১২. অশ্রুকণা বোকা নয়

অশ্রুকণা বোকা নয়, এ আঘাত যে কত বড় তা সে বোঝে। আবার এও বোঝে, মিনতি সেনের মাতৃত্বের হাহাকার। সত্যিই তো। আমি আমার খেয়ালে নিজের ভাগ্যকে এখানে নিয়ে এসেছি। এ দোষ আমার। মিনতি সেন আমাকে থাকতে দিয়েছেন, তাই বলে প্রতিদানে আমি তার সব কিছু কেড়ে নেবো এ হয় না। বললাম, না পিসি আমি সেভাবে বলিনি। দেখলেন না কেমন ব্যবহার করে চলে গেল। আজও যদি আবার আমাকে দেখে এমনি ভাবে চলে যায়। নিজেকে ক্ষমা করব কি করে? তাই বলছিলাম, তাকে থামিয়ে দিয়ে মিনতি সেন বললেন, থাক তোকে আর বলতে হবে না, যা বলার আমিই বলব। বরং আজকের রান্নাটা তুই করনা মা! আমি? কেন পারবি না? কোনদিন তো করিনি। নাইবা করলি, আজকেই না হয় হাতে খড়ি হোক।

আমি এলাম বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার ঠিক আগে। সেলিনার বায়না, সেও আসবে আমার সঙ্গে পিসি বললেন ও যখন যেতে চাইছে, তখন ওকে নিয়ে যাও প্রান্তিক। আমি খুব একটা না করতে পারলাম না। রাস্তায় বেরিয়ে ও বলল, আমাকে নিয়ে যেতে তোমার আপত্তি আছে? কতদিন দেখিনা পিসিকে। অদির সঙ্গে দেখা হয় না অনেক দিন। তাইতো আসতে এত জোর করলাম। আমি বললাম, তোমার যখন ওদের দেখতে ইচ্ছে করছে, তুমিতো এক দিন নিজেও যেতে পারতে। তা হলে ফিরে যাই। হ্যাঁ তাতো যাবেই, তা না হলে আর আমাকে অপমান করার মোলকলা পূর্ণ হবে কেন? সব ব্যপারে তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? আমি গেলে সত্যিই কি তোমার কোন অসুবিধা হবে? তুমি কি বলতে চাইছে, বলত? আমি যা বলতে চাইছি তাতে তোমার না বোঝার কথা নয়। অশ্ৰুদি কি আমায় তোমার সাথে দেখলে অস্বস্তি বোধ করবেন? ভীষণ রাগ হয়ে গেল ওর উপর, বললাম, সেলিনা, ভুলে যাচ্ছ কেন, আগে তোমার যাই পরিচিতি থাকুকনা কেন, এখন তুমি নীলাঞ্জনা পিসির মেয়ে, আর তিনি আমার পিসি। এতটা রেগে যাব বোধ হয় ভাবতে পারেনি সেলিনা। বলল, জানি, আর এও জানি, তুমি তা মানতে চাওনা। মানে? মানে তোমাকে তুমি নিজেই জিজ্ঞাসা কর।

বুঝতে পারছি সেলিনা সেদিন রাতের সেই আবেগ দুর্বলতার কথার দিকে ইঙ্গিত করছে। আমরা যখন শিয়ালদা স্টেশানে এসেছি একটা ফুলের দোকানে এসে থেমে গেল সেলিনা। বলল, দেখ কি অপূর্ব যুঁই ফুলের মালা, কিনব? তোমার পছন্দ? ভীষণ! আচ্ছা কেন তাহলে। কোন মালাটা কিনবো! যেটা তোমার পছন্দ! তোমার পছন্দ নেই? আমার একটাও পছন্দ নয়। দোকানদার বলল, সে কি বাবু এত সুন্দর সুন্দর মালা আপনার পছন্দ নয়? সেলিনা বলল থাক কিনতে হবে না! কেন? তোমার পছন্দ কোনটা বল না? আমারও পছন্দ নয় একটাও। চল, এখানে দেরি না করলে আগের ট্রেনটা পেয়ে যাব। আমি বললাম, বিনা কারণে রাগ করছ সেলিনা। ঠিক আছে আমিই পছন্দ করছি। তারপর ভালো দেখে একটা মালা পছন্দ করলাম, আমি দাম দিতে যাব, সেলিনা বলল, একটা নয় প্রান্তিক ভাই দুটো কেননা! কেন দুটো দিয়ে কি করবে। কেনই না। অবশেষে দরদাম করে দুটো মালা কিনলাম, ভালো করে প্যাকেট করে ওর হাতে দিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বললাম, রাতে কাউকে পরাবে বুঝি! লজ্জায় ওর কান লাল হয়ে উঠলো। কিন্তু সামলে নিয়ে বলল, দেখি যদি কেউ আসে। মালার প্যাকেটটা সেলিনা, তার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। আমরা গাড়ীতে উঠে পড়লাম। গাড়ীতে অসম্ভব ভিড়। ভিড়ের মধ্যে চাপা পড়ে ও আমার কাছ থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, আমি বললাম, স্টেশনে ঢোকার আগেই নেমে পড়ার জন্য এগিয়ে এস, ও বলল আচ্ছা।

ঢাকুরিয়া স্টেশনে যখন আমরা নামলাম, সে প্রায় সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ভিড়ের চাপে ওর শাড়ীর আঁজ কুচকে একাকার। কপালের টিপ যে কার হাতের ঘসায় কোথায় চলে গেছে কে জানে! আঁচলের নীচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে, সেলিনার ব্লাউজের উপরের বোতামটা খুলে গেছে কখন। সে দিকে ওর খেয়াল নেই। নামতে যে পেরেছে এইটাই যথেষ্ট। আমি দেখেও কিছু বলতে পারছি না।

কোন ভাবে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে রিক্সায় উঠলাম। ও বলল এইটুকু রাস্তাতে হেঁটেই যেতে পারতাম। হ্যাঁ, তা পারতাম। কিন্তু ধাক্কাধাক্কিতে এত ক্লান্তি লাগছে যে আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। ও প্রতিবাদ করে বলল তার থেকে বল না আমার সঙ্গে হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। আমি বললাম দুটোই সত্য। ও রেগে গিয়ে বলল, তা হলে তুমি রিক্সায় যাও, আমি হেঁটে যাচ্ছি। আমি বললাম সেই ভাল, তবে হেঁটে যাওয়ার আগে ভিড়ে কোচকানো শাড়ীর আঁচলটা ঠিক করে নিও, পথচারীদের দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। কথার পিঠে কথা বলা ওর স্বভাব। বলল, তোমার দৃষ্টিকটু না লাগলেই হলো। মুখে যাই বলুকনা কেন, দৃষ্টি কিন্তু ফিরালো বুকের আঁচলের দিকে। আর নিজের অবস্থা যে সে বুঝতে পারেনি এর জন্য ওর নিজের পরে রাগে চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করতে লাগল। কিন্তু বোতামটাই যে ছিঁড়ে গেছে। কি করবে। শাড়ীর আঁচলটাই যথা সম্ভব বুকের পরে ভাজ দিয়ে দিল, আর নিজের চোখ দুটি রাখল পায়ের দিকে আলতো করে। বললাম, তাহলে রিক্সায় যাবে না হেঁটে যাবে। ও আমার কোন উত্তর না দিয়ে রিক্সায়ালাকে তাড়া দিয়ে বলল, একটু তাড়াতাড়ি কর ভাই।

মিনতি সেনের বাড়ী এসে, ব্যাগটা কোন ভাবে টেবিলের ওপর রেখে ও বাথরুমে ঢুকে গেল। মিনতি সেন বললেন, কি হল প্রান্তিক, ওর শরীর খারাপ নয়তো। কখন বেরিয়েছিস? এইতো ঘন্টা দেড়েক আগে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল সেলিনা। মিনতি সেনকে প্রণাম করে বলল, কেমন আছ পিসি? ভাল। তোর মা কেমন আছে? ভালো। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল অশ্ৰুদিকে দেখছিনা, অশ্ৰুদি কোথায়? মিনতি সেন বললেন রান্না ঘরে, যানা ওর কাছে? এই যাই বলে নিজের ব্যাগটা নিয়েই ও রান্নাঘরে ঢুকে গেল, পিছন থেকে অশ্রুকণার চোখ বন্ধ করে বলল, বলত আমি কে? হঠাৎ না বলে কয়ে চোখ বন্ধ করাতে ও চমকে ওঠে, তারপর গলার স্বরে চিনতে পেরে বলে, রান্না করতে করতে যার কথা ভাবছিলাম, তুমি সেই এবার ছাড়তো মেয়ে! অশ্রুকণার চোখ ছেড়ে দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠলো সেলিনা, বলল মিথ্যে কথা অশ্রুদি, তুমি আমার কথা একবারের জন্যও ভাবোনি। অশ্রুকশা আঁচটা কমিয়ে দিয়ে ওর দিকে ফিরে বলল, ভাবিনি মানে, বিশ্বাস কর, প্রতিটি মুহূর্তে তোমার কথাই ভেবেছি, তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, যার জন্য সেলিনার পক্ষে অবিশ্বাস করা সম্ভব হল না। বলল তোমার কথা বিশ্বাস করছি অশ্রুদি। কিন্তু তোমার এ অবস্থা কেন? কি হয়েছে তোমার! না কিছু হয়নিতো। তারপর আঁচটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুমি ভিতরের ঘরে যাও সেলিনা, আমার হয়ে গেয়ে প্রায়। হোক এক সঙ্গেই যাব। বাঃ তুমি এসেই রান্নাঘরে ঢুকলে ওরা কি ভাববে? কেউ কিছু ভাববে না। তাছাড়া পিসি তো আমাকে তোমার কাছেই পাঠালেন। তারপর বলল তুমি যাও সেলিনা, আমি আসছি। আমি থাকলে তোমার রান্নায় অসুবিধা হবে, না? তোমার রান্নার নিয়ম কানুন শিখে ফেলি কি না তার জন্য তাড়াতে চাও। অশ্রুকণা হেসে ফেলে বলে, না ভাই তোমার সঙ্গে পারা যাবে না। পেরে কাজও-নেই অশ্ৰুদি, জীবনে তো আর আমার সঙ্গে ঘর করবেনা যে আমার সঙ্গে পারতে হবে। কিন্তু যার সঙ্গে ঘর করবে বলে সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছে তার সঙ্গে পারবে তো। চোখে দুষ্টু হাসি ঝিলিক মেরে যায় সেলিনার। কিন্তু সেলিনার এই ঠাট্টাও অশ্রুকণার মনে কোন নাড়া দেয় না। সে চুপ করে থেকে রান্না করতে লাগল। সেলিনা বলল কি হল অশ্ৰুদি, তোমার মনের মানুষকে নিয়ে অন্যদের ঠাট্টার অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে চাও নাকি! অশ্রুকণা আবারও আঁচটা কামিয়ে দিয়ে সেলিনার দিকে ফিরে বলল, কেন এরকম অসম্ভব ঠাট্টা কর সেলিনা। কার জন্য আমি ঘর ছেড়ে এসেছি, কে আমার মনের মানুষ। অশ্রুকণার এই হঠাৎ প্রতিবাদে অবাক হয়ে যায় সেলিনা। বলে, আমি জানিনা অশ্রুদি এতদিনে তোমার মনের কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা। আমি জানিনা, সত্যি তুমি কেন চলে এসেছে। না জেনে তোমায় যদি সত্যি আঘাত দিয়ে থাকি, তার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী। অশ্রুকণা ওকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, কি সেলিনা, তুমি তো সত্যি কিছুই জান না। বলে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে, উনুনের আঁচটা বাড়িয়ে রান্নায় মনসংযোগ করে অশ্রুকণা। সেলিনা বলল একটা কথা বলব অশ্ৰুদি? বল। কি হয়েছে তোমার? না কিছুই হয়নি তো। কিছুই যদি না হবে, তা হলে আজকের তুমি আর সেদিনের তুমির মধ্যে এত ফারাক কেন? সেতো সেলিনা, তোমার মধ্যেও সে ফারাক রয়েছে। হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে নিশ্চই কারণ আছে? কি কারণ। সব থেকে বড় কারণ অশ্রুদি, রেহানার ঐ ভাবে চলে যাওয়া। আমার মায়ের মৃত্যু, এবং তারপর তার ইচ্ছেনুসারে আমার নিজের মতামতকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। শুধু এই, আর কিছু নেই? সেলিনা বলল, জানিনা আর কিছু বলতে তুমি কি মীন করছ। তবে বয়সের সাথে সাথেতো অনেক কিছু পরিবর্তন হয় অদি। একদিন হয়ত মনে হতো আমার আচরণে কোন দোষ নেই, কিন্তু এখন আর তা মনে হয় না। এখন প্রতিটি আচরণকে মেপে চলতে হয়, পাছে লোকে কিছু ভাবে। যাকগে সে কথা, তোমার আর কত দেরি হয়ে গেছে তুমি একটা কাজ কর সেলিনা, কফিটা হয়ে গেছে পিসি ও প্রান্তিককে দিয়ে এসো না। বাঃ শুধু ওদের জন্য ক্লফি হবে, আর আমাদের হবে না? তুমি আর আমি এখানে বসেই খাবো। ওদের মা-ছেলের সঙ্গে বহুদিন পরে দেখা, মান-অভিমান ছাড়াও নিজেদের কত কথাই থাকতে পারে। কি দরকার তার ব্যঘাত ঘটিয়ে। কি জানি কি ভাবল সেলিনা। বলল, এতো তোমার স্বাভাবিক কথা নয় অশ্ৰুদি, কি হয়েছে আমায় বলবে না? জানিনা তোমার কোন উপকার করতে পারবে কি না, কিন্তু আমি আমার সহানুভূতিতে জানাতে পারবো। একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে অশ্রুকণা বলল, থাক ওসব কথা। আমার ভাগ্যের জন্য তো আমি দায়ী, তাকে তো কেউ গড়ে দিতে পারবে না। এরপর প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, রেহানার কোন সংবাদ পেলে? অবাক হয়ে সেলিনা বলল, রেহানার সংবাদ পেলে তুমি তা জানবে না, এ আবার কবে থেকে ভাবতে আরম্ভ করলে অশ্রুদি! তারপর নিজেই বলল, প্রান্তিক ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বুঝি? বিষয়টাকে হালকা করার জন্য বলল ঝগড়া হলে আনকোরা হাতে রান্না করতাম না। সেলিনা বলল, ঝগড়ার সঙ্গে রান্নার কোন সম্পর্ক নেই, আর রান্নাতো তুমি নিজের ইচ্ছেয় করছ না, পিসির শরীর খারাপ আর জবার মা আসেনি তাই। কি জানি, বলে প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে সেলিনাকে তাড়া লাগিয়ে বলল যাও সেলিনা এটা দিয়ে এস না। দাও বলে সেলিনা কফি এবং তার সঙ্গে টিফিন খাওয়ার জন্য অশ্রুকণা যা তৈরি করেছে তাই নিয়ে মিনতি সেনের ঘরে আসে। ঐ ঘরে বসেই তখন আমি মিনতি সেনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। মিনতি সেনের শেষ কথা শুনে ফেলে সেলিনা। মিনতি সেন বলছিলেন, তাহলে ঐ কথা রইল প্রান্তিক, তুই কাল একবার যাবি ওখানে। কাগজে ওরা বিজ্ঞাপন দিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটি কি, বিজ্ঞাপন কি তোক দেখানো না সত্যিকারের ভালো ছেলে মেয়েদের ওরা মেধার ভিত্তিতে নিতে চায় ঠিকই তবে একটু বাজিয়ে। আমি বললাম, কিন্তু তোমার কথা যদি জিজ্ঞাসা করে কি বলব? কিছু বলতে হবে না। মানে? মানে তোর ভয় নেই, যে পরিচয় তুই আমাকে দিলি, তাতে তোকে তুই নিজে জিজ্ঞাসা না করলে, কোন কিছু বলবে না। আমি বললাম এই যে দেখা হওয়ার পরেও তোমার কথা যদি কিছু জানতে না চান, তোমার কষ্ট হবে না মা! পাগল ছেলের কথা দেখ। আমিতো মা! এক তুই যদি কষ্ট না দিস তাহলে আমার কিসের কষ্ট? আর তা ছাড়া যার কথা তুই বলছিস, সেতো তার অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন আমার অহংকারকে, মৰ্য্যাদা জানিয়েছেন আমার মাতৃত্বকে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রতিমুহূর্তে পাশে থাকার। একটি মেয়ের কাছে এর থেকে তো আর বেশী কিছু পাওয়ার নেই। আমি তবু বললাম, সব জেনেও জানতে চাইছি এতে তোমার একটুও কষ্ট হবে না? পাগল ছেলে কোথাকার। এরপর আমাকে তার কোলের পরে টেনে নিয়ে বললেন, তুই শুধু আমায় কোন আঘাত দিসনা, আমি কষ্ট পেতে পারি এমন কিছু করিসনে। তাহলে কোন কষ্টই আমার কাছে কষ্ট বলে মনে হবে না।

ঠিক সেই সময় সেলিনা কফি নিয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে, বলল, মা ছেলের কথায় ব্যাঘাত ঘটালাম নাতো! আমাকে ছেড়ে দিয়ে মিনতি সেন বললেন, তুই আমার মেয়ে না? অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, সে আর হতে পারলাম কই পিসি, আপনি বুড়ো খোকাকে আদর করছেন, আর মার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। কফির সরঞ্জাম সামনের টেবিলে রাখল সেলিনা, মিনতি সেন তখনো খাটে বসে আছেন, সেলিনা ওগুলো রাখা মাত্র সেলিনাকে টেনে নিয়ে তার কপালে পরপর কয়েকটি চুমু খেয়ে বললেন, রাগ পড়েছে মেয়ের? আমি কেন রাগতে যাব, ঐ দেখুন না আপনার ছেলে আমাকে আদর করছেন বলে কেমন বড় বড় করে তাকাচ্ছে, বলে আর অপেক্ষা না করে দ্রুত পালিয়ে গেল।

অশ্রুকণা তখনো অপেক্ষা করছে সেলিনার জন্য। আসার পরে নিজেরা কফি খেয়ে নিয়ে সেলিনাকে বলল, মাংসটা তুমি রান্না কর না সেলিনা। আমি? হ্যাঁ তুমি, দেখ আমি কোনদিন রান্না করিনি। ভেবেছিলাম পিসি বুঝি দেখিয়ে দেবেন। কিন্তু একবারও রান্না ঘরে আসেন নি। আমি কয়েকবার জিজ্ঞাস করাতে বললেন, তুই যা ভাল বুঝিস তাই কর। মেয়েরা নাকি জন্মের পরদিন থেকেই রান্না করতে পারে। বাজে কথা সবই শিখতে হয়। অশ্রুকণা বলল, তা হলে তুমি এই মাংসটা রান্না করতে আমায় সাহায্য কর।

হঠাৎ বুঝি মিনতি সেনের খেয়াল হয় সেই যে অশ্রুকণা রান্না ঘরে ঢুকেছে একবারও বাইরে আসেনি। ওতো বলেছিল কোনদিনই রান্না করেনি। আমিই ওকে সাহায্য করব বলেছিলাম, অথচ আমি একবারও রান্না ঘরে না গিয়ে বলেছি যা পারিস তাই কর। কি জানি কি করছে খাওয়ার মত হবে তো।

সেলিনা তখন মাংসের হাঁড়িটাতে সব কিছু পরিমান মত দিয়ে চাপাতে যাচ্ছে মিনতি সেন পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, তুইতো আর কিছু বললি না, অথচ বললি রান্না করতে জানিস না। হঠাৎ অশ্রুর মনে হল সে একেবারে অপাংক্তেয় এবাড়ীতে। কাজের লোক ছাড়া যেন কিছুই নয়। বহু কষ্টে অদম্য কান্নাকে চাপা দিয়ে বলল, আপনি ব্যস্ত ছিলেন, তাই আর কি। মেয়েদের রায়া না জানাটা যে কত কষ্টের আগে বুঝতে পারিনি, মাংসটা তাই সেলিনাকেই করতে বলেছি।

অশ্রুকণা যে কথাটা বলতে পারেনি, সেই অব্যক্ততা যেন আঘাত করল মিনতি সেনকে। বললেন, যা অশ্রু, এবার বাথরুমে গিয়ে হাতেমুখে সাবান দিয়ে পরিস্কার হয়ে নে। তুইও যা সেলিনা। রাত হয়ে যাচ্ছে তোদের তো আবার যেতে হবে। সেলিনা কোন ভাবে চোখে মুখে সাবান দিয়ে বেরিয়ে এল। কিন্তু অশ্রু কলার সমস্ত শরীর যেন ব্যথায় টনটন করছে। কি জানি কেন যে তার এত অপমান লাগছে সে নিজেই বুঝতে পারছেনা। তবে একথা ঠিক যে সে সেলিনার আসার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। না সেলিনাকে সে এই মুহুর্ত্তে মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা।

প্রথমে ভেবেছিল ভাল করে হাতে মুখে সাবান দিয়ে বেরিয়ে আসবে, কিন্তু অবশেষে পূর্ণ স্নানই সে করল। ঘরে এসে সব থেকে কম দামের আটপৌরে শাড়ীটা পরে নিল। মাথায় কোন ভাবে চিরুনি বুলিয়ে হাত দিয়ে আধো খোঁপার মত চুলটা বেঁধে নিল। মুখটা সাবান দেওয়ার জন্য খস্ খস্ করাতে ক্রিম বুলিয়ে নিল। সব সময় যে সরু চেনটা পরে থাকে, তা কি খেয়াল হতে খুলে ফেলে হাল্কা একটা কিছু পরে নিল। তারপর এল সে সেই ঘরে যেখানে ওরা সবাই আছে একসঙ্গে। ওকে দেখে চমকে উঠে সেলিনা বলল অশুদি? অকশা ওর কথার উত্তর না দিয়ে প্রান্তিককে বলল, অনেকক্ষণ এসেছে, তোমাদের কাছে আসতে পারিনি বলে কিছু মনে করো না। আসলে জবার মা আজ কয়েকদিন ধরে আসছেনা তো, তাই পিসির অনুরোধে ওর কাজটা আজ আমাকেই করতে হল, আর সেদিন তুমি কথাচ্ছলে বলেছিলেন, যাকে যে কাজ মানায়, তাকে সে কাজই করা উচিত্র আর তার পোষাকটাও সেই রকমই হওয়া উচিত না হলে সামঞ্জস্য থাকে না। অবশ্য কথাটা তোমার নিজের ক্ষেত্রেই তুমি বলেছিলে, কিন্তু আরো বলেছিলে তুমি বিশ্বাস কর, তোমার এ মতটা সার্বজনীন। আমিও তাই কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলার চেষ্টা করেছি। এতেও যদি ভুল হয়, বলে দিও ভবিষ্যতে আবার কোনদিন এরকম অবস্থায় সম্মুখীন হতে হলে যাতে অস্বস্তিতে পড়তে না হয়।

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, বলে কি অশ্রুকণা। ওকি অপমান করতে চাইছে? আমার এবং মিনতি সেনের ভাবনাটা অন্তত সে রকম কিছু। ওর অভিমানটাকে বুঝি, বুঝতে পারে সেলিনাও। সে উঠে এসে অশ্রুকণাকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় যে ঘরে আপাতত থাকে ও। বলে, অশ্ৰুদি আমাকে একটা সত্যি কথা বলতো, আমি তোমার ছোট বোনের মতন, কি হয়েছে তোমার? মিনতি পিসি বা প্রান্তিক ভাই তোমাকে কি কোন অপমান করেছেন? কি ভাবে যে কান্না দমন করছে অশ্রুকণা, তা দৃষ্টি এড়ায়না সেলিনার। বলে, দুঃখকে এভাবে চেপে রেখোনা অশ্রুদি, তাতে আরো বেশী কষ্ট পাবে। বলনা কি হয়েছে? অশ্রুকণা বলে কিছু হয়নি সেলিনা, তোমাদের তো যেতে হবে, চল ও ঘরে। যাব, কিন্তু তার আগে তোমাকে বলতে হবে কি হয়েছে তোমার? কার বিরুদ্ধে তুমি প্রতিবাদ জানাচ্ছ? অশ্রুকণা বলে প্রতিবাদ জানাবার জন্য অধিকার থাকা চাই, যাদের উপর সে অধিকার ছিল প্রতিবাদ করে তাদের কাছ থেকে চলে এসেছি, এবারতো আর প্রতিবাদ করা চলে না ভাই। নিজের পায়ের নীচের মাটি আগে খুঁজে নিতে হবে, যতদিন তা না পাচ্ছি ততদিন আমিতো একটা পরগাছা মাত্র। পরগাছার আবার অধিকার? যাকে নির্ভর করতে হয় অন্যের পরে তারতো কোন স্বপ্ন থাকতে নেই, নেই কিছু পাওয়ার আশা করতে। যতদিন বাবা-মায়ের কাছে ছিলাম, ততদিন বুঝতে পারতাম না, কিন্তু এখন ভালো করে বুঝতে পেরেছি আমার মূল্য কতটুকু। তাই থাক এসব কথা সেলিনা, দেরি হয়ে যাবে তোমাদের। হোক দেরি, তবু তুমি বল অদি। বলতে পারলে দেখবে অনেক হাল্কা লাগছে। অশ্রুকণা বলে, না আর কিছু বলার নেই। নতুন পথে চলতে চলতে যদি নতুন সত্যের কিছু সন্ধান পাই, আর কাউকে না জানালেও তোমাকে জানাব সেলিনা। সেলিনা বলে তুমি কি এখান থেকে চলে যেতে চাইছো? দেখি, সেদিন যখন এসেছিলাম, কেন এসেছিলাম জানতাম না। আবার যখন চলে যাব, কেন চলে যাব, তাও হয়তো বলতে পারবো না, তবু যেতে হবে। কেন? না হলে মা ও ছেলের বিচ্ছেদ হয়ে যাবে, আমি কি তা চাইতে পারি? যার পর নাই বিস্মিত হয়ে সেলিনা বলল, কি বলছ অশ্রুদি। যা ঠিক তাই বলছি, তা না হলে তুমিতো জান আমি আজ কতদিন হয়ে গেল এখানে এসেছি, অথচ প্রান্তিক সেই যেদিন প্রথম এসেছিলাম সেদিনের পরে আর একদিনও আসেনি। কাল আমি ওর সঙ্গে নিজেই দেখা করেছিলাম, হয়তো রাত হয়ে যাওয়াতে বাড়ীতে নামিয়ে দিয়ে পিসিকে বলল, তোমার মেয়েকে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেলাম। অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল খুঁজে পেয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। দেখ আবার যেন হারিয়ে না যায়। সে যে কি তীব্র অপমান তুমি হয়তো বুঝবেনা। অশ্রুকণা বলে চলে আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুল না, পিসি বার বার বলল, কতদিন আসিস না, একটুখানি বসে যা প্রান্তিক। বলল, আজ না কাল। সেই কাল আজ সেলিনা। থাকতে চাইনি। দাঁড়াতে চাইনি প্রান্তিকের সামনে, আবার কি অপমান করবে কে জানে। কিন্তু পিসির অনুরোধে থেকে যেতে হল শুধু নয়, যে রান্না জানিনা, কোনদিনই করিনি, তারই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হল। কোন দুঃখ ছিল না সেলিনা যদি প্রান্তিক অপমান না করতো। কি দরকার ছিল, তারই পয়সায় কেনা, তার প্রিয় ফুলগুলোকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়ার? আমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না এই তো। বলতে পারতো সে কথা। বা একথাও বলতে পারতো যে, এ বাড়ীতে তার একটা পূর্ণ অধিকার আছে। আমার জন্য সে অধিকার থেকে সে বঞ্চিত হবে কেন? আর আমিই বা তাকে বঞ্চিত করব কোন অধিকারে? না সেলিনা পারব না। একদিন তোমাকে বলেছিলাম তোমার মনে আছে কি না জানিনা, ওই অতি সাধারণ ছেলে কি অসাধারণ চৌম্বক আকর্ষণে যে আমাকে টানে, তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু না, ওর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। কোনদিনই আমার দুর্বলতার কাছে সে ধরা দেয়নি। তাইতো ওকে রেহানার হাতে সঁপে দিতে ভিতরটা কাঁপেনি। রেহানার অবর্তমানে আমার ভিতর জন্ম নিল যে নতুন স্বপ্ন, তা হয়তো স্বপ্নই থেকে যেতো, যদি না মিনতি পিসি, আমাকে, জোর বা দাবীর কথা অমন করে মনে না করাতেন। মা হয়েও মিনতি পিসি জানেন না প্রান্তিক কি চায়? অপমানটা আমার সেখানেই বেশী করে বাজছে। রেহানাকে জানি, কোনদিনই সে মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারেনা, অথচ না চেয়েও হৃদয় তার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। আর আমি কানা গলিতে হোঁচট খেলাম বার বার হোঁচট। একটা মেয়ে হয়েও, এই যে অপমান, আজ না বুঝলেও একদিন তুমি বুঝবে সেলিনা, কারণ আমি জানি, রেহানার থেকেও অনেক অনেক বেশী ভালবাস তুমি প্রান্তিককে। রেহানা যেখানে ভালবেসে একা পথে নামতে পারে তার ভালবাসার কি হবে এটা না জেনেও, তুমি তা পারবে না সেলিনা। তুমি উদ্দেশ্যহীন পথে ভেসে গিয়ে আরেক জনের কি হবে তানিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। তোমার ভালবাসার বর্মে তুমি তাকে ঢেকে রাখতে চাইবে। কোন ভাবেই তুমি পারবে না তোমার ঈপ্সিতকে অন্যের হাতে তুলে দিতে। তোমাকে যতটুকু বুঝেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে তুমি ভালবাসবে, ঝগড়া করবে, অভিমান করবে, কথা বন্ধ করে দেবে, কিন্তু তাকে ছেড়ে থাকতে পারবেনা। তোমার প্রলম্বিত ছায়ার নীচে একদিন তাকে আসতেই হবে, এই বিশ্বাসে তোমার পথ চলা। তুমি রেহানা নও, তাই পথেই তুমি ঠিকানা খুঁজে নিতে চাও না, তুমি চাও পথ চলা যেন শেষ হয়, তোমার হৃদয় মন্দিরে এসে। তাকে ফেরাতে প্রয়োজন হলে তুমি আঘাত দেবে, চরম অভিমানে তুমি মুখ ফিরিয়ে নেবে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে প্রতীক্ষায় থাকবে এই বুঝি এলো সে। হঠাৎ সে আসতে পারে, এই বিশ্বাসে, খোলা রাখবে তোমার দরজা, খুলে দেবে দখিন ও পূবের জানালা, একটা দিয়ে ঢুকবে ভোরের বাতাস, আরেকটায় লাল সূর্যের আভা।

আমি রেহানা হতে পারবো না, যে গভীর ভালবাসায় সে পথে নামতে পারে তা আমার নেই, আবার তোমার বিশ্বাসও আমার মধ্যে নেই। আমি প্রতিমুহূর্তে চেয়েছি প্রতিদান, মিথ্যে হোক, তবু যদি একবারও ও বলতো কণা আমি তোমায় সত্যিই ভালবাসি, সব অভিমান জল হয়ে আমি হয়তো নতুন স্বপ্নের আলোকে পথে নামতে পাবতাম। কিন্তু সেলিনা, আজ আমি নিঃস্ব, কিছু নেই আমার। তবু আমি হারতে চাই না, একদিন না একদিন আমার জয় আসবেই, আর সেদিন হয়তো তোমাদের কথাই মনে পড়বে ভীষণ ভাবে। রেহানা, তুমি, প্রান্তিক, তোমাদের আবার নতুন করে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করবো। একটু থামলো অশ্রুকণা, তারপর বলল, এত কথা বলার অন্য কোন কারণ নেই সেলিনা, কারণ আমার প্রতি মুহূর্তের ভয় তুমি আমাকে বাধা দিতে পারো। তাই তোমার ছাড়পত্র আগে থেকেই আদায় করে নিতে চাই।

এতক্ষণ ধৈর্যের সঙ্গে সেলিনা শোনে অশ্রুকণার ক্ষোভ অভিমান, রাগ আর তার ক্ষত-বিক্ষত জীবন কাহিনী। কি উত্তর দেবে সে। যা সে বলেছে তার সম্পর্কে, কোন দিন সেলিনা ভেবে দেখেনি, তা কতটা সত্য, কতটা কল্পনা। কিন্তু তাই বলে প্রান্তিকের সঙ্গে কথা না বলে, কোন ভাবেই অশ্রুকণার যাওয়া হতে পারে না। তার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে বাধা। সে দেবেই। ধীর ধীরে বলল, তোমার সব কথাই শুনলাম অশ্ৰুদি, অংকের মত হিসাব করে ভালবাসার নিক্তিতে মেপেছছ জীবনের দেনা পাওনা। ওভাবে জীবনের অংক মেলেনা অদি। আর পরগাছার কথা বলেছে। জানিনা কেন এই ভয়ংকর শব্দ তোমার মুখে উচ্চারিত হল। বুঝতে পারছি আঘাতের তীব্রতা তোমায় কোথায় নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। তবুও অশ্ৰুদি তোমায় বলব, ছোট খাট ২/১টা ঘটনা দিয়ে জীবনের বিচার করোনা, অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধর। নিজেকে জানার চেষ্টা করা সবার আগে। ভাব কি চাও তুমি, তারপর না হয় নতুন ঠিকানার খোঁজ কর। এখন চল। সত্যিই রাত হয়ে যাচ্ছে, মা চিন্তা করবেন।

নিজের আঁচলে চোখটা মুছে নিয়ে অশ্রুকণা বলল, বেশ চলল। ভেজানো দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই দেখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন মিনতি সেন।

যখন বাড়ী ফিরে এসেছি তখন প্রায় রাত ১২টা, কলকাতার রাস্তায় পারত পক্ষে কোন বাস নেই। ট্যাক্সিতো নেইই। মিনতি সেন বার বার বলছিলেন আজ থেকে যা প্রান্তিক, আমি নীলাঞ্জনাকে যে কোন ভাবে সংবাদ পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এত রাত হবে বুঝতে পারলে হয়তো, আসতাম না, কে জানতো ওভার হেড তারে বিদ্যুৎ না থাকার জন্য ট্রেন প্রায় দেড় ঘন্টা লেট করবে।

একেবারে ফাঁকা রাস্তা। বললাম মনে হচ্ছে হেঁটে যেতে হবে। সেলিনা বলল, তাই চল। দাঁড়াও একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি। অবশেষে বেশী পয়সার টোপ ফেলে একজন টানা রিক্সাওয়ালাকে ম্যানেজ করা গেল, তার দাবি অতরাতে ওতো আর এখানে ফিরতে পারবেনা, তাদের বারান্দায় বা অন্য কোথাও রাত কাটাবার ব্যবস্থা করে দিলে সে যেতে রাজী। তাতেই রাজী হয়ে উঠে পড়লাম।

রিক্সায় আসতে আসতে ফেলে আসা অতীতকে নিয়ে ভাবছিলাম। অশ্রুকণা একটা কথাও বলেনি আমার সাথে। মিনতি সেনও কেমন যেন ব্যপারটিকে খুব ভালভাবে নেননি। অথচ অশ্রুকণারতো এই মুহূর্তে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ওকে নিয়ে কিছু একটা করতেই হবে। সেলিনা বলল, কি ভাবছে। বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে, ফাঁকা রাস্তা, শাড়ীর আঁচল গায়ে বেশী করে জড়িয়েও ও যে শীতে জড়সড় হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। বললাম, না এমন কিছু ভাবছিনা, শুধু নিজের অক্ষমতা নিয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে? তোমার তা হলে কষ্ট হয়? একথা বলছ কেন? না আমার মনে হতো তোমার স্থান এত উঁচুতে যে, তোমার কোন কষ্ট হতে নেই। ঠাট্টা করছ? পাগল তোমাকে ঠাট্টা করব? তারপর হয়তো দেখবো, পছন্দ করে যে মালা দুটো কিনেছো, তাই হয়তো টুকরো টুকরো করে এই পথেই ছড়িয়ে চলেছে।

সত্যি মনে ছিল না, যাওয়ার সময় দুটো সুন্দর যুঁই ফুলের মালা কিনে ছিলাম অবশ্য ও কিনতে বলেছিল তাই। ও নিয়ে ছোট্ট একটা ঠাট্টাও করেছিলাম কিন্তু তারপর ওটা আমার চিন্তায় আর আসেনি, কিন্তু সেটা আলাদা কথা, ও যে মালা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলার কথা বলেছে, এর পিছনে আছে নিশ্চয়ই অশ্রুকণার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছিল তার ইঙ্গিৎ। তাই বললাম, আমি বুঝি পয়সা খরচ করে কিনে ছিলাম টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলার জন্য? তা হয়তো কেনোনি, তবে কেন কিনেছিলে সেটা কি জান? আমি চুপ করে রইলাম। ও বলল হয়তো বলবে আমার ইচ্ছেয় তাইতো! কিন্তু প্রান্তিক ভাই, কাল যে গোলাপগুলো কিনেছিলে তা কিন্তু তোমার ইচ্ছেয় কিনেছিলে তবে তা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে কেন? কেন বুঝলে না ওই অবস্থায় সবাইতো আর সেলিনা নয় এটা তোমার বোঝা উচিৎ ছিল। হয়তো একরাশ লজ্জা এসে ফুলের সাজে সাজতে তাকে বাধা দিয়েছিল বলেই সেটা সে চায় নি? পারতে না, অন্য কোন অবকাশে যা তুমি চাইছিলে সেই ভাবে সাজিয়ে দিতে তাকে? তাতে কি তোমার খুব কষ্ট হতো? তুমি যে এভাবে কাউকে সাজাওনি তাতো নয়? সাজিয়েছে বলেই তুমি কি তাদের কাছে ধরা দিয়েছে? ছিঃ প্রান্তিক ভাই ছিঃ! কি পরিমাণ আঘাত তুমি অশ্ৰুদিকে দিয়েছো জানো? আর তাছাড়া অদির যদি সত্যি কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকতে হয়তো মিনতি পিসির ওখানে আসতেন না। কিন্তু অদির আসার পরে তুমি যে ব্যবহারটা করেছে তাতে আমি ভাবতেও পারছি না। বললাম আমি খারাপ ব্যবহার করেছি? করোনি? আজ দেড় মাস হতে এল অশ্ৰুদি মিনতি পিসির ওখানে এসেছে, কিন্তু এই দেড় মাসের একদিনও কেন আসোনি এখানে? কেন অদির সঙ্গে দেখা করনি একদিনের জন্যও? সেই যখন তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে তোমার সঙ্গে দেখা করল, মিথ্যে সান্ত্বনাও তো দিতে পারতে? ভাবলে নিজের আসল পরিচয়টাই সব। আর কারো কোন পরিচয় নেই? কারো কোন মূল্য নেই?

আমি বললাম, থাক সেলিনা ওসব কথা, তার চেয়ে কলকাতার এই ফাঁকা রাস্তা আর উপরের নীল আকাশ দেখ। কলকাতার এই চেহারাতো দেখনি কোনদিন! তুমি বুঝি বার বার দেখেছে? দেখেও আঁশ মেটেনি বলে আবারও দেখতে চাইছো?

আমি বুঝতে পারছি সেলিনা প্রচণ্ড রেগে আছে আমার ওপর। মনে মনে ভাবছি। যত তাড়াতাড়ি পথটা শেষ হয় ততভাল। ফাঁকা রাস্তায় কুকুরের পাল, মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ করছে, আর সেই মুহূর্তে রাতের এই নিঃশব্দতা খান খান হয়ে নিজেদের বুকে শিহরণ জাগাচ্ছে।

এক সময় পৌঁছে গেলাম বাড়ীতে। নীলাঞ্জনা পিসি ঠায় দরজা খুলে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছেন বারান্দায়। হয়তো বকাবকি করবেন। কিন্তু না, নীলাঞ্জনা পিসি কোন কথাই বললেন না। শুধু সেলিনাকে বললেন, একটা সংবাদ যে কোন ভাবে পাঠিয়ে দিয়ে থেকে যেতে পারতিস তো। সেলিনা বলল, ট্রেনটা বিগড়ে যাবে ভাবতে পারিনি, তাই রাত হল, তুমি খেয়েছো? না খাওয়া হয় নি, তোরা তাড়াতাড়ি আয়, বেশ খিদে পেয়েছে।

খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু পিসিকে কষ্ট দেওয়া হবে, তাই ডাইনিং টেবিলে এসে বসলাম, খেলামও। ঘুমোতে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে খিল তুলে দিলাম।

সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল নটা। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি সেলিনা। কি ব্যাপার তুমি? সে কথা পরে হবে প্রান্তিক ভাই, কিন্তু তুমি দরজা বন্ধ করে শুয়েছে কেন, চোর আসার ভয়ে? মিটি মিটি হাসছেও। বললাম যা হয় একটা ভেবে নিও। আচ্ছা পরেই না হয় ভাববো, আপাতত মায়ের ঘরে চল, প্রায় ২ ঘন্টা হলো মিনতি পিসি এসেছেন, আর তখন থেকেই তোমাকে ডাকছি। বাব্বাঃ ঘুমোতেও পার বটে।

আমি অবাক হয়ে বললাম মা! এত সকালে, কিন্তু কেন? সে তুমি ও ঘরে গেলেই জানতে পারবে, তুমি তাড়াতাড়ি এস। আমি চা নিয়ে আসছি।

নীলাঞ্জনা পিসির ঘরে এসে দেখি বিমর্ষ চিন্তান্বিত মিনতি সেন, চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। বললাম কি হয়েছে মা, এত সকালে? মিনতি সেন কোন কথা না বলে একটা চিঠি তুলে দিলেন আমার হাতে। অশ্রুকণার লেখা, মিনতি সেনকে লিখেছে, পিসি, গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আবার পথে নামলাম। বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনার কাছে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য একটা ছোট্ট চাকরি চেয়েছিলাম, হয়তো আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আপনি রাজী হননি। কিন্তু আমার জন্য আপনার ও আপনার ছেলের মধ্যে কোন ব্যবধান তৈরি হোক চাইনি। আর হ্যাঁ, না বলে আপনার কিছু টাকা নিয়ে গেলাম, অবশ্য টাকাটা বাইরেই পড়েছিল। চোরেও চুরি করতে পারতো। আমাকে না হয় তাই ভাববেন। আপনার ভালবাসা ও সহানুভূতি আমার আজীবন মনে থাকবে। অশ্রুকণা।

অনেকবার পড়লাম চিঠিখানা, তারপর তা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম তুমি বাড়ী যাও মা, আমি দেখছি। সেলিনা চা নিয়ে এল। মিনতি সেন বললেন কিছু খেতে ইচ্ছে করছেনা মা। তুই চা-টা নিয়ে যা। সেলিনা বলল, তুমি বাড়ী যাবে না অফিসে? না ভাবছি কমিশনার কাকার সঙ্গে একবার দেখা করব, তারপর দুপুরে এখানেই ফিরব। কিন্তু মেয়েটা যে কোথায় গেল? আমি বললাম, তুমি চিন্তা করোনা! সেকি প্রান্তিক চিন্তা করবনা? তুই বলছিস কি? আচ্ছা তুমি চিন্তাই কর। আমি আসছি। চা-টা শেষ করে জামা প্যান্ট পরে বেরিয়ে পড়লাম।

মনে হয়েছিল, কলকাতা ছাড়ার আগে ভোরের গঙ্গাঘাটে একবার আসতে পারে ও, যদিও তখন আর ভোর নেই, তবুও একবার এসে পড়লাম সেই গঙ্গা ঘাটে। কিন্তু না, এখানে ও নেই। তপতীর সঙ্গে ওর পরিচয় নেই সেভাবে, তবে চেনে তাকে। জীবনের কঠিন সংগ্রামে তপতী তার পথ খুঁজে পেয়েছে। তার অনেক কথাই শুনেছে সেলিনার কাছে। অশ্রুকণার কথাও হয়তো শুনেছে তপতী। অনেকদিন যোগাযোগ নেই ওর সাথে। ওরতো বদলী নিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল, যদি চলে না গিয়ে থাকে, একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে এলাম ও যেখানে কাজ করে সেখানে। অফিসে জেনে নিলাম, ও ডিউটিতে আছে। একমনে কাজ করছে কেউ নেই। আমি যে এতক্ষণ ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ পিছন ফিরে আমাকে দেখে চমকে উঠে বলল, আরে প্রান্তিক তুমি! তারপর বলল তোমার কথাই ভাবছিলাম না শুধু, ভীষণ ভাবে তোমাকে চাইছিলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম কেন? তুমি বোধ হয় জানো না সৌমেন্দ্র পরীক্ষা ড্রপ করেছে। না জানি না, কিন্তু কেন? ও বলল দেখ এজন্য তোমাকে চাইছিলাম না। তবে এর মাঝে আমি বাড়ীতে গিয়েছিলাম। তারপর তোমার বাবার সাথে দেখা হয়েছিল। তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চেয়েছিলেন। তুমি রেহানা নামে কোন মুসলিম মেয়েকে ভালবাস কি না এটাও জানতে চাইছিলেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কি বললে? আমি কিছুই বলিনি, তবে তোমার উপর যে তোমার বাবার প্রচণ্ড অভিমান, এটা বুঝে এসেছি। কতদিন আগে গিয়েছিলে? তা বেশ কিছু দিন হল, বলল তুমি নাকি গিয়েছিলে অথচ রেহানার কথা কিছুই বলনি। আমি বললাম রেহানার কথা, কি বলব তুমিই বল? আমি বুঝি তোমার অবস্থা। কিন্তু আমার অবাক লেগেছিল, রেহানার সম্পর্কে অত কথা তিনি জানলেন কি করে? আমিও কম অবাক হচ্ছিনা, তোমার কথা শুনে। তপতী বলল, তোমার একবার গ্রাম থেকে ঘুরে আসা উচিত প্রান্তিক। তাছাড়া চিঠিপত্র লেনা। ওখানেই শুনলাম তোমরা গিয়েছিলে। যাকগে সেকথা, তুমি কি আমার কাছে এসে? তোমার কি মনে হয়? আমার? থাক আমার কথা, তবে যদি আজ না এসে অন্যদিন আসতে, ভাবতাম আমার কাছেই এসেছে। তবে আজ নয় কেন? বলব, তুমি একটু বোস, চলে যেওনা আমি আসছি।

মিনিট পাঁচেক পরে ও ফিরে এল, এসেই বলল চল। কোথায়? বা যে জন্য এসেছে, সেখানে যাবে না? আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে বললাম, তোমার হেঁয়ালি কথা ছাড়। একটু সোজাসুজি বল। বলছি, এসো না আমার সাথে। না আমার সাথে যেতেও অসুবিধা। বললাম সৌমেন্দ্র কোথায়? বাড়ীতে গেছে। কথা বলতে বলতে মিনিট কয়েকের মধ্যে ওর কোয়ার্টারে এসে উপস্থিত হলাম, এর আগে হোস্টেলে ছিল, অল্পদিন হলো কেয়ার্টার পেয়ে চলে এসেছে। আমাকে একটা দরজা দেখিয়ে বলল, ভিতরে গিয়ে বস। আমি পোষাকটা বদলে আসি।

ভেজানো দবজা ঠেলে ঢুকলাম, আব ঢুকেই চমকে উঠলাম। অশ্রুকণা খাটের রেলিংএ একটা বালিশে ঠেস দিয়ে আজকের কাগজ পড়ছে। ও বোধ হয় বুঝতে পারছে না, আমি এসেছি, ডাকলাম কণা!

অতি পরিচিত কণ্ঠ স্বরে আর ওই নামে, যে নামে, ওকে আর কেউ ডাকেনা, আনন্দ ও বেদনা মিশ্রিত চোখ তুলে তাকালো। তারপর বলল, ভয় নেই প্রান্তিক তপতীদিকে বলেছি মাত্র একটা দিন যেন আমাকে আশ্রয় দেয়। এইটুকু দয়া তুমি কর প্রান্তিক!

যেন ব্যথার সমুদ্র থেকে ভেসে আসছে অতি করুণ এক সুর। আমি আস্তে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। ও বাধা দিল না। বললাম, কেন এত ব্যথা দাও সকলকে! চল আমার সাথে। কোথায়? সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না কণা, আমি যেতে বলছি, তুমি যাবে। কোন উত্তর না করে চুপ করে রইল। আমি আবারও বললাম, এতো দেরি করোনা। ওরা সবাই তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। ও অবাক হয়ে বলল, ওরা মানে? বা, ওরা মানে মিনতি সেন, নীলাঞ্জনা পিসি, সেলিনা। ও তাই বল। ওদের জন্যই তুমি এসেছো। কিন্তু আমি যাব না প্রান্তিক। আমি আর ফিরে যাবো না। আমি আবেগ মথিত কণ্ঠে বললাম, তুমি কাউকে বুঝতে চাওনা কেন বলত। না আমি কাউকে বুঝতে চাই না, আসলে নিজেই নিজেকে বুঝিনা। এবার ওর একটা হাত ধরে বললাম, কণা, সত্যি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। বড় মুখ করে ওদের আমি কথা দিয়ে এসেছি, ওদের কাছে আমাকে ছোট করে দেবে।

দেখতে পাচ্ছি, ওর চোখ দুটি জলে ভারাক্রান্ত, এখনি বোধ হয় টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়বে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তিন কাপ চা নিয়ে ঢুকলো তপতী। হাসতে হাসতে বলল, ঠিকতো প্রান্তিক, তোমাকে একটু আগে বলেছিনা, আজ না এলে হয়তো ভাবতাম তুমি আমার কাছে এসেছে। আমি অশ্রুকণার হাত ছেড়ে দিয়ে তপতীর কোন উত্তর না দিয়ে তপতীকেই বললাম, সকাল থেকে বলতে গেলে চা খাওয়াই হয়নি। তারপর বললাম শুধু চা? কিছু টিফিন হবে না? কি খাবে বল। যা হোক একটা কিছু দাও। সত্যি ভীষণ খিদে পেয়েছে। তপতী বলল, চাটা খেয়ে নাও দেখছি কি আছে?

কিছু নেই, তাই চা-ই ওদের সঙ্গে খেতে হল। খাওয়া হয়ে গেলে বললাম, তপতী তুমি তো বহুদিন থেকে বলছ পিসির ওখানে একবার যাবে। যাওনি, আজ চল। না আজ থাক। সৌমেন্দ্রের আজ আসার কথা, কোথায় গেছি হয়তো ভাবতে পারে। হাসলাম একটু। তারপর বললাম ওটা অজুহাত। তুমি ভালভাবেই জান, সৌমেন্দ্র আজ আসবে না। ও অবাক হয়ে তাকালে আমার দিকে, তারপর বলল এটা মিথ্যে অজুহাত নয়, ও সত্যিই আসবে। ঠিক আছে, চল। কিন্তু অশ্রুকণা কিছুতেই রাজী নয়। ও বলল, কেন মিথ্যে পিছু ডাকছু প্রান্তিক। আমি আর ফিরে যেতে চাইনা। আমি বললাম বেশ, তুমি চলে এস, কিন্তু এখন আমার সঙ্গে চল, একবার অন্তত আমার কথা রাখ। তার কোন দরকার নেই প্রান্তিক, তুমি ধরং তপতী দিকে নিয়ে যাও, কথা দিচ্ছি আমি এখানেই থাকবো।

তপতী বলল, অশ্রু কেন এরকম করছ? আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত। তোমার কাছে যেটুকু শুনেছি, আমি কিছু না শুনে না জেনেও, তোমার থেকে বেশী জানি ভাই। মিথ্যে অভিমান করে কাকে আঘাত দিতে চাইছো? বরং প্রান্তিককে তোমার কিছু বলার থাকলে বলে নাও এই বেলা, আমি শাড়ীটা বদলে আসছি। তপতী সত্যি সত্যি শাড়ী বদলাতে অন্য ঘরে চলে গেল।

অশ্রুকণা বলল, তুমি কি করে জানলে আমি এখানে এসেছি? আমি বললাম, আমার মন বলছিল আমার সঙ্গে দেখা না করে তুমি কোথাও যেতে পার না। তাই প্রথমে গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে যখন পেলাম না, তখন ভাবলাম, এখানে আসতে পার। এরকম ভাবলে কেন? ভাবনাটা মনে এসে গেল তাই। কিন্তু ওসব কথা থাক। এবার ওঠ কণা। ও বলল, তুমি কি বিশ্বাস কর তোমার সঙ্গে দেখা না করে আমি কোথাও যেতে পারি না। আমার বিশ্বাস থাক কিন্তু তুমি বলত, আমাকে না জানিয়ে তুমি কোথাও যেতে পারবে? জানিনা। জানো যখন, তখন ওঠ। তপতী কি ভাবছে বলত!

শেষ পর্যন্ত এল ও আমাদের সাথে। তবে তাকে কথা দিতে হয়েছে, আজকেই সে ফিরে আসবে তপতীর সঙ্গে। আমি বললাম তাই হবে।

মিনতি সেন অশ্রুকণাকে জড়িয়ে বলল, এ পাগলামি তুই কেন করতে গেলি অশ্রু। আমাকে যদি একটুও ভাল না বাসিস কেন গিয়েছিলি আমার কাছে? এবার চল আমার সাথে! অশ্রুকণা মিনতি সেনকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তা হয় না পিসি। আমাকে নিজের পথ খুঁজে নিতে দিন। উনি বললেন, ওরে পাগলি মেয়ে, আমার সর্বস্ব চুরি করে ভাবছিস তুই পথ খুঁজে পাবি? কোন দিন পারি না। যদি আমার সঙ্গে না যাস তা হলে তোকে আমি এমন শাস্তি দেব, যে শিউরে উঠবি। মনে রাখিস আমি তোর বাবা-মা নই, যে হাজার অপরাধ করলেও তোকে ক্ষমা করতে হবে! অশ্রুকণা চুপ করে রইল। আমি চলে গেলাম আমার নিজের ঘরে। ও ঘরেই একটু পরে এল তপতী, সেলিনা এবং নীলাঞ্জনা পিসি। সেলিনা বলল চা খাবে তপতীদি! নীলাঞ্জনা বললেন কতদিন পরে তোকে দেখছি, পথে ঘাটে দেখা হলে আমিতো চিনতেই পারতাম না। এত কাছে থাকিস অথচ একবারও এলি না ব্যাপার কি বলতো। তপতী বলল, পথে ঘাটে দেখা হলে আমিও তোমায় চিনতে পারতাম না। সেই কত ছোটবেলায় তোমাকে দেখেছি। প্রান্তিকের কাছ থেকে তোমার ঠিকানাও নিয়েছি, কিন্তু আসা আর হয়ে ওঠেনি। সেলিনা চা নিয়ে এল। নীলাঞ্জনা বললেন, সকাল থেকে এরা কিছু খায়নি। মিনতিকে কতবার বললাম, প্রান্তিক যখন বলেছে ওকে যেখান থেকে হোক ফিরিয়েই নিয়ে আসবে, যা হোক কিছুমুখে দাও ভাই। কিন্তু ওর ওই এক কথা। ও না আসা পর্যন্ত আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না। কিন্তু তপু তোর ওখানে ও গেল কি করে? আর গেলইবা কখন? তপতী বলল, ও আগে কোথাও গিয়েছিল কি না জানিনা, প্রান্তিকের যাওয়ার ঘন্টা ২/৩ আগে ও আমার অফিসে গিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর নিজেই বলে, তপতীদি একটা রাত আমি তোমার কাছে থাকব, তুমি আমায় ফিরিয়ে দিওনা, বলে, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর ওকে নিয়ে আমি আমার কোয়ার্টারে এলাম, শুনলাম ওর কথা। তারপর বললাম, অশ্রু, দিদি বলে যখন ডেকেছে, তখন একটা রাত কেন, যতদিন তোমার থাকতে ইচ্ছে করে তুমি থাক। এরপর ওকে ঘরে রেখে আবার আমি ডিউটিতে চলে যাই, কিছু জরুরী কাজ ছিল। সেটা যখন তাড়াতাড়ি সাবছি তখন গেল প্রান্তিক। ওর কথায় বুঝেছি ওর যাবতীয় অভিমান প্রান্তিকের উপর।

আমার আর কি বলার থাকতে পারে। চুপ করে আছি। মনে গভীর বিশ্বাস, একবার যখন ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছি, তখন মিনতি সেনের কাছ থেকে ছাড়া ও আর পাবে না। তপতীর কথার উত্তরে সেলিনা বলল, প্রান্তিক ভাই অদির সঙ্গে যা ব্যবহার করেছে তাতে তো অভিমান হতেই পারে, আমার সঙ্গে প্রান্তিক ভাই ওরকম ব্যবহার করলে আমি শুধু অভিমানে ঘর ছাড়তাম না, প্রান্তিক ভাইকেও রাস্তায় নামিয়ে ছাড়তাম।

তার রাগের আঁচ পেয়ে আমি শুধু শব্দহীন হাসলাম। তপতী বলল তা তুমি পার সেলিনা, তোমার যে পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। সেলিনা বলল, এটা সম্ভব অসম্ভবের কথা নয় তপতীদি। এটা অধিকারের কথা। আমাকে প্রান্তিক ভাইয়ের ভাল না লাগতে পারে, তাই বলে আমাকে অপমান করার অধিকার তার নেই। তবে প্রান্তিক ভাই বলতে পারে উনি যা করেছেন, তাতে অপমানের কিছু নেই, কিন্তু মান অপমানের সংজ্ঞাতো সবার কাছে সমান নয়। কেউ মেনে নিতে পারে, কেউ পারে না। অশ্ৰুদি পারেনি, তার জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। আমিও পারতাম না, তাই বলে, আমি নিজে রাস্তায় না নেমে প্রান্তিক ভাইকে রাস্তায় নামিয়ে ছাড়তাম।

অত্যন্ত কঠিন প্রতিবাদ। সেলিনার জেদি মনোভাবের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, কিন্তু এখন ও যা বলল, এর দ্বারা ও কি বলতে চাইছে বুঝতে পারলাম না। নীলাঞ্জনাও সম্ভবত বুঝতে পারেননি। তপতী শুধু ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, কেন মিথ্যে ভয় পাচ্ছ সেলিনা, তুমি তপতী বা অশ্রু নও, প্রান্তিকের সাধ্য কি তোমাকে অপমান করার। তারপর নীলাঞ্জনাকে বলল, পিসি সকাল থেকে তো কিছুই খাওনি এবার চল যা হোক কিছু খাবে। রান্না করেছে? হ্যাঁ সেলিনা করেছে।

অশ্রুকণা রাজী হয়েছে মিনতি সেনের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার, তবে মিনতি সেনকেও রাজী হতে হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি অশ্রুর যে কোন একটা ব্যবস্থা উনি করবেন। যাওয়ার সময় মিনতি সেন বললেন, প্রান্তিক আগামী রবিবার একবার আসিস তো। আচ্ছা। আর শোন, তার আগে শুক্রবার একবার ওখানে যাবি। সবকিছু ভালো করে জেনে আসবি। আমি বললাম আচ্ছা। মিনতি সেন অকশাকে নিয়ে চলে গেলেন।

তপতী বলল, আমাকেও যে যেতে হবে প্রান্তিক। নীলাঞ্জনা বললেন, কতদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা, আজ থেকে যা না। তপতী আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, না পিসি, ওরতো রাতে ডিউটি আছে। তপতী বলল, আরেকদিন আসব পিসি। আমিতো দেখে গেলাম, বরং তোমরা সবাই একদিন এস না, আমার কোয়ার্টারে। ওখানে আর কে কে থাকে জিজ্ঞাসা করলেন পিসি। তপতী বলল, আমি একাই থাকি। একার পক্ষে কোয়ার্টার যথেষ্ট বড়। বল কবে যাবে? সেলিনা বলল, তপতীদি তুমিতো কোয়ার্টার আজকে পাওনি বেশ কিছুদিন আগেই পেয়েছে। আমাদের চেনোনা তাতো নয়, তবুতো তোমার গৃহপ্রবেশে বলনি,

আজকে হঠাৎ লজ্জায় বলছ নাতো।

সেলিনা চিরদিনই এই রকম যা বলে সোজাসুজি বলে। তপতী বলল, না ভাই ঠিক তা নয়। আসলে তুমি বোধ হয় জানো, আমার বদলীর অর্ডার এখনো বহাল। যেতে কিছুদিন দেরি হবে বলে কোয়ার্টারটা নিয়ে নিতে হল। এটা ঠিক হোস্টেলের এঘর থেকে ওঘরে যাওয়ার মতন। তুমি যেভাবে বলছ, সেভাবে মনেই হয়নি। তাহলে এবার গৃহপ্রবেশটা করেই নাও বলল সেলিনা। তপতী বলল, বল কবে যাবে, তোমরা যেদিন যাবে সেদিনই আমার গৃহপ্রবেশ! কণ্ঠে বুঝি কোন এক না জানা অভিমানের সুর বাজে।

সন্ধ্যা হয়ে আসে। তপতী বলে, প্রান্তিক চল একটু বাসে তুলে দিয়ে আসবে। বললাম চল।

মিনতি সেনের আদেশ, তাকে অমান্য করার কোন উপায় নেই। একদিন এলাম প্রতীম চৌধুরীর অফিসে। দেখি ঘরে আছেন সজল বাবু। আমি নমস্কার করতে উনিও নমস্কার করলেন, সৌজন্য বিনিময়ের পরে তিনি চলে গেলেন। প্রতীমবাবু বললেন, খুব তাড়াতাড়ি এলে, তোমার কথাই ভাবছিলাম। আমার কথা? কেন? হা বলছি, তুমি বোধ হয় দেখেছে আমাদের কোম্পানী কয়েক জন জুনিয়র ম্যানেজার নেবেন। তুমি যদি দরখাস্ত কর, অবশ্য তুমি যদি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতে চাও তাহলে একটা দরখাস্ত পাঠিয়ে দিও। আমি বললাম, আপনি যে আমার কথা মনে রেখেছেন, তার জন্য খুব ভাল লাগছে, আমি এই ব্যপারেই আপনার কাছে এসেছিলাম। সত্যি? হ্যাঁ সত্যি! তা হলে দরখাস্তটা পাঠিয়ে দাও। আমি বললাম দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেই আমার চাকরি হবে? না হওয়ার তো কোন কারণ নেই। আপনাদের রিটেন, পার্সোনালিটি টেষ্ট পাশ করতে না পারলেও। তুমি ফেল করবে এটা ভাবছো কেন? পাশ করব এ গ্যারান্টিতো নেই। না তা অবশ্য নেই। যদি তাইই হয় তা হলে তো হবে না। আমি বললাম, তার মানে আপনারা চাইলেও হবে না। আমরা শুধু পার্সোনালিটি টেষ্টে কিছু কনসিডার করতে পারি, কিন্তু রিটেন টেষ্টে তোমাকে পাশ করতে হবে প্রান্তিক। ঠিক আছে আমি দরখাস্ত পাঠিয়ে দেব। তবে আমি আপনার কাছে এসেছি একটা অনুরোধ নিয়ে। আমি শুনেছি আপনাদের কোম্পানী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটি স্কুল চালায়। সেই সমস্ত স্কুলে শিক্ষক চেয়েও আপনারা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। হ্যাঁ দিয়েছি। তুমি কি স্কুল শিক্ষকতা করবে? করব কিনা জানিনা কিন্তু দরখাস্ত করতে আপত্তি কি? না আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু তুমি মনে হয় বিজ্ঞাপনটা ভাল করে দেখোনি। দেখলে দেখতে পেতে আমরা শুধু মহিলা প্রার্থীর জন্য আবেদন পত্র চেয়েছি, কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা চেয়েছি প্রথম শ্রেণীর স্নাতক। বললাম দেখেছি। তা হলে? আমি ভনিতা না করে বললাম একটা ফর্ম দেবেন? উনি হেসে বললেন দেব। তোমার ক্যান্ডিডেটটা কে? বললাম আপনি তাকে চেনেন। আমি চিনি? অদ্ভুত কথাতো। আমি যদি চিনি তবে আমার কাছে এলোনা কেন? ওদের তো কোন রিটেন টেষ্ট নেই। শুধু মাত্র ওরাল ইনটারভিউ। আপনি থাকবেন বোর্ডে। না থাকলেও কোন অসুবিধা হবে না। তুমি তার নাম ঠিকানা দিয়ে যাও।

আমি অশ্রুকণার নাম ও ঠিকানা দিতেই উনি চমকে উঠে বললেন, অশ্রুকণা। আমি বললাম, হ্যাঁ। আপনি ঠিকই ধরেছেন। যে মেয়েটিকে আপনারা সজল বাবুর জন্য দেখতে গিয়েছিলেন।

কি যেন ভাবলেন প্রতীমবাবু। তারপর বললেন, কিন্তু ওখানে কি ওর ভালো লাগবে? বললাম ভালো না লাগার দায়িত্ব আমি নিলাম। কিন্তু বাকী দায়িত্বতো আপনাকে নিতে হবে। উনি বললেন তা না হয় নিলাম, কিন্তু আমি একটা জিনিষ কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আমি সোজাসুজি বললাম, আসলে ও বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে ওদের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে মায়ের কাছে এসেছে। মা প্রথমে ওকে হঠাৎ খেয়াল এরকম একটা কিছু ভেবে খুব একটা গুরুত্ব দেননি, এবং এই অবহেলার জন্য, আমার মায়ের সঙ্গে অভিমান করে বাড়ী থেকে চলেও যায়। যদিও তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে, কিন্তু কথা দিতে হয়েছে তার জন্য মা চেষ্টা করবেন।

প্রতীমবাবু বললেন, আমার কাছে যে এসেছে সে তোমার নিজের ইচ্ছেয়। হ্যাঁ আমার নিজের ইচ্ছেয়, তবে মায়ের যে এ ব্যাপারে কোন ছুতমার্গ নেই তা আপনাকে হলফ করে বলতে পারি। উনি আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, ওদের দরখাস্ত আমাদের অফিসে পৌঁছাবার শেষ তারিখ আজ। আজ হয়তো পারবে না কিন্তু কাল দশটার আগে তুমি নিজে এসে আবেদন পত্রটা আমার হাতে জমা দিয়ে যেও। আরেকটা কথা, আগামী বুধবার আমরা ইন্টারভিউ নেবো। যদি মনোনীত হয়, তবে তার এক সপ্তাহের মধ্যে কাজে যোগদান করতে হবে, পারবে তো? আমি বললাম নিশ্চয়ই পারবে।

হাতে সময় নেই। বিকেলেই মিনতি সেনের ওখানে এলাম। উনি বাড়ী নেই। জবার মা দরজা খুলে দিলেন। বললাম মা, নেই? না উনিতো ফেরেন নি। তাহলে? দিদিমনি আছেন। আপনি আসুন।

উপরে গিয়ে দেখি অনুতপা আর অশ্রুকণা কথা বলছে। বহুদিন পরে ওর সঙ্গে দেখা। ও বলল, আজকাল দেখছি চিনতে পার না। না চিনতে চাও না। যা তোমার ভাল মনে হয়। তা কেমন আছো? ভাল। তুমি এখন বাড়ী থেকে? না ঠিক বাড়ী থেকে নয়, আবার বাড়ী থেকেও বলতে পার। বড় হেঁয়ালি কথাবার্তা। আগেতো এভাবে কথা বলতে। আগে কি তুমি বলতে এ ভাবে কথা। বললাম আমি? অশ্রুকণা বাধা দিয়ে বলল, তুমি কি ঝগড়া করবে নাকি, সোজা উত্তর দিতে পারনা। কোথা থেকে আসছ?

আমি বললাম, থাক ওসব কথা। তোমরা কথা বল, আমি বরং জবার মাকে বলি, যদি চা বা কফি খাওয়াতে পারে। অশ্রুকণা বলল, তুমি বোস আমি নিয়ে আসছি। অনুতপা বলল আমি উঠিরে অশ্রু। আমি অনুতপাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, অনুতপা, শুধু অকণা তোমার বন্ধু নয়, আমিও তোমার বন্ধু। তুমি মান সে কথা? না মানার কিছু হয়েছে কি? হয়নি বলতে চাও? অশ্রুকশা কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলে, চলে যাসনে কিন্তু, আমি কফি নিয়ে আসছি। ও চলে গেলে অনুতপা বলে চলে, এ বাড়ী থেকে আমাদের বাড়ীতে বেশী দুরে নয়, বরং এবাড়ী আসতে গেলে আমাদের বাড়ীর পাশ দিয়েই আসতে হয়, কিন্তু গেছো একদিনও? অথচ বন্ধুত্বের বড়াই করছ? না হয় অশ্রু, রেহানারা তোমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আমাকে না হয় ভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু হিসাবে ক্ষমা ঘেন্না করতে। বলে হেসে উঠলো। হেসে ৩ঠলেও ওর অভিযোগকে অস্বীকার করতে পারি না, তা যেন হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। বললাম, সত্যি ভুল হয়ে গেছে অনুতপা। আমি প্রমিজ করছি এ ভুল আর হবে না। অনুতপা বলল, আমিও প্রমিজ কবছি আরেকদিন এসে চা খাব, আজ সত্যিই আমার কাজ আছে। অশ্রুকে বলে দিও। তুমি বলে যাওনা। ও আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ঠিক আছে তোমাকে বলতে হবে না।

অশ্রু কফি নিয়ে এসে দেখে অনুতপা নেই। বলল, ও চলে গেলো? আমাকে একবার বলে গেলো না? ওতো বলল তোমাকে যাওয়ার সময় বলে যাচ্ছে, বললাম আমি। কিছুটা বিরক্তি সহকারে অশ্রুকণা অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল, এখন এই অতিরিক্ত এক কাপ কফি কে খাবে? আমি বললাম এর জন্য বিরক্তির কি আছে কণা। হয় এসো আমরা ভাগ করে খাই, না হয় ফেলে দাও। ফেলে দেবো? তাছাড়া আর কি করবে? ভাগ যদি করতে না চাও ফেলে দিতেই হবে। ফেলে দেওয়ার অভ্যেস যে তোমার আছে সে আমি জানি। আমিও জানি ভাগ তুমি করতে পারবে না।

এই শেষের কথাটা বোধ হয় অফিস থেকে ফিরে মিনতি সেনের কানে যায়। বলে কি ভাগ করবি, আর কিইবা ফেলে দিবি। বরং আমাকে দে, তোদের ভাগও করতে হবে না, ফেলতেও হবে না। অশ্রুকণা যেন আমার সঙ্গে একা কাটাবার দ্বিধা থেকে মুক্তি পেল।

কফি খেতে খেতে মিনতি সেনকে বললাম, তোমার মেয়েকে বল, এই ফর্মটা যেন এখনি ফিলাপ করে আমাকে দিয়ে দেয়। ফর্ম জমা দেওয়ার শুধু নয় ওখানে পৌঁছাবার শেষ তারিখ আজ। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে কাল দশটার আগে ওটা ওদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। মিনতি সেন উত্মা প্রকাশ করে বললেন, তা একথা ওকে বলতে পারলি না। কাকে বলব, ও আমার সঙ্গে কথাই বলতে চাইছেনা। তারপর না জানি কি কথা শুনতে হবে।

এত বড় অভিযোগেরও কোন উত্তর দিল না অশ্রুকণা। মিনতি সেনের কাছ থেকে ফর্মটা নিয়ে যেখানে যেখানে আবেদনকারীর স্বাক্ষরের দরকার, সেখানে সেখানে স্বাক্ষর করে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, পিসি আপনার ছেলেকে বলবেন বাকিটা পূরণ করে নিতে। বলেই ও উঠে চলে গেল। মিনতি সেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন, শুধু আমাকে বললেন তোঁদের এই ভুল বোঝাবুঝি মিটবে কবে প্রান্তিক!

জীবনে বুঝি ভুল বোঝাবুঝির কোন শেষ নেই। তা না হলে সেলিনা অমন করে বলবে কেন, প্রত্যেককে অপমান করতে করতে প্রান্তিক ভাই এটা তোমার একটা নেশা হয়ে গেছে। বলিহারি এদের অপমান বোধ। সেদিন ছিল সেলিনার জন্মদিন, কাউকে বলা হয়েগুলার এর হয় নি, মিনতি সেনের দেওয়া শাড়ী ও গয়না পরে ও যখন স্নান করে ভোরে আমাকে প্রণাম করতে এল, সত্যি ওকে অপূর্ব লাগছিল। বলেছিলাম, সেলিনা, তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে আমার অন্তরের ভালবাসা, তোমার জন্মদিনের সৌন্দর্যে পাক তার পূর্ণতা। কেউ ছিল না ঘরে। সম্ভবত: লজ্জায় পালিয়ে গিয়েছিল ও।

নীলাঞ্জনা পিসি মেয়ের জন্মদিনের মিষ্টি নিজে নিয়ে এসে আমাকে দিলে বলেছিলাম আজতো পিসি তোমার জন্মদিন নয়, যার জন্মদিন মিষ্টিটাতো তার হাত দিয়েই আসা উচিত ছিল। আর আমার এই সাধারণ কথার এই উত্তর হয়।

আঘাত সাধারণত আমি পাইনা। কিন্তু ইদানীং যে ভাবে আমাকে লক্ষ করে চারপাশ থেকে বজ্রের ন্যায় অভিযোগের তীর ছুটে আসছে, বুঝতে পারছি তার থেকে বাঁচতে হলে আমাকে পালাতে হবে একদিন। কিন্তু পালাব কোথায়?

যে সেলিনা সকালে করল অপমান, সেই এল গভীর রাতে একা ক্ষমা চাইতে! আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমাদের বোঝা সত্যি দুঃসাধ্য সেলিনা।

মাত্র কদিন আগে, মেদিনীপুরের এক আধা মফসল শহরে স্কুলের চাকরি নিয়ে চলে গেছে অশ্রুকণা। মিনতি সেন বার বার অনুরোধ করেছিলেন, মেয়েটিকে এগিয়ে দিয়ে আসার। কোনদিন মিনতি সেনের অবাধ্য হইনি, সেদিন কিন্তু হয়েছিলাম। বলেছিলাম মা, কি ভাব তোমরা আমাকে বলত। আমি কি রোবট? আমার কি রক্তমাংস নেই, অনুভুতি নেই? না আমি তা পারবো না। কিছুতেই পারবো না। মিনতি সেন চুপ করে থেকে বললেন, ঠিক আছে তোর যেতে হবে না। আমিই যাব, আর কোন দিনই ফিরে আসব না। ওর কাছেই থাকব। যদি কোনদিন আমার কথা মনে পড়ে গিয়ে নিয়ে আসিস। নিজের মান-অপমান, রাগ-অনুভূতি, কামনা-বাসনা কত কথাইতো বললি? ওগুলো কি আমার নেই? আমার কোন স্বপ্ন থাকতে নেই? কেন একটা মেয়েকে তুই স্বপ্ন দেখালি? বুঝলি যদি অসম্ভব, তবে এড়িয়ে না গিয়ে আবো ভালবেসে ভুলটা ভেঙে দিলি না কেন? অশ্রুকণা বলল, পিসি, এ আপনি কি সব বলছেন। আমি নিজেই যেতে পারবে। আপনাকে যেতে হবে না পিসি। মিনতি সেন বললেন হ্যাঁ একাইতে যাবি? তা না হলে আর আমাকে অপমান করা সম্পূর্ণ হবে কেন? মিনতি সেন উঠে চলে গেলেন। আমিও উঠতে যাব, অশ্রুকণা বলল, একটু দাঁড়াও প্রান্তিক। বল। তোমার কি আমার সঙ্গে যাওয়া সত্যিই অসম্ভব। করুণ ভাবে তাকালো ও আমার দিকে। আমি বললাম, আমাকে একটু ভাবতে দাও কশা। ভাবতে তোমাকে হবে ঠিকই কিন্তু তোমার ভাবনার থেকেও যা আমাকে ব্যথা দিচ্ছে তা হচ্ছে আমার প্রতি তোমার অবিশ্বাস। তারপর একটু থেমে বলল, সত্যি কি আমাকে একদমই বিশ্বাস করা যায় না?

আমি যে কি বলব বুঝতে পারছি না, বললাম, আমি কি কখনো বলেছি তোমাকে আমি অবিশ্বাস করি। না মুখে বলনি ঠিকই, কিন্তু তোমার প্রতিটি আচরণ আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা তোমার ভুল! তাহলে সত্যটা কি? তোমাকে জানতে হবে? যদি না বলতে চাও, আমার হয়তো এমন কোন জোর নেই, যাতে তোমাকে আমি বাধ্য করতে পারি। আসলে কশা, নিজের প্রতি বিশ্বাস আমি ক্রমান্বয়ে হারিয়ে ফেলছি। এটা তোমার অজুহাত। না অজুহাত নয়, তুমি কেন বুঝতে চাইছো না, আমিও মানুষ, আমিতো দোষ ক্রটির উর্দ্ধে নই। এই জন্য তোমার ভয়? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি প্রান্তিক, এরকম কোন অবস্থার সৃষ্টি হবে না। বরং এই অজুহাতে যদি তুমি আমাকে এড়িয়ে যাও, আমার অপমান কি পরিমান হতে পারে, তা কি বুঝতে পারছ? আমি বললাম তোমার কথাইতো সব নয়, আমার ভিতবেব দুর্বলতাগুলোকে আমি বন্ধ করব কি করে? অশ্রুকণা বলল, তুমিতো এত দূর্বল ও প্রান্তিক। তুমি নিজেকে যত দূর্বলই মনে করোনা কেন তোমার সৌজন্য বোধ তোমার সীমাবদ্ধতা এতদিন তোমাকে যেমন রক্ষা করে এসেছে আজও তেমনি ভাবে করবে। বললাম জানিনা, কিন্তু কণা, কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে তোমাদের পরিচিত প্রান্তিকের যে মৃত্যু হয়ে গেছে সেকি তুমি জান? পবম দুঃখে কেঁপে উঠে বলল, প্রান্তিক। আমি ওকে বললাম, ভয় পেলে কেন কণা? আমিতো দেবতা নই, হতেও চাইনি কোন দিন। দোষেগুণে মানুষ। হয়তো তুমি আমার উপর অনেক ভুল ধারণা করেছে, আমাকে না বুঝতে পেরে রাগও করেছে, অভিমানে দূরে সরে যেতে চেয়েছে। অথচ আমাকে বোঝার কোন চেষ্টাই করলে না কোনদিন।

অশ্রুকণা বলল, তোমাকে এ ভাবে ভাবিনি কখনন, আজো ভাবিনা, যা তুমি বলছ, ওই দুর্বলতা সবারই আছে আর আছে বলেই আমরা কেউ দেবতা নই। দুর্বলতা কি আমার ভিতরে নেই প্রান্তিক? তুমি জান না? কি তীব্র ভাবে তোমাকে আমি চেয়েছি? চেয়েছি আমার সমস্ত অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার করে। তবু কি পেরেছি তোমাকে আচ্ছন্ন করতে? আমি জানিনা, তোমাকে নিজের কথা আর কোন দিন বলতে পারবো কি না। তবু একটা অনুবোধ, বল আমাকে ফিরাবে না।

আবেগে ওর গলা যেন কেঁপে ওঠে। বললাম, বল। আগে কথা দাও তুমি আমায় ফেরাবে না। দিলাম। তা হলে চল আমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবে। জীবনের অনেক কথা যা অনেক বার তোমাকে বলতে চেয়েছি, একটু খানি সময় দিতে পারবে না কণা। ও কি প্রান্তিক, তুমি এমন থর থর করে কাঁপছ কেন? ও এগিয়ে এসে আমাকে ধরল তারপর বলল, খুবই কি আঘাত দিয়েছি? আমি বললাম, না, আঘাত আজকাল আর পাইনা। আমারও অনেক কথা বলার আছে তোমাকে। ও বলল, চা খাবে? বললাম, না থাক। কখন তোমার ট্রেন? কাল সকাল ৮ টায়। ঠিক আছে আমি যানো। আসি তা হলে। আমি চলে আসতে চাইলে ও বলল, একটু শুয়ে থাক প্রান্তিক। তোমার শরীরটা সত্যি ভাল নেই। উঠোনা কিন্তু আমি আসছি।

ও চলে গেল। এ আমার কি হল। সমস্ত পৃথিবীটা কেন আমার চোখের সামনে ঘুরছে। আমি যে কথা দিলাম পারবো কি মৰ্য্যাদা রাখতে? অশ্রুকণা যে বিশ্বাস রাখতে চাইছে পারব কি আমি হৃদয় দিয়ে তা উপলদ্ধি করতে।

আমার এই কলকাতা জীবনে প্রথম যে মেয়েটি এসেছিল তার ভালবাসার ডালি নিয়ে সেতো এই অশ্রুকণা। কিন্তু তবুতো একে আমি উজাড় কবে নিজেকে দিতে পারলাম না, সেকি আমার দোষ না অতি সাধাবণ হয়ে অতবড় উঁচুতে হাত বাড়ানো ঠিক হবে না ভেবে নিজেকে দূরে সরিয়ে এনেছি, জানিনা। এল রেহানা। তার ফুলের মত কোমল সৌন্দর্য নিয়ে ধীরে ধীরে ও আমাকে তার দিকে টেনে নিল। সর্বস্ব উজাড় করে তাকে দিলাম আমার সবটুকু, তবু কেন বুকে ব্যথা বাজে। অশ্রুকণা তার অভিমান দিয়ে আমাকে জয় করতে চেয়েছিল, মনে হয় তার মানে বুঝতে পারিনি। আজো কি পেরেছি?

কফি নিয়ে এল অশ্রুকণা, বললাম মা কোথায়? শুয়ে আছেন। শুয়ে আছেন? মানে শরীর খারাপ? শরীর হয়তো তত খারাপ নয়, তবে মনে খুব আঘাত লেগেছে। তুমি কফিটা খেয়ে একবার যাও তার কাছে। আমি বলে এসেছি প্রান্তিক কফি খেয়ে আসছে আপনার কাছে।

আমি বললাম, কণা, একটা কথা বলব? বল ও তার ভেজা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আমার দিকে। আমি আস্তে আস্তে বলতে থাকি, আমি যে সত্যিই তোমাকে ধীরে ধীরে ভালবাসতে চেয়েছিলাম, যদি একথা বলি তুমি কি অবিশ্বাস করবে। কেন এমন ভাবছ যে আমি তোমাকে অবিশ্বাস করব। তাহলে শোন, যেদিন তুমি সত্যি সত্যি বাবা-মাকে ছেড়ে চলে এলে সেদিন থেকে মনে হয়েছে আমি সত্যি তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে একদিকে রেহানা, আর একদিকে সেলিনা। রেহানাকে বুঝতে পারি, কিন্তু বুঝতে পারিনা সেলিনাকে। আরো ভয় হয় ওর সহজ সাবলীল স্পষ্টতাকে। আজ আমি চাইলেও বোধ হয় আমার মুক্তির পথ নেই। নিজের দেওয়া গন্ডীতে নিজেই বাধা পড়ে গেছি কখন যেন। যতই তোমাকে অস্বীকার করতে চেয়েছি, যতই তোমাকে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করেছি, তোমার তীব্র অভিমান, ততই তোমাকে আমার আরো কাছে নিয়ে এসেছে। এখন মনে হয়, তোমাকে ছাড়া বুঝি আমি চলতে পারব না, আর এই দুর্বলতা মনের মধ্যে যতই অনুভব করেছি ততই না জেনে তোমাকে আরো বেশি আঘাত দিয়ে ফেলছি। এবার বল আমি কি করব।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অশ্রুকণা বলল, তোমাকে আমি বুঝি প্রান্তিক, তোমার দুঃখ কষ্ট ব্যথা বেদনা সব কিছু একাকার হয়ে আমাকে গ্রাস করে। আমি বললাম, তুমি বোঝ আমার কষ্ট? তোমার কি মনে হয়, বুঝি না? জানিনা কণা, শুধু মনে হয় আজ যে গোলক ধাঁধায় আমি পথ হারাতে বসেছি, সেখান থেকে তুমিই একমাত্র আমাকে বাঁচাতে পার। কি ভাবে? তাতো জানিনা কশা, এ শুধু আমার বিশ্বাস, যে মেয়ের আমাকে না জানিয়ে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই, কেবল মাত্র তার কাছেই আমার মুক্তির মন্ত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *