১৩. চণ্ডীদাস

চণ্ডীদাস

চণ্ডীদাস বাঙলা কবিতার একজন শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর হৃদয় ভরা ছিলো অসাধারণ আবেগে, এতো আবেগ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোনো বাঙালি কবির নেই। তাঁর কবিতা পড়ার অর্থ হলো আবেগের স্রোতে ভেসে যাওয়া। তবে এ-আবেগ বানানো নয়, ফিকে নয়; টসটসে তাঁর আবেগ। তিনি আবেগকে ঠিক ভাষায় সাজিয়ে দিতে পেরেছেন। এ-মহাকবিকে নিয়ে এক বড়ো সমস্যা আছে বাঙলা সাহিত্যে। সমস্যাটি বিখ্যাত চণ্ডীদাস-সমস্যা’ নামে। আমরা চণ্ডীদাস নামের বেশ কয়েকজন কবির কবিতা পেয়েছি। তাদের কারো নাম বড় চণ্ডীদাস, কারো নাম দ্বিজ চণ্ডীদাস, কারো নাম দীন চণ্ডীদাস। এজন্যে প্রশ্ন উঠেছে কজন চণ্ডীদাস ছিলেন আমাদের? এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আজকাল মনে করা হয় তিনজন চণ্ডীদাস আছেন আমাদের : একজনের নাম বড় চণ্ডীদাস, আরেকজনের নাম দীন চণ্ডীদাস, এবং অন্যজনের নাম দ্বিজ চণ্ডীদাস। এখানে দ্বিজ চণ্ডীদাসের কথা বলছি।

বড় চণ্ডীদাস আমাদের প্রথম মহাকবি। তাঁর একটি কাব্য পাওয়া গেছে; নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি এক দীর্ঘ কাব্য, অনেকগুলো পদ বা কবিতার সমষ্টি। বড়ু চণ্ডীদাস কাহিনী বলার ও আবেগ প্রকাশের অসাধারণ ক্ষমতা রাখেন। তাঁর কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি :

কে না বাঁশী বা বড়ায়ি কালিনী নইকুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদে মো আউলাইলোঁ রান্ধন।।
কে না বাঁশী বা বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।।…
অঝর ঝর মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।

দ্বিজ চণ্ডীদাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন চতুর্দশ শতকের শেষভাগে, বীরভূম জেলার নানুর গ্রামে। তিনি ছিলেন বাশুলীদেবীর ভক্ত। তাঁর সম্বন্ধে অনেক উপকথা প্রচলিত আছে। এউপকথাগুলোর মধ্যে সত্য কতোটুকু আছে তা আজ আর যাচাই করে দেখা সম্ভব নয়, তবে এসব থেকে বুঝতে পারি কবি হিশেবে তিনি লাভ করেছিলেন অসীম জনপ্রিয়তা। তার সহজ সরল কথার তীব্র আবেগ বাঙলাদেশকে আকুল করে তুলেছিলো। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক চৈতন্যদেব পাগলের মতো জপ করতেন চণ্ডীদাসের পদাবলি।

চণ্ডীদাসের জনপ্রিয়তার কারণ তাঁর রাধা। রাধার আবেগ, আচরণ, সকাতর হৃদয় এতো মোহনীয় যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। রাধা মানবীরূপে মানুষের হৃদয়ের আবেগ। মানুষের হৃদয়ের আকুলতা তার মধ্যে রূপ লাভ করছে। রাধার সব আবেগ ও কাতরতা কৃষ্ণের জন্যে। কৃষ্ণের নাম শুনেই রাধা কৃষ্ণের জন্যে অধীর হয়, সব সময় সে কৃষ্ণের কথা ভাবে, সব কিছুতে সে দেখতে পায় সুন্দর কৃষ্ণকে। আকাশের মেঘ, যমুনার নীল জল, ময়ূরের কণ্ঠের উজ্জ্বল রঙে রাধা খুঁজে পায় শ্যাম বা কৃষ্ণকে। চণ্ডীদাস জটিল নন, অনেক ভেবে তিনি কবিতা রচনা করেন না। অতি সহজে এতো গভীর কথা তিনি বলেন যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। চণ্ডীদাসের একটি সকাতর পদের কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি :

বহু দিন পরে বধুয়া এলে।
দেখা না হইত পরাণ গেলে।।
এতেক সহিল অবলা বলে।
ফাটিয়া যাইত পাষাণ হ’লে।।
দুখিনীর দিন দুখেতে গেল।
মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল।।
এই সব দুখ কিছু না গণি।
তোমার কুশলে কুশল মানি।।

চণ্ডীদাসের কবিতা স্বতস্ফূর্ত কোমল আবেগের প্রকাশ, গীতিময় ও অন্তরঙ্গ। অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মতো। চণ্ডীদাসের ভাষাও সহজ সরল, তাঁর আবেগের মতো নিরাভরণ। তাঁর পদ অরণ্যের নির্জন পুষ্পের মতো চিরস্নিগ্ধ, গোপন সুবাস বিলিয়ে চলছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

1 Comment
Collapse Comments

অসাধারন কবিতা
কবিতার বই আমি কোথায় পাবো যদি জানান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *