১১. প্রভা (কাল : ৫০ খৃষ্টপূর্ব)

প্রভা – কালঃ ৫০ খৃষ্টপূর্ব

সাকেত কখনও কোনো রাজার রাজধানীতে পরিণত হয়নি। বুদ্ধের সমসাময়িক কৌশল-রাজ প্রসেনজিতের একটি রাজপ্রাসাদ এখানে ছিল, কিন্তু রাজধানি ছিল ছয় যোজন দূরে অবস্থিত শ্রাবন্তীতে (সহেট-মহেট)। প্রসেনজিতের জামাতা অজাতশত্রু কৌশলের স্বাধীনতা হরণ করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবন্তীরও সৌভাগ্য বিলুপ্ত হল। অতীতে সরযুতটে অবস্থিত সাকেত পূর্ব (প্রাচী) থেকে উত্তরের (পাঞ্জাব) যোগাযোগ পথে অবস্থিত থাকায় শুধু জলপথের বাণিজ্রের জন্যই নয়, স্থলপথের বাণিজ্যেরও এক বড় কেন্দ্র ছিল। বহুদিন পযণ্ত তার এই অবস্থা অটুট ছিল। বিষ্ণগুপ্ত  চাণক্যের শিষ্য মৌর্ষ মগ্ধ রাজ্যকে প্রথমে তক্ষশিলা পর্যন্ত, পরে যবনরাজ সেলুকাসকে পরাজিত করে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে পশ্চিমে হিরাত এবং আমুদরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। চন্দ্রগুপ্ত ও তার মৌর্যবংশের শাসনেও সাকেত বাণিজ্য কেন্দ্রের বেশী কিছু ছিল না। মৌর্যবংশ-ধ্বংসকারী সেনাপতি পুষ্যমিত্র প্রথমে সাকেতকে রাজধানীর মর্যাদা দিয়েছিল, কিন্তু তাও সম্ভবত পাটলীপুত্রের প্রাধন্যকে ক্ষুণ্ণ করে নয়। পুষ্যমিত্র অথবা তার শুঙ্গবংশের শানসকালে বাল্মীকি যখন রামায়ণ রচনা করেন, তখন অযোধ্যার নাম প্রচারিত হল। এইভাবেই সাকেত অযোধ্যা বলে পরিচিত হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অশ্বঘোষ বাল্মীকির কাব্যের রসাস্বদন করেছিলেন। কালিদাস যেমন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের আশ্রিত কবি ছিলেন, তেমনি বাল্মীকিও যদি কখনও শুঙ্গবংশের আশ্রিত কবি ছিলেন, তেমনি বাল্মাকীও যদি কখনও শুঙ্গবংশের আশ্রিত কবি থেকে থাকেন অথবা কালিদাস যেমন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য এবং কুমারগুপ্ত এই দুই পিতা-পুত্রকে তাঁর ‘রঘুবংশ’-এ রঘু এবং ‘কুমারসম্ভব’-এ কুমার রুপে চিত্রিত করেছেন, তেমনি বাল্মীকি যদি শুঙ্গবংশের রাজধানীর মহিমাকে উন্নীত করবার জন্যই বৌদ্ধ জাতকের দশরথের রাজধানীকে বারাণসী থেকে সরিয়ে সাকেত বা অযোধ্যায় এনে থাকে এবং শুঙ্গসম্রাট পুষ্যমিত্র বা অগ্নিমিত্রকেই রামরুপে মহিমান্বিত করে থাকেন—তবে বিস্ময়ের কিছু নেই।

সেনাপতি পুষ্যমিত্র আপন প্রভুকে হত্যা করে সমগ্র মৌর্য সাম্রাজ্যকে অধিকার করতে সমর্থ হয়নি। সারা পাঞ্জাব যবনরাজ মিনান্দরের দখলে চলে গেল; এবং পুষ্যমিত্রের পুরোহিত ব্রাহ্মণ পতঞ্জলি-পুষ্যমিত্রের সময়ে এই নগরের নাম সাকেতই ছিল—অযোধ্যা নয়।

পুষ্যমিত্র, পতঞ্জলি এবং মিনান্দরের সময় থেকে আমরা আরও দুশ’বছর পিছিয়ে আসছি। এই সময়েও সাকেতে বড় বড় শ্রেষ্ঠী বসবাস করত। লক্ষ্মীর বসতি ফলে সরস্বতীরও অল্পবিস্তর আগমন হতে লাগল এবং ধর্ম ও ব্রাহ্মণেরা স্বভাবতঃই এসে পড়ল। এইসব ব্রাহ্মণদের মধ্যে ধন-বিদ্যা সম্পন্ন একটি কুল ছিল। এই কুলাধিপতির নাম মুছে গিয়েছে কালের প্রবাহে, কিন্তু কুলাধিপত্মীর নাম অমর করে রেখেছে তার পুত্র। এই ব্রাহ্মণীর নাম সুবর্ণাক্ষী, তার চোখ ছিল সোনার মতো কাঁচাহলুদ রঙ-এর। তৎকালে কাঁচাহলুদ রঙ বা নীল রঙ-এর চোখ সারা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় জাতের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যেত। কাঁচাহলুদ রঙ-এর চোখ থাকা কোন দোষের ছিল না। ব্রাহ্মণী সুবর্ণাক্ষীর এক পুত্র তার মতোই সুবর্ণনেত্র এবং পিঙ্গল কেশধারী ছিল। তার গায়ের রঙ ছিল মায়ের মতোই সুগৌর।

সময়টা বসন্তকাল। আমের মঞ্জরী চারিদিকে আপন সুগন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বৃক্ষরাজি পুরনো পত্রসমূহ ত্যাগ করে নতুন পত্রাবলীতে ভূষিত হয়েছে। চৈত্রের শুক্লানবমী তিথি। সাকেতের নর-নারী সন্তরণ প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে সাকেতবাসীরা বসন্তোৎসব পালন করে। এই সাঁতার প্রতিযোগতিরায় তরুণ-তরুণী উভয়েই একঘাটে নগ্নদেহে অংশগ্রহণ করে। তরুণীদের মধ্যে বহুসংখ্যক কর্পূরশ্বেত যবনী (গ্রীক-নারী) ছিল, যাদের সুন্দর-সুডৌল দেহ যবন শিল্পীর নির্মিত অনুপম মর্মর মূর্তির অনুরূপ।

আর ছিল সোনালী বা পীত কেশধারিণী সুবর্ণাক্ষী ব্রাক্ষণকুমারীগণ, সৌন্দর্যের দিক থেকে তারা যবনীদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। এ ছাড়া ছিল ভ্রমরকৃষ্ণ কেশবিশিষ্টা ধূসরবর্ণা বহুসংখ্যক বৈশ্য তরুণী, তাদের তারুণ্যের মাদকতাও কম আকর্ষণীয় ছিল না। আজকের দিনে সাকেতের প্রতিটি কোণ থেকে কৌমার্যরুপরাশি সরযুতীর এসে উপস্থিত হয়েছে। তরুণীদের মতো নানা কুলের তরুণেরাও গাত্রাবরণ উম্মেচন করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বাড় জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। তাদের ব্যায়ামপুষ্ট সুডৌল সুন্দর দেহ কর্পূরশ্বেত, ধূসর প্রভূতি বিভিন্ন রঙের। তরুণ-তরুণীদের সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য আজকের এই প্রতিযোগিতা মহোৎসবের চেয়ে বড় আর কোনো উৎসবেরই অনুষ্ঠান হত না। প্রতি বছর এই উৎসবের ভিতর দিয়ে কতজনেই না স্বয়স্বরা হয়ে উঠত। বাপ মায়েরা এ বিষয়ে তরুণ-তরুণীদের উৎসাহিতই করতেন। তখনকার দিনে এটাই ছিল সর্বজনমান্য শিষ্টাচার।

নৌকা থেকে প্রতিযোগী তরুণ-তরুণীরা সরযূর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সরষূর নীল জলে কেশরাশিকে জলের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে দু’হাতে জল কেটে কেটে এগিয়ে যেত লাগল। এদের কাছে কাছে থেকে বহু ক্ষুদ্র নৌকা চলছে। নৌকার আরোহীরা প্রতিযোগী তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ দিচ্ছে বা কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাকে নৌকায় তুলে নিচ্ছে।

হাজার হাজার সন্তরণকারীর মধ্যে কারও পক্ষে ক্লান্ত হয়ে হার স্বীকার করাই স্বাভাবিক ছিল। সকল প্রতিযোগীই সর্বোগ্রে যাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। নদীতটে পৌঁছাবার যখন কিছুটা বাকী, তখন বহু প্রতিযোগীই শিথিল হয়ে পড়তে লাগল। পিঙ্গল এবং পাণ্ডুশ্বেতকেশী দু’জনেই সকলের আগে গিয়ে সমগতিতে পাশাপাশি চলতে আরম্ভ করেছে।  তীরের দিকে আরও  এগিয়ে গেল তারা-সকলেই ভাবছিল, এদের ভেতর থেকে কেউ একজন আগে বেরিয়ে যাবে; কিন্তু দেখল দু’জনেই গতিই সমান। নৌকা-রোহীদের মধ্যে কেউ কেউ এ-ও শুনল যে, ওদের মধ্যে একজন অপরকে আগে যাবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে।

দু’জনে এক সঙ্গেই তীরে এসে পৌঁছাল। এদের মধ্যে একজন তরুণ, অপরটি তরুণী। উপস্থিত সকলেই হর্ষধ্বনি করে অভিনন্দন জানাল। ওরা দু’জন আপন আপন পোশাক পরে নিল। দর্শকরা সোৎসাহে পুষ্পবর্ষণ করেছে, তরুণ-তরুণী দু’জন পরস্পরকে কাছ থেকে দেখছিল। উপস্থিত সকলে তাদের শুধু সন্তরণ কৌশলেরই নয়, সৌন্দর্যেরও প্রশংসা করতে লাগল।

কে একজন প্রশ্ন করল,“কুমারীকে তো আমি চিনি, কিন্তু কে এই তরুণ সৌম্য?”

“সুবর্ণাক্ষীপুত্র অশ্বঘোষের নাম শোনোনি?”

“না, আমি নিজেদের পুরোহিত কুলকেই শুধু জানি। আমরা হলাম ব্যবসায়ী, এত খবর রাখবার ফুরসৎ কোথায়?”

তৃতীয়, জন বলল,“আরে সাকেত থেকে অশ্বঘোষের বিদ্যার খ্যাতি দূর-দূরান্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, সমস্ত বেদ এবং সকল বিদ্যাতেই পারদর্শী।”

প্রথম, “কিন্তু ওর বয়স তো চব্বিশের বেশী হবে না।”

তৃতীয়,“হ্যাঁ, ওই রকম হবে। এর কবিতা লোকে সুর করে পড়ে আর গায়।’

দ্বিতীয়, জন জিজ্ঞেস করল,“এই কি সেই কবি অশ্বঘোঘ, যার প্রেমগীতি আমাদের তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ফেরে?”

তৃতীয়,“হ্যাঁ, এই সেই অশ্বঘোষ। কিন্তু কুমারীর কি নাম সৌম্য?”

প্রথম, “সাকেতে আমাদের যবন-কুল-প্রমূখ এবং কোশলের বিখ্যাত  ব্যবসায়ী দত্তমিত্রের পুত্রী প্রভা।”

দ্বিতীয়,“তাই বল! এ রকম সৌন্দর্য খুব কমই দেখা যায়। দেহের গড়নে কত কোমল মনে হয়, অথচ সাঁতার কি পটু!”

প্রথম,“এর মা-বাপ দু’জনেরই চমৎকার স্বাস্থ্য, দু’জনেরই বেশ বলিষ্ঠ দেহ।”

নগরোদ্যানে গিয়ে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে সকলের কাছে এই দুই প্র্রতিযোগীর পরিচয় দেওয়া হল, এবং দু’জন লজ্জাবনত মুখে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হল।

সাকেতের পুষ্পোদ্যান ছিল পুষ্যমিত্রের শাসনের স্মারক। এর র্নিমাণ কাজে সেনাপতি প্রচুর অর্থ এবং শ্রম নিয়োগ করেছিলেন। যদিও এখন পুষ্যমিত্র বংশের শাসন আর নেই, সাকেতও অন্য কোনো রাজার রাজধানীতে পরিণত হয়নি, তবু নিগমকে (নগর-সভা) সাকেতের গৌরব মনে সুরক্ষিত করে রাখা হয়েছে, যেমন রাখা ছিল দুশ’বছর আগের পুষ্যমিত্রের শাসনকাল। উদ্যানের মধ্যস্থলে এক পুষ্করিণী। পুষ্করিণীয় স্বচ্ছ নীল জলে নানা বর্ণের পদ্ম ফুটে থাকত এবং হংসমিখুনের দল সাঁতার কেটে ফিরত, চারিদিকে শ্বেতপাথরের বাঁধানো ঘাট যায় সোপানশ্রেণী স্ফাটকের মতোই স্বচ্ছ। সরোবরের ধার ঘেঁষে সবুজ দূর্বাচ্ছাদিত প্রশস্ত তটভুমি। এর ওপর কোথাও গোলাপ, জুঁই, বেল ইত্যাদি ফুলের কেয়ারি, আবার কোথাও তমাল, বকুল, অশোক বৃক্ষের ছায়া। আবার কোথাও বা লতাগুল্মে ঘেরা কুমার-কুমারীগণের ক্রীড়াক্ষেত্র। উদ্যান মধ্যে মাটি, পাথর আর সবুজে আচ্ছাদিত কয়েকটি মনোরম পাহাড়। উদ্যানের কোনো কোনো জায়গায় ফোয়ারা থেকে ঝরণা-ধারায় জল উৎসারিত হচ্ছে।

অপরাহ্ণে এক লতাগুল্মের কাছে সাকেতের তরুণ-তরূণীদিগের ভিড়, কিন্তু চারিদিকে নীরবতা। সকলেই লতাগুল্মের দিকে কান পেতে ছিল, আর লতাগুল্মের ভিতরে শিলাচ্ছাতিদ আসনে বসে সেই তরুণ, এক মাস আগে সন্তরণ প্রতিযোগিতায় যে এক তরুণীর সঙ্গে যুগ্মবিজয়ী হয়েছিল। তার দেহে মস্বণ সুক্ষ্ম কাপড়েরর পোশাক, দীর্ঘ পিঙ্হল কেশরাশি মাথায় জটার আকারে বাঁধা, হাতে বীণা—তরুণের আঙ্গুল স্বচ্ছন্দ গতিতে মনোহর সুর সৃষ্টি করে চলেছে। অর্ধনুদ্রিত নয়নে স্বরচিত গীত গেয়ে গাওয়ার তাগিদ ছিল, কারণ গায়ক-কবি জানে, তার শ্রোতাদের মধ্যে প্রাকৃত প্রেমিকের সংখ্যাই বেশী। কবি নিজের নবরচিত ‘উর্বশী-বিয়োগ’ গেয়ে শোনাল—উর্বশী লয়প্রাপ্ত হয়ে গেল আর পুরুরবা উর্বশীকে আপ্সরা (জলবিহারিণী) বলে ডাকতে ডাকতে পর্বত, সরোবর, বন, সকল জায়গায় খুঁজে ফিরতে লাগল। অপ্সরার দর্শন সে পেল না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে এল। গানে পুরুরবার অশ্রুবর্ষণের সময় গায়কেরও চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল এবং সমগ্র শ্রোতুমণ্ডলী ও অভিভূত হয়ে পড়ল সেই গান শুনে।

সঙ্গীত শেষ হবার পর এক এক করে সবাই চলে যেত লাগল। অশ্বঘোষ বাইরে এলে কিছু তরুণ-তরুণী তাকে ঘিরে দাঁড়াল। তার মধ্যে আর্ট্র আরক্ত-নয়না প্রভাও ছিল। একজন তরুণ এগিয়ে এসে বলল, “মহাকবি!”

“মহাকবি! আমি যে কবিই নই সৌম্য!’

“আমাকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দাও কবি। সাকেতে আমাদের যবনদের একটি ছোট নাট্যশালা রয়েছে।”

“নাচের জন্য? আমারও নাচের সখ আছে।”

“নাচের জন্যেই শুধু নয়, ওখানে আমরা অভিনয়ও করে থাকি।”

“অভিনয়!”

“হ্যাঁ কবি, কিন্তু যবন-রীতির অভিনয়ে এক বিশেষত্ব আছে। তাদের অভিনয়ে বিভিন্ন স্থান-কালের পরিচায়ক বড় বড় চিত্রপট থাকে, আর সমস্ত ঘটনাকেই বাস্তবের রুপে দেখাবার চেষ্টা করা হয়।”

“কি পরিতাপের কথা, সৌম্য! সাকেতে জন্মগ্রণণ করেও আমি এমন অভিনয় এখনও দেখলাম না!”

“আমাদের অভিনয়ের দর্শক এখানকার যবন-পরিবার এবং কিছু ইষ্ট মিত্র—এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এ জন্য বহু সাকেতবাসী যবন-অভিনয়…..”

“নাটক বলা উচিত, সৌম্য!”

“হ্যাঁ, যবন-নাটক। আজ আমরা এক নাটক মঞ্চস্থ করব। আমাদের ইচ্ছা ‍তুমিও আমাদের নাটক দেখ।”

“নিশ্চয়ই। তোমাদের মতো মিত্রগুলীর অসীম অনুগ্রহ।”

অশ্বঘোষ ওদের সঙ্গে চলল। নাট্যশালায় মঞ্চের কাছে তাকে বসতে দেওয়া হল। অভিনয় হচ্ছিল কোনো এক যবন বিয়োগান্ত নাটক প্রাকৃত ভাষায়, যবন কুলপুত্র-পুত্রীগণ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছিল। অভিনেতা এবং অভিনেত্রীগণের পোষাক-পরিচ্ছদও ছিল যবন-দেশীয়দের মতো। বিভিন্ন দৃশ্যপট যবনরীতি অনুযায়ী অঙ্কিত ছিল। নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করছিল অশ্বঘোষের পরিচিতা প্রভা। তার অভিনয় কৌশল দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সে। অভিনয়ের মাঝে বিরতির সময় পূর্বপরিচিত যবন তরুণ ‘উর্বশী-বিয়োগ’ গানের অনুরোধ জানাল। কোনো রকম আপত্তি না করে বীণা হাতে অশ্বঘোষ রঙ্গমঞ্চের ওপর উঠে এল। তারপর স্বরচিতা গানের গভীরতায় নিজে কাঁদল অপরকেও কাঁদাল। নাটক শেষ হয়ে যাবার পর সমস্ত অভিনেতা, কুমার-কুমারীদের সঙ্গে কবির পরিচয় করানো হল। অশ্বঘোষ বলল, “সাকেতে থেকেও আমি এই অনুপম বলা সম্বন্ধে অজ্ঞ রয়ে গেছি। মিত্রমণ্ডলীর কাছে আমি অসীম কৃতজ্ঞ যে, তোমরা আমাকে এক অজ্ঞাত প্রভালোক দর্শন করালে।”

‘প্রভালোক’ কথাটি উচ্চারণ করার সময় কয়েকজন-তরুণী প্রভার দিকে তাকিয়ে মুখে টিপে হাসল। অশ্বঘোষ পুনরায় বলল, “আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। তোমরা যেমন আজ যবন-নাটকের প্রাকৃত রূপান্তর অভিনয় করলে—মনে হয়, চেষ্টা করলে আমরা স্বদেশের কথা নিয়ে চমৎকার নাটক চরনা করতে পারি।”

“আমাদেরও পূর্ণ আস্থা আছে কবি, তুমি ইচ্ছা করলে মুল যবন-নাটক থেকেও ভালো নাটক রচনা করতে পার।”

“এতটা বল না, সৌম্য! যবন-নাট্যকারদের শিষ্য হওয়ার যোগ্যতাই যথেষ্ট, আমি তাই চেষ্টা করব। আচ্ছা আমি যদি ‘উর্বশী-বিয়োগ’ নিয়ে নাটক লিখি?”

“তা’হলে আমরা তার অভিনয়ও করতে প্রস্তুত, কিন্তু পুরূরবার ভুমিকায় তোমাকেই অভিনয় করতে হবে।”

“আমার আপত্তি নেই, সামান্য অভ্যাস করলে তেমন মন্দ অভিনয় করব না।”

“আমরা চিত্রপটও তৈরী করিয়ে নেব।”

“চিত্রপটের ওপর আমাদের পুরূরবার দেশের দৃশ্য অঙ্কিত করতে হবে। চিত্র অঙ্কন আমিও কিছু কিছু করি। সময় পেলে আমিও সাহায্য করতে পারব।”

“তোমার নির্দেশ মতো দৃশ্যাঙ্কন করা হবে। পাত্র-পাত্রীর বেশভূষা সম্বন্ধেও তোমাকেই নির্দেশ দিতে হবে, সৌম্য!”

“আর পাত্র-পাত্রী নির্বাচন?”

“পাত্র-পাত্রী তো এখনই ঠিক করা যাবে না, সৌম্য! তবে তাদের সংখ্যা কম রাখতে হবে।”

“কত রাখা উচিত?”

“ষোলো থেকে কুড়ি জন আমরা অনায়াসে সংগ্রহ করতে পারবে।”

“আমি ষোলো পর্যন্তই রাখার চেষ্টা করব।”

“পুরূরবা তো তুমিই সাজবে, সৌম্য! আর উর্বশী-চরিত্র আমাদের প্রভাকে দিয়ে কেমন হবে? আজ তো তুমি আর অভিনয় দেখলে।”

“আমার অনভ্যস্ত চোখে নিখুঁত মনে হয়েছে অভিনয়।”

“তা’হলে প্রভাকেই উর্বশী হতে হবে। আমাদের দলে যাকে যে কাজ দেওয়া হবে তাকে তাই করতে হয়।”

প্রভার চোখ কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু দলপতি তরুণের “কি প্রভা?” বলার পর প্রভা সংযত হয়ে জবাব দিল, “আচ্ছা।”

অশ্বঘোষ, যবন-তরুণ বুদ্ধপ্রিয়ের সঙ্গে কয়েকটি যবন নাটকের প্রাকৃত রূপান্তর পড়ল এবং তাদের কলাকৌশল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করল। যবন কলাবিদ্যাকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্যে নাটকের চিত্রপট সমূহের সে নামকরণ করল যবনিকা। সংস্কৃত, প্রাকৃত,গদ্যপদ্য দু’রকমভাবেই লিখল সে। এই সময় প্রাকৃত ও সংস্কৃতের এতটা আবেদন ছিল যে, সম্ভান্ত্র পরিবারগুলোতে তা অনায়াসবোধ্য ছিল। এই ‘উর্বশী-বিয়োগ’ হল প্রথম ভারতীয় নাটক এবং অশ্বঘোষ প্রথম ভারতীয় নাট্যকার। এটাই কবির প্রথম প্রয়াস, তবু তা পরবর্তী ‘রাষ্ট্রপাল’, ‘সারিপুত্ত’ ইত্যাদি নাটক থেকে কম সুন্দর হয়নি।

রঙ্গমঞ্চ তৈরীর সময়, অভিনয় অভ্যাসকালে খাওয়া-দাওয়ার কথাও মনে থাকত না তরুণ কবির। এই সময়গুলোই সে জীবনের সুন্দরতম সময় বলে মনে করত। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রভা আর সে পরস্পরের সঙ্গ লাভ করত। সাঁতারের প্রতিযোগিতার দিন তাদের হৃদয়ে যে প্রেমবীজ রোপিত হয়েছিল এখন তাই অঙ্কৃরিত হতে থাকল ধীরে ধীরে। যবন তরুণ-তরুণীর অশ্বঘোষকে আত্মীয়র মতোই দেখত কাজেই এ ব্যাপারে সহায়ক হওয়াই তারা সৌভাগ্য মনে করত। একদিন অশ্বঘোষ নাট্যশালার বাইরে অবস্থিত ক্ষুদ্র উদ্যানে এসে একটা আসনের ওপরে বসল। এই সময়ে প্রভাও সেখানে এসে হাজির হল। প্রভা তার স্বাভাবিক মধুর কণ্ঠে বলল, “উর্বশী-বিয়োগ’ রচনা করবার সময় তোমার মনে কি ছিল কবি?”

“উর্বশী আর পুরূরবার কাহিনী।”

“কাহিনী তো আমিও জানি, কিন্তু উর্বশীকে অপ্সরা রূপে তুমি বার-বার সম্বোধন করছিলে কেন!”

“উর্বশী যে অপ্সরাই ছিল, প্রভা!”

“তা ছাড়া তুমি উর্বশীর বিয়োগের পর নদী, সরোবর, পর্বত, বন সব জায়গাতে পুরূরবাকে বিহ্বল অণ্বেষণকারীরূপে চিত্রিত করেছ।”

“পুরূবাকে ঐ অবস্থায় ওটাই স্বাভাবিক ছিল।”

“সব শেষে ‘উর্বশী-বিয়োগ’-এর গায়ক লতাকুঞ্জে বসে অশ্রুধারাকে বীণার মতো গীতসঙ্গী করে নিয়েছিল কেন?”

“গায়ক ও অভিনেতার এমনি তন্ময়ভাবে এসে যাওয়াই স্বাভাবিক,প্রভা!”

“উহু,তুমি আমাকে সত্যি কথাটাই বলতে চাইছ না।”

“কেন? তোমান কি মনে হয়?”

“আমার মনে হয়, তুমি পুরাণের কোনো উর্বশীর গান রচনা করনি।”

“তবে?”

“তোমার উর্বশী হচ্ছে—উর-বশী (হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী), আর সেই অপ্সরা ছিল—অপ অর্থাৎ সরযূর জল, সরা অর্থে সন্তরণকারিণী।”

“তারপর?”

“তোমার উর্বশীকে পুরূরবা হিমালয়ের মতো পর্বত বা কোনো বনভূমি, নদী, সরোবর, এ সব খুঁজে ফেরেনি, তোমার পুরূরবা উর্বশীকে খুঁজে ফিরছিল সাকেতের সরষু নদীতে, পুষ্পোদ্যানের ভিতরকার সরোবর, আর লতাগুল্মের ভিতরে।”

“তারপর?”

“পুরাণোল্লিখিত কোনো পুরূরবার দুঃখে বিগলিত হয়ে তোমার চোখের জল ঝরেনি, জল ঝরেছিল তোমার নিজেরই তপ্ত হৃদয়কে শান্ত করতে।”

“এ-বারে আমিও একটা কথা বলব প্রভা?”

“বল, এতক্ষণ তো আমিই অনর্গল বকে গেলাম।”

“সেদিন লতাকুঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসবার সময় আমি তোমার এই মনোহর নীল নয়ন দুটি আমার চেয়েও আরক্ত এবং সিক্ত দেখেছিলাম।”

“তোমার গান দিয়ে আমাকে কাঁদিয়েছিলে কবি।”

“আর তোমার বিরহ দিয়ে আমাকে গীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।”

“কিন্তু কবি, তোমার গানের উর্বশী ছিল পাষাণী! অন্তত তুমি সেইভাবেই তাকে চিত্রিত করেছিল।”

“তার কারণ, আমি নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম।”

“কি ভেবে?”

“আমার মনে হয়েছিল এই অচিরপ্রভাকে (বিদ্যুৎ) আমি আর কখনও দেখবার সৌভাগ্য লাভ করব না—সে কবেই হয়ত ভুলে গেছে আমাকে।”

“তুমি এতটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলে কবি?”

“যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসের অন্য কোনো অবলম্বন না পাওয়া যায়, ততক্ষণ নিজেকে নিঃস্ব ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না প্রভা।”

“তুমি শুধু সাকেতেরই নও, এই বিস্তৃত ভূখণ্ডের মহিমান্বিত কবি। সাকেতের সন্তরণ প্রতিযোগিতায় বিজেতা বীর তুমি। তোমার বিদ্যার খ্যাতি সাকেতবাসীর মুখে মুখে। আর তোমার সম্পর্কে তরুণীদের মনোভাব বলতে গেলে বলতে হয়, সাকেতের সুন্দরীগণ তোমাকে চোখের মণি করে রাখতে চায়।”

“কিন্তু ও সবে কি হবে? আমার কাছে আমার উর্বশীই সবটুকু। সেই সন্তরণ প্রতিযোগিতার পর যখন দু’সপ্তাহ তার দখো পেলাম না, তখন আমার মনে হতে লাগল যেন এ জীবনের কোনো মূল্য নেই। সত্যি বলছি, আমার হৃদয়কে এত দুর্বল হয়ে পড়তে আর কখনও দেখিনি। আর িএক সপ্তাহ যদি তোমাকে দেখতে না পেতাম হা’হলে কি যে করে বসতাম বলতে পারি না।”

“এত স্বার্থপর হয়ো না। তুমি তোমার দেশের এক অমর কবি। দেশ তোমার কাছে কত আশা রাখে। তুমি কি জানো, তোমার এই ‘উর্বশী-বিয়োগ’ নাটকের কত খ্যাতি?”

“আমি তো কিছুই শুনিনি।”

“গত সপ্তাহে এক ব্যবসায়ী ভরূকচ্ছ (ভড়ৌচ) থেকে এখানে এসেছিল। ভরূকচ্ছে যবন নাগরিকেরা বহু সংখ্যায় বাস করে। আমরা সাকেতের যবনরা তো হিন্দু বনে গেছি, কিন্তু ভরূকচ্ছাবাসী যবনেরা আপন ভাষা বিস্মত হয়নি। যবন দেশগুলো থেকে ভরূকচ্ছতে ব্যবসায়ী এবং বিদ্বান ব্যক্তিদের আগমন হয়ে থাকে। আমার এই বন্ধুটি যবন-সাহিত্যে পণ্ডিত, সে তোমার এই নাটকের অনুলিপি পড়ে শ্রেষ্ঠ দুই যবন-নাট্যকার এমপীদোকল এবং য়ুরোপিদ্‌এর প্রতিভার সঙ্গে তোমার তুলনা করেছে। সে এই নাটকের অনুলিপি নিয়ে গেছে। ভরূকচ্ছ থেকে মিশরে অনবরতই জলপোত যাতায়াত করে। এইসব কথা যখন আমার কানে এল, তখন অসীম গর্বে আমার বুক ভরে উঠল।”

“তোমার হৃদয়ের এই গর্বটুকুই আমার জীবনসর্বস্ব,প্রভা!”

“তোমার নিজের মূল্য তুমি জানো না, কবি।”

“আমার এই মূল্যের উৎস তুমিই প্রভা! আর এখন তা আমার অজানা নেই।”

“না না, এটা উচিত নয়। প্রভার প্রেমিক অশ্বঘোষ আর মহান কবি অশ্বঘোষকে পৃথক দৃষ্টিতে দেখাই তোমার কর্তব্য। প্রভার প্রেমিক অশ্বঘোষের জন্য যা কিছু চাও কর, কিন্তু মহান কবিকে এর অনকে উর্ধ্বে উঠতে হবে, সমগ্র বিশ্বের দরবারে তার প্রতিভাকে ছড়িয়ে দিতে হবে।”

“তুমি যেমন বলবে আমি সেইভাবেই চলব প্রভা।”

“নিজেকে এত বড় সৌভাগ্যশালিনী রূপে কখনই কল্পনা করতে পারিনি।”

“কেন?”

“মনে হত, তুমি আমাকে ভুলে গিয়ে থাকবে।”

“এত সাধারণ ছিলে তুমি?”

“তোমার সামনে তাই ছিলাম, এখনও আছি।”

“তোমাকে দেখেই কবিতার এক নতুন উৎসের সন্ধান পেলাম আমি। আমার কবিতায় এখন নতুন প্রেরণা, নতুন আনন্দ। ‘উর্বশী-বিয়োগ’ গীত আর নাটক দুই-ই তোমার প্রেরণায় প্রাণবন্ত। নাটককে আমি স্বদেশের নিজস্ব বস্তুরূপে গড়ে তুলছি প্রভা! কিন্তু তুমি কেন ভাবলে যে, আমি তোমাকে ভুলে যাব?”

“কোনো দিক থেকেই আমি নিজেকে তোমার উপযুক্ত ভাবতে পারিনি। তারপর যখন তোমার গুণাবলীর পরিচয় পেলাম তখন তোমার আশা একবারেই ত্যাগ করলাম। সাকেতের সুন্দরীদের শুধু তোমার নামেই উণ্মাদ হয়ে উঠতে দেখতাম—এ থেকেও নিশ্চয়ই আশা করবার কিছু ছিল না। তা’ছাড়া শুনেছিলাম তুমি উচ্চ কুলের ব্রাহ্মণ। যদিও আমি ব্রাহ্মণকুলের পরবর্তী উচ্চকুলজাত যবন-রাজপুত্রের কন্যা, তবু যে ব্রাহ্মণকুল মাতা-পিতা থেকে সাত পুরুষ উর্ধ্ব পর্যন্ত সম্পর্কিতের খোঁজ-খবর না নিয়ে বিয়ে করে না তার কি করে আমাদের প্রেমকে স্বাগত জানাবে?”

“বড় দুঃখের বিষয় প্রভা, অশ্বঘোষ তোমায় এইভাবে ব্যথিত করে তুলেছিল।”

“তা’হলে তুমি…” প্রভা বলতে বলতে থেমে গেল।

প্রভার অশ্রুপূর্ণ নয়ন চুম্বন করে, তার কণ্ঠলগ্ণ হয়ে অশ্বঘোষ বলল, “ অশ্বঘোষ চিরদিন তোমরাই থাকবে প্রভা। তুমি আর তাকে পর ভাবতে পারবে না।”

প্রভার দুই চোখ বেয়ে টস্‌টস্‌করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল, আর অশ্বঘোষ তার কণ্ঠলগ্ন হয়ে সেই জল মুছিয়ে দিতে থাকল।

‘উর্বশী-বিয়োগ’ একাধিকবার অতি চমৎকারভাবে অভিনীত হল। সাকেতের সমস্ত সম্ভ্রান্ত নর-নারী এই নাটকের অভিনয় দেখল। এর আগে তারা কোনোদিন ভাবতেই পারেনি যে, নাট্যকলা এত পূর্ণ, অভিনয় এত উচ্চশ্র্রেণীর হতে পারে। শেষ দৃশ্যে যবনিকা পতনের পর কয়েকবারই অশ্বঘোষ মঞ্চে উঠে বলেছে, ‘আমি এই নাটকের সব কিছুই যবন রঙ্গমঞ্চ থেকে সংগ্রহ করেছি’, কিন্তু তার নাটক এতটা স্বদেশী প্রভাবাপন্ন ছিল যে, কেউই তার কোনোখানে বিদেশীয়ানার এতটুকুও গন্ধ পায়নি।

অশ্বঘোষের সংস্কৃত ও প্রাকৃত গীত এবং কবিতা সাকেত এবং কোশলের সীমা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু নাটক ছড়িয়ে পড়ল আরও অনেক দূর পর্যন্ত। উজ্জয়িনী, দশপুর, সুপ্পারক, ভরূকচ্ছ, শাকলা (শিয়ালকোট), তক্ষশিলা, পাটলিপুত্র  ইত্যাদি মহানগরীর যেখানে বহুল সংখ্যায় যবনরা বসবাস করত এবং তাদের নাট্যশালা ছিল সে সব জায়গায় অশ্বঘোষের নাটক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। রাজা-রাজড়া, ব্যবসায়ী সকলের দ্বারা সমানভাবে সমাদৃত হল সেইসব নাটক।

 

রঙ্গমঞ্চে অশ্বঘোষের অভিনয় এবং যবন কন্যার সঙ্গে তার প্রেমের ব্যাপার অশ্বঘোষের পিতা-মাতার কাছে অজানা  থাকবার কথা নয়। কথাটা শুনে অশ্বঘোষের পিতা রীতিমতো চিন্তিত হলেন এবং সুবর্ণক্ষীকেও বুঝিয়ে বললেন। মাতা যখন পুত্রকে বললেন যে, আমাদের ব্রাহ্মণকুলের পক্ষে এমন সম্বন্ধ করা অধর্ম, তখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের সমগ্র শাস্ত্রে সুপণ্ডিত অশ্বঘোষ মাতাকে পুরাণ থেকের ঋষিদের আচরণের শত শত প্রমাণ দিল (যার থেকে কিছু অংশ পরে সে নিজের ‘বজ্রচ্ছেদিকা’র লিপিবদ্ধ করেছে—যা বজ্রদিকোপনিষদ্‌নামে উপনিষদগুলির মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে রয়েছে)।

সব শুনে মা বললেন, “এ সব ঠিকই বাবা, কিন্তু আজকের ব্রাহ্মণেরা এই পুরাণোক্ত আচরণকে মানতে চায় না।”

“তা’হলে ব্রাহ্মীপদের জন্য আমি এক নতুন সদাচার উপস্থিত করব।”

মা অশ্বঘোষের যুক্তিসমূহতের সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না, কিন্তু যখন সে বলে বসল যে, প্রভার আর আমার জীবন কখনও স্বতন্ত্র হয়ে থাকতে পারে না, তখন তিনি পুত্রের পক্ষে মত দিয়ে বললেন, “তুইই আমার যথাসর্বঙ্গ বাবা।”

অশ্বঘোষ একদিন প্রভাকে মা’র কাছে পাঠিয়ে দিল। মার তার রূপ আর গুণের পরিচয় পেয়ে এবং তার বিনম্র স্বভাবে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আশীর্বাদ করলেন। কিন্তু অশ্বঘোষের পিতা একে স্বীকার করে নিতে পারছিলেন না।

তিনি একদিন অশ্বঘোষকে ডেকে বললেন, ‘পুত্র, আমাদের শ্রোত্রিয়দের শ্রেষ্ঠ হল ব্রাহ্মণকুল। পঞ্চাশ পুরুষ থেকে শুধু কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যারাই আমাদের ঘরে বধূ রূপে আসছে। আজ যদি তুমি প্রভাকে বিবাহ কর তো আমরা এবং পরবর্তী বংশধরেরা চিরকালের জন্য সমাজে জাতিভ্রষ্ট হয়ে থাকব।”

অশ্বঘোষের পক্ষে প্রভাকে ত্যাগ করা একেবারেই অচিস্ত্যনীয় ব্যাপার বুঝে অশ্বঘোষের পিতা প্রভার পিতামাতার কাছে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করলেন, কিন্তু তাঁদের কিছুই করবার ছিল না। পরিশেষে তিনি প্রভার কাছেই তাঁদ নিবেদন পেশ করলেন। প্রভা বলল,“আমি অশ্বঘোষের কাছে আপনার কথা বলব।”

প্রভা আর অশ্বঘোষ পরস্পরের অভিন্ন সাথী। কি সরযূতীর, কি পুষ্পোদ্যান, কি নৃত্যশালা-নাট্যশালা, কিম্বা অপর কোনো জায়গায় একজন থাকলে আর একজনও থাকবেই। সূর্যের প্রভার মতোই প্রভা অশ্বঘোষের হৃদয়-পদ্মকে বিকাশিত কররে রেখেছে। রূপালী চাঁদের আলোয় প্রায়ই তারা সরষূতীরে যেত। সেকানে তারা জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। এমনি এক জ্যোৎস্নালোকে একদিন সরষুর কালো জলের ধারে শ্বেত শিলাসনে বসে অশ্বঘোষ আপন আনসপটে প্রভার চিত্র অঙ্কন করছিল। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “প্রভা তুমিই আমার কবিতা, তোমারই প্রেরণা পেয়ে আমি ‘উর্বশী-বিয়োগ’ লিখেছি। তোমার রূপরাশি আমাকে বহু সুন্দর কাব্য রচানায় উদ্বদ্বু করবে। কবিতা হল অন্তরের অভিব্যক্তি, বাইরের জিনিস নয়; কিন্তু বাইরের অভিব্যক্তিই যে অন্তরে বিকাশিত হয় এ তত্ত্ব তুমিই আমাকে শিখিয়েছ।”

অশ্বঘোষের কথা শুনতে শুনতে প্রভা সেই শীতল শিলাসনের ওপর শুয়ে পড়ল। অশ্বঘোষ সযন্তে তার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল। ওপর দিকে তাকিয়ে আয়ত দৃষ্টি মেলে প্রভা অশ্বঘোষের শ্রীমণ্ডিত মুখখানা দেখতে লাগল। অশ্বঘোষের কথা শেষ হলে প্রভা বলল,“তোমার সব কথাই আমি মেনে নিতে রাজি। সাকার-সৌন্দর্য থেকে প্রেরণা না পেলে কাব্য কখনও পূর্ণ রূপে বিকাশিত হতে পারে না। আমি তোমার কাব্যের মূর্তিময় প্রকাশ, আবার আমিই বিকাশিত করছি তোমার অন্তরের কাব্যরূপকে। কিন্তু     কবিতা তো শুধু আমার সৌন্দর্যের কথা নয়। সে দিন আমি বলেছিলাম, তোমার ভিতরে দু’জন অশ্বঘোষকেই উপলিদ্ধ করতে হবে। আবার দুয়ের মধ্যে মহান যুগকবি অশ্বঘোষকেই মূখ্য হয়ে উঠতে হবে। কারণ, সে শুধু একটি ব্যক্তির নয়, সমগ্র বিশ্বজনের সে প্রতিনিধি। কালকারামের সেই বিদ্বান ভিক্ষুর কথা মনে আছে? পরশু যাঁকে’ আমরা দু’জনে দেখতে গিয়েছিলাম?”

“অদ্ভুত মেধাবী মনে হয় তাঁকে।”

“ঠিকই, আর বহু দেশও ঘুরেছেন। তাঁর জম্ম মিশরের সেকেন্দ্রিয়া নগরে।”

“তা আমি শুনেছি;  কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারি না প্রভা, যবনরা কেন বৌদ্ধধর্মকে মেনে  চলে!

“কারণ, ব্যেদ্ধধর্ম যবনদের স্বতন্ত্র প্রকৃতি এবং স্বাধীন মনোবৃত্তির অনুকূল।”

“কিন্তু বৌদ্ধধর্ম তো সকলকেই বৈরাগী, তপস্বী এবং ভিক্ষুতে পরিণত করে!”

“বৌদ্ধদের মধ্যে গৃহী অপেক্ষা ভিক্ষুর সংখ্যা অনেক কম এবং বৌদ্ধ গৃহী গার্হস্থ্য জীবরনর রসগ্রহণে কারও অপেক্ষাই পশ্চাৎপদ নয়।”

“এই দেশে আরও কত ধর্ম প্রচলিত রয়েছে, বৌদ্ধধর্মের প্রতিই যবনদের এত পক্ষপাতিত্ব কেন? এ কথাও ঠিক বুঝতে পারি না।”

“এখানে বৌদ্ধর্মই সবচেয়ে উদার। আমাদের পূর্বজগণ যখন ভারতে এল, তখন সকলেই ম্লেচ্ছ বলে তাদের ঘৃণা করত। আমি কিন্তু আক্রমণকারী যবনদের কথা বলছি না, এখানে যারা বসতি স্থাপনকল্পে  এসেছিল বা ব্যব্সার সূত্রে যাতায়াত করত, তাদের সম্বদ্ধেও এই মনোভাব ছিল। কিন্তু বৌদ্ধরা তাদের মোটেই ঘৃণা করত না। যবনেরা বস্তুত নিজ দেশেও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পৌত্র অশোকের সময় বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু যবনদের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের ধর্মরক্ষিত এ দেশে এসে ভিক্ষু হননি, মিশরের বিহারেই তিনি ভিক্ষু হয়েছিলেন।”

“আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই প্রভা।”

“নিশ্চয়ই দেখা করবে। তিনি তোমাকে আরও গভীর দার্শনিক তত্ত্ব বলতে পারবেন শুধু বৌদ্ধধর্মের সম্বন্ধেই নয়, যবন-দর্শন সম্বন্ধেও।”

“যবনদের ভিতরও দার্শনিক রয়েছেন?”

“অনেক মহান দার্শনিক আছেন, যাঁদের বিষয়ে ভদন্ত ধর্মরক্ষিত তোমাকে বলতে পারবেন।  কিন্তু বৌদ্ধ-দর্শনের কথা শুনে প্রভার প্রতি যেন তোমার বৈরাগ্য না আসে প্রিয়তম।” –এই বলে প্রভা আপনর বাহুপাশে অশ্বঘোষকে বেধেঁ ফেলল।

“কালকারামের কিচু কিছু কথা আমার কাছেও খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। ভাবছিলাম , যদি আমাদের সমগ্র দেশ কালকারামের মতো হত?”

প্রভা বলল, “না প্রিয়তম, আমাকে ছেড়ে তুমি কালকারামে চলে যেও না।”

“প্রাণ থাকতে তোমাকে ছেড়ে যবন ধর্মরক্ষিত, পারশী সুমনের দেশ-দেশান্তরের বিদ্বান ভিক্ষু বাস করেন আর আমাদের দেশের ব্রাক্ষণ থেকে চন্ডাল পর্যন্ত সমস্ত কুলের ভিক্ষুরাও বাস করেন। সবাই এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া । করেন, এক সঙ্গেই জ্ঞানার্জনে সমাবিষ্ট হন। কালকারামের সেই কৃষ্ণবর্ণ বৃদ্ধ ভিক্ষুর নাম কি প্রভা?”

“মহাস্থবির ধর্মসেন। সাকেতের সমস্ত বিহারবাসী ভিক্ষুদের প্রধান।”

“শুনেছি, চন্ডাল কুলে তাঁর জম্ম। অথচ আমার আপন কাকা ভিক্ষু শুভগুপ্ত তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁকে প্রণাম করেন। ভেবে দেখ, কোথায় এক শ্রোত্রিয় ব্রাক্ষণ কুলজাত বিদ্ধা্ন শুভগুপ্ত , আর কোথায় চন্ডালপুত্র ধর্মসেন?”

“কিন্তু মহাস্থবির ধর্মসেনও প্রগাঢ় পান্ডিত্যের অধিকারী।”

“আমি প্রাক্ষণ্যধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি, প্রভা?……….”

“বৃদ্ধ তাঁর ভিক্ষু-সঙ্গকে সমুদ্র আখ্যা দিয়েছেন , যিনিই এই সঙ্গে যোগ দেন তিনিই তাঁর নাম-রুপ ছেড়ে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যান।”

“বৌদ্ধ গৃহীরাও কেন এমনি করে না?”

“বৌদ্ধ গৃহীরা দেশের অন্যান্য গৃহী লোকদের থেকে স্বতস্ত্র হয়ে থাকতে পারে না। তা’ছাড়া তাদের ঘাড়ে পারিবারিক বোঝাও থাকে।”

“আমার তো মনে হয় কালকারামের ভিক্ষুদের মতো নগর এবং গ্রামের সমস্থ লোক ‍যদি জাতিভেদ শূন্য, বর্ণভেদ শূন্য হয় হবে খুবই ভালো।”

“একটা কথা তোমাকে আমি বলিনি প্রিয়তম। তোমার পিতা একদিন আমার সামনে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন, আপনার কথা আমি অশ্বঘোষের তুমি মুক্তি দাও।”

“যেন তুমি মুক্তি দিলেই তিনি তাঁর পুত্রকে ফিরে পাবেন! তুমি কি বললে?”

“আমি বলেছিলাম, আপনার কথা আমি অশ্বঘোষের কাছে বলব।”

“আর তাই আজ বললে তুমি। ব্রাক্ষণদের পাষশুতাকে আমি অসীম ঘৃণা করি- ঘৃণায় আমার সর্বাঙ্গ জলতে থাকে । তাঁরা বলে বেড়ায়, আমরা বেদ-শাস্ত্রকে অনুসরণ করি, কিন্তু বহু পরিশ্রম এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে সমগ্র ব্রাক্ষণ্য-বিদ্যা অধ্যয়ন করেও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না, কি তারা অনুসরণ করে।পুরাণের্ কোনো ঋষিবাক্য উদ্বৃত করলে বলবে-আজকাল এ সবের প্রচলন নেই। হয় ‍যুক্তির পথে চল, নয় তো ঋষিবাক্য অনুসরণ কর! পুরাতন বেদনীতি যদি কউ ভঙ্গ করে ,তবেই না নতুন রীতি প্রবর্তিত হয়। ভশু, কাপুরুষ , স্বার্থপররা পুষ্ট বাছুরের মাংস আর মোটা দক্ষিণা পেলেই খুশী। আশ্রয়দাতা রাজা এবং সামন্তগণ যাতে প্রসন্ন হয় সেই কাজেই এরা সদা প্রস্তুত।”

“দরিদ্র হলে কাউকেও নিজেদের ধর্মে স্থান দেয় না এরা…”

“হ্যাঁ, অন্যান্য দেশ থেকে আগত যবন, শক, আভীর ইত্যাদি জাতিসমূহকে এরা ক্ষত্রিয় বলে রাজপুত্র বলে স্বীকার করে নিয়েছে, করাণ, তাদের হাতে ক্ষমতা এবং অর্থ ছিল। তাদের কাছে থেকে এরা মোটা-মোটা দক্ষিণা পেত। কিন্তু স্বদেশের শুদ্র, চণ্ডালদের চিরতরে দাস করেই রেখেছে এরা। যে ধর্ম মানুষের হৃদয়কে উদার করে তুলতে পারে না, যে ধর্মের বিকাশ শুধু টাকার থলি বা শাসন-ক্ষমতার অপেক্ষায় পড়ে থাকে, আমি তাকে মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কলঙ্কজনক মনে করি। জগৎ পরিবর্তনশীল, ব্রাহ্মণদের প্রাচীন ধর্মগ্রস্থ থেকে আজকের গ্রন্থাবলী পর্যন্ত সমস্ত পড়ে তাদের আচার ব্যবহারেও পরিষ্কার পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি! কিন্তু এদের সঙ্গে কথা বল, দেখবে এরা সমস্ত কিছুকেই শাশ্বত সনাতন প্রতিপন্ন করতে চাইছে। একে এক ধরনের জড়তাই আখ্যা দেওয়া যায় প্রভা।”

“তোমার এই সমস্ত বিষোদগারের কারণ আমি নই তো!”

“কারণ হওয়া তো প্রশংসারই কথা প্রভা! তুমি আমার কবিতায় নতুন প্রাণ, নতুন প্রেরণার সঞ্চার করেছ। আমার অন্তদৃষ্টিতেও নতুন প্রাণ, নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করে তুমি আমার উপকার করেছ। এতদিন ভাবতাম যে, জ্ঞানের সর্বোচ্ছ শিখরে আমি আরোহণ করেছি, এই মিথ্যা দম্ভের সহজ স্বীকৃতি হল ব্রাহ্মণকুল। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, জ্ঞানসমুদ্রের পরিধি ব্রাহ্মণদের শ্রুতি আর তাদের তাল এবং ভূর্জপত্রের পুথিতেই সীমাবদ্ধ নয়, সে এ সবের চেয়ে অনেক বিশাল।”

“আমি সামান্য এক নারী মাত্র।”

“সামান্য নারী বলেই যদি কেউ তাকে নীচ বলে, তবে সে আমার ঘৃণার পাত্র।”

“যবনকুলে নারীদের সম্মান অন্যদের চেয়ে বেশী। যদি কেউ নিঃসন্তান থেকে মরেও যায় তবু এক স্ত্রী বর্তমানে সে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারে না।”

“আর এই ব্রাহ্মণেরা শত শত বিবাহ করে বেড়ায় শুধু দক্ষিণা লাভের আশায়, ছিঃ! কোনো যবন যে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে মানে না এতে আমি খুব খুশী।”

“বৌদ্ধ হলেও পূজাপাঠের জন্য আমাদের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা আসে।”

“স্বার্থরক্ষার জন্য যবনদের যখন ক্ষত্রিয় বলে অভিহিত করেছে,তখন দক্ষিণার আশায় এটুকুই বা করবে না কেন!”

“আমি কি তোমার ব্রাহ্মণত্বের অহঙ্কার ভেঙ্গে দেবার কারণ হয়ে দাঁড়ালাম?”

“তাতে মন্দ কিছু হয়নি। ব্রাহ্মণত্বের দম্ভ যদি তোমার আমার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় তো সে দম্ভ আমার কাছে ঘৃণার বস্তু।”

“তুমি আমাকে এত ভালোবাসো জেনে বড় সুখী হলাম।”

“তোমার প্রেমে বঞ্চিত থাকলে অশ্বঘোষ এক নিষ্প্রাণ জড়পিণ্ডে পরিণত হবে।”

“তা’হলে আমার প্রেমের পুরষ্কার, বরদান করতে পার তুমি?”

“ঐ প্রেমটুকু বাদে আর সব কিছু ছেড়ে দিতে পারি।”

“আমার প্রেম যদি অমর অশ্বঘোষ, মহান যুগকবি অশ্বঘোষকে এতটুকুও নীচে নামিয়ে এনে থাকে, তবে ধিক্‌আমার সে প্রেম।”

“পরিষ্কার করে বল প্রিয়!”

“প্রেমের পথে আমি বাধা সৃষ্টি করতে চাই না, কিন্তু আমি তাকে তোমার অমর প্রতিভার সহায়ক রূপে দেখতে চাই। তাই বলছিলাম আমি যদি না থাকি….”

তড়িতাহিত মতো উঠে অশ্বঘোষ প্রভাকে দৃঢ়ভাবে বুকে চেপে ধরল, তার কণ্ঠলয় হয়ে প্রভা দেখল যে, সে কাঁদছে। কিছুটা শান্ত হলে প্রভা বলল,“শোন আমার প্রেম তোমার কাছে বড় জিনিসের প্রত্যাশা রাখে, সেটা তোমাকে দিতে হবে।”

“তোমাকে অদেয় আমা কিছুই নেই প্রিয়ে।”

“কিন্তু তুমি আমার কথা শেষ করতে দাওনি….”

“তুমি যে বস্ত্রবাক্য উচ্চারণ করতে যাচ্ছিলে!”

“কিন্তু এই বজ্রবাক্য শাশ্বত অশ্বঘোষের হিতকল্পে উচ্চারণ তো করতেই হবে। আমার প্রেম চায়, মহান কবি অশ্বঘোষের আপন অমর কবি-প্রতিভার মতো প্রভার প্রেমকেও যেন অমর বলে মনে করে, তাকে যেন শুধু প্রভার রক্ত-মাংসের দেহ দিয়ে বিচার না করে। অমর অশ্বঘোষের প্রভা শাশ্বত তরুণী, শাশ্বত সুন্দরী। শুধু এইটুকুই আমি তোমাকে দিয়ে উপলদ্ধি করাতে চাই।”

“তা’হলে মূর্তিময়ী প্রভার বদলে কল্পলোকের প্রভা আমার সামনে থাকবে?”

“আমি উভয়কেই মূর্তিময়ী মনে করি, পার্থক্য শুধু  এতটুকু যে, দু’জনের মধ্যে একজন এক শ’  অথবা পঞ্চাচ বছর বেঁচে থাকবে আর অন্যজন থাকবে চিরজীবী হয়ে। তোমার প্রভা তোমার ‘উর্বশী-বিয়োগ’-এ অমর হয়ে থাকবে কিন্তু আমার প্রেমকে অমর করে রাখতে হলে তোমাকে অমর অশ্বঘোষের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। রাত অনেক হয়ে গেছে, সরষূর-জল যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, আমাদেরও ঘরে ফেরা উচিত।”

“অমর প্রভার একটি চিত্র আমি আমার মানসপটে অঙ্কিত করে নিলাম।”

“শুধু এইটুকুই আমি চাই প্রিয়তম”—এই বলে রেশমের মতো কোমল কেশপাশ অশ্বঘোষের কপোলতলে বুলিয়ে দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে  রইল প্রভা।

প্রশন্ত এক অঙ্গনের চারিদিকে বারান্দা এবং পিছনে চারতলা এক অট্টালিকা। বারান্দায় ভিজে কাপড় শুকোচ্ছে। অঙ্গনের এক কোণে একটি কুয়া এবং স্নানের ঘর। অঙ্গনের অন্যান্য স্থানে বহু রকমের গাছপালা, তার মধ্যে একটি অশ্বথ গাছ। গাছের মূলে বাঁধানো বেদী আর একটু দুর পাথরের দেওয়াল। দেওয়ালের ওপর সহস্র দীপ রাখবার স্থান। হাঁটু গেড়ে বসে এই সুন্দর বৃক্ষ বন্দনা করে প্রভা বলল, “প্রিয়, এ হচ্ছে সেই জাতে বৃক্ষ যার নীচে বসে সিদ্ধার্থ গৌতম আপন সাধনা, আপন চিন্তায় দ্বারা মনকে ভ্রান্তিমুক্ত করে বোধপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সেই থেকে এ গাছ বুদ্ধের নামে খ্যাত হয়েছে । সেই পবিত্র স্মৃতি স্মরণ করে আমি এই বৃক্ষের সামনে মাথা নত করি।”

“আপন সাধনা, আপন চিন্তায় দ্বারা সমনে ভ্রান্তিমুক্ত করে বৌধিক মার্গ অর্জনের প্রতীক! এ রকম প্রতীককে পূজা করা উচিত প্রিয়ে! এ রকম প্রতীকের পূজা আপন সাধনায় আত্ম-বিজয়েরই পূজা।”

এরপর দু’জনেই ভদন্ত ধর্মরক্ষিতের কাছে গেল। তিনি অঙ্গনের এক বকুল বৃক্ষের নীচে উপবিষ্ট ছিলেন। নবপুষ্পিত ফুলের মধুর সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছিল। বৌদ্ধ উপাসিকার ন্যায় প্রভা পঙ্কপ্রতিষ্ঠিত হয়ে (হাঁটু গেড়ে বসে, হাতের পাতা এবং কপাল মাটিতে ঠেকিয়ে) তাঁকে বন্দনা করল। অশ্বঘোষ দণ্ডায়মান অবস্থাতেই শ্রদ্ধা নিবেদন করল। তারপর দু’জনে মাটির ওপর রক্ষিত চর্মাসনে বসে পড়ল। সাধারণ শিষ্টাচারের কথাবার্তার পর অশ্বঘোষ দর্শনের কথা তুলল। ধর্মরক্ষিত বললেন, “ব্রাহ্মণকুমার, বৌদ্ধধর্মে দর্শনকেও বন্ধন এবং দৃঢ়বন্ধন (দৃষ্টিসংযোজন) বলা হয়েছে।”

“তবে কি বৌদ্ধধর্মে দর্শনের কোনো স্থান নেই, ভদন্ত?”

“বুদ্ধের ধর্মই দর্শনময়, কিন্তু বুদ্ধ একে নদী পার হবার ভেলা মনে করতেন।”

“কি বললেন, ভেলা মনে করতেন?”

“হ্যাঁ, খেয়াবিহীন নদী পার হতে হলে লোক ভেলার সাহায্যে পার হয়। কিন্তু পার হবার পর সেই ভেলা মাথায় করে নিয়ে যায় না।”

“আপন ধর্মের সপক্ষে যে পুরুষ উচ্চকণ্ঠে  এত বড় কথা বলবার স্পর্ধা রাখেন, তিনি নিশ্চয়ই সত্যের অন্তর্নিহিত শক্তিকে উপলদ্ধি করেছেন। ভদন্ত, বুদ্ধের দর্শন থেকে এমন কিছু বলুন যাতে আমরা নিজেদের চলার সঠিক পথ খুঁজে নিতে পারি।”

“অনাত্মবাদ, কুমার! ব্রাহ্মণেরা আত্মাকেই নিত্য, ধ্রুব, এবং শাশ্বত তত্ত্বকে স্বীকার করেন না। এ জন্যেই তাঁর দর্শনকে অনাত্মবাদ, অর্থাৎ অবিরাম উৎপত্তি আর বিনাশের সংঘর্ষে যে অনিত্যতা তারই দর্শন বলা হয়।”

“এই একটা বাণীই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট ভদন্ত! ধর্ম এবং অনাত্মবাদ ভেলার ন্যায়, এই বাণী প্রচার করেছেন যে বু্দ্ধ—তাঁকে শত শত অশ্বঘোষ প্রণাম জানাচ্ছে। অশ্বঘোষ যা খুঁজে মরছিল তা সে পেয়ে গেছে। আমি নিজের ভিতরে এমনই এক চিন্তালহরী অনুভব করছিলাম কিন্তু রূপ দেবার মতো ভাষা এর আগে আমি খুঁজে পাইনি। লোকে বুদ্ধের শিক্ষাকে যথাযথ পালন করলে পৃথিবীর রূপ আজ বদলে যেত।”

“ঠিকই বলছে কুমার! আমাদের যবন দেশগুলোতে মহান দার্শনিকগণ জন্মগ্রহণ করেছেন যাঁদের ভিতর পিথাগোরাস এবং হেরাক্লিটাস ছিলেন ভগবান বুদ্ধের সমসাময়িক আর সক্রেটিস, প্লেটো, দেমোক্রেটাস, আরিস্টোটল—এরাঁ জন্মগ্রহণ করেন কিছুকাল পরে। এইসব যবন দার্শনিকদের সকলেই ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি। কিন্তু একমাত্র হেরাক্লিটাস ছাড়া আর কেউেই শাশ্বতবাদ, নিত্যবাদের উর্ধ্বে উঠতে পারেননি।বর্তমান সম্বন্ধে তাদের মোহ ছিল বড় বেশী। তার কারণ , ভবিষ্যৎকে তাঁরা বর্তমানের নাগপাশে বেঁধে রাখতে চাইতনে। হেরাক্লিটাস অবশ্য বুদ্ধের মতোই, জগৎকে এক মুহূর্তের জন্যও স্থির, অঞ্চল বলে স্বীকার করতেন না, বুদ্ধের মতোই চির-চলমান বলে তিনি জগৎকে মনে করতেন—কিন্তু এর পেছনে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থ।”

“দর্শন-বিচারে ব্যক্তিগত স্বার্থ!”

“উদর নামক জিনিসটি সকলেরই আছে কুমার! হেরাক্লিটাসের সময়ে আমাদের এথেন্স নগরে গণ-শাসন ছিল, অর্থাৎ এথেন্স কোনো রাজার অধীন রাজ্য ছিল না। প্রথমে হেরাক্লিটাসদের পরিবারের মতো বড় বড় সামন্ত পরিবারেরা গণ-শাসনের কর্ণধার ছিলেন। পরে তাঁদের হটিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ী-শেঠরা শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। হেরাক্লিটাস এতে মোটেই খুশী হননি, তিনি পরিবর্তন চেয়েছিলেন সত্যি, কিন্তু এগিয়ে চলার পথে নয়, পিছনে ফিরিবার জন্যে।”

“পরিবর্তন আমাদের চাই, কিন্তু সেটা এগিয়ে যাবার জন্য, পিছিয়ে পড়ার জন্য নয়—আমার মনে হয় ভদন্ত, অতীত চিরকালই মৃত।”

“খুবই খাঁটি কথা! বুদ্ধ পরিবর্তন চাইতেন উন্নততর জগৎ প্রতিষ্ঠার জন্য। এই ভবিষ্যৎ জগতের প্রতীক হিসাবে তিনি ভিক্ষুসঙ্ঘকে সংগঠিত করেছেন। যেখানে জাতিভেদে, শ্রেণীভেদ নেই, উঁচু-নীচুর ভেদ নেই। যেখানে সকলেই সমান, যেখানে সবাইকেই সমান শ্রম করতে হবে। তুমি আমাদের মহাস্থবির ধর্মসেনকে বাইরে ঝাড়ু হাতে কাজ করতে দেখেছ?”

“ঐ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বৃদ্ধটি?”

“হ্যাঁ, উনিই আমাদের ভেতরে শ্রেষ্ঠ, আমরা প্রতিদিন পঙ্ক-প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাঁকে বন্দনা করি। সমগ্র কোশল দেশের ভিক্ষসঙ্ঘগুলির উনিই নায়ক।”

“শুনেছি, উনি না-কি চণ্ডাল কুলজাত?”

“ভিক্ষুসঙ্ঘ কুলবিচার করে না, কুমার। তারা বিচার করে গুণের। নিজ বিদ্যা এবং গুণের জোরেই আজ উনি আমাদের নায়ক, আমাদের পিতা। শুধু নিজের পেট ভরানোর মতো সামান্য ভিক্ষাও যদি তিনি লাভ করেন, তবু সঙ্গীদের ভাগ না দিয়ে কখনই তা গ্রহণ করেন না তিনি এবং এই হল বুদ্ধের শিক্ষা। পরিধেয় তিন খণ্ড কাপড়, মাটির তৈরী  এক ভিক্ষাপাত্র, একটি সূচ, জল পান করবার একটি পাত্র, একটি চিরুণী আর এক কোমর বন্ধনী—এই কয়টি জিনিস ছাড়া আমাদের আর সব কিছু সঙ্ঘের সাধারণ সম্পত্তি। আমাদের কোনো বিহারে যে জমি রয়েছে, তাও সঙ্ঘেরই। কাউকে ভিক্ষুসঙ্ঘে গ্রহণ করতে হলে সঙ্ঘ বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তা করে, কিন্তু একবার যে সঙ্ঘে প্রবিষ্ট হয়েছে, ভিক্ষুতে পরিণত হয়েছে, সে সঙ্ঘের আর সবারই সমান।”

“সারা দেশটাই যদি এমনই এক সঙ্ঘে পরিণত হত!”

“সে কি করে হবে কুমার? রাজা বা ধনীর দল কেন অন্যকে তাদের সমান হতে দেবে! ভিক্ষুরা একাবর একজন দাসকে সঙ্ঘে ঢুকিয়েছিল। সঙ্ঘে আসবার পরই সে আর দাস রইল না, হয়ে গেল সকলের সমান। কিন্তু এরপরই তার প্রভু এসে হল্লা সুরু করে দেয়। রাজা নিজে হাজার হাজার দাসের প্রভু। তিনিই বা তাঁর সম্পত্তির ওপর এ ধরনের হস্তক্ষেপ সহ্য করবেন কেন? এ সবের বিরুদ্ধে কি আর করতে পারি, কাজেই নির্দেশ দিতে হল, কোনো দাসকে আর সঙ্ঘের ভিতর নেওয়া হবে না। অসাম্যের বিশাল সমুদ্রের মাঝে আমাদের সঙ্ঘ এক ক্ষুদ্র দ্বীপমাত্র। দারিদ্র্য এবং দাসত্ব যতদিন অটুট থাকবে, ততদিন আমাদের সঙ্ঘগুলিকে নিরাপদ মনে করা চলে না।”

শরতের পূর্ণিমা। সন্ধ্যা থেকেই চাঁদের আলো পূর্ব দিগন্ত থেকে উঠে আসছে। অন্তমিত সূর্যের লাল আভা যেমন নীল দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে, চাঁদের শীতল রূপালী আলোও তেমনি নীল আকাশকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। আজকাল অশ্বঘোষ বেশীরভাগ সময়ই প্রভাদের বাড়ি থাকে। দু’জনে ছাদের ওপর বসেছিল, প্রভা বলে উঠল, “সরষুর তরঙ্গ-লহরী আমাকে ডাকছে প্রিয়তম! সেই লহরী, যা তোমাকে প্রথম আমার কাছে টেনে এনেছিল এবং প্রথম প্রেমডোরে আমরা বাঁধা পড়েছিলাম। সে দিনটি দু’বছর আগের, কিন্তু আজও মনে হয় যেন গতকালে গটনা। কত চাঁদনী-রাতই না আমরা সরযুতীরে কাটিয়েছি, কি মুধর ছিল সেইসব রাতগুলো! আজও তেমনি মধুযামিনী প্রিয়ে! চল, আমরা সরষুতীরে যাই।” দু’জনে চলতে লাগল। নদী এখান থেকে দুরে। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত বালুকারাশির ওপর দিয়ে অনেক দুর হাঁটল তারা। প্রভা তার চটি জোড়া আগেই তাহে তুলে নিয়েছে, পায়ে নীচে কোমল বালুকারাশির সুখস্পর্শ অনুভব করতে লাগল। দু’হাতে অশ্বঘোষের কটি বেষ্টন করে প্রভা বলল, “সরযু-সৈকতে এই বায়ুর স্পর্শ কি অপূর্ব, না প্রিয়তম?”

“হ্যাঁ, পায়ের নীচে বেশ চমৎকার সুড়সুড়ি দেয়!”

“এক অদ্ভুত অনুভতি না? রোমাঞ্চ লাগে যেন!”

“আমি কতবার ভেবেছি, আমরা দু’জনে পালিয়ে যাই! চলে যাই সেই দেশে যেখানে আমাদের প্রেমকে ঈর্ষা করার কেউ থাকবে না। যেখানে তুমি আমাকে প্রেরণা জোগাবে আর আমি রচনা করব সুন্দর গীত। তারপর বীণা বাজিয়ে সেই গীত এক সঙ্গে গাইব দু’জনে। এখানে এমন রাত্রে আমার বীণা তো সঙ্গে আনতে পারি না প্রভা, লোক জমে যাবে। আর তাদের মধ্যে হয়ত দেখব বহু ঈর্ষাকলষিত নয়ন!”

“মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যদি আমি না থকি…”

প্রভাকে দৃঢ়ভাবে বুকে চেপে ধরে অশ্বঘোষ বলল, “ না না প্রিয়ে, কখনেই তা হতে পারে না, আমরা এমই এক সঙ্গে চিরদিন থাকব।”

“অন্য কিছু ভেবে আমি এ কথা বলছিলাম প্রিয়তম। ধর, তুমি মারা গেলে আমি একা হয়ে গেলাম। জগতে এ রকম ঘটনা ঘটে তো নিশ্চয়ই।”

“ঘটে!”

“তোমার মৃত্যুর কথায় তো অধীর হয়ে উঠলে না তুমি! তোমার অবর্তমানে আমার ওপরেই শুধু শোকের পাহাড় ভেঙ্গে পড়বে—এই ভেবে, না?”

“তুমি নিষ্ঠুর কথা শোনাচ্ছ কেন প্রভা!”

অশ্বঘোষের অধর চুম্বন করে প্রভা বলল, “জীবনে পূর্ণিমাই শুধু নয়, জীবনে অমানিশারও আগমন হয। আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাইছিলাম, একের অবর্তমানে অপরের কর্তব্য কি। তুমি না থাকলে আমি কি করব জানো?”

মাথা নীচু করে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে অশ্বঘোষ বলল,“বল।”

“নিজের জীবনকে কিছুতেই শেষ করে দেব না আমি। ভগবান বুদ্ধ আত্মহত্যাকে পাপপূর্ণ মূর্খের কাজ বলে অভিহিত করেছেন। তুমি তো দেখেছ, ইতিমধ্যেই বীণার ওপর কতটা দখল আামার এসে গেছে।”

“অনেকখানি প্রভা! কতবার তোমার হাতে বীণা ‍তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গান গেয়েছি আমি।”

“হ্যাঁ, কোনোদিনি হয়ত নশ্বর অশ্বঘোষ বিলীন হয়ে যাবে আমার দৃষ্টি থেকে, কিন্তু আমি যুগ-যুগান্তরের অমর কবি অশ্বঘোষের আরাধানা করে চলব। তোমারই বীণায় তোমার রচিত গান গাইব। জীবনভোর গান গেয়ে ফিরব দেশে-বিদেশে, যতদিন না আমাদের যুগ্ম জীবনপ্রবাহ অন্য কোনো দেশকালে এসে সাকার-সম্মিলনের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমি না থাকলে তুমি কি করবে?”

কথাগুলো শুনে অশ্বঘোষের অন্তস্থল থেকে সুরু করে সারা দেহ কেঁপে উঠল খরখর করে, প্রভা অনুভব করল সে কম্পন। কথা বলবার চেষ্টা করল অশ্বঘোষ, কিন্তু কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে তার, চোখে জল। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ক্ষীণকণ্ঠে বলল,“জীবনে এমন দিন সত্যই বড় সাংঘাতিক, কিন্তু আমিও আত্মহত্যা করব না প্রভা। তোমার প্রেমের প্রেরণা আমার হৃদয়ে যে গানের সঞ্চার করবে, তাই আমি গেয়ে চলব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমি যে তোমারই অমর অশ্বঘোষ।”

“সরষুর-ধারা ঘুমিয়ে পড়েছে প্রিয়তম, চল আমরা এবারঘরে ফিরি।”

গ্রীষ্মকাল । মাতা সুবর্ণাক্ষী রোগে পড়লেন। অশ্বঘোষ দিনরাত মায়ের কাছে থাকে। দিনের বেলা প্রভাও থাকে। চিকিৎসায় কোনো ফল হল না, সুবর্ণাক্ষীর অবস্থা সস্কটজনক হয়ে উঠল। আর এক পূর্ণিমার রাত এসে গেল, রুপালী চাঁদের আলো ছড়িয়ে চারিদিকে। এই চাঁদের আলোতেই সুবর্ণাক্ষী ছাদের ওপর যেতে চাইলেন। তাঁর পালস্ক উঠল সেখানে। তাঁর কস্কালসার শরীর দেখে অশ্বঘোষের হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠতে লাগল। ধীরে স্পষ্ট কণ্ঠে মা বললেন, “কি সুন্দর জ্যোৎস্না!”

অশ্বঘোষের কানে প্রভার কথা বেজে উঠল,‘সিরযুর তরঙ্গ-লহরী আমাকে ডাকছে।’বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল অশ্বঘোষের । মা আবার বললেন,“প্রভা কোথায় বাবা?”

“তাদের বাড়িতে মা, সন্ধ্যা পর্যন্ত তো এখানেই ছিল।”

“প্রভা !মা আমার !ওকে তুই কখনও ভুলিস না বাবা…..” কথা হবার আগেই একটা কাশির দমকে সুবর্ণাক্ষীর দেহ নিশ্চল হয়ে গেল। সুবর্ণাক্ষী গত হলেন। সুবর্ণাক্ষী পুত্রের বুক ফেটে হাহাকার উঠল। রাত দিন সমানে কাঁদল সে।

পরদিন মধ্যাহ্ন পর্যন্ত মায়ের দাহকর্মেই কেটে গেল। তারপর প্রভার কথা মনে পড়ল। সে দত্তমিত্রের বাড়িতে গেল। প্রভার মা-বাবা ভেবেছিলেন, সে অশ্বঘোষের কাছেই গেছে। গত রাত্রের আঘাতেই অশ্বঘোষের হৃদয় জর্জরিত হয়ে উঠেছিল, এখন  সে আরও অধরি হয়ে পড়ল। অশ্বগোষ প্রভার শয়নকক্ষে ঢুকল । সব জিনিসই ঠিকমতো সাজানো রয়েছে। শয্যার ওপর থেকে সাদা চাদরটা টেনে তুলল সে, সেখানে দেখতে পেল নিজের একখানা ছবি। ছবিখানা তৈরী করিয়েছিল প্রভা এক নবাগত যবন চিত্রকরকে দিয়ে। এই ছবির জন্য অনিচ্ছসত্ত্বেও অশ্বঘোষকে বহু সময় স্থির হয়ে বসে থাকতে হয়েছিল। ছবির ওপর একটি স্নান জুঁই ফুলের মালা । ছবির নীচে প্রভার মুদ্রাস্কিত তালপত্র-লেখ রয়েছে। অশ্বঘোষ চিঠিখানা তুলে নিল। সুতো ‍দিয়ে বাঁধা ছিল সেটা। সুতোর বাঁধুনি আটুকাবার জন্য যে কালো মাটি লাগানো হয়েছিল তা তখনও ভালো করে শুকোয়নি। সুতো কেটে চিঠি খুলতেই প্রভার সুন্দর হস্তাক্ষরে লম্বা পাতার ওপর লেখা পাঁচটি পংত্তি জলজল করে উঠল-

“প্রিয়তম, প্রভা বিদায় নিয়ে যাচ্ছে, সরষুর জলরাশি আমার ডাক দিয়েছে, তাই আমি চলেছি। আমার প্রেমের প্রতিদারে তুমি একটি প্রতিজ্ঞা করেছিলে মনে আছে?প্রভার চির-তারুণ্য, শাশ্বত সৌন্দর্য আমি রেখে যাচ্ছি তোমার কাছে। পাকাচুল, ভাঙাদাঁত লোলচর্ম প্রভাকে আর তোমায় দেখতে হবে না। আমার প্রেম, আমার এই অবিনশ্বর যৌবন তোমাকে প্রেরণা জুগিয়ে চলবে। এই প্রেরণাকে তুমি হেলায় নষ্ট কর না, প্রিয়তম। এ কথা ভেব না, আমি তোমার আত্নীয়-স্বজনের তিরস্কারের ভয়ে আম্নহত্যা করছি। শুধু তোমাকে কাব্য-প্রেরণা জোগাবার জন্যেই আমি এই পথে আমার অক্ষুন্ন যৌবনকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। প্রিয়তম, প্রভা তার কল্পনায় তোমাকে শেষ আলিঙ্গন আর চুম্বন দিয়ে যাচ্ছে।”

বারে বারে চোখের জল মুছে চিঠিখানা পড়ল অশ্বঘোষ। শেষে চিঠিখানা তার হাত থেকে পড়ে গেল। খাটের ওপর বসে পড়ল সে। সব কিছুই যেন শূন্য হয়ে গেছে তার। তম্নয় হয়ে সে যেন হুদস্পন্দন স্তব্ধ হবার প্রতীক্ষা করতে লাগল। মর্মর মুতির মতো শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রিইল। বহুক্ষণ পর প্রভার বাবা-মা ঘরে এসে ঢুকলেন। অশ্বঘোষের এই অবস্থা দেখে বড়ই শস্কিত হয়ে পড়লেন তাঁরা । তারপর চিঠিখানা তুলে পাঠ করলেন। প্রভার মা তীব্র আর্তনাত করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। দত্তমিত্রের চোখ থেকে নীরব অশ্রুধারা  নেমে এল। অশ্বঘোষ তাকিয়ে রইল তেমনি স্থির শূন্য দৃষ্টি মেলে। বহুক্ষণ পর্যন্ত তাকে এই অবস্থায় দেখার পর প্রভার মা-বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে  গেলেন । সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এল, অশ্বঘোষ বসে রয়েছে সেই একই অবস্থায়। চোখের  জল শুকিয়ে গেল। তার হৃদয়ের ভিতরটাও পাথর হয়ে গেছে যেন। এইভাবে বসে থাকতে থাকতে অনেক রাতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সকলে প্রভার মা এসে দেখলেন , অশ্বঘোষ প্রকৃতিস্থ হয়ে কি যেন চিন্তা করছে বসে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছ?”

“সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছি মা। প্রভা যে কাজ আমাকে  সঁপে দিয়ে গেছে এ বারে আমি তাই সম্পন্ন করব। আমি বুঝতাম না, কিন্তু প্রভা জানত , সে আমার কর্তব্য বলে দিয়ে গেছে।–আম্নহত্যা নয় মা, প্রভা আত্নদান করে গেছে। এ কথা ঠিকই যে, এই আত্নদানকে আমি আম্নহত্যা বলে প্রচার করতে পারি, কিন্তু এত অকৃতজ্ঞ আমি হতে পারব না।”

প্রভার মা তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় যাচ্ছ বাবা?”

“ভদন্ত ধর্মরক্ষিতের সঙ্গে দেখা করতে, আর সরধুকে দেখতেও বটে।”

“ভদন্ত ধর্মরক্ষিত নীচেই বসে আছেন । আর সরধু দেখতে আমিও যাব তোমার সঙ্গে।” কথা বলতে বলতে গলা ধরে গেল তাঁর

নীচে  গিয়ে ধর্মরক্ষিতকে পস্কপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বন্দনা করে অশ্বঘোষ বলল, “ভদন্ত, এ-বারে আমাকে সঙ্গে গ্রহণ করুণ।”

“বৎস, তোমার শোক নিদারুণ।”

“শোকের তাড়নায় আমি বলছি না, প্রভা…..জম্ন্য আমাকে তৈরী করে গিয়েছে।”

“ত’হলেও তোমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, সঙ্গ এত তাড়াতাড়ি তোমাকে গ্রহণ করবে না।”

“প্রতীক্ষা আমি করব ভদন্ত, কিন্তু সঙ্গের আশ্রয়ে থেকে।”

“প্রথমে তোমার পিতার কাছ থেকে সম্মতি আনতে হব। মাতা-পিতার সম্মতি ছাড়া সঙ্গ কাউকে ভিক্ষু হিসাবে গ্রহণ করে না।”

“তা’হলে আমি অনুমতি নিয়েই আসব।”

ঘর থেকে বেরিয়ে  এল অশ্বঘোষ। প্রভার মা তার সুস্থ মস্তিকের কথাবার্তা শোনার পরও শস্কিত হয়েই ছিলেন, তাই তিনিও পিছে পিছে এলেন । নৌকা করে সরযুর জলে সারা দিন দু;জনে খোঁজার পরও কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না প্রভার
। পরের দিন আরও এগিয়ে গিয়ে খোঁজ হল, কিন্তু কোথাও কিছু নেই।

বাড়ি গিয়ে অশ্বঘোষ পিতার কাছে ভিক্ষু হওয়ার জন্য অনুমতি চাইল, কিন্তু একমাত্র পুত্রকে কি করে  তিনি অনুমতি দেবেন এ পথে যাবার জন্য ! অশ্বঘোষ বলল, “মা আর প্রভার শোকে অস্থির হয়ে আমি এ পথ করতে ‍যাচ্ছি না বাবা। নিজের  জীবনে আমি যে কর্মধারা গ্রহণ করছি, এইট তার রাস্তা । তুমি দেখছ না আমার কন্ঠস্বরে, আমার আচরণে কোথাও চিত্তবিকারের এতটুকু লক্ষণ নেই। আমি আর একটা কথাই শুধু বলব-যদি আমাকে জীবিত দেখতে চাও তবে সম্মতি দাও পিতা।”

“কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাববার সময় দাও……”

“আমি সাতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজী  পিতা ।”

পরের দিন চোখের জলে ভেসে  অশ্বঘোষকে ভিক্ষু হবার সম্মতি দিলেন তিনি।

সাকেতের আর্ষ সর্বান্তিবাদ সঙ্গ অশ্বঘোষকে ভিক্ষুরুপে গ্রহণ করল। মহাস্থবির ধর্মসেন হলেন অশ্বঘোষের উপাধ্যায় এবং ভদন্ত ধর্মরক্ষিত হলেন তার আচার্য । নৌকাযোগে ভদন্ত ধর্মরক্শিতের পাটলিপুত্র যাবার কথা ছিল , তাঁর সঙ্গে অশ্বঘোষও সাকেত ত্যাগ করল।

পাটলিপুত্রস্ত অশোকারামে (মঠ) ভিক্ষু অশ্বঘোষের দশ বছর কেটে গেল । ‘বৌদ্ধধর্ম, বৌদ্ধদর্শন এবং যবন-দর্শন সম্পকে গভীর অধ্যায়ন করল সে। মগধের মহাসঙ্গের বিদ্বান মশুলীতে অশ্বঘোষের স্থান ছিল অনেক উঁচুতে । এই সময় পশ্চিম থেকে শক সম্রাট কণিক পূর্বাষ্ণল জয় করবার জন্য পাটলিপুত্রে এসে উপস্থিত হল। পাটলিপুত্র এবং মগধ এই সময় বৌদ্ধধর্মের প্রধান কেন্দ্র ছিল্ বৌদ্ধধর্মের প্রতি কণিকের ছিল প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। গাদ্দারে নিয়ে যাবার জন্য ভিক্ষুসঙ্ঘ থেকে একজন বিদ্ধান ব্যক্তিকে চেয়ে পাঠাল কণিক। সঙ্ঘ অশ্বঘোষকে পাঠিয়ে দিল।

রাজধানী পুরুষপুর (পেশোয়ার) গিয়ে অশ্বঘোষ দেখল, সেখানে শক, যবন, তুসস্ক, পারশী তথা ভারতীয় সংস্কৃতির একত্র সমাবেশ। যবন নাট্যকলাকে অশ্বঘোষ আগেই ভারতীয় সাহিত্যে স্থান দিয়েছিল। যবন-দর্শনের গভীর অনুশীলনের পর, তার বহু বিশেষত্ব, বিশ্লেষণ-শৈলী এবং অনুকূল তত্ত্বসমূহকে নিয়ে ভারতীয় দর্শন, বিশেষ করে বৌদ্ধদর্শনকে সে সমৃদ্ধ করে তোলে। বৌদ্ধদের যবন-দর্শন গ্রহণ করবার পথও প্রশন্ত করে দেয় অশ্বঘোষ। তার পরে অপরাপর ভারতীয় দার্শনিকেরাও এই চেষ্টা করেছে এবং বৈশেষিক আর ন্যায়ের পথে সকলের আগে আগে চলেছে। পরমাণু , সামান্য দ্রব্যগুণ, অবয়বী ইত্যাদি তত্ত্ব এরা যবনদের নিকট থেকেই গ্রহণ করেছে।

অশ্বঘোষের হৃদয়কে বিশাল করে দিয়েছিল প্রভা, কাজেই তার কাছে আম্নপর ভেদ ছিল না।  প্রভার প্রেরণায় সে বহু কাব্য আর নাটক লেখে। তার অনেক কিছুই আজ লুপ্ত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও প্রকৃতি তার প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন ছিল, তাই উনিশ শত বছর পরে মধ্য এশিযার মহাবালুাকরাশি গোবী অশ্বঘোষের ‘সারিপুত্ত’প্রকরণকে (নাটক) মানুষের হাতে তুলে  দেয় [জর্মন ভারত-তাত্ত্বিক অধ্যাপক লুডার্স ১৯১১ খৃষ্টব্দে সারিপুত্ত প্রকরণ নাটকের তালপত্রে  লিখিত খন্ডিত পুতি আবিষ্কার করেন]। অশ্বঘোষের ‘বুদ্দ-চরিত্র;আর‘সৌন্দরান্দ’দুই অমর কাব্য।

প্রভার কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল তাকে যথাযথভাবেই পালন করেছিল সে এবং প্রভার অম্লান সৌন্দর্যরাশি তার কাব্যকে সুন্দরতম করে তুলেছিল। জম্মভূমি সাকেত এবং মাতা সুবর্ণাক্ষীকে কখনও সে বিষ্মত হয়নি। আপন গ্রস্থসমূহে সর্বদাই নিজের নাম লিখত ‘সাকেতবাসী আর্ষ-সুবর্নাক্ষী পুত্র অশ্বঘোষ’।

আমার ভাগ্যচক্ত যেন কেমন! কখনও এক জায়গায় স্থির থাকতে পারিনি। সংসার মরঙ্গ আমাকে সর্বদা চষ্ণল এবং বিহবল করে রেখেছে। জীবনে মধুর দিনও এসেছে যদিও তিক্ত দিনগুলোর তুলনায় সংখ্যায় কম আর পরিবর্তন তো যেন বর্ষাশেষে বাদলা দিনের মতো, বৃষ্টি আর রৌদ্রে লুকোচুরি । জানি না, এই পরিবর্তনের চক্ত কেন ঘুরছে।

পশ্চিম উত্তরাপথ গাদ্ধারে এখনও মধুপর্কে বাছুরের মাংস দেওয়া হয়। কিন্তু মধ্যদেশে (উত্তপ্রদেশ, বিহার) গোমাংসের নাম করা পাপ, এখানে গো-ব্রাক্ষণ রক্ষা করাই শ্রেষ্ট ধর্ম। আমি বুঝে উঠতে পারি না, একই ধর্মে এত বৈপরীত্য কেন! এক জায়গার অধর্ম কি অপর জায়গায় ধর্ম রুপে চলতে থাকবে; অথবা এক জায়গার পরিবর্তন আগে সাধিত হয়েছে, অন্যত্র পরে তার অনুকরণ করবে?

অবন্তীর (মালবা) এক গ্রামে ক্ষিপ্রা নদীতটে আমি জম্মগ্রহণ করেছি। আমার কুলের লোকের নিজেদের পরিব্রাজক বলে, যদিও এদের আপন ক্ষেত-খামার , ঘর-বাড়ি বয়ে গেছে এবং সেগুলো আপন স্বন্ধে বহন করে স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া চলে না । আমাদের কুলের লোকেদের দেহের গড়ন এবং রঙ ও রুপ গ্রামের অন্যান্য লোকজন থেকে কিছুটা পৃথক। আমরা অধিকতর দীর্ঘ, গৌর এবং সেই সঙ্গে আমাদের উৎকর্ষ অন্যদের কাছে ছিল অসহ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *