১৩. ছেলে আনো বাড়িতে, আর পড়তে হবে না

ছেলে আনো বাড়িতে, আর পড়তে হবে না

এত কথা ভাবলম কিন্তুক যে-ই শোনলম বড় খোঁকাকে ধরে জেলে নিয়ে গেয়েছে, অমনি সব ওলোট-পালোট হয়ে গেল। ছেলেকে জেলে নিয়ে গেয়েছে, দড়ি দিয়ে বেঁধেছে, না শেকল দিয়ে বেঁধেছেলাঠির বাড়ি মেরে টানতে টানতে নিয়ে গেয়েছে–উ ছেলে কুনোদিন কারু হাতে মার খায় নাই, কেউ ওর গায়ে হাত দেয় নাই কুনোদিন, সেই ছেলে পুলিশের লাঠির বাড়ি খেচে কি জানি, সারাদিন উপোস করে আছে না কি, ভোক্ সহ্য করতে পারে না সি তো আমি জানি, কেউ হয়তো এট্টু খাবার দেয় নাই তাকে–তবু মুখ ফুটে তো একটি কথা সি বলবে না কখনো এইসব হক না-হক কথা খালি বুকের মদ্যে উথথাল-পাতাল করতে লাগল আর খানিক বাদে বাদে দোম যেন আটকে যেতে লাগল। আমি কেবলই বলতে লাগলম, আমার ছেলে এনে দাও, যেমন করে পারো আমার ছেলে এনে দাও। যেন ছেলে বলতে আমার একটিই। ইদিকে পরের খোঁকাটি আট বছরের হয়েছে, চাঁদের মতুন একটি মেয়েও হয়েছে–অ্যাকন ছ-মাসের সিসব কথা মনে হলো না। উরা যি ছামনেই রয়েছে, তাই খেয়াল হচে না। খালি মনে হচে, আমার নাড়িছেড়া ধনটিই আমার কাছে। নাই–আমার কেউ নাই, আমার বিশ্ব-ভোবন আঁদার।

তবে কত্তা গেয়েছে, আমি একটু নিশ্চিন্তি। উ লোক সামান্য লয়, উ মানুষ বটবিরিক্ষি, তামাম মানুষকে হেঁয়া দিতে পারে। ঠিক তা-ই হলো। তিমি-সাঁঝের বেলা খোঁকাকে নিয়ে ফিরলে কত্তা। অন্য অন্য দিন সে ফিরে নিজের বাইরের ঘরেই থাকে, আমরাই পা-ধোয়ার পানি, শরবত নিয়ে যাই। আর খুব কিছু বেপার হলে সে বাড়ির ভেতর মা-বুনের কাছে আসে। আজ সে তা-ই করলে, ছেলেকে নিয়ে সোজা বাড়ির ভেতরে এসে মায়ের কাছে বড় খোঁকাকে ঠেলে দিয়ে বললে, ছেলে যে পথে যাচ্ছে এই বয়েস থেকে, কেন যাচ্ছে, কি করতে যাচ্ছে–এইসব কথা ওর কাছ থেকেই শোনো। তারপর তুমিই ঠিক করো, ওকে বারণ করবে কি করবে না। নেহাত কম বয়েস, তাই দয়া করে এবার ছেড়ে দিলে–দু-বছর জেলও দিতে পারত। ব্রিটিশদের রাজত্ব, বড় কঠিন শাসন মা। এই শাসন এখন দেশের লোকও আর মানতে চাইছে–ঘর-সংসার বাপ-মা ভাই-বোন লেখাপড়া ছেড়ে দলে দলে সব বেরিয়ে আসছে–এরই মতন খোঁকা সব, কিছুই মানছে না,কারুর বারণ শুনছে না, ঝাঁকে ঝাঁকে মরতে যাচ্ছে। কি এখন বলবে বলো দিকিন। আইন তো ছাড় কথা এখানে বোমা ফাটাচ্ছে, ওখানে সায়েব মারছে আর যতো জেল হচ্ছে, ফাঁসি হচ্ছে, ততো তাদের রাগ বাড়ছে। আগুন জ্বলছে দেশে, কি করা যাবে বলো তো? গিন্নি দেখি চুপ করে আছে, তার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে বেধবা ননদটি। কেউ কুনো কথা বলছে না। বড় খোঁকা কত্তার পাশে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে, তার একটো হাত কত্তার হাতে ধরা। আমি আর থাকতে পারলম না, ছুটে যেয়ে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে দেখি, গা-গরম, জ্বর এয়েছে। আমি চেঁচিয়ে ওঠলম, ই কি, ই-যি অ্যানেক জ্বর! বাপ না ছাই, কত্তা এই ছেলেকে শহর থেকে নিয়ে এয়েছে, কতোবার গায়ে-পিঠে হাত পড়েছে, ছেলের জ্বর সি কিছুই ট্যার পায় নাই।

আমার চিচকার শুনে গিন্নি এগিয়ে এসে খোঁকার কপালে হাত রাখলে। সে তো অস্থির হবার মানুষ লয়, যাতে বেপদই হোক, মাথা তার ঠান্ডা। কপালে একবার, বুকে একবার হাত দিয়ে গিন্নি আমার দিকে চেয়ে বললে, হা, জ্বর অনেক। তা এত হ্যাঙ্গামা-হুঙ্কুতে জ্বর আসবে না! কেন ভাই, এসবের মধ্যে থাকছ তুমি? তা যাক, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এয়েছে, জ্বর নিয়ে ভাবতে হবে না, আপনা-আপনিই চলে যাবে। যাও, মেজ বউ, উত্তর-দুয়োর ঘরে বিছেনা করে দাও।

সাঁঝবেলার আঁদারে সব ভূতের মতুন দাঁড়িয়ে আছে।পিদিম কিল কিছুই ত্যাকননা জ্বালানো হয় নাই। তখন-তখুনি বিছেনা করব কিআগে একটো রেড়ির ত্যালের পিদিম জ্বালিয়ে উত্তর-দুয়োরি ঘরে ঢোকলম। এমন লাগচে ক্যানে মা! এত আঁদার লাগচে ক্যানে। ঘরের এক কোণেপিদিমটো রাখলম–সারা ঘর যেমনকার তেমনি আঁদার। শুদু পিদিমটো মিটমিট করে জ্বলতে লাগল এক কোণে। খুঁজে খুঁজে বারুণ আনলম, তিমি-সাঁঝে ঝট দিতে নাই। তবু ঘরটো একবার ঝট দেলম, খেজুর পাতার নকশা করা শেতল পাটিটো পাতলম, তাপর হাতের আন্দাজে খুঁজে খুঁজে সিন্দুকের ভেতর থেকে সুজনিটো বার করে পাটির ওপর পাতলম–আহা ত্যাকননা জানি না, জাদু আমার কি কষ্ট করে ঘরের ভেতরে আঁদারের মদ্যে দাঁড়িয়ে আছে। যি ছেলে সহজে নিজের কষ্টের কথা বলে না, সেই ছেলে য্যাকন বললে, মা, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, ত্যাকন আমার হুশ হলো। এই যি বাপ, এই হয়ে গেল বলে তাড়াতাড়ি করে আমি খোঁকাকে ধরে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিতে দিতে বললম, হ্যাঁ বাপ, পুলিশ কি তুকে মেরেছে? আমার কথা শুনে খোঁকা হাসলে, আবছা আঁদারে তার হাসিটি আমি দেখতে প্যালম না। ঐরকম করে হাসতে হাসতেই সে বললে, না না, গায়ে হাত দেবে কেন? গায়ে। হাত দেয় নাই। এক পুলিশের অফিসার আমাকে বললে, তাড়াতাড়ি ছাড়া যদি পাও, ঘরের ছেলে ঘরে যাও–এ পথে থাকলে মরবে–যারা তোমাদের এসব কাজে লাগাচ্ছে তাদের কিছুই হবে না। মাঝখান থেকে তোমরাই মারা যাবে।

খোঁকাকে বিছেনায় শুইয়ে পিদিমটো এনে তার মাথার কাছে রাখতে যেয়ে দেখলম, চোখদুটি তার লাল টকটকে। কপালে হাত দিয়ে দেখলম, জ্বর হু হু করে বাড়ছে। গিন্নি এসে সব দেখেশুনে বললে, খোঁকার মাথাটো একবার ঠান্ডা পানিতে ধুইয়ে দাও মেজ বউ, দিয়ে খানিকক্ষণ কপালে জলপটি দাও। তাইলে জ্বর কমে যাবে।

তা-ই করলম। চাচারা সব এল-গেল, কতো কথা বললে খোঁকাকে, কতো আদর করে কতো কথা বললে, বারে বারে গিন্নি আর বুবু এসে খোঁকার কাছে বসলে। তা-বাদে বাড়ির সব লোকদের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে আমাকে গিন্নি কতোবার বললে রেতের ভাত খেতে! আমি খোঁকার শিয়র থেকে নড়লম না, জলপটি দিতে দিতে আমার কতোবার ঝিমুনি এল, ঝুঁকে ঝুঁকে পড়তে লাগলম, তবু খোঁকার কাছ থেকে যেতে পারলম না। অ্যানেক রেতে মনে হলো, জ্বরটো যেন এট্টু কম হয়ে এয়েছে। খোঁকা আর ত্যাতটো অস্থিরও করছে না। একটু বাদে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সকালবেলায় মনে হলো জ্বরটো আর নাই, ছেলেকেও অ্যানেকটো চনমনে লাগছে! কাল রেতে কিছুই খায় নাই। তাকে ধরে আস্তে আস্তে পিঁড়েয় নিয়ে বসিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে দেলম। কাল রেতে ছেলের লাল টকটকে চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেয়েছেলম। অ্যাকন দেখলম, মুখচোখ শুকিয়ে গেয়েছে বটে, তবে চোখের সেই লাল টকটকে ভাবটো আর নাই।

লিশ্চিন্ত হয়ে আছি–যাকগো, জ্বরটো খারাপ জ্বর লয়। ত্যাকনকার ডাক্তার-বদ্যি খুব কম, লোকে সহজে তাদের ডাকতে যেত না। আর ডাকতে চাইলেই বা পাবে কোথা। পাশ করা কুনো ডাক্তার দশ গাঁয়ে খুঁজলেও পাওয়া যেত না, দু-একজনা যা থাকত সি শহরে। গাঁয়ের মানুষ কি তাদের কাছে যেতে পারে? ই গাঁয়ে উ গাঁয়ে হয়তো বদ্যি দু-একজনা ছিল, ডাক্তার বোধায় একটোও লয়। কেউ হয়তো কুনোদিন কুনো ডাক্তারের কাছে দিনকতক ছিল, এটো-ওটো নাড়াচাড়া করেছে, কষ্টমষ্ট করে ইঞ্জিশন খুঁড়তে পারে, নাইলে দু-দাগ মিকচার বানিয়ে দিতে পারে–সে-ই হলো ডাক্তার। তা ইসব ডাক্তারও কি সব গাঁয়ে আছে? তা নাই। আমার বাপের গাঁয়ে কুনো ডাক্তার-কবরেজ ছিল না। তিন কোশ দূরের গাঁয়ে একজনা ছিল, সকালে তাকে ডাকতে গেলে বৈকালি বা সাঁঝবেলায় একটো বুড়ো ঘোড়ায় চেপে হটর হটর করে সে আসত। তা সে-ই হলো যেয়ে বড় ডাক্তার। আমার শ্বশুরবাড়ির গাঁ ইদিক থেকে খুব ভালো। আছে একজন অ্যালাপ্যাথি, পাশ-টাশ দেয় নাই, তবে খুঁড়তে পারে, বড়ি-মিকচার দিতে পারে। আর একজন হলো হেমাপ্যাথি, শিশিতে পানি ভরে দু-ফোটা করে ওষুধ দিত। এক-আধ আনা পয়সা কেউ তাকে দিত, কেউ দিত না। ইদিকে অসুখ-বিসুখ রাতদিন লেগে আছে, কে আর অত ডাক্তারের কাছে যায় জ্বরজ্বারি নিয়ে? দু-চার দিন বাদে আপনিই চলে যাবে। সর্দি-কাশিতে জ্বর, ফেঁড়ার তাড়সে জ্বর, বদহজমে প্যাটে যন্তন্না, উসব কিছু ধত্যবের লয়, গা-গরম। তবে কঠিন কিছু হলে কি আর করবে মানুষ, রুগির ঘরে যেয়ে চেয়ে চেয়ে দেখত। অসুখ-বিসুখ হামেশা হচে, আপনা-আপনি সেরেও যেচে, আবার মরেও যেচে অ্যানেক মানুষ।

অসুখ কঠিন না সহজ, বোঝবার বাগ ছিল না সি-সময়ে। বড় খোঁকা সকালে কিছু খেলে না। বললে মুখে মজা নাই। অত জ্বর ছিল রেতে, মুখে কি মজা থাকে? তবু সকালে খই-মুড়কি খেলে, দোপরবেলায় ভাতও দুটি খেলে। আমি লিশ্চিন্ত মনে ঘরের কাজকৰ্ম্ম করছি, বাড়ির আর সবাইও লিশ্চিন্ত— সাঁঝবেলার খানিক এণ্ড ঘরে যেয়ে দেখি, খোঁকা বিছেনায় শুয়ে আছে। বললম, এই অবেলায় শুয়ে ক্যানে খোঁকা, একটু উঠে হেঁটে বেড়াও–বলতে বলতে দেখি, বলব কি, তার মুখের দিকে চাওয়া যেচে না, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে–ছেলে খুব হাঁসফাস করছে। ঠিক, অ্যানেক জ্বর গায়ে। আবার ক্যানে জ্বর এল–মনে একটু ভাবনা হলো, বাড়ির সবাইকে জানালম। খবর পেয়ে কত্তা জ্বরকাঠি নিয়ে ঘরে এল। বগলের তলায় জ্বরকাঠি দিয়ে দেখলে, হ্যাঁ অ্যানেক জ্বর।

এই যি জ্বর এল আর ছাড়লে। সকালবেলাটোয় কম, মনে হতো বুঝিন গেয়েছে, পেথম দিন যেমন মনে হয়েছিল। কিন্তুক ঐ জ্বরকাঠি দিতেই দেখা যেত জ্বর আছে, ছাড়ে নাই। তিন-চার দিন এই রকম গেল, সকালে কম, রেতে অ্যানেক জ্বর। খাওয়ারও রুচি নাই, তা-বাদে, এই কদিন পাইখানা বন্ধ ছিল, একদিন খুব শক্ত পাইখানা হলো, তাপর ঘন ঘন লরম বাজি আর প্যাটে যন্তন্না। কত্তা গাঁয়ের অ্যালাপ্যাথি ডাক্তারকেই আগে ডাকলে।

জ্বরটো যাচ্ছে না কেন, তিন-চার দিন হয়ে গেল–কত্তা শুদুইলে ডাক্তারকে। লাঙলা চাষার মতুন চেহারা ডাক্তারের, দেখলে পছন্দ হয় না। তা মিছে লয়, নিজের হাতে চাষবাস করে ডাক্তার, দরকার হলে লাঙলের মুটোও ধরে। দুই পায়ের আঙুলে হাজা, হাতের আঙুলগুলিনও এই মোটা মোটা! কি করে পছন্দ হবে এমন ডাক্তার? খানিকক্ষণ সে খোঁকার নাড়ি টিপে চোক বুজে থাকলে, তারপর বললে, জিভ বার করে অ্যা অ্যা করো। সব দেখে শুনে শ্যাষে বললে, হাঁ জ্বর আছে–কিসের জ্বর তা তো এখন বলতে পারা যাচ্ছে না। জিবে ময়লা পড়ে রয়েছে। যা-ই হোক, টাইফয়েড সন্দেহ করছিআর দু-চার দিন যাক, রোগ ঠিক বেরিয়ে পড়বে। ওষুধপত্তর কিছু দিচ্ছি। শক্ত খাবার একদম বন্ধ, সা-বালি খাবে, তাতে দুধ দেওয়া চলবে না, জল দিয়ে রান্না করতে হবে। ডাবের জলটা খেতে পারবে আর বেদানার রস। এইরকম চলুক।

এইসব বলে চার আনা ভিজিট নিয়ে ডাক্তার চলে গেল। কথা শুনে কত্তা লিশ্চিন্ত হতে পারলে না, হেমাপ্যাথি ডাক্তারটি বন্ধু লোক, তাকে ডেকে নিয়ে এল। ই ডাক্তারের পরনে একটো হেঁটো ধুতি, কাঁধে একটো মোটা চাদর। সি যি কতো কথা শুদুইলে তার আর অন্ত নাই। অত কথার জবাব খোঁকা আর কি দেবে? ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা শোনছেলম। কত্তাই সব কথার জবাব দিচে, শেষে সে বললে, তোমার কি মনে হচ্ছে? ডাক্তার বললে, সর্বাংশে কিছু নয়–আমি তিনটি পুরিয়া দেব–বাস, আর কিছু লাগবে না।

ঐরকম করে কথা বললে কি কিছু বোঝা যায়। আমি কিছু বুঝতে পারলম না। আরও দুটো দিন গেল কিন্তুক জ্বর একবারও ছাড়লে না। সকালের দিকটোয় একটু কম থাকে, গায়ে-মাথায় হাত দিয়ে মনে হয়, জ্বর নাই আর জ্বরকাঠি বগলে দিলেই দেখা যায় এট্টু জ্বর লেগেই আছে। ক্যানে জানি না, আমার মন খুব কু ডাক ডাকতে লাগল। কিন্তুক কাকে কি বলব বেশি কিছু বলতে গেলেই লোকে বলবে মেতর-বউ বাড়াবাড়ি করছে। অসুখ-বিসুখ যি মানুষের গা-সওয়া। সবাই জানে অসুখ আছে চিকিচ্ছে নাই-সেই লোগে অসুখে কেউ গা করত না। বলত উ কিছু লয়, গা-গরম, এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। ভালো কি আর হতো? হাজার কিসিমের রোগ-বালাইয়ে হর-হামেশা লোক মরত। কতোরকম অসুখই না ছিল–ঝি-বউদের সূতিকা রোগ, ছোট ছোট ছেলেমেয়ের পুঁয়ে-লাগা রোগ–দিন দিন শুকিয়ে যেচে, শুকিয়ে যেচে, শেষে একদিন মরে গেল, আর একটা রোগ হুপিং কাশি, বাবা রে কি কাশি, কাশতে কাশতে চোখে রক্ত পয্যন্ত জমে যেত, তাপর বড়দের হাঁপানির ব্যায়রাম-ইসব রোগের কুনো চিকিচ্ছে ত্যাকন হতো না। ওগুনো যেন রোগই লয়। দু-একটো মরে গেলেও কুনো শিক্ষে নাই। তেমনি বাতাস লেগে মওত, বাণ মেরে মানুষ মারা ইসবও ছিল। আর ছিল দুটি অসুখ–সি হলে কেউ চিকিচ্ছে করাত না, কুনো চিকিচ্ছে ছিলও না। একটি হলো কুট–হাতে-পায়ে কুটই ভালো হবার লয়, কুনো চিকিচ্ছে নাই। সবচাইতে খারাপ শাপ হচে তোর মুখে কুট হোক। আর একটো হচে ক্ষয়-কাশি, উ হলে মওত আসবেই, চিকিচ্ছে কিছুই নাই। সব শ্যাষে আর ছিল দুটি রোগহুড়মুড়িয়ে এসে পড়ত। একটি হলো নামুনে-কলেরা আর একটি গুটি-বসন্ত। এই দুটি রোগ আপনা-আপনি হতো না। দুই হারামজাদি মাগী এক গাঁ থেকে আর গাঁয়ে নিয়ে যেত। এক মাগীর নাম মা-শেতলা, আর এক মাগী ওলা-বিবি। একজনা বসন্তের, আর একজনা নামুনের, একজন হিঁদু, আর একজনা মোসলমান। দুজনায় মিলে কি মাহা-কাজই না করত! ত্যাখন আর হিঁদু-মোসলমান বাছত না। এক-একটো গাঁয়ে দশ-পনেরোদিন থাকত। কতো বংশ যি নিব্বংশ হতো! বিরান হয়ে যেত গাঁ-কে গাঁ। পরে আর একটি গায়ে যেত। এই দুটি মাহামারী রোগ এলে লোকে চিকিচ্ছে আর কি করাবেদু-হাতে মাথা চাপড়াত।

আমিও খোঁকার অসুখটোকে মনে করেছেলম এমনি জ্বর। দু-দিন বাদেই সেরে যাবে। অ্যাকনো তা-ই মনে হচে। যি রোগের কথা ঐ হেঁটো-ধুতি পরা বামুনটো বলে গেল, সি লোগ আমার ছেলের হতে যাবে ক্যানে? কার কাছে কি দোষ আমি করেছি, কার কি শাপ আমি কুড়িয়েছি যি আমার বড় খোঁকার উ রোগ হতে যাবে? উ কি য্যাকন-ত্যাকন যার-তার হয়? জাতসাপের কামড়ের মতুন উ হলো কালরোগ। পাড়াগাঁয়েরও সব লোক জানে সান্নিপাতিক জ্বর হলে রুগি বাঁচে না। ঐ একজ্বরী সান্নিপাতিক এমনি জ্বর যি একনাগাড়ে একুশ দিন, না-হয় আটাশ দিন, না-হয় ছাপ্পান্ন দিন গায়ে লেগে থাকবে, কিছুতেই ছাড়বে না–শত ওষুধ-পত্তরে কুনো কাজ হবে না। ঐ মেয়াদের মদ্যে রুগি মরে গেল তো গেল, মেয়াদ পয্যন্ত যেদি বেঁচে থাকে তত সুস্থ হবে বটে কিন্তুক একটি অঙ্গ হয় একটি চোখ, না-হয় একটি হাত কিংবা একটি পা লষ্ট হবেই হবে। এমনি কঠিন রোগ! আমার ছেলের কি সেই রোগ হয়েছে? তা ক্যানে হবে? এই দিন-দুনিয়ার সব মানুষ ভালো থাকুক–সব মায়ের পুত!

কিন্তুক সাত দিন পেরিয়ে গেল, ছেলের জ্বর ক্যানে যেচে না? প্যাটটোও খারাপ হলো, তলপেটে দরদও খুব। কত্তা বরং একবার শহর থেকে ডাক্তার নিয়ে আসুক। আমি আর থির থাকতে পারছি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *