১৩. ডাক বাংলোয়

সার্কিট হাউজে কামরা খালি নেই। ডাক বাংলোয় পাওয়া গেল। ঠিক তখন সন্ধে। দোতলার একটা ঘর খুলে দিল চৌকিদার। জাহেদা বলল, এত টায়ার্ড লাগছে।

লাগবে না? কতদূর এসেছে। গাড়িতে একভাবে বসেছিলে।

বাতি জ্বালালো চৌকিদার। দুটো খাট। একটা ড্রেসিং টেবিল। তার ওপরে কবেকার একটা মেঘলা গ্লাশ পড়ে আছে। ঘরে ঢুকে জাহেদ, যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। একবার শুধু উচ্চারণ করল, এই ঘর?

হ্যাঁ। এক্ষুণি সব ঝেড়ে মুছে ঠিক করে দিচ্ছে; চৌকিদার ভাল করে বিছানা করে দিও। কম্বল দিও। পরিষ্কার সব চাই। একেবারে পরিষ্কার! মেমসাহেব যেন পছন্দ করেন। বুঝেছ?

হ্যাঁ। সে বুঝেছে। সে এক্ষুণি সব গুছিয়ে দিচ্ছে। গরম পানি আগে চাই? কইরে পানি গরম কর। না, এখানে তো খাবার ব্যবস্থা এখন করা যাবে না। কাল হতে পারে। আজ বাইরে থেকে খাবার এনে দিক সে। আচ্ছা, আপনাদের মর্জি, বাইরেও ভাল ভাল হোটেল আছে। সকালে কি নাশতার ব্যবস্থা করব? ডিম কেমন খাবেন, পোচ, ওমলেট?

জাহেদাকে বাবর বলল, গরম পানি হলেই হাত মুখ ধুয়ে চল কোথাও থেকে খেয়ে আসি। চটপট। তুমি বেরুলে আমিও মুখটা ধুয়ে নেব।

অন্য কিছু ভাববার অবকাশ দিতে চায় না বাবর। ঝড়ের মত কথা বলে চলে। চৌকিদারকৈ আরেকটা তাগিদ দিল গরম পানির জন্যে। একবারও সে জাহেদার দিকে তাকাল না। চৌকিদার বাইরে গেলে বাবর বলল, আমি আসছি। সিগারেট নিয়ে আসি।

বাইরে এসে চৌকিদারকে ধরল সে। বলল, কম্বল একটাই দিও। কেমন? আর একটা আমাদের আছে।

অন্ধকার মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় এলো বাবর। ফুটপাথে অসংখ্য দোকান বসে গেছে। হারিকেন, হ্যাজাক, বিজলী বাতি আর মানুষের কণ্ঠস্বরে গমগম করছে সন্ধ্যাটা। বাবর দুতিন দোকান ঘুরে অবশেষে একটাতে তার সিগারেট পেল। জিগ্যেস করল। এখানে খাবার ভাল রেস্তোরাঁ আছে? নাম ঠিকানা শুনে নিল তার কাছ থেকে। তারপর ধীর পায়ে ফিরে এলো বাংলোয়।

দেখে, জাহেদা ঘরে নেই। ধক করে উঠল তার বুকের ভেতরে। তারপর হেসে ফেলল, জাহেদা তো বাথরুমে। পানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বসে বসে আরো দুটো সিগারেট শেষ করল সে। সব তার ভেবে ঠিক করা আছে। যেন একটা নাটকে দীর্ঘদিন মহড়া দিয়ে আজ মঞ্চে নেমেছে। পার্ট মনে আছে সব, তবু কেমন যেন একটা উদ্বেগ হচ্ছে থেকে থেকে।

বাথরুম থেকে বেরুল জাহেদা। বেরিয়ে তাকে দেখেই থমকে গেল যেন। তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল আয়নার দিকে। চুল ঠিক করতে লাগল। বাবর জানে এখন কোনো সংলাপ নেই। এখন শুধু মঞ্চে নিঃশব্দে পদচারণা। সে ভেতরে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। জাহেদার তোয়ালে দিয়ে ঘষে ঘষে মুছল মুখ, একবার চেপে ধরে সুগন্ধি নিল। আয়নায় নানা রকম মুখভঙ্গি করে মুখের জড়তা ভাঙ্গল। তারপর বেরিয়ে এলো।

জাহেদা শাদা একটা পুলওভার পরে নিয়েছে। আয়নার সামনে তখনো নিজেকে দেখছে সে। নিঃশব্দে। অতি ধীরে। আর চৌকিদার বিছানা করছে। নিজের সুটকেশ থেকে কর্ডের জ্যাকেটটা বের করে গায়ে চড়াতে চড়াতে বাবর বলল, চল, চল।

বলে সে বাইরে এসে দাঁড়াল। জাহেদা যেন একযুগ পরে এলো।

চল, শহরটা ঘুরে আসি। খেয়েও নেব। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে হাত পা ভেঙ্গে আসছে যেন।

কথাটা মিথ্যে। বাবর এখন ছাত্রীসেনার মত সতেজ, প্ৰস্তুত, অস্থির।

কিন্তু ফল হলো। জাহেদা মুখ খুলল।

আবার এখন গাড়ি চালাতে চান?

না। রিকশা নেব।

তখন সিগারেট কিনতে যাবার সময় মাঠে একটা ছোট্ট বাঁধান নালা দেখেছিল বাবর। প্ৰায়

পা পড়ে মাচকাচ্ছিল। আর কী। সেখানে এসেই চটু করে জাহেদার হাত ধরে বলল, সাবধানে।

তারপর হাত ছাড়ল না। গেট পর্যন্ত ঐ ভাবেই হাঁটল। গেটের কাছে এসে জাহেদা নিজেই হাত ছাড়িয়ে নিল। মুখে বলল, এত ভিড়।

এইতো বেচাকেনার সময়।

কথাটা বলেই বাবর বুঝল, আরো একটা অর্থ হয় এর। কে জানে জাহেদা তাই বুঝল কিনা। জাহেদা আর কিছু বলল না। রিকশায় উঠে বসল। ওরা। ঊরুতে ঊরু লাগল। বাবর টের পেল জাহেদা একবার ছাড়াতে চেষ্টা করল সন্তৰ্পণে, কিন্তু পারল না। মনে মনে হাসল বাবর। মুখে বলল, রিকশা, নবাবগঞ্জের দিকে চল।

এর আগে কখনো কোনো মফঃস্বল টাউনে এসেছ?

না। জাহেদা তাকে অবাক করে দিয়ে হাসল। এখন হাসিটা আশা করেনি বাবর। জাহেদ আরো বলল, দেখার মধ্যে ঢাকা আর চাটগাঁ।

তোমার জন্ম কোথায়?

ঢাকায়। আপনার?

বর্ধমানে। আর সেখানে যাওয়া হবে না। এখন আর আপন-পর বুঝি না। যেখানেই যাই সেই আমার দেশ।

সাইকেলের দোকান, কবিরাজি ওষুধের দোকান, বই, মনোহারি জিনিস, কাপড়-চোপড়, ছোট ছোট চায়ের আড্ডা, হা করা অন্ধকার সব গলির মুখ। কোথায় যেন কাঁসর বাজছে। সুম সুম করছে। হ্যাজাকের আলো। হা হা হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। পুরনো পুরনো সব দালানের পলেস্তারা ওঠা থাম চারদিকে। একটা বাদুড় উড়ে গেল। আকাশে অনেকগুলো তারা ঝিকিমিক করছে।

বাবর বলল, এখানে একটা জিনিস লক্ষ করছ। প্রত্যেক দোকানে, রাস্তার মোড়ে আড্ডা হচ্ছে। এখানকার মানুষগুলো বোধ হয় খুব আড্ডাবাজ। মনে হচ্ছে, সারা শহরে আড্ডা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিষয় নেই।

জাহেদার গা থেকে মাঝে মাঝে একটা মিষ্টি গাঢ় ঘ্রাণ দিচ্ছে।

অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াল ওরা। তারপর সিগারেট কিনে শোনা সেই রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করল। বড় রাস্তার ওপর একটা সরু প্যাসেজের মুখ। সেটা দিয়ে ঢুকলে ডান দিকে একটা বড় ঘর। জানোলা দিয়ে চোখে পড়ল নীল চুনকাম করা দেওয়াল। রেডিও বাজছে রংপুর ষ্টেশনে। এককোণে চারজন তরুণ চায়ের কাপ নিয়ে জটলা করছে। তাদের ঢুকতে দেখে হঠাৎ সব চুপ হয়ে গেল। মাথা নামিয়ে নিল সব এক সঙ্গে। তারপর একে একে মাথা তুলে একেবারে সরাসরি তাকিয়ে তাদের দেখতে লাগল।

মজা লাগল বাবরের। বলল, ভাগ্যিস এরা টিভি দেখতে পায় না এখানে। এর জন্যে ঢাকায় কোথাও বসতে পারি না।

আসবার সময় আরিচা ফেরিতে কয়েকজন আপনাকে চিনেছিল।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, আপনার নাম বলছিল।

খেয়াল করিনি। কী খাবে? কিছুই নেই। মফঃস্বল তো কিছু পাবে না। বিরিয়ানি খাও। এ ছাড়া–

যা আপনার খুশি বলুন। আমার একেবারে ক্ষিদে নেই।

আসলে এখন দরকার ছিল গরম সুপ। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

হ্যাঁ। ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ।

চল, খেয়েই বাংলোয় যাব।

খেতে খেতে হঠাৎ জাহেদা একবার বলল, শারমিন আর পাপ্পু খুব আরাম করে বিছানায় শুয়ে আছে।

তোমার রুমমেট?

হ্যাঁ, ওরা কি স্বপ্নেও জানে আমি এখন এখানে?

কোনোদিন জানবেও না। বাবর প্রশস্ত হেসে বলল।

তখন কী যেন কথাটা বলছিলেন? অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝখানে, কী যেন?

অতীত আর ভবিষ্যতে মাঝখানে তুমি আছ, যেখানে আগেও ছিলে, পরেও থাকবে। অর্থাৎ সব সময়ই বর্তমান, জাহেদা। বর্তমানটাই আমরা একমাত্র চাক্ষুস করি। অসংখ্য বর্তমানের একটি মালা এই জীবন।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাটতে ওরা সেই মন্দিরের কাছে এলো যেখানে কাঁসর বাজছিল। এখন সেখানে গান হচ্ছে। একটা তালপাতার মত লোক, মাথায় একরাশ কোঁকড়ান বাবরি, পরনে হলুদ ধুতি, গায়ে লাল ছোপান গেঞ্জি, কপালে চন্দনের ফোঁটা দুহাত তুলে গান করছে। চারদিকে মেয়ে পুরুষে গোল হয়ে ভক্তিমন্ত্র মনে বসে আছে। জাহেদা অবাক হয়ে শুনতে লাগল। তন্ময় হয়ে শুনতে লাগল সে। লোকটা বলছে। —

তোমার স্বৰ্ণসীতা কি কথা বলতে পারে? না। সে কি চোখে দেখতে পারে? না, তাও পারে না। সে কি কানে শুনতে পায়? না, সে কানেও শুনতে পায় না। সঙ্গে সঙ্গে মৃদঙ্গে একটা রোল পড়ল। লোকটা দুহাত তুলে ঘুরতে ঘুরতে এবার সুরে গেয়ে উঠল, তবে চাই না, চাই না।

আমি স্বর্ণসীতা চাই না। স্বর্ণসীতা কী, জিগ্যেস করবার জন্যে জাহেদা ফিরে তাকাতেই টের পেল বাবর তার একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে শরীরের পেছনে যে উষ্ণতা তাকে জড়িয়েছিল তা বাবরের। জিগ্যেস করা আর হলো না। কেবল বলল, চলুন।

চল।

নিঃশব্দে পায়ে হেঁটে বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানপাটের, থমথমে দরোজাগুলোর সমুখ দিয়ে তারা বাংলোয় এসে পৌঁছুল। আবার সেই মাঠের মধ্য নালাটার কাছে এসে বাবর তার হাত ধরল। হাত ধরে পার করে দিল তাকে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

জাহেদা বলল, একটা বাতি নেই।

বাবর কিছু বলল না। শুধু হাসল। ঠিক হাসিও নয়, হাসির একটা তরঙ্গ মাত্র। কেমন একটা উদ্বেগ তার ভেতরে এখন হঠাৎ বড় হচ্ছে, কেন হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না।

জাহেদাই বলে চলল, আমাদের হোস্টেলেও এ রকম হয়। হঠাৎ হঠাৎ চুরি হয়ে যায়। কে চুরি করে কে জানে?

নিঃশব্দে ঘরের দরোজা খুলল বাবর। জাহেদা কথা বলেই চলেছে।

একদিন অন্ধকারে প্রায় গড়িয়ে পড়েছিলাম সিঁড়িতে। বাঁ পায়ের গোঁড়ালিটা মচকে গিয়েছিল। সারারাত কী ব্যথা! পাপ্পু তেল মালিশ করে দিয়েছিল। ও জানেন, খুব সেবার হাত ওর। কার কোথায় মাথা ধরেছে, কার গা গরম, কে তরকারি পছন্দ নয় বলে খায়নি, কার বাড়ির চিঠি পেয়ে মন খারাপ-সব পাপ্পু সামলাচ্ছে।

জাহেদা কথা বলছে আর বাবর ওদিকে কখনো একটু হাসছে, কখনো তাই নাকি বলছে আর বিছানা ঠিকঠাক করছে চটপটে দুহাতে। একবার শুধু ছোট্ট করে বলল, পুলওভারটা খুলে বস। কম্বলের নিচে চাদর দিয়ে দিয়েছি।

জাহেদা পুলওভার খুলতে খুলতে বাধ্য বিনীত ভঙ্গিতে কম্বলের তলায় পা চালান করে চুলে একটা ঝাড়া দিয়ে ঠেস দিয়ে বসল। আর এই সৰ্বক্ষণ বলে চলল কথা।

পাপ্পুকে তো দেখেননি? একদিন আলাপ করিয়ে দেব। রাঙ্গামাটির মেয়ে। তেমনি চ্যাপ্টা নাক, চওড়া মুখ, হলুদ রং; কিন্তু ভারি মিষ্টি। জানেন ওরা বৌদ্ধ। আমাদের সবাইকে বলেছে ওদের ওয়াটার ফেষ্টিভ্যাল হয়, এবার নিয়ে যাবে দেখাতে। খুব নাকি মজা হয়। ভরা পূর্ণিমা রাতে নাচ হয়, গান হয় পুজো হয়। আচ্ছা, বৌদ্ধারা কি হিন্দু?

না।

তাহলে ওরা পুজো করে যে। একটু অন্যমনস্ক দেখাল জাহেদাকে। তারপর হেসে আবার তুবড়ি ফোঁটাতে লাগল, আমার কিন্তু ভালই লাগে। আমি অবশ্য কোনোদিন পুজো দেখিনি। আমার বাবা জানেন, আমাকে ইংরেজি পড়িয়েছে বটে বিস্তু ভারি গোঁড়া। আমাদের কোথাও নিয়ে যায়নি। কোনো একটা কিছু করতে গেলেই হা হাঁ করে ওঠেন। তুলার মুখে সৰ্বক্ষণ গোল গেল লেগে আছে। পারেন তো ছেলেমেয়েকে একেবারে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখেন। একবার জানেন কী হলো–আজকাল তো ওড়না পরে না, শুধু কামিজ পাজামা। তাই পরে বাড়ি গেছি, বাবার তো চক্ষুস্থির। রাগে হার্টফেল করেন আর কী? মাকে বললেন, মেয়ের জন্ম দিয়েছ, আদব কায়দা নামাজ রোজা শেখাতে পারনি? জান, ছেলেমেয়ের দোষে বাপ-মাকেও দোজখে যেতে হয়? আচ্ছা বলুন তো, যেতে হয় নাকি? বাবর সেই কখন, আরাম চেয়ারটা টেনে, তার ওপর গা এলিয়ে বসেছে। একদৃষ্টি তাকিয়ে জাহেদার দিকে। জাহেদার একটা কথাও কানে যাচ্ছে না তার; কেবল জাহেদার জীবন্ত, বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার দূরান্ত মুখখানা সমস্ত অস্তিত্ব, বস্তু এবং বিশ্ব জুড়ে আছে। জাহেদা এবার থামতেই কুয়াশার মত হাসল বাবর। জাহেদাও হঠাৎ চুপ হয়ে গিয়ে নিম্পলক তাকিয়ে রইল তার দিকে। একটি যুগ যেন অতিবাহিত হয়ে গেল। সে নিজেই মনে করতে পারল না। এতক্ষণ একতাড়া কী বলছিল সে। ভীষণ অপ্ৰস্তুত হয়ে হঠাৎ সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করল। বলল, কম্বল একটা যে! কিম্বল? বাবর হাসিতে মধুর হয়ে উঠল। উত্তর দিল, মফঃস্বলের ডাকবাংলো কম্বল এদের একটাই আছে। ঢাকা থেকে আনা উচিত ছিল। কে জানে। এখানে এত শীত।

এত শীত কেন এখানে?

হিমালয়ের কাছে যে। এইতো, চোখ তুলে তাকালেই হিমালয়।

আপনার শীত করবে না? জাহেদা উদ্বিগ্ন চোখে প্রশ্ন করল।

নাহ। চলে যাবে। রাত অনেক হয়েছে তুমি ঘুমোও। সারাদিন পথ চলে ক্লান্ত তুমি।

বলে সে জাহেদার কাছে এসে তার বুক পর্যন্ত কম্বল টেনে দিল গুঁজে দিল, চারপাশে। যখন ওপাশে গুঁজে দিচ্ছিল তখন তোরণের মত বাঁকা তার দেহের নিচে ঢাকা পড়ে গেল জাহেদা। সোজা হতেই দেখল জাহেদা বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে ততক্ষণে। কিন্তু চোখ খোলা। কাজল একজোড়া চোখ টলমল করছে। চোখের শাদায় শিরাগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার। আর খাড়া নাকের নিচে সোনালি রোম, যেন কিছু ফুলের রেণু লেগে আছে ওখানে। শিরশির করে উঠল বাবরের শরীর। সে আবার আরাম চেয়ারে এসে বসল। বলল, ঘুমোও।

আপনি?

আমি কিছুক্ষণ বসে থাকব।

বলে বাবর আরো একটা সিগারেট ধরাল। জাহেদা কী ভেবে একটু পর চোখ বুজল। তখন একেবারে অন্য একটা মেয়ে বলে মনে হলো। সে একটু সোজা হয়ে বসতেই চেয়ারে ক্যাচ করে একটা শব্দ উঠল। চোখ খুলল জাহেদা। তাড়াক করে উঠে বসে কম্বলটা পা পর্যন্ত ঠেলে দিয়ে বলল, এ হতে পারে না। আপনি কী গায়ে দেবেন? তাকে উঠতে দেখে বাবরও নিজের অজান্তেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। এখন সে হেসে ফেলে বলল, আমার জন্যে ভাবতে হবে না। তুমি ঘুমাও তো।

না।

দ্যাখ, দুষ্টুমি করলে কিন্তু আমি বকব।

আমার ঘুম আসবে না।

আসবে, চেষ্টা করলেই আসবে। শুয়ে পড়।

জাহেদা কম্বলের দিকে চোখ ফেলে চুপ করে রইল।

কথা শুনতে হয় জাহেদা। তুমি ঘুমোও। আমার তেমন কিছু ঠাণ্ডা লাগছে না। সোয়েটার আছে। একটা চাদর এই যে। এতেই চলে যাবে।

জাহেদা একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার তেমনি গোয়ারের মত বসে রইল। বাবর দাঁড়িয়ে আছে বলে জাহেদাকে ওপর থেকে দেখছে। চিবুকটা সরু লাগছে। কোমল একটা ত্রিভুজের মত মনে হচ্ছে। ত্রিভুজটার খাড়া নিচে তার দুই ঊরুর সংযোগ বিন্দু। সেটা চোখে পড়তেই বাবরের আরেকবার মনে হলো, কী দীর্ঘ, কী ক্লান্তিকর এইসব প্রস্তুতি। মুখে কিন্তু অন্য রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল সে। এক টুকরো বাঁকা হাসি। ধাক্কা দিয়ে হাসল সে একটু। হাসতে হাসতে বলল, বোকা মেয়ে, এক কম্বলে দুজনের হয়? নাও, শুয়ে পড় দেখি।

হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল জাহেদা। সুবোধ মেয়ের মত নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল পাশ ফিরে; পা থেকে মাথা পর্যন্ত কম্বল টেনে দিল নিজেই। নীল জামা পাজামা, ফোলান লালচে চুল, পরিচ্ছন্ন ঘাড়, সব ঢাকা পড়ে তাকে দেখাল একটা বৃহৎ জান্তব্য পোস্টাল পার্সেলের মত।

বাবর ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ। হঠাৎ করে মাথার ভেতরে সব শূন্য হয়ে গেছে যেন। অনিশ্চিতভাবে এদিক ওদিক সে তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে শরীরের মধ্যে টের পেতে শুরু করল একটা অস্থির স্রোত সরু হতে হতে নিচের দিকে নেমে আসছে। যতই নামছে জ্বালা বাড়ছে তত। সেতারে ঝালার মত তীব্র সেই অনুভূতি। বাবর নাভির নিচে হাত রাখল, চেপে ধরল এবং তখন তার মনে পড়ল। অনেকক্ষণ বাথরুমে যাওয়া হয়নি। এখন সেটা ফেটে বেরুতে চাইছে।

সন্তৰ্পণে বাথরুমের দরোজা খুলে ঢুকল সে। ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল সন্তৰ্পণে। স্যাঁতস্যাঁতে হলুদ দেওয়াল যেন চেপে এগিয়ে এলো চারদিকে। শীত করতে লাগল হঠাৎ।

নিঃশেষে ভারমুক্ত হলো বাবর। টোকা দিয়ে শেষ বিন্দুটা পর্যন্ত ঝরিয়ে দিল। পানি দিতেই ছ্যাত করে উঠল ঠাণ্ডাটা। প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল বাবর। নিজেকে সামলে নিল। দেখল কেমন দ্রুত গুটিয়ে আসছে ওটা; রং শ্যামল থেকে কালো, কালো থেকে ঘন কালো হয়ে গেল, এখন তাকে দেখাল কোনো পুরনো বাড়ির সদর দরোজায় বেরিয়ে পড়া মড়চে ধরা বড় একটা ইস্কুরুপের মত। জাহেদার আকাশ-নীল তোয়ালে দিয়ে আবৃত করে মুছল সে। তোয়ালের নরম সুতোয় শুষে নিল সমস্ত সিক্ততা। এখন সেটাকে দেখে বাবরের মনে হলো মিটিমিটি হাসছে।

তারপর আয়নায় আবার ভাল করে মুখ দেখে, মাথার চুল টেনে টাক ভাল করে একপ্রস্থ ঢেকে বেরিয়ে এল আগের মতই সন্তৰ্পণে। দরোজা লাগিয়ে ঘুরে দেখে জাহেদা এখন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, তেমনি কম্বলে ঢাকা, নিতম্বের নিচে দুপায়ের ফাঁকে সৃষ্টি হয়েছে একটা দীর্ঘ উপত্যকা, একগুচ্ছ চুল বেরিয়ে আছে বালিশে।

বাবর টের পেল, জাহেদা এখনো ঘুমোয়নি।

সে এবারে তার নিজের বিছানায় বসল, সাবধানে ধীরে, ধীরে। মাত্র একাগজ দূরে জাহেদার বিছানা। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। কী অসীম দূরত্ব। কিম্বা কাছেই, মাঝে একটি স্তব্ধতার পাহাড়। বাবর কান খাড়া করে বাইরের শব্দ শোনার চেষ্টা করল। তখন কানে এলো দূরে কোথাও কারা কথা বলছে, একটা রিকশা টুনটুন করে চলে গেল, কুকুর ডাকছে দীর্ঘস্বরে। জাহেদা পড়ে আছে, যেন একটা মৃতদেহ। যেন এতটুকু প্ৰাণের লক্ষণ নেই তার আচ্ছাদিত দেহে। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে রইল বাবর। দ্রুত নিঃশ্বাস পড়তে লাগল তার। এত শব্দ হতে লাগল যেন জাহেদা শুনতে পাবে। প্ৰাণ পণে সে নিঃশ্বাস শাসন করতে লাগল। ফলে দেহের আধোভাগে উত্তাপ আরো দ্বিগুণ দ্রুততায় বৃদ্ধি পেতে লাগল তার। পায়ের উপর পা দিয়ে বসল সে।

হাঃ ফিরোজ মাজমাদার বলে কিনা, ভালবাসা না হলে তার জমে না। আজ বিকেলে রংপুরের পথে জাহেদাকে সে যা বলেছে তা শোনা উচিত ছিল তার। নিজেই চমৎকৃত হলো ভেবে-ভালবাসাকে কাঁঠাল বলেছে। কথাটা তখনি মাথায় এসেছিল। এর চেয়ে চমৎকার করে আর দেখান যেন না ভালবাসার আকাশ-প্ৰমাণ মিথ্যেটাকে। হাঃ।

তবে হ্যাঁ, আমি বাছাই করি, আমার পছন্দ-অপছন্দ আছে। সবার সঙ্গেই শুতে হবে নাকি? বাজারের সব জামা কি পছন্দ হয় আমার? দশটার মধ্যে একটা কিনি। তার কাপড় পছন্দ হতে হবে, বুনোন ভাল হওয়া চাই, রং পছন্দ হওয়া চাই, ছাঁট ভাল লাগা চাই। তবে তো? এমন রংয়েরও জামা আছে বিনি পয়সায় দিলেও আমি ছুঁয়ে দেখব না। মাজমাদারকে এক সময় বলবে সে। দেখি সিঙ্গি মাছটা জবাব কী দেয়?

আরো একটু এগিয়ে বসল বাবর। কোনোমতে কেবল পেছনটা তার ছয়ে রইল খাটোয় প্ৰান্ত। সে জানে, একটু পর ওখানে একটা গভীর সরল রেখা পড়ে যাবে। অবশ হয়ে আসবে। শেষে ঝিনঝিন করে উঠবে। তবু ঐ কষ্টকর ভঙ্গিতে বসে রইল সে, বসে রইল জাহেদার উপুড় হয়ে থাকা অস্তিত্বের দিকে অপলক তাকিয়ে।

হঠাৎ আরো একটা তুলনা মাথায় এলো তার। আদিম কালে মানুষ যখন অরণ্যচারী ছিল, পাথরের বল্লম নিয়ে শিকার করত, তখন কী তার একপাল শ্বাপদের মধ্যে এটিকে পছন্দ হয়ে যেত না?–যাকে নিজ হাতে হত্যা করতে ইচ্ছে হয়?

সে যদি গল্প লিখতে জানত, তাহলে চমৎকার একটি গল্প লিখিত সে। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে। হিমালয়ের পাদদেশে অরণ্যের এক প্ৰান্তে বাস করত এক গোষ্ঠী। তার তরুণ এক সদস্য একদিন পিপাসার্ত হয়ে ঝিলে গিয়েছিল। উপুড় হয়ে জন্তুর মত জলপান করছিল সে। তৃপ্ত হয়ে মুখ তুলতেই দেখে ওপারে দপদপে একটা আগুন স্থির হয়ে আছে।

বাঘ! তরুণ একটি বিদ্যুতের তরঙ্গ।

মুহূর্তে সে নলখাগড়ার ভেতরে অন্তৰ্হিত হলো। কিন্তু তাকে আর ভুলতে পারল না সে। তার দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার জুড়ে রইল সেই বাঘের দুঃসহ বুকভাঙ্গা সৌন্দর্য। গোষ্ঠীর মধ্যে নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়ায়। উৎসবের রাতে সে দূরে নির্জনে পাথরের চাকতির ওপর বসে থাকে। সূর্য ওঠার আগে চুপিচুপি বল্লম হাতে অধীর হৃদয়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রতি বনে, প্ৰতি ঝিলের কিনারে, রৌদ্র ছায়ায়, শরবনে সে সন্ধান করে বাঘটাকে। গোষ্ঠী প্ৰধান তার সুদূরে নিবদ্ধ চোখ দেখে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেন, কিন্তু কোনো উত্তর পান না। সবার সঙ্গে থেকেও সে আলাদা। যেন সে একটা ভিন্ন সময়ের ভিন্ন জগতের মানুষ।

কিন্তু পরিহাস এই মানুষটা জানে না প্রথম যেদিন বাঘটা তাকে দেখেছে সেও তার তাকে ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারেনি ঝিলের ওপর উপুড় হয়ে পড়া পেশির স্থির তরঙ্গে গরীয়ান তার প্রশস্ত কাল কাঁধ। যখন চোখাচোখি হয়েছিল তখন যে তত্ত্বরিত প্রবাহিত হয়েছিল তার অভিভাব যেন মাতৃযোনী থেকে নির্গমনের মত। জতুটাও সেই তরুণের সন্ধানে বারবার এসেছে ঝিলের কিনারে, রাতের অন্ধকারে সাহস করে গোষ্ঠীর আগুন জ্বালা বাসস্থান পর্যন্ত গিয়েছে। আকাশে মুখ তুলে ঘ্রাণ নিয়েছে। বুনো হলুদ ফুলের মত কান দুটো খাড়া করে সেই তরুণের মুখনিঃসৃত কোনো শব্দ শুনতে চেষ্টা করেছে সে।

তারপর একদিন পূর্ণিমা রাতে যখন সুন্দরী রমণীর গাত্রবর্ণের মত জোছনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে চারদিক, উত্তরে হিমালয় যখন গভীর তন্ময় একটি মৃদুহাস্য হয়ে আছে, ঝিলের জল যখন তীব্র আবেগে কুঞ্চিত হয়ে গিয়েছে, তখন তাদের সাক্ষাৎ হলো। এবড়ো থেবেড়ো জমির ওপর, চন্দ্ৰতারকাখচিত রঙ্গমঞ্চে, দুধারে সুউচ্চ বৃক্ষের উইংস দিয়ে দুজনে বেরিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। নদীর উৎস মুখে। যেমন অবিরাম একটা তান শোনা যায় তেমনি একটা ধ্বনি সমাবেশ শুনতে পেল তারা উভয়ে। তাদের চোখগুলো একেকটি ক্ষুদ্র তীব্ৰ চাদ হয়ে গেল। বল্লম তুলল তরুণ। জন্তুটা একবার মুখব্যাদান করল— হিংসায়, ক্ৰোধে সে এ রকম করে থাকে। কিন্তু আজ সে আবেগ নয়, সম্পূর্ণ অন্য কিছু যা তার পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। সে দৃপ্ত পিঠটাকে বাঁকিয়ে মাটি স্পর্শ করল প্রায়, যেমন সকল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মাটি স্পর্শ করে মানুষকে সে নিতে দেখেছে। তারপর একটি মাত্র মুহূর্ত। গোষ্ঠীর অনির্বাণ আগুন হঠাৎ একেক সময় যেমন লাফিয়ে ওঠে, তেমনি।

উষ্ণ প্রস্রবণের মত উৎক্ষিপ্ত হতে লাগল রক্ত।

দক্ষিণ অভিমুখে বহমান একটি নদীর মত নিৰ্গত হতে লাগল তরুণের অশ্রু।

প্ৰভাতে গোষ্ঠীর সবাই আবিষ্কার করল উভয়ের পায়ের ছাপ। আর কোনো চিহ্ন নেই, অবশিষ্ট নেই, এমনকি কোনো সংকেতও নেই। দলের মধ্যে শুভ্রকেশ যে বৃদ্ধ ছন্দােবদ্ধ ভাব প্রকাশে সক্ষম, তিনি আকাশবিদ্ধ করা একটি গাছের দুধশাদা কাণ্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, মুদিত চোখে, হাত নিবদ্ধ করে একটি গাথা রচনা করলেন। তিনি আমাদের থেকে উন্নীত হলেন। তাঁর দেহ দেবতার মত জ্যোতির্ময়। কুঙ্কুমের টিপ শোভিত চির তরুণ। ব্যাঘ তার বর্তমান রূপ। এসো প্ৰণিপাত করি।

ঢাকায় ফিরে আজহারকে সে গল্পটা বলবে। অনেকদিন আজহার কিছু লেখে না। তার শেষ বইটা খুব খারাপ হয়েছিল। সেদিন টেলিভিশনে একটা নাটক হলো তার, এমন তৃতীয় শ্রেণীর নাটক আর হয়েছে বলে মনে পড়ে না। তবু লোকটা ভাল। লেখার জন্য সর্বক্ষণ আকুলি-বিকুলি করে। লেগে আছে, এইটাই বড় কথা। তাকে গল্পটা বলবে বাবর।

নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। কখন যে পোশাক পালটে পাজামা পরে নিয়েছে মনেও পড়ল না তার। গল্পটা তাকে একবারে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এখন ঘোরটা কেটে যেতেই আবার তার সমস্ত ভাবনা, উদ্যম, দৃষ্টি জাহেদার দিকে ধাবিত হলো। এক পা এগিয়ে বালিশের ওপর লুটিয়ে থাকা তার চুলের গুচ্ছ স্পর্শ করল সে। কান পেতে চেষ্টা করল জাহেদার নিঃশ্বাস শুনতে। কিন্তু ভারি কম্বলের ভেতর থেকে কিছুই শোনা গেল না। তখন সে ডান হাত রাখল। জাহেদার নিতম্বের উপর। প্রথমে আলতো করে তারপর ধীরে ধীরে চাপ বাড়াল। কোমল মাংসের মধ্যে বসে গেল তার করতল। কিন্তু কোনো প্ৰতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল না জাহেদার। সে তখন ফিসফিস করে নাম ধরে ডাকল। একবার দুবার। কোনো সাড়া এল না। আবার সে বলল বাতি নেভানোর কথা। শব্দগুলো গুঞ্জন করে উঠে থেমে গেল। তেমনি লম্বমান নিষ্পন্দ হয়ে পড়ে রইল ব্ৰাউন কম্বলের অতলে জাহেদার দেহ। ঘড়ি দেখল বাবর। রাত এখন বারোটা উনিশ। বাইরে থেকে আবে কোনো শব্দ আসছে না। বাতাসের একটানা চুলঝারার মত একটা ক্ষীণ ধ্বনিমাত্র, আর কিছু নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *