১৩. বারের মধ্যে চার-পাঁচজন নরনারী

বারের মধ্যে চার-পাঁচজন নরনারী টেবিলের সামনে বসে ড্রিঙ্ক করছিল। একপাশে একটা ঘেরা কাঁচের পার্টিশন ভোলা জায়গায় ফোন ছিল। পার্টিশনের মধ্যে ঢুকে সর্বাগ্রে নিকটবর্তী থানায় পরিচিত থানা অফিসার রজত লাহিড়ীকে দুঃসংবাদটা দিয়ে কিরীটীকে ফোনে ডাকলাম।

হ্যালো! কিরীটী রায় কথা বলছি। তারে কিরীটীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

আমি সুব্রত, বৈকালী সঙ্ঘ থেকে বলছি রে।

কি ব্যাপার?

মিত্রা সেন খুব সম্ভবত murdered!

সংবাদটা শুনে কিন্তু অপর পক্ষের কণ্ঠে কোনরূপ বিস্ময় প্রকাশ পেল না। শান্ত প্রত্যুত্তর শোনা গেল : শেষ পর্যন্ত murdered! কিন্তু এতটা ঠিক তো আশা করিনি? নিজের পরিচয় দিয়েছিস নাকি?

হ্যাঁ, এইমাত্র দিলাম।

এত তাড়াতাড়ি! আর একটু পরে দিলেই হত। যাকগে, থানায় সংবাদ দিয়েছিস?

হ্যাঁ, রজত লাহিড়ীকে জানিয়েছি। তিনি এক্ষুনি আসছেন।

অশোক রায় ঐখানেই আছে তো?

অশোক রায়! কই না, তাকে তো এখনো পর্যন্ত দেখিনি!

খোঁজ নে, আমি আসছি। হ্যাঁ ভাল কথা, ক্লাবের প্রেসিডেন্টের খবর কি?

এখনও খবর নিতে পারিনি।

কেউ যেন না সটকাতে পারে। Keep an eye!

হ্যাঁ, সে ব্যবস্থা করেছি।

যাচ্ছি আমি।

ফোন রেখে বের হয়ে এলাম। শ্ৰীমন্ত পাল পার্টিশনের সুইং-ডোরের অল্প দূরেই দাঁড়িয়েছিলেন। এবং ঘরের মধ্যে যাঁরা টেবিলে বসে ড্রিঙ্ক করছিলেন তাঁরা দেখলাম পূর্ববৎ নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বুঝলাম এ-ঘরের নরনারীদের মধ্যে এখনও দুঃস্বপ্নের ধাক্কাটা এসে পৌঁছয়নি।

কিন্তু সত্যিই অশোক রায়কে তো এতক্ষণ পর্যন্ত আজ এখানে আসা অবধি একবারও দেখিনি। মিত্রা সেন এসেছিল অথচ জোড়ের অন্যটি অশোক রায় আসেননি এ তত হতে পারে না— বিশেষ করে আজ শনিবার। মিত্রা সেনের অনিবার্য উপস্থিতির রাত যখন, তখন অশোক রায়ের আসাটাও অনিবার্য।

বিশেষ করে ঐ সঙ্গে আরও একট কথা মনে পড়ল। মাত্র আগের দিনেই কিরীটীর মুখে শুনেছি মিত্রা ও অশোকের বিবাহের ব্যাপারটা স্থির হয়ে গিয়েছে। সে অবস্থায় আজকের রাত্রে মিত্রা সেন এসেছে অথচ অশোক রায় আসেননি এবং শুধু আসাই নয়, মিত্রা সেন বিষপ্রয়োগে নিহত অথচ অশোক রায় অনুপস্থিত। কথাটা ভাবতে ভাবতেই শ্ৰীমন্ত পালের দিকে এগিয়ে গেলাম।

চলুন মিঃ পাল, প্রেসিডেন্টের ঘরে একবার যাওয়া যাক।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে শ্ৰীমন্ত পাল বললেন, চলুন।

ঘর থেকে বের হয়ে অপরিসর প্যাসেজটা দিয়ে পাশাপশি যেতে যেতে আমিই আবার প্রশ্ন করলাম, অশোক রায়কে দেখছি না, তিনি কি আজ আসেননি নাকি?

কই, আমি তো তাঁকে আজ দেখিনি একবারও।

কখন আপনি এসেছেন আজ?

রাত সাড়ে নটার পর।

আপনি যখন হলঘরে এসে ঢোকেন কাকে কাকে দেখেছিলেন সেখানে, মনে আছে?

হ্যাঁ।

মিত্রা সেন তাদের মধ্যে ছিলেন কি?

না। তাকেও দেখিনি।

তবে কে কে ছিলেন তখন হলঘরে?

মহারানী,সুধীরঞ্জন, সুমিত্রা চ্যাটার্জী, নিখিল ভৌমিক, মনোজ দত্ত, সোমেশ্বর আর রমা মল্লিক ছিল।

বিশাখা ছিলেন না?

না, কই! তাকে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না!

ভাল করে মনে করে দেখুন, আর কাউকে হলঘরের মধ্যে দেখেননি?

আমার বেশ মনে আছে। আর কাউকে তখন হলঘরের মধ্যে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। পাশাপাশি চলতে চলতেই বললেন শ্ৰীমন্ত পাল।

চলুন একবার প্রেসিডেন্টের ঘরে যাওয়া যাক, বললাম আমি।

চলুন।

সরু প্যাসেজটা ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। ডান দিকে ঘুরতেই সামনে একটা দরজা আমার চোখে পড়ল।

দরজার গায়ে একটা সাদা বেকালাইটের প্রেস বাটন আছে দেখলাম।

শ্ৰীমন্ত পালই এগিয়ে গিয়ে দরজার গায়ে প্রেস বাটনটা টিপলেন।

ধীরে নিঃশব্দে আমাদের চোখের সামনে দরজাটা খুলে গেল।

দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভিতর থেকে আহ্বান শোনা গেল, আসুন।

প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তীর গলা।

প্রেসিডেন্টের ঘরের যে দ্বারপথটি সেদিন আমার নজরে পড়েছিল, সেটা ছাড়াও এটি তাহলে ঘরে যাবার অন্য আর একটি দ্বার।

এ ধরনের আরও দ্বারপথ আছে কিনা তাই বা কে জানে!

শ্ৰীমন্ত পালের সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রেসিডেন্টের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

প্রেসিডেন্ট আমাদের দিকে পিছন ফিরে টেবিলের সামনে বসে একতাড়া ভাউচার সই করতে ব্যস্ত ছিলেন।

একটা ব্যাপার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ্য করেছিলাম। পশ্চাতের দ্বারের পাল্লাটি বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে যেন একেবারে দেওয়ালের গায়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। বাইরের থেকে প্রবেশদ্বারটি বোঝা গেলেও আকৃতি ও দ্বারের বৈশিষ্ট্য থেকে ভিতর থেকে সেটা বোঝবারও উপায় নেই। সমস্ত দ্বারপথটি জুড়ে দেওয়ালের গায়ে আঁকা রয়েছে একটি নৃত্যরতা চৈনিক সুন্দরীর নিখুঁত প্রতিকৃতি। বুঝলাম বাইরে থেকে জানা গেলেও ঘরের ভিতর থেকে দ্বারপথটি বোঝবার কোনও উপায় বা চিহ্ন নেই। তা থেকে স্পষ্টই প্রমাণ হয় যে ঐটি একটি গোপন দ্বারপথ।

ভাউচারগুলি সই করতে করতেই পূর্ববৎ চেয়ারে উপবিষ্ট অবস্থায় প্রেসিডেন্ট আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বললেন,কি খবর শ্রীমন্তবাবু?

শ্ৰীমন্ত পালের দিকে না তাকিয়েই বুঝলাম প্রেসিডেন্ট তাঁকে চিনতে পেরেছেন তা সে যে ভাবেই হোক।

সত্যসিন্ধুবাবু মানে সুব্রতবাবু—

শ্ৰীমন্ত পালের কথা শেষ হবার পূর্বেই চকিতে মুখ তুলে তাকালেন প্রেসিডেন্ট আমাদের দিকে। কালো চশমার অন্তরালে সেই মুহূর্তে তাঁর চোখের দৃষ্টির মধ্যে কি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল না টের পেলেও তাঁর চকিত শিরোত্তোলন ও তাকাবার ভঙ্গী থেকেই বুঝেছিলাম, আমার নামটা তাঁর কানে আকস্মিক ভাবেই প্রবেশ করেছে।

সুব্রতবাবু! সত্যসিন্ধুবাবুর সঙ্গে সুব্রতবাবুর কি সম্পর্ক?

সেই শুভ্রকেশ শান্ত চেহারা।

কথা বললাম এবারে আমিই, আমার নাম ও পরিচয়ের ব্যাপারে আমি গোপনতার আশ্রয় নিয়েছিলাম, মিঃ প্রেসিডেন্ট। তার জন্য আমি দুঃখিত–

গোপনতার আশ্রয় নিয়েছিলেন তার জন্য আপনি দুঃখিত মিঃ সুব্রত রায়! কিন্তু কেন বলুন তো? একটা সুতীক্ষ্ণ শব্দভেদী বাণের মতই যেন প্রেসিডেন্টের শান্ত কণ্ঠ হতে উচ্চারিত প্রশ্নটা আমাকে এসে বিদ্ধ করল।

আপনার সে প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আপনাকে একটা দুঃসংবাদ জানাতে চাই মিঃ চক্রবর্তী।

কিন্তু আমার কথার ধার দিয়েও যেন গেলেন না রাজেশ্বর চক্রবর্তী। আপন মনেই বললেন, অজ্ঞাতকুলশীল!! সুধীরঞ্জন is responsible বলতে বলতে টেবিলের গায়ে একটা অদৃশ্য বোম বোধ হয় টিপলেন।

মুহূর্ত পরেই সম্মুখের দ্বারপথে মীরজুমলাকে দেখা গেল।

মীরজুমলা, সুধীরঞ্জন—

মীরজুমলা আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বারপথে ক্ষণপূর্বে যেমন আবির্ভূত হয়েছিল ঠিক তেমনি করেই অন্তর্হিত হল।

আমরা দুজনেই এতক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রেসিডেন্ট আবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, আপনার সত্যকার পরিচয় তাহলে সুব্রত রায় আপনি! লালবাজার স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রাক্তন সি.আই.ডি.!

তা যা বলেন।

হ্যাঁ। তা বেশ। কিন্তু কি যেন দুঃসংবাদের কথা বলছিলেন একটুক্ষণ আগে?

মিত্রা সেন মারা গেছেন।

কি? কি বললেন? অত্যন্ত চমকিত বিস্ময়ে প্রশ্নটা করলেন তিনি।

মিত্রা সেন মারা গেছেন এবং কোনও তীব্র বিষই তাঁর মৃত্যুর কারণ। তাঁর মৃতদেহ বাগানের বেঞ্চিতে–

মানে, এখানে?

হ্যাঁ।

Are you mad Mr. Roy! কি সব আবোল-তাবোল বকছেন?

নিজেই স্বচক্ষে বাগানে দেখবেন চলুন না। আপনার একবার দেখা দরকার। থানায় অবিশ্যি আমি এইমাত্র ফোন করে দিয়েছি।

কিন্তু কে–কে আপনাকে গায়ে পড়ে সর্দারি করতে বলেছে মিঃ সুব্রত রায়, জানতে পারি কি?

আমার কর্তব্য বলে মনে করেই থানায় আমি ফোন করেছি মিঃ চক্রবর্তী।

All right? আপনি এখন যেতে পারেন এ ঘর থেকে। আর একটা কথা জেনে যান, এই মুহূর্ত থেকে আর আপনি বৈকালী সঙ্ঘের মেম্বার থাকলেন না।

ধন্যবাদ! আমারও ঘর ছেড়ে যাবার পূর্বে একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার, পুলিস আসা পর্যন্ত এ বাড়ি ছেড়ে আপনি যেন কোথাও যাবার চেষ্টা না করেন।

ধন্যবাদ!

আমারই ক্ষণপূর্বের ধন্যবাদটা যেন ব্যঙ্গোক্তির মধ্যে ফিরিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট আমাকে।

আমি ঘর থেকে দ্বিতীয় দ্বারপথে বের হয়ে সোজা হলঘরে চলে এলাম।

হলঘরে ঢুকতেই কানে এল ভায়োলিনের করুণ মিষ্টি সুর।

চেয়ে দেখি নির্জন হলঘরের মধ্যে একাকী এক কোণে একটা চেয়ারে বসে সুধীরঞ্জন আপন মনে ভায়োলিন বাজাচ্ছেন।

সুধীরঞ্জন কি তবে প্রেসিডেন্টের পরোয়ানা এখনও পায়নি। মীরজুমলা কি এ ঘরে আসেনি!

এগিয়ে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকলাম, সুধীরঞ্জন!

প্রথম ডাকটা শুনতে পেল না। দ্বিতীয়বার ডাকতেই মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভায়োলিন বাজানো বন্ধ করে বলল, কি?

প্রেসিডেন্ট যে তোমাকে ডাকছেন, শোননি?

না।

কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

এসেই একটু বাইরে গিয়েছিলাম, এই মিনিট কয়েক হল ফিরে হলঘরে কাউকে না দেখতে পেয়ে একা একা কি করি, তাই একটু ভায়োলিন বাজাবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কি ব্যাপার? আজ যে আসর ফাঁকা? সব গেল কোথায়?

একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।

পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনাই তো একদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে দুর্ঘটনা! ওর মধ্যে নতুনত্ব তো কিছু নেই!

না, না—সত্যিই–

আমি কি বলছি মিথ্যে—

খুব সম্ভব মিত্রা সেন নিহত হয়েছেন!

What! কি বললে?

মিত্রা সেন নিহত হয়েছেন, বিষপ্রয়োগে।

এ যে সত্যিই Arabian Night-এর গল্প শোনাচ্ছ হে! কিন্তু সংবাদটা দিল কে?

মহরানী অফ সোনপুরই প্রথম মিত্রা সেনের মৃতদেহ আবিষ্কার করেন বাগানে।

তার মানে, এইখানে?

হ্যাঁ।

হঠাৎ এমন সময় পশ্চাতে মীরজুমলার কণ্ঠস্বর শোনা গেলঃ স্যার! আপনাকে প্রেসিডেন্ট তাঁর ঘরে ডাকছেন।

সুধীই প্রশ্ন করে মীরজুমলার মুখের দিকে তাকিয়ে, কাকে?

তোমাকে। বললাম আমি।

 আমাকে?

হ্যাঁ, আমার সম্পর্কে আলোচনার জন্যই বোধ হয় তলব পড়েছে তোমার।

তোমার সম্পর্কে? হঠাৎ–

সত্যকার পরিচয়টা যে এইমাত্র তাঁকে দিয়ে এলাম।

সর্বনাশ করেছ! তারপর?

মীরজুমলা আবার ঐ সময় বলল, চলুন স্যার।

সময় নেই যাবার এখন, প্রেসিডেন্টকে গিয়ে বলমীরজুমলা। শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল সুধীরঞ্জন।

কিন্তু স্যার–

যা বললাম তাই বলগে–যাও!

ঠিক সেই মুহূর্তে হলঘরের প্রধান দরজা খুলে গেল এবং হলঘরে এসে প্রবেশ করল প্রথমে দারোয়ান, তার পশ্চাতে থানা অফিসার রজত লাহিড়ী এবং সর্বশেষে কিরীটী ও দুজন ইউনিফর্ম-পরিহিত পুলিস। পুলিস দুজনের দিকে তাকিয়ে রজত লাহিড়ী বললেন, তোম দোনো এই দরওয়াজা পর খাড়া রহে। বিনা হুকুমসে কোই বাহার না যায়। আউর বাহারসে ভি কোই নেই অন্দার ঘুষে।

কিরীটী ততক্ষণে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

বলা বাহুল্য আমার ছদ্মবেশই ছিল। তথাপি কিরীটী মুহূর্তকাল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললে, মেক-আপটা বেশ জুতসই নিয়েছিস তো সুব্রত!

হেসে ফেললাম আমি।

চল্‌, কোথায় ডেড বডি আছে?

বাগানে।

 এস হে রজত! কিরীটী রজত লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে আহ্বান জানাল।

হঠাৎ ঐ সময় লক্ষ্য করলাম হলঘরের মধ্যে কোথাও মীরজুমলা নেই।

নিঃশব্দে ইতিমধ্যে কখন একসময় যেন সে সবার অলক্ষ্যেঅন্তর্হিত হয়েছে।

সুধীরঞ্জনও আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলল।

দোতলার সরু প্যাসেজটা দিয়ে কিরীটী ও লাহিড়ীকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে যাবার সময় কিরীটী প্রশ্ন করল, অশোক রায় কোথায়?

এখনও পর্যন্ত তার কোনও হদিস পাইনি।

সে আজ এসেছিল, না মোটে আসেইনি?

তাও বলতে পারি না। এখনও বিশেষ কারও সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি। তবে আমার ধারণা সে নিশ্চয় এসেছিল।

কিসে বুঝলি?

আজ শনিবার। বিশেষ করে তোকে তো বলেছিলাম বৃহস্পতি ও শনিবার মিত্রা সেন এখানে আসবেই, এ তো অশোক জানে।

আমার কথার প্রত্যুরে কিরীটীর দিক থেকে বিশেষ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না অতঃপর আমরা লোহার ঘোরানো সিঁড়িপথে নেমে এসে একের পর এক নীচে বাগানে পা দিলাম। ইতিমধ্যে চাঁদ আকাশের পশ্চিম প্রান্তে অনেক হেলে পড়ায় তার আলোও ঝিমিয়ে এসেছিল।

দেখলাম যে কজন নরনারীকে প্রায় মিনিট কুঠি-পঁচিশ পূর্বে বাগানের মধ্যে সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে চিত্রার্পিতের মত দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখে গিয়েছিলাম, তাঁরা তখনও সেইখানেই যে যার দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক তেমনি। এবং মনোজ দত্তও ইতিমধ্যে কখন একসময় যেন আবার বাগানের মধেফিরে এসেছেন প্রেসিডেন্টের ঘর থেকে। আমাদের পদশব্দেওঁরা সকলেই একবার মুখ তুলে তাকালেন। কিরীটীও দেখলাম সেই মৃদু চন্দ্রালোকে সকলের মুখের দিকে পর পর একবার তাকিয়ে মৃতদেহের দিকে দৃষ্টি দিল।

কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে কিরীটী লাহিড়ীকে সম্বোধন করে নিম্নকণ্ঠে কি যেন বলল।

লাহিড়ী দণ্ডায়মান নরনারীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা যান, সকলে হলঘরে গিয়ে অপেক্ষা করুন, আমরা আসছি। আপনাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমাদের কিছু কথা আছে।

এতক্ষণ তাঁরা যেন সকলে ঐ বিশেষ নির্দেশটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সকলেই একে একে স্থানত্যাগ করলেন।

ধীরে ধীরে অনেকগুলো পদশব্দ বাগানের অপর প্রান্তে আলোছায়ার রহস্যের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল।

অদ্ভুত স্তব্ধ চারিদিক। মধ্যে মধ্যে কেবল মৃদু পত্রমর্মর ও একটানা একটা ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে।

মৃতদেহ ঠিক পূর্ববৎ বেঞ্চের উপরে উপবিষ্ট রয়েছে।

পকেট থেকে পেনসিল-টচটা বের করে টর্চের আলো ফেলে পায়ে পায়ে কিরীটী মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল।

মৃতার চিবুক স্পর্শ করে, মুখে টর্চের আলো ফেলে ক্ষণকাল সেই মৃত্যুনীল মুখখানার দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, সত্যিই বিষ সুব্রত।

শুধু বিষই নয়। এই যে বিষ-পাত্রও পেয়েছি! বলতে বলতে পকেট থেকে পেগ গ্লাসটা বের করে কিরীটীর সামনে এগিয়ে ধরলাম।

গ্লাসটা হাতে নিয়ে বার দুই ঘুরিয়ে দেখে নিম্নকণ্ঠে কিরীটী বললে, এ যে দেখছি সুরাপাত্র! মিত্রা সেনের কি সুরাসক্তি ছিল নাকি?

না, আমি কখনও দেখিনি এবং সকলে তাই বললেনও এখানে।

তাই তো মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা সুইসাইড নয় তো?

অসম্ভব বলে স্ত্রী-চরিত্রে কোন কিছুই নেই। তাই সে সম্ভাবনাটাও আমাদের চিন্তা থেকে বাদ দিতে পারব না। কিন্তু দীর্ঘদিন পরে জীবনে যার মধুযামিনী এমনি করের আসন্ন হয়ে উঠেছিল, কোন্ দুঃখে সে আত্মহত্যা করতে যাবে। তাছাড়া এ বিবাহে যখন দুজনেই মন দেওয়া-নেওয়ার পর্বটা সমাপ্ত করে অগ্রসর হয়েছিল তখন আচমকা এমনি করে আত্মহত্যাই বা একজন করতে যাবে কেন?

কিরীটীর কথাটা একেবারে যুক্তিহীন নয়।

কিরীটী আবার বললে,সে যাই হোক, এখানে মৃতদেহের কাছেই পেগ গ্লাসটা যখন পাওয়া গিয়েছে অবশ্যই তার একটা তাৎপর্য আছে। তা সে মিত্রা সেন কোনদিন ড্রিঙ্কে অভ্যস্ত থাকুন বা নাই থাকুন। তাছাড়া আরও একটা কথা এর মধ্যে ভাববার আছে। মিত্রা সেনের মত মেয়ে যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন তো এই বিশেষ স্থানটি ও সময় বেছে নিলেন কেন? তাঁর চরিত্রের ভ্যানিটির কথাটাও আমাদের ভুললে চলবে না।

কথাগুলো বলে কিরীটী চারপাশে আলো ফেলে ফেলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখতে লাগল। তারপর আবার ক্ষীণকণ্ঠে বললে, মৃতের চোখেমুখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন সুস্পষ্ট আছে বটে। তবে মৃতদেহের সহজ পশ্চার দেখে মনে হয় মৃত্যুর কারণ যে বিষই হোক না কেন, সেটা অত্যন্ত তীব্র ও দ্রুত কার্যকরী ছিল। আর খুব সম্ভবত ব্যাপারটা যা মনে হচ্ছে, যদি হত্যাই হয়ে থাকে, নিশ্চিন্ত বিশ্বাসেমিত্রা সেন হত্যাকারীর হাত থেকে বিষ গ্রহণ করে পান করেছিলেন। তারপর ভাববারও আর সময় পাননি, অবধারিত মৃত্যুকে বরণ করেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে হয় হত্যাকারী পূর্ব হতেই জানত আজ রাত্রে কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ে মিত্রা সেন এখানে আসবেন বা থাকবেন, না হয় তাঁরই পূর্ব পরিকল্পনা বা প্ল্যান মত মিত্রা সেনকে এখানে কোন এক সময় আজ রাত্রে আসতে হয়েছিল। পরের ব্যাপারটাই যদি সত্যি হয় তো বলতে হবে হত্যাকারী পূর্ব থেকেই বিষ নিয়ে প্রস্তুত ছিল।

কিন্তু একটা কথা কিরীটী–বাধা দিলাম আমি।

কি?

ধরেই যদি নেওয়া যায় যে, ঐ পেগ গ্লাসেই মিত্রা সেনকে বিষ দেওয়া হয়েছিল, তাহলে মদ ভিন্ন কি এমন পানীয় যা মিত্রা সেনকে বিষ মিশ্রিত করে হত্যাকারী তার হাতে তুলে দিয়েছিল।

হ্যাঁ, কথাটা অবিশ্যি ভাববার। তবে তারও পক্ষে তোর একমাত্র যুক্তি তো যে, মিত্রা সেনের ড্রিঙ্ক করার হ্যাবিট ছিল না, এই তো? কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবনে কখনও যে তিনি ড্রিঙ্ক করেননি বা করতে পারেন না, তারও তো কোন মানে নেই। দৈব কার্যকারণ বলে একটা কথা আছে, মানিস তো?

তা মানি। তাই যদি হবে তো সে এমন কেউ হওয়া দরকার যার দ্বারা সেটা হওয়া সম্ভব!

সে তো এখানেই কেউ হতে পারে।

মানে?

মানে এখানে সকলের সঙ্গেই তো তার ভাব ছিল, হৃদ্যতা—অর্থাৎ তোমার অশোক রায় থেকে শুরু করে বিশাখা চৌধুরী বা স্বয়ং মহারানী অফ সোনপুরও তো হতে পারেন। বলেই কিরীটী হেসে ফেললে, কিন্তু থাক সে কথা, স্বেচ্ছাকৃত বিষগ্রহণ যদি না হয় তাহলে নিশ্চয়ই সে সময় দ্বিতীয় কোনোনরনারীর সুনিশ্চিত এখানে আবির্ভাব ঘটেছিল। শুধু তাই নয়, ঐ সঙ্গে একটি কথা ভুললে চলবে না সুব্রত, মিত্রা সেনের বিবাহের দিন অসন্ন হয়ে এসেছিল এবং বর্তমানের অতি আধুনিক ইঙ্গ-বঙ্গ সোসাইটির সে ছিল অন্যতম। কিন্তু আর এখানে নয়। রাত অনেক হল, এবারে এখানকার ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়গণকে ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। পুলিসের হুমকি দিয়ে অনেক্ষণ তাঁদের আটকে রাখা হয়েছে। কি বলেন মিঃ লাহিড়ী?

এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে যেন নির্বাক দর্শকের মতই একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিঃ লাহিড়ী। একটি কথা বা একটি মন্তব্যও করেননি। কিরীটীর প্রশ্নোত্তরে মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, রাত অনেক হয়েছে, প্রায় সাড়ে এগারোটা।

চল্ চল্ সুব্রত। হলঘরে একবার যাওয়া যাক।