১২. পুরীর সমুদ্রের ধারে

॥ ১২ ॥

জ্ঞান হয়ে প্রথমেই মনে হল পুরীর সমুদ্রের ধারে রয়েছি। এত হাওয়া সমুদ্রের ধারেই হয়। কান ঠাণ্ডা, নাক ঠাণ্ডা, চুল উড়ছে।

কিন্তু জল কোথায়? বালি? ঢেউ কোথায়? এ গর্জন তো ঢেউয়ের গর্জন নয়; এ তো চলন্ত গাড়ির শব্দ। অন্ধকারের মধ্যে খোলা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছি আমরা। গাড়ির পিছনে বসে আছি আমি। আমি মাঝখানে, ডান পাশে লালমোহনবাবু, বাঁয়ে যে লোক তাকে চিনি না, দেখিনি কখনও। সামনে ড্রাইভারের মাথায় পাগড়ি, তার পাশে আরেকটা লোক। কেউ কথা বলছে না।

একটু মাথা তুলতেই পাশের লোকটা ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। আধা-গুণ্ডা টাইপের চেহারা। কোনও ধমক দিল না। কেন দেবে? আমাদের ভয় করার তো কোনও কারণ নেই। আমাদের কাছে কোনও হাতিয়ার নেই। হাতিয়ার ফেলুদার কাছে। সে এ গাড়িতে নেই। সে কোথায় জানি না।

কিন্তু ফেলুদার সেই ঝোলাটা?

আমার মাথার পিছনে, কাচের সামনের তাকটায়। ঝোলার স্ট্র্যাপটা আমার গালের পাশ অবধি ঝুলে আছে।

‘মিডনাইট’, পাশ থেকে বলে উঠলেন জটায়ু। আমি আড়চোখে দেখলাম ওঁর চোখ এখনও বোজা।

‘মিডনাইট, মা!—জয় মা, মা সন্তোষী!…মিডনাইট…’

‘বকো মৎ!’ পাশের লোক শাসাল।

আবার ঝিমুনি। আবার অন্ধকার। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে এল…

এর পর আবার যখন চোখ খুলল তখন মন বলছে দেখব কোনও মন্দিরের ভিতর বসে আছি। না, মন্দির না—গির্জা। এ তো পিতলের দিশি ঘণ্টা নয়। এ-সুর বিলিতি।

কিন্তু দেখলাম এটা মন্দির নয়। এটা বৈঠকখানা। মাথার উপর ঝাড় লণ্ঠন, তবে সেটা জ্বলছে না। ঘরে আলো বেশি নেই—কেবল একটা ল্যাম্প। সেটা একটা মখমলে মোড়া সোফার পাশে একটা টেবিলের উপর রাখা। আমিও বসে আছি মখমলের সোফায়। বসে না; আধ-শোয়া। আমার পাশেই লালমোহনবাবু। তাঁর চোখ বন্ধ। আমার ডান দিকে পরের সোফাটায় বসে আছে ফেলুদা। তার মুখ গম্ভীর। তার কপালের ডান দিকে একটা অংশ কালো হয়ে ফুলে আছে। বাঁয়ে আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে একটা লোক, যাকে আমরা পেয়ারেলাল বলে চিনি। তার হাতে রিভলভার। কোল্ট ৩২। নির্ঘাত ফেলুদারটা।

আরও তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দিকে মুখ করে। কেউ কোনও কথা বলছে না। কথা বলার লোক বোধহয় এখনও আসেনি। আমাদের সামনে সবচেয়ে যে বড় সোফা, যার মখমলের রং কালো, সেটা এখনও খালি। মনে হয় সেটা কারুর অপেক্ষায় রয়েছে। বোধহয় মিস্টার চৌধুরী। কিন্তু এটা আলিপুরের কোনও হালের বাড়ি নয়। এ বাড়ি আদ্যিকালের। এর সিলিং বিশ হাত উঁচু। লোহার কড়িবরগা। এর দরজা দিয়ে ঘোড়া ঢুকে যায়।

আরও আছে। ঘড়ি। ঝুলোনো আর দাঁড়ানো ঘড়ি। তার মধ্যে একটা প্রায় দেড় মানুষ উঁচু, আমার ডান দিকে। এই ঘড়িগুলোই বাজছিল একটু আগে। এখনও মাঝে মাঝে বেজে উঠছে। রাত দুটো।

ফেলুদার সঙ্গে একবারই চোখাচোখি হয়েছে। ওর চোখের ভাষাটা আমি জানি বলেই ভরসা পেয়েছি। ওর চোখ বলছে ঘাবড়াসনি, আমি আছি।

‘গুড মর্নিং, মিস্টার মিটার!’

বিলিতি নিয়মে রাত বারোটার পরেই মর্নিং।

ভদ্রলোককে দেখতে পাইনি, কারণ ল্যাম্পের ঠিক পিছন দিকের দরজা দিয়ে ঢুকেছেন। এখনও মখমল। আগের বার যা দেখেছিলাম তার চেয়েও বেশি। না হবার কোনও কারণ নেই। এখন উনি আপ, ফেলুদা ডাউন।

‘ওতে কী আছে পেয়ারেলাল? ওটা সার্চ করা হয়েছে ভাল করে?’

ভদ্রলোকের চোখ গেছে ফেলুদার ঝোলার দিকে। ওটা যে কখন ফেলুদার কাছে চলে গেছে জানি না।

পেয়ারেলাল জানাল যে ওতে বই খাতা আর ছবি ছাড়া আর কিছু নেই। একটা বোতল ছিল, সরিয়ে রাখা হয়েছে।

‘কিছু মনে করবেন না এইভাবে ধরে আনার জন্য’—গলায় একটু বেশি পালিশ দিয়ে ফেলুদাকে উদ্দেশ করে কথাটা বললেন মিঃ চৌধুরী। ‘ভাবলাম পেরিগ্যাল রিপিটার সম্পর্কে যখন আপনার এতই কৌতুহল, তখন জিনিসটা আমার হাতে এসে পড়ার মুহূর্তে আপনি থাকলে হয়তো খুশিই হবেন।—কেয়া বলওয়ন্ত, সাফা হুয়া ঘড়ি?’

একজন ভৃত্য মাথা নেড়ে বলল, ঘড়ি সাফা হয়ে এল, এক্ষুনি আসবে।

‘টু হান্ড্রেড ইয়ারস গ্রেভের মধ্যে পড়েছিল,’ বললেন মিঃ চৌধুরী। ‘উইলিয়াম এ কথাটা আগে আমাকে বলেনি। বলেছে তার কাছে পেরিগ্যাল ঘড়ি আছে। অথচ আনব-আনব করে দেরি করছে। তারপর চাপ দিতে বলল ঘড়ি আছে মাটির নীচে তাই দেরি হচ্ছে। ডেডবডির পাশে পড়েছিল তাই বললাম বুরুশ দিয়ে ঝাড়ন দিয়ে সাফা না করে আমার কাছে আনবে না। ডেটলের পোঁছ দিয়ে দেবার কথাও বলেছি।’

ফেলুদা সটান চেয়ে আছে মিঃ চৌধুরীর দিকে। মুখ দেখে তার মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। আমাদের ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করেছিল; ওকে মাথায় বাড়ি মেরে।

‘আপনি কোত্থেকে জানলেন এ ঘড়ির কথা মিঃ মিটার?’ প্রশ্ন করলেন মহাদেব চৌধুরী।

‘ঊনবিংশ শতাব্দীর একটা ডায়রি থেকে। যার ঘড়ি তার মেয়ের ডায়রি।’

‘ডায়রি? চিঠি না?’

‘না, ডায়রি।’

মিঃ চৌধুরী তার বিলিতি সিগারেটের প্যাকেটটা বার করেছেন পকেট থেকে, আর সেইসঙ্গে সোনার লাইটার আর সোনার হোল্ডার।

‘আপনার সঙ্গে উইলিয়ামের পরিচয় নেই?’ হোল্ডারে সিগারেট ঢোকালেন মিঃ চৌধুরী।

‘উইলিয়াম নামে আমি কাউকে চিনি না।’

ফস্ করে মিঃ চৌধুরীর ডানহিল লাইটার জ্বলে উঠল।

‘তা হলে ওই ডায়রি পড়েই আপনার ঘড়িটার উপর লোভ হয়েছিল?’

‘লোভ জিনিসটা তো আপনার একচেটিয়া, মিঃ চৌধুরী।’

মখমলের উপর মেঘের ছায়া। দুই আঙুলে ধরা হোল্ডারটা ঈষৎ কাঁপছে।

‘আপনি মুখ সামলে কথা বলবেন, মিঃ মিটার!’

‘সত্যি কথা বলতে আমি মুখ সামলাই না, মিঃ চৌধুরী। আমার উদ্দেশ্য ছিল ঘড়ি যাতে গডউইনের কবরেই থাকে; আপনার মতো লোকের হাতে—’

ফেলুদার কথা শেষ হল না। একজন লোক হাতে একটা সিল্কের রুমালের উপর একটা জিনিস এনে মিঃ চৌধুরীকে দিল। চৌধুরী জিনিসটা হাতে তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশ থেকে একটা গোঙানির শব্দ উঠল—

‘আঁ…আঁ…আঁ..আঁম্…’

লালমোহনবাবুর জ্ঞান হয়েছে, আর হয়েই মিঃ চৌধুরীর হাতের জিনিসটা দেখেছেন। জিনিসটা তিনি খুব ভাল করেই চেনেন।

মিঃ চৌধুরীর অবস্থা যে কী হল সেটা আমার পক্ষে লিখে বোঝানো খুব মুশকিল। ফেলুদাকেই বলতে শুনেছি যে গানের সাত সুর আর রামধনুর সাত রঙের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, কিন্তু একটা মানুষের গলায় আর মুখে এত কম সময়ে এত রকম সুর আর এত রকম রং খেলতে পারে সেটা ভাবতে পারিনি। গালাগাল যা বেরোল মানুষটার মুখ দিয়ে সেটা শোনা যায় না, বলা যায় না, লেখা যায় না। ফেলুদা অবিশ্যি নির্বিকার। আমি বুঝতে পারছি এটা তারই কীর্তি; কাল যখন দুপুরে দশ মিনিটের জন্য সে গোরস্থানে ঢুকেছিল তখনই সে এ কাজটা করে এসেছে। কিন্তু আসল ঘড়ি কি তা হলে নেই?

কুককেলভির ঘড়িটাকে মিঃ চৌধুরী উন্মাদের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তার ডান পাশে খালি সোফাটার দিকে। আর তার পরেই তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন—

‘উইলিয়াম সাহাবকো বোলাও!—আর উয়ো রিভলভার দেও হামকো!’

পেয়ারেলাল রিভলভারটা মিঃ চৌধুরীর হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মিঃ চৌধুরী দু-একবার ‘স্কাউন্ড্রেল’ ‘সুইন্ডলার’ ইত্যাদি বলে সোফা ছেড়ে উঠে অত্যন্ত অসহিষ্ণু ভাবে পায়চারি শুরু করলেন।

এবার পেয়ারেলাল সেই পিছনের দরজাটা দিয়ে আরেকটা লোককে সঙ্গে নিয়ে ঢুকল। আবছা অন্ধকারে দেখলাম কাঁধ অবধি লম্বা মাথার চুল আর ঠোঁটের দুপাশে ঝুলে থাকা গোঁফ। পরনে প্যান্ট, শার্ট আর সুতির কোট।

‘কী ঘড়ি নিয়ে এসেছ তুমি কবর খুঁড়ে?’ বজ্রগম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন মিঃ চৌধুরী। তিনি আবার সোফায় গিয়ে বসেছেন, তাঁর হাতে এখনও রিভলভার, দৃষ্টি এখনও ফেলুদার দিকে।

‘যা পেয়েছি তাই এনেছি, মিঃ চৌধুরী’—আগন্তুক কাতর স্বরে জবাব দিল। ‘আপনাকে ঠকিয়ে কি আমি পার পাব? আপনি এত বড় এক্সপার্ট!’

‘তা হলে সে চিঠির কথা কি মিথ্যে?’ ঘর কাঁপিয়ে প্রশ্ন করলেন মহাদেব চৌধুরী।

‘তা কী করে জানব মিঃ চৌধুরী? ওটার উপর ভরসা করেই তো সব কিছু। এই তো সেই চিঠি—দেখুন না।’

আগন্তুক একটা পুরনো চিঠি বার করে মিঃ চৌধুরীর হাতে দিল। চৌধুরী সেটায় চোখ বুলিয়ে বিরক্তভাবে সেটাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিলেন পাশের সোফার উপর, আর ঠিক সেই সময় হেসে উঠল ফেলুদা। প্রাণখোলা হাসি। এমন হাসি ওকে অনেকদিন হাসতে দেখিনি।

‘হাসির কী পেলেন আপনি মিঃ মিটার?’ গর্জন করে উঠলেন মহাদেব চৌধুরী। কোনওমতে হাসিটাকে একটু চেপে ফেলুদা উত্তর দিল—

‘আপনার এত নাটকীয় আয়োজন সব ভেস্তে গেল দেখে হাসি পেল, মিঃ চৌধুরী।’

চৌধুরী রিভলভার হাতে আবার সোফা ছেড়ে উঠে পুরু কার্পেটের উপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে এগিয়ে এলেন ফেলুদার দিকে।

‘আমার নাটক কি শেষ হয়ে গেছে ভাবছেন, মিঃ মিটার? আসল ঘড়ি যে আপনার কাছে নেই তার কী বিশ্বাস? আপনি তো গোরস্থানে অনেকবার গেছেন। আজও তো উইলিয়ামের আগে আপনি পৌঁছেছেন। আপনার কাছে ঘড়ি থাকলে সে ঘড়ি হাত না করে কি আমি ছাড়ব? আপনি যেখানে সেটা লুকিয়ে এসেছেন সেখান থেকে আপনাকেই সেটা বার করে দিতে হবে মিঃ মিটার। আর ঘড়ি যদিও নাও থেকে থাকে—এই চিঠি যদি মিথ্যে হয়ে থাকে—তা হলেও যে আমি আপনাকে ছেড়ে দেব এটা কী করে ভাবছেন? আপনার সব ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাসটা যে আমার পক্ষে বড্ড অসুবিধাজনক, মিঃ মিটার! কাজেই, নাটক ফুরিয়েছে কী বলছেন? নাটক তো সবে শুরু!’

ফেলুদার গলায় এবার আমার একটা খুব চেনা সুর দেখা দিল। এটা ও নাটকের চরম মুহূর্তে ব্যবহার করে। লালমোহনবাবু বললেন, এ সুরটা নাকি ওঁকে তিব্বতি শিঙার কথা মনে করিয়ে দেয়।

‘আপনি ভুল করছেন, মিঃ চৌধুরী। নাটক এখন আমার হাতে, আপনার হাতে নয়। এই মুহূর্ত থেকে আমি নাটকটা চালাব। আমিই বিচার করব আপনাদের দুজনের মধ্যে কার অপরাধ বেশি—আপনার, না যিনি উইলিয়াম বলে—’

ঘরে তোলপাড় ব্যাপার। উইলিয়াম একটা প্রচণ্ড লাফ দিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো পেয়ারেলালকে এক ঘুঁষিতে ধরাশায়ী করে বাইরের দরজার দিকে ধাওয়া করেছে। চৌধুরীর রিভলভারের গুলি তাকে হাত দু-একের জন্য মিস করে দরজার বাঁ দিকের একটা দাঁড়ানো ঘড়ির কাচের ডায়াল খানখান করে দিল; আর সবাইকে অবাক করে সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল সেই জখম ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি।

মিস্টার উইলিয়ামকে ধরতে আরও দুজন লোক ছুটছে; কিন্তু তারা বেশি দূর যেতে পারল না। তাদের পথ আটকেছে কয়েকজন সশস্ত্র লোক। তারা এবার উইলিয়াম সমেত সকলকে নিয়ে বৈঠকখানায় এসে ঢুকল। সামনের ভদ্রলোককে দেখে বলে দিতে হয় না ইনি একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর। সঙ্গে আরও পাঁচজন পুলিশ কনস্টেবল ইত্যাদি, আর সবার পিছন দিয়ে সাগ্রহে উঁকি দিচ্ছেন লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদ দত্ত।

‘সাবাস, হরিপদবাবু,’ বলল ফেলুদা।

‘আপনিই তো ফেলু মিত্তির?’ ঠিক লোকের দিকে চেয়েই প্রশ্নটা করলেন ইন্‌স্পেক্টর মশাই। ‘কী ব্যাপার বলুন তো? মিঃ চৌধুরীকে তো চিনি—কিন্তু ইনি কে, যিনি পালাচ্ছিলেন?’

ফেলুদা এর উত্তর দেবার আগে হতভম্ব মহাদেব চৌধুরীর হাত থেকে নিজের রিভলভারটি অনায়াসে বার করে নিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, মিঃ চৌধুরী—এবার আপনি কাইন্ডলি আপনার নিজের জায়গায় গিয়ে বসুন তো। নাটকের বাকি অংশটা দেখার সুবিধে হবে। আর তা ছাড়া আপনাকে কালো মখমলে মানায় বড্ড ভাল। আর মিস্টার উইলিয়াম’—ফেলুদার দৃষ্টি ঘুরে গেছে—‘আপনার চুল আর গোঁফটাতে কিন্তু আপনাকে হুবহু আপনার প্রপিতামহের মতো দেখাচ্ছে। ও দুটো খুলবেন কি দয়া করে?’

পুলিশ টান দিতেই উইলিয়ামের গোঁফ আর পরচুলা খুলে এল, আর অবাক হয়ে দেখলাম উইলিয়ামের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন নরেন বিশ্বাসের ভাই গিরীন বিশ্বাস!

‘এবার বলুন তো মিঃ বিশ্বাস,’ বলল ফেলুদা, ‘আপনার পুরো নামটা কী?’

‘কেন; আমার নাম আপনি জানেন না?’

‘আপনার এখন দুটো নাম জানা যাচ্ছে। এই দুটো জুড়েই বোধহয় আপনার আসল নাম, তাই না? উইলিয়াম গিরীন্দ্রনাথ বিশ্বাস—তাই না? অন্তত প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনে গোল্ড মেডালিস্টদের তালিকায় তো তাই বলছে। আর আপনার ভাইয়ের নাম বলছে মাইকেল নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। ভিজিটিং কার্ডের ‘এম’টা হয়ে যাচ্ছে মাইকেল, তাই না? আপনারা বাংলা নামটা ব্যবহার করতেন বলেই বোধহয় নরেনবাবু ভিজিটিং কার্ডে “এম. এন” না ছেপে “এন. এম” ছেপেছিলেন—তাই না?’

গিরীনবাবু চুপ। বোঝাই যাচ্ছে ফেলুদা ঠিকই বলেছে।

‘আপনার দাদা আপনাকে কী বলে ডাকেন, মিঃ বিশ্বাস?’

‘তাতে আপনার কী প্রয়োজন?’

‘আপনি যখন বলবেন না, তখন আমিই বলছি। উইল। উইল বলে ডাকেন আপনার দাদা। হাসপাতালে জ্ঞান হবার পর তিনি আপনারই নাম উচ্চারণ করেছিলেন দুবার—তাই না?’

পুরীর সমুদ্রের ধারে

এবার ফেলুদা লাল খামটা থেকে একটা বড় ছবি টেনে বার করল। ‘দেখুন তো গিরীনবাবু এঁদের চেনেন কি না। এ ছবি হয়তো আপনাদের বাড়িতেও নেই। কিন্তু বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ডে ছিল।’

স্বামী-স্ত্রীর ছবি। যাকে বলে ওয়েডিং গ্রুপ। ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে গিরীনবাবুর চেহারার আশ্চর্য মিল। আর ভদ্রমহিলা মেমসাহেব।

ফেলুদা বলল, ‘চিনতে পারছেন এঁদের? ইনি হচ্ছেন পার্বতীচরণ—অর্থাৎ পি সি বিশ্বাস, আপনার প্রপিতামহ। ইনি যে ক্রিশ্চান হয়েছিলেন সেটা তো এঁর পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর এই মহিলাটি হচ্ছেন টমাস গডউইনের নাতনি—ওই চিঠিটা যিনি লিখেছেন তিনি—ভিক্টোরিয়া গডউইন। এঁর কুমারী অবস্থার ছবিও বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ডে রয়েছে। এই ভিক্টোরিয়া আপনার প্রপিতামহের মতো একজন নেটিভ ক্রিশ্চানকে ভালবেসে তার ঠাকুরদাদার বিরাগভাজন হয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুশয্যায় টম গডউইন ভিক্টোরিয়াকে ক্ষমা করে যান। তার এক বছর পরেই পার্বতীচরণ ভিক্টোরিয়াকে বিয়ে করেন। তার মানে হচ্ছে এই যে, কলকাতায় একটি নয়, দুটি পরিবারের সঙ্গে টম গডউইনের নাম জড়িত রয়েছে—একটি রিপন লেনে, আরেকটি নিউ আলিপুরে। আর আশ্চর্য এই যে, দুজনের কাছেই এমন দলিল রয়েছে যাতে টমাসের ঘড়ির উল্লেখ রয়েছে। এক হল ভিক্টোরিয়ার এই চিঠি, আর আরেক হল টমাসের মেয়ে শার্লট গডউইনের ডায়রি।’

আশ্চর্য ঘটনা! গল্পকে হার মানায়। ভিক্টোরিয়ার লেখা চিঠির একটা তাড়া বহুকাল থেকেই নাকি নরেনবাবুদের বাড়িতে রয়েছে পুরনো ট্রাঙ্কের মধ্যে, কিন্তু কেউ গরজ করে পড়েনি। পুরনো কলকাতা নিয়ে লিখতে শুরু করার পর নরেনবাবু চিঠিগুলো পড়েন। তখনই টমাস গডউইনের ঘড়ির ঘটনাটা জানতে পারেন, আর ভাইকে সে সম্বন্ধে বলেন।

গিরীনবাবু ফেলুদার জেরার ঠেলায় কাহিল, কিন্তু এখনও তাকে রেহাই দেবার সময় আসেনি। ফেলুদা হঠাৎ প্রশ্ন করল—

‘আপনার কি রেসের মাঠে যাবার অভ্যেস আছে, মিঃ বিশ্বাস?’

ভদ্রলোক কিছু বলার আগে মিঃ চৌধুরী খেকিয়ে উঠলেন।

‘আমার কাছ থেকে টাকা আগাম নিয়ে সব ঘোড়ার পিছনে খুইয়েছে, আর এখন কবর খুঁড়ে কুককেলভির ঘড়ি এনে হাজির করেছে—অকর্মা কোথাকার!’

ফেলুদা চৌধুরীর কথায় কান না দিয়ে গিরীনবাবুকেই উদ্দেশ করে বলে চলল, ‘তার মানে টম গডউইনের একটি গুণ আপনি পেয়েছেন! আর সেই কারণেই বোধহয় এত বড় একটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন?’

উত্তরটা এল বেশ ঝাঁজের সঙ্গে।

‘মিঃ মিত্তির, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে, একশো বছর পেরিয়ে গেলে কবরের ভিতরের কোনও জিনিসের উপর কোনও ব্যক্তিবিশেষের আর কোনও অধিকার থাকে না। ওই ঘড়িটা এখন আর টম গডউইনের সম্পত্তি নয়।’

‘সেটা জানি মিঃ বিশ্বাস। ও ঘড়ি সরকারের সম্পত্তি, আপনারও নয়। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, আপনার অপরাধ তো শুধু ঘড়ি চুরির চেষ্টা নয়, অন্য অপরাধও যে আছে।’

‘কী অপরাধ?’ গিরীন বিশ্বাস এখনও একগুঁয়ে ভাব করে চেয়ে আছেন ফেলুদার দিকে।

এবার ফেলুদা তার পকেট থেকে ছোট্ট একটা জিনিস বার করল।

‘দেখি তো, এই বোতামটা আপনার ওই কোটটা থেকেই পড়েছে কি না—যে কোটটা আপনি এই দুদিন আগে হংকং লন্ড্রি থেকে নিয়ে এলেন।’

ফেলুদা বোতাম নিয়ে এগিয়ে গেল।

‘এই দেখুন, মিলে যাচ্ছে।’

‘তাতে কী প্রমাণ হল?’ প্রশ্ন করলেন গিরীনবাবু। ‘এটা খুলে পড়ে যায় গোরস্থানে। আমি তো অস্বীকার করছি না যে সেখানে গিয়েছিলাম।’

‘আমি যদি বলি এটা আপনার কোট নয়, আপনার দাদার কোট, তা হলে স্বীকার করবেন কি?’

‘কী আবোল-তাবোল বকছেন আপনি?’

‘আবোল-তাবোল আমি বকছি না, মিঃ বিশ্বাস, আপনি বকছেন। কাল আমার বাড়িতে এসে বকেছেন, আবার এখানে বকছেন। এ কোট আপনার দাদার। এটা পরে তিনি গোরস্থানে গিয়েছিলেন সেই ঝড়ের দিন। গিয়ে দেখেন গডউইনের কবর খোঁড়া হচ্ছে, আপনি রয়েছেন। তিনি আপনাকে বাধা দিতে যান। আপনি তার মাথায় বাড়ি মারেন—লাঠি বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে। নরেনবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আপনি হয়তো তাকে মেরেই ফেলতেন, কিন্তু সেই সময় ঝড়টা আসে। আপনি পালাতে যান। গাছ পড়ে—’

গিরীনবাবু আবার বাধা দিলেন।

‘আমার দাদাকে আপনি মিথ্যেবাদী বানাতে চান? তিনি বলেছেন তাঁর মাথায় গাছের ডাল—’

কিন্তু ফেলুদার কথা আটকানো এখন সহজ নয়। সে বলেই চলল—

‘গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আপনার পিঠে। আপনার গায়ে কোট ছিল না। পিঠের জখম ঢাকবার জন্য আপনি দাদার কোট খুলে নিজে পরেন। কোটের বোতাম ছিঁড়ে যায়, পকেট থেকে মানিব্যাগ পড়ে যায়। আপনার নিজের পকেট থেকে রেসের বই—’

গিরীনবাবু আবার পালাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। এবার ফেলুদাই তাঁকে ধরে তাঁর কোটটা খুলে দিয়ে দেখিয়ে দিল তাঁর টেরিলিনের শার্টের নীচে ব্যান্ডেজটা।

‘আপনার দাদা আপনাকে বাঁচাবার জন্য অনেক মিথ্যে বলেছেন গিরীনবাবু, কারণ তিনি আপনাকে অত্যন্ত বেশিরকম স্নেহ করতেন।’

ফেলুদা এবার তার ঝোলাটায় কুককেলভির ঘড়িটা আর ভিক্টোরিয়ার চিঠিটা ভরে নিয়ে, সেটা কাঁধে নিয়ে হতভম্ব মিঃ চৌধুরীর দিকে ফিরে বলল, ‘আপনার সব ঘড়িতে এক সঙ্গে বারোটা বাজলে কেমন শোনায়, সেটা শোনার আর সুযোগ হল না। হবে হয়তো একদিন!’

তিনবার ডাকার পর জটায়ু উঠলেন। তিনি যে এর ফাঁকে আবার হুঁশ হারিয়ে নাটকের আসল দৃশ্যটাই মিস্ করে গেছেন সেটা এতক্ষণ বুঝতে পারিনি।

* * *

‘এসব লোককে দাবিয়ে রাখা যায় না রে। পুলিশও কিছু করতে পারে না। মহাদেব চৌধুরীর মতো লোকগুলো হল এক-একটা হিটলার। কাজ গুছিয়ে নিতে এরা কত লোককে যে টাকার জোরে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখে তার ঠিক নেই।’

আমরা তিনজনে পেনেটির গঙ্গার ঘাটে এসে বসেছি। চৌধুরীর বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ এই ঘাট। পুব আকাশের রং দেখে মনে হচ্ছে সূর্য এই উঠল বলে। হরিপদবাবু অক্ষরে অক্ষরে ফেলুদার নির্দেশ পালন না করলে আজ আমাদের কী দশা হত জানি না তো। (লালমোহনবাবু বললেন গঙ্গাপ্রাপ্তি)। একজন লোকের কতখানি দায়িত্বজ্ঞান থাকলে তবে আমাদের গাড়ির পিছনে ধাওয়া করে এসে সটান গিয়ে থানায় খবর দেয়, সেটা ভাবতে অবাক লাগছে। লালমোহনবাবু হরিপদবাবুরই এনে দেওয়া ভাঁড়ের চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, ‘গাড়ি কেনার ফলটা আশা করি টের পেলেন?’

‘মোক্ষমভাবে’, বলল ফেলুদা। ‘আপনার গাড়ির উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে এই তিন দিনে। আজ শহরে ফিরে দুটো জায়গায় যাবার পর আর বেশ কিছুদিন ও গাড়ির ওপর জুলুম করব না।’

‘দুটো জায়গা মানে?’

‘এক হল নরেনবাবুর বাড়ি। তাকে খবরটা আর সেই সঙ্গে এই চিঠিটা ফেরত দেওয়া দরকার।’

‘আর দ্বিতীয়?’

‘সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান।’

‘আ-হাবা-র!’

‘কী সাবধানে পা ফেলতে হয়েছে জানিস্ তোপ্‌সে? এর জন্যে জুত করে লড়তে পারলাম না লোকগুলোর সঙ্গে!’

ফেলুদা তার বাঁ পায়ের হান্টিং বুটটা খুলে তার ভিতর হাত ঢুকিয়ে প্রথমে বার করল তার তৈরি ফল্‌স সুকতলা, যার তলায় খোপ, যার মধ্যে তুলোর মোড়কে লুকিয়ে আছে একটি আশ্চর্য জিনিস, এত হুলস্থুল কাণ্ডের মধ্যেও যার শুধু কাচটি ছাড়া আর সবই অক্ষত, অটুট রয়েছে।

‘এটা যথাস্থানে ফেরত দিতে হবে না?’

ফেলুদার হাতে ঝুলছে টমাস গডউইনকে তার রান্নার জন্যে দেওয়া লখ্‌নৌ-এর নবাব সাদাত আলির প্রথম বকশিশ—ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারিগর ফ্রানসিস পেরিগ্যালের তৈরি রিপিটার পকেট ঘড়ি—দুশো বছর তার মালিকের কঙ্কালের পাশে ভূগর্ভে থেকেও যার জৌলুস সূর্যের প্রথম আলোতে এখনও আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।

॥ শেষ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *