গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

১১. বিরাট একটা ফোকর

হ্যাঁ, জাঁতা-ঢিবিটার ওপর নয়, গায়েই বিরাট একটা ফোকর। আর সেই ফোকরের নীচে বিরাট ইঁদারার মতো এক গভীর গর্ত। ফোকরের ধার দিয়ে একটা গড়ানে ঢালও বাচ্চাদের স্লিপ খাবার কাঠামের মতো নীচে নেমে গেছে।

ফোকর দিয়ে সেই ঢালটার ওপর দিয়েই আগের সবাই গড়িয়ে গেছে।

আমার পক্ষে সেটা কিন্তু সহজ হল না।

ফোকরটা তখনই ধীরে ধীরে বুজে আসতে শুরু করেছে। যতটুকু বুজে এসেছে, ওপর থেকে দেখলে পাথুরে-ঢিবিটা থেকে তা আলাদা করে চেনা অসম্ভব। বাকিটুকু বন্ধ হয়ে গেলে আগের দেখা জাঁতা-ঢিবির মতো ওপর থেকে কিছু ধরাই যেত না।

আধখানা বুজে আসা ফোকরের ভেতর দিয়ে কোনওরকমে গলে গেলাম বটে কিন্তু স্পেস-স্যুটের একটা হাতা শেষ পর্যন্ত বুজে যাওয়া ফোকরের ফাঁকে এমন

আটকে গেল যে টেনে সেটা ছাড়াতে গিয়ে একটু ছিঁড়েই গেল।

গড়ানে ঢাল দিয়ে নীচে নেমে যেতে যেতে বুকটা তখন আতঙ্কে একেবারে হিম।

স্পেস-স্যুট ছিঁড়ে যাওয়া মানে তো সর্বনাশ। পৃথিবীতে যে হাওয়ার চাপে আমরা অভ্যস্ত, শুধু তাই কমে গিয়ে শরীরের রক্ত চলাচল থেকে সব কিছু বেসামাল শুধু হবে না, নিশ্বাসের হাওয়াই তো আর পাব না!

ওপরে কোথাও থাকলে, স্পেস-স্যুট একেবারে বিকল হওয়ার আগে কোনওরকমে শূন্যযানে পৌঁছবার চেষ্টা করতে পারতাম, কিন্তু এ তো পাতাল-গহ্বরে কোথায় যে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছি তাই জানি না!

মাথা খুঁড়লেও এখন তো ওপরে ওঠবার আর আশা নেই।

যে-ঢালটা দিয়ে নামছি সেটা আরও গড়ানে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নামবার বেগ যেমন কমতে লাগল, সুড়ঙ্গ কূপটার গাঢ় অন্ধকারও তেমনই ফিকে হয়ে এল।

আমার বেশ কিছুটা নীচে স্লিপ খাওয়ার মতো করে নামায় সুরঞ্জনের স্পেস-সুটটা তখন অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

সেই সঙ্গে আরও কটা জিনিস যা টের পাচ্ছি সেইটেই মারাত্মক।

নিশ্বাসের কষ্টে বুকটা ক্রমশ যেন জাঁতাকলে চেপে ধরছে।

প্রাণপণে হাঁপরের মতো নিশ্বাস টেনে আর ফেলেও হাওয়ার অভাব যেন মিটছে না।

মাথাটা তখনও একেবারে ঘোলাটে হয়ে যায়নি বলে ব্যাপারটা কী হচ্ছে তা একটু বুঝতে পারছি।

স্পেস-স্যুট ছিঁড়ে ফুটো হয়ে যাওয়ার দরুন ভেতরকার হাওয়া বেরিয়ে গিয়ে শরীরের ওপরকার স্বাভাবিক চাপ রাখার ব্যবস্থাটা নষ্ট হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস জোগাবার মুখোশটাও কাজ করছে না।

বাতাসহীন এই গ্রহে যার দৌলতে এতক্ষণ প্রাণে বেঁচে চলাফেরা করেছি সেই মুখোশ মুখে এঁটেই এবার দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে।

গড়ানে ঢালটা আরও কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে জানি না কিন্তু সজ্ঞানে সেখানে পেঁৗছনো আমার কপালে নেই।

বাতাসের অভাবের অসহ্য কষ্টটাও ক্রমশ তখন মাথাটা অসাড় হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে।

গড়িয়ে নামা শেষ হবার আগেই একটা নিবিড় অন্ধকারের মাঝে যেন ড়ুবে গেলাম।

ব্যাপার যা হয়েছিল তাতে জ্ঞান আর না হবারই কথা।

কিন্তু জ্ঞান তবু ফিরল। ফিরল আমার অজ্ঞান অবস্থাতেই একটা অচেতন যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ায়।

প্রথম একটু হুশ হবার পর টের পেলাম একটা বেশ প্রশস্ত গোলাকার জায়গায় আমি পড়ে আছি আর প্রাণপণে সুরঞ্জনকে বাধা দিচ্ছি যাতে আমার মাথা থেকে খুলে ফেলা মুখোশটা সে না চাপাতে পারে।

মুখোশটা নিশ্বাসের কষ্টের পর অজ্ঞান অবস্থাতেই আমি খুলে ফেলেছি নিশ্চয়। সুরঞ্জনের সেটা আবার মাথায় পরিয়ে দেবার চেষ্টাতেও বাধা দিচ্ছি সেই অবস্থায়।

সরঞ্জনের অবশ্য দোষ নেই। নিশ্বাসের মখোশ খুলে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্য জেনেই সে সেটা চাপিয়ে দেবার জন্য অত ব্যস্ত হয়েছে। মুখোশটা আগেই বিকল হয়েছে সে আর কী করে জানবে।

মুখোশটা বিকল।

হঠাৎ মাথার ভেতর বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠেছে কথাটা।

মুখোশটা বিকল হয়ে গেছে সন্দেহ নেই। নিশ্বাস নিতে না পারার যন্ত্রণায় আপনা থেকে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াতেই আমি সেটা যে খুলে ফেলেছি তাও ঠিক। কিন্তু খুলে ফেলার পরও বেঁচে আছি কী করে!

শুধু বেঁচে নেই, অজ্ঞান অবস্থা থেকে আবার জ্ঞানও ফিরে পেয়েছি।

কেমন করে তা সম্ভব?

তাহলে কি–?

কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে স্পেস স্যুট পরা সুরঞ্জনকে একটু ঠেলে দিলাম।

তার মুখ দেখবার উপায় নেই, কিন্তু তার দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে বুঝলাম ব্যাপারটা যে কতখানি অদ্ভুত ও আশ্চর্য এতক্ষণে তার মাথাতেও ঢুকেছে।

বিনা মুখোশে আমার বেঁচে থাকা আর জ্ঞান ফিরে পাওয়ার তো একটা মাত্রই মানে হয়।

মঙ্গলের ওপরের হাওয়া যেমনই হোক, এই সুড়ঙ্গ কূপের ভেতর আমাদের নিশ্বাস নেবার মতো হাওয়াই রয়েছে।

মুখোশ খুলে ফেলার পর স্পিকিং টিউবে কথা বলার উপায় নেই, সুরঞ্জনকে তাই ইঙ্গিতেই মুখোশটা খুলে ফেলতে বললাম।

বার দুই ইশারার পর নির্দেশটা বুঝলেও প্রথমটা সে একটু ভয়ই পাচ্ছিল! আমার ভরসা পেয়ে খুলে ফেলার পর তার উৎসাহ দেখে কে!

দেখেছেন! সুরঞ্জন উত্তেজিত ভাবে বললে, একেবারে আমাদের পৃথিবীর মতো হাওয়া, বরং আরও নির্মল পরিষ্কার, ঠিক আমাদের সমুদ্রের ধারের হাওয়ার মতো। অথচ ওপরে মঙ্গলগ্রহে তো বাতাস নেই বললেই হয়। যা আছে তা পৃথিবীর হাওয়ার শতকরা এক ভাগ মাত্র ঘন। তারও বেশির ভাগ কার্বন ডায়ক্সাইড, তাতে অক্সিজেন আর জলীয় বাষ্প যা আছে তাও ছিটেফোঁটার বেশি নয়।

সব তো বুঝলাম, সুরঞ্জনের উত্তেজিত বক্তৃতায় বাধা দিয়ে বললাম, কিন্তু এই সুড়ঙ্গ কূপে এমন হাওয়া এল কোথা থেকে? জায়গাটাও বা কী?

জায়গাটা একটু অবাক করবার মতোই। যেখানটায় গড়িয়ে নেমেছি, সেটা খুব বড় সার্কাসের তাঁবুতে ঘেরা খেলার অ্যারিনার মতো গোল একটা জায়গা। তার একদিকে যেখান দিয়ে আমরা নেমে এসেছি সেই ঢালু সুড়ঙ্গটা ওপরে উঠে গেছে, আর একদিকে পাথরের দেয়াল ভেদ করে ওপরে উঠবার একটা চওড়া গোল সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। জায়গাটার চারিধারের মসৃণ পাথুরে দেয়ালে আর-কোনও আসা-যাওয়ার ফাঁক কি দরজা কিছু নেই। মাথার ওপরেও নিরেট একটানা পাথুরে ছাদ একেবারে নিচ্ছিদ্র।

এরকম জায়গার আসল তাৎপর্যটা কী? শুধু একদিক দিয়ে গড়িয়ে নেমে আর। একদিক দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার জন্যই জায়গাটা রাখা আছে বলে তো বিশ্বাস হয় না।

তা ছাড়া যাদের অনুসরণ করে এ গুপ্ত সুড়ঙ্গের হদিশ পাওয়া গেছে সেই জালা-মূৰ্তিরাই বা গেল কোথায়? তাদের মতো আমাদের বটুকেশ্বরেরও তো কোনও পাত্তা নেই।

সকলের আগে বটুক কীভাবে এই পাতাল-সুড়ঙ্গে ঢুকল সে কথা সুরঞ্জনকে এবার জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে আমি লুটভিককে কন্ট্রোল রুমে দেখতে যাবার পর জানলা থেকে তারা আর একবার এই জালা-মূর্তিদের দেখতে পায়। আমাকে জানিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করলে পাছে সে মূর্তিগুলির রহস্য জানার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায় সেই ভয়ে স্পেস-স্যুট পরে তারা তৎক্ষণাৎ শূন্যযান থেকে বেরিয়ে পড়ে।

অত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া সত্ত্বেও কোনও লাভ কিন্তু হয় না।

তাদের বেরুতে দেখেই মূর্তিগুলো ওই সব জাঁতা-ঢিবির আড়ালে যায় অদৃশ্য হয়ে।

হতাশ হয়ে একটা ওই রকম ঢিবি যখন তারা পরীক্ষা করে দেখছে তখনই আশ্চর্য অভাবিত একটা ব্যাপার ঘটে।

দানবদের জাঁতার মতো সেই বিরাট পাথুরে ঢিবির গা-টা যেন কোন মন্ত্রে ফাঁক হচ্ছে মনে হয়। সেখান থেকে গুটি তিনেক জালা-মূর্তিকে বেরিয়ে আসতে দেখে তারা একেবারে মড়ার মতো নিশ্চল হয়েই ছিল, কিন্তু কেমন করে যেন টের পেয়ে মূর্তিগুলো নিমেষের মধ্যে আবার ঢিবির ফাঁক-হওয়া-গহ্বরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাদের ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পাথুরে ফোকরটাও তখন আবার বুজে আসতে শুরু করেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে ফাঁক বুজে গিয়ে ঢিবির গায়ে তার আর চিহ্নই থাকে না।

বটুকের পক্ষে সেই কয়েক সেকেন্ডই কিন্তু যথেষ্ট।

এমনিতে একটু যেন জড়ভরত। কিন্তু আসল দরকারের সময় ও একেবারে চিতাবাঘের চেয়েও চটপুটে আর বেপরোয়া।

ওই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, পাথুরে চিচিংফাঁক বন্ধ হবার আগেই, এক লাফে সে জালা-মূর্তিদের পেছনে ওই ফোকরে ঢুকে পড়ে।

সুরঞ্জন তার পরেই যখন ঢুকতে যায় তখন পাথুরে ঢিবি আবার মন্ত্রবলে যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

কী করবে বুঝতে না পেরে ঢিবির ফোকর আবার খোলবার আশায় সে ওখানে বসে ছিল।

অন্য একটা ঢিবি থেকে আর-একদল জালা-মূর্তি বার হবার পর তাদের ফিরে যাওয়ার লক্ষণ দেখে আমাকে সুদ্ধ সঙ্গে নিয়ে অমন তাড়া করে ছুটে গিয়েছিল ওই ফাঁকটা খোলা থাকতে থাকতে ভেতরে ঢুকতে পাবার আশায়।

সে আশা সফল হয়েছে, কিন্তু আসল উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে লাভ কিছু হয়নি। বটুকেশ্বরের কোনও পাত্তাই নেই, আর জালা-মূর্তিদের রহস্য যেমন ছিল তেমনই অভেদ্যই হয়ে আছে।

এখন তাহলে আমাদের কী করা উচিত? সুরঞ্জনকেই জিজ্ঞাসা করেছি, এখানে দশ বছর বসে থাকলেও আমাদের সমস্যার কিনারা হবে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ ভেঁড়া স্পেস-স্যুট নিয়ে আমার শূন্যযানে ফেরারও উপায় নেই। তার চেয়ে তুমিই ফিরে যাও, সুরঞ্জন, বটুকেশ্বরের জন্য আমিই এখানে অপেক্ষা করি যতদিন পারি।

না। জোর দিয়ে বলেছে সুরঞ্জন।

মাথায় মুখোশ দেওয়া শিরস্ত্রাণটা সে আগেই খুলে ফেলেছিল।

এবার স্পেস স্যুটটাও গা থেকে খুলে ফেলতে ফেলতে বলেছে, দুজনের যখন যাবার উপায় নেই, এখানে তখন আমিই থাকব। আপনি আমার স্পেস-সুটটাই পরে শূন্যযানে ফিরে যান। আপনার জায়গায় আমি গেলে কোনও লাভ হবে না। আপনি তবু লুটভিক-এর কাছে কায়দা করে শূন্যযান চালাবার কলাকৌশলগুলো শিখে নিয়েছেন। দরকার হলে তার কাছ থেকে আরও কিছু জেনে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবেন। আমি গেলে সেরকম ফিরে যাবার কোনও আশাই নেই। সুতরাং পোশাকটা পরে নিয়ে আপনি ওদিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে যান। সিঁড়িটা ওই জন্যই আছে বলে মনে হয়—

ধৈর্য ধরে সুরঞ্জনের সব কথা শোনবার পর একটু হেসে বললাম, হৃদয়টা তোমার সত্যিই বড়, সুরঞ্জন। তোমার নিঃস্বার্থতার প্রশংসা করি। কিন্তু বটুকেশ্বরের খোঁজ না পেয়ে এখান থেকে আমিও যেতে পারব না। তাতে যদি সারাজীবন এখানেই কাটাতে হয় সেও ভাল। হ্যাঁ, সত্যিই তাই ভাল।

হ্যাঁ, সত্যিই তাই ভাল।

যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম দুজনে।

এ কী শুনছি?

পরিষ্কার বাংলা কথা! তাও বটুকের গলায় হলেও বুঝতাম।

তার গলা তো নয়ই, কোনও পুরুষের গলাই নয়।