১৩. বিশ্ববিদ্যালয় : রাজনীতির হেরফের : দাঙ্গা : দেশবিভাগ

বিশ্ববিদ্যালয় : রাজনীতির হেরফের : দাঙ্গা : দেশবিভাগ

বি.এ পাস করে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম তখনও আমরা নামে প্রেসিডেন্সি কলেজেরই ছাত্র। কিন্তু মাসিক মাইনেটা কলেজের অফিসে জমা দেওয়া ছাড়া তখন কলেজের সঙ্গে আমাদের আর কিছু বিশেষ সম্পর্ক রইল না। এই বিচ্ছেদ আমার পক্ষে সত্যিতে বেশ বেদনাদায়ক হয়েছিল এবং তার একটা যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল। এক সময় স্নাতকোত্তর বিভাগের পড়ানোও কলেজেই হত, কিন্তু সে ব্যবস্থা অনেকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। কতকটা অক্সব্রিজের পুরনো আদর্শে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভাল করে পড়ানোর উপর বিশেষ জোর দেওয়া হত। তবে অক্সব্রিজের সঙ্গে ওখানকার পড়ানোর এক ব্যাপারে মৌলিক তফাত ছিল। অত্মব্রিজে পাঠন ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে টিউটোরিয়াল প্রথা, যার মূল কথা শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ছাত্রদের নিজেদের পড়াশুনো, চিন্তা করা এবং লিখতে শেখা। প্রেসিডেন্সি এবং কলকাতার অন্যান্য ভাল কলেজে কোথাও কোথাও টিউটোরিয়াল প্রথা নামে চালু থাকলেও, আসলে জোর দেওয়া হত অধ্যাপকের বক্তৃতার উপর। এ নিয়মের যে যথেষ্ট ব্যতিক্রম ছিল সে কথা আগেই লিখেছি। তবে প্রায় প্রতিটি বিষয়েই পাণ্ডিত্য এবং প্রকাশভঙ্গি দুদিক থেকেই অসাধারণ কিছু শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের কাছে পড়তে পারা যে সৌভাগ্যের কথা এ বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সচেতন ছিলাম। ভাল শিক্ষক আর ভাল ছাত্রর সমম্বয়ের ফলে প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা প্রায় সব বিষয়েই ফার্স্ট সেকেন্ড হত। সুতরাং আমাদের মাটিতে পা পড়ত না, ধরাকে সরাজ্ঞান করতাম। প্রেসিডেন্সি কলেজের পর স্নাতকোত্তর বিভাগের অভিজ্ঞতা অন্তত আমার কাছে কিছুটা জোলো মনে হয়েছিল। ওখানে এসে মনে হল—ক্লাসে পড়ানোটাকে তাঁদের প্রধান কর্তব্য মনে করেন এরকম শিক্ষক কমই আছেন। সুশোভনবাবু তখনও স্নাতকোত্তর বিভাগে পড়ান, কিন্তু তা নামে মাত্র। অধ্যাপক ত্রিপুরারি চক্রবর্তীর শিক্ষক হিসাবে খ্যাতি ছিল, কিন্তু ওঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ওঁর পড়ানোর মান কিছুটা নষ্ট করত। ক্লাসে যে বক্তৃতা সম্পূর্ণ অসাধারণ মনে হত, পরে তার অনেক কথাই কোনও না কোনও বিখ্যাত বই খুলে পাতার পর পাতা ঠিক সেই কথাগুলিই হুবহু দেখতে পেয়ে কিছুটা নিরুৎসাহ হয়ে যেতাম। মানুষটির স্মৃতিশক্তি সত্যিই অসাধারণ ছিল। রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে ওঁর রামায়ণ এবং মহাভারত ব্যাখ্যা এক সময় কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। উনি প্রথমে কয়েকটি শ্লোক আবৃত্তি করতেন, তারপর তার ব্যাখ্যা করতেন। সামনে কোনও বই থাকত না। আমার দৃঢ় ধারণা—ওই দুই মহাকাব্য ওঁর কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল। ক্লাসে পড়ানোর ব্যাপারেও ওঁর উৎসাহ এবং উত্তেজনায় আমরা কিছুটা অংশীদার হতাম সন্দেহ নেই। তবুও সব মিলিয়ে স্নাতকোত্তর ক্লাসের পঠন-পাঠন আমাদের মন আকর্ষণ করতে পারেনি। আমরা প্রায় যৌথ উদ্যোগ নিয়ে ক্লাস ফাঁকি দিতে শুরু করি। এমনকী নিতান্ত ভাল মানুষ, আমাদের ফার্স্ট বয় অশোকও ক্লাস পালানোর উৎসবে যোগ দিল। মাস্টারমশাইরা সবই জানতেন, কিন্তু কিছু গা করতেন না। শুধু একদিন ত্রিপুরারিবাবু বললেন, “তপন, মাঝে মাঝে ক্লাসে এলেও পারো।” খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। কারণ সত্যিতে উনি ভাল পড়াতেন। ওঁর ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার সপক্ষে কোনও যুক্তি ছিল না। আসলে ব্যাপারটা একটা ছেলেমানুষি বাহাদুরিতে দাঁড়িয়েছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের ভিত্তি ছিল ক্লাসে পড়ানোয় নয়, অধ্যাপকদের পাণ্ডিত্য এবং গবেষণার খ্যাতিতে। সে সময়ে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, হেম রায়চৌধুরী, সুরেন দাশগুপ্ত, সুকুমার সেন, দীনেশ সরকার, নীহাররঞ্জন রায়, ডক্টর হবিবুল্লাহ এঁরা সবাই শুধু জীবিত নন, এঁদের প্রতিভা তখন মধ্য গগনে। আমরা যাঁরা পরবর্তী জীবনে শিক্ষা বা গবেষণা পেশা হিসাবে গ্রহণ করি এইসব মহারথীদের জীবন ও কর্ম তাঁদের প্রেরণা জোগায়। গভীর গবেষণায় রত অধ্যাপকরা অনেক সময়ই যে ভাল শিক্ষক ছিলেন তা না। নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ ভাল পড়াতেন না। কিন্তু সরকারি দলিলপত্রর ভিত্তিতে ওঁর গভীর গবেষণা পরবর্তী প্রজন্মের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত পণ্ডিতকে প্রেরণা জুগিয়েছে। আমরা যখন ছাত্র, তখন দেখতাম ক্লাস শেষ হলেই উনি ট্রামে চেপে কলকাতা হাইকোর্টে চলে যেতেন—ওখানকার নথিপত্র দেখতে। এই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম হতে কখনও দেখিনি।

পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে আমাদের দেশে গবেষণার ক্ষেত্রে পাণ্ডিত্যই প্রধান লক্ষ্য ছিল, বিশ্লেষণ নয়। তখন গবেষণাভিত্তিক ডিগ্রি একটিই ছিল—পিএইচডি। আমাদের সময়ই প্রথম পিএইচডির তুলনায় নিচু মানের ডিফিল ডিগ্রি চালু হয়। কাজটা ঠিক হয়নি বলে আমার বিশ্বাস। নতুন ডিগ্রি চালু হওয়ার ফলে সহজে কেল্লা ফতে করার একটা প্রবণতা আসে। তখনকার দিনে পিএইচডি ডিগ্রি পেতে দশ-বারো বছর লেগে যেত। থিসিসগুলি আর যেদিক থেকেই কাঁচা হোক, পাণ্ডিত্যে কোনও ত্রুটি থাকত না। এখন অনেক উচ্চাঙ্গের কাজ হচ্ছে ঠিকই, আজকালকার গবেষকরা সে যুগের তুলনায় অনেক বেশি কইয়ে বলিয়েও, কারও কারও দুনিয়ার হাটে খুবই নামডাক। কিন্তু সে যুগে কাঁচা সংস্কৃতজ্ঞান নিয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চা করার সাহস কারও হত না। এখন মনে হয় নগদ পাওনার দিকে নয়া পণ্ডিতদের নজর একটু বেশি। সে সময় বেশির ভাগের কপালে নগদ কেন, কোনও পাওনারই সম্ভাবনা ছিল না। অনেকে সারা জীবন গবেষণা তথা শাস্ত্রচর্চায় কাটাতেন। কিন্তু তাঁদের ছিন্নতন্ত্রী বীণার সুর কারও কানেই পৌঁছাত না। এঁরা গবেষণা করতেন জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে নয়। দ্বিতীয় প্রয়োজন যতটুকু মিটত তা প্রায় উবৃত্তি করে। যখন অক্সফোর্ডে পড়ি তখন নরেনবাবুর কাছ থেকে একটি চিঠি পাই। “জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লেকচারার থেকে রিডার হয়েছি। মাইনে আটশো টাকা। যাক, এতদিনে নিশ্চিন্ত হলাম, আর উঞ্ছবৃত্তি করে পরিবার পোষণ করতে হবে না।”

স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়তে গিয়ে যেসব পণ্ডিতদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংস্পর্শে আসি, তাঁদের মধ্যে নানা কারণে বিশেষভাবে স্মরণীয় বহুভাষাবিদ পণ্ডিত সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক বিনয় সরকার। উনি কথায় এবং লেখায় অনেক সময় বিচিত্র ভাষা ব্যবহার করতেন। বাঙালির পাণ্ডিত্যে একটা গোমড়ামুখো দিক ছিল। মনে হয় ওঁর ভাষাশৈলীর ভিতর তাকে মুখ ভেঙানোর একটা প্রবণতা দেখা যেত। অধ্যাপক সরকারের শিষ্য হরিদাস মুখোপাধ্যায়ের সংকলিত ‘বিনয় সরকারের বৈঠকে’শীর্ষক বইয়ে ওই ভাষাশৈলীর বহু উদাহরণ আছে। উনি তরুণ সমাজকে আত্মপ্রকাশ এবং কিছুটা আত্মপ্রচার করতে বিশেষ উৎসাহ দিতেন। বলতেন, “নো বডি উইল পিটাবে ইওর ঢাক আনলেস ইউ পিটাও ইট ইওরসেলফ।” যতদূর মনে পড়ে ১৯৪৫ সনে ওঁরই উৎসাহে স্নাতকোত্তর বিভাগের তিন উজ্জ্বল রত্ন যুদ্ধ যখন থামবে নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করেন। ভূমিকায় অধ্যাপক সরকার লেখেন, “বিশ বাইশ বছরের যুবক বাংলার মগজের চৌবাচ্চায় কী রকম ঘিলু কিলবিল করে?” অর্থাৎ সেই কিলবিলায়মান ঘিলুর চমৎকারিত্ব এই চটি বইটি পড়লে বোঝা যাবে। তাছাড়া সমাজতত্ত্ব পড়াতে গিয়ে উনি কিছু সমীকরণের আশ্রয় নিতেন। যথা শেক্সপিয়ার + কালিদাস = রবীন্দ্রনাথ; কার্ল মার্কস + জোনাথন সুইফট = বার্নার্ড শ’ ইত্যাদি। ওঁর কিছু কিছু বক্তব্য উনি হাইকু মাকা কবিতায় প্রকাশ করতেন। যথা “ক’ বোতল মদ গিলে গো রঘুবংশম যায় লেখা?” “গ্রামগুলি নয় গুড় মাখানো, শহরটা নয় আস্তাকুড়।” বলতেন, “ওই শুধু ঘাসপাতা খেলে কি মানুষের মাথা খোলে? এক থাল ষাঁড়ের ডালনা খেয়ে তবে মুনিঋষিরা উপনিষদ লিখতে বসতেন।” নীরদ চৌধুরীর মতো ওরও সম্ভবত বিশ্বাস ছিল যে, শাকাহারী হয়ে ভারতীয় প্রতিভার অনিষ্ট হয়েছে। দেশপ্রেমিক এই মানুষটি দেশপ্রেমের ভড়ং বরদাস্ত করতে পারতেন না। সে সময় ছাত্রদের এক বিকট উল্লাস ছিল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে কালির বোতলগুলি দেওয়ালে ছুঁড়ে মারা। ফলে আশুতোষ বিল্ডিংয়ের দেওয়ালগুলি কখনও মসীমুক্ত থাকত না। ওই কালিমাখা দেওয়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে অধ্যাপক প্রশ্ন করতেন, “তোরা তো সব সোসিওলজি পড়িস। বল দেখি এই সব কেন হয়?” একটু থেমে নিজেই উত্তর জোগাতেন, “তাও জানিস না? ১৭৫৭! পলাশির যুদ্ধ! সকলই ইংরাজের দোয়! পরাধীনতার পরিণাম। এ কথা কখনও ভুলবি না। খুব সাবধানে থাকবি! আমরা যে অমানুষ, সে কথা যেন লোকে জানতে না পারে।” ওঁর বক্তৃতা শুনে দুটি ব্যাপারে চক্ষুরুন্মীলন হয়। প্রথম কথা, ইতিহাস এবং সমাজশাস্ত্রগুলির মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য গণ্ডি টানা অর্থহীন, কারণ এইসব বিষয়গুলি ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরসম্পৃক্ত। দ্বিতীয়, ওয়েবার এবং ডুৰ্বহাইমের চিন্তা ভারতবর্ষের ইতিহাস আলোচনায় কতটা প্রাসঙ্গিক তাও ওঁর আলোচনা থেকেই প্রথম বুঝতে পারি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ে বিদ্যাবুদ্ধি কতটা এগিয়েছিল বলতে পারব না। কিন্তু ওই সময়ই মনস্থির করি যে, এম. এ. পাস করে মুঘল যুগের সামাজিক/অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করব। এ ব্যাপারে উৎসাহ দেন অধ্যাপক মাখনলাল রায়চৌধুরী ওরফে মৌলানা মাখনলাল। তাই আবার তোড়জোড় করে ফারসি পড়া শুরু করলাম, যদিও ওই প্রচেষ্টা কখনওই একেবারে ত্যাগ করিনি। চোদ্দো বছর বয়স থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পঁয়ষট্টি বছর ধরে ওই ভাষা-সরস্বতীর প্রসাদ ভিক্ষা করছি। কিন্তু দেবীটি আমার প্রতি সদয় হননি। আগেই বলেছি, আমার বড় শখ ছিল অভিধানের সাহায্য ছাড়াই আরামকেদারায় বসে কখনও রুমি-হাফিজের রস গ্রহণ করতে পারব। কিন্তু আমার ফারসিজ্ঞান সেই পর্যায়ে কখনও পৌঁছায়নি। পেশার প্রয়োজনে এবং কিছুটা নিজের শখ মেটাতে দেশি-বিদেশি কয়েকটি ভাষা মোটামুটি রপ্ত করেছি—মানে পড়তে অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমার ফারসিজ্ঞান সেই পর্যায়ে কিছুতেই পৌঁছাল না। গবেষণার ক্ষেত্রে যে ক্রমে মুঘল যুগ ছেড়ে উনিশ শতকে চলে এলাম তার একটা কারণ এই ব্যর্থতা।

এবার ফারসি শেখার জন্য যাঁর ঘরে নাড়া বাঁধলাম তিনি বিচিত্র স্বভাবের মানুষ। নাম আবদুল আলিম রাজি। ‘রাজি’ পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নামের অংশ নয়, সাহিত্যিক হিসাবে ছদ্মনাম, নিজেরই দেওয়া। সে সাহিত্য বড় বিচিত্র। সে কথায় পরে আসছি। রাজি সাহেব ফরিদপুর অঞ্চলের এক পিরের ছেলে, মাদ্রাসায় পড়া আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে বিরাট পণ্ডিত। কিন্তু সে পাণ্ডিত্যে উনি তৃপ্ত নন। ওঁর উচ্চাশা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পাস করে লন্ডন গিয়ে ডক্টরেট নেবেন এবং ব্যারিস্টার হবেন। পিরের শিষ্যদের কাছে ওয়াজ করে টাকা তুলে এই উচ্চাশা উনি মিটিয়েছিলেন এবং শুনেছি পরে ঢাকায় প্র্যাকটিস করতেন। খবরটা শুনে ওঁর মক্কেলদের জন্য কিছুটা দুশ্চিন্তা হলেও, ওঁর কথা ভেবে খুশিই হয়েছিলাম। দুঃখের কথা শুধু এই যে, রাজি সাহেব ব্যারিস্টার বনায় বাঙালি সমাজ এক বিরাট প্রতিভাকে পণ্ডিত হিসাবে পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হল। আমার সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, উনি তখন স্নাতকোত্তর বিভাগে ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র। কিন্তু ওঁর মনপ্রাণ তখন অন্যত্র বাঁধা পড়েছে। সাহিত্যসরস্বতী তখন পেত্নির মতো ওর স্কন্ধারূঢ়া। সেই সাহিত্যসাধনার রোমহর্ষক ফল একটি গভীর বিয়োগান্তক উপন্যাসলাম ‘আরাকানের পথে’। বিষয় বার্মা থেকে পলায়মান উদ্বাস্তুদের দুর্দশা। মূল্য আট আনা। যতদূর জানি এই মহৎ সাহিত্য আমি ছাড়া আর কেউ পয়সা দিয়ে কেনেনি। গুরুদক্ষিণা হিসাবে আট আনা পয়সা আমি ব্যয় করেছিলাম—দু কাপ কফির দাম।

পয়সাটা অপব্যয় হয়নি। কারণ অন্য কোনও সাহিত্যকর্ম থেকে এরকম অনাবিল আনন্দ কখনও পাইনি। স্মৃতি থেকে এই মর্মন্তুদ দুঃখের কাহিনির শেষ পরিচ্ছেদের কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি। নায়িকা আয়েষা (?) পথশ্রমে পিপাসায় মুমূর্ষ। তাঁর স্বামী ইমরান (?) বিধ্বস্ত, পরাজিত, নিরুপায়। “রুদ্ধ কণ্ঠে আয়েষা কহিল, ‘পা-আ-আ-নি, পা-আ-আ-নি৷’ইমরান কী। করিবে? কোথায় পানি? পানি তো কোথাও নাই। নিরুপায় ইমরান মৃতপ্রায় পত্নীর মুখবিবরে তার জেহ্ব ঢুকাইয়া দিল। কিন্তু হায়, সে জেহ্বাও শুখা।” রাজি সাহেব প্রশ্ন করলেন, “বোঝলেন কেমন?” উত্তরে সত্যি কথাই বললাম, “এমন জিনিস বিশ্বসাহিত্যে আর দ্বিতীয় নেই।” রাজি সাহেব করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। মুখে বললেন, “থ্যাংক ইউ। আমারও তাই ধারণা। এহন থিকা আর অন্য কাজে সময় নষ্ট করব না। জিন্দিগিটা সাহিত্যের সেবায়ই ব্যয় করব।” পাঠকদের সৌভাগ্য—এই ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা শেষ অবধি বজায় থাকেনি। শুধু লাভের মধ্যে আমাকে ফারসি পড়ানো উনি বন্ধ করে দিলেন। সাহিত্যসেবায় নিবেদিতপ্রাণ বিরল প্রতিভার বাজে কাজে নষ্ট করার মতো সময় কোথায়? ফারসির মাধ্যমেই উনি ভাষাটা শেখাতেন, ফলে ভাষাজ্ঞানটা বেশ দ্রুতগতিতেই এগুচ্ছিল। গুরু মহত্তর সাধনায় জীবন উৎসর্গ করায় শিক্ষাটা মাঝপথে ঠেকে রইল।

ফারসি শেখার চেষ্টায় গুলবদন বেগমের ‘হুমায়ূননামা’ মূল থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলাম—ইংরাজি অনুবাদের সাহায্য ছাড়াই। বাবরকন্যা ওই মহিলাটি সহজ সরল ভাষায় বইটি লিখেছিলেন। আবুল ফজলের মতো এক একটি বাক্য জড়িয়ে পেঁচিয়ে সাত আট মাইল লম্বা না। অনুবাদটি ছাপাবার চেষ্টায় সজনী দাসের কাছে যাই। তার অল্পদিন আগে কোনও সাংস্কৃতিক সম্মেলন উপলক্ষে উনি বরিশাল এসেছিলেন। সেই সূত্রে পরিচয়। লেখাটা উনি নিলেন এবং কিছুদিন পরে ফেরত দিলেন। মনে হয় না খুলে দেখেছিলেন। একটু দমে গেলাম। কবে যেন হস্তলিপিটি হারিয়েও গেল। কিন্তু এইভাবে সজনীবাবুর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়ে গেল। মাঝে মাঝে উনি নিজের লেখা কবিতা পড়ে শোনাতেন। আমার ধারণা ওঁর অনেক কবিতা বেশ উঁচু দরের। কিন্তু তার চেয়েও উঁচু দরের ছিল শত্রুপক্ষীয় সাহিত্যিকদের সম্পর্কে ওঁর চোখা চোখা সব মন্তব্য। এঁদের কয়েক জনের বর্ণনা প্রসঙ্গে একদিন বললেন, “এরা কী জানো? এরা অতি অমায়িক খচ্চর।” বর্ণনাটি আমার বেশ রসোত্তীর্ণ মনে হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে দেশে, বিশেষ করে আমার স্বজাতি বাঙালিদের মধ্যে, বেশ কিছু অমায়িক খচ্চরের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের দু-একটি এখনও পিছনে লেগে আছে। এরা অমায়িক হাসি হেসে হঠাৎ পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়, তারপর অত্যন্ত বিব্রত মুখে বলে, “আহা, লাগল নাকি?” আমার ধারণা এই প্রজাতির জন্ম ইংরাজ সংস্পর্শে। পারফিডিয়াস অ্যালবিয়নের জারজ সন্তান ন্যাকা বজ্জাত ভারতীয়, বোকা বজ্জাতের অগ্রজ/অগ্রজা। বুদ্ধিমান বাঙালিদের মধ্যে প্রাণীটি সংখ্যায় কিছু বেশি। কিন্তু দেখবেন উনিশ শতকের আগে বাংলা সাহিত্যে এই প্রাণীর সাক্ষাৎ পাবেন না। হীরা মালিনী ন্যাকা না, ফিচেল ছেনাল।

স্নাতকোত্তর বিভাগে ক্লাস ফাঁকি দিতে শুরু করায় হাতে বেশ অফুরন্ত সময়। তার বেশ বড় একটা অংশ কাটে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় আমাদের কয়েক জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল। তাদের নিয়েই আমাদের কফি হাউস চক্র গড়ে উঠল। গোষ্ঠীপতি হলেন আড্ডাবাজদের শিরোমণি অমল দত্ত, যে কিনা প্রেমও যুথবদ্ধভাবে করার পক্ষপাতী ছিল। অন্যান্য সভ্য অর্থনীতির হীরেন রায়, ইতিহাস বিভাগের অশোক, তরুণ ব্যানার্জি এবং আমি। অশোক এবং অমলের জীবনে প্রেমের আবির্ভাব ঘটায় তাঁদের ভাবী পত্নীরা অরুণা সেন আর পূর্ণিমা সেনও এই আজ্ঞাচক্রের সভ্যা হলেন। নারীসঙ্গে অনভ্যস্ত আমরা এই দুই তরুণীর আবির্ভাবে বেশ খুশি। আড্ডার রথ সবেগে ধাবমান হল।

কফি হাউসের আড্ডা নিছক এরন্ড-ভর্জনের রসুইখানা ছিল এ কথা ভাবলে ভুল হবে। শিক্ষাক্ষেত্র হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি খুব পিছিয়ে ছিল না। রাজনীতি থেকে ফুটবল পর্যন্ত পৃথিবীতে যা কিছু আলোচ্য বিষয় আছে তার সব কিছুরই ওখানে বিদগ্ধ বিশ্লেষণ হত। অমল তখন নিত্যনতুন গুরু আবিষ্কারে ব্যস্ত—যথা বারট্রান্ড রাসেল, বার্নার্ড শ, অলডাস হাক্সলি ইত্যাদি। ওর সুবাদে আমাদেরও এইসব গুরুবাণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। ভারতীয় রাজনীতির তাপমান তখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। তার গতিপ্রকৃতি অশোক যা বিশ্লেষণ করত, কোনও পত্রপত্রিকায় তার তুলনীয় কিছু পাওয়া যেত না। সবাই তখন পাল্লা দিয়ে অনেক কিছু পড়ে ফেলতে ব্যস্ত। ফলে কফি হাউসের আড্ডা জ্ঞানান্বেষণের প্রতিপন্থী ছিল না। মাঝে মাঝে অম্লানদা (অম্লান দত্ত) এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন।

১৯৪৬ সালে কফি হাউসের আড্ডায় নতুন এক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হল। ধূর্জটিপ্রসাদের পুত্র কুমার বার্ড কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে কলকাতায় এসে আমাদের আড্ডায় যোগ দিল। কিন্তু সত্যিতেই সে তো আগমন নয়, আবির্ভাব। নাতিদীর্ঘ সুপুরুষ মানুষটির পরনে ভাল দর্জির কাটা দামি স্যুট, হাতে সম্ভবত তার চেয়েও দামি সিগারেটের টিন, চলাফেরা এক ফিয়াট (?) গাড়িতে। আমাদের বয়সি কোনও মানুষ নিজের গাড়ি চালিয়ে চলাফেরা করছে, এ ব্যাপারটা বুঝতে এবং হজম করতে রীতিমতো পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তার চেয়েও ভয়ানক-সমাজশাস্ত্র থেকে সব থানথান কথা কুমার আলগোছে ছুঁড়ে দিচ্ছে। বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমার মাঝখানে ধরা ক্রিকেট বিষয়ক বই কফির টেবিলে অবহেলায় ফেলে দিয়ে ও যখন আমাদের আড্ডায় এসে বসত, হীনম্মন্যতায় আমরা কেঁচো বনে যেতাম। আমরা সব প্রেসিডেন্সি কলেজের ডাকসাইটে ছাত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখনও ভারতবর্ষে পয়লা নম্বর (অন্তত আমাদের তাই ধারণা)। কোথাকার কোন লখনউ থেকে এই লোকটি এসে আমাদের কিনা টিট করে দিল! ওকে সহ্য করা গেল মুখ্যত এক কারণে–ওর অফুরন্ত কৌতুকবোধ, যা থেকে ও নিজেকেও রেহাই দিত না। ওর বাল্যকাল সম্পর্কে ওর কাছেই শোনা একটা গল্প বলি। অশোক মিত্র (আই.সি.এস) ধূর্জটিপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। সিঁড়ির উপর গোলমুখ এক বালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ বয়স আটময় হবে। অশোকবাবু বললেন, “কী খবর কুমার? কী করছ আজকাল? কিছু লিখছ-টিকছ?” উত্তর, “না, তেমন কিছু না। এই দু-চারটে হালকা প্রবন্ধ, কিছু ছোট গল্প, গদ্য কবিতা দু-একটা—এই আর কী!”ভবিষ্যদ্বাণী হিসাবে উত্তরটা অন্তত পঞ্চাশ ভাগ সত্যি হয়েছে। সব আপ্তবাক্য এতটা নির্বিষ ছিল না। কোনও বিবাহসভায় এক পিতৃবন্ধু হঠাৎ স্মৃতিচারণে রত হলেন, “এই যে কুমার! সে কতকালের কথা! সেই তোমার বাবার বিয়ের সময়..” কথা শেষ করতে না দিয়ে কুমারের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “আজ্ঞে হ্যাঁ, তখন আমি খুবই ছোট ছিলাম।” এরপর বাক্যালাপ আর বেশি এগোয়নি। ওর ভাবটা ছিল এই যে, বর্বরায়মান কলকাতা শহরে বাস করা আর সম্ভব হচ্ছে না। সভ্যতার অপস্রিয়মাণ অঞ্চল আশ্রয় করে কোনও মতে সে বেঁচে রয়েছে। কিন্তু বড়ই ক্লান্ত, বিপর্যস্ত। কফি হাউসের দেওয়াল ঘেঁষে কপালের রগ টিপে বসে থাকত। ভাবটা–”আর সহ্য হয় না। মা তারা, এই সর্বব্যাপী বর্বরতা থেকে উদ্ধার করো মা।” আমাদের এক নব-অনুরাগী কিঞ্চিৎ পশ্চিমায়িত এক সহপাঠী তার স্বভাবসিদ্ধ ইংরিজিঘেঁষা বাংলা উচ্চারণে কুমারকে ঘাঁটাতে গিয়েছিল : “কী কুমার, আই সে, ইউ লুক রাদার ডিপ্রেসড।” উত্তর, “কী করা যাবে! সবাইর তো তোমার মতো বাঁধা ‘–’ নেই।” এরপর প্রেমিক পুরুষটি বেশ কিছুদিন কুমারের সঙ্গে কথা বলেনি।

এই সময় দিয়ে আমাদের গোষ্ঠীজীবনে এক নিষ্ঠুর ট্র্যাজেডির ছায়া পড়ে। সেই ঘটনার প্রতিধ্বনি প্রায় ষাট বছর পরেও মাঝে মাঝে কানে আসে। প্রতিধ্বনি নয়, বিকৃত প্রতিধ্বনি। সেই বিয়োগান্ত নাটকের প্রধান কুশীলবরা কেউ বেঁচে নেই। তাদের সন্তান-সন্ততি এখন। প্রাপ্তবয়স্ক, জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। আশা করি তারা অপরাধ নেবে না।

আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে প্রথম বিবাহ করেন শম্ভু নন্দ। ওদের নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের ফ্ল্যাটের ছাদে এই উপলক্ষে চায়ের পার্টি হয়। সেখানেই অমল প্রস্তাব করল, নব দম্পতিকে একদিন চাং ওয়ায় খাওয়ানো যাক। এসব ব্যাপারে ও ছিল অত্যন্ত কর্মতৎপর। ব্যাপারটা আচ্ছা দেখা যাবে বলে ফেলে রাখায় মোটেই বিশ্বাসী ছিল না। তাই পার্টি শেষ হতেই আমাদের কফি হাউসের আড্ডাগোষ্ঠীকে নিয়ে হেদোর পাড়ে এক বেঞ্চিতে মিটিং বসাল। আলোচ্য বিষয়—কী খাওয়ানো হবে এবং তা কবে। সবাই অল্পবিস্তর উৎসাহী। এক তরুণ ব্যানার্জি বারবারই বলছিল পরিকল্পনা থেকে ওকে বাদ দিতে। ওর মনমেজাজ ভাল নেই, নানা সমস্যার ভিতর রয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এত সহজে ছাড়ার পাত্র অমল নয়। ফলে শেষ অবধি তরুণও নিমরাজি হল, তখনকার মতো সভা ভঙ্গ।

পরদিন সকালবেলা হিন্দু হোস্টেল থেকে আমাদের চেনা একটি ছেলে হন্তদন্ত হয়ে এসে খবর দিল—তরুণ আত্মহত্যা করেছে। হিন্দু হোস্টেলে গিয়ে দেখি, হোস্টেলের বাইরে একটি দড়ির খাঁটিয়ায় তরুণের শরীরটি শোয়ানো। চারিদিকে পুলিশ। এক অতি উৎসাহী ইনস্পেক্টার সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তার বক্তব্য—ব্যাপারটা জটিল এবং প্রেমঘটিত। কোনও ব্যক্তি নিজের স্বার্থে তরুণকে আত্মহত্যায় মদত দিয়েছে। সে ব্যক্তির হাতে হাতকড়া পরাতে ইনস্পেক্টর বদ্ধপরিকর। তার শুভ চেষ্টা সফল হয়নি।

কিন্তু পরদিন কলেজে গিয়ে দেখি চারিদিকে দারুণ উত্তেজনা। ওয়াকিবহাল মহলরা নাকি সবই জানতেন, অনেকদিন থেকেই তারা এরকম কিছু ঘটবে আশঙ্কা করছিলেন। নেহাত পরের ব্যাপারে তারা নাক গোঁজা পছন্দ করেন না, তাই এতদিন চুপ করে ছিলেন। কিন্তু এখন, সম্ভবত ধর্মের খাতিরে, নাক গোঁজার ব্যাপারে তাদের কোনও অনীহা দেখা গেল না। এঁদের বক্তব্য অমলের বাগদত্তা অরুণা আসলে অতি ঘঘাড়েল মেয়ে। যুগপৎ দু’জনের সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলছিল। শেষ অবধি অনেক হিসেব-নিকেশ করে অমলকেই। মাল্যদান করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই আত্মহত্যা। সহজ সমস্যা, সরল সমাধান।

ক্লাসের অনেক মেয়ে এই গহিত ব্যবহারের জন্য অরুণার সঙ্গে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিল। তাঁদের মতো সব সুযোগ্যা নায়িকা থাকতে তরুণ ওই বিশ্রী মেয়েটার প্রেমে পড়তে গেল? কী আর এমন দেখতে অরুণা! (পাঠিক/পাঠক বঙ্কিমরচিত আয়েষার বর্ণনা স্মরণ করুন; “পাঠিকা স্মরণ করুন, যাহাকে দেখিয়া বলিয়াছেন ‘এমন আর কি দেখিতে,’ “) কিছু লোক এমন দৃষ্টিতে অমলের দিকে তাকাত যেন সে বন্ধুহত্যা করেছে।

বহুদিন আগের এই ঘটনার সত্যিকার কারণ যতটা বুঝেছিলাম তা লেখা প্রয়োজন মনে করি। শোকের মুহূর্তে তরুণের বাবা বলেছিলেন, ওঁদের পরিবারে আত্মহত্যার চেষ্টা এই প্রথম নয়। যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি, তখন একবার তরুণের সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। একদিন আমাকে আন্ডার কারেন্টে টেনে নিয়ে যায়, নুলিয়ারা কোনও মতে আমাকে উদ্ধার করে। তরুণকে বলেছিলাম, যখন ঘটনাটা ঘটে তখন ভয়ে আমি আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। তরুণ অবাক হয়ে বলল, “কেন? আমার এরকম কিছু হলে আমি তো খুশিই হতাম।” বুঝতে পেরেছিলাম যে ও ছেলেমানুষি বাহাদুরি করছে না, কথাটা মনের থেকেই বলছে। কেন, তার কারণ জানতে পারিনি। বি.এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস না পেয়ে ও ভীষণ মুষড়ে পড়ে। তখনও বিদেশি রাজত্ব, চাকরি-বাকরির বাজার খুব খারাপ। ফার্স্ট ক্লাস না পাওয়ার অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই শেষ অবধি কেরানিগিরি করে জীবিকা অর্জন। সুতরাং মুষড়ে পড়াটা কিছু আশ্চর্য না। মনের যখন এই অবস্থা তখন ওর অরুণার সঙ্গে পরিচয় হয়, অমলের বাগদত্তা হিসাবেই, এবং আমাদেরই কফি হাউসের আড্ডায়। তার বাইরে অরুণার সঙ্গে ওর কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু ও যে অরুণার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। অমল ওর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তাই ওর সম্পূর্ণ নির্দোষ ভালবাসা ওর মনে এক গভীর অপরাধবোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারই শেষ পরিণাম ওই আত্মহত্যা।

মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন যে, আত্মহত্যা সাধারণত কোনও বিশেষ কারণে হয় না। হয় মানসিক একটা প্রবণতা থেকে, অনেক সময়ই যা বংশানুক্রমিক। ঘটনাবিশেষ সে প্রবণতাকে উসকে দিতে পারে। গভীর ডিপ্রেশনের সময়ে অরুণার সঙ্গে ওর পরিচয়। এবং ওর নীতিবোধ অনুযায়ী ওর নির্দোষ ভালবাসা নিজের চোখেই পাপ মনে হয়েছে। এই কল্পিত পাপের জন্য অমলের কাছে ক্ষমা চেয়ে ও একটা চিঠি লিখে গিয়েছিল। কিন্তু নীতিবাগীশদের রোষ তাতে প্রশমিত হয়নি। যখন অরুণার প্রথম সন্তানটি ক্যানসারে মারা গেল এবং অরুণার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটল, তখন এমন কথাও শুনেছি যে মেয়েটা শেষ অবধি তার পাওনা শাস্তি পেল। আমাদের সমাজে নীতিবোধের এই বিচিত্র প্রকাশ নিজের জীবনেও ভুগতে হয়েছে। গ্রাম্য চণ্ডীমণ্ডপের রাজনীতি আর বিদেশি শাসনে জীবনের সব ক্ষেত্রেই গভীর নিরাশা মিলিয়ে আমাদের সমাজজীবনে কিছু বিকৃতি সৃষ্টি করেছিল। আমার ধারণা যেধরনের বিকৃত মানসিকতার কথা লিখলাম তা সেই ব্যাপকতর সামাজিক মনোবিকলনেরই বহিঃপ্রকাশ।

স্নাতকোত্তর বিভাগে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে এক ব্যাপারে বিশেষ পার্থক্য দেখলাম। কলেজে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছাত্রর সংখ্যা অনুপাতে কম ছিল। পড়াশুনো, ভবিষ্যতের চিন্তা নিয়েই প্রায় সবাই ব্যস্ত। এখানে দেখলাম অনেকেই সক্রিয়ভাবে কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত। জেলখাটা লোকের সংখ্যা কম নয়। আন্দামান ফেরতও দু-একজন আছেন। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা আট আর ছয়ে চোদ্দোয় না পৌঁছালেও যেটের কৃপায় একেবারে নগণ্য না। যুব কংগ্রেস রীতিমতো শক্তিশালী। ছাত্র মুসলিম লিগ অত্যন্ত সক্রিয় এবং শেষোক্ত দলের ভিতরেও ডানবাঁর রেষারেষি লক্ষণীয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যে-নির্বাচন হল তাতে এইসব ছাত্রকর্মী এবং নেতারা রীতিমতো সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছেন। ‘৪৫ সালে দেশনেতারা জেল থেকে ছাড়া পেলেন। শোনা গেল ইংরাজ শাসক সমঝোতার চেষ্টায় আছেন, হয়তো ক্ষমতা হস্তান্তরও অসম্ভব না। কিন্তু একটা কিছু যে শিগগিরই ঘটবে এবং তাতে আমাদের ছাত্রদের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকবে সে বিষয়ে আমাদের মনে সংশয় ছিল না।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পণ্ডিত নেহরু কলকাতায় এলেন। দেশপ্রিয় পার্কের সভায় ওঁর কথা শুনতে কয়েক লক্ষ লোক জড়ো হয়েছিল। কিন্তু মাইক্রোফোন কাজ না করায় একটি কথাও শোনা গেল না। আমরা শুধু অনেক দূর থেকে দেখলাম—পণ্ডিতজি অত্যন্ত চটে গিয়ে ওঁর পাশের লোকদের খুব বকাবকি করছেন। পরদিন কাগজে ওঁর বিবৃতি পড়লাম। উনি দেশের লোককে আসন্ন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন। পরে মৌলানা আজাদের আত্মচরিতেও দেখি, যুদ্ধের শেষে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিশ্বাস করেননি যে, ইংরাজ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরিত করার কথা সত্যিতেই চিন্তা করছে।

‘৪৬ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক নতুন মোড় নিল। যুদ্ধের সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির কার্যকলাপ সম্বন্ধে কিছু উড়ো কথা মাঝে মাঝে কানে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছিল সে সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা ছিল না। শুধু মনে পড়ে একদিন কিরণশঙ্করবাবুর বসবার ঘরে আমরা ক’জন বসেছিলাম। এমন সময় খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে ফোন এল, “রেডিওটা খুলুন, সুভাষ বলছেন।” বক্তৃতাটা সিঙ্গাপুর থেকে প্রচার হচ্ছিল। এর বেশি কিছু বোঝা গেল না। আসলে ওয়াকিবহাল মহলে অনেকেই আই.এন.এর খবর রাখতেন। কিন্তু এ নিয়ে কাউকে কখনও কিছু আলোচনা করতে শুনিনি। তাই আই.এন.এর নেতৃবৃন্দর বন্দিদশা এবং বিচারের খবর হঠাৎ একটা বোমা ফাটার মতো আমাদের রাজনৈতিক চেতনা উচ্চকিত করল। ঠিক তার আগেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পরেই বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হয়েছে। তা নিয়ে সর্বত্রই প্রচণ্ড জল্পনাকল্পনা। অনেকেই কথাটা বিশ্বাস করেনি। আর বৌবাজারের মোড়ে কাগজবিক্রেতারা রোজই চেঁচাচ্ছে, “নেতাজি আ গিয়া, নেতাজি আ গিয়া।” সেই আওয়াজ অল্প কিছুদিন আগেও শুনেছি। প্রসঙ্গত বলি, ওই দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয় এ কথা অবিশ্বাস করার একটি বিশেষ কারণ আছে। প্রচারিত ঘটনার তিন সপ্তাহ পরে ভাইসরয়ের স্বরাজ্যসচিব ওঁর কর্মসমিতির বিবেচনার জন্য একটি সুদীর্ঘ গোপন মন্তব্য লেখেন। সেই মন্তব্যটি পরে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ‘ট্রান্সফার অফ পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক বহু খণ্ডে প্রকাশিত দলিলসংগ্রহে ছাপা হয়েছে। মন্তব্যটির প্রধান আলোচ্য—নেতাজিকে নিয়ে কী করা হবে। কিন্তু এই প্রামাণ্য দলিলটির কোথাও, উনি যে জীবিত নেই বা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে একটা গুজব উঠেছে, এরকম কোনও কথার ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ নেই। একাধিক তদন্ত কমিশন চুড়ান্ত মত দিয়েছে যে ওই দুর্ঘটনায়ই নেতাজির মৃত্যু হয়। তা হলে ওই দলিলটির কী ব্যাখ্যা হয় সে বিষয়ে কিন্তু সবাই নিশূপ। নেতাজির জীবনীলেখক, যুদ্ধের সময় সামরিক বিভাগের গোয়েন্দা আমার বন্ধু কর্নেল হিউ টয়কে আমি এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। উনি বললেন, তখন গোলমালের সময়। সব খবর সকলের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাত না। তাই স্বরাজ্যসচিব ভুলভাল সব লিখেছেন। এ কথা আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। নেতাজির মৃত্যুসংক্রান্ত গুজব নিয়ে দেশ তখন তোলপাড়। কিন্তু সে গুজব স্বরাজ্যসচিবের কানেও পৌঁছয়নি—অথচ তিনি যেভাবে লিখছেন তাতে নিঃসন্দেহে মনে হয় নেতাজি কোথায় তা তার ভালই জানা আছে—এমন অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বিশ্বাস করা সম্ভব না। এখানে আর একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। নেতাজি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কোথায় বা কত দিন বেঁচে ছিলেন সে সম্বন্ধে আমার কোনও মতামত নেই, কারণ এ ব্যাপারটা অনেকে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন, আমি তাদের একজন নই। শুধু ওই বিমান দুর্ঘটনায় ওঁর মৃত্যুর কাহিনিটা কেন সত্যি হতে পারে না, তার কারণ আমি ব্যাখ্যা করলাম। এ নিয়ে আর কোনও তর্ক-বিতর্কে জড়াবার ইচ্ছে বা একতিয়ার আমার নেই, সে কথা ছাপার অক্ষরে কবুল করাও দরকার মনে করলাম। কারণ এ সব ব্যাপারে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা।

আই. এন, এ-র যুদ্ধপ্রচেষ্টার সংবাদ দেশে এক অভূতপূর্ব উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বিদেশি শাসনের প্রতি পুঞ্জীভূত বিদ্বেষ কতটা তীব্র এবং সর্বব্যাপী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যুদ্ধের গোড়া থেকেই তা বোঝা যাচ্ছিল। রেডিওতে অক্ষশক্তির বিজয়সংবাদ শুনে জনসাধারণ কী পরিমাণ উল্লসিত হত, সে যে না দেখেছে তাকে বোঝানো সম্ভব না। ইংরাজ শাসকের প্রতি সাধারণের বিতৃষ্ণা অক্ষশক্তির প্রতি এক নির্বোধ আকর্ষণের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। কলকাতার এক পুলিশ কমিশনার তার গোপন রিপোর্টে লেখেন যে, জাপানিরা কলকাতায় এলে নিউ মার্কেটের ফুলের দোকান সব লুট হয়ে যাবে। বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে মহাত্মার অহিংস রাজনীতি কখনওই পূর্ণ সমর্থন পায়নি। সহিংস বিপ্লবে বিশ্বাসী অগ্নিযুগের দাদা সকলের চোখেই বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। দেশবন্ধু এবং সুভাষচন্দ্র—দু’জনের সঙ্গেই বিপ্লবীদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, এ কথা এখন সর্বজনবিদিত। যুক্ত বঙ্গে সুভাষচন্দ্রের অন্যতম প্রধান সমর্থক ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’, এক সময় যারা সশস্ত্র বিপ্লবের পথে এগিয়েছিলেন তাঁদেরই প্রতিষ্ঠান। কংগ্রেস নেতৃত্ব থেকে সুভাষচন্দ্র বহিষ্কৃত হওয়ার পর তার নীতি এবং ব্যক্তিত্বও ভারতবর্ষের সর্বত্রই বহু সংখ্যক রাজনৈতিক কর্মীর এবং জনগণের সমর্থন পায়। সেই সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ভারতীয় যোদ্ধারা সংগঠিতভাবে অস্ত্রধারণ করেছে, এই সংবাদ যেন অসংখ্য ভারতবাসীর অনেক দিনের গোপন ইচ্ছা পরোক্ষভাবে পূরণ করল। আই. এন. এর নেতৃবৃন্দকে লাল কেল্লায় বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে বিচার করা হবে আর সে বিচার করবে বিদেশি সরকার, এই সংবাদ জনগণের মনে আগুন ধরিয়ে দিল। যাঁরা এক সময় নেতাজির বিরোধিতা করেছিলেন, জাপানিদের সঙ্গে তার সহযোগিতার নিন্দা করেছিলেন, তারাও এখন আই. এন. এর সমর্থনে সোচ্চার হলেন। পণ্ডিত নেহরু স্বয়ং তার বহুদিনের পরিত্যক্ত ব্যারিস্টারি গাউন আবার গায়ে চড়িয়ে লাল কেল্লার ক্যাঙ্গারু আদালতে হাজির হলেন। আগস্ট আন্দোলনের সময়ও অন্তত যুক্ত বঙ্গে এত উত্তেজনা দেখা যায়নি। কলকাতার যুবসমাজ, বিশেষ করে ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে এই উত্তেজনা এক নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। তখন শাসকরা এক দিকে আই. এন. এ. বন্দিদের বিচারের ব্যবস্থা করছে, অন্য দিকে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আলাপ-আলোচনারও উদ্যোগ চলছে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বোঝা দরকার, যে কথা পরবর্তী গবেষণার ফলে জানা গেছে এবং যা ‘৪৬-’৪৭ সনে সম্ভবত পাক-ভারতীয় নেতাদের কাছেও স্পষ্ট ছিল না। হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে–”নশো মুসো খাকে বিল্লি হজকে চলি”। অর্থাৎ নো ইঁদুর খেয়ে বিড়াল হজে চললেন। বিড়ালতপস্বী সাম্রাজ্যবাদী ইংরাজ ক্ষমতা হস্তান্তর বলতে সত্যি কী ভেবেছিল তা শুধু অল্প ক’জন কর্তাব্যক্তিই জানতেন। ওঁদের ভরসা ছিল যে, বাবা বাছা করে পিঠে হাত বুলিয়ে ভারতীয় নেতাদের দেশটাকে ডোমিনিয়ন থাকতে রাজি করানো যাবে। তাদের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু তাদের আরও ভরসা ছিল যে স্বাধীন ভারত তার অনভিজ্ঞতার কারণে নিজের স্বার্থেই ইংরাজের পৃথিবীব্যাপী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় শামিল হবে। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে ভারতবর্ষে ইংরাজের বাণিজ্যগত স্বার্থ এবং মূলধন নিয়োগের ব্যাপারেও কোনও রদবদল হবে না। ত্রিশের দশকে এক আদর্শবাদী তরুণ পেন্ডেরেল মুন আই. সি. এস. পরীক্ষায় পাস করে ইন্ডিয়া অফিসের বড় কর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। ভারতবাসীদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতির উপায় সম্বন্ধে উনি যা চিন্তা করেছিলেন সেসব বড় কর্তাদের কাছে নিবেদন করেন। কিছুক্ষণ শোনার পর ওঁরা যা বললেন তার মর্ম এই : “দেখ বাছা, ভারতবাসীদের গণতন্ত্র শেখানোর জন্য আমরা ওখানে বসে নেই। ও দেশে আমাদের হাজার কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ আছে। আমাদের কাজ তার রক্ষণাবেক্ষণ।” আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ঝুনো আই.সি.এস. অফিসার লর্ড হেইলি প্রস্তাব করেছিলেননরমপন্থী নেতাদের ডেকে ডোমিনিয়ন স্টেটাস দিয়ে দাও। শুধু খেয়াল রেখো, আমাদের অর্থনৈতিক আর সামরিক স্বার্থ যেন বজায় থাকে। ৪৫-৪৬-এর ইঙ্গ-ভারতীয় আলাপ-আলোচনার পিছনেও যে এই জাতীয় চিন্তা কাজ করছিল এখন তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই আপাতদৃষ্টিতে যা অর্থহীন মনে হয়–মানে ইংরাজ কেন এক দিকে পাততাড়ি গোটাতে ব্যস্ত অথচ একই সঙ্গে দেশপ্রেমিক ভারতীয় সৈন্যদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করছে—আসলে তা মোটেই অর্থহীন ছিল না। ভবিষ্যতে যদি ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ইংরাজের তাবে রাখতে হয়, তবে ইংরাজবিরোধী ভারতীয় সৈন্যদের বরদাস্ত করা চলবে না। ইংরাজের তৈরি ওই বাহিনী যাতে অটুট থেকে ইংরাজের স্বার্থরক্ষার কাজে লাগে এ নিয়ে ইংলন্ডে ফৌজি বড়কর্তাদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এবং সেই কারণেই তারা নাটকের শেষ অঙ্কে ভারতবিভাগ বন্ধ করার জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে খেলাটা তাঁদের হাতের বাইরে চলে গেছে। ভারতবর্ষে শেষ অবধি আই.এন.এ. নেতৃবৃন্দের বিচারের প্রহসন থেকে সরকার বাহাদুর যে পিছিয়ে এলেন তার কারণ দুটি। প্রথম কথা, তারা দেখলেন এই বিচারপ্রচেষ্টায় সৈন্যদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ নিয়ে দেশব্যাপী প্রতিরোধের আশঙ্কা ওঁরা আদৌ করেননি। অল্প কিছু দুবৃত্ত বাদ দিলে ভারতবাসী যে মনেপ্রাণে ইংরাজ শাসনের অনুরাগী এই অন্ধ বিশ্বাস বহু ইংরাজেরই শেষ অবধি বজায় ছিল এবং এখনও আছে। কর্তৃমহলের ভারতবর্ষকে ইংরাজের অঞ্চলাশ্রয়ী করে রাখার ইচ্ছা যে পূর্ণ হয়নি, তার কারণ যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে রাজনীতির চেহারা আশাতীতভাবে বদলে যায়। ফলে ব্রিটেনের ডোমিনিয়নগুলি তার পক্ষপুটে থাকবে এ আশাও পুর্ণ হল না। যুদ্ধোত্তর জগতে ব্রিটেন বৃহৎ শক্তি ঠিকই, কিন্তু আমেরিকা আর সোভিয়েট রাশিয়া, ওই দুই মহাশক্তির ছায়ায় তার ক্ষমতা কিছুটা ম্লান। নতুন স্বাধীনতা পেয়ে ব্রিটেনের অধীনস্থ দেশগুলি সত্যিতেই স্বাধীন হল। দরিদ্র জনগণের ভাগ্যে যাই জুটুক, এই নবলব্ধ আজাদি ঝুটা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই সত্য উপলব্ধি করতে ইংরাজদের বেশ কিছু সময় লেগেছিল। নেহরুর নিরপেক্ষতা নীতি তাদের হিসাবের ভিতরে ছিল না।

কলকাতায় প্রগতিবাদী ছাত্রদের মধ্যে যুদ্ধের পর স্পষ্ট কোনও কর্মসূচির জন্য তীব্র আগ্রহ দেখা যায়। ভারতবর্ষের যুবসমাজ স্বাধীনতালাভের জন্য আর অনন্তকাল অপেক্ষা করতে রাজি নয়, নানা ঘটনা আর রাজনৈতিক জল্পনা-কল্পনার ভিতর দিয়ে সে কথা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। দ্বিতীয় কথা, গাঁধীজির কারামুক্তির পর জিন্না সাহেবের সঙ্গে তার আলাপ-আলোচনার ভিতর দিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় রাজনীতির সব মহলেই এক গভীর দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে। সাম্প্রদায়িক বিরোধ কী ভয়াবহ রূপ নেবে তখনও কেউ তা কল্পনা করেনি ঠিকই, কিন্তু পাকিস্তানের দাবি যে শেষ অবধি ভারত সাম্রাজ্য দ্বিখণ্ডিত করবে, আগস্ট ‘৪৬-এর আগে এ কথাও অধিকাংশ ভারতবাসীর কল্পনায় আসেনি। পাকিস্তান দাবির সত্যিকার স্বরূপ কী তা নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা প্রায় শেষ অবধি ছিল। দুই পরস্পরবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রর প্রস্তাব অনেকদিন পর্যন্ত দুই মুসলমানপ্রধান প্রদেশ—অর্থাৎ যুক্তবঙ্গ এবং পঞ্জাবের নেতৃবৃন্দের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে তো কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা চালু ছিল। বেলুচিস্তানেও পাকিস্তান প্রস্তাব সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহ দেখা যায়নি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ যে ক্রমেই বাড়ছে, সে কথা কারও কাছে অস্পষ্ট ছিল না।

যুক্তবঙ্গ সম্পর্কে এ কথা বিশেষভাবে সত্যি। সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে, বাংলায় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। এই কথা বোঝার জন্য আমরা যারা সেই সময় সাবালক হয়েছি তাদের গবেষণার আশ্রয় নিতে হয় না। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী পত্রপত্রিকায় মুসলমানদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যেভাবে নিষ্ঠুর বিদ্রূপ করা হত, তা সাম্প্রতিক কালের সঙ্ পরিবারের ভাষার থেকে খুব কিছু আলাদা নয়। বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের অবস্থা অবশ্যি তখন খুবই সঙ্গিন। একেই বিদেশি শাসনের আওতায় চাকরিবাকরির সম্ভাবনা কম, তার উপর শতকরা পঞ্চাশ ভাগ চাকরি মুসলমানরা পাবে এই নিয়ম হওয়ায় হিন্দুদের যুক্তবাংলায় চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। কারণ এই নিয়ম যখন চালু হল, তখন প্রায় নব্বই ভাগ চাকরি হিন্দুদের হাতে। আনুপাতিক সংখ্যাটা নব্বই থেকে পঞ্চাশে নামাতে হলে কার্যত হিন্দুদের চাকরি দেওয়া বন্ধ করতে হয়। সরকারি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে নতুন নীতির ফল প্রায় তাই-ই দাঁড়িয়েছিল। সরকারি কলেজে মুসলমান ছাত্রদের নামের পাশে ইংরাজিতে ‘এম’ অক্ষরটি লেখা থাকত, আর তপশিলভুক্ত বা শিডিউলড কাস্ট ছাত্রদের নামের পাশে লেখা থাকত ‘এস’। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম আমাদের নামের পাশে ‘ও’ অর্থাৎ অপ্রেসড লেখা থাকা উচিত। প্রায় সম্পূর্ণভাবে চাকরিনির্ভর বাঙালি হিন্দুর সত্যিতেই মরণদশা ঘটেছিল। ওই অবস্থায় আমরা যে সবাই মুসলমানবিদ্বেষী হয়ে উঠিনি তাতে প্রমাণ হয় যে, জাতীয়তাবাদ আমাদের চেতনায় কিছু সুবুদ্ধির বীজ বপন করতে পেরেছিল। দোষটা যে মুসলমানের না, বিদেশি শাসনের, সে কথা মনে রাখা তখন কোনও অর্থেই সহজ ছিল না। পরীক্ষায় ফাস্ট-সেকেন্ড হয়েও দীর্ঘদিন বেকার থাকার সম্ভাবনা বিভীষিকার মতো বাঙালি হিন্দুর চেতনাকে আচ্ছন্ন করে থাকত। আর যারা সাধারণ ছাত্র, খুব শক্ত খুঁটির জোর না থাকলে তাদের চাকরি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। ফলে অনেকেই ভাবত যে, মুসলমান আর ইংরেজ যোগসাজসে হিন্দুর মুখের ভাত কেড়ে নিচ্ছে। আর হিন্দু জমিদার এবং কুসীদজীবী যে তাদের মুখের ভাত কাড়ছে, বর্ধিষ্ণু কৃষক সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা নতুন মুসলমান মধ্যবিত্তের এ তো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। যে কংগ্রেস জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি রাখে, সেই কংগ্রেসই যে কৃষক এবং অধমর্ণের অত্যন্ত ন্যায্য দাবির সমর্থনে আইন পাস করতে রাজি হয়নি, সে কথাই বা তারা ভোলে কী করে? কিছু কিছু জাতীয়তাবাদী পত্রিকা যেভাবে মুসলমানদের রাজনীতি নিয়ে বিদ্রূপ করত, তাতে শিক্ষিত মুসলমানের ক্ষিপ্ত হওয়া কিছু আশ্চর্য ছিল না। এরকম একটি পত্রিকা সম্বন্ধে ফজলুল হক সাহেব একদিন মন্তব্য করেছিলেন, “দ্যাখ, আমি হিন্দুবিদ্বেষী, ছালানিয়া পাড়া [বরিশালবাসী হিসাবে এই শব্দসমষ্টির জন্য আমি বিশেষ গর্ব বোধ করি। এমন অর্থবহ বর্ণনা বাংলা ভাষায় আর দ্বিতীয় নেই। ছালান পাঁঠা হচ্ছে যাকে ইংরেজিতে বলবে এসেন্স অফ পাঁঠা, মানে যার নির্বুদ্ধিতায় কোনও ভেজালের স্পর্শ পড়েনি। এরকম মানুষ দু-চারটি দেখিনি এমন নয়। এরা না থাকলে আমাদের জীবন অত্যন্ত বর্ণহীন হয়ে যেত।] ছাড়া এ কথা কেউ কইবে না। কিন্তু সকালে উড়িয়া ওই কাগজখান পড়লে আমারও ইচ্ছা করে হিন্দুগো মুন্ডু চিবাইতে।” ওই পত্রিকার এক পূজা সংখ্যায় ‘ছহি হকনামা’ বলে একটি রসরচনা বের হয়েছিল। সেটি পড়ে সমস্ত শিক্ষিত মুসলমান যদি ক্ষেপে উঠে থাকেন তো বলার কিছু নেই। মোট কথা যার চোখ আছে সেই দেখতে পাচ্ছিল যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাঙালিকে এক অজানা সর্বনাশের পথে ঠেলে নিয়ে চলেছে। এই অশুভ সম্ভাবনা সম্পর্কে আমরা ছাত্ররা বিশেষ সচেতন ছিলাম।

আই. এন. এ.-কে ঘিরে উত্তেজনা আমাদের কাছে এক নতুন সম্ভাবনার পথ দেখাল। জাতীয় ফৌজে নেতাজির অন্যতর অবদান জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করা। যুবনেতারা দেখলেন ওই আদর্শে এক সত্যিকার জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। এ ব্যাপারে বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলন, বিশেষ করে ছাত্র ফেডারেশন যে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সে কথা অস্বীকার করা যায় না। ‘৪৫-এর নভেম্বরে আই. এন. এ. দিবস পালন করা হয়। ‘৪৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ‘রশিদ আলি দিবস’ পালনের ডাক এল। আই. এন. এ. নেতা রশিদ আলির তখন সাত বছর কারাবাসের হুকুম হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে প্রথম সভা হবে তারপর বন্দিদের মুক্তি দাবি করে যেসব প্রস্তাব পাস হবে তা নিয়ে ডালহাউসি স্কোয়ারে শোভাযাত্রা করে গিয়ে, আমাদেরই নির্বাচিত মন্ত্রীদের হাতে তার প্রতিলিপি তুলে দেওয়া হবে। এর মধ্যে সর্বদলীয় ঐক্যর সম্ভাবনা আমরা দেখেছিলাম, কিন্তু সংঘাতের সম্ভাবনা কেউই দেখেনি। কারণ আভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষার ভার তখন প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজের হাতে না। এবং তখন আই. এন. এ-র প্রতি অন্তত মৌখিক আনুগত্যে কোনও রাজনৈতিক দলই পিছ-পা না।

নভেম্বর মাসে আই. এন. এ. দিবসে কয়েক হাজার ছাত্র ওয়েলিংটন স্কোয়ারে জমা হয়েছিল। সেখান থেকে মিছিল বের হয়ে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবেই ডালহাউসি স্কোয়ারের দিকে এগুচ্ছিল। কিন্তু ধর্মতলা স্ট্রিটে পুলিশ শোভাযাত্রাকে বাধা দিল। কারণ ডালহাউসি স্কোয়ার নিষিদ্ধ অঞ্চল। সেখানে যাওয়া চলবে না। শোভাযাত্রীরা রাস্তার ওপর বসে পড়ে। পুলিশ শোভাযাত্রীদের ছত্রভঙ্গ হওয়ার আদেশ দেয়। সে কথায় কেউ কর্ণপাত না করায় গুলি চলে। বেশ কয়েকটি ছেলে খুনজখম হয়। এদের কেউই শহিদ হওয়ার জন্য ওখানে এসেছিল মনে হয় না। প্রথম যে ছেলেটি মারা পড়ে, তার নাম রামেশ্বর। তার পকেটে পরবর্তী শোয়ে মেট্রো সিনেমার একটি টিকিট পাওয়া যায়। বেচারার নিতান্তই অপঘাত মৃত্যু ঘটে, কারণ মনে হয় না ও মিছিলে যোগ দিতে এসেছিল। কিন্তু ওই দিনকার প্রতিবাদ এক কারণে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কারণ গুলি চলার পরও ছেলেমেয়েরা পালায়নি। রাস্তার উপরই বসেছিল। বেশ অনেক রাত অবধি পুলিশ আর শোভাযাত্রীরা মুখোমুখি বসে থাকে। পুলিশও আর দ্বিতীয়বার গুলি চালায়নি। সত্যিকার বিপ্লব চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু তার পরের ক’দিনের ঘটনায় বৈপ্লবিক পরিস্থিতি কাকে বলে তার কিছু আঁচ পেয়েছিলাম। উপরি উক্ত ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রদের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যৌথভাবে সভা, মিছিল এবং ডালহাউসি অভিযানের আহ্বান হল। এদিন ধর্মতলার সভায় যুক্ত বঙ্গের দূর দূর অঞ্চল থেকে হাজারে হাজারে ছাত্র কলকাতা শহরে উপস্থিত হয়েছিল। এবারকার প্রতিবাদ ছেলেখেলা না, মনে মনে সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে ময়দানে নামা। এসব সময় মিছিলে কত লোক শামিল হয়েছিল তার সঠিক হিসাব কখনও পাওয়া যায় না। যদি বলি কয়েক লাখ লোক মিছিলে যোগ দিয়েছিল তাহলে বোধ হয় অতিরঞ্জন হবে না। এদিনের প্রতিবাদের আর এক বৈশিষ্ট্য, সভা এবং মিছিলে ছাত্র মুসলিম লিগের এক অংশের সক্রিয় অংশগ্রহণ। ফেব্রুয়ারি মাসে রশিদ আলি দিবসে মুসলিম লিগ সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। নভেম্বর মাসে আই. এন. এ. দিবসের পরদিন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের সভায় কংগ্রেসের তেরঙ্গা ঝাড়ার সঙ্গে মুসলিম লিগের সবুজ পতাকা আর ছাত্র। ফেডারেশনের লাল ঝান্ডা এক সঙ্গে বাঁধা হল। সেই তিন ঝান্ডা নিয়ে মিছিল ধর্মতলা স্ট্রিট দিয়ে কিছুটা এগুতেই, সশস্ত্র পুলিশ পথ আটকাল। শোভাযাত্রীরা পথ জুড়ে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষ থেকে শরৎ বসু এবং কংগ্রেসি নেতা কিরণশঙ্কর রায় এলেন। তাঁরা ছাত্রদের কাছে আবেদন করলেন, “আপনারা ফিরে যান। আপনাদের দাবি যাতে যথাস্থানে পৌঁছায় তার দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি।” কিন্তু এই আবেদনে কেউ সাড়া দিল না। নেতারা ফিরে গেলেন। তার কিছুক্ষণ পর পুলিশ ছত্রভঙ্গ হওয়ার হুকুম দিল। কিন্তু যে যেখানে বসেছিল বসেই রইল। বোধ হয় একজনও নড়েনি। তারপর গুলি চলল-সম্ভবত একাধিকবার। কারণ পরবর্তী হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশের উপরে, আহতের সংখ্যার ঠিক হিসাব কখনও শুনিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দি সাহেব স্বয়ং এলেন। সঙ্গে শরৎবাবু। পুলিশের অবিবেচনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে এবং তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উনি বললেন যে, ডালহাউসি অভিযানে উনি নিজেই নেতৃত্ব করবেন। মিছিল ডালহাউসি চলল, পুরোভাগে সুরাবর্দি সাহেব আর শরৎবাবু। অবাক বিস্ময়ে এই প্রহসনে অংশ গ্রহণ করি। শেষ অবধি যদি যেতেই দেবে, তবে এতগুলি ছেলেমেয়েকে খুন করার কী দরকার ছিল? কার নির্দেশে এবং কেন পরপর দুদিন গুলি চলল? আমার দু’জন ছাত্র এই সময়কার ঘটনাবলী নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁরাও এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পাননি। পুলিশের গোপন দলিলপত্র যদি সত্যিতে কখনও নির্দ্বিধায় গবেষকদের দেখতে দেওয়া হয়, তবে হয়তো আমার প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাবে। প্রতিশ্রুত তদন্ত কখনও হয়নি। একটা কথা বলে এই প্রসঙ্গ শেষ করি। সেদিন পুলিশের গুলিতে যারা খুন হয় তাদের অনেকেরই পকেটে নিজেদের নাম-ঠিকানা লেখা চিরকুট পাওয়া যায়। মানে এরা জানত—হয়তো আর বাড়ি ফেরা হবে না। আত্মীয়স্বজনদের ওরা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রাখতে চায়নি। অনেকদিন পরে, তখন আমি অক্সফোর্ডে শিক্ষক, বন্ধু হিউ টয় যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়কার কিছু ফোটো দেখাচ্ছিলেন। একটা ছবি দেখিয়ে বললেন, “এটা কলকাতার ধর্মতলার ছবি। আই. এন. এ. ডে মনে আছে?” বললাম, “আছে।” হিউ বললেন, “এ হরিড অ্যান্ড স্টুপিড বিজনেস।” ওঁর দুর্ভাগ্য, ওঁর সেখানে উপস্থিত থাকতে হয়েছিল। বললাম, “আমিও ছিলাম–আর কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের মতো।” আলাপটা সেদিন আর এগোয়নি।

‘৪৬ সনের গোড়ায় শীতের সময় আই.এন.এর বিচার-প্রহসন নিয়ে সারা দেশ তোলপাড় হল। শেষ অবধি সরকার মামলা তুলে নিলেন। আই.এন.এ-র নেতৃবৃন্দ এবং সৈনিকদের অসম্মানজনকভাবে বরখাস্ত [ডিস-অনারেবল ডিসচার্জ করেই মনের ঝাল মেটাতে হল। এর মধ্যে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত বদলাচ্ছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই হক সাহেবকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। সে এক বিচিত্র ঘটনা। এখন যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, ‘৩৭ সনে দেশে যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চাল হয়, যুক্ত বাংলার ক্ষেত্রে সেটা অনেকাংশে প্রহসনে দাঁড়ায়। অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল গভর্নর অল্প কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি উপদেষ্টার সাহায্যে সত্যিকার ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই ব্যবস্থার ভিত আরও শক্ত করা হয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে কর্তাদের কোনও আপত্তি ছিল না–যতক্ষণ পর্যন্ত সে ব্যবস্থা তাঁদের মর্জি মতো চলছে। কিন্তু ফজলুল হক সাহেব ছোট লাটের গৃহ-মার্জার হতে রাজি না হওয়াতেই যত গণ্ডগোল শুরু হল। গোদের উপর বিষফোঁড়া মন্ত্রিসভায় উনি প্রথমে শ্যামাপ্রসাদের মতো বাঘের ছানাকে নিয়ে এলেন, তারপর কিছু কংগ্রেসকে জোটালেন, শেষে শোনা গেল জাপানিদের সহযোগী সুভাষচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ শরৎ বসুকে মন্ত্রিসভায় আনবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কত আর সহ্য হয়? ছোট লাটসাহেব প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে পদত্যাগপত্রের খসড়া তাঁর হাতে তুলে দিলেন। ফজলুল হক বলেন, বিধানসভার অধিকাংশ সভ্য ওঁকে সমর্থন করছে। তাছাড়া মন্ত্রিসভা ওঁর পৈতৃক সম্পত্তি না। ওঁর দলের লোকদের সঙ্গে আলোচনা না করে উনি কী করে পদত্যাগ করেন? ছোটলাট এসব শুনতে রাজি না। পদত্যাগপত্রে সই না করা অবধি উনি হক সাহেবকে ঘর থেকে বের হতে দিলেন না। বিধানসভায় তাঁর বিবৃতিতে বরখাস্ত প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, এই রসালাপের সময় লাট সাহেবের টেবিলের উপর একটি রিভলবার। রাখা ছিল। সেটি ব্যবহার করতে বড়কর্তা প্রস্তুত ছিলেন কি না আমাদের জানা নেই। তবে লীলাচ্ছলে সেটি নাকি মাঝে মাঝে হাতে তুলে নিচ্ছিলেন।

ইংরেজ ঘোটলাট এবং তাঁর হাতে গোনা কয়েকটি আমলা আর বেসরকারি পেয়ারের লোক মিলে কার্যত বাঙালিদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বাছা মন্ত্রিসভাকে সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধভাবে ক্ষমতাচ্যুত করলেন। ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় যুক্ত বঙ্গে স্বর্গরাজ্য নেমে আসেনি ঠিকই, কিন্তু হিন্দু এবং মুসলমান নির্বাচকমণ্ডলীর রাজনৈতিক প্রত্যাশার মধ্যে একটা সমঝোতার সম্ভাবনা হয়েছিল, সন্দেহ নেই। মধ্যবিত্ত হিন্দু আর উঠতি মধ্যবিত্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায়, হিন্দু জমিদার মহাজন আর মুসলমান রায়তের সম্পর্কে, দুর্লভ-সমাধান কিছু স্বার্থের সংঘাত ছিল ঠিকই। তার উপরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বার্থনিরপেক্ষ কিছু বিদ্বেষের বীজ ঐতিহাসিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে লালিত হচ্ছিল। এই বিদ্বেষের গতিপ্রকৃতি এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট না। কিন্তু এই সমস্যা আমরা এক দিক থেকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছি, আর বহু লোক এই বিদ্বেষকে হয় নিজেদের স্বার্থে, নয়তো নিজেরাই অন্ধ বিদ্বেষের বাহক হয়ে, শুধু বাঁচিয়ে রাখা না, নানাভাবে লালনপালন করতে যত্নবান হয়েছে। দুঃখের কথা—দু-চারজন সত্যিকার পণ্ডিত মানুষ এই খেলায় মেতেছিলেন, যদিও অধিকাংশ খেলুড়েরা সাধারণ গুন্ডাবদমাসের সমধর্মী ছাড়া অন্য কিছু না। গণতন্ত্রের খেলায় বাজি জিতে আর পাঁচটা বদমাসের মতো এরাও পঙ্কিল রাজনীতির উপরের স্তরে ভেসে উঠেছে। চরম দুঃখের কথা, বেশ কিছু শিক্ষিত বাঙালি এখন খাতায় নাম লেখানো মুসলমানবিদ্বেষীর দলে যোগ দিয়েছে। এ বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ নির্লজ্জ। আবারও বলি, এই মারাত্মক সমস্যার মূল অনুসন্ধান এখনও হয়নি।

‘৪৫ সনে ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে শেষ নির্বাচন। যুক্তবঙ্গে ছোটলাট এবং ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়াই মুসলিম লিগ নির্বাচনে জয়ী হল। নতুন প্রধানমন্ত্রী শহিদ সুরাবর্দি। ১৯৩৭-এর নির্বাচনে লিগ সারা ভারতবর্ষে অল্প সংখ্যক মুসলমানেরই সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু ‘৪৫-৪৬-এ হাওয়া সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অধিকাংশ ভারতীয় মুসলমান তখন মুসলিম লিগ এবং পাকিস্তান দাবির সমর্থক। কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশগুলিতে মুসলমানদের উপর অত্যাচার বা অবিচার হয়েছে, মুসলিম লিগের এই প্রচার হয়তো তাঁদের অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন। ‘৩৯ সনে যখন কংগ্রেস প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাগুলি থেকে পদত্যাগ করল, তখন লিগের নেতৃত্বে ‘মুক্তিদিবস’ পালন করা হয়। কংগ্রেস যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা না করায় বড়লাট লিনলিথগো জিন্না সাহেবের পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধিতা না করার পক্ষে রায় দিলেন, ফলে ওব্যাপারে ইংরেজ সরকার তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করে। যুদ্ধ শেষ হলে যখন নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু হল, তখন জঙ্গি লাট ওয়াভেল সাহেব যে নীতি অবলম্বন করেন তার অর্থ দাঁড়ায় লিগ এবং কংগ্রেস সমতুল্য প্রতিষ্ঠান। একজন বিশেষজ্ঞর মতে—জিন্না সাহেব যে পাকিস্তানকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে পরিকল্পনা করেন, তা ওয়াভেলের নীতিরই ফল। প্রথমে ওঁর উদ্দেশ্য ছিল–মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলি ভারতবর্ষের ভিতরেই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বলে স্বীকৃত হবে। যুদ্ধ শেষ হলে ইংল্যান্ডে শ্রমিক দল ক্ষমতায় এল। মন্ত্রিসভার তিন প্রতিনিধি ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব নিয়ে ভারতবর্ষে এলেন। পুরনো পাকিস্তান প্রস্তাবই কেটেছেটে স্বাধীন ভারতের মানচিত্র তৈরি হল। জিন্না বললেন, মথ-ইটন পাকিস্তান। পোকায় খাওয়া পাকিস্তান। হোক পোকায় খাওয়া, তবু তো পাকিস্তান! কায়েদ-ই-আজম নিমরাজি হয়ে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে নিলেন। দিল্লিতে সাংবিধানিক সভা-কনস্টিটুয়েস্ট অ্যাসেম্বলি বসল। শাসনভার ‘অন্তর্বর্তী সরকার’-এর হাতে। লিগ আর কংগ্রেস এবং অন্যান্য দলের প্রতিনিধি নিয়ে মন্ত্রিসভা। কিন্তু ব্যবস্থাটা নেহাতই নড়বড়ে। এ হ্যাঁ বলে তো ও না বলবেই। এভাবে যে রাজ্য চলতে পারে না তা বুঝতে কারও বাকি নেই। ইতিমধ্যে এক কাণ্ড ঘটল। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে নেহরুজি বললেন—সাংবিধানিক সভা সার্বভৌম। কোনও রকম শর্তাধীন নয়। ব্যস। জিন্না সাহেব বললেন, এদের রম দেখ। ইংরেজ এখনও যায়নি আর এরা এখনই বলছে এরা কোনও শর্তাধীন নয়। তার মানে ক্যাবিনেট মিশনের যে প্রস্তাব এরা মেনে নিয়েছে, সে অনুযায়ী চলতে এরা বাধ্য নয়। এই যাদের মতিগতি তাদের বিশ্বাস করা চলে না। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে পাকিস্তান ছিনিয়ে নেওয়া ছাড়া নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করা হল।

সেই বিভীষিকার কাহিনি বলার আগে ওই উত্তাল দিনগুলির কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি। ‘৪৬-এর ফেব্রুয়ারি মাস কলকাতার ছাত্র সমাজের দুঃখের দিন, কিন্তু সুখের দিনও বটে। আই, এন, এ. এবং রশিদ আলি দিবসে ধর্মতলার পথে অতগুলি ছেলে সত্যিতে অকারণে খুন হল—এ কথা ভোলবার নয়। কিন্তু এই অর্থহীন রক্তমানে আমরা অর্বাচীনরা এক ক্ষীণ আশার আলো দেখেছিলাম। ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের প্রতীক তিন পতাকার ঘনিষ্ঠ সহাবস্থানের দৃশ্যটা আমাদের বিভ্রান্ত করেছিল। আমরা কল্পনা করতে পারিনি যে যারা সেদিন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করেছে ছ’ মাস পরে তারাই নির্দ্বিধায় পরস্পরের বুকে ছুরি বসাতে পারে। তা ছাড়া তখন নিত্যনতুন দারুণ উত্তেজনার সব ঘটনা ঘটছে। স্বাধীনতা যে ঘরের দুয়ারে এ বিষয়ে এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। দিল্লি শহরে সাংবিধানিক সভা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের খসড়া তৈরি করছে। রাষ্ট্রক্ষমতা কার্যত জনপ্রিয় নেতাদের হাতে। শুধু নামে ছাড়া সব অর্থেই দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কিন্তু ইংরেজ চলে যাওয়ার পর রাষ্ট্রব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের মধ্যে সমঝোতা হয়েও হচ্ছে না। ইতিমধ্যে জিন্না সাহেব প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন। সে সংগ্রাম কী রূপ নেবে কারও জানা নেই। মরিয়া হয়ে ইংরেজ সরকার রাজার সম্পর্কে খুড়ো মাউন্টব্যাটেন সাহেবকে ভারতবর্ষের ভাইসরয় করে পাঠিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন—আগস্ট ‘৪৮-এর মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা হবে-কংগ্রেস-লিগ সমঝোতা হোক চাই না হোক। অবস্থা কতকটা সেই রূপকথার মতোকন্যাদায়গ্রস্ত রাজা সকালবেলা উঠে যার মুখ দেখবেন তার হাতেই কন্যা সম্প্রদান করবেন।

তখন শীত প্রায় শেষ হয়ে এসে বসন্তের হাওয়া দিচ্ছে। পিসেমশায় কিরণশঙ্করবাবু একদিন ডেকে বললেন, “আমাদের সঙ্গে দিল্লি চল। কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বৈঠক চলছে। দেশ স্বাধীন হবে। এই বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা রঙ্গমঞ্চের কাছাকাছি বসে দেখবি চল। ইতিহাসের ছাত্র হয়ে এই সুযোগ ছাড়িস না।” তল্পিতল্পা বেঁধে, ওঁদের সঙ্গে দিল্লি চলোম। এর অল্পদিন আগে একবার দিল্লি গিয়েছিলাম—ইসলামের ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পাঠান-মুঘল যুগের পুরাকীর্তি দেখতে। সে কথা পরে লিখছি। সেবার নতুন দিল্লি দেখিনি বললেই চলে। এবার যে-শহর কাছে থেকে দেখলাম, সে শহর আসন্ন স্বাধীনতার যুগের ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী। অপর পক্ষে সেই শহর বিদেশি শাসকের স্পর্ধিত জয়স্কন্ধাবার। ‘৪৬ সনের কলকাতা বর্তমান কলকাতার তুলনায় প্রায় স্বর্গপুরী ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ইংরেজের তৈরি এই শহর তখনই অনেকটা জরাজীর্ণ। নতুন দিল্লির রোয়াব তার কোথায়? বাঙালের হাইকোর্ট দেখার মতো নয়া দিল্লি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। অমলকে চিঠি লিখি, “দিল্লি দেখে আমি হতবাক। ভবিষ্যতে এখানে কাজ করার সুযোগ পেলে খুশি হব।” সেই সুযোগ ঠিকই এসেছিল। কর্মজীবনে পনেরো বছর দিল্লি বাস করতে হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতাটা খুব সুখের হয়নি। জীবনে তিন-চারবার এই ধরনের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে : নেহাতই কথার কথা ভাবে একটা কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করেছি, কখনও অল্পদিনের মধ্যে, কখনও বা অনেকদিন পরে সেই ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছে। দু-তিনবার হওয়ার পর এ বিষয়ে আমার প্রায় একটা কুসংস্কার জন্মে যায়। এই প্রসঙ্গে আমার বিখ্যাত ইংরেজি ছোটগল্প ‘মাংকি’স প’ মনে পড়ত। মনে হত-সব ইচ্ছা পূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয় না, কারণ ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারে কোথায় কী অলিখিত শর্ত লেখা থাকে তা আমাদের জানা নেই। পাঠিকা/পাঠক আশা করি এই কথাটা আপনারা আক্ষরিক অর্থে নেবেন না।

কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য হিসাবে শরৎ বসু দিল্লির ক্যানিং লেনে একটা সরকারি বাংলো পেয়েছিলেন। ‘৪৬ সনে পিসেমশায় ওই বাড়িটিতে উঠেছিলেন। নয়া দিল্লির প্রশস্ত ঝকঝকে রাস্তা, ছিমছাম সরকারি বাংলো, চারিদিকে মুঘল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দম্ভভরা সব পূর্তকীর্তি, ক্ষমতা লাভের সম্ভাবনায় শহরময় একটা চাপা উত্তেজনা—সব মিলিয়ে দিল্লির আকাশ-বাতাসে তখন একটা মাদকতার স্বাদ পেয়েছিলাম। সেই সময় দিয়ে প্রকাশিত ‘যাযাবর’-এর বিখ্যাত বইটি দিল্লির রোমান্টিক সম্ভাবনা যেন আরও উজ্জ্বল করে তোলে। উত্তেজনায় পরিপূর্ণ দিল্লিতে একটি দিনের দৃশ্য বেশ মনে পরে। কনট প্লেসের উপর চা-খাওয়ার বিখ্যাত জায়গা ডেভিকো। বিকেলে চায়ের সময় সেখানে সাহেব মেমদের চিত্তবিনোদনের জন্য ব্যান্ড বাজত। একদিন বিকেলে ওখানে চা খেতে গিয়েছি। দেখলাম একটু উঁচু পাটাতনের উপর বড় একটি টেবিলের চারপাশে অসাধারণ রূপবান/রূপবতী মধ্যবয়স্ক কিছু স্ত্রী-পুরুষ একত্র বসে চা খাচ্ছেন। বেশ চোখ ঝলসানো সব চেহারা। যিনি আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি গলা নামিয়ে বললেন, “শহরে মুসলিম লিগের কর্ম সমিতির মিটিং চলছে। এঁরা সব তার সভ্য-সভ্যা অথবা সভ্যদের স্ত্রী।” বেশ নিলজ্জভাবেই সেই রূপের হাট অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। এক জিন্না সাহেব ছাড়া লিগের প্রথম শ্রেণির সব নেতাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

সেবারকার দিল্লিবাসের সব চেয়ে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা ঘনিষ্ঠ পরিবেশে জাতির পিতা মহাত্মা গাঁধীর দর্শনলাভ। একদিন সকালবেলা পিসেমশায় বললেন, “গাঁধীজির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। তুইও আমার সঙ্গে চল।” হঠাৎ এইরকম সৌভাগ্য হবে এ আমার কল্পনার অতীত। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে গাঁধী-সন্দর্শন করতে রওনা হলাম।

মহাত্মা তখন ভাঙ্গি কলোনিতে বাস করছিলেন। ছোট একটি ঘর। সেখানে আসবাবপত্র বলতে প্রায় কিছুই নেই। ঘরটি যে ভাঙ্গি কলোনিরই, আলাদা করে গাঁধীজির জন্য তৈরি নয় সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। তফাত শুধু এক ব্যাপারে : ঝকঝকে পরিষ্কার। মেঝের উপর হালকা একটি গদি, সাদা খদ্দরের কাপড়ে ঢাকা। ঘরটিতে কোনও দরজা নেই, শুধু খসখসের একটি টাটি ঝুলছে, তার সুগন্ধে ঘরটি ভরে আছে। মহাত্মা পা মুড়ে—যে-ভঙ্গিতে অনেক ছবিতেই ওঁকে দেখা যায়, গদির উপর বসে আছেন। পাশে একটি তাকিয়া। মানুষটির চেহারায় যা দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম সে হচ্ছে তাঁর প্রায় চকচকে মসৃণ ত্বক—কোথাও একটি ভাঁজ পড়েনি। তখন ওঁর বয়স প্রায় আশি ছুঁয়েছে। আর একটি জিনিস দেখে বেশ মজা পেয়েছিলাম। সম্পূর্ণ আড়ম্বরহীন এবং আসবাবহীন ঘরটিতে তাকের উপর শুধু একটি প্রসাধন দ্রব্য রয়েছে। সেটি হচ্ছে একটি পন্ডস ক্রিমের ডিব্বা। মনে মনে ভাবলাম স্বদেশির প্রবক্তা বিলাসবিমুখ জাতির পিতা কি পন্ডস ক্রিম মাখেন, না ডিব্বাটিতে গুজরাটিদের প্রিয় কোনও মুখশুদ্ধি রয়েছে। এই প্রসঙ্গে দিল্লিতে শোনা উর্দু কবি ফেরাখের নামে চালু একটি কাহিনি মনে পড়ছে। ফেরাখ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছুদিন সবরমতী আশ্রমে বাস করেন। সেখানে রোজকার খাদ্য চাপাটি আর নিমপাতা বাটা। হুইস্কি পানে অভ্যস্ত কবি নিমপাতার তেতো স্বাদ খুশি মনেই গ্রহণ করেন। একদিন তিনি বাপুর কাছে তাঁর এই অপ্রত্যাশিত তৃপ্তির ব্যাপারটা নিবেদন করলেন, “বাপ, এটা তো বেশ খেতে।”চমকে উঠে মহাত্মার প্রশ্ন, “ওটা তোমার খেতে ভাল লাগছে?” “হাঁ বাপুজি, বেশক।” “তা হলে ওটা খাওয়া বন্ধ করো। আহারের উদ্দেশ্য দেহধারণ, ইন্দ্রিয়তৃপ্তি না।”

গাঁধীজির সঙ্গে কিরণশঙ্করবাবুর কোনও গোপনীয় আলোচনা ছিল না, থাকলে আমার সেদিন গাঁধীদর্শন হত না। ওঁদের কথাবার্তার মাঝে মাঝে অন্য লোকজনও যাওয়াআসা করছিলেন। নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাঙালি হিন্দুর স্বার্থরক্ষা কীভাবে সম্ভব এ নিয়ে কিরণশঙ্করবাবু কিছু প্রশ্ন তোলেন। এর মধ্যে প্রবীণ বিপ্লবী মধু (সুরেন) ঘোষ এসে বসলেন। যত দূর বুঝলাম—ওঁর মতে প্রয়োজন হলে সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। গাঁধীজি হেসে বললেন, “মধুবাবু, তোমাদের পুরনো অভ্যেস গেল না! সশস্ত্র প্রতিরোধের পথে তোমরা কি সুফল পেয়েছিলে? এ বিষয়ে আমার মতামত তো তোমাদের জানা। আমার নতুন কিছু বলার নেই। সত্যিই যদি গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তবে প্রতিরোধের উপায় সশস্ত্র সংগ্রাম না, অহিংস সত্যাগ্রহ।” ওঁকে প্রণাম করে চলে এলাম। দেখলাম নেহরুজির মতো ওঁর প্রণামে আপত্তি নেই। প্রথম জ্ঞান হওয়া অবধি যে-মানুষটির কথা শুনে এসেছি, তাঁর চরণ স্পর্শ করে নিজেকে ধন্য মনে হল। আমাদের নাস্তিক পরিবারে ঈশ্বরের স্থান উনিই গ্রহণ করেছিলেন।

.

জিন্না সাহেব প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান দেওয়ার পর কলকাতা শহরের আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। ১৬ আগস্ট যখন প্রায় এসে গেছে, তখন শোনা গেল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রথম রণস্থল হবে কলকাতা শহর। এই অসামান্য সম্মান কলকাতার ভাগ্যে কেন জুটল, তা নিয়ে মতভেদ আছে। যাঁদের ধারণা, মুসলিম লিগ সংগ্রাম বলতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথাই চিন্তা করেছিল, তাঁরা বলতেন যে, ওই সময় এক যুক্তবঙ্গেই নিরঙ্কুশ লিগ রাজত্ব। সুতরাং সরকারি আওতায় দাঙ্গা করার এমন সুবিধা আর কোথাও হবে না। অপর পক্ষে ভারতবর্ষে রয়ে গেছেন এ রকম কিছু প্রগতিশীল মুসলমানদের মুখে শুনেছি যে, তাঁদের সপরিবারে ময়দানের সভায় যেতে বলা হয়েছিল এবং অনেকে তাই গিয়েছিলেন। যদি দাঙ্গা বাঁধানোর মতলব নিয়েই লিগ মন্ত্রিসভা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালনে উদ্যোগী হয়ে থাকে, তা হলে কি তারা মুসলমান মেয়ে এবং বালক বালিকাদের জীবন বিপন্ন করত? ময়দানের সভা শেষ হবার আগেই জোর দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। হিন্দুদের মধ্যে অনেকেরই বিশ্বাস সরওয়ার্দি সাহেবের আশ্রয়ে মুসলিম লিগ দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। তেমনি অনেক মুসলমান বলতেন–হিন্দুরাই তাদের উপর হামলা করার জন্য অনেকদিন ধরে তৈরি হচ্ছিল। না হলে ময়দানের সভা থেকে মুসলমানরা যখন ফিরছে তখন হাওড়া পুলের উপর তারা সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হল কী করে?

যা হোক, আগস্ট মাসের গোড়া থেকেই শহরে নানা গুজব ছড়াতে থাকে। দাঙ্গা নাকি হবেই। শোনা গেল লিগের পক্ষ থেকে গুন্ডাদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। কোনও কোনও অঞ্চলে হিন্দুদের বাড়ি আক্রমণের জন্য নির্দেশ দিয়ে হ্যান্ডবিল বিলি হয়েছে। রাজাবাজার এবং অন্যান্য মুসলমানপ্রধান পাড়ায় রোজ সন্ধ্যায় নাকি ট্রাকে করে লিগের। প্রচারকরা দাঙ্গা করার জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু অস্ত্রশস্ত্রও বিলি হয়েছে। এইসব গুজব নিয়ে কলকাতার রক এবং চায়ের দোকানের আড্ডা তখন সরগরম ঠিকই, লোকের মুখে প্রায় অন্য কোনও কথা নেই, কিন্তু একটা কারণে আমার ধারণা যে, হুজুগপ্রিয় কলকাতাবাসী তাদের নিজেদেরই ছড়ানো গুজব খুব একটা বিশ্বাস করেনি।

আমার এই ধারণার প্রধান কারণ-দাঙ্গা বাধার আগে কলকাতাবাসী হিন্দু-মুসলমান কেউই নিজের বাসস্থান ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। সকলেই জানেন শহর কলকাতার আবাসনে একটা বিশেষ ছক আছে। মুসলমানপ্রধান অঞ্চলগুলিতে অল্প কিছু হিন্দু এবং হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে সামান্য সংখ্যায় মুসলমানের বাস। যে কলকাতাবাসীরা জাপানি বোমার আশঙ্কায় প্রায় মুক্তকচ্ছ হয়ে মফস্বলে পালিয়েছিল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা করলে তারা যে নিশ্চিন্তে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে—এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। আর মন্ত্রিসভার আওতায় মুসলিম লিগ যদি ব্যাপক দাঙ্গার পরিকল্পনা করে থাকে, তো সে কথা রাজনীতির উপরমহলের লোকেরও জানা ছিল না। কিরণশঙ্কর রায়ের বড় মেয়ে এবং জামাই ক্রিস্টোফার লেনের একটি বাড়িতে থাকতেন। তার চারপাশে অত্যন্ত দরিদ্র অবাঙালি মুসলমানদের বাস। পিসেমশায় দাঙ্গা বাধার পর মেয়ে-জামাইয়ের খবর নিতে গিয়ে দেখেন আততায়ীরা বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়েছে। জামাইকে ছোরা মেরে কোলের ছেলেটাকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছে। উনি যদি ঘুণাক্ষরেও আশঙ্কা করতেন যে, এই রকম ঘটার সম্ভাবনা আছে, তা হলে মেয়ে-জামাইকে ওইভাবে বিপদের মধ্যে ফেলে রাখতেন না। সিমলে পাড়ায় বিবেকানন্দ রোডে একটি মুসলমান মেয়েদের হস্টেল ছিলনাম মুন্নুজান হল। ওখানে স্নাতকোত্তর বিভাগের মুসলমান ছাত্রীরা থাকতেন। অধিকাংশই বেশ বড় ঘরের মেয়ে। লিগের কর্তৃস্থানীয়দের সঙ্গে এঁদের সব পরিবারেরই ভাল জানাশুনো ছিল। ওই মহিলারাও প্রায় সবাই দাঙ্গার দিন হস্টেলেই ছিলেন–মুসলমানপ্রধান পাড়ায় আত্মীয়স্বজনের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাননি।

লিগ সরকারের কুমতলবের প্রমাণস্বরূপ বলা হয় যে, দাঙ্গা শুরু হওয়ার অল্প কদিন আগে সুরাবর্দি সাহেব কলকাতার পুলিশি ব্যবস্থা আগাগোড়া বদলে দেন। এ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁরা কিন্তু প্রচলিত গুজবের সপক্ষে কিছু লেখেননি। লেখার অসুবিধেও আছে। এ সময়কার পুলিশ দফতরের কাগজপত্র সত্যিতে এখনও গবেষকের কাছে অধিগম্য নয়। আর যদি আপত্তিজনক কোনও আদেশ দেওয়া হয়ে থাকে, তার নজির রেখে দেওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে পুলিশি কাগজপত্র গবেষকদের দেখতে দেওয়া হলে হঠাৎ লিগের পেয়ারের লোকদের মোক্ষম সব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এ কথা সত্যি কি না তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ হতে পারে। তবে কলকাতার পুলিশে হঠাৎ উঁচু পদে দুই মুসলমান কর্মচারীকে বহাল করা হয়—এ কথা অনেকেরই মনে আছে।

দাঙ্গা যেদিন শুরু হয় সেদিনকার অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে অন্যত্র লিখেছি। এখানে ঘটনাবলির আর একটু বিবরণ দেব। মানিকতলা বাজারের প্রায় উলটো দিকে বিডন স্ট্রিটের উপর আমাদের হস্টেল। পাড়ার বাসিন্দা প্রায় সবাই বাঙালি হিন্দু। শুধু হস্টেলের সামনে এক সারি দোকানের পিছনকার বস্তিতে কিছু ফিরিওয়ালা শ্রেণির গরিব বিহারি আর উত্তরপ্রদেশের লোকের বাস। আর আমাদের পাঁচমিশালি হস্টেলের বাবুর্চি খিদমতগার সবাই বিহারি মুসলমান। আমাদের পাড়ায় কোনও গোলমালের আশঙ্কা আছে এমন আমাদের মনে হয়নি।

সকাল ন’টা নাগাদ সার্কুলার রোডের বস্তি থেকে হতদরিদ্র কিছু মুসলমান লিগের ঝান্ডা হাতে স্লোগান দিতে দিতে বিডন স্ট্রিটে ঢোকে এবং মোড়ের মিঠাইয়ের দোকানটি লুঠ করে। পরে শুনি, কলকাতায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে এটাই নাকি প্রথম ঘটনা।

ব্যাপারটা পূর্বপরিকল্পিত মনে হয় না। জলুশধারীরা মিঠাই লুঠ এবং লুষ্ঠিত মিঠাই ভক্ষণ ছাড়া আর কোনও হিংসাত্মক কাজ করেনি বলেই আমার ধারণা। তার পরই পালা জমে উঠল। আমাদের হস্টেলের এক মুসলমান আবাসিক এসে খবর দিলেন—অবস্থা ভাল নয়। তিনি রাজাবাজারের ভিতর দিয়ে পায়ে হেঁটে এসেছেন। উনি স্বচক্ষে দেখেছেন–ওখানকার কসাইরা বড় বড় ছুরি আর দায়ে শান দিচ্ছে। ওঁর পরনে ধুতি থাকায় ওঁর দিকে সবাই বিষদৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, তবে কেউ আক্রমণ বা পরিচয় জিজ্ঞাসা করেনি। এখানে বলিদাসা ভালমতো শুরু হওয়ার পর মুসলমান পাড়ায় ধুতি অথবা হিন্দু পাড়ায় লুঙ্গি পাজামা পরে ঢোকার কথা কেউ আর চিন্তা করতে পারত না। আবাসিকটি এই খবর আনার অল্পক্ষণ পরেই নানা গুজবে হস্টেলের আবহাওয়া গরম হয়ে উঠল। রাজাবাজার, কলুটোলা, পার্ক সার্কাসে নাকি হাজার হাজার হিন্দু খুন হয়েছে। কত হিন্দু মেয়ে যে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত হয়েছে তার সীমাসংখ্যা নেই। একজন কোথা থেকে একটা চোথা খবরের কাগজ নিয়ে এল। যার নাম আগে বিশেষ শুনিনি। লোমহর্ষক সব কাহিনিতে ভরা ওই কাগজটির বিক্রি নাকি তিন দিনে বেশ কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবং তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী সম্পাদকটি শুনেছি সমস্ত কাগজখানা নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসে লিখতেন। বাইরে বের হওয়া তখন নিরাপদ ছিল না। আর দাঙ্গার আগে ওই কাগজটির যা বিক্রি তাতে সম্পাদক ছাড়া অন্য কোনও কর্মচারী রাখার মতো সামর্থ্য বা প্রয়োজন হয়েছে এমন মনে হয় না। এখন ওই বিরল প্রতিভাটি সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে কলকাতার কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ওই বজ্জাতের মনোভূমি কলকাতার রাস্তার চেয়ে দাঙ্গার জন্মস্থান হিসাবে সত্যের আকর হয়ে উঠল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাতারাতি ওই চোথা পত্রিকাটি স্মৃতিশ্রুতির স্থান অধিকার করল। শহরের সর্বত্র কী ঘটছে না ঘটছে তা ওই অশ্লীল নির্জলা মিথ্যা কথায় ভরা প্রকাশনটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে সবাই আলোচনা করতে লাগল। যদি প্রশ্ন করা হত—এসব যে সত্যি তা তোমরা কী করে জানলে, তাহলে লোকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিত। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, কয়েক দশক ধরে বিপ্লব বা গণসংঘর্ষে গুজবের অবদান নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। যুক্তবঙ্গে দাঙ্গার ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাস ‘৪৬ সনের ঘটনায় গুজবের অবদান নিয়ে কিছুটা বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু ওই বিষাক্ত পত্রিকাটির কোনও কপি এখন আর পাওয়া যায় না। নগণ্য একটি প্রকাশন মিথ্যা প্রচারের মারফত কত অনিষ্ট করতে পারে, বাঙালির দুর্ভাগ্যের বিবরণীতে সে ইতিহাস অলিখিত রয়ে গেল।

গুজবের সুফল কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বচক্ষে দেখতে হল। ন-দশ বছর বয়সি একটি মুসলমান ছেলে আমাদের পাড়ায় আম বিক্রি করতে আসত। সেদিনও একটু বেলা হলে ঝাঁকা মাথায় করে ছেলেটি এল। হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনলাম “মোছলমান! মোছলমান!” তারপর দৌড়োদৗড়ির আওয়াজ। হস্টেলের বারান্দায় গিয়ে দেখি রাস্তায় ছোটখাটো একটি ভিড় জমেছে। তার মধ্যে বাঙালি ভদ্রলোক’ই সংখ্যায় বেশি। কিছু দরিদ্র বস্তিবাসীও আছে। সকলেরই হাতে লাঠিসোটা। একটা আর্ত চিৎকার কানে এল। তারপর সব চুপ। লাঠি হস্তে বীরবৃন্দ তখন পলায়নতৎপর। দেখলাম রোগা ছেলেটার অর্ধাহারক্লিষ্ট রক্তাক্ত শরীরটা রাস্তায় কুঁকড়ে পড়ে আছে। হিন্দু জাতি এবং কৃষ্টির সম্মান রক্ষা হয়েছে দেখে বড় গর্বিত বোধ করলাম। তাছাড়া শিক্ষিত বাঙালির মহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথাটাও ভুললে চলবে না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি বলে কথা!

ওই ছেলেটা আমাদের হস্টেলেও আম বেচতে আসত। মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে কথা হত। বিধবা মাকে নিয়ে ও কলকাতার দক্ষিণে শহরতলির এক বস্তিতে থাকত। ওর রোজগারেই মা-ছেলের আহার জুটত। প্রতিবন্ধী মায়ের বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছু রোজগার করার মতো ক্ষমতা ছিল না। সহায়সম্বলহীন ওসমানের কিন্তু উচ্চাশার অভাব ছিল না। একটু পয়সা জমাতে পারলেই ও নাকি গড়িয়াহাটের বাজারে একটা ফল-তরকারির দোকান খুলবে। ওর আরও একটা উচ্চাশা ছিল। মাঝে মাঝে ও আমাদের গান শোনাত। লাজুক লাজুক মুখে বলত, যখন একটু পয়সা হবে তখন ওর ইচ্ছা মাস্টার রেখে গান শিখবে। অবিনাশী আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না। করলে বলতাম, যদি নিষ্পাপ অসহায় মানুষের জন্য ঈশ্বর নামক কোনও সত্তা স্বর্গ বা বেহেস্তের বন্দোবস্ত করে থাকেন, তা হলে আমার সহায়-সম্বলহীন ছোট ভাই ওসমানের জন্য সেখানে যেন একটা ফল-তরকারির দোকান খুলে দেন। আর যেন কোনও দেবদূত ওকে গান শেখায় তারও ব্যবস্থা করেন। আর ওসমান, নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত তোমার অমানুষ এই দাদাটি, তোমাকে বাঁচাবার কোনও চেষ্টা করেনি। পারো তো তুমি তাকে ক্ষমা কোরো। তোমাকে যে কথা দিয়েছিলাম তোমার গান শেখার খরচটা আমি দেব, সেই প্রতিশ্রুতি রাখার তো আর পথ রইল না।

দিন যতই গড়াতে লাগল গুজবে গুজবে হাওয়া ক্রমেই গরম হয়ে উঠল। বিকেল নাগাদ নতুন এক রাজনৈতিক থিসিস কানে এল, ‘অফেনস ইজ দা বেস্ট মিনস অফ ডিফেন্স’অর্থাৎ “হে হিন্দু সন্তানগণ, খরকরবাল হাতে নিয়ে এবার তোমরা যবননিধনের জন্য প্রস্তুত হও।” হস্টেলের স্পোর্টস রুম থেকে সব হকি স্টিক বের হয়ে এল। দু-চারটে বন্দুক, কিছু গোলাগুলিও অজ্ঞাত কোনও উৎস থেকে সংগৃহীত হল। কোথা থেকে যেন বেশ কয়েক টিন কেরোসিন জোগাড় হয়েছে দেখলাম। সংগ্রামী পুরুষদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বামপন্থী ছাত্রও আছে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। অন্য সকলের সঙ্গে কোনও আলোচনা তখন আর সম্ভব না। তাই আগ্রাসী হিন্দু বনে যাওয়া বামপন্থীদেরই শুধু প্রশ্ন করিনীতির কথা ছেড়ে দিলেও তারা যা করতে যাচ্ছে তাতে কার কী লাভ হবে। উত্তর পেলাম মুসলমান খুন হচ্ছে এই খবর যথাস্থানে পৌঁছলে হিন্দু হত্যা বন্ধ হবে। বললাম—হিন্দু হত্যার খবর বা গুজব যথাস্থানে পৌঁছনোর ফলে তো তোমরা মুসলমান মারার জন্য। উদ্যোগী হয়েছ। মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া তোমাদের থেকে ভিন্ন হবে মনে করছ কেন? উত্তর—এখন কাজের সময়। বাজে কথা শোনার তাদের অবসর নেই।

অন্ধকার একটু ঘন হওয়ার পর আসল কাজ শুরু হল। বেশ ভাল করে খাওয়াদাওয়া সেরে বীরবৃন্দ রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। হাতে কেরোসিনের টিন এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র। ভাবলাম আমাদের পাড়ায় তো মুসলমান নেই। তবে বীরকৃত্যটা এঁরা কোথায় করবেন? পার্ক সার্কাস বা রাজাবাজার অভিযান করে শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলা হবে? না, না! অকারণ ঝক্তি নেওয়ার লোক এরা না। আর একটু রাত বাড়লে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি তুলে সশস্ত্র যোদ্ধারা সার্কুলার রোড পার হয়ে রাস্তার পাশের মুসলমান বস্তি আক্রমণ করলেন। ওখানকার হতদরিদ্র বাসিন্দারা কোনও হিন্দুকে হত্যা করেনি অথবা কোনও হিন্দু নারীকে লাঞ্ছনা করেনি। দুষ্কর্মের মধ্যে তাদের কেউ কেউ সকালবেলার মিষ্টান্ন লুণ্ঠনে শরিক হয়েছিল। কাজটা গর্হিত সন্দেহ নেই কিন্তু তার জন্য প্রাণদণ্ডটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।

আমার চেনা হিন্দু বীরবৃন্দ কওমের সেবায় কী মহৎ কর্ম করেছিলেন তা আমার সঠিক জানা নেই। কিন্তু তাঁরা যখন বীরকৃত্য সেরে ফিরে এলেন, তখন তাঁদের মুখভাবে উদ্দীপ্ত গৌরবের কোনও লক্ষণ দেখিনি। বরং তাঁদের দেখে যে-প্রাণীটির কথা মনে এসেছিল সে পশুরাজ সিংহ না, গৃহস্থের তাড়া খাওয়া লেজ গুটিয়ে পলায়মান রাস্তার কুকুর। প্রত্যক্ষদর্শীর লেখা কলকাতার দাঙ্গার বিবরণ বেশি পড়িনি। তাই ওই দুঃসময়ের মানবিক অভিজ্ঞতার দিকটা বর্ণনা করা প্রয়োজন মনে করি। অন্যত্রও লিখেছি—আমার ধারণা, ৪৬ সনে কলকাতা শহরে দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় তা বিশেষ ঘটেনি। দুই দল ক্ষিপ্ত মানুষ পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করছে, এ দৃশ্য যতই বেদনাদায়ক হোক, মানুষের ইতিহাসে সংঘাত অপরিহার্য জেনে ওই দৃশ্যে কোথায় যেন একটু মনুষ্যত্বের তলানি পাওয়া যায়। কিন্তু কলকাতার রাস্তায় যা ঘটেছিল তার ভিতর মনুষ্যোচিত কোনও ব্যবহারের লক্ষণ দেখা যায়নি। বিবেকবর্জিত কিছু দ্বিপদ সম্পূর্ণ অসহায় কিছু নারী-পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হিন্দু পাড়ায় মুসলমান আর মুসলমান পাড়ায় হিন্দু নরনারী-শিশু কোলে-আম নীতির শিকার হয়। প্রতিরোধের প্রশ্ন প্রায় কোথাওই ওঠেনি।

এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলি। আমরা, বিশেষত ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা, অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ভিয়েতনামে আর ইরাকে মার্কিনরা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানরা কী করেছে তা আলোচনা করে ধিক্কার দিই, কিন্তু নিজেদের দেশে আমাদেরই আপনজনেরা অন্য ধর্মী স্বজাতীয় মানুষের উপর কী বীভৎস অত্যাচার করেছে, তা নিয়ে হিন্দু বা মুসলমান কাউকেই কখনও নতমস্তকে অপরাধ স্বীকার করতে দেখিনি। ওই পাশবিক কাজগুলির জন্য যেন আমাদের কোনও দায়িত্ব নেই। সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য ইংরেজ যে-বীভৎসতার আশ্রয় নিয়েছে তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করি। কিন্তু আমাদের করা বিচিত্র কুকর্মের জন্য আমাদের কোনও লজ্জা নেই। দেশভাগের সময় পশ্চিম ভারতে যেসব অমানবিক ঘটনা ঘটে, তার ইতিহাস সম্প্রতি লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। আমরা, সংস্কৃতিবান বাঙালিরা, কী করেছি, আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনে উত্তরপুরুষকে তা জানানো প্রয়োজন।

নিজের চোখে দেখা ঘটনার বিবরণে ফিরে যাই। হস্টেলের বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম রাস্তার ওপারে আগুন জ্বলছে। বুঝলাম ব্যাপারটা আমার চেনা মহাপুরুষদেরই মহান কীর্তি। হস্টেলের ছাদে উঠে দেখলাম—আগুন শুধু আমাদের পাড়ায় না, যত দূর চোখ যায় সর্বত্র আকাশ লালে লাল। তিন দিন তিন রাত কলকাতার পথে ঘাটে নিরবচ্ছিন্ন পিশাচনৃত্য চলে। কোথাও একটি পুলিশের দেখা পাওয়া গেল না। আগুন নেভাতে কোথাও কোনও দমকল এল না। সুরাবর্দি সাহেব স্বেচ্ছায় দাঙ্গার প্রশ্রয় দিয়েছিলেন কি না জানি না। কিন্তু এই পুলিশ এবং দমকলের অন্তর্ধান কেন এবং কীভাবে হল, তার ব্যাখ্যা কেউ দেয়নি। আর যে-ছোটলাট টেবিলে রিভলবার রেখে হক সাহেবের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র আদায় করেন, তার উত্তরসাধকটি রাস্তায় ফৌজ নামাতে কেন তিন দিন সময় নিলেন, এই সময় তাঁর পেয়ারের সরকারি-বেসরকারি গোরাচাঁদরা কেন হাত গুটিয়ে বসেছিলেন, সে বিষয়েও সরকারি দলিলপত্র সম্পূর্ণ মৌন। ফিলিপস সাহেব কলকাতার ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করে বলেন, কয়েক হাজার লোক কলকাতার রাস্তায় নিহত বা অঙ্গহীন হয়েছিল। কিন্তু শুধু একটি মাত্র হত্যাকাণ্ডের আদালতে বিচার হয়। শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল বলে তিনি রায় দেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী তিন দিনে তিন হাজার স্ত্রী-পুরুষ-শিশু খুন হয়। বেসরকারি হিসাবে নিহতর সংখ্যা দশ থেকে পঞ্চাশ হাজার। সত্যিতে গণহত্যার শিকারের সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব নয়, কারণ বহু মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আর রাস্তার ম্যানহোল খুলে যেসব শরীর নীচের নর্দমায় ফেলা হয়, তারও পরিসংখ্যান সম্ভব না। মর্গে যেসব শরীর এসেছিল তারই ভিত্তিতে সরকারি হিসাবটা করা। কিন্তু ওই হিসাব সত্যিতে হতাহতের নিতান্তই সামান্য একটি অংশ, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

ওই তিন দিন কলকাতায় শাসনব্যবস্থা কি সত্যিতে ভেঙে পড়েছিল? তার পরবর্তী ঘটনাবলি বিচার করলে তা মনে হয় না। যখন ফৌজ, পুলিশ, দমকল সব রাস্তায় নামল তখন তো পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনতে কোনও সময় লাগেনি। তার মানে একটাই দাঁড়ায়। কর্তৃপক্ষ হয় ইচ্ছে করে, নয় নেহাত নির্বুদ্ধিতাবশত হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু রাস্তা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে দাঙ্গাকারীদের যথেচ্ছ খুনজখম করার পথ পরিষ্কার করা শুধু অনবধানতার ফল—এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।

দাঙ্গার প্রথম ধাক্কা থামবার পর বিপজ্জনক এলাকায় যেসব বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন ছিলেন, তাঁদের খোঁজ নিতে বের হই। প্রথমেই গেলাম মুন্নুজান হলে। ‘৪৫-এর শেষ দিকে ইসলামের ইতিহাসের ছাত্রদের সঙ্গে উত্তর ভারতে ইন্দো-মুসলিম যুগের পুরাকীর্তি দেখতে গিয়েছিলাম–ডক্টর হাবিবুল্লার সুযোগ্য নেতৃত্বে। দিল্লি, আগ্রা, ফতেপুর সিক্রি, আজমির শরিফ আমরা বেশ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখেছিলাম। হাবিবুল্লা সাহেবের অগাধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যার ফলে ওইসব পুরাকীর্তি এক নতুন আলোয় দেখতে পাই। আমাদের সঙ্গে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মুন্নুজান হলের বাসিন্দা বেশ কয়েকজন ছিলেন। এঁদের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল। এঁরা অনেকেই বংশের প্রথম মহিলা যিনি নাকি স্নাতকোত্তর বিভাগে পড়তে এসেছেন অথবা সহশিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে এঁদের চিত্ত কিছুটা টলমল ছিল, কিন্তু এঁদের আচার-ব্যবহারে কোনও রকম জড়তা অথবা প্রগলভতা কখনও নজরে আসেনি। এঁরা কেউ কেউ ছাত্র মুসলিম লিগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কোনও লক্ষণ এঁদের কথায় বা ব্যবহারে কখনও পাইনি। মুসলমানদের কিছু ন্যায্য দাবি আছে। তারই জন্য এদের লড়াই, হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষবশত না। নিরঙ্কুশ হিন্দু পাড়ার মধ্যে ওদের হস্টেল। তবে ভদ্র বাঙালি পাড়া। সুতরাং প্রথমটায় কিছু দুশ্চিন্তা করিনি। কিন্তু দাঙ্গা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালির রুচি-সংস্কৃতির যেসব নমুনা দেখলাম, তাতে সন্দেহ হল যে, মুনুজান হলবাসিনী আমার বন্ধুদের গিয়ে আর জীবিত দেখব না।

হস্টেলের কাছাকাছি পৌঁছে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে ভয়ে আমার বাক্যরোধ হল। বাড়িটার সামনে রাস্তায় কিছু ভাঙা সুটকেস আর পোড়া বইপত্র ছড়ানো। বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। ফুটপাথে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন—একটু আগে পুলিশের গাড়ি এসে মেয়েদের নিয়ে গেছে। ওঁদের জিনিসপত্র লুঠ বা পোড়ানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কারও গায়ে হাত পড়েনি।

আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হল দু-একদিন বাদে, আশুতোষ বিল্ডিংয়ে। মনে হল, ওঁদের মুখের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। কেমন একটা ভীত ত্রস্ত ভাব, রক্তহীন পাংশু চেহারা–যেন যে-বিভীষিকার মধ্যে দিয়ে ওরা গিয়েছে, তার রেশ এখনও কাটেনি। শুনলাম—১৬ই বেলা এগারোটা নাগাদ একদল সশস্ত্র লোক হঠাৎ হুড়মুড় করে হস্টেলে ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা অশ্রাব্য গালিগালাজ করে যার মূল বক্তব্য-মুসলমান স্ত্রীলোক আর রাস্তার গণিকার মধ্যে কোনও তফাত নেই। তারপর বাক্সপ্যাটরা বইপত্র সব রাস্তায় টেনে নামানো হয়। গায়ে হাত দেওয়ার শুভ চেষ্টা হয়নি তা নয়, তবে সেটা নাকি বন্ধ হয় কিছু বস্তিবাসীর হস্তক্ষেপের ফলে। আমার বিশিষ্ট বন্ধু হাজেরা আরও একটা কথা বললেন। হামলাকারীরা অধিকাংশই ছিলেন ভদ্ৰশ্রেণির মানুষ এবং তাঁদের কেউ কেউ ওঁদের বিশেষ পরিচিত, পাড়ার দাদা। হাজেরা হিন্দু ভদ্রলোক নামক প্রাণীর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। ওঁর সঙ্গে স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক আর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়নি।

ক্রমে ক্রমে আরও সব বীভৎসতার কাহিনি এল। রাজাবাজারে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট হস্টেলের ছ’টি ছেলে খুন হয়েছে শুনলাম। একজন ক্ষতবিক্ষত হয়েও বেঁচে ছিল। আমার পিসতুতো দিদির বাড়িতে আক্রমণের কথা আগেই লিখেছি। নানা খুনজখম বলাৎকারের কাহিনি চারিদিক থেকে আসতে থাকে। তার কিছু সত্যি, অধিকাংশই মিথ্যা। বীভৎস সব কাহিনি রটিয়ে কিছু লোক এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পায়। তার চেয়েও অবাক হলাম যখন দেখলাম কয়েকজন তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত লোক মুসলমানদের উপর নানা অত্যাচারের সত্যি বা কল্পিত কাহিনি বলে বা শুনে বিশেষ আনন্দ পাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে দু-তিনজন রীতিমতো বিখ্যাত লোক। প্রয়াত এক পণ্ডিত ব্যক্তি, যাঁর নাম শুনলে অনেক নিষ্ঠাবান হিন্দু এখনও যুক্তকরে প্রণাম জানায়, তাঁকে এবং সমবেত অধ্যাপকদের কাছে নিকাশিপাড়ার মুসলমান বস্তি পোড়ানোর কাহিনি বলা হচ্ছিল। যিনি বলছিলেন তিনি প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিশ্বাসযোগ্য লোক। বেড়া আগুন দিয়ে বস্তিবাসীদের পুড়িয়ে মারা হয়। একজনও নাকি পালাতে পারেনি। ছেলেটি বলছিল কয়েকটি শিশুকে আগুনের বেড়া টপকে তাদের মায়েরা আক্রমণকারীদের হাতে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যাতে ওদের প্রাণগুলি বাঁচে। বাচ্চাগুলিকে নির্দ্বিধায় আবার আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। আমরা শুনেছিলাম, এই কুকীর্তির নায়ক কিছু বিহারি কালোয়ার। তাই ভয়াবহ বর্ণনাটি শুনে সুশোভনবাবু মন্তব্য করেন, “এর মধ্যে নিশ্চয়ই বাঙালি ছেলেরা ছিল না?” শুনে সেই পণ্ডিতপ্রবর গর্জে উঠলেন, “কেন, বাঙালি ছেলেদের গায়ে কি পুরুষের রক্ত নেই?” আমি বরিশালের বাঙাল। ফলে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, ভেবেছিলাম প্রশ্ন করি, “বরাহশাবক, তোমার ধমনীতে কোন জানোয়ারের রক্ত, একটু বলবে?” কিন্তু সব সদিচ্ছা পূর্ণ হয় না। কী আর করা যাবে।

তিন দিন দক্ষযজ্ঞের পর আম-খুন অগ্নিদাহ বন্ধ হল ঠিকই, কিন্তু পথেঘাটে মৃতদেহের স্তূপ সরাতে বেশ ক’দিন লেগেছিল। আর সেই স্কুপে নতুন মাল সরবরাহের কাজও চলতেই থাকে। এক বছর ধরে রোজই দু-চারটে খুন-জখমের সংবাদ পাওয়া যেত। কয়েকটা জায়গায় দিনের মধ্যে কয়েকবার ট্রাম বাসে অ্যাসিড বা আর স্টেনগান থেকে গুলি চালানো নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ঠনঠনের মোড় এইসব কাজের একটি প্রধান অকুস্থল ছিল। ওই পথে রোজই কলেজ যাওয়াআসা করেছি। কিন্তু কখনও আক্রমণের অভিজ্ঞতা হয়নি। সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে ব্যাপারটা কিছু অস্বাভাবিক না। বহু লক্ষ মানুষের বাস কলকাতা শহরে কয়েক হাজার লোক খুনজখম হলে ব্যক্তিবিশেষের গায়ে আঁচ লাগার সম্ভাবনা শতকরা একেরও কম। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে ক্ষতিটা প্রায় স্পর্শগ্রাহ্য হয়ে উঠেছিল। আমাদের চেনা কলকাতা শহর হারিয়ে গিয়েছিল। কোথাও দূরে যেতে হলে আগে হিসাব করতে হত কোন পথে যাব? হিন্দু না মুসলমান পাড়ার ভিতর দিয়ে? একদিন পার্ক স্ট্রিট চৌরঙ্গি অঞ্চলে যেতে হয়েছিল। অনেক ভেবেচিন্তে পাজামা পাঞ্জাবি পরে বাসে উঠি। কর্নওয়ালিস স্ট্রিট থেকে উঠেছি। হিন্দু পাড়া। তাই দু-একজন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেও কেউ খুব একটা নজর করছিল না। কারণ ওপাড়া তখন মুসলমানশূন্য। আর কোনও মুসলমানের এমন সাহস নেই যে, পায়জামা পরে ওপাড়ায় চলাফেরা করে। কিন্তু রব উঠল যখন পার্ক স্ট্রিটে নামলাম। শুনলাম, “শালা নেড়ের বাচ্চাকে ছেড়ে দিলি? দেখলি তো! কেমন হিন্দু হিন্দু ভাব করে পার পেয়ে গেল?” চিৎপুরের আমজাদিয়া রেস্টুরেন্ট আমাদের মতো স্বল্পবিত্ত ছাত্রদের সস্তায় বিলাসব্যসনের একটি অতি প্রিয় জায়গা ছিল। দাঙ্গার পর আর ওমুখো হইনি। যত দূর জানি আমজাদিয়ার গৌরবের দিনও এই সময়েই অস্তমিত হয়।

কলকাতার দাঙ্গার অল্পদিনের মধ্যে সরকারি ঘোষণা হল কংগ্রেস পাকিস্তানের দাবি মেনে নিয়েছে। দেশ ভাগ হওয়া এখন সুনিশ্চিত। আগস্ট ‘৪৮-এর মধ্যে ইংরেজ দুই সার্বভৌম রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে বিদায় নেবে। এই প্রসঙ্গে এক সময় মহাত্মার সেক্রেটারি অধ্যাপক নির্মল বসুর কাছে যেকাহিনিটি শুনেছিলাম সেটা লিখছি। নির্মলবাবু বলেন–দেশবিভাগের প্রস্তাব নিয়ে নেহরু মহাত্মার সঙ্গে যখন আলোচনা করতে আসেন, অধ্যাপক। তখন উপস্থিত ছিলেন। সব শুনে গাঁধীজি বলেন—তাঁর মন এই প্রস্তাবে সায় দিতে পারছে না। তাঁর প্রথম প্রস্তাব ছিল জিন্না সাহেবের হাতে অবিভক্ত ভারতের রাজ্যভার তুলে দিয়ে ইংরেজ বিদায় নিক। তারপর আমাদের সমস্যার মোকাবেলা আমরা করব। জিন্না এ প্রস্তাবে রাজি হননি। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দও রাজি হতেন মনে হয় না। নেহরু জিজ্ঞেস করেন–পাকিস্তান প্রস্তাব না মেনে মহাত্মা তার বিকল্প পন্থা কী চিন্তা করছেন। এ প্রশ্নের দ্বিধাহীন উত্তর—”আর একবার গণআন্দোলন করতে হবে।” নেহরুজি বলেন, কলকাতার রক্তপাত দেখার পর ওঁর আর সাহস নেই। একটু সময় চুপ করে থেকে মহাত্মা বললেন, “তোমরা কি ভাবছ যে, ভারত স্বাধীন হবে আর তার জন্য অন্তত দশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দেবে না? রক্তপাত হবেই। তবে তা মহৎ উদ্দেশ্যে হবে, না বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে হবে, তা নির্ভর করবে জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ কোন পথ গ্রহণ করবেন তার উপর।”

এর পরবর্তী ইতিহাস কারও অজানা নয়। দেশবিভাগের সিদ্ধান্তে কোনও নড়চড় হল না। শুধু কোন অংশ পাকিস্তানে যাবে আর কোন অংশ ভারতবর্ষে থাকবে তা নিয়ে দর কষাকষি চলল। কংগ্রেস এবং শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে হিন্দুরা পঞ্জাব এবং যুক্তবঙ্গ দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব আনলেন। ব্রিটিশ সরকার আর মুসলিম লিগ শেষ অবধি এই প্রস্তাব মেনে নিলেন। জিন্না সাহেব নিরুপায় হয়েই ‘পোকায় খাওয়া পাকিস্তান’ই গ্রহণ করতে রাজি হলেন। কিন্তু যে-বিষাক্ত রক্তপাতের সম্ভাবনা তাঁর ভবিষ্যৎ দৃষ্টি নিয়ে গাঁধীজি দেখতে পেয়েছিলেন, সেই রক্তপাত এড়ানো গেল না। কলকাতার দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য মহাত্মার আগমন এবং অনশনের কাহিনি এখন সর্বজনবিদিত। কলকাতার দাঙ্গা থামতে না থামতে নোয়াখালিতে হিন্দু এবং বিহারে মুসলমানদের উপর আক্রমণ এবং বীভৎস অত্যাচার শুরু হয়। মহাত্মা আগুনে জল ঢালার চেষ্টায় প্রথম নোয়াখালি এবং তারপর বিহার গেলেন।

অনেক সময় এইসব ঘটনার বিবরণ যেভাবে লেখা হয় তাতে মনে হতে পারে এদের মধ্যে কোনও কার্যকারণ জাতীয় যোগসূত্র আছে। কিন্তু নোয়াখালির মুসলমান জনগণ কলকাতার সংবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে হিন্দুনিধনে তৎপর হয়, এরকম মনে করার কোনও কারণ। আছে মনে হয় না। কৃষকবিদ্রোহের অঙ্গ হিসেবে বাংলার গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা কখনও ঘটেনি এমন নয়। কিন্তু ওই জাতীয় সংঘাত যুক্তবঙ্গে প্রধানত কয়েকটি শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। কতকটা অর্থনৈতিক কারণেও গ্রামজীবনে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ সম্ভব ছিল না। না হলে দুই সম্প্রদায়ের পরস্পরনির্ভরতার ভিত্তিতে গঠিত অর্থনৈতিক তথা সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ত। মোট কথা, নোয়াখালির ঘটনা নিম্নবর্গীয়দের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রাসন নয়, একটি বজ্জাত ধান্দাবাজের সুপরিকল্পিত বদমাইসির পরিণাম। প্রাণীটির নাম গোলাম সরোয়ার। পেশা মোক্তারি। অধ্যাপক মাখনলাল রায়চৌধুরীর দাদা রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী নোয়াখালি বারে ওকালতি সূত্রে তার বিশেষ পরিচিত এবং শোনা যায়, ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। নিতান্তই আদর্শগত কারণে সরোয়ার সাহেব শহর থেকে দলবল নিয়ে গ্রামে বন্ধুর জমিদারি প্রাসাদ আক্রমণ করেন। এর মধ্যে লোভ বা বিদ্বেষের কোনও ব্যাপার ছিল না। এই আদর্শবাদী কর্মযজ্ঞে ওই পরিবারের যে কটি পুরুষমানুষ সেদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলেন তাঁরা সবাই আহুতি হন। স্থানীয় মুসলমানরা আশ্রয় দেওয়ায় বাড়ির মেয়েরা বেঁচে যান। সরওয়ার কিছুদিন কারাবাস করেন। সে সময় অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তী অবিশ্বাস্য এই জন্তুটিকে দেখতে নোয়াখালি জেলে গিয়েছিলেন। সরওয়ার বলে যে, কাগজে যেসব খবর বের হয়েছে সবই মিথ্যে কথা, হিন্দু সাংবাদিকদের বানানো গল্প। ও নাকি ইসলামের চোখে অন্যায় বলা চলে এমন কোনও কাজ করেনি। আর ওর যা কৈফিয়ত তা ও নেতাদের কাছে দেবে। নেতারা লোকটাকে স্নেহের দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন। যথাকালে এই জানোয়ার পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সভ্য হয়।

নোয়াখালির ঘটনার পর গাঁধীজি দীর্ঘদিন গিয়ে ওখানকার বিধ্বস্ত গ্রামগুলিতে কাটান। এখানে বলা প্রয়োজন—গোলাম সরওয়ারের আদর্শনিষ্ঠা ফলপ্রসু হয়েছিল। নোয়াখালির গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ শিকড় গেড়েছিল। দাঙ্গা এক দিনে শেষ হয়নি। মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু এই সময় বাংলা দ্বিখণ্ডিত করার পক্ষে রায় দেয়। সিদ্ধান্ত হয়—পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের অংশ হবে আর পূর্ববঙ্গের নতুন নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান। এইসব সাতবাসি পুরনো কথা পুনরাবৃত্তি করছি, কারণ দেখেছি আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ে এইসব অতিপরিচিত তথ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন।

নতুন বঙ্গভঙ্গের যখন আয়োজন হচ্ছে, সেই সময় পাশাপাশি দুটি পরস্পরবিরোধী প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এক পূর্ববঙ্গের সর্বত্র আর কলকাতা শহরে যেখানেই পূর্ববঙ্গবাসী হিন্দুদের আস্তানা সেখানেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠিবিশেষকে কেন্দ্র করে ডজন ডজন ম্যাপ, সেন্সস রিপোর্ট আর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার নিয়ে আলোচনাচক্র বসল। উদ্দেশ্য খুব সরল। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর র‍্যাডক্লিফ সাহেব মানচিত্রের উপর একটি লাইন টেনে বাংলা এবং পঞ্জাবের কোন কোন অংশ ভারতে এবং কোন কোন অংশ পাকিস্তানে যাবে তা নির্ধারণ করবেন। কংগ্রেস-লিগ হিন্দু-মুসলমান সবাই এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে। যে-আলোচনাচক্রের কথা বললাম আসলে সেগুলি আবেদনচক্র। উদ্দেশ্য ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন করা, “প্রভু, যাও গো যাও, যাবার আগে আমায় হিন্দুস্থানে (বা পাকিস্তানে) রেখে যাও।” আবেদনের ভাষাটা অবশ্যি মেষসুলভ নয়, উকিলি সিংহগর্জনের রীতিমতো তথ্যপ্রমাণ দিয়ে জোরালো দাবির ভাষা। তবে সেসব দাবি কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানবিক যুক্তিতর্ক ছাড়িয়ে এক অতীন্দ্রিয় জগৎকে স্পর্শ করেছিল বলা চলে। যেসব অঞ্চল হিন্দুস্থানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয় তার মধ্যে ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম কোনও অঞ্চলই বাদ পড়েনি। মানচিত্রে কলকাতা থেকে ট্যারাকো সব লাইন টেনে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ভারতভুক্তির দাবি করা হয়। তার সবগুলি মানলে পূর্ব পাকিস্তান জন্মের আগেই লুপ্ত হত। পঞ্জাবে এর সঙ্গে তুলনীয় কোনও চেষ্টা হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। তবে শিখরা তাঁদের স্বশাসিত রাজ্যের দাবি করেছিলেন ঠিকই। র‍্যাডক্লিফ সাহেব এইসব সূক্ষ্ম যুক্তিতর্কে সমৃদ্ধ দাবির কোনও তোয়াক্কা করেছিলেন এমন প্রমাণ নেই।

ভারতভুক্তির দাবি নিয়ে এই আন্দোলনের পাশাপাশি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এক প্রচেষ্টা হয়। সে চেষ্টা স্বাধীন সার্বভৌম যুক্তবঙ্গ রাষ্ট্র স্থাপনের। শরৎ বোস, সুরাবর্দি, কিরণশঙ্কর এই তিনজন পরামর্শ করে সার্বভৌম বঙ্গের পরিকল্পনা করেন। জিন্না সাহেব এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কারণ সম্ভবত তাঁর বরাবরই দুই পাকিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কত দূর কার্যকরী হবে এ নিয়ে সন্দেহ ছিল। অপর পক্ষে কারও কারও ধারণা যে মুসলমানপ্রধান। স্বাধীন বঙ্গদেশ কালে কালে পাকিস্তানেই যোগ দেবে-ওঁর এই ভরসা ছিল। কংগ্রেস এ প্রস্তাবে কখনওই রাজি হয়নি। বলা হয় কলকাতাবাসী অবাঙালি গোষ্ঠীবিশেষের প্রবল আপত্তিই তার কারণ। তখনকার বাঙালির রাজনৈতিক মনোভাব দেখে মনে হয় এই প্রস্তাব যুক্তবঙ্গেও ধোপে টিকত না। মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবের উদ্যোক্তাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। পিসেমশায়ের কাছে ওঁর ভাইসরয় সাক্ষাৎকারের বিবরণ শুনি। অভিজাত ইংরাজের স্বভাবসিদ্ধ চটুল ভঙ্গিতে বড়লাট নাকি ওঁর বুকে এক মৃদু ধাক্কা দিয়ে একটি চেয়ারে বসিয়ে দেন এবং নিজে সামনের টেবিলে বসে বলেন “ইউ উইল গো ডাউন ইন হিস্টরি অ্যাজ আ বাঞ্চ অফ স্কাউলেস—কাটিং আপ দা কান্ট্রি হিয়ার কাটিং ইট আপ দেয়ার!”

না, সে যাত্রা দেশটাকে এখানে সেখানে কেটে তিন টুকরো করার ব্যবস্থা হয়নি। সে সমাধান আর এক দিনের জন্য ভোলা ছিল, সম্পূর্ণ অন্য পরিস্থিতিতে। বৃহৎ সার্বভৌম বাংলাদেশের পরিকল্পনা বড় দেরিতে এসেছিল। তখন এর পিছনে গণ-সমর্থনের সম্ভাবনাও বিশেষ ছিল না। ফজলুল হক সাহেব তাঁর মন্ত্রিসভা গঠনের সময় বারবারই কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাবার চেষ্টা করেছিলেন। সে চেষ্টা সফল হলে কি বাঙালির ইতিহাস অন্য পথে যেত, না হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থের সংঘাত যে জায়গায় পৌঁছেছিল তাতে দেশভাগ ছাড়া তখন আর অন্য কোনও সমাধানের পথ ছিল না? ‘যদি-ভিত্তিক ইতিহাস’ বা কী হতে পারত তার বিশ্লেষণ এখন ঐতিহাসিকদের চোখে সত্যানুসন্ধানের শ্রদ্ধেয় উপায়। আমার ওই পথে আস্থা নেই। কেন, কী ঘটেছিল তা আমাদের বোঝার ক্ষমতা নিতান্তই সীমিত। কী ঘটতে পারত তার নির্দেশ আমরা কোথা থেকে পাব? শুধু বলতে পারিবঙ্গভঙ্গ হয়ে উভয় বঙ্গে সব সম্প্রদায়ের বাঙালিরই সর্বনাশ ঘটেছিল, এটা আমার স্থির বিশ্বাস। ইতিহাসের সেই রদবদল করার ক্ষমতা আমাদের নেই।

ভারত বিভাগের এবং বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত যখন কঠিন সত্য বলে মেনে নিতে হল, তখন পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত হিন্দু সবাই যে ঠিক মাথায় হাত দিয়ে বসে, তা নয়। তাদের জীবনে যে একটা বিরাট পরিবর্তন আসছে এটা বোধহয় প্রায় সবাই বুঝতে পেরেছিল। অনেকেই। পশ্চিমবঙ্গে একটা মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজতে শুরু করে, কিন্তু ওই চেষ্টার পথ সহজ ছিল না। প্রথম কথা, হঠাৎ অন্য জায়গায় গিয়ে বাড়িঘর কিনে বসতি করার সামর্থ্য অল্প লোকেরই ছিল। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাঙালি চাকরিজীবী। মধ্যবয়সে নতুন জায়গায় গিয়ে চাকরি খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে উদ্বাস্তুর ঢল নামার সময়ানুক্রমিক হিসাব কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত ধারণা যে, ঢলটা নামে দেশবিভাগের পর, আগে নয়। এ ধারণা ভুল হতে পারে। সম্ভবত কলকাতার দাঙ্গার পর থেকেই কিছু মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে পালাবার পথ খুঁজছিলেন। বাড়ির দাম এবং বাড়িভাড়া দুই ই আকাশচুম্বী হওয়ার লক্ষণ দেখা দেওয়ায় সে চেষ্টা সফল হওয়া সহজ ছিল না। অনেকে এসে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ওঠেন। সে অভিজ্ঞতা কারও পক্ষেই সুখের হয়েছিল মনে হয় না।

আমাদের পরিবার কয়েক পুরুষের জমিদার। ঠাকুর্দারা চার ভাই ছিলেন। বড় ভাইয়ের ছেলেরা কলকাতার সাউথ এন্ড পার্কে একটা বাড়ি করেছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন একটা চাকরি করতেন। বাকি তিনজন জমিদারির আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। আর তিন। ‘কোঠা’র বাকি আটজন শরিকের মধ্যে একজন ছিলেন ব্যারিস্টার, আর দু’জন ছোটখাটো কোনও কাজ করতেন। কিন্তু প্রায় সবারই প্রধান নির্ভর ছিল জমিদারির আয়ের উপর। এই আয় যে হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এই সম্ভাবনা কেউই ঠিক পুরোপুরি উপলব্ধি করেছিলেন বলে মনে হয় না। হক সাহেব প্রধানমন্ত্রী হয়ে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করবেন সে কথা সরাসরিই বলেছিলেন। বছরে দু-তিনবার শরিকরা একসঙ্গে বসে মিটিং করতেন, সম্পত্তির ছোটবড় সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হত বা হত না। কিন্তু সেইসব মিটিংয়ে সামনে যে সম্পত্তিনাশের সম্ভাবনা, এবং সে জন্য কী করা দরকার এ নিয়ে কখনও কোনও আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। মধ্যস্বত্বভোগী ঘরের ছেলে মিহির সেনগুপ্ত দেশভাগের সময় এবং সম্পত্তি চলে যাওয়ার পর ওঁর বাপ-জ্যাঠারা কীভাবে হাত গুটিয়ে বসেছিলেন তার বিবরণ লিখেছেন, পূর্ববঙ্গের প্রায় সব জমিদার-তালুকদার পরিবারের ইতিহাস ঘাঁটলে প্রায় ওই একই ছবি চোখে পড়বে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষক এবং কৃষির কী অনিষ্ট হয়েছে এ নিয়ে এক সময় ঐতিহাসিক এবং অর্থনীতিবিদরা উত্তপ্ত আলোচনা করেছেন। মোটামুটি সবাই এ সম্বন্ধে একমত যে, জমিদারি প্রথার ফলে জমির আয়ের সিংহভাগ রায়তের পেটে না গিয়ে জমিদার, মধ্যস্বত্বভোগী এবং আমলা-তহশিলদারদের পেটে যায়। কর্নওয়ালিস সাহেবের যে ভরসা ছিল জমিদাররা নিজের স্বার্থে কৃষির উন্নতি করবে—সে আশা ফলপ্রসূ হয়নি। দোল-দুর্গোৎসব-বাইনচে চাষির কষ্টার্জিত পয়সা খরচা হয়েছে। আয়েসে অভ্যস্ত জমিদারশ্রেণি এক দিকে বংশবৃদ্ধি করেছেন আর অন্য দিকে নায়েব-গোমস্তার হাতে সম্পত্তি দেখাশুনোর ভার ছেড়ে দিয়ে ক্রমে নিজেরা দারিদ্রের প্রান্তসীমায় পৌঁছেছেন। এই অবক্ষয়ের ইতিহাস কেউ লেখেননি। তারাশঙ্কর-বনফুলের উপন্যাসে জমিদারদের এক রোমান্টিক ছবি তুলে ধরা হয়েছিল, যদিও শেষের দিকের লেখায় তারাশঙ্কর শ্রেণি হিসাবে জমিদারদের অন্তঃসারশূন্যতার কথাই বলেছেন। খুব অল্পসংখ্যক জমিদারই সত্যিতে ধনী ছিলেন। কিন্তু বংশানুক্রমিকভাবে খাওয়া-পরার সংস্থান বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকায় এঁদের মধ্যে অদ্ভুত এক উদ্যমহীনতা স্বভাবসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। মিহির জমিদারদের সামন্ত বলে বর্ণনা করেছেন। কিছু কিছু জমিদার সামন্ত বা অভিজাতজনোচিত হাবভাব অবলম্বন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু শ্রেণি হিসাবে এঁদের সত্যিকার চরিত্র বর্ণনা করতে গেলে ফরাসি শব্দ রাঁতিয়ের, অর্থাৎ জমি বা বাড়ির ভাড়ার উপর নির্ভরশীল এক গোষ্ঠী বলে বর্ণনা করতে হয়। এমনকী এঁদের মধ্যে যাঁরা মধ্যযুগের ছোটবড় রাজা-মহারাজার বংশধর, সামরিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে তারাও শ্রেণি হিসাবে ভাড়া-উপজীবীই হয়ে গিয়েছিলেন।

নিজেদের কথায় ফিরে যাই। বাবা-জ্যাঠাদের এস্টেট সংক্রান্ত মিটিংয়ে সম্পত্তি পার্টিশন করার কথা কয়েকবারই হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত কখনও নেওয়া হয়নি। যদি হত, তা হলে নিজেদের ছোট ছোট অংশগুলি বর্ধিষ্ণু জোতদারদের কাছে বিক্রি করে প্রত্যেকেই কিছু সম্বল হাতে পেতেন, কারওকেই একেবারে নিঃস্ব হতে হত না। কিন্তু সম্পত্তি বিক্রি করা শরিকদের কেউ কেউ মহাপাপ বলে মনে করতেন। ফলে পার্টিশন বা সম্পত্তি বিক্রি—এর কোনও পথেই আত্মরক্ষার কোনও চেষ্টা হয়নি। কুখ্যাত সাহাবাবু আমাদের সম্পত্তির অংশ কিনে নিতে চেয়েছিলেন। অপমানজনক জ্ঞানে এই প্রস্তাব বাবা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শেষে যখন বিক্রির চেষ্টা করেন তখন বড় দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফলে প্রকৃতপক্ষে কপর্দকহীন অবস্থায় আমরা পাকিস্তান ছেড়ে আসি। যত দূর জানি আমাদের তুলনায় অন্যান্য শরিকরা আরও বিপন্ন হয়েছিলেন।

ক্রমে স্বাধীনতা তথা দেশবিভাগের দিন কাছে এসে গেল। আমরা যারা কলকাতার দাঙ্গা নিজের চোখে দেখেছি তারা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার কথা একবারও চিন্তা করিনি। কিন্তু বাবাকে যখনই লিখতাম এবার পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার উদ্যোগ করো, খুব যে একটা উৎসাহ দেখাতেন তা নয়। শেষ অবধি যখন এলেন তখনও বরাবরের মতো দেশত্যাগ করছেন এ ধারণা ওঁর ছিল না। আসলে অনেকেই ভেবেছিলেন যে, দেশে থেকে যাওয়া কিছু অসম্ভব হয়ে উঠবে না। কারণ ‘৪০-এর দশকে পূর্ববঙ্গে নোয়াখালি ছাড়া আর কোথাও দাঙ্গা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আর আগেই লিখেছি—নোয়াখালির ঘটনা স্বতঃস্ফুর্ত গণসংঘর্ষ নয়, এক বদমাইস ব্যক্তির ব্যক্তিগত শুভ প্রচেষ্টার ফল। তা ছাড়া সহায়সম্বলহীনভাবে পশ্চিমবঙ্গে এসে রুজির জোগাড় কী করে হবে সে দুশ্চিন্তাও ছিল। অত্যন্ত অভিমানী মানুষ আমার বাবা ছেলেদের রোজগারে খাবেন, এ চিন্তা কিছুতেই করতে পারতেন না।

ফলকথা, ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে আমাদের পরিবার বরিশালে। পরীক্ষা পিছানোর ঐতিহ্য কলকাতায় দাঙ্গার পর থেকেই শুরু হয়েছে। তাই যে এম. এ. পরীক্ষা জুন-জুলাইয়ে হত তা ডিসেম্বর অবধি পিছিয়ে গিয়েছে। দেশবিভাগের তিন-চারদিন আগে হস্টেল ছেড়ে বরিশাল চলে গেলাম। গিয়ে দেখি সারা শহর আসন্ন দাঙ্গার গুজবে টলমল করছে। এরকম সময় মানুষের মনের অবস্থা কী হয় তার একটা উদাহরণ দিই। একদিন বিকালবেলা বিবির পুকুরের পাড় দিয়ে বাড়ি ফিরছি। দেখি বেশ কিছু মুসলমান চাষি সার দিয়ে নদীর পাড়ের দিকে চলেছে। অন্য সময় হলে এ দৃশ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখতাম না, কিন্তু বোধ হয় দাঙ্গার গুজবের ফলেই নজর করলাম সবারই হাতে দা বা কাস্তে। ভয়ে প্রাণ শুকিয়ে গেল। ভাবলাম এরা নিশ্চয়ই দাঙ্গা করার জন্যই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলেছে। নদীর পাড়ের পথে প্রথমেই তো আমাদের বাড়ি। দৌড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। একটু পরে মনে হল–আরে এরা তো হাটুরে। কেনা-বেচা শেষ করে নদীর দিকে রওনা দিয়েছে–নিজের নিজের ডিঙি নিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে। ভয়ের তো কোনও হেতু নেই।

ভয়ের সত্যিতে কোনও হেতু ছিল না। কারণ হিন্দুপ্রধান বরিশাল শহরে দাঙ্গা করার কথা তখন কেউ চিন্তা করেনি। স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে কোনও গোলাম সরওয়ারের আবির্ভাব ঘটেনি। যেমন ১৬ আগস্টের আগে কলকাতায়, তেমনই দেশভাগের ঠিক আগে বরিশাল শহরে, দাঙ্গার গুজবটা সত্যিতে বোধ হয় বেশি কেউ বিশ্বাস করেনি। কারণ শহরের বেশির ভাগ হিন্দু যেখানকার লোক সেখানেই ছিল। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা দিবস। সকাল থেকেই মিছিলে মিছিলে শহর উত্তাল। কিছু বামপন্থী হিন্দুও সেইসব মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। দাঙ্গার আশঙ্কায় প্রতিরোধের কোনও বিশেষ ব্যবস্থা কেউ করছিলেন বলে আমার জানা নেই। আমাদের বাড়িতে দেখলাম বাবার কথামতো বামনবীর বসা আমাদের একমাত্র বন্দুকটি বের করে সেটা পরিষ্কার করছে। এবং তার সঙ্গে ওর স্বভাবসিদ্ধ তড়পানি। সত্যিতে দাঙ্গা বাধলে ওই একটি বন্দুকে সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই বেশি হত বলে আমার ধারণা।

রাত বারোটায় নদীতে জড়ো হওয়া সব স্টিমার, লঞ্চ, মোটরবোট ভেঁপু বাজিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করল। সারা শহর আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মুখরিত হল। সারা রাত বাবা বন্দুকটি হাতে নিয়ে বসে রইলেন। একটি কথাও বলেননি। সাতাশ বছর ধরে। মানুষটি স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওঁর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার সমাপ্তি এইভাবে হবে, এ কথা নিশ্চয়ই কখনও কল্পনা করেননি।

পরদিন সকালে টাউন হলের বাইরে দাঁড়িয়ে রেডিওতে কায়েদ-ই-আজমের বক্তৃতা শুনলাম। তিনি বললেন—পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নতুন রাষ্ট্রে সকলেরই সমান অধিকার। এই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের কোনও স্থান নেই। ওঁর এই আশ্বাসবাণী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আক্ষরিক অর্থে নিতে পারেনি। অবস্থা তা পারবার অনুকূল ছিল না।

১৫ আগস্ট কলকাতা শহরে অন্য এক নাটক অভিনীত হচ্ছিল। আমার দুর্ভাগ্য সেই অভাবনীয় নাটক শুধু ছায়াছবিতেই দেখেছি। সেদিন সকালবেলা চিৎপুরের মুসলমান পাড়া থেকে ব্যান্ড বাজিয়ে তাজিয়া সাজিয়ে জরির টুপি মাথায় সব লোক আতর আর মিঠাই ছড়াতে ছড়াতে হিন্দু পাড়ায় এল। কোলাকুলি আর আনন্দাশ্রুপাতে সারা কলকাতা শহর আবেগে ভেসে গেল। নতুন সরকার রাজভবন জনসাধারণের জন্য খুলে দিলেন। লাখ লাখ লোক লাটভবনে ঢুকে পড়ে। বড় বড় বিছানা আর বাথটাবে বিনা বাধায় গড়াগড়ি দিয়ে ক্ষণিকের রাজকীয় আরাম উপভোগ করল সবাই। বেশ কয়েক বছর পশ্চিমবঙ্গের সব সিনেমাহলে এই ঘটনার তথ্যচিত্র দেখানো হত। আমার মনে হয় ওই অভূতপূর্ব ঘটনার ছবিটি এখনও মাঝে মাঝে দেখালে ভাল হয়।

কলকাতার ওই অবিশ্বাস্য আনন্দের দিনটি আরও একটি স্মরণীয় শিল্পকর্মে ধরা আছে। ওই দিনটিকে কবি বিষ্ণু দে এক গভীর আবেগভরা কবিতায় স্বাগত জানানঃ “আনন্দ আজ আনন্দ অসীম… নীল আকাশের নীচে, মিলেছে আজ হিন্দু-মুসলমান।” ওঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর এই কবিতাটি উনি একদিন পড়ে শুনিয়েছিলেন। রীতিমতো সিনিকাল মানুষটির চোখে সেদিন জল দেখেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *