প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৩. ব্রাত্য মানে কী

১৩. ব্রাত্য মানে কী

বলাই বাহুল্য, পুরোনো পুঁথিপত্রে গণ-সংক্রান্ত যে-অজস্র তথ্য পাওয়া যায় তার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ আমাদের পক্ষে বর্তমানে সম্ভব হবে না—বিশেষ করে এই কারণে নয় যে তাহলে আমাদের মূল যুক্তি থেকে বহুদূরে বিক্ষিপ্ত হবার ভয় থাকে। তাই এখানে আমরা আমাদের মূল যুক্তির দিকে নজর রেখেই গণ সম্বন্ধে আরো কিছু নির্বাচিত তথ্যর আলোচনা করবো। আমাদের মূল যুক্তি হলো, গণ বলতে প্রাক-বিভক্ত যৌথ-সমাজকে বোঝানো হয়েছে। পৃথিবীর অন্যন্য সমস্ত মানবদলের মতোই বৈদিক মানুষেরাও এককালে এই প্রাক-বিভক্ত যৌথ-সমাজেই জীবন যাপন করতেন। তাই তাঁদের সাহিত্যের প্রাচীনতর পর্যায়গুলিতে গণ বা গণপতি সম্বন্ধে ঘৃণার ভাব নেই। কিন্তু উত্তরকালে রাষ্ট্রশক্তির মুখপাত্ররা বৈদিক ঐতিহ্যের গরিমা দাবি করলেও গণসমাজকে—এবং অতএব গণপতিকেও—ঘৃণার চোখেই দেখতে শিখেছিলেন : মানব-গৃহ্যসূত্র বা যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে গণপতি বা বিনায়কের বিরুদ্ধে যে-বিষোদগার তার সঙ্গে মহাভারতের সংবাদদাতাদের মুখে বাহীক-প্রমুখদের সম্বন্ধে ওই তীব্র ঘৃণার সম্পর্ক রয়েছে। ভারতবর্ষের জমিতে যে এইরকম ঘটনা ঘটেছে তার কারণ, ভারতবর্ষ এতোটুকু দেশ নয় এবং এখানে পুরো দেশ জুড়ে একই তালে সব মানুষের সমাজজীবন সমান পরিবর্তন দেখা দেয়নি। তাই এদেশে রাষ্ট্রশক্তির পাশাপাশিই টিকে থেকেছে আদিম সাম্যসমাজ।

গণেশকে অনুসরণ করে গণসমাজ-সংক্রান্ত আমরা যে-ইতিহাসটার ইঙ্গিত পাই তারই অনুরূপ ইতিহাস পাওয়া যায় ব্রাত্য শব্দটির তাৎপর্য বিচার করলে। উত্তরযুগে যাঁরা বৈদিক ঐতিহ্যের বাহক বলে নিজেদের পরিচয় দেবার চেষ্টা করলেন, তাঁদের মধ্যে শুধুই যে গণ বা গণপতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষের ভাব ফুটে উঠলো তাই নয়, ব্রাত্য সম্বন্ধেও। তেমনি বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতর পর্যায়ে শুধুই গণ বা গণপতির গৌরবোজ্জল চিত্র নয়, ব্রাত্যেরও। এবং ব্রাত্যের এই ইতিহাসটিকে বিশ্লেষণ করার বিশেষ প্রয়োজন আছে; কেননা, আধুনিক পণ্ডিতমহলে ব্রাত্য শব্দটি নিয়ে নানা রকম ভুল ধারণার প্রচলন দেখা যায়।

বাহীকদের বর্ণনায় মহাভারতের যে-অংশের তর্জমা উদ্ধৃতি করেছি তাতে রয়েছে, ‘দেবগণ সেই ব্রতবিহীন দুরাচারদিগের অন্ন ভোজন করেন না’। প্রশ্ন হলো, ব্রতবিহীন শব্দটি এলো কোথা থেকে? মূলে আছে, ব্রাত্যনাম্‌ দাসমীয়ানাম্‌ অন্নম্‌ দেবাঃ ন ভুঞ্জতে (১৪৬)। স্পষ্টই, ওই ব্রাত্যানাম্‌ শব্দটিকে ব্রতবিহীন বলে তর্জমা করা হয়েছে। এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, আধুনিক কালে ব্রাত্য শব্দটির ওই রকমই একটা অর্থ করবার চেষ্টা করা হয়। এবং এ-চেষ্টা অকারণ বা অমূলক নয়। কেননা, মনু, বোধায়ন (১৪৭) প্রমুখেরা ব্রাত্য শব্দের অর্থ করেছেন সাবিত্রীপতিত। মনু (১৪৮) বলছেন, সাবিত্রীপতিতা ব্রাত্যা ভবন্ত্যার্য্যবিগর্হিতাঃ—ঠিক বয়সে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সন্তানদের উপনয়ন না হলে তারা আর্যবিগর্হিত হয়, তাদেরই ব্রাত্য বলে। অতএব, মনুর মত অনুসরণ করে বলা হয়েছে (১৪৯) “সাবিত্রীপতিত উপনয়নাদি সংস্কারবিহীন ব্যক্তিই ব্রাত্য নামে অভিহিত। ব্রাত্যের যজ্ঞাদি বেদবিহিত ক্রিয়ায় অধিকার নাই—ব্রাত্য ব্যবহারযোগ্যও নহে, ইহাই এক শ্রেণীর শাস্ত্রসম্মত সিদ্ধান্ত।” এই রকমই অর্থের উপর নির্ভর করে আধুনিক পণ্ডিতেরা (১৫০) ব্রাত্য বলতে “ব্রত থেকে পতিত” অর্থ করছেন। “কিন্তু”, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৫১) দেখাচ্ছেন, “ব্রত হইতে পতিত এইরূপ অর্থে ব্রত শব্দের উত্তর কোন রূপ তদ্বিত প্রত্যয় করিয়া ব্রাত্য শব্দ নিষ্পন্ন হইতে পারে তাহার সূত্র পণিনির ব্যাকরণে নাই।” শাস্ত্রী মহাশয় শুধু এইটুকু কথাই বললেন, কিন্তু পাণিনির ব্যাকরণে এই ব্রাত্য শব্দের নিষ্পত্তি ঠিক কী ভাবে করা হয়েছে তার উল্লেখ তিনি করলেন না। সেইদিক থেকে দেখা যায়, ব্রাত্য শব্দের নিষ্পত্তি ব্রত শব্দ থেকে নয়। কেননা, পাণিনি বলছেন (১৫২), ব্রাত শব্দের উত্তর স্বার্থে এবং ঞং প্রত্যয় করে ব্রাত্য শব্দ নিষ্পন্ন হয়। তাই, ব্রাত এবং ব্রাত্য।

যদি ব্রাত শব্দের উত্তর স্বার্থে ঞং প্রত্যয় করে ব্রাত্য শব্দ নিষ্পন্ন হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ব্রাত্য বলতে ব্যতহীন অর্থ করবার অবকাশ থাকে না। আমরা আগেই দেখেছি, মহামহোপাধ্যায় পি. ভি. কানে কাত্যায়নের শ্রৌতসূত্রের নজির দেখিয়ে বলছেন, গণ পূগ ব্রাত শ্রেণী প্রভৃতি শব্দগুলির একই অর্থ। অর্থটা হলো, সমূহ। পাণিনির ভাষ্যকারদের মধ্যেও ব্রাত শব্দের তাৎপর্য-নির্ণয় প্রসঙ্গে দলবাচকত্বের উপরই ঝোঁকটা সবচেয়ে বেশি। এবং এই ব্যাকরণশাস্ত্রের ঢের আগে, ঋগ্বেদে (১৫৩), গণ ও ব্রাত শব্দ সমানার্থে,—বা অন্তত প্রায়-সমানার্থে,—ব্যবহৃত হয়েছে:

ষো বঃ সেনানী মহতঃ গণস্য
রাজা ব্রাতস্য প্রথমঃ বভূব।
তস্মৈ কৃণোমি ন ধনা রুণধ্নি
দশাহং প্রাচীন্তঋতং বদামি।।

অর্থাৎ (খুব সম্ভব অক্ষর ঘুঁটিগুলিকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে!) মহৎ গণের মধ্যে যিনি সেনানী (নায়ক), ব্রাতর মধ্যে যিনি প্রথম রাজা, আমি তাঁকে প্রণাম করি। দশ-আঙুল তুলে আমি দেখাচ্ছি, আমি ধন গোপন করছি না; আমি সত্য (ঋত) কথা বলছি।

বলাই বাহুল্য, এই ঋকটির অর্থ অনেকাংশে দুর্বোধ্য; পরবর্তী পরিচ্ছেদে এর আলোচনায় ফেরবার চেষ্টা করবো। বর্তমানে আমাদের যুক্তির পক্ষে শুধু এইটুকুই প্রাসঙ্গিক যে, এখানে গণ ও ব্রাত শব্দ প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই ভাষ্যে সায়ণ বলছেন, গণব্রাতয়োরল্পো ভেদঃ—গণ এবং ব্রাত-র মধ্যে বড়ো একটা তফাত নেই।

ব্রাত এবং ব্রাত্যঃ। গণব্রাতয়োরল্পো ভেদঃ। অথচ মনু প্রমুখের রচনায় এই ব্রাত্যই পতিতসূচক হয়ে দাঁড়ালো। তার কারণ কি এই নয় যে, উত্তরযুগে মনু প্রমুখের মতো শ্রেণীশাসনের প্রচারকেরা গণসমাজকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করলেন? অথচ, যে-বৈদিক ঐতিহ্যের গরিমায় তাঁরা নিজেরা অতোখানি আত্মপ্রসাদ পেতেন সেই বৈদিক সাহিত্যেই ব্রাত্য সম্বন্ধে মনোভাবটা একেবারে বিপরীত। আর যদি তা হয় তাহলে কি অনুমান করবার অবকাশ থাকে না যে, বৈদিক সাহিত্য সমাজ-বিকাশের যে-স্তরের স্মৃতি বহন করছে সে-স্তরে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেয়নি?

অথর্ববেদের পঞ্চদশ কাণ্ডটি কেবল ব্রাত্য মহিমাতে পরিপূর্ণ। ব্রাত্য বৈদিক-কার্য্যে অধিকারী, ব্রাত্য মহানুভব, ব্রাত্য দেবপ্রিয়, ব্রাত্য ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় প্রভৃতির পূজ্য, অধিক কথা কি, ব্রাত্য স্বয়ং দেবাধিদেব। ব্রাত্য যেখানে গমন করেন, বিশ্বজগৎ ও বিশ্বদেবগণও সেইখানে তাঁহার অনুগমন করেন। তিনি যেখানে অবস্থান করেন, বিশ্বদেবগণ সেই স্থানে অবস্থান করেন, তিনি তথা হইতে গমন করিলে তাঁহারাও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গমন করেন। সুতরাং তিনি যখন সেখানে গমন করেন, তখন যে রাজার ন্যায় গমন করিয়া থাকেন।

সমগ্র পঞ্চদশ কাণ্ডেই এইরূপ কেবল ব্রাত্যমহিমা দেখিতে পাওয়া যায়। অথর্ববেদের পঞ্চদশ কাণ্ডোক্ত ব্রাত্য বাচ্যবিষয়ে ধর্মসংহিতোক্ত ব্রাত্য হইতে সম্যক স্বতন্ত্র। এই ব্রাত্যসকল বৈদিক পুরুষসূক্তের পুরুষ এবং পৌরাণিকগণের বিরাট পুরুষ বলিয়াই ধর্তব্য। (১৫৪)

অগত্যা, ভাষ্যরচনার সময় সায়ণাচার্যকে বলতে হচ্ছে যে, অথর্ববেদের এই বর্ণনা সমস্ত ব্রাত্যের উপরই নির্বিচারে প্রযোজ্য নয়—তার বদলে এই বর্ণনা ব্রাত্যদের মধ্যে শুধুমাত্র সাধু ও শক্তিশালীদের উপরই প্রযোজ্য (১৫৫)। সায়ণের এই ব্যাখ্যা যে কৃত্রিম তা আধুনিক পণ্ডিতের চোখে এড়িয়ে যায়নি (১৫৬)। কিন্তু এ-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, উত্তরযুগে ব্রাত্য শব্দের যে-পরিণতি দাঁড়িয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রাচীন যুগের রচনার ভাষ্য করতে হলে এই জাতীয় কৃত্রিম উক্তি না করে উপায় নেই। আধুনিক পণ্ডিত (১৫৭) বলছেন :

কী প্রকারে ব্রাত্য শব্দের এইরূপ অর্থাবনতি সংগঠিত হইল, পরব্রহ্মের বাচক শব্দটি কী প্রকারে মানবসমাজের অসম্মানিত জনের অর্থবোধক রূপে ব্যবহৃত হইল, তাহারও অনুসন্ধান প্রয়োজন।

আমাদের মন্তব্য হলো, যতোদিন না সমাজ-বিজ্ঞানের দিক থেকে এই অনুসন্ধান করা হবে ততোদিন পর্যন্ত সমস্যাটির প্রকৃত সমাধান সুদূরপরাহত হয়ে থাকবে।

——————-
১৪৬. কর্ণপর্ব ৪৪.৪৫।
১৪৭. P. V. Kane HD 2:376.
১৪৮. মনু ২.৩৯।
১৪৯. বিশ্বকোষ ২০:১০১।
১৫০. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : ব্রাত্য। ‘প্রাচী’-অগ্রাহয়ণ ১৩৩০।
১৫১. ঐ।
১৫২. পাণিনি ৫.৩.১১৩।
১৫৩. ঋগ্বেদ ১০.৩৪.১২।
১৫৪. বিশ্বকোষ ১০:১০১।
১৫৫. P. V. Kane HD 2:386.
১৫৬. Ibid.
১৫৭. বিশ্বকোষ ১০:১০৩।