ভুলু নামের ওই বিদঘুটে ছেলেটি অনিমেষকে বারান্দা পার করে এই ঘরে বসিয়ে রেখে সেই যে উধাও হল আর দেখা নেই। আসার সময় সে লক্ষ্য করেছিল দু পাশের দরজা-জানলা বন্ধ । একটা বুড়ী ঝি ছাড়া কোন মানুষ এ বাড়িতে আছে বলে মনে হচ্ছিল না। আবরুটা এ বাড়িতে একটু বেশী কড়া, কিন্তু কেমন যেন গা-গিরসিরে। পরমহংসের আত্মীয় এরা কিন্তু তাকেও ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় কিনা সন্দেহ আছে। এই ঘরের জিনিসপত্র প্রচুর। সবগুলোই ক্লাইভের আমলে কেনা হয়েছিল বোধ হয়েছে এবং এ ঘরের সব কটা দরজা-জানলা খোলা। কিছুক্ষণ পরে অনিমেষের মনে হল তাকে কেউ বা কারা লক্ষ্য করছে। দরজা বা জানলার বাইরে থেকে চুরি করে এভাবে দেখাটা বোঝা যাচ্ছে চুড়ির শব্দে। খুব অস্বস্তিকর ব্যাপার কিন্তু কিছু করার নেই। চট কর উঠে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে দর্শকদের দেখা যাবে, কিন্তু তাতে লাভ কি!
বসে থাকাটা যখন আর সম্ভব হচ্ছে না তখন বাইরে নারীকণ্ঠ শোনা গেল, যা না, ভেতরে যা, মাস্টারের কাছে পড়তে হবে যখন তখন লজ্জা করে লাভ কি। মাস্টার হল বাবার মতন। বাইরে বোধ হয় ঠেলাঠেলি চলছে। ছাত্রীটি ঘরে ঢুকতে চাইছে না। নিজেকে কেমন চোর চোর মনে হল অনিমেষের। সুযোগ থাকলে তক্ষুণি রাস্তায় নেমে যেত সে।
ভুলুর পেছন পেছন খড়মের আওয়াজ তুলে শিয়ালতালুই ঘরে ঢুকলেন। ঢুকে গ্রাম ভারী গলায় বললেন, এদিকে আয়।
ডাকের সঙ্গে সঙ্গে সুড়সুড় করে যে চলে এল তাকে দেখে অনিমেষ সোজা হয়ে বসল।
শিয়ালতালুই বললেন, মন দিয়ে পড়াশুনা করবি। এই শেষবার, এবার যেন ফেল না হয় । মাস্টার, ফাঁকি দেবার চেষ্টা করো না। পড়াতে যে জানে সে গাধা পিটিয়েও ঘোড়া করতে পারে।
অনিমেষ তক্তপোশ থেকে দাঁড়াল, আমি কিন্তু সন্ধ্যে নাগাদ আসব। ছটা। ছটা থেকে সাড়ে আটটা। আড়াই ঘন্টা পড়ালেই যথেষ্ট।
রোজ?
রোজ না পড়ালে তুমি ছাত্রীকে পাস করাতে পারব হে? তা হলে মাস্টার রাখতে যাব কেন? আচ্ছা নাও, পড়াশুনা কর। শিয়ালতালুই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এবার আবার ছাত্রীর দিকে তাকাল অনিমেষ। শরীরের কোথাও খাঁজ আছে বলে মনে হচ্ছে না, কারণ শাড়িটা ওকে আল খাল্লার মত জড়িয়ে রেখেছে। চট করে পিপের কথা মনে আসে। গায়ের রঙ অসম্ভব ফর্সা, মুখে একটা মিষ্টি ছাপ আছে।
চিবুক এখন প্রায় বুকের ওপর নামানো। আঁচলের আড়ালে রাখা হাতের আদলেই বিব্ৰত হল সে, এত মোটা মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না। অনিমেষ কিছু বলার আগেই ভুলু বলল, মা তোকে প্রণাম করতে বলেছে না! প্রণাম কর!
কথাটা শেষে হতেই দম-দেওয়া পুতুলের মত শরীরটা অনিমেষের দিকে এগিয়ে আসতে অনিমেষ আঁতকে উঠল, না, না, প্রাণাম করতে হবে না।
ভুলু বলল, ছি, ছি, মাস্টার মশাই, মা বলেছে আপনি বাবার মতন, প্রণাম না নিলে খুকুর পাপ হবে। প্রণাম কর খুকু।
অতএব প্রণাম নিতে হল ।
মেয়েটির বোধ হয়, ঝুঁকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। অনিমেষ বলল, বসো।
টেবিল চেয়ার নয়, এই তক্তাপোশের ওপর বসেই পড়াতে হবে। কিন্তু বইপত্র কিছু সঙ্গে আনেনি মেয়েটা। অনিমেষ ঠিক করল প্রথম দিন ওর কোর্স জেনে নেবে। অনেকটা দূরত্ব রেখে খুকু বসল। বসার সময় তক্তপোশের মচমচে শব্দটা কান এড়ালো না অনিমেষের। এই ছাত্রীকে পড়াতে হবে ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা হিমভাব আসছে। অনিমেষ নিজের জায়গায় বসে দেখল ভুলু ঘরের এক কোণে একটা চেয়ারে বাবু হয়ে বসে এদিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার দিকে নজর পড়ার পর অন্যরকম অস্বস্তি হতে আরম্ভ করল। ওকে কি পাহারা দেবার জন্যে বসিয়ে রেখেছে? ছেলেটার অস্তিত্ব উপেক্ষা করল অনিমেষ। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, ক্লাস সেভেনে পড়?
তুমি বলতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। এত বড় মেয়েকে প্রথমেই তুমি বলা অন্য সময় হয়তো অসম্ভব হতো, এখন পারল। সে নিজের মুখ-চোখে খুব ভারিক্কী ভাব রাখার চেস্টা করতেই মনে পড়ল তাকে এই বিশাল মেয়েটির বাবার মতন বলা হয়েছে। শরীর দেখলে বয়স ঠাওর হয় না। বলা যায় না, তার সমান বয়সীও হতে পারে। প্রশ্নটার জবাব তখনো আসেনি। অনিমেষ বিরক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হল?
সঙ্গে সঙ্গে ভুলুর গলা ভেসে এল, বাবা তো বলেছেই কোন কেলাসে পড়ে, আবার নেক্কড়ি করে জিজ্ঞাসা করার কি আছে?
সে আমি বুঝব, তুমি চুপ করো। চাপা গলায় ধমকে উঠল অনিমেষ।
সঙ্গে সঙ্গে ভুলুর কপালে তি–চারটে ভাঁজ পড়ে গেল, আর অনিমেষ দেখল মেয়েটা খুব দ্রুত সামন–পেছনে ঘাড় নাড়ছে। অবাক হতে গিয়ে সামলে নিল, ঘাড় নাড়ার অর্থ সেভেনেই পরে।
কি কি পড়ানো হয়?
এবার কোন উত্তর নেই। হঠাৎ অনিমেষের সন্দেহ হল মেয়েটি কি কথা বলতে পারে না। বোবা মেয়েরাও তো পড়াশুনা করে। নিঃসন্দেহ হবার জন্য জিজ্ঞাসা করল, সে তুমি কি কথা বলতে পার না?
সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা নড়বড় করে জানাল, হ্যাঁ।
তা হলে আমি যেটা জিজ্ঞাসা করেছি তার জবাব দাও।
ঠোঁট দুটো খানিক কাঁপল, তারপর খুব নীচু স্বরে সরু গলায় উত্তর এল, ইংরিজী, বাংলা ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ড্রইং—
হেসে ফেলল অনিমেষ, না, না, আমি সে কথা জিজ্ঞাসা করছি না, তোমাদের কি কি বই পড়ানো হয়? তুমি তো সঙ্গে কোন বই আনোনি।
সঙ্গে সঙ্গে ভুলু উঠে দাঁড়াল, আমি নিয়ে আসছি বই। তারপর দরজা অবধি এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। এক সেকেন্ড কি ভেবে বোনের দিকে ঘুরে বলল, আমি তো যেতে পারব না। আমাকে এখানে থাকতে বলেছে।
অনিমেষের মাথায় রক্ত উঠে গেল। এরকম নোংরা মানসিকতার মধ্যে কোন ভদ্রলোক পড়াতে পারে না। এর মেধ্যে খুকু উঠে দাঁড়িয়ে সেইরকম গলায় বলল, আমি বই নিয়ে আসছি, আপনি বসুন।
ছাত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনিমেষ ভুলুর দিকে তাকাল। সেই একরকম ভঙ্গীতে তাকে জুলজুল করে দেখছে। কপালে ভাঁজগুলো এখনও মেলায়নি। অনিমেষ ডাকল, এই, এদিকে এসো!
ভুলু খেকুড়ে গলায় বলল, কেন?
আমি ডাকছি তাই আসবে।
ইস, ডাকলেই হল! কাছে গেলে ধোলাই লাগবে, জানি না! মাস্টাররা খুব মারকুটে হয়, জানি বাবা। ঘন ঘন ঘাড় নাড়তে লাগল সে।
আমি তোমাকে খামকা মারতে যাব কেন, কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করব বলে তোমাকে কাছে ডাকছি। অনিমেষ গলার স্বর নরম করর চেষ্টা করল।
ভুলুকে একটু ভাবতে দেখা গেল। অন্যমনস্ক হলেই লালা গাড়িয়ে আসে, সেটাকে টেনে নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি কতা?
তোমাকে এখানে কে থাকতে বলেছে?
বাবা।
তোমার বাবা বলেছেন! কেন?
আপনি বাইরের লোক, খুকী সোমও মেয়েছেলে তাই।
কোনরকমে ঢোক গিলল অনিমেষ, আগের মাস্টারের সময়ও তুমি থাকতে? মানে এইরকম পাহারা দিতে?
ঘাড় নাড়ল ভুলু, হু। তখন মা বলতো থাকতে। মা বলতো বুড়োরা নাকি খুব খচ্চর হয়।
কথাটা শুনে জমে গেল অনিমেষ। এরকম পরিবারের কথা তার কল্পনায় ছিল না। আগের মাস্টারের বয়স আশির ওপর ছিল তা গৃহকর্তা জানিয়েছেন। তবু পাহারা চলত। সে গম্ভীর গলায় বলল, কিন্তু আমি যখন পড়াবো তখন তোমার থাকা চলবে না।
ইস! সেই ফাঁকে যদি ফষ্টি-নষ্টি চালান! আমাদের বাড়িতে চাকর পর্যন্ত রাখা হয় না এ জন্যে। কথাটা শেষ করার আগেই ছাত্রী বইপত্র দুহাতে জড়িয়ে ঘরে ঢুকল।
ততক্ষণে অনিমেষের পড়ানো মাথায় উঠেছে। তাকে খাট থেকে নামতে দেখে ভুলু প্রস্তাব দিল, আমাকে যদি এক টাকা করে মাসে দেন তবে
তুমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। হাত তুলে ওকে দরজা দেখাল অনিমেষ।
ওর গলার স্বরে এমন একটা কাঁপুনি ছিল যে ভুলু থতমত হয়ে এক লাফে দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর নিরাপদ দূরত্বে থেকে বলে উঠল, ইস্! খুব নেক্কড়বাজ!
কথাটার মানে বোধগম্য হল না। এই সময় ছাত্রীটি বলে উঠল, বই এনিচি, দেখুন।
অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, খুকী, আজকে আমার পড়াবার মন নেই। যদি আবার আসি তখন তোমাকে পড়াবো। আজ আমি যাচ্ছি। তারপর হন হন করে বাইরে বেরিয়ে এল। কোনদিকে না তাকিয়ে সে সোজা বাইরের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।
পরমহংস নেই কিন্তু শিয়ালতালুই খালি গায়ে বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হতে নাক কুঁচকে বলে উঠলেন, এ কি, পড়ানো হয়ে গেল! মাস্টাররা যদি ফাঁকি দেয় তবে ছাত্রেরা কি শিখবে! না না, দুঘন্টার কম পড়ানো আমি পছন্দ করি না।
অনিমেষ হেসে ফেলল, দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি এখানে পড়াব না ঠিক করেছি। আর একটা অনুরোধ করছি, পড়ানোর চেষ্টা না করে এবার ওর বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। নমস্কার। কোনরকমে প্যাসেজে নেমে পায়ে জুতো গলিয়ে দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে এল অনিমেষ।
ধারেকাছেও পরমহংস নেই। এভাবে একদম না বলে কয়ে চলে যাবে আশা করা যায় না। অবশ্য যদি থাকার হলে ও-বাড়িতেই সে থাকত। কিন্তু পুরো ব্যাপারটার জন্যে অনিমেষ পরমহংসের ওপর রাগ করতে পারছে না। বাড়াবাড়িটা যে এতটা দূর হবে সেটা হয়তো সে আন্দাজ করতে পারেনি। তাই কলকাতা শহরে এরকম পরিবার এখানে থাকতে পারে বিশ্বাস করা শক্ত। এরাও বাংলা দেশের মানুষ, যে দেশের স্টুডেন্টস ইউনিয়নগুলো ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। এই যে এত মিছিল হয়, আন্দালনে আগুন জ্বলে, তার সামান্য আঁচ এ-বাড়িতে লাগেনি। ঠিক জানা নেই, তবে নিশ্চয়ই এরকম বাড়ির সংখ্যা কম নয়।
কয়েক পা হাঁটার পর অনিমেষের নিজেকে খুব হালকা মনে হলে। যেন একটা ভারী পাথর তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, হঠাৎ সরে গেছে। এতক্ষণ যে ধৈর্য ধরে ওখানে পড়েছিল সেটাই আশ্চর্যের। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার সময় ব্যাপারটা ঠাওর করে চলে আসতে পারতো। তা হলে কি টাকার লোভ, না ছাত্রীটিকে দেখবার আগ্রহ? ছাত্রীটি যে নীরেট হবে এটা অনুমান করা গিয়েছিল, কিন্তু ধৈর্য না রাখলে এরকম বাড়ির পূর্ণ চিত্র তো পাওয়া যেত না। টাকাটা পেলে অবশ্যই উপকার হতো, কিন্তু আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে নিশ্চয়ই নয়। অনিমেষ হেসে ফেলল, প্রথম রোজগার করতে গিয়েই তাকে এমনভাবে হোঁচট খেতে হল, যাচ্ছলে!
বি. কে. পাল এভিন্যুতে আসতেই চিৎকার করে কেউ তাকে ডাকছে শুনতে পেল অনিমেষ। পরমহংসের গলা, একটা চায়ের দোকান থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসছে। কাছে এসে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, হয়ে গেল?
কি? অনিমেষ ভ্রূ কোঁচকালো।
দুটোই।
পরমহংসের মুখের দিকে তাকিয়ে রাগতে পারল না অনিমেষ । ছেলেটার মুখে এমন মজা–করা ভাব আছে যে রাগাও যায় না । ও বলল, হ্যাঁ বেশ পড়িয়ে-টড়িয়ে এলাম। ছাত্রীটি খুব ভাল।
ভাল মানে? পরমহংসের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
ভাল মানে ভাল। ইনটেলিজেন্ট। তুমি তো জল বাদ দিয়ে দুধটুকু খাও আর সহজ কথাটা বুঝতে পারো না! কপট বিরক্তি দেখাল অনিমেষ।
সঙ্গে সঙ্গে হতাশ ভঙ্গী করল পরমহংস, দুর শালা! যা ভেবেছিলাম তাই বলে কেটেছে, না ভক্কি দিয়ে?
আমি কেটেছি কে তোমাকে বলল?
কেন ছলনা করছ, গুরু! তালুইমশাই আমাকে ভাগিয়ে দেবার পর থেকে ওয়াচ করছি চায়ের দোকানে বসে। দেরি দেখে ভাবছিলাম ক্যালেণ্ডার হয়ে ঝুলে গেলে বোধ হয়। কিন্তু ওই গোবরে মেয়েটাকে যখন ইনটেলিজেন্ট বলছ তখন তুমি নির্ঘাত কেটে পড়েছ। পরমহংস নিশ্চিত গলায় জানাল।
হেসে ফেলল অনিমেষ, হ্যাঁ, ও মেয়েকে আমি পড়াতে পারব না, অসম্ভব। আর তুমি দেখে-শুনে ও বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভাল করনি। ফালতু সময় নষ্ট হল।
কোন কিছু ফালতু নয় বন্ধু । যাকে উপেক্ষা করছ সেই একদিন তোমার উপকারে আসতে পারে । কাদের জন্যে দেশ উদ্ধার করবে তা চোখ চেয়ে দেখবে না? তালুইকে কি বললে?
বললাম, আমি পড়াব না, পারলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে।
যাচ্ছলে! হয়ে গেল, ও বাড়ির দরজা আমার জন্যে ফর এভার বন্ধ হয়ে গেল। পড়াবে না সেটা বললেই হত, মেয়েটা সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়ার কি দরকার ছিল! চলো।
আবার কোথায় যাবো?
আমার সঙ্গে এসো না! অলটারনেটিভ ব্যবস্থা রাখাই আছে–এটা ফেল করলে, আর একটা ফিট করে রেখেছি। বাড়ির দালালরা যেমন একসঙ্গে দু-তিনটে বাড়ি দেখায়। এটা হরি ঘোষ স্টপে, বেশী দুরে নয়।
অবাক হয়ে পরমহংসকে বলল অনিমেষ, সে কি! তোমার সন্ধানে কটা টিউশনি আছে? এজেন্সি নিয়েছ নাকি। তবে ওরকম বাড়ি হলে আমার গিয়ে দরকার নেই আগে থেকে বলে দিচ্ছি।
যাচ্চলে! অত গেরান্টি আমি দিতে পারব না। তা ছাড়া তোমাকে তো কেউ দিব্যি দেয়নি যে পড়াতে হবেই। ভাল লাগলে পড়াবে, নইলে নয়। আরে, এক-একটা ছেলে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পড়তে কত টাকা টিউশনি করে রোজগার করে ভাবতে পারবে না। আমাদের পাড়ার সুবলদা টিউশনি করতে করতে এম-এ পাস করল। তারপর চাকরি-বাকরি না পেয়ে টিউশনিটা বাড়িয়ে দিল। রোজ সকাল সাড়ে ছটা থেকে আটটা বাগবাজারে, সওয়া আটটা থেকে পৌনে দশটা শ্যামবাজারের, দুপুরে দুজায়গায় মেয়ে পড়ায়, মর্নিং স্কুল হওয়ার সেইটে সুবিধে, রাত্রে আবার দুটো। সপ্তাহ তিন দিন করে হলে সিক্স ইন্টু টু মাসে বারোটা টিউশনি, এক শো পঁচিশ করে ইচ, হাই ক্লাসের স্টুডেন্ট সব। নেট দেড় হাজার টাকা মান্থলি ইনকাম। চাকরি করলেও পেত না, বল?
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, তা ঠিক। তবে লোকটার নিশ্চয়ই পার্সোনাল লাইফ বলে কিছু নেই, কোন কিছু সিরিয়াসলি চিন্তা করতে পারে না। যত টাকাই পাওয়া যাক এরকম চেন-বাধা হয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। অনিমেষ মরে গেলেও তা পারবে না। কিন্তু একটা এক্সট্রা ইনকাম তার যে খুব প্রয়োজন–সে কথা ঠিক। বাবা স্বৰ্গছেঁড়া থেকে যে টাকা পাঠাচ্ছেন এতগুলো বছরে তার অঙ্কটা বাড়েনি। বাড়ানো যে বাবার পক্ষে সম্ভবও নয় তা সে জানে। মাঝে মাঝে মনে হয় পারলে সে বাবাকে নিষ্কৃতি দিত–এই টাকা পাঠানোর কর্তব্য থেকে, ইউরোপ-আমেরিকায় ছেলেমেয়েরা তো রেস্টুরেন্ট হোটেলে চাকরের কাজ করে নিজেদের পড়াশুনার খরচ চালায়–সেরকম যদি একটা কিছু করা যেত।
সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যু দিয়ে খানিকটা যাওয়ার পর পরমহংস বলল, আমাদের ডান দিকে কি বল তো? বিরাট রাস্তার ডান দিকে তাকিয়ে অনিমেষ পুরোনো ধাঁচের কিছু ঘরবাড়ি দোকানপাট ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না।
পরমহংস ওর মুখের ভাব লক্ষ্য করে মজা পেল, জানো না? যা, তুমি নেহাতই নাবালক। এই এলাকাটা ভুবনবিখ্যাত। কোথায় যেন পড়ছিলাম প্যারিসের বারবণিতারা, বঙ্গ সন্তানটি এই জায়গা ঘুরে গেছে জানলে, একদম ঠকাবার চেষ্টা করে না। ওরা আদর করে একে ডাকে গোলডি বলে।
গোলডি!
সোনাগাছি। কলকাতায় আছ আর সোনাগাছি কোথায় জান না? এই জনচেতনা নিয়ে তুমি রাজনীতি করবে, ইস্!
আচমকা অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আজকাল প্রায়ই তুমি ওর রাজনীতি করার প্রসঙ্গ তুলছে কেন বল তো? এটা তো আমার ব্যাপার, তাই না?
পরমহংস অনিমেষকে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল । চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষের মনে হল কথাটা এভাবে না বললেও চলত, যা এতদিন দেখেছে তাতে ছেলেটাকে হাসিখুশী জমাটি বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির ব্যাপার নিয়ে এই–রকম শ্লেষ ভাল লাগে না, বিশেষ করে সে যখন সক্রিয় রাজনীতি করছেই না।
একটা পার্কের পাশ দিয়ে চলে আসার সময় বড় বড় বাড়ির দরজায় সাজুন্তি মেয়েদের দেখা গেল। সেই কলকাতায় প্রথম আসার পর বউবাজার, কিংবা জলপাইগুড়ির বেগুনটুলির গলিতে সে এদের দেখেছে, তাই চিনতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু তার পরেই পাড়াটা স্বাভাবিক, ভদ্রলোকের মনে হল। এরকম সহ-অবস্থান বোধ হয় কলকাতাতেই সম্ভব।
হরি ঘোষ স্ট্রীটের মাঝামাঝি বাড়িটা। এখন রাত হয়েছে, অন্তত সাড়ে সাতটা তো হবেই। পরমহংস বলল, সবে সন্ধ্যো।
যিনি দরজা খুলে দিলেন তাকে সুন্দরী বললে কম বলা হবে। অহঙ্কার গাম্ভীর্যের সঙ্গে মিশে, চোখের চাহনি শরীরের গঠনের সঙ্গে মিলে এমন একটা ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছে যে চোখ চেয়ে থাকাও যায় না, আবার চোখ সরিয়েও নিতে ইচ্ছে করে না। পরমহংসকে দেখে মহিলা বললেন, আরে, পথ ভুলে নাকি? কি সৌভাগ্য। এসো, এসো।
পরমহংস বলল, সঙ্গে আমার বন্ধু আছে, অনিমেষ মিত্র, হোস্টেলে থাকে, জলপাইগুড়ির ছেলে।
মহিলার দুটো ভ্রূ ডানা মেলার মত ওপরে উঠল, জলপাইগুড়ি! ও মা, তাই নাকি! বসো, বসো। ছিমছাম সাজানো বাইরের ঘর। কোন বাড়তি আসবাব নেই। ওরা সোফায় বসার পর মহিলা সামনেই একটা গদি-মোড়া টুল টাইপের আসনে বলেন, জলপাইগুড়ির কোথায় থাকা হয়?
হাকিমপাড়া। অনিমেষ বলল। সত্যি, মহিলার ছারপাশে এমন একটা মিষ্টি আকর্ষণের মায়া জড়ানো যে ভাল না লেগে যায় না। বয়স হয়েছে, অবশ্যই চল্লিশের চৌহদ্দিতে, কিন্তু কোথাও সেটা তাকে আক্রমণ করতে পারনি। বিজ্ঞাপন ছাড়া এমনটি দেখা যায় না!
ও মা, হাকিমপাড়ায় যে আমার বাপের বাড়ি ছিল! কি মজা! হ্যাঁ, ওই যে ঝোলনা পুল, ওটার ঠিক ডান দিকে। বর্ষার সময় করলার জল একদম বাড়ির মধ্যে ঢুকে যেত। সেসব দিনের কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। কি আনন্দে ছিলাম তখন। আপনাদের বাড়িটা কোনখানে?
অনিমেষ বলল, আমাকে তুমি বলবেন, আমি ওর সহপাঠী।
বেশ, বেশ। অতটুকু ছেলেকে আপনি বলতে ইচ্ছে করে না, আবার না বললে–।
অনিমেষ হেসে ফেলল, আমরা তো মফস্বলের ছেলে, আমাদের অত ভ্যানিটি নেই। ও হ্যাঁ, আমাদের বাড়িটা হল টান ক্লাব ছাড়িয়ে তিস্তা নদীর ধারে।
কোন বাড়িটা? বিরাম করদের বাড়ির কাছে?
না। কিন্তু বিরাম করকে আপনি চেনেন?
খুউব চিনি। ওঁরা তো এখন রিচি রোডে আছেন। দু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, বড়জন আমেরিকায়, মেজটা বম্বেতে। ছোটটারকি একটা অসুখ হয়ে শরীর এত রোগা হয়ে গেয়ে যে ওকে নিয়ে বিরামবাবুদের চিন্তা। তুমি ওদের চেন নাকি? ভদ্রমহিলার চোখ সব সময় কথা বলে।
চিনতাম। কলকাতায় আসার পর আর দেখা হয়নি।
ওই তো, থার্টি ফোর বি রিচি রোডে ওরা থাকে, চলে যেও এক দিন।
দেখি।
আরে তখন থেকে কথা বলে যাচ্ছি, কি খাবে বল?
পরমহংস এতক্ষণ কথা শুনছিল, এবার বলল, দেশের লোক পেয়ে এমন মগ্ন হয়ে পড়লেন যে আমার কথা খেয়ালই নেই। খাব, কিন্তু আমার একটা প্রয়োজনে এসেছি।
সে তো জানি, দরকার ছাড়া আমার কাছে কেউ আসে না। আগে চা খাও, তারপর শুনব। বসো তোমরা। ভদ্রমহিলার হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গীটায় অদ্ভূত মাদকতা আছে।
অনিমেষ পরমহংসকে নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কে ইনি?
তোমার দেশওয়ালীভাই। নর্থ বেঙ্গলের লোকদের দেখেছি পরস্পরের প্রতি খুব টান থাকে, সেটা মনে পড়তেই নিয়ে এলাম।
কিন্তু এখানে কাকে পড়াতে হবে?
ওঁর ছেলে । উনি ইণ্ডিয়ান টোবাকোতে বড় চাকরি করেন।
ওঁর স্বামী?
ছিল, এখন ডিভোর্সি।
সে কি!
যাঃ, আঁতকে উঠলে! এই মন নিয়ে তুমি পলিটিক্স–সরি, মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে। এরাও, আমার আত্মীয়, মানে এঁর হাজব্যান্ড।
বাব্বা, তোমার তো ভ্যারাইটিস আত্মীয়স্বজন আছে!
অনেকেই অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। একমাত্র আমিই সেতু হয়ে আছি। তবে এ বাড়িতে অনেক দিন পরে এলাম।
দেওয়ালে কয়েকটা কিউরিও, একটা বাচ্চা ছেলের দারুণ উজ্জ্বল ছবি চোখ টানে। হঠাৎ অনিমেষের খেয়াল হল এই মহিলা বিরাম করের কথা বলছিলেন। জলপাইগুড়ির একালের কংগ্রেসী রাজনীতির নেতা বিরামবাবু নিশ্চয়ই আর সক্রিয় নন, থাকলে নাম শোনা যেতে। ওঁরা কলকাতায় আছেন কিন্তু কোন দিন দেখা করার বাসনা হয়নি। মুভিং ক্যাসেল কি এই মহিলার বন্ধবী? অবশ্য তার বয়স নিশ্চয়ই বেশী। মেনকাদি এবং উর্বশীর বিয়ে হয়ে গেছে, সময় কিভাবে চলে যায়! অনিমেষ আবিষ্কার করল উর্বশী নয়, এত দিন পরে রম্ভার জন্যে মনে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। তার জীবনে রম্ভাই প্রথম যে নারী হবার আগেই ওকে চুমু খেয়েছিল। কি বিরক্তি এবং ক্রোথ সে সময় তাকে মেয়েটাকে ঘেন্না করতে সাহায্য করেছিল! এখন এই মুহূর্তে হাসি পায়। ভদ্রমহিলা যা বললেন তা যদি সত্যি হয় তা হলে রঙ্কাই এখন অসুস্থ! সেই স্বাস্থ্যবতী মেয়েটা। সেই দুপুরে শরীরে জ্বর নিয়ে শুয়ে–থাকা মেয়েটার সব অহঙ্কার সে মার করে দিয়েছিল নিলি হয়ে–এখন কেমন যেন মায়া লাগছে সে কথা ভেবে। অনিমেষের খেয়াল হল এই মহিলার নিশ্চয়ই ও বাড়িতে যাতায়াত আছে এবং রম্ভা যখন শুনবে যে অনিমেষ টিউশনি উমেদারি করতে এখানে এসেছে তখন নিশ্চয়ই ঠোঁট বেঁকাবে। মেয়েরা অনিমেষ ঘুরে বসল, এই, তুমি এখানে টিউশনির কথা বলো না।
অবাকহল পরমহংস, কেন?
না, আমি ঠিক করলাম, জলপাইগুড়ির লোকের বাড়িতে টিউশনি করব না। এটা ঠিক হবে না।
যত সব ফালতু সেন্টিমেন্ট। ভাল মাল দেবে বুঝলে!
দিক। তবু না, প্লিজ। এসব কথা পেড়ো না।
কিন্তু আমি যে বললাম প্রয়োজনে এসেছি।
কথাটা ঘুরিয়ে নিও, সে তুমি পারবে।
তোমার টাকার দরকার নেই?
আছে।
তা হলে?
আমার কতগুলো জমানো স্মৃতি আছে, সেগুলোকে বিক্ষত করে টাকা চাই না। এ তুমি ঠিক বুঝবে না।
Md mahmud
বাকি অংশ দেয়া হবে কি?
Bangla Library
হ্যাঁ, তবে দুঃখিত একটু সময় লাগবে।