১২. মহারানীর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের পর

মহারানীর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের পর হলঘরের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য তখন একটা মৃত্যুর মতই কঠিন পীড়াদায়ক স্তব্ধতা নেমে আসে।

সকলেই যেন একটা আকস্মিক আঘাতে যোবা হয়ে গিয়েছি। কারও মুখে কোন কথা নেই।

এবং সুকঠিন সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে সর্বপ্রথম কথা বললেন শ্ৰীমন্ত পাল।

শ্ৰীমন্ত পালই জিজ্ঞাসা করেন, কোথায়? কোথায় আপনি দেখেছেন মহারানী মিত্রা সেনকে?

কামিনী ঝোপের সামনে যে বেঞ্চটা আছে, সেই বেঞ্চে—

আমিই এবার শ্ৰীমন্ত পালের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, জানেন আপনি জায়গাটা মিঃ পাল?

হ্যাঁ, আসুন।

শ্ৰীমন্ত পালকে অনুসরণ করেই অতঃপর সকলে আমরা হলঘরের এক নম্বর দরজা দিয়ে বের হয়ে লোহার সেই ঘোরানো সিঁড়িপথে উদ্যানে এসে নামলাম।

আকাশের পঞ্চমীর চাঁদ। মৃদু চন্দ্রালোকে উদ্যানটার মধ্যে একটা আলোছায়ার রহস্য যেন গড়ে তুলেছে। অদ্ভুত স্তব্ধ চারধার।

শ্ৰীমন্ত পালকে অনুসরণ করেই সকলে আমরা অগ্রসর হলাম। উদ্যানের একেবারে পূর্ব কোণে গোটা দুই কামিনী ফুলের গাছ পাশাপাশি ডালপালা ছড়িয়ে একটা ঝোপ সৃষ্টি করেছে। সেই ঝোপটা ঘুরে সামনে এগিয়ে যেতেই থমকে দাঁড়ালাম।

মৃদু চন্দ্রালোকে যে দৃশ্য আমার চোখে পড়ল আজও আমার যেন তা স্পষ্ট মনে আছে।

লোহার ব্যাকওয়ালা একটা বেঞ্চ। তারই একধারে উপবিষ্ট ভঙ্গীতে দেখলাম মিত্রা সেনকে।

মাথাটা বুকের সামনে ঝুলে পড়েছে। হাত দুটো কোলের উপরে ভাঁজ করা। পরিধানের সাদা জর্জেটের জরি ও চুমকি বসানো আঁচলটা বুকের ওপর দিয়ে নেমে এসেছে। চাঁদের আলোয় সেই আঁচলার জরির কাজ ও চুমকিগুলো যেন চিকচিক করে জ্বলছে!

আশেপাশে কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।

স্তিমিত চন্দ্রালোকে সমস্ত দৃশ্যটা এমনি করুণ যে, কয়েক মুহূর্ত কারও কণ্ঠ থেকে যেন স্বরটুকু পর্যন্ত বের হয় না। মৃত্যুর হাতে কি মর্মান্তিক করুণ আত্মসমর্পণ! মিত্রা সেনের সমস্ত দম্ভ, আভিজাত্য ও বৈশিষ্ট্য যেন নিঃশেষে তার শেষ করুণ ভঙ্গিটির মধ্যে নিবিড় এক আত্মসমর্পণে ধ্যানস্থ হয়ে আছে।

নির্বাক চিত্রার্পিতের মত মৃতের চারিপাশে সব দাঁড়িয়ে।

ধীরে ধীরে আমিই শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম উপবিষ্ট মৃতদেহের সামনে সর্বপ্রথম। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আর একবার ভাল করে তাকালাম মৃতার দিকে।

তারপর একসময় আবার ঘুরে গিয়ে দাঁড়ালাম মৃতের পশ্চাতের দিকে। এবং হঠাৎ সেই সময় নজরে পড়ল সেই মৃদু চন্দ্রালোকে মাটিতে কি একটা বস্তু চকচক করছে। কৌতূহলভরে নিচু হয়ে দেখতে যেতেই বুঝলাম সেটা একটা ছোট কাঁচের পেগ গ্লাস।

সন্তর্পণে মাটি থেকে পেগ গ্লাসটা তুলে নিলাম।

আমার হাতে পেগ গ্লাসটা দেখে অস্ফুটকণ্ঠে ব্যারিস্টার মনোজ দত্ত বললেন, পেগ গ্লাস না?

হ্যাঁ।

গ্লাসটা নাকের কাছে তুলে ধরতেই একটা আলতো অ্যালকহলের গন্ধ আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল।

মনোজ দত্তই আবার কথা বললেন, মিস সেন তো কখনও ড্রিঙ্ক করতেন না! পেগ গ্লাস এখানে এল তবে কি করে?

মনোজ দত্তর কথায় মনে পড়ল, সত্যিই মিত্রা সেনকে আজ পর্যন্ত কখনও ড্রিঙ্ক করতে দেখিনি এবং বিশাখার মুখেই শুনেছি তিনি ড্রিঙ্ক করেন না কখনও। এবং বৈকালী সঙ্ঘের সভ্য-সভ্যাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ড্রিঙ্কের ব্যাপারটা আদপেই নাকি পছন্দ করতেন না। এমন কি তিনি দু-একবার এমন প্রস্তাবও নাকি তুলেছিলেন যে, বৈকালী সঙ্ঘ থেকে ড্রিঙ্কের ব্যাপারটা একেবারে তুলে দেওয়া হোক। কিন্তু অন্যান্য সভ্য ও সভ্যাদের প্রতিবাদের জন্যই সেটা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি আজও।

সেই মিত্রা সেনের রহস্যপূর্ণ আকস্মিক হত্যার অকুস্থানে পেগ গ্লাস তাহলে এল কি করে!

আর শুধু তাই নয়, পেগ গ্লাসটার মধ্যে এখনও সদ্য অ্যালকোহলের গন্ধ জড়িয়ে আছে।

পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সেই রুমালের মধ্যে অত্যন্ত সন্তর্পণে পেগ গ্লাসটা জড়িয়ে পকেটের মধ্যে আবার রেখে দিলাম।

মনোজ দত্ত ও আমার মধ্যে হঠাৎ দু-একটা কথাবার্তার শব্দের পরই যেন অকস্মাৎ সব আবার নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে।

মৃদু চালোকে একবার আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান নির্বক নিশ্চল নরনারীদের মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল কেউ যেন তারা জীবিত নয়। কতকগুলো পটে আঁকা ছবি মাত্র আমার আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে।

পকেট থেকে এবারে সরু পেনসিল-টচটা বের করে মৃতার আরও একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে ডান হাতে টর্চটা জ্বেলে বাঁ হাত দিয়ে মিত্রা সেনের চিবুকটা স্পর্শ করতেই একটা বরফ-শীতল বিদ্যুৎ-স্পর্শে যেন হাতের আঙ্গুলগুলো আমার শিহরিত হল।

মৃতের ঝুলন্ত শিথিল মুখখানি ঈষৎ উত্তোলিত হল আমার হাতের মধ্যে। বুঝলাম মৃত্যু বেশিক্ষণ ঘটেনি। এখনও মৃতদেহে রাইগার মর্টিস্ সেট ইন্ করেনি। আমার হস্তপ্ত টর্চের আলোয়, সেই মুহূর্তে উত্তোলিত মুখখানির মধ্যে যেটা আমার দুচোখের প্রখর দৃষ্টির সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, সেটা হচ্ছে মিত্রা সেনের প্রসাধন-চিহ্নিত সমগ্র মুখখানি জুড়ে নীলাভ একটি ছায়া। আর বিস্ফারিত দুটি চক্ষু, ঈষৎ বিভক্ত দুটি ওষ্ঠের প্রান্ত বেয়ে একটি লালা ও রক্তমিশ্রিত কালচে ধারা নেমে এসেছে।

সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের অজ্ঞাতেই যেন মনের ভেতর থেকে কে আমায় বলে উঠল, বিষ! কোন তীব্র বিষেই তার মৃত্যু ঘটেছে!

তীব্র কোন বিষের ক্রিয়াতেই মৃত্যু।

মনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতটা বোধ হয় অকস্মাৎ মুখ দিয়েই আমার অজ্ঞাতে অস্ফুটে শব্দায়িত হয়ে উঠেছিল : বিষ!

সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনজনের কণ্ঠ হতে প্রতিশব্দের মতই যেন দু-অক্ষরের কথাটি উচ্চারিত হয় : বিষ!

হ্যাঁ, বিষেই মৃত্যু হয়েছে। ক্ষীণ অথচ স্পষ্টকণ্ঠে বললাম আমি।

কথা বললে এবারে বিশাখা, আত্মহত্যা! সুইসাইড!

সুইসাইডও হতে পারে, হোমিসাইডও হতে পারে! কথা হচ্ছে, বিষ যখন মৃত্যুর কারণ এবং মৃত্যু যখন সকলেরই আমাদের অজান্তে আকস্মিকভাবে ঘটেছে, এখুনি সর্বাগ্রে আমাদের একটা পুলিসে সংবাদ দেওয়া কর্তব্য।

আমার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রার চার-পাঁচটি কণ্ঠ হতে যুগপৎ অস্ফুটে উচ্চারিত হল : পুলিস!

হ্যাঁ, পুলিসে এখুনি একটা সংবাদ দিতে হবে বৈকি।

বিশাখা চৌধুরী বললে, পুলিস! পুলিস কেন?

বললাম তো, সাসপিসাস্ ডেস্! আপনারা একজন কেউ যান, পুলিসে একটা ফোন করে দিন। নিকটবর্তী থানা যেটা সেখানে ফোন করলেই হবে।

সকলের মুখের দিকে তাকিয়েই কথাটা আমি বললাম। কিন্তু কারোর মধ্যেই যেন সাড়া পেলাম না।

পরস্পর তারা বারেকের জন্য পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে যেন সকলে নিশ্চল পূর্ববং দাঁড়িয়েই রইল।

বুঝলাম কেউ এগুবে না।

তখন আমিই শ্ৰীমন্ত পালের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, চলুন শ্ৰীমন্তবাবু, ফোনটা কোনখানে আমাকে দেখিয়ে দেবেন চলুন।

চলুন, বারে ফোন আছে। শ্ৰীমন্ত পাল মৃদুকণ্ঠে যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই কথাটা উচ্চারণ করলেন।

স্থানত্যাগের পূর্বে আমি সকলকে সম্বোধন করে বললাম, একটা কথা বলা প্রয়োজন, পুলিস না আসা পর্যন্ত অর্থাৎ তাদের বিনানুমতিতে যেন এখান থেকে বাইরে কেউ যাবেন না।

বাইরে যাব না! অভিনেত্রী সুমিত্রা চ্যাটার্জী প্রশ্ন করলেন আমাকে।

না। এ অবস্থায় পুলিস এসে এখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত, বুঝতেই তো পারছেন, এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে রিস্ক আছে। যদি শেষ পর্যন্ত মিত্রা সেনের মৃত্যুর ব্যাপারটা সুইসাইড না হয়ে হোমিসাইড প্রমাণ হয়, হয়তো আপনাদের প্রত্যেককেই আলাদা আলাদা ভাবে পুলিসের জবানবন্দির সম্মুখীন হতে হবে। আপনারা তাহলে অপেক্ষা করুন। আমি একটা ফোন করে দিয়ে আসি। আর একটা কথা, মৃতদেহের আশেপাশে কেউ যেন যাবেন না, মৃতদেহ স্পর্শও যেন কেউ করবেন না।

কিন্তু আপনি সত্যসিন্ধুবাবু এত কথা জানলেন কি করে? হঠাৎ মনোজ দত্ত আমাকে প্রশ্ন করলেন।

আমি?

হ্যাঁ—these are all law points! আমি পূর্বে কিছুদিন লালবাজারে স্পেশাল ব্রাঞ্চে চাকরি করেছিলাম।

C. I. D.? অস্ফুট কণ্ঠে বললেন মনোজ দত্ত।

আর নিজের আত্মপরিচয় গোপন রাখা বৃথাই, তাই এবারে স্পষ্টকণ্ঠে জবাব দিলাম, হ্যাঁ মিঃ দত্ত, তবে সরকারী নয়, বে-সরকারী শখের সত্যসন্ধানী আমি। কিরীটী রায়ের নাম শুনেছেন?

কিরীটী রায়! একসঙ্গে সকলের কণ্ঠ হতেই নামটা উচ্চারিত হল।

হ্যাঁ, কিরীটী রায়ের সহকারী আমি সুব্রত রায়।

সে কি! অস্ফুট আর্তকণ্ঠে বললে এবারে বিশাখা চৌধুরী।

তাই বিশাখা দেবী। সত্যসিন্ধু আমার ছদ্মনাম, ছদ্মপরিচয়। আমি সুব্রত রায়। বলেই শ্ৰীমন্ত পালের দিকে এবারে তাকিয়ে বললাম, চলুন মিঃ পাল, we must inform the police!

একটা আকস্মিক বজ্রপাতের মতই যেন আমার সত্যকার পরিচয়টা সমস্ত পরিস্থিতিটাকে বিমূঢ় বিস্ময়ে একেবারে বরফের মতই জমাট বাঁধিয়ে দিয়েছিল।

বিমূঢ় নিশ্চল মানুষগুলোর মুখের দিকে আর না তাকিয়েই এবারে আমি শ্ৰীমন্ত পালকে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।