১১.  মোরগের ডাক শুনে

কুউ—কুরু—ত—কু—উ–

মোরগের ডাক শুনে জয়গুন আর বিছানায় পড়ে থাকে না। তাড়াতাড়ি উঠে আগে ফজরের নামাজ পড়ে, তারপর মায়মুনকে ডাকে—গা তোল, মায়মুন। আত-মোখ ধুইয়া জলদি কইর‍্যা চুলা জ্বাল।

—মিয়াভাই আহে নাই, মা?

–উহুঁ।

জয়গুন আর কিছু না বলে কোষায় ওঠে। অনভ্যস্ত হাতে লগি বেয়ে সে রেল-রাস্তার পাশে আসে।

বিলের শেষ প্রান্তে গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য উকি দিচ্ছে।

আবছা আলোয় দুর থেকে জয়গান দেখতে পায় স্টেশনের চালাঘরে হাসু চোলি হয়ে শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে হাত রাখতেই হাসু ধড়ফড়িয়ে ওঠে। মা-কে সামনে পেয়ে তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে।

জয়গুন দেখে, হাসুর সারা মুখে মশার কামড়ের দাগ। চোখ দুটোও লাল। মুখে ভয়ের সুস্পষ্ট ছায়া! সে বলে—ডরে ধরছিল, অ্যাঁ?

হাসু মাথা নেড়ে স্বীকার করে।

—ডরে ধরছিল! কিছু দেখছিলি নি?

—হ। কি দুড়দুইডা আন্ধার গো মা! একটা মাইনষের আলয় নাই। এইহানে ওইহানে। এটটু পরে পরে কিয়ের জানি খচখচানি। বিলের মধ্যে কিয়ের যেন বাত্তি—এই জ্বলে, এই আবার নিবে। আবার কিয়ের বিলাপ হুনলাম। মাইনষের মন কান্দে। ডরে আমি এক্কেরে মাডির লগে মিশ্যা আছিলাম। এই আলোগুলা আলৈয়া, না মা?

—যাউক, অই হগল কওয়ন ভাল না। তোর অহনও ডর করে অ্যাঁ?

হাসু হাঁ-সুচক মাথা নাড়ে।

—না—না, ওগুলা কিচ্ছু না।

পথে আসতে আসতে হাসু কালকের সমস্ত ঘটনা মা-র কাছে বলে। রশীদ—গৃহিণীর দেয়া টাকাটা মা-র হাতে তুলে দেয়।

বাড়ীর ঘাটে কোষ ভিড়ার শব্দ পেয়ে মায়মুন দৌড়ে আসে। শফি, শফির মা-ও আসে।

শফির মা জিজ্ঞেস করে—কোনখানে পাইলি গো?

—ইস্টিশনে হুইয়া আছিল।

—ইস্টিশনে আছিল! একলা! তুই বড় নিডুর গো! মা অইয়া কেমুন কইর‍্যা পেডের বাচ্চারে ফ্যালাইয়া চইলা আইছিলি!

শফি বলে—দ্যাহ মা, মোখটা কেমুন দরমা-দরমা অইয়া গেছে।

—দরমা দরমা অইয়া গেছে!

হাসু বলে—মশার কামড়। সারা রাইত—

বাধা দিয়ে শফির মা বলে—মশার কামড়, না আর কিছু! তোরা দ্যাখ দেহি ভাল কইরা চউখ লাগাইয়া। আমি আবার চউখে দেহি না।

জয়গুন ভালো করে দেখে বলে—মশার কামড়ই।

—নালো, আমার কিন্তুক ভালা ঠেকে না। দিনকাল খারাপ। শেখপাড়ায় এক ঘরও বাদ নাই। মোল্লাপাড়ায়ও দয়া অইছে। আমি এই ডরেই আর খরাত করতে ঠ্যাং বাড়াই না ওই মুখি। হোনলাম ছয়জন পাড়ি দিছে।

হাসু শিউরে ওঠে ভয়ে। সে নিজের কানেও শুনেছে খোদাই শিরনি দেয়ার চিৎকার।

জয়গুন চিন্তিত হয়। বলে রাইতে ডরেও ধরছিল, ভাজ। আমারও চিন্তা লাগে।

—ডরে ধরছিল!

শফির মা চমকে ওঠে। সে আবার বলে—তোরা কি কথা কস! আমার এক্কেরেই ভালা ঠেকে না।

—অহন কি উপায় করি, বইন?

—এক কাম কর। গোসল না করাইয়া ওরে ঘরে নিস না। সোনা-রূপার পানি দিয়া গোসল করাইয়া তারপর ঘরে লইয়া যা।

হাসুর মা হাসুকে বলে—তুই অহন বাইরে থাক। গোসল কইর‍্যা তারপর ঘরে গিয়া ভাত খাবি। এতক্ষণই যহন থাকতে পারলি, এডুকে আর কি অইব? তারপর শফির মা-কে উদ্দেশ করে বলে—তোমার ঘরে রূপা আছে নি ভাজ? সোনা ত নাই জানি।

—নালো, বইন। রূপাও নাই। কবে বেইচ্যা খাইছি। আকালে কি আর কিছু রাইখ্যা গেছে? বেবাক ছারখার কইরা লইয়া গেছে, খালি শফিরে রাইখা গেছে। শফিই আমার সোনা, শফিই আমার রূপা, ও-ই সব। এখন খোদায় মোখ চাইলে অয়।

—খাড়ুজোড়া, হেইও খাইছ? আহা কেমুন সোন্দর জল-তরঙ্গের খাড়ু আছিল তোমার। আমার এতডি বয়স অইল, ওই রহম খাড় আর চউখে দ্যাখলাম না।

—কত আশা আছিল দিলে। শফিরে বিয়া করাইলে ওর বউরে দিমু খাড় জোড়া। কিন্তু উদরের টানে তাও দিলাম বেইচ্যা। সোয়ামীর চিহ্ন একটা ভাতের কাড়িও রইল না আর।

শফির মা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে।

জয়গুন বলে—অখন কোথায় পাই সোনা-রূপার পানি। মোড়ল বাড়ীর বউ-ঝিগ গায়ে রূপার গয়না আছে। কিন্তু সোনার গয়না ধারেকাছে কার ঘরে আছে আমার ত চউখেই পড়ে না।

—ক্যান, যার আছে হের আছেই। আমাগ মতন পোড়াকপাল কি আর বেবাকের! খোরশেদ মোল্লার বাটীতে আছে। কিন্তুক হেই বাড়ীর লাগা পরের বাড়ীতেই গুডির ব্যারাম। হ, এক কাম কর। গদু পরধানের বাড়ীতে গেলেই পাবি। গদু পরধানের বউগ শরীল গয়নায় ঝিল্লিক মারে। তুই আমার কথা হুনলে তোর শরীলও আইজ সোনা-দানায় ভরা থাকত। আইজগা আর বিচরান লাগত না।

জয়গুন বিরক্ত হয় শফির মা-র ওপর। সে বলে—চান্দের মইদ্যে ফান্দের কথা ক্যান আনো? কেরামতের বউর একজোড়া সোনার কানফুল দেখছিলাম।

—ইস! সোনা না আরো কিছু! ক্যামিকল, হুনছি আমি! হেই যে আমার দাদী কইত কথা—দড়ি যদি হাপ অইত আর অজা যদি রাজা অইত! হ, সোনার এক জোড়া মুড়কি আছিল জালালের বউর। হেদিন গিয়া দেহি বউর কান খালি। জিগাইলাম, তোর কান যে খালি বউ? হে কইল-মুড়কি বেইচ্যা কাপড় কিনছি। কাপড় আগে না গয়না আগে? হাচা কথাই ত। কাপড় না থাকলে কি গয়না ধুইয়া পানি খাইব মাইনষে?

জয়গুন বলে—গদু পরধানের বাড়ীত আমি যাইতে পারতাম না। তোমার শফিরে পাড়াইয়া দ্যাও। মায়মুনও যাইব লগে।

শফির মা বলে—যা শফি চিল-সত্বর চইল্যা আবি। কোনখানে দেরী করিস না কিন্তুক।

একটা মেটে ঘটের মধ্যে সোনা ও রূপার গয়না-ধোয়া পানি নিয়ে কয়েক পা এসেই মায়মুন বিস্ময়ের স্বরে বলে—দ্যাখলা শফি ভাই? এমুন মোট্টা মোট্টা রূপার গয়না বেডিগো গায়ে! আবার সোনার গয়নাও আছে!

—তোরে এই বাড়ীতে বিয়া দিমু। এই রহম মোট্টা মোট্টা গয়না পরতে পাবি। কেমুন?

মায়মুন দাঁত বের করে ভেঙচি কাটে, জবাব দেয়—তোমার বউ নিমু এই বাড়ীততন। ঐযে হেঁড়ি কোদালের মতন দাঁত–

মায়মুন হাঁসের ডাক শুনে পাশের দিকে চেয়ে দেখে খাঁচায় বাঁধা দুটো হাঁস তাদের দিকে চেয়ে প্যাঁক-প্যাঁক করে ডাকছে। মায়মুন চিনতে পারে—তাদেরই হাঁস যে! হাঁস দুটোও মায়মুনকে চিনতে পেরে খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

মায়মুন আস্তে শফিকে বলে—শফি ভাই, দ্যাখছো? আমাগো আঁস দুইডা বাইন্দা থুইছে।

শফি চোখ দুটো বড় বড় করে বলে—আঁ, সত্যই নি!

—কাইল রাইতে ওইগুলা বাড়ীত যায় নাই।

–বাড়ীত যায় নাই! তুই পানির ঘটটা লইয়া কোষায় গিয়া ব’। আমি ফাঁক বুইঝ্যা ছাইড়া দিয়া পলাইমু।

শফি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সুযোগের সন্ধানে! গদু প্রধানের শেষ পক্ষের স্ত্রী ওকে দেখতে পেয়ে বলে কি চাসরে ছেঁড়া ঐহানে?

—কিছু না। সোনা-রূপার পানি নিতে আইছিলাম।

সে চোখের আড়াল হতেই শফি এক টানে খাঁচাটা উল্টে দিয়ে পালায়। হাঁস দুটো দৌড়ে গিয়ে পানিতে নামে।

শফি কোষাটাকে জোরে বেয়ে নিয়ে যায়। চকের মাঝে গিয়ে কোষা থামিয়ে মায়মুন ডাকে—চঁই-চঁই-চঁই।

পরিচিত কণ্ঠের ডাক অনুসরণ করে হাঁস দুটোকে ধানখেতের আল দিয়ে আসতে দেখা যায়। মায়মুনের ডাক শুনে গদু প্রধানের বাড়ীতে হাঁস দুটোর খোঁজ পড়েছে। সেই বাড়ীর কুড়ি খানেক ছেলেমেয়ে বাড়ীর নিচে পানির কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। একটি ছোট মেয়ে চেঁচিয়ে বলে-কতগুলা ধান খাইছে আমাগ! আবার ধরতে পারলে গলা কাইটা খাইমু।

শফি লগি উঁচু করে চীৎকার করে–তোগ গলা কাটমু।

মায়মুন বলে—হেই ছেঁড়ি। ঐ যে কোদালের মতন দাঁত। তোমার বউ।

মায়মুনের কথায় কান না দিয়ে শফি বলে—আইজ ব্যাডাগুলা বাড়ীতে নাই, থাকলে আমাগ গলাই কাইট্যা ফেলাইত রে!

কাছে এলে হাঁস দুটোকে কোষায় তুলে নিয়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে মায়মুন।

শফি কোষ বেয়ে বাড়ী যায়।

 

নিছক মশার কামড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না হাসুর মুখে! দুদিন বাদেই রমজানের ব্যবস্থা মত সে কাজে লেগে যায়।

বিরাট জায়গা নিয়ে দালান উঠছে। হাসুর আনন্দ হয়। কারণ, অনেকদিন এখানে কাজ করা যাবে। এখানে কাজ বেশী। ইট ভেঙে সুরকি করা, ইটের বোঝা টানা, পানি তোলা—এইসব কাজ করতে হয়। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত খাটতে হয়। এক মুহূর্তও বসে কাটাবার উপায় নেই। কিন্তু তবুও হাসুর খারাপ লাগে না। স্টেশনে টো-টো করে ঘোরার চেয়ে এ কাজ অনেক ভালো। এখানে ইচ্ছে মতো বোঝা নেওয়া যায়। কেউ ভারী বোঝা মাথায় চাপিয়ে দেয় না। কিন্তু স্টেশনের যাত্রী বাবু-সাহেবরা মাঝে মাঝে এত ভারী বোঝা মাথায় চাপিয়ে দেয় যে ঘাড় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়। স্টেশনে কাজেরও কোন ঠিকানা নেই, পয়সারও কোন ঠিক নেই।

বারো আনা পয়সা প্রায় দিনই হয়ে ওঠে না। কিন্তু এখানে একদিন কাজ করলেই বাধা। এক টাকা। এক পয়সাও কম না। বন্ধুত্বের খাতিরে এক আনা করে সরদারি দিতে হয় না। রমজানকে! স্টেশনের কাজে আরও কত ঝকমারি। বাবুদের সাথে দরাদরি, ভিড় ঠেলে পথ চলা, সাঁতার কেটে স্টীমারে ওঠা, এইসব। এগুলো সহ্য হলেও নম্বরী কুলিদের অত্যাচার একেবারেই অসহ্য।

হাসুদের দলের সব ছেলেই এখানে কাজে যোগ দিয়েছে। হাস শফিকে এনে এখানে কাজে ভর্তি করে দেয়।

শফি একদিন মা-কে বলে—মা, তুমি আর খরাত কইর‍্য না। মাইনষে মন্দ ক০০

ছেলের মুখের কথা লুফে নিয়ে মাথা নেড়ে শফির মা বলে—মাইনষে কয় খরাতনীর পুত? হেইয়াতে কি গায়ে ঠোয়া পড়ে? দশ-দুয়ার মাইগ্যা আইন্যা তোরে এতখানি ডাঙ্গর করছি।

জয়গুন বলে—পোলা তোমার উচিত কতাই কয় গো। ও অহন যাইডের বড় অইছে। রোজগারও করছে। ওর শরম লাগনের কতাই।

—ও রুজি-রোজগার করলে আর আমার ভাবনা কি! আমি খরাত করি কি আমার আমোদে? ঠ্যাঙ্গের জোরও গেছে। শরীলেও তাকত নাই। অহন সারাদিন এক ও’কত খাইয়া আর বইস্যা খোদার শুকুর ভেজতে পারলে বাঁচি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *