণ্ড উঠোনটা পার হয়ে। এই মাঝের উঠোনেই ধানের গোলা মরাই, সারা বছরের জ্বালানী কাঠের মাচা, চালার নিচে জালা জালা বীজধান।

নেড়ু দিগ্বিজয়ীর মত কাশীশ্বরীর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল, কারণ রামকালীকে ডেকে আনার ভার আর কেউ নিতে চায় নি। সত্য পর্যন্ত ঝাড়া জবাব দিয়েছিল, এই দেখলাম বড় পিসঠাকমা চান করে এল, এক্ষুনি আবার কী ব্যায়োয় ধরল যে বাবাকে শত কষ্মের মধ্যে থেকে ডেকে আনতে যাব? মানুষটার কি এখন মাথার ঠিক আছে? ঘরে তো জোয়ানের বড়ি আছে, তাই খেয়ে নাও না।

তুই বেরো দজ্জাল হারামজাদী বলে মোক্ষদা নেড়ুকে ধরেছিলেন।

কিন্তু নেড়ুদের তো আর গিন্নীদের ঘরে ওঠবার হুকুম নেই, তাই এই যে ঠাকুমা– বলে দাঁড়িয়ে পড়ল। নিচু দরজা, রামকালী খড়ম খুলে মাথা নিচু করে ঢুকলেন। আর সমস্ত ভুলে মোক্ষদা তুই পালা লক্ষ্মীছাড়া ছেলে বলে নেড়ুকে তাড়া দিয়ে বিদেয় করলেন।

রামকালী দেখলেন কাশীশ্বরী মাটিতে শুয়ে আছেন থানের আঁচলটুকু মুখে চাপা দিয়ে। এটা আবার কি! নিশ্চয় কোন মান-অভিমানের ব্যাপার। বিরক্তি এল, তবু শান্তভাবেই বললেন, কি ব্যাপার!

ব্যাপার বেশ উত্তম- চাপা গলায় এটুকু জ্ঞান দান করে মোক্ষদা আরও ফিস ফিস করে বললেন, দুয়োরটা ভেজিয়ে দিয়ে তবে শুনতে হবে।

রামকালী একবার বাইরে তাকালেন। শুচিবাই মোক্ষদাদের এই দিকটা বাদে সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য, এর মধ্যে কপাট ভেজিয়ে গুপ্তমন্ত্রণা! তিনি তো পাগল হন নি! গম্ভীর গলায় বললেন, কপাট থাক, কি বলবার আছে বলো।

.

কিন্তু বলবার কিছু আর আছে নাকি?

আছে বলবার মত মুখ?

অথচ এত বড় ভয়ানক কথা রামকালীকে না জানিয়ে করবেন কি মুখ দুটো মেয়েমানুষ? হিতাহিত জ্ঞান কি আর কিছু আছে তাদের? মোক্ষদার আর কাশীশ্বরীর! শঙ্করী যে কাশীশ্বরীরই নাত-বৌ!

ভয়ঙ্কর খবরটা এখনও পাঁচকান হয় নি, এখনও সংসারে সবাই আপন আপন কাজে হাবুডুবু খাচ্ছে, কিন্তু কতক্ষণ আর অন্যমনস্ক থাকবে লোক? কতক্ষণ আর তাদের কান বাঁচিয়ে রাখা যাবে? তার পর? এক কান থেকে পাঁচ কান, তার পরই তো লহমায় পাঁচশ কান। খড়ো চালার পাড়ায় আগুন লাগাও যা, আর একটা বিধবার কলঙ্ক-কেলেঙ্কারী প্রকাশ হয়ে যাওয়াও। এ চাল থেকে ও চাল তো এ মুখ থেকে ও মুখ। হাড়হাবাতে লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষটা নিডুবি হবার আর দিন পেল না!

যদি জলে ডুবে নিডুবি হয়ে থাকে তো সেও বরং ভাল কথা, কিন্তু যদি ভরাডুবি করে বসে থাকে?

কাশীশ্বরীর ধারণা তাই। তাই তিনি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পড়ে আছেন। আর মর্মে মর্মে অনুভব করছেন, কেন সেই সর্বনাশীর খুড়োখুড়ী ও মেয়েকে ঘরে রাখে নি, উপযাচক হয়ে কাশীশ্বরীর গলায় গছিয়ে গেছে। হায় হায়, কালই তো টের পেয়েছিলেন কাশীশ্বরী, নাপিত-বৌয়ের কথার আঁচে, তবে কেন আবাগীর বেটিকে দুয়ারে তালা লাগিয়ে আটকে রাখেন নি! পাঁচটা কুটুমের কাছে সাফাই গাইতে বললেই হত, হঠাৎ মাথাটার কেমন দোষ হয়ে গেছে শঙ্করীর, তাই কাজের বাড়িতে ছেড়ে রাখতে সাহস করেন নি!

মোক্ষদা কিন্তু জলে ডোবার কথাই তোলেন। কোন্ রাত্তিরে কখন উঠে এ কাজ করেছে কিছু টের পাই নি রামকালী, সকালবেলাও বলি চানে গেছে না কোথায় গেছে। বেলা হতে মাথায় বজ্রাঘাত। আমার স্থির বিশ্বাস, বড় পুকুরে গিয়ে ডুবেছে কপালখাকী। এইবেলা জাল ফেলালে

না! রামকালী জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, জাল ফেলা হবে না।

জাল ফেলা হবে না!

যন্ত্রচালিতের মত উচ্চারণ করেন মোক্ষদা।

না। এতগুলো লোকের খাওয়া পণ্ড হতে দেব না আমি।

মোক্ষদা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ভাবে বলেন, কিন্তু একটা জীবের জীবনের চাইতে যজ্ঞিটাই বড় হল তোমার বিচারে?

শুধু আমার বিচারে নয়, যে কোন বুদ্ধিমান লোকের বিচারেই। রামকালী ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বলেন, বলছ সকাল থেকে দেখতে পাও নি, ধরে নিতে হবে কাজটা হয়ে থাকে তো রাতেই হয়েছে। এখন জাল ফেললে জীবটা জীবন্ত উঠবে তোমাদের বিশ্বাস?

মোক্ষদা চুপ করে থাকেন উপযুক্ত উত্তরের অভাবে। আর কাশীশ্বরী চাপা গলায় হু-হুঁ করে দে ওঠেন।

থাম! লোকজন খাওয়ার আগে যেন টু শব্দটি না হয়। যদি ডুবে থাকে তো যতক্ষণ না ভেসে, ততক্ষণ তাকে জলের তলায় থাকতে দাও। ডুবলে ভেসে উঠতেই হবে, নদী নয় যে ভেসে চলে যাবে। কিন্তু– পায়চারি থামিয়ে রামকালী কাশীশ্বরীর খুব কাছে সরে আসেন, ঈষৎ নিচু হয়ে চাপা গম্ভীর সুরে বলেন, আর যদি ডুবে না থাকে, বৃথা জাল ফেলার পর সমাজে অবস্থাটা কি দেখাবে অনুমান করতে পারছ? ঘরের বৌ-ঝিকে আগলে আটকে রাখার ক্ষমতা যখন নেই, তখন নিজেদের জিভকেই আগলে আটকে রাখো!

কাশীশ্বরী সহসা কেঁদে ওঠেন, ও রামকালী, তুমি আমায় একটু বিষ দাও বাবা, আমি এই মুখ আর কাউকে দেখাতে পারব না।

ছেলেমানুষি করো না। মৃদুস্বরে ধমকে ওঠেন রামকালী, বিপদে মতি স্থির রাখ। আমাকে বিবেচনা করবার সময় দাও। কিন্তু এই ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি আমি, বলছ তোমাদের কাছে শুতেন অথচ দু-দুটো মানুষ কিছু টের পেলে না তোমরা?

মরণের ঘুম এসেছিল বাবা আমাদের– কাশীশ্বরী আর একবার কেঁদে ওঠেন।

পিসীমা, হাতজোড় করছি তোমায়, হৈ-চৈ করো না। সবাইকে না হয় বলো খুড়োর অসুখের খবর পেয়ে হঠাৎ বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে।

মানুষ তো আর ঘাসের বিচি খায় না রামকালী, মোক্ষদা নিজস্ব ভঙ্গীতে ফিরে আসেন, কাল রাতদুপুর সবাইয়ের সঙ্গে কুটনো কুটেছে লক্ষ্মীছাড়ী

আশ্চর্য! আবার পায়চারি করতে করতে বলে ওঠেন রামকালী, এ রকমটা হল কেন কিছু অনুমান করতে পারছ তোমরা?

কাশীশ্বরী মুখের ঢাকাটা আরও শক্ত করে চাপা দিয়ে বলে ওঠেন, আমি পারছি রামকালী। মতিগতি তার ভাল ছিল না। ধিঙ্গী বয়েস অবধি খুড়োর ঘরে থেকেছে, মা-বাপ ছিল না যে সুশিক্ষে দেবে, উচ্ছন্নে যাওয়ার বুদ্ধির বৃদ্ধি করেছে বসে বসে! আমি বুঝছি জলে ডুবে মরে নি ও, আমাদের মুখে চুনকালিই দিয়েছে।

ঘরটা নিচু-নিচু অন্ধকার মত। জানলা আছে কি নেই, তবু রামকালীর টটকে ফরসা মুখটা আরও কত টকটকে হয়ে উঠেছে, টের পেলেন মোক্ষদা। চেয়ে চেয়ে মনে হল যেন ওই টকটকে মুখটা থেকে উত্তাপ বেরোচ্ছে। বেপরোয়া মোক্ষদাও ভয় খেলেন। কি বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।

আর ঠিক এই সময় দরজার গোড়ায় কাসর বেজে উঠল।

মাজাঘষা চাচাছোলা কাসর। ওগো অ ঠাকমারা, কাটোয়ার বৌ গেল কোথায়? পান সাজবার জন্যে যে হাঁক-পাড়াপাড়ি হচ্ছে তাকে। তোমরাই বা দুই বুনে এই বেলা দুপুর অবধি শোবার ঘরে গুলতুমি করছ কেন? চান করে আবার শোবার ঘরে এসে সেঁধিয়েছ যে বড়? আর একবার চানের বাসনা আছে বুঝি? তা তোমাদের বাসনা মেটাও, বৌকে পাঠিয়ে দাও।

ঘরে ঢোকবার অধিকার নেই তাই বাইরে দাঁড়িয়েই বাক্যস্রোত বইয়ে দেয় সত্য। ধারণাও করতে পারে না ঘরের ভিতরে তার বাপের উপস্থিতি সম্ভব।

উঁচু ‘পোতা’র ঘর, দরজার বাইরে থেকে ছোটদের পক্ষে ভিতরটা স্পষ্ট দেখাও সম্ভব নয়।

মোক্ষদা বিনা বাক্যব্যয়ে কপাটের সামনে এসে দাঁড়ান, অতএব ঘরেই আছেন তিনি। সত্য বিরক্ত কণ্ঠে বলে, কি গো, মুখে বাক্যি-ওক্যি নেই কেন? কাঠোয়ার বৌ গেল কোথায় সেটা বলবে তো? ঘাট থেকে আরম্ভ করে সাত চৌহদ্দি ছিষ্টি খুঁজে এলাম

সহসা মোক্ষদা সরে দাঁড়ালেন, এবং সেই শূন্য স্থানে রামকালীর মূর্তিটা দেখা গেল।

বাবা!

সত্য বজ্রাহত!

এখানে বাবা! আর সত্য মুখের তোড় খুলে দিয়েছে! ছি ছি! কিন্তু বাবা এখানে কেন? তা হলে নির্ঘাত কাটোয়ার বৌয়ের হঠাৎ কোনও অসুখ করেছে, পিসঠাকুমারা তাই নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। ছি, ছি, এদিকে এই কাণ্ড, আর সত্য কিনা পান সাজার তাগাদা দিতে এসেছে! বাবা কি বলবেন! বাড়ির কোনও খবর রাখে না সত্য এইটাই প্রমাণ হবে!

মনে মনে জিভ কেটে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বেচারা। আজ আর মানসিক চাঞ্চল্য নিবারণ করতে অভ্যাসগত শাড়ির আঁচলটা নিয়ে চিবোবার উপায় নেই, পরণে উৎসব উপলক্ষে নিজের বিবাহকাল লব্ধ একখানা ভারী বালুচরী চেলি।

রামকালী ঘাড় ফিরিয়ে মোক্ষদা ভগ্নীদ্বয়কে উদ্দেশ করে মৃদুস্বরে বললেন, স্বাভাবিক ভাবে যার যা কাজ করো গে যাও, বৃথা ঘরের মধ্যে বসে থাকবার দরকার নেই। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এসে মেয়েকে একটা সহজ পরিহাসের কথা বলে উঠলেন, ইস! মেলাই সেজেছিস যে!

কথাটা মিথ্যা নয়, শুধু বালুচরী কেন, মেয়েকে আজ একগা গয়না পরিয়ে সাজিয়েছে ভুবনেশ্বরী। কমগুলি গয়না তো হয় নি সত্যর বিয়ের সময়, পরে কবে? বাপের কথায় লজ্জিত হাসি হেসে মাথা নিচু করল। এবার রামকালী পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, ভাগ্নে-বৌমাকে কে ডাকছে?

ভাগ্নে-বৌমা অর্থে আপাতত শঙ্করীকেই বোঝাল। সত্য বাবার কথায় নয়, বাবার কণ্ঠস্বরে থতমত খেল, অসহায়-অসহায় চোখে বলল, ওই তো ওরা, যারা এক বরজ পান নিয়ে সাজতে বসেছে।

তাদের বলে দাও গে উনি আজ আর পান সাজতে পারবেন না। হঠাৎ যেন রামকালীও অসহায়তা বোধ করলেন, তাই তাড়াতাড়ি বললেন, আচ্ছা থাক, তোমার এখন আর ওদিকে যাবার দরকার নেই, যারা পান সাজছেন সাজুন।

কথায় কথায় পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছেন রামকালী, ঘরের পিছনে ঢেঁকি ঘরের দিকে ইচ্ছে করেই। সত্য সে খেয়াল করে না, ম্লানমুখে প্রশ্ন করে, কাটোয়ার বৌয়ের অসুখ কি বেশী বাবা?

অসুখ? কে বলবে? রামকালী চমকে উঠে সামলে নিয়ে গম্ভীর ভাবে বলেন, শোন, ওঁকে বৃথা ডাকাডাকি করো না। অসুখ করে নি, ওঁকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

.

আশ্চর্য! এ কথা কেন বললেন রামকালী!

একট আগেও কি সিদ্ধান্ত করেছিলেন তিনি এ সংবাদটা আর কারও কাছে প্রকাশ করবেন না? হয়তো আর কেউ হলেই করতেন না, হয়তো ভুবনেশ্বরী এসে প্রশ্ন করলেও তাকে এই ডাকাডাকি করো না বলেই থেমে যেতেন, কিন্তু সত্যর ওই উজ্জ্বল বিশ্বস্ত মস্ত বড় বড় চোখ দুটোর সামনে যেন সত্য গোপন করা কঠিন হল। আর রামকালীর চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে এমনও মনে হল, এই ন বছরের মেয়েটার কাছে বুঝি তিনি চিন্তার ভাগ নেবার আশ্রয় খুঁজছেন।

কিন্তু সত্যর তো ততক্ষণে হয়ে গেছে!

খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?

আস্ত একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!

তাতে আবার মেয়েমানুষ! বেটাছেলে নয় যে পায়ে হেঁটে কোথাও চলে গেছে! মেয়েমানুষকে খুঁজে না পাওয়ার অর্থই নির্ঘাত বড়পুকুরের কাকচক্ষু জল। অবশ্য এ জ্ঞানটা সত্যর সম্প্রতিই হয়েছে সারদাকে উপলক্ষ্য করে। তাই চমকে উঠে বলে, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? হায় আমার কপাল, ওই ভয়ে বড়বৌকে সমস্ত রাত ঘরে ছেকল তুলে রেখে দিলাম, আর কাটোয়ার বৌ এই করল! হে ঠাকুর, আমি কেন দুটোকেই ছেকল দিলাম না?

বড় বৌমাকে ছেকল দিয়ে রেখেছিলে? চমৎকৃত রামকালী প্রশ্ন করেন।

না দিলে– সত্য উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলে, নিশ্চিন্দি হয়ে ঘুম আসে? জলচৌকির ওপর জলচৌকি বসিয়ে কত কাণ্ড করে ছেকলে হাত দিয়েছি! ভোরের বেলা মাকে বলেকয়ে খুলিয়ে দিই। হায় হায়, কাটোয়ার বৌকেও যদি বলেই সত্য সহসা সুর ফেরায়, করুণ রসের পরিবর্তে বীর রসের আমদানি করে, যাক, সে বেচারা মরেছে না জুড়িয়েছে। মানুষটা একদিন ঘাট থেকে আসতে একটু দেরি করেছে, লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যে দিতে পারে নি, তার তরে কী গঞ্জনা কী বাক্যিযন্ত্রণা! একটা মনিষ্যি, তাকে দশটা মানুষে তাড়না! বড় পিঠাটি কি সোজা নাকি? গাল দিয়ে দিয়ে আর আশ মেটে না। অত বাক্যযন্ত্রণায় পাষাণ পিরতিমে হলেও জলে গে ঝাঁপ দেয়।

রামকালী যেন ক্রমশ রহস্যের সূত্র পাচ্ছেন। বললেন, বকাবকিটা কখন হল?

এই তো কালই। অবশ্যি বৌয়েরও দোষ আছে, জল নিতে গেছ জল নিয়ে চলে এস, সন্ধ্যেভোর ঘাটে বসে থাকার দরকার কি? তবে হ্যাঁ, এনাদেরও লঘুপাপে গুরুদণ্ড! অবীরে বিধবা, মনেপ্রাণে কি সুখ আছে ওর? দু দণ্ড নয় ছিলই ঘাটে, তার জন্যে অত গালমন্দ! এই গ্রীষ্মকালে কুল কোথায় তার ঠিক নেই, সকল গাছই তো নেড়া, তবু বলে কি ঘাটে যাবার ছুতোয় কুল খাচ্ছিলি, আরও সব কত কথা– বলেই হতাশ নিঃশ্বাস ফেলা সত্য, আমি তার মানেই জানি না বাবা।

রহস্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাল সন্ধ্যায় ঘাটে যে নারীমূর্তিটি দেখেছিলেন রামকালী, সে মূর্তি তা হলে সারদার নয়, কাশীশ্বরীর নাত-বৌয়ের! আত্মহত্যার চেষ্টাই ছিল তার তখন!

একবারের চেষ্টায় পারে নি, তাই দ্বিতীয়বার আবার! কিন্তু খটকা লাগছে একটা জায়গায়, বকাবকিটা তো তার পরবর্তী ঘটনা। তা ছাড়া সত্যবতী বর্ণিত কুল খাওয়া শব্দটা! যা শুনে এত চিন্তার মধ্যেও হাসি এসে গিয়েছিল তার।

কাশীশ্বরীও ওই সন্দেহ ব্যক্ত করেছেন।

রামকালী চাটুয্যের বাড়িতে এমন একটা ঘটনাও ঘটা সম্ভব!

ভয়ানক একটা যন্ত্রণা অনুভব করলেন রামকালী। না, শঙ্করীর অপঘাত মৃত্যু ভেবে নয়, চাটুয্যে বাড়ির সম্ভ্রম নষ্ট বলেও নয়, যন্ত্রণা বোধ করলেন নিজের ত্রুটির কথা ভেবে। আরও হুশিয়ার থাকা উচিত ছিল তার, আরও যথেষ্ট পরিমাণে সাবধান। একটা নিতান্ত তুচ্ছ মেয়েমানুষ যেন রামকালীর ক্ষমতার তুচ্ছতাকে ব্যঙ্গ করে গেল।

মেয়েটার এ ধৃষ্টতাকে ক্ষমা করা যাচ্ছে না।

হঠাৎ অনুভব করলেন সত্য পিছিয়ে পড়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে থমকে গেলেন। সহসা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে কান্না শুরু করেছে সত্যবতী।

রামকালী পিছিয়ে এলেন। গম্ভীরভাবে বললেন, তোমার কাঁদবার দরকার নেই।

বাবা! এবার আর নিঃশব্দে নয়, ডুকরে ওঠে সত্য, সব দোষ আমার। কাটোয়ারা বৌ তো রাতদিন বলত, মরণ হলে বাঁচি, আমি যদি তখন তোমাকে বলি তো একটা প্রিতিকার হয়। মনে করতাম অলীক কথা, রাজ্যি সুদ্দু মেয়েমানুষই তো রাতদিন মরণ-মরণ করে–তেমনি। কাটোয়ার বৌ সত্যি ঘটিয়ে ছাড়ল! মা নেই বাপ নেই ভাই নেই, স্বামীপুতুর কেউ নেই মানুষটার, শুধু গালমন্দ খেয়ে খেয়ে বেঘোরে মরে গেল! তুমি আগে টের পেলে

কান্নাটা বড় বেশী উথলে উঠল সত্যর।

.

রামকালী কি হঠাৎ তড়িতাহত হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন? নইলে মুখের চেহারা তাঁর হঠাৎ অত অদ্ভুতভাবে বদলে গেল কি করে? যে ভ্রূকুটি নিয়ে একটা তুচ্ছ মেয়েমানুষের ধৃষ্টতার দিকে তাকিয়েছিলেন, সে কুভ্রূটি মিলিয়ে গেল কেন? হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে কি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল তার এতক্ষণকার চিন্তাধারা?

কান্না থামাও! বলে আস্তে আস্তে চলে গেলেন তিনি বারবাড়ির দিকে। গিয়ে দাঁড়ালেন ভিয়েন-ঘরে যেখানে কুঞ্জ তখন জলচৌকিটা ঘুরিয়ে নিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে বসে একসরা গরম ছানাবড়া চাখছেন।

বললেন, বড়দা, আমাকে একবার বেরোতে হবে, তুমি দেখো অতিথিদের যেন কোন অমর্যাদা না হয়।

আ-আমি! মিষ্টি গলায় বেধে গেল কুঞ্জর।

হ্যাঁ, তুমি। নয় কেন? তুমি বড়!

হ্যাঁ, বেরোবেন রামকালী। জেলেদের ঘরে গিয়ে বলতে হবে, পুকুরে আর একবার জাল ফেলানো দরকার। বাড়িতে কাজ, সন্দেহ করার কিছু নেই। ভাববে মাছের কমতি পড়েছে।

তবে রামকালী যেন বুঝছেন, ওটা নিরর্থক। কাশীশ্বরীর নাতবৌ নিজে ডুবে মরে নি, সংসারটাকে ডুবিয়েছে।

রামকালী কি তবে এবার নির্দেশের আশ্রয় খুঁজবেন? নিজের ওপর কি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন? নইলে যে প্রাণীটাকে শুধু প্রাণীমাত্র ভেবে তার ওপর বিরক্ত হচ্ছিলেন তার ধৃষ্টতার বহর দেখে তাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছেন কেন? কেন ভাবছেন তারও কোনো প্রাপ্য পাওনা ছিল সংসারে? তাই রামকালী উপদেষ্টার দরকার অনুভব করছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *