প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১২. শুনঃশেপ-এর কাহিনী

শুনঃশেপ-এর কাহিনী

সংহিতার পর ব্রাহ্মণ। ঋগ্বেদের প্রধান ব্রাহ্মণ বলতে ঐতরেয়। রচনাকালের দিক থেকে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলই সবচেয়ে অর্বাচীন। তাই এই দশম মণ্ডলের রচনাকালের সঙ্গে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের রচনাকালের খুব বেশি ব্যবধান থাকার কথা নয়।

স্বভাবতই, বৈদিক সমাজে যে-পরিবর্তনের ফলে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে আমরা ওইভাবে প্রাচীন সমষ্টিজীবনকে ব্যক্তিস্বার্থের নিচে অবদলিত হতে দেখি, তারই অনুবৃত্তি ঐতরেয় ব্রাহ্মণে শ্রেণীবিভাগ-আবির্ভাবের বিভীষিকাকে আরো প্রকট করে তুলেছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা এখানে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ(৭১) থেকে শুনশেপ-এর কাহিনী উদ্ধৃত করবো।

রাজা হরিশ্চন্দ্রের ছেলে হয়নি। বরুণের কাছে তিনি প্রার্থনা করেছিলেন, ‘আমার পুত্র হউক, তাদ্বারা তোমার যাগ করিব।’ বরুণ বললেন, তাই হোক। তখন তাঁর রোহিত নামে পুত্র জন্মালো! বরুণ হরিশ্চন্দ্রকে বললেন, ‘তাহলে তুমি এই পুত্র দিয়ে আমার যাগ করো’। হরিশ্চন্দ্র সময় নিতে লাগলেন : ছেলে একটু বড়ো হোক, ইত্যাদি। সন্নাহপ্রাপ্তি (ধনুর্বান, কবচাদি ধারণ) হবার পর রোহিত অরণ্যে প্রস্থান করলেন এবং অরণ্যে বিচরণ করতে লাগলেন। বরুণ হরিশ্চন্দ্রকে চেপে ধরলেন; হরিশ্চন্দ্রের উদরী রোগ উৎপন্ন হলো। রোহিত ষট্‌ সংবৎসর অরণ্যে বিচরণ করলেন।

এবং সূয়বসের পুত্র ক্ষুধাপীড়িত অজীগর্তকে দেখিতে পাইলেন। এই অজীগর্তের শুনঃপুচ্ছ, শুনঃশেপ, শুনোলাঙ্গুল নামে তিন পুত্র ছিল। তিনি সেই অজীগর্তকে বলিলেন, অহে ঋষি, তোমাকে একশত (গাভী) দিতেছি, আমি ইহাদের (তোমার পুত্রদের) মধ্যে একজনকে নিষ্ক্রয়রূপে দিয়া আপনাকে মুক্ত করিব। তখন অজীগর্ত জ্যেষ্ঠ পুত্রকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, আমি ইহাকে কিছুতেই দিব না। মাতা (অজীগর্তের পত্নী) কনিষ্ঠকে (টানিয়া লইয়া) বলিলেন, আমি ইহাকে দিব না। তাঁহারা উভয়ে মধ্যম শুনঃশেপকে দান করিলেন। তখন অজীগর্তকে একশত (গাভী) দিয়া তিনি সেই শুনঃশেপকে লইয়া অরণ্য হইতে গ্রামে আসিলেন। (তদনন্তর) তিনি পিতার নিকট গিয়া বলিলেন, অহে, আমি এই ব্যক্তিকে নিষ্ক্রয় (মূল্য) স্বরূপ দিয়া আপনাকে মুক্ত করিতে চাহি। তখন হরিশ্চন্দ্র রাজা বরুণকে বলিলেন, আমি এই ব্যক্তিদ্বারা তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক—ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় অপেক্ষা অধিক আদরণীয়। এই বলিয়া তাহাকে রাজসূয় নামক যজ্ঞক্রতু অনুষ্ঠান করিতে বলিলেন। হরিশ্চন্দ্রও রাজসূয়ের অভিষেক অনুষ্ঠানের দিনে শুনঃশেপকে পুরুষ (মনুষ্য) পশুরূপে নির্দেশ করিলেন।

সেই হরিশ্চন্দ্রের (রাজসূয় যাগে) বিশ্বামিত্র হোতো, জমদগ্নি অধ্বর্যু, বশিষ্ঠ ব্ৰহ্মা ও অয়াস্ত উদগাতা হইয়াছিলেন; পশুর উপকরণের পর নিযোক্তা (যুপে বন্ধনকর্তা) পাওয়া গেল না। সেই সূয়বসের পুত্র অজীগর্ত বলিলেন, আমাকে আর একশত (গাভী) দাও, আমি ইহাকে নিয়োজন (যুপে বন্ধন) করিব। তখন হরিশ্চন্দ্র তাঁহাকে আর একশত গাভী দিলেন; তিনিও নিয়োজন করিলেন।

উপকরণ ও নিয়োজনের পর আপ্রীমন্ত্র পঠিত ও পর্যাগ্নিকরণ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হইলে বিশসন (বধ) কর্মের জন্য কাহাকেও পাওয়া গেল না। তখন অজীগর্ত বলিলেন, আমাকে আর একশত (গাভী) দাও, আমি ইহার বিশসন (বধ) করিব। তখন হরিশ্চন্দ্র তাঁহাকে আর একশত (গাভী) দিলেন। তখন তিনি অসি (খড়্গ) শানাইয়া (তীক্ষ্ণ করিয়া) উপস্থিত হইলেন।

ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে প্রতিফলিত বৈদিক সমাজের একটা ছবি এখানে পাওয়া যাচ্ছে : ক্ষুধাপীড়িত পিতা একশত গাভীর বিনিময়ে পুত্রকে বিকিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, আরো একশত গাভীর লোভে পুত্রকে যূপে বদ্ধ করতে অগ্রসর হচ্ছে। আরো একশত গাভীর প্রলোভনে খড়্গ শানিয়ে স্বয়ং পুত্রকে বধ করতে উদ্যত হচ্ছে।

এর পাশে ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলের সেই ধুয়াটি মনে রাখা যায়; বৃহৎ বদেম বিদখে সুবীরাঃ–আমরা সভায় উচ্চকণ্ঠে বীর পুত্রের কামনা জানাই। ব্রাহ্মণ সাহিত্য যাঁরা রচনা করেছিলেন তাদেরই পূর্বপুরুষদের কাছে এইটিই ছিলো একটি প্রধানতম কামনা। কিন্তু ইতিমধ্যে বৈদিক মানুষদের সমাজে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। সে পরিবর্তনের দরুন বৈদিক মানুষদের চিন্তাচেতনাও অনেকখানি রূপান্তররিত হয়েছে। এখানে তার সামান্য আলোচনা তুলবো।

————
৭১. বৈদিক সাহিত্যে শুনঃশেপএর কাহিনীর অন্যান্য উল্লেখও পাওয়া যায়। A. B. Keith RVB 61-8.