১১-১৫. এই বাঁধা পরান যে আর মানে না বারণ

এই বাঁধা পরান যে আর মানে না বারণ
অঙ্গের জ্বালা আর মানে না শাসন
শয়নে কণ্টক ফোটে জাগিলে ব্যাকুল
বধুঁরই পিরিতে হইয়াছি আকুল
শাওন মেঘের লাহান পরান উতলায়
মরিলাম বুঝি আমি যৈবন-জ্বালায়
আমি জল আনতে নদীর ঘাটে
তুমি পবন হইয়া ঢেউ দেও তাতে
কলসি দূরে ভাসিয়া যায়
কুলকন্যার লাজ রাখা যে দায়।

হোসেন ছবদারকে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিল বটে, কিন্তু নিজেও মুক্ত হইয়া চলিয়া আসিতে পারিল না। মৃতপ্রায় ছবদারকে লইয়া যখন সেইখানে গিয়া পৌঁছাইয়াছে তখন গভীর রাত্রি; পাড়ে উঠিয়া ডাকাডাকি করিয়া ঘরে উঠাইবার পর আরও অনেক দায়-দায়িত্ব দেখা গেল। যে-মানুষটা একইরকম জীবন যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করিতেছে তাহাকে সে উপেক্ষাও করিতে পারে নাই। বিশেষ করিয়া সে যখন দেখিল, তাহার স্ত্রী-কন্যা এবং বালক পুত্রের পক্ষে এমন কোনো সাধ্য-সামর্থ্য ছিল না যাহার বলে ছবদারের তত্ত্বতালাফি করিতে পারে। কিন্তু কবিরাজ দেখাইয়াও কোনো লাভ হইল না; পথেই ছবদার আউলাইয়া গিয়াছিল, বাড়ি পৌঁছিবার দিন দুয়েকের মধ্যে সে একেবারেই চলিয়া গেল।

তেমন সংসার মানুষ যে কোন সুখে করে! কাফন-দাফনের ব্যয় দূরের কথা, ঘরে উপযুক্ত আহার্য পর্যন্তও নাই। সে বাহির হইত কেরায়া খাঁটিতে, স্ত্রী সামান্য কিছু জুটাইয়া আনিত জমি-জমা ওয়ালাদের বাড়িতে ধান ভানিয়া, না হয় অন্য কোনো কাজ করিয়া। মেয়ে মেহেরজানকে বিবাহ দিয়াছিল অনেক আশা করিয়া, কিন্তু পণের কড়ি জোগাইতে পারে নাই বলিয়া সেই মেয়ের সংসারও সুখের হয় নাই। নানারকম অত্যাচারের কবলে পড়িয়া সে একদিন অগত্যা বাপের বাড়ি চলিয়া আসিয়াছে, বরপক্ষও আর খবর লয় নাই, সে ও আর কিছুতেই সেইমুখী হইবে না স্থির ধরিয়া বাপের শণের কুঁড়াতেই রহিয়া গিয়াছে। বালক পুত্র জাফর এখনও তাহার কৈশোর অতিক্রম করে নাই। ছবদারের মৃত্যুতে সকলেই যেইভাবে ভাঙিয়া পড়িল, তাহার মধ্য হইতে নিজেকে সরাইয়া লইবার উদ্যোগ করিয়াও হোসেনের আর পা উঠিল না।

মৃতের সাতি করিতে হয়, সুতরাং একটা অনুষ্ঠানেরও ব্যবস্থা হইল। সেই সব বিষয় অথবা ঘটনা অজানা ছিল না হোসেনের কাছে, কিন্তু যে-মুহূর্তে সেই অনুষ্ঠানের পরিচালক এক মৌলবি জানাজায় উপস্থিত সকলের দিকে ঘুরিয়া জানিতে চাহিল মৃতের প্রতি কাহারও কোনো দাবি দাওয়া আছে কিনা, সেইসময় হোসেনের কাছে সমস্ত জগৎ সংসারের উদাসীন ভাবটা যেন আরও প্রকট হইয়া ধরা পড়িল। কপর্দকহীন বৃদ্ধ ছবদারের মৃতদেহটা উঠানের উপর, তাহার সাধ্যমতো সংগ্রাম সে-ও করিয়াছে, তাহার পক্ষেও কি সব জগৎ-সংসারের প্রতি কোনো দাবি নাই? চোখে পড়িয়াছিল তাহার স্ত্রী এবং পুত্র কন্যাকে এখন কী উপায়ে তাহারা জীবন চালাইবে? তাহার স্ত্রীও ক্রমাগত কাঁদিয়া জানাইল, গ্রামে দুষ্ট লোকের অভাব নাই বলিয়া মেহেরজানের পক্ষেও কোনো শ্রমের কাজের সুযোগ নাই। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে মেহেরজানের দিকেও তাকাইয়াছিল। সে কিছুই বলে নাই, দুইটি গভীর চোখের দৃষ্টি সরাইয়া লইয়া আড়ালে চলিয়া গিয়াছিল। পুত্র জাফর যেন তখনও সমস্ত ঘটনার গুরুত্ব সঠিকভাবে বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই।

দিন কয়েক পরে হোসেন জাফরকে সঙ্গে করিয়া সেই বাড়িয়ালের পুকুরের ধারে বড়শি ফেলিয়া বসিয়াছিল। মনে যত না শিকারের চিন্তা, তাহার তুলনায় অনেক বেশি অন্য অন্য বিষয়। অনেক পুঁটি ট্যাংরা খোঁট দিতেছিল বড়শিতে, কিন্তু হোসেন বিচরণ করিতেছিল যেন অন্য কোন জগতে, কোনো বারই সে যথাসময়ে ছিপে টান দিতে পারিয়া উঠিতেছিল না। মনের হয়তো আমোদ পাইতেছিল, কিন্তু হোসেন বিরক্ত বোধ করিতে শুরু করিয়াছিল নিজের উপরেও, এক সময় কলসি-কাঁখে করিয়া মেহেরজানকেও সেই পুকুরের অন্য এক ঘাটের দিকে যাইতে দেখিয়া সে আরও অন্যমনস্ক হইয়া পড়িল। গাছ-গাছালির আড়ালে মাত্র মুহূর্তকালের জন্য দেখা গেলেও মনে হইল সে-ও আবার স্বাভাবিক সংসারকর্মে লিপ্ত হইতে চাহিতেছে। পুকুরের একদিকে কলাপাতা দিয়া ঘেরা তাল-তমালের গুঁড়ি দিয়া বাঁধা ঘাটের দিক হইতে কতকগুলি ছোটো ছোটো ঢেউ তাহাদের দিকেও বিস্তৃত হইয়া আসিল। বড়শির ফাতনার দিকে আঙুল তুলিয়া জাফর বলিল : মা-য় না বুজান-এ বোধ করি নাড়াইয়া দিল পানি, এখন মাছগুলান দুদ্দাড় করিয়া এইদিক সেইদিক ছুট দিবে। দেখিয়েন এখন অনেকক্ষণ অবধি আর বড়শি খোটাইবে না!

হোসেন তাহাকে শান্ত করিতে চাহিল : আহা, অন্যেরও তো কামকার্য আছে! মনে কয় তোমার বুজানই ঘরের কোনো কাজে জোগান দিতে ঘাটে আসছে।

জাফর মেয়েদের ঘাটের দিকে একবার মুখ উঁচাইয়া বলিল : হ, বুজানই হইবে, দেখি তো ঢেউগুলান ছোটো ছোটো। বুজান যখন ঘাটে নামে তখন যেন পানিরে তক টের পাইতে দিতে চায় না। নাহ্, তেমন ভাবনার কারণ নাই। কেবল বুজান এখন ঘাটের এইদিক-সেইদিক কিছু না কিছু ছিটাইলে আমাগো আধারেরও কেউ তেমন হেলাফেলা করবে না।

কিন্তু হোসেন আবারও সময়মতো ছিটে টান দিতে ভুল করিয়া ফেলিল। জাফর বেশ একটু শোরগোল তুলিয়া তাহার হাত হইতে ছিপটা টানিয়া লইতে চাহিল : নাহ্, আমার তো মনে কয় আপনে বৈদেশি মানুষ বলিয়াই ওইসব মাছগুলান আপনারে কেবলই ফাটকি-ফুটকি দিতে শুরু করছে।

বড়শিটা আবারও ফেলিতে না ফেলিতেই মেয়েদের সেই ঘাটের দিক হইতে একটা আর্তস্বর ভাসিয়া আসিল; ডাক শুনিয়া জাফর তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া গেল। হোসেনও ছিপ সরাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

কয়েক মুহূর্তপর মেয়েদের সেই ঘাটের দিক হইতে জাফরের আর্তকণ্ঠ শোনা গেল : ভাইজান, ভাইজান, শিগগির আসেন। আমার বুজানরে বুঝি নাপে খাইল!

হোসেন তাহার ইঙ্গিত অনুসরণ করিয়া দেখিল ভরা-কলসি কাঁখে মেহেরজান ঘাটের পৈঠার উপর নিশ্চল, উপরের ঘাটে দুইটা গোক্ষুর সাপ ফণা উঁচাইয়া পরস্পরের সঙ্গে কোনো বীভৎস খেলায় মাতিয়াছে। একটা ফণা নামাইয়া সরিয়া যাইতে চায়, অন্যটা আবার ধাইয়া আসে। তাহাদের ফোঁস-ফোঁসানি যেন ক্রমাগত বাড়িয়া উঠিল, আর একটা অদ্ভুত গন্ধেও চারিদিক ভরিয়া গেল।

: ওই তেতুঁলতলায় এক খোঁড়লে থাকে, আমি আরও একদিন দেখছি। হোসেন জাফরকে কাছে টানিয়া শান্ত করিতে চাহিল : ডরের কারণ নাই। তুমি কোঁচ-সড়কি হাতের কাছে যা পাও লইয়া আসো গিয়া। কোনো ডরের কারণ নাই।

বলিল বটে, কিন্তু হোসেন মেহেরজানকে তৎক্ষণাৎ আরও কিছু পরামর্শ দিতে পারিল না। সে এমন একটা স্থানে দাঁড়াইয়া ছিল যে, সেইখান হইতে যে-কোনো দিকে পা বাড়াইলে হয়তো একটা না একটা সাপের গায়ের উপর গিয়া পড়িবে।

: ধীরে ধীরে পিছু হটিয়া নীচের দিকে নামিয়া যায়েন। সাবধান, কোনো শব্দ না হয়। মনে কয় নিজেগো লইয়াই মত্ত আছে।

মেহেরজান একটু ভ্রুকুটি করিয়া তাহার উপর হইতে দৃষ্টি সরাইয়া নিল। কাঁখে ভরা-কলসি, না নড়িয়া পিছনে পৈঠার দিকে পা বাড়ানো শক্ত, তাহার উপর সারা অঙ্গে সিক্ত বসন লইয়া সে আরও জড়-সড়, মনে হইল হোসেনের উপস্থিতি সে যেন চাহিয়াও চায় নাই।

ইতিমধ্যে জাফর লইয়া আসিয়াছে দুই দুইটা কোচ-বর্শা, তাহার পিছনে মায়ের হাতেও লাঠি-খোটা। হোসেন জাফরকে সরাইয়া দিয়া মেহেরজানকে ত্রাণের উপায় খুঁজিতে লাগিল।

জাফরের মা অবস্থা দেখিয়া প্রথমে পাথর হইয়া পড়িলেও সাহস জোগাইতে ব্যস্ত হইল : থাউক, থাউক, গায়ে আঘাত না পাইলে ওরা কেউর ক্ষতি করে না। এখন বোধ করি হাউশের কাল, মনে কয় খেলতে খেলতেই তেতুল গাছের গোড়ায় নালার দিকে নামিয়া যাইবে।

: বিশ্বাস কী! ঘাটের দিকেও নামিয়া পড়িতে পারে! হোসেন শক্ত মুখে সেই বাধা উড়াইয়া দিতে চাহিল : এমন বিপদ চুপ করিয়া দেখন যায় না। জাফরের মা সাপ দুইটার আকৃতি, শক্তি এবং তর্জন-গর্জনের দিকে ইঙ্গিত করিয়া বলিল : ওদের সঙ্গে বুঝিয়া ওঠাও সাধ্যে কুলাইবে না।

তাহার কথা শেষ হইবার আগেই হোসেন দুইহাতের দুই কোচ-বর্শায় সাপ দুইটাকে মাটির উপর গাঁথিয়া ফেলিল বটে, কিন্তু তাহাদের সমস্ত আক্রোশ একই সঙ্গে হোসেনের দিকে ঝুঁসিয়া উঠিল; সেইরকম বিদ্ধ অবস্থাতেই দেহের সমস্ত শক্তি লইয়া জড়াইয়া উঠিতে চাহিল অস্ত্রের হাতল; হোসেন ভয় পাইল, তবু টলিল না; দুই বাহু, সমস্ত শরীর থর থর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। সেই মুহূর্তে মেহেরজান তাহার মা-এর হাত হইতে লাঠি ছিনাইয়া ঝাঁপাইয়া না পড়িলে হয়ত নিদারুণ কোনো অঘটন ঘটিয়া যাইত। জাফরের মা হায় হায় করিতেছিল, কিশোর জাফরও কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ইতিমধ্যে সাপ দুইটা যেন হোসেনকেও জড়াইয়া ফেলিবার উপক্রম করিয়াছে, সেই অবস্থায় মেহেরজান আর নিশ্চল থাকিতে পারিল না। উপর্যুপরি কয়েকটা আঘাতেই সাপ দুইটা নিস্তেজ হইয়া পড়িল। জাফরও আগাইয়া গিয়া তাহাদের যেন মাটির সঙ্গে মিশাইয়া দিতে চাহিল।

হোসেনের সারা দেহে তখন ঘাম ছুটিয়াছে; জাফরের মা কাঁপিতে কাঁপিতে একধারে বসিয়া পড়িয়াছে; মেহেরজানও তাড়াতাড়ি যেন সম্বিৎ ফিরিয়া পাইয়াই, আড়ালে চলিয়া গেল।

: বড়ো ফাঁড়া গেছে, বড়ো ফাড়া গেছে। আমার যেন আর উঠিয়া খাড়াইবারও শক্তি নাই।

হোসেনও হাঁপাইতেছি; সাপ দুইটার মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া কেবল বলিল : এমন বিপদ ধারে-কাছে লইয়া বসত করাও কোনো সুবুদ্ধির কাজ হইত না।

কিছুকাল পরে হোসেন যখন ঘরের বারান্দায় বসিয়া নিজেকে গুছাইয়া লইবার বিষয়ে উদ্যোগ করিতেছে, সেইসময় কপাটের কাছে মেহেরজানের সাড়া পাওয়া গেল। একটু পরে জাফর ডাকিতে আসিল : আসেন ভাইজান, বুজানে কইছে গোসলে যাইতে, খাওনের সময় হইছে।

ছবদারের সংসারের বিধি-বিধানের সঙ্গে নিজেকে আরও জড়াইয়া লইবার কোনো ইচ্ছা ছিল না হোসেনের, কিন্তু জাফরের আহ্বান উপেক্ষাও করিতে পারিল না, বরঞ্চ সেই আহ্বানের আড়ালে মেহেরজানের প্রখর দৃষ্টি লক্ষ করিয়া সে বেশ কিছুক্ষণ অবাক হইয়া রহিল!

: আরে আসেন, আসেন! যে মাছগুলান ধরছিলাম, এখন তাই ভাজা হইতে আছে

জাফর হোসেনকে একরকম টানিয়াই উঠাইল।

বাড়ির ধারে খালের উপর নৌকাটার দিকে চোখ পড়িতেই হোসেন যেন সচেতন হইয়া উঠিল; ‘পাড়া’র বাঁধন পরীক্ষা করিয়া সে যেন আপনমনেই বলিল : হ, এখন আমারেও যাইতে হয়।

: কোথায়-জানিতে চাহিল জাফর; হঠাৎ তাহাকেও কেমন অসহায় দেখাইল। হোসেন এক মুহূর্ত তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া খালে নামিয়া গেল : আসো জাফর, তবে যেন স্রোতের দিকে যাইও না।

কিন্তু জাফর যেন হোসেনের নৈকট্যের অভয় লইয়াই কখনও ঝপাঝাপি, কখনও ডুব সাঁতার, আবারও কখনও চিৎ হইয়া ভাসিয়া থাকিয়া তাহাকে চমকৃত করিয়া দিতে চাহিল।

: সাবাশ, সাবাশ! শিখলা কেমন করিয়া এত সব?

জাফর নাক মুছিয়া বলিল : বাজানে শিখাইছে!-পরক্ষণেই আবারও ডুব দিয়া ভাসিয়া উঠিল আরেকধারে উলাস তুলিয়া, যেমন করে গাঙের শুশুক : কিন্তু পুকুরে আমি আরও ভালো পারি। এইখানে কোনটাকে যে কোনদিকে ভাসিয়া যাইতে হয় সেই ডর লাগে।

: বুঝছি, বুঝছি খুব বাহাদুর তুমি। ডুব দিয়া দুই চৌখ রাঙা করিয়া ফেলাইছ, এইবার উঠতে হয়।

সেইসময় আবারও তাহার নিজের পথে মন দিবার কথা মনে হইল হোসেনের। আহারে বসিয়াও সেই কথাটা ঘুরিয়া-ফিরিয়া মনে আসিতে লাগিল, জাফরও পাশে বসিয়া কী বলিয়া যাইতেছিল সেইদিকেও তাহার বিশেষ খেয়াল ছিল না। আহার বাড়াইয়া দিতে ছিল জাফরের মা, আড়ালে মেহেরজান। ভাই-এর বেশবাস এবং ভাবভঙ্গি দেখিয়া মেহেরজান হাসিয়া ফেলিল : আহা, কী বাহার! যা ছিরি, ঘর নাই তবু দুয়ার দিয়া শোয়!

জাফর ‘আলপাশ’ করা চুলের উপর হাত ছোঁওয়াইয়া হোসেনের দিকে ইঙ্গিত করিল : ভাইজানেই আঁচড়াইয়া দিল। আর ভালোও পারে, না? মেহেরজান তাহার মা-র আড়াল হইতে একটু মুখ কুঁচকাইল, হয়তো বা অস্ফুটস্বরে কিছু বলিয়াও থাকিবে, যা ছিরি! অথবা ওই ধরনের কিছু; কিন্তু জাফর আর সেই সব গ্রাহ্যে না লইয়া বড়শিতে ধরা মাছগুলির ভাগাভাগিতে ব্যস্ত হইয়া উঠিল, নির্দিষ্ট করিয়া দিতে লাগিল কোনটা কাহার, বড়ো-সড় একটা সে নিজেই হোসেনের পাতে তুলিয়া দিল। মেহেরজান তাহার ভাব ভঙ্গি লক্ষ করিয়া তাহার মা-এর কাছেই মন্তব্য করিল : আর বাদ বাকি সবগুলানই ওনার বেবাক!

হোসেনও সেইসব খেয়াল করিয়া মুখ তুলিল : আর সেই বড়ো পাবদাটা, সেটা দেখিয়া তুমি এত হৈ চৈ উঠাইছিল, সেইটাও তোমার।

: কই, সেই বড়ো পাবদাটা তো দেখি না।-জাফর সমস্ত মাছগুলি উলটাইয়া পালটাইয়াও তাহার কোনো সন্ধান পাইল না।

জাফরের মা-ও কোনো সদুত্তর দিতে পারিল না, পিছনে মেয়ের দিকে মুখ ফিরাইয়া সে একটু হাসিয়া সে বিষয়ে আর কথা বাড়াইল না।

জাফর হঠাৎ হাসিয়া ফেলিল : আছি বুঝছি। এবার সেইটা বিড়ালে খাইছে।

: হইছে, হইছে।-জাফরের মা তাড়া দিল : খালে আরও বড়ো বড়ো অনেক পাওয়া যায় ভাটার কালে। এক সময় আবারও বড়শি লইয়া বসলেই হইবে। তুই যা দেখি মেহের একটা পাঙ্খ লইয়া আয়। দুইজনেই যেন ঘামে আবার নাইয়া ওঠছে।

হোসেন কাঁধের গামছায় মুখ মুছিয়া বলিল : এমন আমার সব সময়ই হয়।

: আমারও। মা-য় কইছে খাওনের কালে যার নাক মুখ এই রকম ঘামে সে খুব বউর আদর পায়।

জাফরকে আপন মনেই হাসিয়া গড়াইয়া পড়িয়া যাইতে দেখিয়া জাফরের মা তাড়া লাগাইল : হইছে, হইছে, ভালো করিয়া কাঁটা বাছিয়া খাওয়া শেষ কর তো তুই, এমনিতেই অসময় হইয়া গেছে।

মেহেরজান ধীরপদে একটা পুরাতন তালপাখা হাতে লইয়া ফিরিয়া আসিল, কিন্তু তাহার মা-এর হাতে দিতে চাহিল না; ফিসফিস করিয়া বলিল : নতুন যেটা বানাইছেলাম অনেক তালাশ করিয়াও আর পাইলাম না। মনে কয় সেই জানাজার দিনই কেউ বেখেয়ালে উঠাইয়া লইয়া গেছে। এইটা দিয়া বাতাসের কাম নাই।

সেইসব কথাবার্তার দিকে নয়, তাহার হাতের চুড়িগুলির শব্দেই হোসেন একবার তাহার দিকেই নিবদ্ধ ছিল হয়তো, কিন্তু, তৎক্ষণাৎ অন্যদিকে সরাইয়া লইল।

: অবস্থা তো জানোই। ভালো কিছু ধরিয়া দিতে পারলাম না তোমার সামনে, বাজান। একটা ঝাঁকি জাল লইয়া খালে ক্ষেপ দিলে অনেক মাছই পাওন যাইবে।

: অনেক খাইলাম চাচি। তবে এইবার আমারেও উঠতে হয়। হ, যাইতেও হয়।

জাফর মাঝে পড়িয়া বলিল : ওই শোনো, ভাইজান সেই কখন থেকিয়া বারংবার একই কথা কইতে আছে। না, যাইতে দিমু না!

জাফরের মা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া রহিল, তারপর পিছনে মেয়ের দিকে ফিরিয়া বলিল : আয়, এইবার তুইও কিছু মুখে দিবি। এই জাফর তুইও বুজানরে কিছু সাহায্য কর। আমার কোমরের ব্যথা লইয়া তেমন আর উঠতে বসতে পারতে ‘আছি না।-খানিক পরে সে আবারও হোসেনের দিকে মুখ ফিরাইল : কখন যাবা ঠিক করছ? পরের পোলা তুমি, আমাগো ধরিয়া রাখনেরই বা কি এমন সাধ্য আছে।

জাফর হাঁড়ি বাসন লইয়া রাঁধা-বাড়ার ঠাঁই-এর দিকে যাইতে যাইতে মেহেরজানকে ডাক দিল : আসো, আসো পুষি, পুষি!

মেহেরজান তাহাকে বাগে পাইয়া ছোটো একটা কিল বসাইয়া দিল তাহার পিঠে খবরদার, এই কথা আবারও উঠাইস না।

জাফর খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল : একশোবার উঠামু, তুমি আমার ছিরি লইয়া ভ্যাঙাইছিলা ক্যান?

: যদি কইস তা হইলে আমার মরা মুখ দেখবি। মরামুখের প্রসঙ্গে জাফরের মুখের হাসি নিভিয়া গেল; মেহেরজানকে দুই হাতে জড়াইয়া সে ধীরে ধীরে বলিল : না, বুজান, না কখনও কেউরে কমু না। তুমি যে পাবদামাছ এমন ভালোবাসো তা তো আমিও কক্ষনো জানি নাই।

ভাইকে একটু আদর করিয়া মেহেরজান মাচার উপর হইতে লেবুর আচারের শিশি নামাইয়া আনিল, জাফর যেন কৃতার্থ হইয়া গেল।

সেই সময় জাফরের মা কাছে আসিয়া লক্ষ করিয়া আপশোশ উঠাইল : আহা, একটু আগে যদি মনে করতি। মনে কয় ওই পোলাটারও মুখে রুচত।

মেহেরজান বারান্দার দিকে একবার ক্ষিপ্র দৃষ্টি বুলাইয়া বলিল : ইচ্ছা হইলে তার যাওনের সময় তুমি শিশিটাই তার সঙ্গে দিয়া দিও।

জাফরের মা খাটালের একধারে বসিয়া পড়িল। খাবার পাত্র সামনে লইয়াও সে বহুক্ষণ অবধি বাইরের রৌদ্রজ্বলা উঠানের দিকে চাহিয়া রহিল।

মেহেরজান রাগ দেখাইল : এই মা, তুমি কিছু মুখে না দিলে আমিও কিন্তু এই উঠলাম।

জাফরের মা পাত্রের উপর মনোযোগ দিবার চেষ্টা করিল : মনে কয়, যাওনের কাল আমারও হইছে, তেমন আর খিদা-তৃষ্ণাও যেন নাই!

: না খাওয়াটাই অভ্যাস হইয়া গেছে।

মেয়ের কথাটা খেয়াল করিয়া জাফরের মা-র মুখেও একটা ছোটো হাসি ফুটিয়া উঠিল: হইবে। হ, তা-ও হইতে পারে। এখন বোধ করি কেবল উপাস দেওনই কপালের লিখন হইয়া রইছে।

হোসেন যাত্রার আয়োজনে মন দিয়াছিল।

খালপাড়ে বাঁধা নৌকাটার তদারকি শেষ করিয়া বাড়িয়ালের দিকে পা বাড়াইয়াছে, এমন সময় দুইজন দেহাতির সম্মুখে পড়িয়া গেল। তাহাদের একজনের হাতে ঝাঁকিজাল, অন্যজনের হাতে খালুই, মনে হইল, ছবদারের অন্তেষ্টির সময় তাহাদেরও দেখিয়াছিল। এই বাড়িয়ালের অল্প দূরেই তাহাদের বাড়ি, ডাক দিলে সাড়া পাওয়ার মতো কিন্তু হোসেন শুনিয়াছে, কোনো সাহায্যে অগ্রসর হইয়া আসে না।

: এই মিঞা।

একজনের হাঁক শুনিয়া হোসেন থামিয়া গেল : জ্বে?

: এখনও তক এইখানে?

তাহার তির্যক দৃষ্টি এবং প্রশ্নের কোনো যথাযোগ্য উত্তর দিতে পারিল না হোসেন, আমতা আমতা করিয়া বলিল : এগো এমন অবস্থায় ফেলাইয়া যাইতে পারলাম না। একটা ব্যবস্থা করন লাগে। কিন্তুক আমার সাধ্যই বা কী আছে!

সেই লোকটি মুখে একটা ঘাসের খণ্ড নাড়াচাড়া করিতেছিল, সেটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া হাসিতে চাহিল : আছে, মর্দ আছে। জোয়ান মানুষ, বিষয়াদি করেন নাই। মাইয়াডারে যথারীতি তালাক লওয়াইয়া হালাল করিয়া লইলেই হয়। দশজনেও আর কিছু কওনের সুযোগ পাইবে না।

হোসেন তাহাদের হা হা করিয়া হাসিয়া চলিয়া যাইতে দেখিল। রওয়ানা হইয়া পড়িতে একরকম মনস্থির করিয়াছিল, লোক দুইটির ভাবভঙ্গি লক্ষ করিয়া সে যেন আবারও একটা দোটানার মধ্যে পড়িয়া গেল। ঘরে ফিরিয়া গিয়া সে বসিল পুকুরঘাটের একটা গাছের তলায়। তাহার কেবলই ভয় হইতে লাগিল সে সম্ভবত বাস্তবিকই অসঙ্গত কিছু করিয়া ফেলিতেছে। সে নিজেকে বুঝ-সমঝ দিয়া সরাইয়া লইয়া গেলেও সকলের বিশেষ করিয়া মেহেরজানের ভবিষ্যৎ কী হইবে ভাবিয়া তাহার উৎসাহও কমিয়া গেল। মেহেরজানের মতো কন্যা কোনো দুষ্ট লোকের লালসার দৃষ্টি হইতে রেহাই পাইবে না।

সেই সময় হঠাৎ সে মেহেরজানের উপস্থিতি টের পাইল কাছাকাছি। মুখ ঘুরাইয়া দেখে আহার শেষে একখিলি পান বানাইয়া তাহাকে দিবার জন্য জাফরকে তালাশ করিতেছে। হোসেনই উঠিয়া তাহার কাছে আগাইয়া গেল। মেহেরজান গায়ের আঁচল সংযত করিয়া দৃষ্টি নত করিল। মনে হইল, আহারান্তে সেও বুঝি পান খাইয়া থাকিবে, তা না হইলে মুখের ঠোঁট ওই রকম রাঙা হইতে পারে না। আরও মনে হইল, হয়তো বা অন্য কোনো কারণে তাহার মুখমণ্ডলও যেন আরক্ত হইয়া পড়িয়াছে, সমস্ত শরীরে কোনো আশ্চর্য জড়তা পুঞ্জিভূত হইয়া উঠিয়াছে।

: জাফরের হাতে পাঠাইয়া দিতে চাইছিলাম, তারে কোথাও দেখি না।

তাহার ঈষৎ বাড়াইয়া ধরা পানের খিলিটা হাতে লইতেও ভয় করিতে লাগিল, হোসেনের মাথার মধ্যে বুকের মধ্যে যেন সমস্ত কিছুই গোলমাল হইয়া যাইতে শুরু করিল। তাহার অকস্মাৎ আশ্লেষে মেহেরজান থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল; তারপর জোর করিয়া নিজেকে ছাড়াইয়া লইয়া সে ঘরের পথে ছুটিয়া গেল। হয়তো বা অস্ফুটস্বরে কিছু বলিয়া থাকিবে, হোসেন বুঝিতে পারিল না। নিজেকে সামলাইয়া লইতে তাহার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগিল, তারপর নত মস্তকে ধিক্কার-ভরা অন্তরে সে বহুক্ষণ যাবৎ সেই পুকুর পাড়ে বসিয়া রহিল।

.

১২.

পঙ্খী কখন যেন উড়িয়া যায়।
বুঝি বদ হাওয়া লাগিয়াছে খাঁচায়
খাঁচার আড়া পড়ছে ধ্বসিয়া
পঙ্খি দাঁড়ায় কেমন করিয়া
এই ভাবনা করছি বসিয়া
চমক-জ্বর লাগছে এ গায়।

ভাবিয়া অন্ত নাহি দেখি
কার বা খাঁচা কেই বা পঙ্খি
আমারই পিঞ্জিরায় থাকি
আমারে মজাইতে চায়।

আগে যদি যাইত জানা
জংলা যে সে পোষ মানে না
তবে তার প্রেম করতাম না
লালন ফকির কাঁদিয়া কয়।

লতিফের আসর এক সময় ভাঙিয়া গেলেও শিকদার আর ঘুমাইতে পারে নাই। লতিফের তরফে যত্ন আস্তিকের কোনো ত্রুটি ছিল না। মাঝে মাঝে দোকানে একলা পড়িয়া থাকে, স্টিমারের সময় ছাড়া খরিদ্দার-গ্রাহকদের কোনো তেমন ভিড় হয় না। সে তখন একটা অন্যরকম পেশায় নামিয়া ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। শিকদারের মতো মানুষ পাইয়া সে বাস্তবিকই খুব। খুশি হইয়াছিল। আসরে নানাজনের সমাবেশে সে আরও গর্ববোধ করিয়াছে। ঘাট-মাস্টারের সঙ্গে আরও কিছু ঘনিষ্ঠতা হইল শিকদারের। সে কেবল গীত গানের সমঝদারই নয়, মনে হইল তাহার জীবনেও গভীর কোনো দুঃখ আছে, কিন্তু সে যেমন আপনা হইতেই কিছু বলিল না শিকদারও তেমনই সম্ভ্রম দেখাইয়া কোনো প্রশ্নও করিল না। সে আসর শেষ হইবার আগেই নিজের কাজে চলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু তাহার কথাগুলি বারংবারই নানাভাবে ঘুরিয়া-ফিরিয়া মনে আসিতে লাগিল। সমস্ত জগৎ সংসারের দুঃখের বাস্তবিকই কোনো অবধি আছে? পিতামহ করমালীও তো দুঃখ ব্যতীত জীবনে অন্য কিছু দেখে নাই, যে-আনন্দের সন্ধান সে পাইয়াছিল তাহা একান্ত তাহার আত্মগত, হয়তো তাহাও কেবল একটা উত্তরণের চেষ্টার মধ্যেই শেষ হইয়া গিয়াছে। ঘাট-মাস্টারের কথা গুরু-কবিয়ালের মতো শোনাইয়াও শোনাইল না, সে যেন অন্য একটা ইঙ্গিত দিল।

একটি রাত্রির মধ্যে শিকদারের অনেক দিনের পুষিয়া-চলা ভাবনাগুলি যেন আর একইরকম মনে হইল না। একে একে এক একটি মানুষ, এক একটি ঘটনা পর্যালোচনা করিতে করিতে তাহারও বিশ্বাস হইতে শুরু করিল দুঃখও মানুষেরই সৃষ্টি, হয় দুর্বুদ্ধি না হয় শয়তানিই তাহার আসল স্রষ্টা। একটা লোভী দস্যুর মতো শয়তানই মানুষের জীবনকে মারিয়া-কাটিয়া পুড়াইয়া দিবার অধীর উল্লাস খুঁজিয়া বেড়াইতেছে সবখানে। তাহার স্বরূপ চিনাইয়া সাবধান করিয়া দিতে পারিলে অনেক দুঃখেরই তো অবসান হইতে পারে, সে যদিও ভাবিয়া পাইল না কী সে করিবে, কিন্তু সংকল্প করিল আর কখনওই সে দুঃখের গীত গাহিবে না, দুঃখ হইতে মুক্তির পথই তাহাকে খুঁজিয়া লইতে হইবে। কিন্তু কীভাবে, সারা রাত্রি ভাবিয়াও শিকদার কোনো মীমাংসা পাইল না।

সকালে, বাড়ি রওনা হইবার আগে, সে ঘাট-মাস্টারের কাছে বিদায় লইতে গেল। সকালের স্টিমার আসিতে তখনও অনেক দেরি। গাঙের উপর পাল উড়াইয়া চলিয়াছে মহাজনি নৌকার বহর, একটা মালটানা জাহাজও গাঙের মাঝ বরাবর চলিয়াছে কোনো সদর-বন্দরে। ঘাট-মাস্টার পলটুনের একধারের মাল-পত্রের হিসাবে ব্যস্ত ছিল। মালটানা জাহাজের সারেং-এর সিটি শুনিয়া সে-ও হাত নাড়াইয়া অভিবাদনের প্রত্যুত্তর দিল; শিকদারকে দেখিয়া খাতাপত্র অন্য একজনকে বুঝাইয়া দিয়া কাছে আসিল।

: কী কবি, সকালের খাওয়া হইছে? চলো, কিছু মুখে দেওন যাউক, লতিফও তা হইলে উঠিয়া পড়ছে।

শিকদার একটু আপত্তি উঠাইল : না না, সে চা-বিস্কুট দিছে। আমার চা এর অভ্যাস নাই।

ঘাট-মাস্টার তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া সঙ্গে টানিল : আরে, লতিয়ের সঙ্গে আমার অন্য বন্দোবস্ত আছে। আসো, মনের মতো দুইটা কিছু মুখে দিয়া লও, তারপর ধীরে-সুস্থে ফুর্তি করিয়া বাড়ির পথ ধরবা।

লতিফ হাসিতে লাগিল : এইখানে ঘর-পরিবার নাই তো ঘাট-মাস্টারের। আমার সঙ্গেই খাওয়ার বন্দোবস্ত। যখন কামে থাকে আমিই গিয়া তার টিকেট ঘরে দিয়া আসি, না হয় আমার সঙ্গেই বাসন টানিয়া বসিয়া যায়।

মাটির বাসনে আউশ-চাউলের পান্তাভাত, কোরা নারকেলের শাঁস, আর এক গুচ্ছের পোড়া মরিচ।

ঘাট-মাস্টার শিকদারকে একটু অবাক থাকিতে দেখিয়া হাসিতে চাহিল : চা-বিস্কুটে আমারও তৃপ্তি হয় না। তবে অত মরিচ খাইতে পারি না আমি লতিফের মতো। ধারে কাছের গ্রাম থেকিয়া জোগাড় করা খেজুরের গুড় মিশাইয়া লইলে আরও মজা। একবার খাইয়া দেখো।

সে খাদ্য অপরিচিত ছিল না শিকদারের কাছে; হোসেনের সঙ্গে খাইয়াছে বহুবার শৈশব-দিনে কিংবা আত্মীয়-বাড়িতেও তাহার দেখা পাইয়াছে কতবার, জোবেদাও একবার পরামর্শ দিয়াছিল আরও কী অনুপান মিশাইতে সেই সঙ্গে, কিন্তু অবাক বোধ করিল ঘাট-মাস্টারের মতো শিক্ষিত মানুষ কী করিয়া এখনও তাহার প্রতি এমন আসক্ত থাকিতে পারিতেছে। ঘাট মাস্টারের পরিতৃপ্তি লক্ষ করিয়া তাহার বিস্ময় আরও বাড়িয়া গেল।

লতিফ মুখের ঝালের উ-আ করিয়া হাসিতে লাগিল : বুঝছেন বয়াতি ভাই, উনি সব ফালাইয়া এই রকম খাইয়া অমৃত, অমৃত করেন। গঞ্জে কি খাতিরের অভাব! কিন্তু এইসব ছাড়িয়া অন্য কিছু ওনার আর মুখে রোচে না।

ঘাট-মাস্টার খাওয়া শেষ করিয়া শিকদারের দিকে চাহিল : কেবল খাওয়ার প্রশ্ন না করি। কেবলই তো দেখি মানুষ আপন জিনিস ফেলিয়া পায়ের কাদার মতো ধুইয়া মুছিয়া অন্য কিছু হইয়া যাইতে আছে। এই রকম একটা বাসন সামনে পাইয়া আমি অনেক স্থিত হইয়া যাই। আমার মা-এর কথা মনে পড়ে। মনে কয় সে-ও ধারে কাছে কোনোখানে আছে; ভাই-বেরাদর আত্মীয়-স্বজনও দূরে নাই, আর কোনো রকম দুঃখ বিলাসেরও সুযোগ থাকে না, অনেক দুঃখ উড়িয়া যায়, উবিয়া যায়, একলা থাকনের কোনো কষ্টই টের পাই না।

: তবে অন্য অন্য ভালো-মন্দের ব্যবস্থাও হয় বইকী মাঝে মাঝে। লতিফ তবুও একটু সাফাই দিতে চাহিল : গাঙে মাছের অভাব? জালিয়া পাড়া আছে। একদিকে, হাঁস মুরগির ব্যাপারীরাও লইয়া আসে এটা-সেটা, ফল-ফলারি সবজি, কোনোটারই অভাব নাই। ঘাট মাস্টারের কল্যাণে আমারও আর কোনো রকম খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট নাই।

ঘাট-মাস্টার কাজের তাড়ায় আর সময়ক্ষেপ করিতে চাহিল না : আমার নানান রকম উদ্বেগ আছে কবি। আমার এখন উঠতেই হয়। কথা রইল, আবার যখন এইদিকে আসবা, আমারে অবশ্যই খবর দিও।

শিকদারও বাড়ির দিকে রওনা হইতে মনস্থির করিয়াছিল, এমন সময় দেশের প্রধান বড়োমিঞার বাড়ির পেয়াদা মনসব সর্দারের মুখোমুখি পড়িয়া গেল। অনাবশ্যক রকম ঠা ঠা হাসিয়া সে শিকদারকে আবারও সেই চায়ের দোকানে বসাইল।

: এইটা কি ঠিক দেখতে আছি? যার ঘর ছাড়া বাহির নাই, তারে এই ঠাটা পড়া রোদের মধ্যে দেখিয়াও বিশ্বাস হইতে আছিল না। বড়োমিঞারে সদরের দিকে যাত্রা করাইয়া দিতে আসছিলাম, সদরে কাম, কী এক মামলা মোকদ্দমার তারিখ লইতে হইবে। এত্তো বড়ো এস্টাটের কামে কার্যে তো আর তেমন সহজ কিছু না। তিনি বসছেন কী-এক আপনা কথাবার্তার মজলিশে। এই সুযোগে একটু এইদিক-সেইদিকে চোখ বুলাইতেছিলাম। ইচ্ছা আছিল দেখি একবার ওই জালিয়াবাড়ির দিকে, তাগো তামাকের খুশবাই আর পাথরের লাহান মাইয়াছেইলাগো আদর-আস্তিক-এর কক্ষনো কোনো তুলনা পাই নাই। প্রথমে তো মনে কইল, নাহ্, আমার চৌখেরই আর বিশ্বাস নাই। আসো, আসো এক বাটি চা হউক।

–শিকদারের ওজর আপত্তির দিকে কোনো গ্রাহ্য না করিয়া মনসব সর্দার লতিফকে হাঁক দিল : ও মনে, খানকতক বিস্কুটও চাই। দুই এক বাণ্ডিল মোহিনী বিড়িও চলুক। নাকি ওই বগামার্কা সিগারেটই হউক কবি, এ?

শিকদার সসঙ্কোচে বলিল : আমার কোনোটারই অভ্যাস নাই।

: এইটাই তো হইছে তোমারে লইয়া জ্বালা, এমন গুণী মানুষ তুমি, কিন্তু আস্তিক করনের উপায় খুঁজিয়া পাই না। সৃষ্টিকর্তায় যে ইন্দ্রিয়গুলান দিছে তাগো এমন উপবাসে রাখনের ঝোঁকটা কেউই বুঝিয়া উঠতে পারি না।

শিকদার প্রসঙ্গ এড়াইতে চাহিল। সেই চা-এর দোকানে তখন আরও কিছু লোকজন বসিয়াছে, কেউ যাত্রী-চড়নদার, কেউবা গঞ্জে বাঁধা কেরায়া কিংবা মহাজনি নৌকার মাঝি মাল্লা একধারে এক ভদ্রলোক, সম্ভবত সদর শহরে কোনো দফতরের চাকরিজীবী, সবে সম্মুখে আনিয়া রাখা সিগারেট মুখে তুলিয়া জ্বালাইতে শুরু করিয়াছে, এমন সময় কয়েকজন নিষ্কর্মা গ্রামীণ তাহার কাছে গিয়া বসিল। পরিচয় নাই, তবু একজন ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করিল : আপনে কোমনে যাইবেন?

ভদ্রলোক নাকে-মুখে ধোঁয়া ছাড়িয়া গম্ভীরভাবে তাহাদের এক নজর দেখিয়া লইল, একটা কিছু ইঙ্গিত করিতে চাহিল, কিন্তু অধিক আলাপের উৎসাহ দেখাইল না।

সেই গ্রামীণ তাহার সিগারেট খাওয়া প্রাণ ভরিয়া দেখিতে দেখিতে মনসবের দিকে ঘুরিয়া বলিল : যে যাই কউক, ছিকারেট ধক কম, বাসটা ভালো।

মনসব সর্দারও সতৃষ্ণ নয়নে তাহার সিগারেট খাওয়ার মুখ লক্ষ করিতেছিল; গ্রামীণ লোকটির সঙ্গে তাহার কোনো পূর্ব-পরিচয় না থাকিলেও মাথা দুলাইয়া সায় দিল; তারপর সরাসরি ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করিল : আপনার ঠিকানা?

ভদ্রলোক আড়চোখে তাহাকে এক নজর দেখিয়া সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল : সুবিদপুর।

: কোন বাড়ি?

: কোন বাড়ি চেনা আছে?

: কয়েন না দেখি। আমারেও বেশ বড়ো-সড় একটা এস্টাট চালাইতে হয়, আশেপাশের মুলুকগুলানের সঙ্গে একটু-আধটু চিন পরিচয় আছে বইকী। আমার নাম মনসব। কামদেবপুরের বড়োমিঞার ডাইন হাত আমি।-মনসব সর্দার বেশ গরিমার সঙ্গে চতুর্দিকে দৃষ্টি বুলাইয়া আরও বলিল : এই সব মুলুকের এমন ধনী মানীরেও চিনি না জানলে বড়োমিঞার আমারে চাকরি থেকিয়া খেদাইয়া দিবে।

: আমাদের বাড়ি হাজি-বাড়ি বলিয়া পরিচিত। চেনেন সেই বাড়ি?

মনসব সর্দার একটু কাল অবাক হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল; তারপর অকস্মাৎ সম্মুখের টেবিলের উপরে হাত চাপড়াইয়া বলিল : চিনুম না আবার! অবশ্যই চিনি। দুনিয়াজোড়া কত নাম-ডাক তাগো। তাগো বংশের কতজন এই শহরে সেই শহরের তাবড় তাবড় চাকরিবাকরি করে। আপনে?

: আমিও সেই বংশের, সরকারি আপিসে লোয়ার ডিভিশনে আছি।

: অ, তাই কয়েন আমার চেহারা দেখিয়াই বোঝান উচিত আছিল।-মনসব সর্দার অন্তরঙ্গ আলাপে ছেদ টানিয়া ভদ্রলোকের হাতের সিগারেটটার দিকে ইঙ্গিত করিল : আমারে দেবেন একটান-তারপর অসঙ্কোচে আবারও পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরিয়া গেল : মনে কয়, সরকারি চাকরির সঙ্গে কোনো পেশারই তুলনা হয় না।

সেই সময় লতিফ সেই গ্রামীণদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল : আরও কিছু চাই?

গ্রামীণ দুইজন একটু অপ্রতিভভাবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিয়া মাথা দোলাইল, নাহ্, তাহাদের তেমন কোনো কিছুর প্রয়োজন নাই।

: তবে দুইজনে যে দুইটা সিগারেট নিলেন, তার দামটা দেন, আমার হিসাব মিলাইয়া রাখতে হয়।

: দিতাছি, বাপু, দিতাছি, পলাইয়া তো যাইতে আছি না।-গ্রামীণদের একজন কোমরে বাঁধা খুঁতির মধ্য হইতে কয়েকটা পয়সা লতিফের সামনে তুলিয়া দিল।

কেবল সেই সময়ই শিকদারেরও চোখে পড়িল তাহাদের পকেটে দুইটা সাধারণ সিগারেট সম্ভবত শরীরের ঘামে একবারে দুমড়াইয়া রহিয়াছে। হাজি-বাড়ির সেই ভদ্রলোক তাহার সিগারেটটায় আরও গোটাকতক টান দিয়া মনসব সর্দারের দিকে বাড়াইয়া দিল। গ্রামীণ দুইজনও সেই অপেক্ষায় হাত বাড়াইতেছিল, কিন্তু, মনসব সর্দারের ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তাল রাখিতে না পারিয়া গুটাইয়া লইল। তবু তাহাদের একজন লোভী চক্ষু মেলিয়া বলিল : এই মর্দ, আমারেও দেবেন একটান।

মনসব সর্দার বেশ কয়েকটা ঘন ঘন টানে সিগারেটটা প্রায় শেষ করিয়া বাকিটুকু তাহাদের একজনের হাতে তুলিয়া দিল, মুঠির আঙুলের ফাঁকে সেইটুকু বসাইয়া লোকটি বেশ গরিমা ভরে চতুর্দিকটা দেখিয়া লইল।

অন্যজন তাড়া দিল : আহা, দেরি করতে আছ খামোকা, পুড়িয়া যাইতে আছে না, না হয় আমারেই দেও।

: সবুর।-সিগারেটধারী এক প্রবল টানে একমুখ ধোঁয়া গিলিয়া কাশিয়া কাশিয়া অস্থির হইয়া গেল। অন্যজন সিগারেটের সামান্য বাকি অংশটুকু তাহার হাত হইতে একরকম ছিনাইয়া লইল : হয়, হয় হইছে। তোমার কাম ছিকারাট খাওয়া! দেখো, দেখো চৌখ মেলিয়া এই সময়ে কী কায়দায় খাইতে হয়।

মনসব সর্দার অকস্মাৎ চঞ্চল হইয়া উঠিয়া পড়িল : বড়োমিঞার নৌকা ঘাটে আসিয়া পড়ার সময় হইছে, আমারে সেইদিক দেখতে হয়। তুমি যাইও না কবি, একই সঙ্গে গাঁও গ্রামের মধ্য দিয়া দেশে ফেরন যাইবে। এখন খরার কাল, তরে তরে যাইতে, কওন তো যায় না, দুই একজন ঝি-বউও চৌখে পড়িয়া যাইতে পারে। তোমার এই বিরাগী জীবনের শেষ দেখলে আমারও খুশীর সীমা থাকবে না। আচ্ছা, হইবে, হইবে, যাইতে যাইতে সেইসব কথা হইবে।

ঘাটের দিকে কলরব বাড়িয়া উঠিতেছিল; কোথাও হইতে সদরগামী স্টিমার আসার কথা। গাঙের ওই ধারের ঝালকাঠির পাশের গাবখানের মধ্য হইতে হঠাৎ সেইটা ঝপ ঝপ করিয়া বিরাট দেহ লইয়া বিশাল গাঙের উপর ভাসিয়া আসে। যতবারই সেইদিকটা দেখিয়াছে শিকদার ঘন বন-জঙ্গল ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ে নাই। অথচ সেই সব স্টিমারের মধ্যের মানুষেরা যেন অন্য কোনো জগতের বাসিন্দা, তাহাদের কাছাকাছি হইলেও যেন একটা অদ্ভুত সুবাস আসিয়া নাকে লাগে, তাহাদের তেজ-বীর্যের উত্তাপে চতুর্দিকের ভিড়ও যেন পাতলা হইয়া পড়ে। লতিফও দেখিয়া আসিয়াছে সেইসব ঠাঁই, কিন্তু তাহারও মন বসে নাই।

: যার দেশে সেই রাজা। অন্যের গোলামি করিয়া পেট ভরে তো মন ভরে না।

শিকদার স্মিতমুখে তাহার বর্ণনা শুনিতেছিল, এমন সময় দ্রুতপদে ঘাট মাস্টারকে আসিতে দেখা গেল : কবি কি চলিয়া গেল? আমি সমূহ কাজ ফেলাইয়া চলিয়া আসছি। এই নাও কবি-তোমার জন্য এইটা আনার ফরমায়েশ দিছিলাম, এখন আমারে দৌড়াইতে হয়। আবার যখন এইদিক আসবা, অনেক অনেক নতুন গান শুনতে চাই।

সুদৃশ্য একটা দোতারা হাতে পাইয়া শিকদার অভিভূত হইয়া পড়িল। লতিফও তাহার গড়ন-গঠন-বাহার লক্ষ করিয়া মন্তব্য করিল : এইটার কারিগর বড়ো গুণীদের যোগানদার। এই রকম যেন আর কক্ষনো দেখি নাই। ধরো বয়াতি ভাই, কিছু বোল উঠাও।

শিকদার কিছুক্ষণ দোতারাটির উপর হাত বুলাইয়া আবারও তাহাকে খোলসে ঢাকিয়া রাখিল। এক সময় লতিফকে জিজ্ঞাসা করিল : তোমরা কি ওনারে কক্ষনো গীত-গান করতে শুনছ?

লতিফ মাথা দোলাইয়া : না তো, সেই কথা কেন?

: আমার মনে কয়, এইটা ওনার নিজের, সখের সম্পত্তি। কেন যে আমার লাহান অভাজনরে দিয়া এমন ঋণী করিয়া ফেলাইলেন তা বুঝিয়া উঠতে পারতে আছি না।

সেই সময় ঘাটের দিকে ক্রমশ ভিড় বাড়িয়া উঠিতেছিল; রৌদ্রও আরও তীব্র হইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িতেছিল চতুর্দিকে। শিকদার সব এড়াইয়া তাহার আপন-ঘরের বারান্দায় গিয়া বসিবার প্রেরণা অনুভব করিল। আরও খেয়াল করিল হোসেনের প্রতিও তাহার একটা কর্তব্য রহিয়াছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল : আমার দেশের দিকে রওয়ানা দিতে হয় ভাই। তুমি আমারে ওই প্যাকেট ভরিয়া গোটাকয়েক সিগারেট দেও। আর মনসব সর্দাররে বলিয়া দিও আমি ধীরে-সুস্থে আউগাইছি। ওই সেইদিকে বাবুগো বসতি, দিঘি-মন্দির, বট-শিমুলের সংখ্যা শুমার নাই, সেই পথ ধরিয়া বড়ো কাটাখালের শুরুতেই আমার দেখা পাইয়া যাইবে। মনে কিছু উদ্বেগ আছে বলিয়াই এমন রওয়ানা হইয়া গেলাম।

: বেশ, বেশ। আবারও যেন শিগগির শিগগির দেখা পাই। কিন্তু লতিফ গোটাকয়েক সিগারেটের মূল্য কিছুতেই গ্রহণ করিতে চাহিল না।

.

১৩.

মাটি হন্তে ভেদ পায় শূন্য চলাচল
ছোটো বড়ো বঙ্গ যত মাটিতে সকল
নানা রঙ্গে কেলি কলা উপজে বিলাস
মৃত্তিকায় ভোগ পুনি মৃত্তিকা গবাস
কে বুঝিবে মাটি মর্ম পরম সংশয়
হাসি খেলি যত ইতি মাটিতে মিশয়
মাটি দেখি মাটি ভুলে মাটি মহামায়া
মাটি শূন্য, স্থিতি মাটি, মাটি যুক্ত কায়া।
মহামায়া মাটি যুক্ত হই যুবা জন
নারীর লাবণ্য রূপে মজিয়াছে মন
তুরুমূলে গ্রাসি যেন ভূমি রহিয়াছে
নারী মায়া পাশে তেন পুরুষ রহিছে।

–দৌলত কাজী

ঘাটের দিক হইতে অভ্যন্তরের পথ অনেক রকম গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা। আশেপাশে বর্ধিষ্ণু বাবু-মহাশয়দের বাড়ি-ঘর। সঙ্গতিপন্ন জমিজমার খেত-খামার। বহু প্রাচীন বটগাছের মূলে-শিকড়ে জড়ানো নানারকম দেব দেবীর মন্দির। এমনকী স্নানের পুকুরের পাড়ের কাছেও নানারকম কারুকার্য করা কাঠের স্তম্ভ। সব ছাড়াইয়া এক সময় একটা নিভৃত স্থানে গিয়া দাঁড়াইল শিকদার, তারপর চতুর্দিক দেখিয়া আস্তে আস্তে কোলের মধ্যেকার দোতারার আচ্ছাদনটি একটু একটু করিয়া সরাইয়া দেখিতে চাহিল। সে নিজেও বুঝিতে পারিতেছিল না কেন তাহার বক্ষস্পন্দন দ্রুত হইয়া উঠিতেছে। কেবলই মনে হইতে লাগিল সেই অবস্থায় কোথাও দেখা কোনো রমণীর সঙ্গে তাহার একটা সাদৃশ্য রহিয়াছে। খোলসটি সম্পূর্ণ খুলিয়া সে আরও ভালোভাবে দেখারও সাহস পাইল না; বারংবার মনে হইতে লাগিল সেই অবস্থায় মনসব সর্দার দেখিয়া ফেলিলে তাহার মুখে আর কিছুই আটকাইবে না।

একটু অস্থিরভাবে শিকদার আবারও পথে নামিল। গাঙের সঙ্গে মেশা একটা বড়ো খালের পাড়ে নজরে পড়িল একদল উলঙ্গ ছেলেমেয়ে, খালের স্রোতকে উপেক্ষা করিয়া ঝাপাঝাপিতে মত্ত। কানে আসিল মুখে কাটা ছড়া :

এই গাঙে কুমির নাই
ঝাপপুড় নাইয়া যাই।
গাঙে আছে লাঙ-এর কূল
উদলা গায়ে বাঁধছে চুল।
চ্যাঙা মাছেরাও উলাস দেয়
তিত পুঁটিরাও কুতকুতি দেয়—

শিকদারকে দাঁড়াইয়া পড়িতে দেখিয়া তাহাদের হুড়াহুড়িটা যেন আরও বাড়িয়া উঠিল।

হায় হায় কোন বৈদেশি দেখিয়া যায়
মাইরের চোটে মারবে মায়—

অত সহজভাবে মুখে মুখে প্রায় তৎক্ষণাৎ তৈরি করা ছড়াগুলি বেশ মন দিয়া শুনিবার ইচ্ছা হইলেও শিকদার সরিয়া গেল। আবারও ঘাট-মাস্টারের কথাগুলি ঘুরিয়া-ফিরিয়া আসিতে লাগিল মনে। কাব্য কী গীতকথা কী কখনও কোনো একক উপলব্ধি অথবা উচ্চারণ? স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই সব কথা ছন্দবদ্ধভাবে উৎসারিত হইয়া পড়ে। কষ্টকৃত গীত-কাব্যে সেইরকম প্রাণ প্রতিষ্ঠা যেন কখনওই সম্ভব হয় না, বাবুদের বাড়ির অনেক মূর্তির মতো তাহারা কেবল রূপ অথবা আচার-সর্বস্ব হইয়া পড়ে। শিকদারের আরও খেয়াল হইল হয়তো বা মুখে মুখে হৃদয়ে হৃদয়ে ঝকৃত হইয়া সমস্ত গীত-কথা গাঙের মতোই বহিয়া চলিয়াছে। গাঙের মতো তাহারও কোনো স্থির রূপ নাই, থাকিতে নাই। তাহারও উপর শৈশব-কৈশোর ত্যাগ করিয়া জীবনের সব সত্যের মুখোমুখি হইতে হইতে সমস্ত কাব্যকণা যেন খরা-রৌদ্রের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। পথের দুই ধারে দৃষ্টি বুলাইয়া দেখে খেত-খামার, খাল বিল, গৃহস্থ বাড়ি ঘর, নিত্যদিনের গাঁও-গ্রাম, দেশ। মাথার উপরের প্রখর সূর্যের রৌদ্র যতই সমস্ত কিছু যেন পুড়াইয়া দিতে চায়, ঝলসাইয়া দিতে চায়, ততই যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি মাটির এই পৃথিবীর অভ্যন্তর হইতে জাগিয়া উঠিয়া যখন-তখন যুদ্ধে লিপ্ত। ধূসর জংলি পাখিগুলির ঝগড়া-বিবাদের মতো তাহাদেরও সেই সর্বক্ষণের দ্বন্দ্বের কোনো মীমাংসা নাই; অস্তিত্ব নয়, যেন দ্বন্দ্বটাই সত্য হইয়া রহিয়াছে।

আবারও পিতামহ করমালীর কথা মনে পড়িয়া গেল। কেবলমাত্র তত্ত্বকথার পশার খুলিয়া বসিতেন বলিয়া লোক তাহাকে এড়াইয়া চলিত। দাদি মুখে আঁচল গুঁজিয়া লুটাইয়া পড়িতে পড়িতে বলিতেন : ওইটুকু শরীরে যাবৎ সংসারের চিন্তার ভারে আর খাড়া হইয়া চলতে পারতে আছে না। খবরদার, তোমারেও যেন কোনো কুক্ষণে সেই ব্যাধিতে পাইয়া না বসে। আমি তো কই, এই জগৎ সংসারে যার যতটুক হায়াত হাসিয়া-খেলিয়া কাটাইয়া দেওনেরই চেষ্টা করণ উচিত। কোনো তত্ত্ব মীমাংসার ভারে পড়লে আর কেউই কোমর সোজা করিয়া খাড়া হওনেরও শক্তি থাকে না।

এমন সময় পিছন দিক হইতে মনসব সর্দারের হাঁক শোনা গেল : এই মর্দ, ওই কবি? আমি কি ইচ্ছা করলেই তোমার লাহান পাখনা মেলিয়া উড়াল দিতে পারি? এত্ত বড়ড়া এস্টাটের নানান কাম-কায্য সামলাই, স্টিমারটাও ছাড়তে দেরি করিয়া ফেলল।-মনসব সর্দার হন হন করিয়া কাছে আসিয়া আরও বলিল : পথে নামিয়া পা-ও উঠিয়া গেল ওই জালিয়াপাড়ার দিকে। মনে কইল, যাই দেখি যদি তেমন কোনো ভালোমন্দ কিছু পাওন যায়। বড়োমিঞার সব সংসারকে তুষ্ট রাখতে পারতে আছি বলিয়াই না এমন বড়ো এস্টাটটা এখনও ঠিকঠাক মতো চলতে আছে। বোঝই তো ওই জালিয়াগো রীতি-নীতি, একে তাগো নিজেগো তৈরি তামাকের টান তায় তাগো পাথরের লাহান মাইয়া-ছেইলাগো বানা নিয়াপানের খিলি। না কবিয়াল, এই সবের মর্ম তোমারে বুঝাইয়া কইতে পারি এমন সাধ্য নাই।

শিকদার সস্মিতমুখে তাহার দিকে লতিফের দোকান হইতে কেনা সিগারেট কয়টি বাড়াইয়া দিল।

মনসব সর্দার একটু অবাক হইয়া গেল, পরে খুশিতেও ভাসিয়া উঠিল তাহার মুখ : তুমি আবার এইসব খরচের মধ্যে কেন গেলা কবি। রাজ্য শুদ্ধ। আমরা এতগুলান মানুষ তোমার জন্য কিছু করতে পারি না বলিয়া এমনিতেই আমাগো মনে আপশোশের শেষ নাই। শোনো কবি, একটা কথা তোমারে আবারও কইতে হইবে। তুমি গোস্বা করো আর যা-ই করো, আমার মনে কয় একটা মাইয়া মানুষের জন্য তোমার এই রকম বিরাগী হইয়া থাকন কোনো কামের কথা না। তুমি কও আমারে কোনখানে কোন মাইয়া মানুষটা তোমার মনে ধরে, আমি আজ রাত্তিতেই তারে মুরগির লাহান, হ, তারে চাপিয়া ধরিয়া তোমার খোপে আনিয়া দিমু। দেখো একবার একটা তরতাজা মাইয়াছেইলার সঙ্গে সংস্রব-সহবাস করিয়া। না, না, কোনো ঠাটা-পড়া রৌদ্র না, কোনো নিশিরাইতের আন্ধারও না, তোমার চতুর্দিক পূর্ণিমার জোচ্ছনার লাহান মৌ মৌ করিয়া ভরিয়া যাইবে। যে পুরুষ মাইয়া মানুষের শরীর চেনে না, তাহার কোনো তত্ত্ব কথনেরও অধিকার হয় না, সংসার না জানলে জগৎ সংসারেরও বুঝিয়া ওঠন যায় না। একটু অবসর পাইয়া শিকদার জানিতে চাহিল : একটা মাইয়া মানুষের জন্যই যে আমি এমন ঘর বিরাগী হইয়া আছি, সেই কথাটাই বা কে কইল?

: কেডা না কয়?-মনসব সর্দার হাত ছড়াইয়া ইঙ্গিত করিল চতুর্দিকে, সারা শরীর দুলাইয়া হাসিয়া বলিল : মাইয়াছেইলারা তক দুঃখ করে। লিখনপড়ন না হয় করি নাই, কিন্তু দিনে দিনে এইটুকু তো বুঝি যে যা রটে তার কিছু বটে। এই যে তুমি সব ছাড়িয়া ছুড়িয়া একেবারে এমন উদাস হইয়া গেলা, এর পশ্চাতে ওই রকম একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। আমারে এত্তো বড়ো এস্টাটের কাম-কায্য চালাইতে হয়, খবরাখবর রাখতে হয় সকলেরই। তার উপর তোমার লাহান গুণী মানুষের কথা তো লোকের মুখে মুখে। তোমার গীত-গান বন্ধ করিয়া কেবল তোমারই অভাব হয় নাই, আমাগোও আরও দশজনেরও অভাব বোধ হয়। কবি, তোমারে লইয়া আমরাও যে গর্ব করার সুখ চাই।

মনসব সর্দার অনর্গল আরও অনেক কিছু বলিয়া গেল। এক সময় দাঁড়াইয়া পড়িয়া সে সুর করিয়া শুনাইয়াও দিল গঞ্জের কোনো বয়াতির কোনো গীতের দুই এক চরণ : আমি যেই দিকে চাই সেইদিকে সব তত্ত্বকথা কইবার চায়। আমি দেখি মাইয়া মানুষেরই মধ্যে সারা দুনিয়া দেখন যায়। শিকদার এক সময় না বলিয়া পারিল না : কবির দলে তো আমিও যোগ দিছিলাম সর্দা। এক জায়গার কথা আর-এক জায়গায় উগরাইয়া দিয়া, কেবল কথার উপর কথা সাজাইয়া ইনাম-আনামের ভাণ্ডারী হইতে আর মন চায় নাই। মানষে চায় রসের কথা, চায় আনন্দ-উৎসব, চায় তত্ত্বকথা, আমি যে কোনোই বিষয় খুঁজিয়া পাই না।

মনসব সর্দার হঠাৎ কোনো উত্তর দিল না; পথ চলিতে চলিতে এক সময় কেবল বলিল : এই জন্যই তো বলি, একটা বাধা পড়ছে সম্মুখে। তারে ভাঙন দরকার। এমন গুণী মানুষ তুমি, ভাঙো ওই বাঁধটা, দেখিও স্রোতের লাহান কলকলাইয়া উঠবে আবার তোমার গীত গান। এই মনসব সর্দার তার জন্য সব অসাধ্য সাধন করতেও রাজি আছে। শোনো কবি, আমার একটা প্রস্তাব। আগামী পূর্ণিমায় বড়োমিঞার বাড়িতে একটা পর্ব আছে, ছোটো পোলার মুখে ভাত। সেই উপলক্ষে বেশ উৎসব আয়োজন হইতে আছে, দেশ-বিদেশের অনেক অতিথি-মেহমান আসবে, জারী-সারির আসরের ব্যবস্থাও হইবে। আমি চাই তুমি সেই আসরে আসো। বড়োমিঞাও নিশ্চয় খুব খুশি হইবে। আরও দশজনের সামনে প্রমাণ হইয়া যাউক, গীত-গানেও আমাগো এই মুল্লুক ঠেলিয়া-ফেলিয়া দেওনের মতো না। তোমারে রাজি হইতেই হইবে, কথা দাও। শিকদার সসঙ্কোচে এড়াইয়া যাইতে চাহিল, নানারকম ওজর-আপত্তি উঠাইল, কারণ দর্শাইল : অনেক দিন আমার কোনো চর্চা নাই, নতুন কোনো কথা নাই, দেশ-বিদেশের মানুষের সামনে কোনো পুরাণ-গীতে আর আগ্রহও নাই।

: বাঁধো নতুন গীত। এখনও তো বেশ কিছুদিন সময় আছে। আমি চাই, আমরা দেশশুদ্ধা মানুষ সকলেই চাই, তুমি আবারও মাথা উঁচা করিয়া আবারও সব জগৎসভায় খাড়া হও।

শিকদার একসময় হাসিয়া ফেলিল : কোন দুঃখে যে এই গীত-গানের পথ ধরছিলাম।

মনসব সর্দার একটু অবাক হইয়া জানিতে চাহিল : কেন, সেই কথা কেন?

: এই যে, এই রকম বাধ্য-বাধকতার মুখোমুখি হইতে হয়।

মনসব সর্দার বেশ কিছুক্ষণ তাহাকে লক্ষ করিয়া মিটিমিটি হাসিল : আমার তো মনে কয় তোমারেও জোর করিয়া ধরিয়া ধরিয়া লইয়া যাওন ছাড়া উপায় নাই। আমিতো কই তাতে তোমারই ভালাই হইবে। আমি আসুম আবারও খবর লইতে, ইতিমধ্যে তুমি তৈয়ার হও। তা না হইলে যেখান থেকিয়া পারি একটা মাইয়া মানুষ তোমার ঘরে উঠাইয়া দিমু। তুমি দশের গৌরব, তোমার এইভাবে শেষ হইয়া যাওন আমরা দেখতে পারি না।

: বুঝছি, আমারে খেদাইয়া দিতে চায়েন!-শিকদার হাসিতে চাহিল।

মনসব সর্দার জিভ কাটিল : ছি, ছি, এত বড়ো এস্টাট চালাইতে গিয়া হাকামের সর্দারি করতে হয় ঠিকই, কিন্তু আমার কথাটার উলটা অর্থ করিও না। তোমারে এই মুলুকে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়া ধরতে চাই। তুমি ভুল বুঝিও না। আবার আসমু এক সময়, তখন কথা হইবে।

মনসব সর্দার তাহার স্বভাবমতো হন হন করিয়া বাড়ির পথ ধরিল, কিন্তু কয়েক পা গিয়া আবার ফিরাইয়া দাঁড়াইল : কবি।

শিকদার দাঁড়াইয়া পড়িল।

মনসব সর্দার দাড়ির উপর হাত বুলাইয়া মিটিমিটি হাসিল : মনে কোনো ডর রাখিও না কবি। তোমার ঘরে জোর করিয়া কোনো মাইয়া-মানুষ তুলিয়া দেওনের ইচ্ছা আমার নাই। তবে একটা ভালো বউ জুটানোর বিষয়টা বাস্তবিকই আর হেলন-ফেলন করণ যায় না।

-হঠাৎ ঠা ঠা হাসিয়া হাত নাচাইয়া মনসব সর্দার চলিয়া গেল।

বাড়ি ফিরিয়া শিকদার বেশ কিছুক্ষণ আপন ভুবনের নানারকম ভাবনার মধ্যে তন্ময় হইয়া রহিল। ঘাট-মাস্টারের দেওয়া সেই দোতারাটি সে সন্তর্পণে একটু একটু করিয়া খুলিয়া দেখিল বটে, সসঙ্কোচে হাত বুলাইয়া তাহার সর্বাঙ্গে কিন্তু তাহার পুরানো দোতারাটি যেন অধিকতরভাবে তাহার মন কাড়িয়া লইতে লাগিল। দুইয়ের মধ্যে কোনো বিশেষ বৈষম্য নাই, একটা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, অনেক বছর অনেক যুগের সঙ্গ-সাহচর্যে তাহার সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছে, মনে হয় হাত দিয়া ছোঁয়ামাত্র সজীব-সরব হইয়া উঠিবে, অন্যটির সঙ্গে তাহাকে এখনও অভ্যস্ত হইতে হইবে। একজন যেন বহুকালের প্রণয়িনী, আর অন্য জন কোনো নতুন যুবতী তরুণী, কবি-কথায় যাহাকে বলে এখনও যেন বিপুল যৌবন-বেদনা সর্বাঙ্গে দমিত রাখিয়া লাজে-শরমে কোনো বিশেষ পুরুষ-পরশের প্রতীক্ষায় রহিয়াছে। বিষয়টা শিকদারের কাছে ভালো লাগিল বটে, কিন্তু কোনো উপযুক্ত পদ পংক্তিমালা সে কিছুতেই সাজাইয়া উঠিতে পারিল না। এক সময় খুঁজিয়া খুঁজিয়া সংগুপ্ত মাচানের উপর হইতে মোড়কে-বাঁধা-পুথি কাগজ, খাগরা কলম, গাছের কষ দিয়া তৈরি কালির বাটি লইয়া সে ওই বিষয়ের উপরেই কয়েকটি পঙক্তি রচনার চেষ্টা করিল।

.

১৪.

সারিন্দা বানাই সব কারিগর
তারে সুরে বাঁধতে জানি না
সুর-সাগরের সিনানের সাধ
সকল ভাগ্যে হয় না।
আমি যন্ত্র ধরি, মন্ত্র যে না পাই
আমার দুঃখ নিশি ঘোচে না।
যতেক গুরু কয় কাব্য কথা
পরান যে তার ভরে না।
কুসুম ছাড়িয়া খোলস যে খায়
তার পরান-ক্ষুধা মেটে না।

কয়েক পদ পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াও শিকদারের মনে হইল, এখনও কেবল বিলাপ-উক্তিটাই তাহার প্রধান বক্তব্য হইয়া উঠিতেছে। কোথায় বাজিতেছে বিলাপের সুর, দুঃখের লোকগাথা, অভিযোগের বৃত্তান্ত, কবি তাহা অবশ্যই লক্ষ করিবে, কিন্তু সেই গীত আরও রংচং ভরাইয়া বর্ণনা করিবার মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট্যের দাবি সে করিতে পারে? এই সব দুঃখ-বিলাপের সমবেত সংকীর্তন, না দুঃখমুক্তির উজ্জীবনা? কোনটা তাহার লক্ষ্য হওয়া উচিত? আসল তত্ত্বের দিক হইতে অতি সহজে সকলকে আদি রসে টানিয়া লওয়া যায়, যেমন সে তাহার সুর-যন্ত্রকেও রমণী হিসাবে কল্পনা করিয়া রচনা করিতে পারে।

.

১৫.

দীঘল দেহী যুবতী নাগরী
প্রতি অঙ্গে পৌরুষ যাচে
তব নয়ন-কণ্ঠ-কটির আহ্বানে
কী আকুল তরঙ্গ নাচে–

কিন্তু সেইসব পদ মনসব সর্দারও হয়তো বুঝিয়া উঠিতে পারিবে না। যন্ত্র থাকুক, স্বয়ং জীবনকেও যে-কোনো যুবতী রমণীর মতো কল্পনা করা যায়, সেই কথা উচ্চারণ করিলেও সকলে মিলিয়া তাহার কোনো রকম মস্তিষ্ক বিকৃতিই সাব্যস্ত করিয়া বসিবে। কোনো কবির কি বাস্তবিকই জগৎসভায় কোনো নতুন বিষয় উপস্থাপন করিবার অধিকার আছে? পুরাতন কথাগুলি নতুন ছাঁচে ঢালিয়া ইনাম-আনাম সাধুবাদের পশরা লইয়া জীবন-সার্থকে ব্যস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আর হাট-বাজারের ব্যাধি-ব্যামো সারাইবার ওঝাদের সঙ্গেও সে কোনো পার্থক্য খুঁজিয়া পায় না। ভাষা ভিন্ন হইতে পারে কায়দা ভিন্ন হইতে পারে এমনকী তাহাদের ব্যক্তি অথবা শ্রেণিও ভিন্ন হইতে পারে, কিন্তু তাহাদের মূল উদ্দেশ্য কী? শিকদার অন্যমনস্কভাবে তাহার পুথিপত্র বাঁধার নকশা করা মোড়কটির উপর হাত বুলাইতে লাগিল, পুরাতন শাড়ির পাড় জুড়িয়া ছুড়িয়া সেই মোড়কটি সেলাই করিয়া দিয়াছিল তাহার পিতামহী, উপরে কারুকার্য করা কাঠের মলাটটিও করমালীর উপহার, কবে কোন মুলুকের পুস্তকাগার না উপাসনাগার হইতে সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল। মধ্যকার সমস্ত ভূর্জপত্র তাহার খুল্লতাতের স্বহস্তে তৈরি, গিরা দিয়া বাধনের রঙিন সূত্রটিও এক ভগিনীর উপহার, সেই খাগের কলম সে স্বয়ং তৈরি করিয়াছে সত্য, কিন্তু তাহার মধ্যেও অজস্ৰজনের স্মৃতি। তাহার বাল্যবন্ধু তালের ডোঙায় চড়াইয়া বিলের সেই অঞ্চলে লইয়া না গেলে কখনও সেই খাগ সংগ্রহও সম্ভব হইয়া উঠিত না। এই কালি, কবে কখন কোন দিনে কে এইভাবে গাছের বাকলা পুড়াইয়া তৈয়ার শিখাইয়াছে। এখন কলম হাতে লইয়া একটি অক্ষর খাড়িতে বসিয়াও শিকদার সেই সব কৃতজ্ঞতা এবং ঋণের প্রতি সজাগ হইয়া উঠিতে লাগিল। আবারও তাহার মনে হইল, গীত গান কথা কোনো এককের কোনো খেয়াল-খুশির খেলা নয়, তাহার মধ্যে কেবলই সমস্ত মানুষের মন মানসিকতার রূপ-উপস্থাপন ঘটিয়া চলিয়াছে। মধ্যে কত পুরাণে কথা, পরান কথা এবং প্রাণের কথার স্মৃতি। ভাষাতেই কত বিচিত্র ব্যাপ্তি! কেউর আশা অর্থ-বিত্ত, কেউর লক্ষ্য যশোমান কিন্তু কাব্য বস্তু যতই পুরাতন ধারা বা রীতি-নীতির অনুসারী হউক, তাহাকে মানুষের দুঃখ মোচনের সঠিক প্রেরণার দিকে আকৃষ্ট করিতে না পারিলে তাহার আর কোনো অর্থ নাই। বড়োমিঞা তাহার গীত-গান শুনিয়া ইনাম-আনাম দিবে, জমি জমা সমস্যারও সুরাহার পথ মিলিবে, কোনো যুবতী রমণীর সোহাগ-যত্নের অবকাশ ঘটিবে, এই সবই কি সে তাহার কিবয়াল জীবনের অভীষ্ট করিয়াছিল? পিতামহ করমালীও কি তাহাকে সেইদিকে পরিচালনা করিতে চলিয়াছিলেন?

জোবেদাও একবার ঠোঁট ফুলাইয়া বলিয়াছিল : কত বয়াতির কথা শুনি, ঘর-বাড়ি উঠাইছে, জমিজমা কিনছে, পানসি চড়িয়া দেশ-বিদেশে যাওয়া আসা করে। এখন নাকি খোদ সদর মুলুকেও পাকা দালান উঠাইতে আছে। রাজা-রাজ্যের সাহায্যে। তোমার যে কেন সেই সব দিকে হুঁশ নাই?

শিকদার সেই সময় গুছাইয়া কোনো উত্তর দিতে পারে নাই। যে রকম তাহার স্বভাব, হয়তো এখনও নিজের মনোভাব সহজ সরলভাবে বুঝাইয়া উঠিতে পারিবে না, না পারিবে হোসেন কিংবা মনসব সর্দারদের মতো কাহারো কাছে কোনো কৈফিয়ত দিতে। এক সময় সে নিজেকেই ব্যঙ্গ করিয়া বলিতে চাহিল : দুনিয়ার এত কাজ থাকতে কেন যে এইসব দিকে এমন ঝুঁকিয়া পড়ছিলাম। অস্ফুটস্বরে নিজেই নিজেকে সেই কথাগুলি বলিতে চাহিল বটে, কিন্তু একই সঙ্গে আবার সোহাগের দোতারাটি কোলে তুলিয়া লইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *