১৩. দুঃসংবাদটা চাপা থাকে না

দুঃসংবাদটা চাপা থাকে না। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ-কান ও-কান হতে হতে সংবাদ সমস্ত ইন্দ্ৰালয়ে ছড়িয়ে যায়।

কিরীটীর অনুরোধে চৌবেজী ইন্দ্ৰালয়ে পুলিস-প্রহরা মোতায়েন করেছিলেন ইতিমধ্যে এবং নির্দেশ জারি করে দিয়েছিলেন তাঁর বিনানুমতিতে কেউ ইন্দ্ৰালয় ছেড়ে আপাততঃ যেতে পারবে না।

সকলকেই আপাততঃ নজরবন্দী থাকতে হবে। রীতিমত এক অস্বস্তিকর পরিবেশ।

উৎসব আরো কদিন হবার কথা ছিল, কিন্তু চিত্রাঙ্গদা দেবীর আকস্মিক মৃত্যু আততায়ীর হাতে হঠাৎ যেন সব কিছুর ওপর একটা পুর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছিল। আনন্দ-কোলাহল মুখরিত ইন্দ্ৰালয়ের ওপরে হঠাৎ যেন শোকের একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে।

উৎসব থেমে গিয়ে যেন একটা শ্মশান-স্তব্ধতা নেমে এসেছে ইন্দ্ৰালয়ের ওপর।

 

দুটো দিন আমনি করে কেটে গেল আরো।

কিরীটী মধ্যে মধ্যে এক-একজনকে আলাদা করে তার ঘরে ডেকে এনে আরো কিছু কিছু প্রশ্ন করেছে এবং সবাই জানতে পেরেছে কিরীটীর কথায়, পুলিস এবং তার ধারণা, বাইরের কেউ চিত্রাঙ্গদা দেবীর নৃশংস হত্যার জন্য দায়ী নয়।

হত্যা করেছে। চিত্রাঙ্গদা দেবীকে বাড়ির মধ্যে যারা সে-রাত্ৰে উপস্থিত ছিল, অর্থাৎ চিত্রাঙ্গদা দেবীর কোন আপনজনই, বিশেষ করে যাদের অন্দরে ও চিত্রাঙ্গদা দেবীর ঘরে অবাধ গতিবিধি ছিল।

কথাটা শোনা অবধি সকলেই যেন হঠাৎ কেমন বোবা হয়ে গিয়েছে। সকলেই পরস্পর মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছে সর্বক্ষণ। একের অন্যের প্রতি কেমন যেন সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের দিকে কেমন সন্দেহ নিয়ে তাকাচ্ছে।

কে—তাদের মধ্যে কে? কে হত্যা করল চিত্রাঙ্গদা দেবীকে?

জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্র ও জয়ন্ত, বিশেষ করে ওই পাঁচজন—পাঁচ ভাইয়ের মনেই যেন ওই কথাটা ঘুরে ফিরে উদয় হয়।

স্বাতীও তাকায় তার ভাইদের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে।

কে-কে হত্যা করল?

আর ওদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে সুধন্যও।

কেউ কারো সঙ্গে মন খুলে কথা পর্যন্ত যেন বলতে পারছে না, কথা বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে।

সবাই যেন নিজের নিজের মনের মধ্যে গুমরোচ্ছে। বিশ্ৰী অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতি।

সেদিন দুপুরে কিরীটী তার ঘরের মধ্যে বসেছিল, বাইরে ফণীন্দ্রর গলা শোনা গেল।

মিস্টার রায় আসতে পারি?

আসুন—আসুন! ডান পা-টা খোঁড়া ফণীন্দ্রর। ডান পা-টা একটু টেনে টেনে আস্তে আস্তে চলে সে। পা টেনে টেনে ফণীন্দ্র এসে ঘরে ঢুকল।

বসুন।

মিস্টার রায়!

বলুন?

এরকম করে তো আর পারছি না মিস্টার রায়—এই যে সৰ্বক্ষণ এক সন্দেহের দুঃসহ যন্ত্রণা-সত্যি বলছি, আর কাঁটা দিন এভাবে থাকলে হয়ত পাগল হয়ে যাব।

আমি তো আপনাদের প্রত্যেককেই বলেছি। ফণীন্দ্রবাবু, আপনারা যে যা জানেন—কোন কথা গোপন না করে অকপটে আমাকে জানতে দিন। তাহলে এভাবে আপনাদের কষ্ট পেতে হয় না। —আমিও ব্যাপারটার একটা মীমাংসায় পৌঁছতে পারি।

কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, সব কথাই আপনাকে অন্ততঃ আমি বলেছি।

না।

কি বললেন?

আপনি সব কথা বলেননি।

বলিনি!

না।

কি কথা আপনার কাছে আমি গোপন করেছি?

গোপন করেছেন সে-রাত্রে—মানে দুর্ঘটনার রাত্রে, রাত সোয়া নটা থেকে রাত পৌনে। এগারোটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন, কি করেছিলেন।

আমি তো আমার ঘরে ঘুমিয়েছিলাম। ওই সময়টা।

না।

হ্যাঁ, আপনি বিশ্বাস করুন—

বিশ্বাস আমি করতে পারছি না।

পারছেন না?

না।

কেন?

কারণ রাত দশটা নাগাদ আপনাকে আমি গানের আসরে দেখেছি।

না না, মানে০০

অস্বীকার করবার চেষ্টা করছেন কেন? আমি আপনাকে দেখেছি—বলুন, সেরাত্রে আসরে আপনি যাননি?

হ্যাঁ—গিয়েছিলাম, বড়ে গোলাম আলি যখন গান ধরেন।

হ্যাঁ, রাত ঠিক দশটায়—আমার মনে আছে তিনি গান ধরেছিলেন।

হ্যাঁ, মিস্টার রায়, অস্বীকার করব না-গিয়েছিলাম। আমি। কিন্তু শরীরটা ভাল না থাকায় একটু পরে চলে আসি।

তাহলে আপনি যে বলছিলেন, সেদিন সন্ধ্যা থেকে আপনাকে ডাকা পর্যন্ত আপনি ঘরে শুয়েছিলেন, সত্যি নয়?

ফণীন্দ্র মাথা নীচু করে।

কথাটা আপনি সেদিন স্বীকার করেননি কেন?

ভয়ে। কিন্তু, আপনি বিশ্বাস করুন, বড়মাকে খুন আমি করিনি। কেন করব—কি স্বার্থ থাকতে পারে আমার?

সেকথা যদি বলেন তো স্বাৰ্থ আপনার আছে বৈকি।

স্বাৰ্থ আছে? কি স্বাৰ্থ? বড় বড় চোখ করে তাকায় ফণীন্দ্র কিরীটীর চোখের দিকে।

প্রথমত ধরুন, বড়মার মৃত্যু হলে আপনি নিয়মিত মোটা একটা মাসোহারা পাবেন তঁর উইল অনুযায়ী। অন্যান্য সম্পত্তির ভাগ ছাড়াও—আর সব চেয়ে বড় কথা, দিবারাত্র বড়মার মুখের দিকে চেয়ে তাঁর ভয়ে জুজুর মত থাকতে হবে না—এই বন্দী-জীবন কাটাতে হবে না-এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন।

যন্ত্রণা থেকে মুক্তি!

নয়? ভেবে দেখুন, আপনারা প্রত্যেক ভাইবোনেরাই কি আপনাদের বড়মার প্রতি, নিরন্তর শাসন আর বিধিনিষেধ, সৰ্ব্বক্ষণ তাঁর শাসনের ঝাপটা সয়ে সয়ে ভেতরে ভেতরে হ্যাঁপিয়ে ওঠেননি? মানুষ তো কেবল মাথা গোঁজবার একটা ঠাই ও সেই সঙ্গে দু-বেলা নিশ্চিন্ত আহার কিংবা খানিকটা অর্থের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিশ্চিন্ততা নিয়েই তাঁর জীবনের যা কিছু কাম্য পেয়ে যায় না বা তার মনটা সব দিক দিয়ে ভরে ওঠে না।–তার সব অভাব অভিযোগ মিটে যায় না। সে চায়—শুধু সে কেন, প্রতিটি মানুষই চায়, তার ব্যক্তিস্বাধীনতা সবার ওপরে; এখানে সকল প্রকার স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামের মধ্যে থেকেও সেই স্বাধীনতাটুকুর–অভাবেই কি আপনার প্রত্যেকে দিনের পর দিন এই ইন্দালয়ের দেওয়ালে মাথা কুটে। মরেননি? এই চার দেওয়াল থেকে মুক্তি চাননি?

চেয়েছি—চেয়েছি মিস্টার রায়-প্রতি মুহুর্তে চেয়েছি। কিন্তু—হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ফণীন্দ্র বলে ওঠে।

তার চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠে।

কিরীটী বাধা দিল, কিন্তু পারেননি-এই বন্দীশালার চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে যেতে পারেননি। কারণ এখানকার এই স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম দিনের পর দিন যেমন করে খাঁচায় পাখির ডানাকে অনভ্যস্ত থাকায় অবশ করে দেয়, আপনাদের ঠিক সেই অবস্থা হয়েছিল বলে।

তবু-তবু মাঝে মাঝে মনে হয়েছে —

বের হয়ে পড়েন, তাই না? তবু পারেননি। কারণ পা দুটোই যে আপনাদের অরশ হয়ে গিয়েছিল, তাই নয়? চৌকাঠ ডিঙোবার জন্য মনের যে সাহসের দরকার, সে সাহসের মেরুদণ্ডটাও ভেঙে দিয়েছিলেন আপনাদের ওই বড়মা। আর সেই অক্ষমতা ক্রমশ আপনাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যে বড়মার প্রতি যে একটা প্রচণ্ড ঘৃণা, পুঞ্জীভূত করে তুলেছিল, তাতে করে কেবলমাত্র আপনি কেন, আপনাদের চার ভাইয়ের মধ্যে যে কারুর পক্ষেই চিত্রাঙ্গদা দেবীকে হত্যা করা শেষ পর্যন্ত আদৌ অসম্ভব ছিল না।

ফণীন্দ্ৰ যেন বোবা হয়ে যায়। সে মাথা নীচু করে বসে থাকে।

যে আমি বুঝিনি তা নয়। ফণীন্দ্রবাবু—মানুষ সহ্যের শেষ সীমাটুকু যখন অতিক্রম করে যায়, আমি জানি, তখন সে মরীয়া হয়ে ওঠে—আর তখন তার পক্ষে কোন কাজই অসাধ্য থাকে क्रा।

কিরীটীবাবু!

বলুন?

সত্যিই কি আপনি–

কি?

মনে করেন আমাদের মধ্যেই কেউ–

এই বাড়ির মধ্যে সে-রত্রে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যেই একজন।

কে?

আপনিই ভেবে দেখুন না কে হতে পারে!

ফণীন্দ্ৰ অতঃপর হঠাৎ যেন চুপ করে গেল। একটু পরে যেন কেমন চোরের মত নিঃশব্দে ফণীন্দ্র ঘর থেকে বের হয় গেল।

কিরীটী চেয়ে থাকে তার গমনপথের দিকে।

ডান পা-টা টেনে টেনে ফণীন্দ্র ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এসেছিল একটা প্রতিবাদ জানাতে, এখন যেন ভীত চোরের মত মাথা নীচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।