১৩. নানা জায়গা ঘুরিয়া

নানা জায়গা ঘুরিয়া সন্ধ্যাটা কাটাইয়া প্রদীপ তাহার মেসের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল কে একটা লোক তাহার বিছানার উপর উবু হইয়া পড়িয়া আছে। তিন সিটের ঘর—বাকি দুই জনের এত শীঘ্ন বাড়ি ফিরিয়া আসিবার কথা নয়। রমেন বাবু শহরের কি-একটা বায়স্কোপঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া টিকিট কুড়া, আর প্রতিনিধান রাত্রি করিয়া

কো-একট। কোচিং-ক্লাশে মোক্তারি পড়িতে যায়। তাহারা এই অসময়ে মেসে ফিরিয়া আসিলে ও কখনই প্রদীপের বিছানায় গড়াইতে সাহস করিত না। এ উহাদের চেয়ে শয্যা-বিলাস সম্বন্ধে উদাসীন বা অপরিচ্ছন্ন বলিয়া নয়, উহাদের সংশ্রব হইতে সে নিজেকে দূরে সরাইয়া রাখিত বলিয়া। তা ছাড়া ঘরের তালাই বা কে খুলিল, খুলিল ত’ কষ্ট করিয়া আলোটাই বা জ্বালাইল না কেন!

লণ্ঠন জ্বালাইবার সময় ছিল না; সাহস করিয়া আগন্তুকের গায়ে ঠেলা দিয়া কহিল,—“কে?”

লোকটি অনেকক্ষণ পরে সাড়া দিল। মুখ না ফিরাইয়া আন্দাজে উত্তর দিল : “প্রদীপ এলে?”

স্বর পরিচিত। এইবার পকেট হাতড়াইয়া দেশাই বাহির করিয়া তাড়াতাড়ি আলো জ্বালাইল। দেখিল, অজয়। জীর্ণ ময়লা কাপড় জামার মধ্যে নিজের শরীরটাকে শামুকের মত সঙ্কুচিত করিয়া পড়িয়া আছে। অজয়ের গলা শুনিয়া প্রদীপ যেমন সুখী হইয়াছিল, ভয়ও হইয়াছিল ততখানি। ভয় হইয়াছিল, অজয় বুঝি তাহার স্বাভাবিক। যৌবন-প্রমত্ততায় আবার কোথাও হঠকারিতা করিয়া বিপদে পড়িয়াছে; আর সুখী হইয়াছিল এই ভাবিয়া যে, তাহার আশ্রয়ে সে যখন একবার আসিয়া পড়িয়াছে, তখন তাহার কেশাগ্র স্পর্শ করিতে পারে এমন লোককে পৃথিবীতে প্রদীপ নিশ্বাস নিতে দিবে না। কিন্তু আলো জ্বালাইয়া অজয়ের এই শ্রীহীন কাতর চেহারা দেখিয়া প্রদীপ বিমর্ষ হইয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি অজয়ের গা ঘেঁসিয়া বসিয়া প্রদীপ জিজ্ঞাসা করিল,—“কি হ’ল অজয়? কোত্থেকে?”

একটা দুর্বল হাত দিয়া প্রদীপের বাহুটা চাপিয়া ধরিয়া অজয় কহিল,—“জান-ই ত’ লোকের সন্দেহ এড়াবার জন্যে একটা ভদ্রআস্তানা ঠিক রেখেছিলুম, আপাতত সেই আস্তানা থেকেই আসছি। ভীষণ জ্বর এসেছে।”

প্রদীপ ব্যাকুল হইয়া কহিল,—“জ্বর নিয়ে বাড়ি ছাড়লে কেন? কেউ তাড়া করেছিল না কি?”

ম্লান একটু হাসিয়া অজয় কহিল,—“এবার যে তাড়া করেছিল সে আমাদের সকল শত্রুর চেয়ে দুর্দম। তার কাছেই আমরা বার বার হেরেছি, বার বার হারব,—সে আমাদের ভাগ্য।”

অজয়ের চুলের মধ্যে হাত বুলাইতে বুলাইতে স্নিগ্ধস্বরে প্রদীপ কহিল,-“তোমার এই বড় দোষ অজয়, তুমি বড় ভাবুক। তুমি সোজা বুদ্ধিকে কল্পনা দিয়ে ঘুলিয়ে তোল। কি হয়েছে স্পষ্ট করে বলবে?”

প্রদীপের ঠাণ্ডা হাতখানি অজয় তাহার উত্তপ্ত গালের উপর চাপিয়া ধরিল; কহিল,—“ভাবুকতা না থাকলে কোনো পরাজয়, কোনো ব্যর্থতাকেই মহনীয় করে দেখা যায় না। সে-তর্ক তোমার সঙ্গে পরে করলেও চলবে। সোজা স্পষ্ট করেই বলছি। কিন্তু সব কথা স্পষ্ট করে’ বললে তার মানেটা সব সময়েই পরিস্ফুট হয় না, প্রদীপ। যেমন ধর, আমি যদি বলি, একটি মেয়ে আমার অনুগামিনী হ’ল না বলেই আমি অভিমানে বেরিয়ে পড়লাম—কথাটার আদ্যোপান্ত তুমি বুঝতে পারবে?”

প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“কথাটাকে যদিও এর চেয়ে স্পষ্ট করে’ বলা যেত, তবু এটুকুই আমার কাছে যথেষ্ট অর্থবান হয়ে উঠেছে। মেয়ে! আর আমাকে বলতে হবে না। রোগ শুধু তোমার গাত্রোত্তাপ নয়, অজয়।”

অজয় উচ্ছসিত হইয়া উঠিল : “হ্যাঁ জানি। এ আমার আত্মার উত্তাপ, প্রদীপ। কিন্তু মেয়েটি তাকে দেহের উত্তাপ বলেই ধরে’ নিল। তোমাকে স্পষ্ট করেই বলি তা হলে। দেখ কিছু করা যায় কি না।” বলিয়া অজয় তাহার মাথাটা প্রদীপের কোলের উপর তুলিয়া দিল। যেন আপন অন্তরের সঙ্গে কথা কহিতেছে, তেমনি মৃদু-গভীর

ও বেদনাগগদস্বরে বলিতে লাগিল,—“মেয়েটি বিধবা, নিরঙ্করা, অশ্রুমতী! আমাদের ব্রতচারিণী তপস্বিনী ভারতবর্ষ। কিন্তু হঠাৎ

একদিন তারই সেই ম্লান চোখে বিদ্যুৎ দেখতে পেলুম—বুঝলুম সে বিদ্রোহিনী। মনে মনে তাকে প্রার্থনার মত আহ্বান করেছিলুম হয় ত’, সে আচার ও কৃত্রিম লজ্জাশীলতার বেড়া টপকে আমার ঘরে চলে এল মৰ্ত্তাবতীর্ণা মৃত্যুর মত। দুই হাতে সেবা নিয়ে, চোখে নিয়ে করুণা! মনে রেখে প্রদীপ, রাত্রে এল—যে-মুহূর্তে কবির মনে কল্পনাকায়া কবিতার আবির্ভাব হয়। আমি তাকে বল্লুম, আমার হাত ধরে বেরিয়ে পড়, নমিতা।”

কথার মাঝখানে প্রদীপ হঠাৎ চমকাইয়া উঠিল : “নমিতা?”

অজয় বলিয়া চলিল : “আমাকে শেষ করতে দাও। বল্লম, নমিতা, আমার সঙ্গে এস। লাখো লাখো মেয়ে মরছে, সমাজে সংসারে অসংখ্য তাদের অত্যাচার। কেউ মরছে আচারের দাসত্ব করে’, কেউ সন্তানধারণ করে’-কেউ কেরোসিন জ্বালিয়ে, কেউ গলায় দড়ি দিয়ে। তুমি বীর-ভগ্নীর মত মরবে, এস।”

প্রদীপ আবার বাধা দিল : “নমিতা কি বলে?”

ম্লান বিদ্রুপের হাসি হাসিয়া অজয় কহিল,-“নুমিতার উত্তর শুনে তুমি হেসো না, প্রদীপ। ভাবলে আমি বুঝি ওকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাই তুচ্ছ দেহ-বিলাসের জন্যে। বললে : আপনি যে এত খারাপ তা আমি ভাবিনি। কথাটা মনের মধ্যে দাগ কেটে বসে আছে। পরে ভাবলুম, বাঙালি মেয়ের কাছ থেকে এর বেশি আর কী উত্তর আমরা প্রত্যাশা করতে পারি?”

প্রদীপ কহিল,—“ও! নমিতা তা হলে তোমার ভগ্নীপতির ভাই-ঝি হয়! কাছেই আছে তাহলে। আমি এতদিন ওর একটা ঠিকানা পৰ্যন্ত পাই নি। তোমার সঙ্গে দেখাও ত’ আজ প্রায় তিন বছর বাদে। প্রথম দেখা কবে হয়েছিল মনে আছে?”

—“আছে না? সেই চিতোরগড়ে, রাণা কুম্ভের জয়স্তম্ভের ওপরে! কিন্তু নমিতাকে তুমি চিন্‌লে কি করে?”

—“সেই জয়স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে চারদিকের অগণন পাহাড়ের দিকে চেয়ে তুমি কি বলেছিলে মনে আছে, অজয়? বলেছিলে তুমি অতীতে ছিলে জয়মল্ল, দুর্গ রক্ষা করতে গিয়ে: আকবরের হাতে প্রাণ দিয়েছ, পরে নতুন দেহ নিয়ে নতুন যুগে বাঙলা দেশে অজয় হয়ে জন্মিয়েছ। কথাটা ভাবুকতার চুড়ান্ত, কিন্তু সেই দিনই তোমার সঙ্গে বন্ধুতা না করে পারলুম না। তার পর দুই জনে ঝড় আর বিদ্যুতের মত সহযাত্রী হয়ে সমস্ত উত্তর-ভারতটা মথিত করে’ এলুম। আজ এত দিন বাদে তুমি আমার ঠিকানা পেলে কি করে?”

অজয় হাসিয়া কহিল, “তার চেয়েও বড়ো জিজ্ঞাস্য, তুমি নমিতাকে চিনলে কি করে?”

প্রদীপ বলিল,—“নমিতার স্বামী সুধীন্দ্র আমার সাহিত্যিক বন্ধু ছিল। রাণীগঞ্জে ও যখন মরে, তখন আমিই ওর পাশে ছিলাম।”

—“তোমার ঠিকানা আমি পেলুম অত্যাশ্চর্য্যরূপে, প্রায় সতেরোটা মেস্ খুঁজে। অত্যাশ্চর্য বলছি, কারণ তুমি যে এখনো কলকাতায়ই। আছ, তা আমি ভেবে নিলুম কি করে? মনে হ’ল এর আগে রাস্তায় একদিন যেন তোমাকে আমি দেখেছিলুম চিনে-বাদাম খচ্ছি। দিন সাতেক আগে হয় ত’। এখনো তোমাকে চিনে-বাদাম খেতে হয় নাকি? ভাবলুম দিব্যি বিয়ে-থা কবে’ ব্যথার সমুদ্র পার হয়ে এসেছ বুঝি।”

অজয়ের মুখে ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া প্রদীপ কহিল,—“আমার ইতিহাসটা এমন নয় যে তাকে আঁকজমক করে বর্ণনা করতে হবে। নমিতার সন্ধান পেলুম, ঐটা আমার একটা সম্পত্তি, অজয়। নমিতাকে আর হারাচ্ছি না।”

এইবার অজয় একেবারে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল; কহিল, “মেয়েমানুষ সব সাধনার বিঘ্ন, প্রদীপ—সে কবিতায়ই হোল্ক বা ধর্মাচরণেই হোক। আমার বিশ্বাস আর নেই। একাকী থাকবার মধ্যে সুখের চেয়ে সুবিধা বেশি। সে-বাড়িতে এতক্ষণে চিঢি পড়েছে নমিতা সংসারের চোখে কুলটার কলঙ্ক নিয়ে বিরাজ করবে—তবু কুলপ্লাবিনী হয়ে বেরিয়ে পড়বে না!”

—“তুমি বল কি, অজয়?”

—“বলেছি না, ভাগ্য! নমিতার ভাগ্য। আমাকে খারাপ বলে’ বর্জন করে সে তার শুদ্ধাচার সতীত্বের খাপে তার বিদ্রোহাচরণের তলোয়ার ঢেকে রাখছিল, এমন সময় শাসনকর্তার দণ্ড নিয়ে দিদির আবির্ভাব হ’ল। নমিতা পড়ল ধরা! আর যায় কোথা! নমিতা রাত করে’ লুকিয়ে পরপুরুষের দুয়ারে পসারিণী হয়ে এসেছে! সমস্ত মুখে কালি মাখিয়ে নমিতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তবু কালীর মত জেগে উঠতে পারল না। আমি ওকে প্রণাম করতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু এমন নমিতাকে শেষ পর্যন্ত আমি শ্রদ্ধাটুকু পর্যন্ত দিতে পারলুম না ভাই।”

এইবার প্রদীপ আর না-হাসিয়া থাকিতে পারিল না। অবোধ সন্তানকে মা যেমন সান্ত্বনা দেন, তেমনিভাবে কোলের উপর অজয়ের মাথাটাকে আস্তে আস্তে একটু একটু দোলা দিতে দিতে প্রদীপ কহিল,-“তুমি এত বেশি হঠকারী যে, ব্যগ্রতাকে সংযত করতে শেখনি। তোমার মত দ্রুত নিশ্বাস যে নিতে না পারে তাকে তুমি মৃত বলেই ত্যাগ কর—এটা তোমার বাড়াবাড়ি। প্রত্যেক পরিণতির পেছনে প্রচুর প্রতীক্ষা চাই। আমরা এই বলদৃপ্ত যৌবনের পূজায় কত অসংলগ্ন দিন-রাত্রির অঞ্জলি দিয়েছি, তার হিসেব রাখ? ঝড়ে আমি বিশ্বাস করি না, তার চেয়ে একটি স্থির-প্রশান্ত গভীর-নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নের আমি উপাসক। নমিতা সংসারেই বিরাজ করুক, সেখানে থেকেই  যদি তার গ্রন্থি ও শিথিল করতে পারে তবেই ভালো। তার জন্যে ও লাঞ্ছিত হোক, অপমানিত হোসেটা তার আশীর্বাদ।”

নিশ্বাস ফেলিয়া অজয় কহিল,—“আমিও তাকে সেই কথাই বলে এসেছি।”

—“সেইটেই সব চেয়ে বড় প্রার্থনা। আমার সঙ্গে তার যে একটা ব্যাপার ঘটে গেছে, সেটা তোমাকে পরে বললেও চল্‌বে। এখন তোমাকে কিছু খাওয়াই।”

অজয় কহিল,—ক্ষিদে আমার সত্যিই পেয়েছে। কিন্তু তোমার আছে কি যে খাওয়াবে? এই ত’ তোমার বিছানার চেহারা! সামান্য একটা বাক্সও তোমার আছে বলে মনে হচ্ছে না।” বলিয়া মাথা তুলিয়া অজয় ঘরের চারিদিকে একবার চাহিল।

প্রদীপ হাসিয়া বলিল,—“দুর্ভাগ্যবশত তোমার জ্বর হয়েছে বলে তোমাকে আজ খাওয়াতে পারব না বলে মনে হচ্ছে না। পকেটে দু’ আনা এখনো আছে বোধ হয়। তুমি একটু শুয়ে থাক। আমি সাবু আর মিছরি কিনে নিয়ে আসছি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *