১১. বেলগাছের নীচে ছোট্ট শিবমন্দির

বড়সড় বেলগাছের নীচে ছোট্ট শিবমন্দির। বাঁধানো। নিয়মিত পুজোআচার বন্দোবস্ত আছে। মন্দিরের গায়ে মধুবাবার আশ্রম। নামেই আশ্রম, আদতে বাঁশ দরমার কাঠামোর মাথায় টিনের চাল ফেলা একখানা বড় ঘর। বহিরঙ্গের চেহারা দেখে বোঝা যায় ঘরখানা হালে হয়েছে।

আশ্রমের পিছনেই রেললাইন। সামনে প্রকাণ্ড মাঠ। প্রকৃতপক্ষে মাঠও নয়, হালকা বন। খোলামেলা জায়গায় অনেকটা দূরে দূরে ছড়িয়ে আছে শালগাছ। ওই শাল গাছগুলোর নীচেই হাট বসে করমপদায়।

চারটে বাজে। হাট এখন ভাঙার মুখে। কেনাকাটার আর ভিড় নেই তেমন, সওদা সেরে ফিরছে আদিবাসীরা। বেশ কিছু আদিবাসী আশ্রমের সামনে জড়ো। জোর ক্যালর ব্যালর চলছে। আদিবাসী মেয়েদের মাথায় পলাশ শিমুল। সেগুনফুলও খোঁপায় খুঁজেছে কেউ কেউ। রংচঙে পোশাকে রঙিন হয়ে আছে জায়গাটা। মহুয়ার উগ্র গন্ধ ভাসছে বাতাসে।

ভক্তদের সামনে ছোট একটা বেদিতে বসে আছেন মধুবাবা। বেদি মানে বেঁটে বেঁটে চারখানা শালবল্লার খুঁটির ওপর চেরা চেরা কাঠের পাটাতন। একা নন মধুবাবা, তাঁর পাশে এক চ্যালাও বিরাজমান।

গেরুয়া রং-এর আলখাল্লা পরে আছেন মধুবাবা। ঘাড় অবধি লম্বা লম্বা চুল। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি বুকের কাছে ঝুলছে! কপালে গালে খানতিনেক বড় বড় আঁচিল। চ্যালাটিরও মুখ শ্মশ্রুগুম্ফশোভিত। তবে তাঁর আলখাল্লার রং সাদা।

টুপুরদের জিপ থেকে নামতে দেখে পুরো সমাবেশটাই থমকে গিয়েছিল। ভক্তরা ঘুরে ঘুরে দেখছে টুপুরদের। মধুবাবার মোটা মোটা ভুরুতে পুরু ভাঁজ, চ্যালার চোখে জিজ্ঞাসা।

করমপদার বনকৰ্মীটি টুপুরদের সঙ্গে এসেছে। বেদির কাছে গিয়ে কানে কানে কী যেন বলল চ্যালাটিকে। চ্যালাও গুরুকে ফিসফিস করে বলল কীসব।

মধুবাবার ভুরু স্বাভাবিক হল। হাত নেড়ে ডাকলেন টুপুরদের। সামনে এসে বসার জন্য ইঙ্গিত করলেন।

মিতিন অক্ষুটে বলল, তোমরা যাও। আমি এখানেই আছি।

সহেলি বললেন, সে কী? কেন? তুইও চল।

আমি দূর থেকেই দেখি।

টুপুর বলল, আমিও তা হলে মিতিনমাসির সঙ্গে থাকি।

মিতিন আদেশের সুরে বলল, না। তুই সামনে গিয়ে বোস। ভাল করে দ্যাখ, সাধুবাবা কোনও চালাকি করছে কি না।

মিতিনমাসি একটা কাজের ভার দিতে টুপুর মহা আহ্লাদিত। বুমবুমের হাত ধরে গটগট এগিয়ে গেল। বেদির হাতদুয়েক তফাতে বসল আসনপিঁড়ি হয়ে। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে মধুবাবার ঐশী কার্যকলাপ।

টুপুরের পাশে পার্থ। তার পাশে সহেলি। হাতজোড় করে বসেছেন সহেলি, মুখে গদগদ ভাব। অবনী আসেননি সঙ্গে, মুধবাবাতে তাঁর কণামাত্র আগ্রহ নেই। তিনি এখন থলকোবাদের জঙ্গলে বসে মহাসমুদ্রের টানে বিভোর।

মধুবাবা এক আদিবাসী মহিলার সমস্যা শুনছিলেন। টুপুরদের আগমনে কিছুক্ষণের জন্য অমনোযোগী হয়েছিলেন তিনি, আবার মগ্ন হয়েছেন মহিলার আবেদনে। শুনছেন মহিলার কথা।

বেদির পাশে প্ৰকাণ্ড ড্রাম। মহিলার কথা শেষ হওয়া মাত্র ড্রাম থেকে জল তুলে ঢালা হল একখানা স্টিলের ডেকচিতে। চ্যালা ডেকচিটা মধুবাবার সামনে এনে ধরল। জলে ডান হাত ড়ুবিয়ে দিলেন মধুবাবা। চক্ষু নিমীলিত। জলে ঘোরাচ্ছেন হাতখানা, ঠোঁট নড়ছে অল্প অল্প। পনেরো কুড়ি সেকেন্ড পর হাতখানা তুলে নিয়ে ইশারা করলেন চ্যালাকে।

আদিবাসী মহিলাটিকে ফ্যাসফেসে গলায় চোস্ত হিন্দিতে নির্দেশ দিল চ্যালা, এই জল তোর বোতলে ঢেলে নে। ছেলেকে আজ তিন বার খাওয়াবি, কাল তিনবার। দুচুমুক করে। পূর্ণিমা লাগার পরে আর খাওয়াতে হবে না।

মহিলাটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, পেটের ব্যথা সেরে যাবে তো মহারাজ?

মধুবাবা চোখ বুজে ঘাড় নাড়লেন। হাতে অভয়মুদ্রা।

মহিলা মধুবাবাকে সাষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করল। কোঁচড়ে রাখা প্লাস্টিকের বোতলে ঢেলে নিল জলটা। তারপর উঠে গেছে ধীর পায়ে।

এবারে এক আদিবাসী বৃদ্ধ।

চ্যালা ফের ফ্যাসফেসে স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমার কী সমস্যা?

বৃদ্ধ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, আমার বুড়ি বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। হাত পা মুখ সব ফুলে গেছে।

চ্যালা বলল, কেঁদো না। বাবার ওপর ভরসা রাখো।

এবার জল নয়, ঝোলা থেকে এক মুঠো চাল বার করে বৃদ্ধের হাতে দিয়েছে চ্যালা। বলল, চাল খেয়ে দেখো। মিঠা?

বৃদ্ধ দু-তিনটে চাল দাঁতে কেটে মাথা নাড়ল, না।

এবার চাল বাবার হাতে দিয়ে দাও।

বৃদ্ধ কুঁজো হয়ে চাল দিচ্ছে। দু হাতে চালটা নিলেন মধুবাবা। ফের চক্ষু নিমীলিত, ঠোঁট নড়ছে, হাতে চাল ঘষছেন।

চ্যালা বলল, এবার এক দানা চাল মুখে দাও।

চাল দাঁতে কেটে বৃদ্ধ বিহুল। বারবার কপালে হাত ঠেকাচ্ছে।

চ্যালা প্রশ্ন করল, চাল মিঠা লাগছে?

হ্যাঁ মহারাজ।

জোরে জোরে সবাইকে বলো।

বৃদ্ধ ঘড়ঘড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, চাল মিঠা। চাল মিঠা।

সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা ধ্বনি তুলেছে, মধুবাবাকি জয়। মধুবাবাকি জয়।

চ্যালা বলল, এই চাল এবার গিয়ে বউকে খাইয়ে দাও। জলে ভেজাবে না, সেদ্ধ করবে না, কাঁচা খাবে।

বৃদ্ধ কোঁচড়ে চাল বেঁধে নিয়ে চলে গেল।

টুপুর কয়েকটা ব্যাপার লক্ষ করছিল। এক নম্বর, মধুবাবা বসে আছেন নির্বাক হয়ে। যা বলার বলছে তাঁর চ্যালা। দুনম্বর, চ্যালাটির ভাষা বিশুদ্ধ হিন্দি, যা এই আদিবাসী অঞ্চলে অপ্রচলিত। শিষ্যটিকেও কি গুরু সঙ্গে এনেছেন? সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়, কারুর কাছ থেকেই প্রণামী নিলেন না মধুবাবা। অনেক জায়গায় এরকম ক্ষেত্রে বাক্সটাক্স রেখে দেওয়ার নাকি চল আছে, ভক্তরা যে যা পারে সেই বাক্সে দিয়ে যায়। এখানে সেরকম কোনও বন্দোবস্তও নেই। যদি ভণ্ডামিটাই উদ্দেশ্য হয়, তা হলে বিনা পয়সায় খেল দেখাবেন কেন?

মধুবাবার মুখে তৃপ্তির হাসি। দৃষ্টি পড়েছে বুমবুমের দিকে। একটা আঙুল নেড়ে বুমবুমকে ডাকলেন কাছে।

বুমবুম নয়, সহেলিই উঠে দাঁড়িয়েছেন। ঢিপ করে একটা প্ৰণাম ঠুকলেন বেদিতে। নিজস্ব হিন্দিতে বললেন, আমাদের আশীর্বাদ করুন বাবা।

মধুবাবা একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। চ্যালা বলল, বাবা আপনার হাত ধরতে চাইছেন।

সম্মোহিতের মতো দুটো হাতই বাড়িয়ে দিলেন সহেলি।

মধুবাবা ডান হাতখানা ধরলেন। নিজের দু হাতের মাঝখানে হাতটাকে রেখে ঘষছেন। একটু পরেই ছেড়ে দিলেন।

চ্যালা সহেলিকে বলল, আপনার হাত জিভে ঠেকান। মিষ্টি হয়ে গেছে।

পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই সহেলি হুমুড়ি খেয়ে পড়েছেন মধুবাবার পায়ে, বাবা, আপনি ভগবান। আমাকে দয়া করুন।

চ্যালা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আপনার?

হাঁটু আর কোমরে ভয়ানক যন্ত্ৰণা মহারাজ। পূৰ্ণিমা-অমাবস্যায় বাড়ে।

মধুবাবা ইশারা করলেন চ্যালাকে। চ্যালা বলল, আপনাদের কাছে এক টাকার কয়েন আছে?

পার্থ চকিতে পার্স খুলে চার-পাঁচখানা কয়েন রাখল বেদিতে।

মধুবাবা তার থেকে মাত্র দুটো কয়েন তুলে নিলেন। আঙুলে ঘষে ফেরতও দিলেন সঙ্গে-সঙ্গে। চ্যালাও যথাবিহিত নির্দেশ দিল সহেলিকে, ব্যথার স্থানে কয়েনটা ঘষবেন। রাত্রে শোয়ার সময়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে। যন্ত্রণার উপশম হবে।

পার্থ জিজ্ঞেস করল, কয়েন মিষ্টি হয়ে গেছে?

চ্যালা বলার আগেই সহেলি জিভে ঠেকিয়েছেন কয়েন দুটো। আপ্লুত গলায় বললেন, ওমা, এ যে লজেন্সের চেয়েও মিষ্টি!

বুমবুম বায়না জুড়ল, আমায় দাও। আমায় দাও।

সহেলি মোটেই কয়েন দুটো হাতছাড়া করতে রাজি নন। বেঁধে ফেলেছেন আঁচলে।

ঘন ঘন জয়ধ্বনি চলছে। এক এক আদিবাসীর এক এক সমস্যা, মধুবাবা কাউকেই নিরাশ করছেন না। কারুর কপালে জুটছে মিষ্টি জল, কেউ বা পাচ্ছে মিষ্টি চাল। খোঁপার ফুল পর্যন্ত অবলীলায় মিঠে হয়ে যাচ্ছে মধুবাবার ছোঁয়ায়।

টুপুর ধন্দে পড়ে যাচ্ছিল। কী ঘটছে ব্যাপারটা? এ তো ম্যাজিশিয়ানের হাত সাফাই নয়, মার হাতটাই তো মিষ্টি হয়ে গেছে। বুমবুমকে দুখানা বেলপাতা দিলেন মধুবাবা, দুটো পাতাই যেন গুড়! কী করে সম্ভব? তা হলে কি অলৌকিক ক্ষমতা বলে সত্যিই কিছু আছে?

মুগ্ধ হয়েছে পার্থও। বলল, তোর মাসি পেছনে দাঁড়িয়ে করছেটা কী? ডেকে আন। দেখুক।

বটেই তো! মিতিনমাসি না দেখলে হয়?

টুপুর ভিড় টপকে পিছনে এল। এদিক ওদিক খুঁজল মিতিনকে। কোথায় গেল মিতিনমাসি? এখানেই তো ছিল!

নজরুলও ভিড়ে মিশে মধুবাবার কাণ্ডকারখানা প্রত্যক্ষ করছিলেন। টুপুরকে দেখে সরে এলেন, এবার যাবে নাকি?

মা কি এক্ষুনি নড়বে? …মিতিনমাসি গেল কোথায়?

দিদি তো লেভেল ক্রসিং-এর দিকে গেলেন।

শখানেক গজ দূরে লেভেল ক্রসিং। কয়েকটা রেলের কোয়ার্টার মতন আছে ওদিকে। তার পিছনেই জঙ্গল। ওটা তো ফেরার রাস্তা, ওখানে কেন গেছে মিতিনমাসি?

টুপুর একাই এগিয়ে দেখবে কি না ভাবছে, তখনই দেখা গেল মিতিনকে। কাঁধে ক্যামেরাখানা ঝুলিয়ে হনহনিয়ে ফিরছে।

কাছে এসে হাসল মিতিন, গোটাকয়েক স্ন্যাপ নিলাম করমপদার।

হঠাৎ?

সব জায়গারই কিছু কিছু স্মৃতি থাক। মিতিনের হাসি সামান্য চওড়া হল, তোর মাকে এবার ডাক। বিকেল ফুরিয়ে এল,অন্ধকারে ফিরতে বড়দির ভাল লাগবে?

বনকৰ্মীটিও চলে এসেছে। তাকে দিয়ে সহেলিদের ডাকিয়ে জিপে বসল মিতিন।

গাড়ি গতি নিয়েছে। মিতিন জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলে মধুবাবাকে?

সহেলি এখনও ঘোরে। বললেন, তুই যে কী মিস করলি মিতিন! একবার যদি বাবাকে ছুঁয়ে আসতিস!

দুপুরের গোমড়া ভাবটা কেটে গেছে মিতিনের। মুচকি হেসে বলল, আমি যা দেখার দেখে নিয়েছি।

কী করে দেখলি? তুই তো পেছনে ছিলি!

বেশি সামনে গেলে তোমাদের মধুবাবার অসুবিধে হত।

তার মানে তোর এখনও বিশ্বাস হয়নি?

কোনটা বিশ্বাস করার কথা বলছ? ওই মিষ্টি করে দেওয়ার ক্ষমতাটা? না কি মধুবাবার দৈবশক্তি?

ওমা, মিষ্টি করার ক্ষমতাটাই তো দৈবশক্তি।

মোটেই না বড়দি। তোমার মধুবাবাটি একটি তৃতীয় শ্রেণীর ফ্রড। করমপদার মতো রিমোট জায়গায় না উঠে কলকাতায় আড্ডা গাড়লে অ্যাদ্দিনে ওর চামড়া উঠে যেত। কীভাবে সব কিছু মিষ্টি করে দিচ্ছে জানো? অজস্র ধরনের প্ল্যান্ট প্রোডাক্ট আছে, যেগুলো দারুণ মিষ্টি হয়। চিনি গুড়ের চেয়ে ঢের ঢের বেশি মিষ্টি। সবচেয়ে কমন উদাহরণ, সরবিটল, গ্লিসারল। কিংবা তোমাদের মধু। এরা প্রায় চিনির মতোই। কিন্তু এদের কেমিক্যাল স্ট্রাকচার চিনির চেয়ে আলাদা। রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে গেলে এদের চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। ডায়েবিটিস রুগিদের সন্দেশ তৈরি হয় সরবিটল দিয়ে। হজমের ওষুধে গ্লিসারল মেশায়, মিষ্টি করার জন্যে।

মিতিনের কথাগুলো মগজে ঢুকছিল না সহেলির। বললেন, তার সঙ্গে মধুবাবার চাল জল মিষ্টি করার কী সম্পর্ক?

আছে। আছে। ডালসিটল বা স্টেডিওসাই চিনির চেয়ে তিনশো গুণ মিষ্টি। এগুলোও উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয়। এবং সেই গাছ খুব বিরল নয়। এমনকী কলকাতাতেও মেলে। অ্যাজিরেটাম বলে একটা গাছ আছে, যার পাতা, কাণ্ড সবই ভয়ানক মিষ্টি। এরকম যে-কোনও একটা উদ্ভিদের নির্যাস হাতে লাগিয়ে মধুবাবার খেলাটি দেখানো সম্ভব। এমনিতে হাত দেখে কিছু টের পাওয়া যাবে না, কিন্তু ওই হাতে যা ছোঁবে তাই মিষ্টি হয়ে যাবে। মিতিন পার্থর দিকে ফিরল, তোমার সেই গোড়বাবার কেসটা মনে আছে?

কোনটা বলো তো? সেই মহারাষ্ট্রে…?

ইয়েস। পুনে ডিস্ট্রিক্টের বারামতীতেও এরকম একটা মিষ্টি বানানো বাবার আবির্ভাব হয়েছিল। উনিশশো বিরানব্বই সালে। প্রতারকটির নাম ছিল ভানুদাস গায়কোয়াড়। সে ঝাল কাঁচা লঙ্কাকেও মিষ্টি করে দিত। তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এক আয়ুর্বেদ ডাক্তার। খেলাটা অবশ্য বেশিদিন চালাতে পারেননি ভানুদাস ওরফে গোড়বাবা ওরফে গুড়বাবা। যুক্তিবাদী সমিতির লিডাররা গিয়ে লোকটাকে ধরেও ফেলেছিল। কিন্তু পাবলিক সেন্টিমেন্টের জন্য কিছুই করা যায়নি। ভানুদাস তাদের চোখে ছিল একজন হিরো। লোকটা যে চিটিংবাজ হতে পারে, এ তারা মানেইনি। তা ছাড়া ভানুদাসের পেছনে অনেক বড় বড় চাঁই ছিল, তারাও ভানুদাসকে প্রোটেকশান দিয়েছে। এই মধুবাবা হচ্ছে ওই ভানুদাস গায়কোয়াড়েরই করমপদা সংস্করণ।

সহেলির চোখ কেমন ঘোলা হয়ে গেছে। বললেন, তাই? হাতে রস মাখিয়ে রাখে?

তোমাকে উনি কী দিয়েছেন? মিঠে জল?

না। একজোড়া করেন।

রেস্টহাউসে ফিরে সারগিয়াকে বোলো ভাল করে কেরাসিন দিয়ে মুছে দিতে, তারপর চুষো। এক ফোঁটা মিষ্টি পেলে বোলো আমায়।

কিন্তু… এখানে যে সকলের অসুখ সেরে যাচ্ছে?

এখানকার আদিবাসীদের শরীর খুব পলকা নয়। হাজার হাজার বছর ধরে এরা জঙ্গলে রয়েছে। বেশিরভাগ অসুখবিসুখ এদের শরীরই প্রতিরোধ করতে পারে। মিতিন হাসল, তা ছাড়া দৈব ওষুধের মজাটা তো এরকমই। দশজনের মধ্যে একজনের অসুখ এমনিই সারে। আর তখন দৈব ওষুধের প্রচারে গগন ফাটে। যাদের সারে না, তারা চুপচাপ চেপে যায়। ভাবে, এ বুঝি তাদের পাপের ফল। আর এইভাবেই বাবারা মহাবাবা হয়ে যান।

সহেলি গুম মেরে গেলেন।

টুপুর মজা পেয়েছে খুব। বলল, আমারও তাই কেমন কেমন ঠেকছিল!

বাজারের পেছনে তো একটা নিমগাছও ছিল। নিমপাতা এনে বাবার হাতে ঘষে দিলি না কেন? রহস্য ফাঁস হয়ে যেত।

পার্থ বলল, সে তো তুমিও করতে পারতে।

না স্যার। পাবলিক সেন্টিমেন্ট বলে একটা ব্যাপার আছে বললাম যে। আদিবাসীরা সবাই মিলে আমায় ঠেঙাত তা হলে। এখন যা করতে হবে, সব রয়েসয়ে।

টুপুর বলল, কিন্তু লোকটা করমপদায় এসে ডেরা বেঁধেছে কেন? লোকটা তো পয়সাকড়িও নেয় না?

কারণ নিশ্চয়ই আছে। মিতিনের স্বর ফের গম্ভীর, শিগগিরই জানতে পারবি।

পাহাড়ের আড়ালে ঝুপ করে হারিয়ে গেছে সূর্য। কয়েক মিনিটের মধ্যে জঙ্গল অন্ধকার। সাবধানে চড়াই-উতরাই ভাঙছেন নজরুল। জিপেও সবাই চুপচাপ।

আঁধার বনে অস্বস্তি কাটাতেই পার্থ হঠাৎ বলে উঠল, তোমার মেঘাতুবুরু অভিযানের কী ফল?

কাজ হয়েছে। আশা করছি আজই ফোর্স এসে যাবে।

চাইবাসায় ফোন করেছিলে?

তার চেয়েও বড় জায়গায়। চিফ কন্জারভেটর অব ফরেস্টকে ফোন করেছি।

তাঁর নম্বর কোত্থেকে পেলে?

অনিশ্চয়বাবু। আমাদের লালবাজারের ডি সি সাহেব। ওঁর শালা দেবজ্যোতি সরকার গোটা পূর্ব ভারতের বনজঙ্গলের হৰ্তাকৰ্তা। তাঁকেই ফোনে বললাম এলিফ্যান্ট এপিসোড। খবর উনিও পেয়েছেন, তবে স্কেচি। ডিটেলে শুনে উনি রীতিমতো এক্সাইটেড। ইমেডিয়েটলি ডি-এফ-ও চাইবাসাকে অর্ডার করবেন বললেন।

পার্থকে খুব আশান্বিত মনে হল না। বলল, দ্যাখো কী করে। সরকারের তো আঠারো মাসে বছর!

কোনও কোনও সময়ে তিন মাসে বছর হয়। যদি ওপরওয়ালা চান। এবং আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, থলকোবাদে এখন এক দুজন ফরেস্ট অফিসারকে আমি পাব।

অনিশ্চয়বাবুর সঙ্গে কথা হল? বললে হাতির কেসটা?

তার চেয়ে অনেক বেশিই কথা হয়েছে।

কী কথা?

বললাম যে, জানতে পারবে। ধৈর্য ধরো।

মিতিনের অনুমানই সঠিক। জঙ্গলের বেশ কয়েকজন অফিসার পৌঁছে গেছেন থলকোবাদের ইনস্পেকশন বাংলায়। ডি-এফ-ও সাহেব তো আছেনই, উপগ্রহের মতো সামটা গুয়া কোয়না, তিন রেঞ্জেরই রেঞ্জার সাহেব হাজির। বাংলোর কম্পাউন্ড জিপে জিপে ছয়লাপ।

অবনীর সঙ্গে বাংলোর হাতায় কথা বলছিলেন ডি-এফ-ও নাম। ছবিলাল মারান্ডি। বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ। বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা জঙ্গলেও তাঁর পরনে হাফশার্ট।

মিতিনকে দেখে ছবিলাল এগিয়ে এলেন, আপনি দেবজ্যোতিবাবুর পরিচিত, এ-কথা চাইবাসাতে একবার বলেননি কেন? আমি আপনাদের জন্য ইনস্পেকশন বাংলোটাই বুক করে দিতাম।

রেস্টহাউসেই বেশ আছি। মিতিন মুখ টিপে হাসল। সরাসরি চলে এল কাজের কথায়, আপনাদের অ্যারেঞ্জমেন্ট কদ্দুর?

ফোর্স আসছে। আজ রাতে, নইলে কাল সকালেই পৌঁছে যাবে। আমি রাঁচিতে খবর করে দিয়েছি।

দেরি হয়ে যাবে না তো?

কী করা যাবে ম্যাডাম? চাইবাসায় আমার হাতে যে কজন গার্ড আছে, সবাইকে আমি জঙ্গলে পোস্ট করে দিয়েছি। গেটগুলোতেও আর্মড গার্ড বাড়াতে হয়েছে। বদমাইশগুলো পালাতে গেলে তাদের সঙ্গে ফাইট হতে পারে। অ্যাডিশনাল ফোর্সের জন্য আমাকেও তো রাঁচির ওপর ডিপেন্ড করতেই হয়। রাঁচি টু থলকোবাদ দূরত্বটাও ভাবুন। প্রায় দুশো সত্তর কিলোমিটার। ওখান থেকে পৌছতে দশ থেকে বারো ঘণ্টা তো লাগবেই।

পার্থ বলল, সে তো বটেই। রাস্তাঘাটও তো তেমন…

প্রথম আলাপ সাঙ্গ করে মিতিনকে নিয়ে বাংলোয় গিয়ে বসলেন ডি-এফ-ও সাহেব। সারান্ডার ম্যাপ খুলেছেন। বললেন, আমি এক্ষুনি এক্ষুনি যা স্টেপ নেওয়ার নিয়েছি। বদমাইশগুলো নুনের প্ল্যান থেকে সরবে না বলেই আমার ধারণা। লিগিরদায় ওরা ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু অন্য কোথাও ওরা ট্রাই করবেই। হাতিটাকে লাস্ট দেখা গেছে তিরিলপোসির তিন কিলোমিটার ওয়েস্টে। ওখান থেকে মোটামুটি পনেরো কিলোমিটার রেডিয়াসে আমাদের আরও তিনটে সল্টলিক আছে। ডি-এফ-ও সাহেব ম্যাপে ঝুঁকলেন। আঙুল দিয়ে দেখালেন বিন্দুগুলোকে। বললেন, সবকটাই ওয়েলগার্ডেড। তবে..

কী হবে?

কোয়েনার রেঞ্জার বলে উঠলেন, স্যার মনে করছেন আজকের রাতটা ওর চুপচাপই থাকবে। কাল পূর্ণিমা পড়ছে। পূর্ণিমার রাতটাকে পছন্দ করে পোচাররা। জ্যোৎস্নায় চারদিক আলো হয়ে থাকে তো। তখন লক্ষ্যস্থলের অনেক দূরে গাড়ি রেখেও হেঁটে ওরা টার্গেট পয়েন্টে পৌঁছে যেতে পারে।

ডি-এফ-ও বললেন, ইয়েস পূর্ণিমাতেই জঙ্গলে শিকার খুব সহজ। এর ওপর যদি ওদের কাছে টেলিস্কোপিক রাইফেল থাকে, তা হলে তো ওরা অনেক দূর থেকেই ট্রাই নিতে পারে।

মিতিন অক্ষুটে বলল, অরণ্যের জ্যোৎস্না এত নিষ্ঠুর হয়?