১১. মুসলিমসমাজে বিবাহ

১১.  মুসলিমসমাজে বিবাহ

মুসলিমসমাজে বিবাহ সম্পর্কে বাধানিষেধ হিন্দুসমাজের তুলনায় অনেক কম। তবে প্রথম বিবাহ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুঢ়া মেয়ের সঙ্গে হওয়া চাই। পরবর্তী বিবাহ সম্বন্ধে কোন বাধানিষেধ নেই। হিন্দুদের মত মুসলমানসমাজে কোন গোত্রবিভাগ নেই। সেই কারণে বহির্বিবাহের কোন নিয়ম-কানুনও নেই। নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে কোন পুরুষ যে কোন স্ত্রীলোককে বিবাহ করতে পারে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ হয় না তবে বাঞ্ছনীয় বিবাহ হিসাবে খুড়তুতে, জাঠতুতে, মাসতুতে, মামাতে, পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত আছে। এরূপ ভাই বোন থাকলে তাদের মধ্যে বিবাহই অগ্রাধিকার পায়। তা না হলে অন্ত পরিবারে বিবাহ হয়। এরূপ বিবাহের সমর্থনে বলা হয় যে, এতে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা হয় ও সম্পত্তি অবিভক্ত অবস্থায় থাকে। তবে কোন কোন জায়গায় ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহের বিরোধিতাও লক্ষিত হয়।

হিন্দুসমাজের মত মুসলিমসমাজেও বিবাহ সর্বজনীন ব্যাপার। সকলকেই বিবাহ করতে হয় এবং চিরকৌমাৰ্য কখনও উৎসাহিত করা হয় না। মুসলিমসমাজে ১৫ বৎসরের অধিক বয়স্ক যে কোন পুরুষ বিবাহ করতে পারে। অভিভাবকদের সম্মতি নিয়ে ১৫ বৎসরের কম বয়স্ক ছেলেমেয়েদের মধ্যেও বিবাহ চলে। মুসলিমসমাজে বিবাহে বর ও কনে উভয়েরই সম্মতির প্রয়োজন হয় এবং তা বিশেষভাবে স্পষ্টতার সঙ্গে প্রকাশ করতে হয়। দু’জন পুরুষ বা একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোকের সামনে বিবাহের প্রস্তাব ও স্বীকৃতি একই সময় করতে হয়। প্রতারণা বা বলপ্রয়োগ দ্বারা বিবাহ অবৈধ বলে গণ্য হয়। মুসলিমসমাজে কোন স্ত্রীলোক মুসলমান ব্যতীত অপর কাহাকেও বিবাহ করতে পারে না। তবে পুরুষরা মুসলমান ব্যতীত “কিতাবিয়া” ( ক্রীশচীন বা ইহুদী ) নারীকেও বিবাহ করতে পারে। মুসলিমসমাজে বহুপত্নী গ্রহণের কোন বাধা নেই। তবে চারটির বেশী পত্নী গ্রহণ নিয়মবিরুদ্ধ বলে ধরা হয়।

যদি বিদ্যমান সম্পর্ক অবৈধ বলে গণ্য না হয় তা হলে মুসলিমসমাজে স্ত্রী-পুরুষ যেখানে স্থায়ীভাবে স্বামী-স্ত্রীরূপে বাস করে আসছে কিংবা পুরুষ যদি স্বীকার করে যে সে নারী তার স্ত্রী তাহলে সে সম্পর্ককে বিবাহের পর্যায়ে ফেলা হয়। ইসলামধর্মাবলম্বী কোন-কোন শাখার মধ্যে “মোতা” নামে একরকম বিবাহ প্রচলিত আছে। “মোতা” বিবাহ হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাময়িক বিবাহ। অনেক সময় এরূপ বিবাহ মাত্র একদিনের জন্যও স্থায়ী হয়। এরূপ বিবাহে স্ত্রীধনও দেওয়া হয়। কিন্তু এরূপ বিবাহের ফলে উৎপন্ন সন্তানের কোন উত্তরাধিকার থাকে না। তবে পরস্পরের মধ্যে চুক্তি করে এরূপ সন্তানের উত্তরাধিকার দেওয়া চলে। অবশ্য উত্তরাধিকার না থাকলেও সন্তানের বৈধতা সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন বা বিবাদ ওঠে না। বিচ্ছেদের পর এরূপ বিবাহে স্ত্রী কোনরূপ ভরণপোষণ পায় না। সাধারণত নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হলে বা তার পূর্বে উভয়ের মধ্যে কেউ মারা গেলে বা স্বামী যদি মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই সময়ের মকুফ করে তা হলে এরূপ বিবাহের ছেদ ঘটে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও স্ত্রীকে “ইন্দত” উদযাপন করতে হয়। মুসলিমসমাজে “ইন্দত” বলতে বোঝায়

এক বিবাহ বিচ্ছেদের সময় থেকে নুতন অপর বিবাহের মধ্যবর্তীকালীন অপেক্ষা করবার সময় ।

আদালতের সাহায্য ব্যতিরেকে মুসলিমসমাজে সহজে বিবাহ বিচ্ছেদ করা যায়। এ সম্পর্কে প্রথাগত রীতি অনুযায়ী ছ’রকম

পদ্ধতি আছে। প্রথম পদ্ধতি হচ্ছে “তালাক” উচ্চারণ করে দাম্পত্য সম্পর্কের ছেদ ঘটানো। যদি “তালাক” একবার উচ্চারণ করা হয় তাহলে তালাকের পর “ইন্দত” পালন করতে হয়। আর এক রকমের “তালাক” হচ্ছে স্ত্রীলোকের ক্রমান্বয় তিনটি “তুড়”-এর (মাসিক ঋতু) সময় তিনবার পতালাক” উচ্চারণ করা। তবে প্রত্যাহার না করবার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে একই সঙ্গে তিনবার “তালাক” উচ্চারণ করা যেতে পারে। “তালাক” উচ্চারণের সময় কোন সাক্ষী বা স্ত্রীর উপস্থিতির প্রয়োজন হয় না স্ত্রী নেপথ্যে থাকলেও “তালাক” দেওয়া যেতে পারে। বিবাহ-বিচ্ছেদের দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে “ইলা” । “ইলা” হচ্ছে ব্রত গ্রহণ করে চারমাস স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম না করা । তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে “জিহার” । “জিহার” হচ্ছে স্বামী যদি বিবাহের জন্ত সম্পর্কিত কোন আত্মীয়ার নাম উচ্চারণ করে তাহলে স্ত্রী তাকে “তালাক” উচ্চারণ করতে বাধ্য করাতে পারে। স্বামী যদি অস্বীকৃত হয় তাহলে স্ত্রী আদালতে গিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রার্থনা করতে পারে। চতুর্থ পদ্ধতি হচ্ছে “খোলা”। যেখানে স্ত্রী স্বামীকে রাজী করিয়ে এবং তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে দাম্পত্য বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায় সেখানে বিবাহ-বিচ্ছেদকে “খোলা” বলা হয়। পঞ্চম পদ্ধতিকে “মুবারত” বলা হয়। “মুবারত” হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সম্মতিক্রমে বিবাহ-বিচ্ছেদ। “মুবারতে”র সঙ্গে “খোলা”-র প্রভেদ হচ্ছে এই যে, “খোলা” পদ্ধতিতে স্ত্রী-ই বিবাহ-বিচ্ছেদ চায় আর “মুবারত” পদ্ধতিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বিবাহ-বিচ্ছেদ চায়। বিবাহবিচ্ছেদের ষষ্ঠ পদ্ধতি হচ্ছে “তালাক-ই তাফ যুজ”। এ ক্ষেত্রে স্বামী দ্বারা আদিষ্ট হয়ে স্ত্রী-ই “তালাক” উচ্চারণ করে।

আদালতের আশ্রয় নিয়েও মুসলিমসমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদ করা যায়। এ সম্বন্ধে ১৯৩৯ সালে মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইনের ২নং ধারায় যে সকল কারণে আদালতকে বিবাহ-বিচ্ছেদ গ্রাহ করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে

তার মধ্যে আছে :

(১) চার বৎসর যদি স্বামীর কান খোঁজ-খবর না না পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে আদালতের রায় ছ’মাসের জন্য মুলতুবী রাখা হয় এবং ওই সময়ের মধ্যে স্বামী যদি প্রত্যাবর্তন করে তাহলে ওই রায় বাতিল হয়ে যায়।

(২) দু বৎসর যদি স্বামী স্ত্রীর ভরণপোষণে অমনযোগী হয়।

(৩) সাত বা ততোধিক বৎসরের জন্য যদি স্বামীর কারাদণ্ড হয়।

(৪) তিন বৎসর যদি স্বামী তার দাম্পত্যধর্ম না পালন করে।

(৫) স্বামী যদি নপুংশক হয়। এক্ষেত্রে তার প্রজননশক্তি প্রমাণ করবার জন্য স্বামীকে এক বৎসরের জন্য সময় দেওয়া হয়।

(৬) দু বৎসর ব্যাপী স্বামী যদি উন্মাদ রোগাক্রান্ত হয়।

(৭) স্বামী যদি কুষ্ঠ বা কোন কুৎসিত যৌনব্যাধিগ্রস্ত হয়।

(৮) ১৫ বৎসর বয়স উর্ত্তীর্ণ হবার আগেই যদি পিতামাতা বা অভিভাবকের সম্মতি অনুসারে তার বিবাহ হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রী ১৮ বৎসর উর্ত্তীর্ণ হবার পর স্বামীকে পরিহার করতে পারে।

(৯) স্বামী যদি স্ত্রীকে দৈনিক বা মানসিক কোনরূপ পীড়া দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *